#বিবর্ণ_আলোকবর্ষ
#পর্বঃ১৮
#লেখিকাঃদিশা মনি
আলো আজও ভার্সিটিতে এসেছে। এসেই দেখা হয়ে গেল রুহি বনানীর সাথে। আলো মেয়েটাকে যত ইগনোর করার চেষ্টা করে মেয়েটা আরো তত পিছনে ঘোরে। রুহি বনানী আলোকে বলে,
‘শুনলাম তুমি বর্ষ স্যারের বাড়িতে থাক! কথাটা কি ঠিক?’
আলো হতবাক হয়ে যায় রুহি বনানীর কথা শুনে।
‘তুমি কিভাবে জানলে এই কথা?’
‘গোটা ভার্সিটির সবাই জানে আর আমি জানবোনা। এটা তো এখন টক অব দা টাউন হয়ে গেছে। সত্যি করে বলো তো তুমি কি বর্ষ স্যারের গার্লফ্রেন্ড?’
‘পা’গল নাকি তুমি? আমি তাও আবার ঐ রাগী লোকটার। এটা কোনদিনও সম্ভব নয়।’
‘না হলেই ভালো। তুমি শুধু আমার ভাই,,,,,’
‘কি বললে তুমি?’
‘কিছুনা। চলো ক্লাসে যাই। ক্লাসের টাইম হয়ে গেছে।’
আলো আর কিছু না ভেবে রুহি বনানীর পেছনে যেতে থাকে। কিছুটা সামনে এগিয়ে যেতেই কেউ তাকে ফোন করে।
‘আলো তুমি যাও আমার কল এসেছে আমি একটু কথা বলে নেই তারপর যাব।’
আলো নিজের মতো চলে যায়। রুহি বনানী ফোনটা রিসিভ করে। বিপরীত দিক থেকে কেউ রাগী কন্ঠে বলে,
‘মুখে লাগাম দিতে পারিস না? আজ তোর জন্য সব ফাঁস হয়ে যেত। এই জীবনে প্রথম কোন মেয়েকে আমি পছন্দ করেছি৷ আমি চাই ওর মন জয় করতে। আর তুই তো জীবনে আমার কোন উপকারই করলি না অন্তত ক্ষতি করিস না।’
‘কি বলছিস ভাইয়া। আমি আলোকে কিছু বলবো না। তুমি কবে থেকে ভার্সিটিতে আসবে?’
‘আসব মানে অলরেডি এসে গেছি তোর সামনে দেখ।’
রুহি বনানী সামনে তাকিয়ে মুচকি হাসে। রুহির ভাই রানা হোসেন দাড়িয়ে আছে। রানা তাদের ভার্সিটিতেই অনার্স ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট। গতকাল আলোর সাথে তোলা ছবি সে দেখিয়েছিল রানাকে। রানা আলোকে প্রথম দেখেই তার প্রেমে পড়ে যায়। আজ রানা অনেকদিন পর ভার্সিটিতে এলো শুধুমাত্র আলোর সাথে দেখা করার জন্য। তার উদ্দ্যেশ্য যে করেই হোক আলোকে নিজের প্রেমে ফেলা।
৩৫.
‘আপনি কেন সবাইকে বলেছেন আমি আপনাদের বাড়িতে থাকি?’
আলোর প্রশ্ন শুনে বর্ষর কোন ভাবান্তর নেই। বর্ষ নিজস্ব ভঙ্গিমায় চশমায় হাত দিয়ে বলে,
‘ভার্সিটির সবার তো এটা জানা উচিৎ যে এই ভার্সিটির নতুন স্টুডেন্ট কেমন। যে অন্যের বাড়িতে এসেছে কোন বাজে উদ্দ্যেশ্যে।’
‘আপনি কিছু না জেনে এমন কথা বলতে পারেন না। আপনি একটা,,,, আপনার মতো মানুষ যে কিভাবে সুমনা আন্টির ছেলে হলো আমি বুঝতে পারলাম না।’
কথাগুলো একনাগাড়ে বলে চলে আসে আলো। তার চোখে জমেছে বিন্দু বিন্দু অশ্রুকণা। আচমকা কেউ এসে আলোর চোখের অশ্রুকণা মুছে দিয়ে বলে,
‘ছোট ছোট বালুকণা
বিন্দু বিন্দু জল
গড়ে তোলে মহাদেশ
সাগর অতল।’
‘তোমার এই চোখের জল অমূল্য আলো। এটা অপাত্রে দান করো না।’
আলো বিস্ময়ভরা চোখে লতার দিকে তাকায়। লতা শুধু একটু মুচকি হাসে। লতা এই হাসি দিয়ে যেন তার হৃদয়ে থাকা অসীম যন্ত্রণা লুকানোর চেষ্টা করছে।
আলো নিজেকে নিজে বড্ড উদাসীন। তাই বলে,
‘জানো তো লতা আমার জীবনে ভালো কিছু আশা করা ভুল। আমার জন্মের পর আমার মায়ের মৃত্যু হয়েছে, বিয়ের পর স্বামীর অত্যা’চার সহ্য করতে হয়েছে, ডিভোর্সি হতে হয়েছে, ভালোবাসার মানুষটার কাছে ঠকে যেতে হয়েছে, সমাজের মিথ্যা অপবাদ সহ্য করতে হয়েছে। আরো অনেককিছুই,,, এতকিছুর পরেও আমার জীবন এখনো বিবর্ণ থেকে গেল। ২০ বছর ধরে বিবর্ণ আলোকবর্ষ পারি দিয়েও বিন্দুমাত্র আলোর দেখা পেলাম না। এখন তো আমার নিজের মৃত্যু কামনা করতে ইচ্ছে করে। এত কষ্ট করে বেচে থাকার চেয়ে তো মরে যাওয়াই ভালো।’
আলোর কথা শুনে লতার চোখমুখ শক্ত হয়ে যায়। লতা আলোর কথা শুনে খুব রেগে যায়।
‘তুমি নিজের মৃত্যু কামনা করো না। আমাদের মানুষের জীবন এমনই। আমরা সবাই নিজেদেরকে সবথেকে বেশি অসুখী ভাবি। কিন্তু যদি ভালো করে খেয়াল করি দেখতে পারব সবার জীবনেই কোন না কোন সমস্যা আসে। সেইসব সমস্যার কথা শুনলে হয়তো আমাদের হয়তো নিজেকে সবথেকে সুখী মানুষ মনে হবে। তুমি শুনবে আলো আমার গল্প?’
আলো মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘হ্যা শুনব।’
লতা আবার হানা দেয় নিজের বেদনাদায়ক অতীতে।
৩৬.
গোপালপুর জেলার একটি গ্রামে জন্ম হয় লতার। তার বাবা ললিত দাস এবং মা মোহনা দাস। লতার বাবা ছিল একজন সামান্য দিনমজুর। লতারা ছিল দুই বোন এক ভাই। লতার বোন খুব সুন্দরী ছিল সেখানে লতা কালো। যার কারণে লতার মা-বাবা তাকে খুব অবজ্ঞা করত। লতা ছোটবেলা থেকে দারিদ্র্য আর অবহেলায় বড় হয়েছে। একসময় লতার বড় বোনের। লতার বোনের স্বামীর চরিত্র একদম ভালো ছিল না। একদিন লতা একা বাড়িতে ছিল। লতার বোনের স্বামী সেদিন লতার একাকীত্বের সুযোগ নিয়ে লতাকে ধ’র্ষ’ণ করার চেষ্টা করে। লতার চিৎকার শুনে সেদিন গ্রামের অনেকে উপস্থিত হয়। আশ্চর্যজনক ভাবে সেদিন কেউ লতার পাশে ছিল না। লতার বোনের স্বামী ইচ্ছামতো গল্প বানিয়ে দেয় যে, লতাই তার সাথে নোংরামি করে গায়ে ঢলে পড়ে। লতা সেদিন চিৎকার করে বলে সে নির্দোষ কিন্তু কেউ তাকে বিশ্বাস করে না। লতার মা বাবাও তার পাশে ছিলনা। সেদিন সালিশে লতাকে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। লতা বাধ্য হয়ে নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে আসে এই ঢাকা শহরে। তখন থেকে লতার জীবনযুদ্ধ শুরু। প্রথম প্রথম রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে তাকে নিজের দিন অতিবাহিত করতে হয়েছে। লতা তবুও হার মারেনি। ছোটবেলায় একটু পড়াশোনা জানত। তাই অনেক কষ্ট করে টিউশনি জোগাড় করে, কোনরকমে মাথা গোজার মতো একটা ঠাঁই পায়। আজ অব্দি এভাবেই লড়াই করে যাচ্ছে লতা।
লতার জীবনের গল্প শুনে অজান্তেই আলোর চোখে জল চলে আসে। অথচ লতা হেসে হেসেই নিজের গল্পগুলো বলছিল।
‘জীবন মানেই যন্ত্রণা আলো। এত ভেবে লাভ নেই। চলো এখন যাই ক্লাসে।’
আলো লতার সাথে ক্লাসে যায়। আজও প্রথম ক্লাস বর্ষর। আলো বর্ষর দিকে একটুও তাকাচ্ছিল না শুধু নিজের খাতায় নোট করছিল। বর্ষর সহ্য হয়না এমন ব্যবহার। তাই বর্ষ বলে,
‘এই নতুন মেয়ে তুমি কি বুঝতে পারছ পড়া?’
‘হুম।’
আলোর অকপট উত্তরে বর্ষ একদম খুশি হয়না। বিড়বিড় করে বলে,
‘কিসের এত অহংকার এই মেয়েটার। বর্ষ মাহমুদের সাথে এমন ব্যবহার। আমি তো সহ্য করবো না।’
ক্লাস শেষে সবাই যে যার মতো বেড়িয়ে যায়। রুহি বনানী আলোকে এসে বলে,
‘চলো একসাথে কফি খেতে যাই।’
আলো যদিওবা রাজি ছিলনা। রুহি বনানীর জেদের কাছে হেরে যায়। লতাকে সাথে নিয়ে আসতে চাইলেও লতা কাজের কথা বলে মানা করে দেয়।
ক্যান্টিনে এসে রুহি বনানী আলোকে বসিয়ে রেখে কোথায় যেন চলে যায়। আলো বসে বসে বিরক্ত হচ্ছিল। রানা চলে এসে আলোর সামনের সিটে বসে পড়ে। আলো তাকে দেখে চমকে যায়।
‘সরি আমি এখানে বসলে কি তোমার সমস্যা হবে? আমি রানা হোসেন তোমার সিনিয়র।’
‘কোন অসুবিধা নেই।’
রানা এবং আলো একসাথে বসে কফি খায়। রানা যেচে আলোর সাথে কথা বলছিল বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। আলো ইতস্তত বোধ করলেও কিছু বলতে পারছিল।
দূরে দাঁড়িয়ে আলো আর রানাকে একসাথে দেখে রাগে ফুসছিল বর্ষ।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨