বিবর্ণ বসন্ত পর্ব-১২

0
173

#বিবর্ণ_বসন্ত
১২তম_পর্ব
~মিহি

সোহরাব টি-শার্ট থেকে অনামিকার চুল ছাড়িয়ে দিতেই অনামিকা উঠে দাঁড়ায়। সোহরাবের কেন যেন মনে হয় অনামিকার কাছে আসার উপযুক্ত সময় এখনো আসেনি। তাদের মধ্যে বোঝাপড়া এখনো হয়ে উঠেনি। অনামিকাও তো তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি। সোহরাবের রাগটা বজায় থাকলো। কপট রাগ দেখিয়েই সে বিছানা থেকে বালিশ নিয়ে মেঝেতে পাটি বিছিয়ে শুয়ে পড়লো। অনামিকা ড্যাব ড্যাব করে এ দৃশ্য দেখল। শেষমেশ কপাল চাপড়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। পড়াশোনা না করার কারণটা শুধু ঐ ফেসবুক গ্রুপের পোস্ট নয়। অনামিকাও চেয়েছিল পড়াশোনা শেষ করে একটা বড় চাকরি করার স্বপ্ন পূরণ করতে। কিন্তু এখন সোহরাবের একার কাঁধে সমস্ত সংসারের গুরু দায়িত্ব। তার উপর আবার এডমিশনের প্রিপারেশনেরও ব্যাপার আছে, বই কিনতে গেলে প্রচুর খরচ হবে। সামনে ইদ, তাছাড়া সুমি আর তন্বীর ল্যাপটপটাও কিনতে হবে। চোখ বন্ধ করতেই মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো অনামিকার। একটা ভালো পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে ফ্রিল্যান্সিং শিখতে পারে বা কোনো উদ্যোক্তা হতে পারে তো অনামিকা! এখন তো স্বনির্ভর হতে চাকরিই মুখ্য না। আর এডমিশনের জন্য প্রস্তুতি তো ফোন দেখেই নিয়ে ফেলতে পারে। যতদূর বিষয় সোহরাব এবং তার সম্পর্কের অবনতি হওয়ার আশঙ্কা, সেটা বোধহয় সম্ভব নয়। সোহরাবের আচরণ বলে দেয় সে অনামিকা ছাড়া কখনো ভালো থাকতে পারবে না। মুচকি হেসে বিছানা ছেড়ে নিচে মেঝেতে বসলো অনামিকা। সোহরাব ভ্রু কুঁচকে তাকালেও কিছু না বলে পাশ ফিরলো। অনামিকা সোহরাবের বালিশেই মাথা রাখলো।

-‘আমাকে কাল আম্মুর ওখানে রেখে আসবেন। এডমিশনের জন্য পড়তে হবে তো। এখানে মা একা সব সামলে নিতে পারবেন?’

সোহরাব চকিত হয়ে অনামিকার দিকে ঘুরলো। হঠাৎ অনামিকার দিকে ঘোরায় অনামিকার অনেকটাই কাছাকাছি চলে এলো সে। অনামিকাকে অবাক করে দিয়ে সোহরাব জড়িয়ে ধরলো তাকে। অনামিকা স্তম্ভিত হয়ে গেল। সোহরাব কিছুক্ষণ পর অনামিকাকে ছেড়ে দিল। অনামিকার কপালে ঠোঁটের আলতো স্পর্শ করলো।

-‘এতটুকু কাছে আসাআসিই যথেষ্ট এখন। পড়াশোনায় মন দাও।’

-‘হুম।’

অনামিকার লজ্জা করছে। এ লজ্জা লুকোবার জন্য সোহরাবের বুকে কি ঠাই হবে তার? সোহরাব বোধহয় অনামিকার মনের কথা বুঝলো। অনামিকাকে বুকে জড়িয়ে তার চুলে বিলি কাটতে থাকলো। অনামিকার চোখ বেয়ে ক্রমাগত জল গড়াতে থাকলো। ভালোবাসি না বলেও যে ভালোবাসা যায় তা বোধহয় অনামিকা এখন বুঝলো। বাইরে মৃদু বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে তীব্র বজ্রপাতের শব্দ। এর মাঝে সোহরাবের বুকে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকা অনামিকার চোখ জুড়ে নামে নিশ্চিন্তের ঘুম।

__________________

সকালে চোখ মেলতেই অনামিকা দেখতে পায় সোহরাব উঠে পড়েছে আগেই। ফ্রেশ হয়ে অনামিকার জন্য চা রেখে গেছে পাটির এক পাশে। চা থেকে এখনো ধোঁয়া উঠছে। অনামিকা উঠে হাতমুখ ধুয়ে এসে চা খায়। এর মধ্যেই সোহরাব আসে। সোহরাব ঘরে ঢুকে অনামিকাকে সজাগ দেখে কিছু একটা ভেবে বাথরুমের দিকে এগোয়।

-‘চা ভালো হয়েছে।’

-‘তোমার চেয়েও?’

-‘উমম…হুম। আমার চেয়েও ভালো হয়েছে।’

-‘তাহলে গিফট দাও।’

-‘কী গিফট?’

-‘এখন বললে লজ্জা পাবে। পরে চেয়ে নিব। ডাইনিংয়ে খাবার দেওয়া আছে, খেতে বসো। খেয়ে এসে গোসল করে রেডি হবা।’

সোহরাব কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো। অনামিকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে দশটা বাজে। এতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে! চা শেষ করে দ্রুত ডাইনিং টেবিলে যেতেই দেখলো সুমি আর তন্বী কলেজের জন্য বেরোচ্ছে। সাজিয়া শেখের খাওয়া শেষ হয়নি এখনো। অনামিকা গিয়ে তার পাশে বসলো।

-‘মা স্যরি। আমার উঠতে আজ অনেকটা দেরি হয়ে গেল। তোমার একা রান্না করতে হলো।’

-‘তোকে কে বললো এসব আমি রেঁধেছি?’

-‘তুমি রাঁধোনি?’

-‘তোমার বরমশাই রেঁধেছেন। অল্প অল্প করে সব খাও।’

অনামিকা টেবিলে রাখা প্লেটগুলোর দিকে তাকালো। একপ্লেটে ডিম আলুর ভর্তা, বেগুন ভাজি, অন্যদিকে মুরগীর মাংসের ঝোল আর মিষ্টির মধ্যে আবার ভাজা সেমাই। এতকিছু সোহরাব করেছে? এ ছেলে রান্নাও পারে?

-‘কী রে? তাকানো শেষ হলে খাবি তো?’

-‘অ্যাঁ? হ্যাঁ হ্যাঁ খাচ্ছি।’

অনামিকা খেয়ে দেখলো সোহরাবের রান্নার হাত দারুণ। সোহরাবের রান্নায় অন্যরকম একটা স্বাদ আছে।

-‘আমার ছেলেটা ছোটতে একদম আমার স্বভাব পেয়েছিল। কলেজে উঠার আগেই সবরকম রান্না শিখেছিল। কলেজে উঠার পর বন্ধুদের সাথে মিশে রান্নায় আর মন বসেনি। বাবার মতো গম্ভীর হতে থাকে। অথচ এ ছেলেটা আবার তোর আগমনে এখন আগের মতো হয়ে উঠেছে। আমি ভুল করিনি রে মা তোকে বেছে।’

-‘এই পরিবার পেয়ে আমি কৃতজ্ঞ মা। আল্লাহ আমাকে এমন একটা পরিবারে পাঠিয়েছেন যেখানে আমি অপূর্ণতা পাইনি কোনো কিছুর।’

-‘তাড়াতাড়ি খেয়ে রেডি হ যা। সোহরাব আবার চেঁচামেচি করবে।’

অনামিকা দ্রুত খেয়ে প্লেট ধুয়ে রেখে ঘরে ঢুকলো। সোহরাব তখন মাত্র গোসল সেরে বেরিয়েছে। এখনো শার্ট জড়ায়নি গায়ে। অনামিকা খেয়াল করলো সোহরাবের পিঠের ডানদিকে একটা লালরঙা তিল। ভ্রু কুঁচকে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকানোর পর সোহরাব মেকি কাশলো।

-‘আপনার কি আমাকে দেখা শেষ বিবিসাহেবা? তবে কি বস্ত্র পড়তে পারি?’

সোহরাবের কথায় লজ্জায় চোখ সরিয়ে নিল অনামিকা। ছেলেটা এভাবে লজ্জা দিল!

-‘রেডি হয়ে আসো তাড়াতাড়ি।’

-‘আপনি ছুটি নিয়েছেন আজ?’

-‘হুম।’

-‘রান্না ভালো হয়েছিল।’

-‘দেখালাম যে তুমি না থাকলেও একটু আধটু সামলাতে পারবো আর কী। নাহলে তো আবার সংসারের চিন্তায় পড়াশোনা লাটে তুলবা। যাও গোসলে।’

অনামিকা মাথা নেড়ে বাথরুমে ঢুকলো। সোহরাবের প্রতি ভালোবাসা যেন অনামিকা মনেও চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। আধঘণ্টার মধ্যে অনামিকা গোসল করে একটা সুতি শাড়ি পড়লো। এখানে সালোয়ার কামিজ পড়ে থাকলেও মায়ের বাড়িতে আজ একটু বউ সাজেই যেতে ইচ্ছে হলো অনামিকার। সোহরাব ঘরে ঢুকে অনামিকাকে শাড়ি পড়া দেখে খানিকটা মলিন চোখে তাকালো।

-‘ভালো লাগছে না?’

-‘বোরকা পড়তে।’

-‘শাড়ির উপর পড়বো।’

অনামিকার কথায় সোহরাবের মুখের জ্যোতি ফিরলো। অনামিকাও মুচকি হেসে উঠলো। সোহরাব অধিকার দেখাতেও শুরু করেছে, কেবলমাত্র ভালোবাসি বললো না। অবশ্য ভালোবাসি না বললে কি ভালোবাসা হয় না? হয় তো!

দই মিষ্টি নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে পা রাখলো সোহরাব। অনামিকার আসার খবর সে সকালেই পাঠিয়ে দিয়েছে। আশেপাশের প্রতিবেশীরা সোহরাব অনামিকাকে দেখতে এসেছে। সোহরাবের সাথে তারা ঠাট্টা তামাশা করছেন। অনামিকার মা অন্তরা বেগম দুজনকে ঘরে বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ করে দিলেন। ঘরে ঢুকেই সোহরাব বিছানায় বসে পড়লো। এতক্ষণ ধরে এই সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আচমকা দুষ্টুমি ভর করলো তার মাথায়।

-‘এই অনামিকা, একটা কথা বলো তো।’

-‘কী?’

-‘তোমার কোনো ভাই বোন নেই কেন?’

অনামিকা ভ্যাবাচ্যাকা খেল। এ আবার কেমন প্রশ্ন! অনামিকাকে আরেকটু বিব্রত করতে চাইল সোহরাব। অনামিকার কানের কাছে মুখ নিয়ে সে বিড়বিড় করে উঠলো,’আমরা কিন্তু কমপক্ষে চারটা বেবী নিব।’ সোহরাবের কথায় চোখ গরম করে তাকালো অনামিকা। সোহরাবকে নির্লজ্জ অসভ্য বলতে বলতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। সোহরাব ঘরে বসেই হাসতে থাকলো।

_______________________

কলেজ শেষ করে বাড়িতে এসেই ফ্রেশ হলো সুমি। সেজেগুজে অপেক্ষায় রইলো ইমাদ আসার। আজ সে সব পড়া একদম ঠোঁটস্থ করেছে। আজ কোনোভাবেই আটকানো যাবে না। ইমাদ বিকালে যথারীতি এসে বসলো। সুমি যে পড়া ঠোঁটস্থ করেছিল ইমাদ সেটা ধরলোই না বরং অন্য পড়া পড়াতে লাগল। সুমির মন মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আজ এত কষ্ট করে সে পড়েছিল অথচ ইমাদ ধরলোই না। তন্বী কিছুক্ষণ বাদে এটা সেটা প্রশ্ন করলেও সুমি সেদিকে ধ্যানই দিল না। সে আনমনে ইমাদের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। অনেকটা ঘোর লাগানো দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়েই রইল সে। খানিকক্ষণ বাদে স্কেলের বাড়ি দেওয়ার শব্দে হুশ ফিরলো তার। ইমাদ টেবিলে স্কেল দিয়ে বাড়ি দিয়ে সুমির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে।

-‘কোন ধ্যানে ছিলে ওয়ামিয়া?’

-‘স …স্যরি স্যার।’

-‘আমি সত্যিই বিরক্ত ওয়ামিয়া। সোহরাব বলেছিল তুমি স্টুডেন্ট হিসেবে ব্রিলিয়ান্ট। অথচ এখন দেখছি এই অবস্থা। আচ্ছা তোমার সমস্যা কী? আমি সমস্যা? আমার মনে হচ্ছে তোমার অন্য টিচার দেখা উচিত। তুমি আমার সাথে কথা বলতেই এতটা জড়তা দেখাও তাহলে আমি কিভাবে পড়াবো? আমি সোহরাব ভাইয়ের সাথে কথা বলে ভালো টিচারের ব্যবস্থা করে দিব। তন্বী, অনামিকা ভাবী বাসায় নাই?’

-‘না ভাইয়া।’

-‘আচ্ছা তাহলে আমি আসি। ফোনে কথা বলে নেব সোহরাব ভাইয়ের সাথে।’

ইমাদ উঠে হনহন করে চলে যেতেই রাগী দৃষ্টিতে সুমির দিকে তাকালো তন্বী। সুমির চোখ ছলছল করছে।

-‘কেন এমন করিস সুমি? ভাইয়া তো কত ভালো পড়ায়। তুই কেন মনোযোগ দিস না? ধ্যাত!’

তন্বীও বইখাতা নিয়ে উঠে চলে যায়। সুমির এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে বইখাতা সব পুড়িয়ে ফেলতে। রাগে মাথায় দপদপ করে আগুন জ্বলছে। এতটা অপমানিত সে কি কখনো হয়েছিল? তন্বী চলে যেতেই দরজাটা খট করে লাগিয়ে দিল সুমি। এ ঘরের এক ড্রয়ারে ব্লেড রাখা আছে। সুমির দুর্বল মনটা যেন আজ মৃত্যুর জন্য প্রত্যয়ী হয়ে উঠেছে। ইমাদের থেকে এতটা অপমান সে মেনে নিতে পারছে না। সুমি উঠে গিয়ে ড্রয়ার থেকে ব্লেডটা বের করলো। ব্লেডের প্যাকেট খোলা হয়নি এখনো। স্বভাবতই ধারালো সেটা। সুমি ব্লেডটা হাতে নিয়ে শিরার উপর টান দিল। ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল। সুমি চোখ খোলা রাখার চেষ্টা করলো। অদ্ভুতভাবে কোনো এক সম্মোহনী শক্তি জোরপূর্বক সুমির চোখ বুঁজে দিতে চাইল। রক্তাক্ত হাত নিয়ে সুমি মেঝেতে বসে ক্ষীণ কণ্ঠে আর্তনাদ করতে লাগলো। মৃত্যু এতটা যন্ত্রণাময়? আগে তো বোঝেনি সুমি। মৃত্যু কোথায়? খুব কি সন্নিকটে? যতটা দূরত্ব তার আর ইমাদের মধ্যে ততটাই সন্নিকটে কি মৃত্যু?

চলবে…