বিবর্ণ বসন্ত পর্ব-১৬

0
172

#বিবর্ণ_বসন্ত
১৬তম_পর্ব
~মিহি

অনামিকার ঢাবিতে হয়নি, হওয়ার কথাও না। কিন্তু পাশমার্কই উঠেনি। মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত আত্মবিশ্বাস যেন ভেঙেচুরে গেছে। রূপার মৃত্যুর পর থেকে এমনিতেও সে অবসাদগ্রস্ত ছিল, রেজাল্ট দেখে একদম ভেঙে পড়েছে। সারাদিন ধরে সোহরাবের কল ধরেনি। খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে নিজেকে ঘরবন্দি করে ফেলেছে সে। অনামিকার মা কী করবেন ভেবে উঠতে পারছেন না। সকাল থেকে মেয়েটা না খাওয়া, এখন সন্ধ্যে হতে চললো অথচ ঘরের দরজাই খুলছে না সে। এরই মধ্যে অন্তরার ফোনে কল আসলো পলাশের মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ওনাদের কাজের মেয়েটা কল করেছে। পলাশ বাড়িতে থাকে না, তার মা একাই থাকে। অন্তরা এখন পড়লেন মহাসংকটে। একবার পলাশের মায়েয কাছে যেতে না পারলেই নয়। চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি। এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো। অন্তরা চিন্তিত মুখে দরজা খুলেই সোহরাবকে দেখতে পেলেন। চিন্তা কমলো তার।

-‘আসসালামু আলাইকুম।’

-‘ওয়ালাইকুম সালাম। ভেতরে এসো বাবা। দেখো তো মেয়েটা কী শুরু করেছে। ওদিকে পাশের বাসার ভাবী অসুস্থ, একা মানুষ। একটু না দেখলে হয়? তুমি বসো, আমি অনামিকাকে ডাকছি।’

-‘না মা, আপনি যান। আমি নিজেই ডেকে নিচ্ছি।’

-‘বেশ।’

অন্তরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তিনি যেতেই সোহরাব দরজা লাগিয়ে অনামিকার ঘরের দিকে পা বাড়ালো। পরপর বেশ কয়েকবার শব্দ করার পরও অনামিকা দরজা খুললো না। শেষমেশ বাধ্য হয়ে সোহরাব অনামিকাকে ডাকল।

-‘অনামিকা, এবার দরজা না খুললে আমি চলে যাবো।’

কথায় কাজ হলো। চটজলদি দরজাটা খুলে গেল। অনামিকার চোখজোড়া বেশ লাল। সোহরাব বুঝতে পারলো না কী বলে সান্ত্বনা দেবে।

-‘ঢাবি কি তোমার বর? এমন বিধবার মতো কাঁদতেছো কেন? আরো ভার্সিটি আছে তো!’

সোহরাবের কথাটা বলতে দেরি, অনামিকার তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেরি নেই। সোহরাব খানিকটা বিস্মিত হলো। হঠাৎ অনামিকার এ দুর্বল সত্তাটা প্রকাশ্যে আসা সোহরাবের নিকট বিস্ময়ের। সোহরাব ঘামছে। অনামিকার শরীর থেকে একটা ঘ্রাণ পাচ্ছে। এটা কি শ্যাম্পুর ঘ্রাণ? সশব্দে বাইরে বিদ্যুৎ চমকালো। অনামিকার বাঁধন আরো দৃঢ় হলো। সোহরাব বোকার মতো কেবল অনুভব করে গেল। অনামিকার কাছে আসা তার ভালো লাগছে। অথচ কত দ্বিধা সংকোচ নিয়ে সে অনামিকার খুব কাছে যাওয়া থেকে নিজেকে সংযত রেখেছিল। আবারো বিদ্যুৎ চমকালো। বজ্রপাতের তীব্র শব্দে সোহরাবের মনের ভেতরেও ঝড় উঠলো। অনামিকাকে শক্ত হাতে আলিঙ্গন করলো সেও। ভয়ানক ঝড় হলো সে রাতে। অন্তরা আর রাতে বাড়ি ফিরতে পারেনি। অবশ্য এ বোধহয় সৃষ্টিকর্তার এক ইচ্ছে। অনামিকার দুর্বল মনটাতে মলমের প্রলেপ লাগাতেই আগমন ঘটেছিল সোহরাবের।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অনামিকা। ভেজা চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে মেঝেতে। আজ তাকে অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে। মুখভর্তি অন্যরকম ঔজ্জ্বল্য। সোহরাব এখনো ঘুমিয়ে। আজ শুক্রবার। অফিসের ঝামেলা নেই। আয়নাবিলাস রেখে অনামিকা নাস্তা বানাতে গেল। রাতেও কিছু খায়নি সোহরাব। চটজলদি নাস্তা বানিয়ে সোহরাবকে ডাকতে এসে অবাক হলো অনামিকা। এতটুকু সময়ে সোহরাব গোসল সেরে রেডি হয়েছে। এখনি কি বাড়িতে চলে যাবে নাকি?

-‘এখনি রেডি হলেন যে?’

-‘বাড়িতে কাজ আছে একটু।’

-‘ভালো! যান।’

অনামিকার অভিমানগুলো ইদানিং ভালোই বোঝে সোহরাব। আলতো করে অনামিকার হাত ধরে তাকে নিজের খানিকটা কাছে আনলো।

-‘ঐ বাড়িটা তোমায় ছাড়া এমনিতেই ফাঁকা। এখন আমিও এখানে থাকলে মা সামলাবে কী করে?’

-‘আমিও যাই তাহলে?’

-‘একদম না। দুই সপ্তাহ পর পরীক্ষা আর উনি এখন যাবেন। নেক্সটটা ভালোমতো দাও।’

অনামিকার মন আবারো খারাপ হয়ে গেল। মাকে সেও খুব মিস করছে। কতদিন হয়ে গেল সংসার ফেলে এসব আজগুবি বইখাতায় মুখ গুঁজে আছে! সোহরাব নাস্তাটুকু করেই বিদায় নিলো। অনামিকা উদাসী দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। মানুষটাকে এতটাই জায়গা দিয়ে ফেলেছে হৃদমাঝারে যে তাকে ছাড়া সবটাই শূন্য লাগে।

____________________________

রাহেলা বানুর হাবভাব তন্বীর মোটেও সুবিধের লাগছে না। আজ তন্বীকে সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য আটঘাট বেঁধেছেন তিনি। তন্বী নাও করতে পারছে না। বাড়িতে অনামিকা নেই, সুমির অবস্থা আগের চেয়ে ভালো হলেও পুরোপুরি স্বাভাবিক নয়। এখন তন্বীর উচিত না তাদের ঘাড়ে বসে থাকা। সাজিয়া এমনিতেও তাকে কোনো কাজে হাত লাগাতে দেন না। শেষমেশ বাধ্য হয়েই তন্বী রাহেলা বানুর সাথে নিজ বাড়িতে ফেরার প্রস্তুতি নিল। রাহেলার মুখে অন্যরকম একটা আনন্দের ঝিলিক তা দৃষ্টির অগোচর হয়নি তন্বীর। তার মনটাও কু-ডাকছে। না জানি কোন বিপদ ঘাড়ে ঝোলার জন্য অপেক্ষা করছে। বাড়িতে ঢোকার মুখেই নাদিমকে দেখলো বাড়ির রাস্তায়। নাদিম অনেকটা শুকিয়ে গেছে, চোখমুখে দুশ্চিন্তার হাবভাব স্পষ্ট। চোরের মতো দৃষ্টিতে বারবার তন্বীর দিকে তাকালেও তন্বী দৃষ্টি নামিয়ে নিল। রাহেলা তন্বীর হাত ধরে দ্রুত বাড়ির ভেতর টেনে আনলেন তাকে। তন্বীর মনটা তবুও নাদিমের জন্য হাহুতাশ করছে। নাদিম কি তবে তন্বীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল? তন্বীকে সত্যিই ভালোবেসে কষ্ট পাচ্ছিল সে? প্রশ্নগুলো নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবার অবকাশ পেল না তন্বী। রাহেলা বানু দ্রুত পায়ে একটা রঙিন শাড়ি তন্বীর সম্মুখে রাখলেন।

-‘গোসল করে এটা পড়ে নে।’

-‘মানে? কেন পড়বো শাড়ি?’

-‘যা বলছি তাই কর। বেশি কথা বললে থাপ্পড় দিয়ে সবকটা দাঁত ফেলে দিব।’

তন্বী চুপ হয়ে গেল। রাহেলা বানুর রাগ সম্পর্কে সে অবগত। রাগ হলে যে তিনি কতটা পাশবিক হতে পারেন সে সম্পর্কেও তন্বীর ধারণা আছে। তাই জেদ না করে চুপচাপ গোসল করতে গেল।

অভিজাত পোশাকে এক দম্পতি এবং তাদের ছাব্বিশ বছর বয়সী ছেলের আগমন ঘটলো রাহেলা বানুর বাড়িতে। নাদিম দূর থেকে চেয়ে দেখলো। আপন মানুষ হারানোর যন্ত্রণাটা যেন খুব করে বুঝতে পারছে সে। দূর থেকে ছেলেটাকে কিছুটা চেনা চেনা লাগলেও ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারলো না নাদিম। একরাশ হতাশা নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো।

তন্বী স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল আজ তাকে দেখতে আসবে কিন্তু আজকেই আকদ হবে তা ভাবেনি। ছেলের নাম অভ্র। পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার বিশাল ব্যবসা সামলাচ্ছে। ছেলে দেখতে শুনতেও বেশ, পরিবারও ভালো তবুও তন্বীর মন টানছে নাদিমের জন্য। অভ্র নিতান্তই ভদ্র তা সহজেই বোঝা যাচ্ছে কিন্তু তন্বী তো নিজের মনে তাকে ঠাই দিতে পারবে না। ছেলে মেয়ে আলাদা কথা বলানোর প্রস্তাব রাখলেন অভ্রের বাবা। অভ্রের মা তাতে বিশেষ খুশি হলেন বলে মনে হলো না। তন্বীর মাও আলাদা কথা বলার বিপক্ষেই খানিকটা বাক্যব্যয় করলেন। তাতে অভ্রের মায়ের মুখে হাসি ফুটলো। তন্বী ভয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। নাদিমের থেকে এতদিন দূরে ছিল কিন্তু নাদিমকে হারিয়ে ফেলার ভয় কাজ করেনি। এখন কাজ করছে ভয়টা। অচিরেই নাদিম নামটা মুচে যেতে চলেছে তার জীবন থেকে।

অভ্র আকদের জন্য নিষেধ করলো। প্রথম দেখাতেই আকদ বিষয়টা খুব অদ্ভুত লাগে। আগে দুজনের জানাশোনা হোক এমন নানান কথায় আকদ টলালো সে। তন্বী মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ দিল তাকে। অভ্রের মা বিরক্ত হলেও কিছু বললেন না। বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লো তারা। অভ্র তন্বীর নম্বর চাইলে রাহেলা নিজের নম্বরটা দিলেন। মেয়ে জামাই মেয়ের সাথে কথা বলবে এটাই তো স্বাভাবিক। তন্বীকে ফোন দেওয়ার ঝুঁকি তো তিনি নিবেন না, তাই নিজের নম্বরটাই দিলেন। তন্বীর মন তখনো কু-ডাকছে। আশেপাশের সবকিছু অসহ্য ঠেকছে তার নিকট। বারবার মনে হচ্ছে বড়সড় কোন ঘটনা ঘটতে চলেছে তার জীবনে, যে ঘটনা তার জীবনের মোড় পুরোপুরি ঘুরিয়ে দিতে চলেছে। তন্বীর অচেতন মনের ধারণাটা বোধহয় ঠিক হওয়ার ছিল। সত্যিই এক ঝড় তার জীবনের মোড় পুরোপুরি ঘোরানোর প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে।

চলবে…