#বিবাহিতার সাতকাহন
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১৬
দরজার বাইরে কেউ নেই অথচ একটা বড়ো বক্স পড়ে আছে। এর উপরে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা মুমু তোমার জন্য। আমি বুঝতেছিলাম না কাজটা কার। তবে আন্দাজ করতে পারছিলাম কাজটা পিয়াসের হবে। আমি বক্সটা নিয়ে রুমে আসলাম। তারপর বক্সটা খুলে বিস্ময় যেন বেড়ে গেল। পিয়াস পাঠিয়েছে এটা আন্দাজ করতে পারলেও আজকে যে আমার জন্মদিন সেটা সে জানবে কল্পনাতেও কল্পনা করতে পারিনি। কারণ আমার জন্মদিন আমি নিজেই বেমালুম ভুলে গেছি। আমার জন্য একটা ট্যাডি, কেক আর চকলেট পাঠিয়েছে। কেকের সাইজটা খুব বড়ো না তবে দেখতে কিউট। গিফট গুলো পেয়ে আমি চট করে পিয়াসকে কল না দিয়ে নুহাশকে দিলাম তাকে বলার জন্য যে আমার জন্মদিন সে জানে কিনা। নুহাশকে দুবার কল দেওয়ার পর সে রিসিভ করল। আমি সে কিছু বলার আগেই ঠাস ঠাস বলে উঠলাম
“নুহাশ তুমি কী জানো না আজকে আমার জন্মদিন? বিয়ের পর আমার প্রথম জন্মদিন আমাকে উইশ করবে না?”
নুহাশের কোনো হেলদুল জাগল না। চুপ গলায় কিছুক্ষণ থেকে বলল
“মুমু তুমি তো বাচ্চা না। এগুলো নিয়ে বাচ্চারা পড়ে থাকে। কাজের মধ্যে শুধু শুধু এত বিরক্ত করো তুমি। কেন যে বুঝি না। যাইহোক হ্যাপি বার্থ ডে। এবার ফোন রাখো।”
আমি কথা না বাড়িয়ে ফোন রেখে দিলাম। বুকটা ভীষণ ভার লাগছে নুহাশের কথা ভেবে। যে মানুষটাকে আমি প্রিয় মানুষ ভেবে পাগলামি করি সে মানুষটার কাছে আমার কোনো মূল্য নেই। আমি দম ধরে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর পিয়াসের দেওয়া চকলেট আর ট্যাডিটা আলমিরার এক কোণে রেখে দিলাম। মানুষ ভীষণ অদ্ভুত কিছু মানুষ আছে যাদের কাছে আপনি কিছু আশা করবেন না তবুও তারা আপনার জন্য সর্বস্ব দিয়ে দিবে। আর কিছু মানুষ আছে যাদেরকে আপনি কলিজা বেটে খাওয়ালেও বলবে বাটাটা মিহি হয়নি। দুনিয়ায় সবচেয়ে অদ্ভূত প্রাণীই হলো মানুষ।
কেকটা বেশ ছোটো। একজন খাওয়ার মতো। আমি নিজেই কেক কেটে নিজেকে উইশ করলাম। তারপর পিয়াসকে ধন্যবাদ লিখে মেসেজ পাঠালাম। মনকে স্বান্তণা দিলাম কেউ তো আমার জন্য এক টুকরো সুখ খুঁজে এনেছে। এটাই বা কম কিসের!
সারাদিন পিয়াস আর আসে নি। আমিও আমার মতো রান্না করে নিলাম। খাওয়ার সময় খেয়ে নিলাম। নুহাশকে কল দিয়ে আর বিরক্ত করিনি। সত্যি বলতে যে যেভাবে থাকতে চায় তাকে সেভাবে থাকতে দেওয়া উচিত। জোর জবরদস্তি করে কারও ভালোবাসা, মূল্য আদায় করা যায় না। মোবাইলটা হাতে নিয়ে পিয়াসকে মেসেজ দিয়ে আবারও ধন্যবাদ জানালাম। পিয়াস প্রত্তুত্বরে শুভকামনা জানাল।
সারাদিন পার হয়ে গেল। নুহাশ এলো সন্ধ্যা বেলায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম খাবে কিনা। সে উত্তর দিল বাইরে থেকে সে খেয়ে এসেছে এখন খাবে না। আমি আর কথা বাড়ালাম না।
দিন যাচ্ছে সময় সময়ের গতিতে বহমান। আমার দিনকে দিন নুহাশের প্রতি সকল আশা ভরসা কমতে লাগল। আগের মতো নুহাশকে আর পেতে মন চায় না। পিয়াসের পাগলামিও দিন দিন বাড়ছে। বুঝতে পারছিলাম পিয়াস কোনোভাবে আমার প্রতি দুর্বল হচ্ছে যা অনুচিত। পিয়াসের পাগলামিতে আর সায় দেওয়া উচিত হবে না। দিনকে দিন পিয়াসের সাথে কথা বলা কমিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু পিয়াসের পাগলামিগুলো যেন সব তছনছ করে দিচ্ছে। বাধা দিয়েও যেন কোনো লাভ হচ্ছে না। বিষয়টা নুহাশের সাথে শেয়ারও করতে পারছি না আবার মনে গেথে রাখতেও কষ্ট হচ্ছে। নুহাশের সাথে শেয়ার করলে সে সেটা স্বাভাবিক দৃষ্টিতে নাও নিতে পারে। তাই বেশ এলোমেলো পরিস্থিতির সম্মুখীন হলাম।
বেলা বাজে ৪ টা। সূর্যটা হেলে পড়েছে। আজকে শ্বাশুড়ি মা আসবেন বাসায়। দু মাস হলো নুহাশের ছুটি না থাকায় আমরা যেতে পারিনি তাই তিনিই আসবেন আমাদের দেখতে৷ রওনা দিয়েছেন অনেক আগে হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবেন। ভাবনার মধ্যেই কলিং বেলের আওয়াজ। আমি দৌঁড়ে উঠে গেলাম দরজা খুলতে। এপাশ থেকে কে বলতেই শ্বাশুড়ি মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। দরজা খুলতেই তিনি গজগজ করে বলে উঠলেন
” সারাদিন তো শুয়ে বসেই থাকো তারপরও দরজা খুলতে এত দেরি হলো কেন? আর নুহাশ কোথায়?”
“মা নুহাশ ডিউটিতে। বাবা তো আসার কথা ছিল উনাকে তো দেখছি না৷ উনি কোথায়?”
“উনি বাসার নীচে হাঁটছে। যাইহোক যা আছে তাই দাও। খেয়ে একটু রেস্ট নিব৷ আর তোমার বাবার জন্য গরম পানি বসাও এসেই গোসল করবে।”
“আচ্ছা মা”
কথোপকথনের শেষে আমি সরাসরি চলে গেলাম রান্না ঘরে। তারপর খাবার তৈরী করে টেবিলে দিলাম। মা খেতে বসলেন। লোকমা মুখে দিয়েই বিরক্ত গলায় বললেন
“না হয়েছে লবণে না হয়েছে মরিচে। বাপের বাড়ি থেকে কিছুই শিখায়নি। এসব ছাই পাসেই আমার ছেলেকে খাওয়াচ্ছ।”
আমি হেসে জবাব দিলাম
“মা আপনি সত্যিই বলেছেন। বাপের বাড়িতে আমাকে কেউ কাজ করতে দেয়নি। সত্যি বলতে আদরে বড়ো হয়েছি তো তাই। আর নুহাশের মতো বড়ো অফিসারের কাছে বিয়ে দিয়েছিল কাজ যেন করে না খেতে হয় সেজন্য। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস দেখুন কত ভিন্ন। সেটা তো আর আমার পরিবার বুঝতে পারে নি।”
আমার হাসি মুখের কড়া জবাব শুনে মা একদম চুপসে গেলেন। এর মধ্যেই বাবা হাজির হলেন৷ বাবাকে গরম পানি দিলাম গোসল করতে। বাবা গোসল করে খাবার টেবিলে বসলেন। আমি খাবার দিলাম। বাবা খেয়ে বেশ স্বাভাবিক গলায় বললেন
“রান্না তো বেশ মজা হয়েছে।”
বাবার কথা শুনে খুশি মনেই উত্তর দিলাম
“আলহামদুলিল্লাহ। ”
এরপর লক্ষ্য করলাম মা পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি এবার আরেকটু হেসে বললাম
“বাবা মাকে একটু ডাক্তার দেখিয়েন।”
বাবা বিচলিত কণ্ঠে জবাব দিলেন
“কেন তোমার শ্বাশুড়ি মায়ের আবার কী হয়েছে?”
“তেমন কিছু না বাবা, এই যে উনার মুখে রুচি কমে গেছে। তাই একই তরকারি আপনার কাছে মজা লাগলেও উনার কাছে মনে হচ্ছে লবণ মরিচ দেইনি। উনার মুখটা মনে হয় পানসে হয়ে গেছে।”
আমার এমন উত্তরে বাবা ইতস্তত হচ্ছেন। কারণ নারীদের কুটিলতা ধরার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা পুরুষদের একটু কমেই দিয়েছেন। তাই নারীদের তুলনায় পুরুষরা একটু সরল হয়। তবে যে পুরুষ যত কুটিল তার মধ্যে নারী সুলভ আচরণ ততবেশি বিদ্যমান।
খাবার পর্ব শেষ। আমি উনাদের রুম দেখিয়ে দিলাম থাকার জন্য। উনারা রেস্ট নিতে রুমে প্রবেশ করলেন। আমি এদিকে সকল কাজ শেষ করলাম। প্রায় সন্ধ্যা গড়িয়ে আসছে। একটু ছাদে যাওয়ার জন্য মনটা আনচান করছে। তাই সব গুছিয়ে ছাদে ছুট লাগালাম। আকাশটা দেখতে ভীষণ ভালো লাগে। আর এ ভালো লাগা বেড়ে যায় যখন আকাশে রক্তিম আভা বিরাজ করে। বলা চলে সূর্য উদয় এবং সূর্যাস্তের সময়টায় আকাশ টা নতুন রুপে সাজে। নতুন উদ্যমে প্রস্ফুটিত হয়।
পাশে কারও উপস্থিতি টের পেলাম। পার ফিরে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম পিয়াস দাঁড়িয়ে আছে। পিয়াসকে ইদানিং ভীষণ এড়িয়ে চলি আমি। কারণ আমার প্রতি তার দুর্বলতা আমাদের দুজনকেই একদিন গ্রাস করে নিবে। তাই তাকে না দেখার ভান করে আসতে নিলাম। পিয়াস পিছু ডাকল। আমি তবুও পিছু ফিরলাম না। তবে একটা বিকট শব্দ আমাকে পেছন ফিরতে বাধ্য করল। আমি পেছন ফিরে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। হাত পা ক্রমশ ঠান্ডা হতে লাগল।
#বিবাহিতার সাতকাহন
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১৭
পিয়াস ছাদে নেই। আমি দৌঁড়ে ছাদের কার্ণিশে গিয়ে লক্ষ্য করলাম পিয়াস ছাদ থেকে লাফ দিয়েছে। আট তলা ছাদ থেকে লাফ দিলে কেউ বেঁচে থাকার কথা না। আমার বুকটা ধুক করে উঠল। এমন কিছু আমি কখনই আশা করিনি। জোরে একটা চিৎকার দিয়ে নীচে গেলাম। লিফট আসতে দেরি হচ্ছে তাই সিঁড়ি দিয়েই নামতে শুরু করলাম।
নীচে নেমে লক্ষ্য করলাম পিয়াসকে ঘিরে লোকের সমাগম। ইতোমধ্যে পিয়াসের পরিবারও চলে এসেছে। আমি চুপ হয়ে তাকিয়ে আছি। তার রক্তাক্ত মুখটা আমাকে দেখে যেন উপহাস করে বলছে আমি চলে গেলাম তুমি সুখে থেকো। আমি তো বোবার মতো দাঁড়িয়ে আছি। দ্রূত এম্বুলেন্সে করে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলো।
কিছুক্ষণ দম ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। লোক সমাগম কমতে লাগল। আশপাশের ভীড় কমে যাওয়ায় সে জায়গা থেকে প্রত্যাবর্তন করে বাসায় আসলাম। রুমে এসে খাটে হেলান দিয়ে বসলাম। বারবার মনে হচ্ছে পিয়াসকে আমি প্রথম থেকে পাত্তা না দিলে বিষয়টা এতদূর এগুতো না। আমি সরল মনে ওকে ছোটো ভাই, বন্ধুর মতোই দেখে এসেছি। ও যে সেটা ভিন্ন গল্পে রুপান্তর করবে কে জানত। যত পাগলামিই সে করুক নুহাশকে ছাড়ার কথা আমি ভাবতেও পারি না। পিয়াসের প্রতি এতদিনে আমার দুর্বলতা তৈরী হয়েছে ঠিকেই তবে সেটা কেবল নিজের মধ্যেই রেখেছি। নুহাশের সকল অবহেলার পূর্ণতা আমি পিয়াসের মাঝে পেতাম। আমি চাইলেই নিজের দুর্বলতাকে সায় দিয়ে পিয়াসের সাথে পরকিয়ায় জড়াতে পারতাম, যেটা সচরাচর হয়ে থাকে। তবে আমি তো তা করতে পারিনি। পিয়াসের জন্য বুকটা ফেটে যাচ্ছে। আমি কখনও ওর এমন পরিণতি চাইনি। ওর ভালোই চেয়েছি। চেয়েছি ও বড়ো হোক। কখনও চায়নি আমার মতো মেয়ের মোহে পড়ে ও ঝরে পড়ুক। নুহাশকে সবটা বলার সাহস ও পাচ্ছি না। আজকে যদি নুহাশ একটু কেয়ারিং হত তাহলে পিয়াস হয়তো আমার সাথে এত মিশতে পারত না। জীবনের এমন কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতাম না।
বুক ফেটে কান্না আসতেছে। বেশ জোরে জোরে কাঁদতে লাগলাম। চোখ দুটোতে কান্না যেন গ্রাস করছে। কাঁদতে কাঁদতেই মাথাটা ঝিম ধরে গেছে। এর মধ্যেই শ্বাশুড়ি মায়ের আগমণ। বেশ জোরে জোরে বলতে লাগল
“আদিক্ষেতার শেষ নেই। এভাবে গলা চেঁচিয়ে কাঁদছো কেন? ”
আমি মায়ের দিকে তাকালাম। মাকে বেশ ঝাঁপসা লাগছে। মাথাটা ঘুরতে শুরু করল। কখন যে মাথা ঘুরে পড়লাম জানি না। জ্ঞান ফেরার পর লক্ষ্য করলাম আমি হাসপাতালে আর আমার পাশে নুহাশ বেশ খুশি মনে বসে আছে। আমি ওর দিকে তাকাতেই সে খুশি গলায় বলে উঠল
“মুমু আমাদের পরিবারে নতুন মেহমান আসতে চলেছে।”
কথাটা শুনার পর চোখ দিয়ে গড়গড় করে পানি পড়ছিল। মা হওয়ার এক ক্ষুদ্র অনুভূতি আমাকে ঘিরে ধরেছিল। সে সাথে এক রাশ যন্ত্রণাও আমাকে গ্রাস করছিল পিয়াসের কথা ভেবে। না জানি তার মা কত কষ্ট পাচ্ছে। একটা বাচ্চা মায়ের কাছে কত আপন সেটা মা না হলে টের পাওয়া সম্ভব না।
আমাকে বাসায় আনা হলো। নুহাশ বেশ চিন্তিত। আমার দিকে তাকিয়ে বলল
“পাশের বাসার পিয়াসের অবস্থা ভালো না। মুখে ৫২ টা সেলাই লেগেছে। আই সি ইউতে আছে। জ্ঞান ফিরেনি এখনও। একটা বড়ো অপারেশন ও হবে রাতে। বাঁচার সম্ভবনা ক্ষীণ। ছেলেটাকে তো ভালোই মনে হত। নম্র, ভদ্র, আর তোমার কথা সবসময় জিজ্ঞেস করত। তোমাকে বড়ো বোনের খুব মহব্বত করত বুঝতাম। হুট করে কী এমন হলো আত্মহত্যার পথ বেছে নিল। সে কী ছাদ থেকে লাফ দিয়েছে নাকি পড়ে গেছে বুঝতে পারছি না। সেটা জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত জানাও সম্ভব না।”
আমি চুপ হয়ে কথাগুলো শুধু শুনছিলাম। পিয়াসের এই অবস্থার জন্য পরোক্ষভাবে আমাকে দায়ী মনে হচ্ছে। যদিও কিছুই আমার হাতে ছিল না। রাত অনেক হয়েছে। নুহাশ আমার পাশেই বসে আছে। আমি বুঝতে পারছি না নুহাশকে সবটা খুলে বলব কি’না। কয়েকবার বলার চেষ্টা করেও যেন উষ্ঠ জোড়ায় কথা আটকে যাচ্ছিল। অবশেষে বলতে ব্যর্থ হলাম। নুহাশের বুকে মাথা রেখে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিচ্ছি কেবল। এক অনাবিল শান্তির খু্ঁজে এখানে এসেছিলাম। রঙিন স্বপ্নগুলো আমাকে ভীষণভাবে তাড়া করছিল। আর সে স্বপ্নগুলো যেন এক ধমকা হাওয়ায় ভেঙ্গে গেল। জীবনের গতি ভীষণ নড়বড়ে। আমরা চাইলেও সেটা সুন্দর করে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি না। সবকিছু আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী হয় না। পরিকল্পনার বাইরে কিছু ঘটে যায় যা আমাদের কল্পনায়ও থাকে না।
অস্থির রাত পার হলো। সকালে নুহাশ চলে গেল অফিসে। আর মা রান্না ঘরে রান্না করছে। যদিও রান্নাটা আমাকেই করতে হত তবে শরীরের বেগতিক অবস্থা দেখে রান্নাটা তিনিই চড়িয়েছেন। আমার সন্তান আসার সংবাদ শুনে উনার কোনো রকম অনুভূতির শব্দ আমি খুঁজে পাইনি। খুশি হয়েছেন নাকি খুশি হন নি। সেটা উনার মুখ অবয়ব দেখে বুঝতে পারছি না।
মোবাইলটা বেজে উঠল। বেলা বাজে এগারো টা। কে কল দিয়েছে বুঝতে পারছি না। অচেনা নম্বর। ধরব কি’না বুঝতেছি না। অনেক ভেবে কলটা ধরলাম। গম্ভীর গলার সুর কানে আসলো। গলাটা পিয়াসের বাবার। গলার গম্ভীরতা কমিয়ে বেশ ভার গলায় বলল
“মুমু আমি পিয়াসের বাবা। পিয়াসের জ্ঞান ফিরেছে। বারবার তোমাকে দেখতে চাচ্ছে। তোমাকে বোনের মতো মহব্বত করত তাই হয়তো তোমাকে দেখতে চাচ্ছে। তুমি কী একটু হাসপাতালে আসবে?”
আমি কী উত্তর দিব বুঝতে পারছিলাম না। হাত, পা অনবরত কাঁপতে লাগল। নিজের গলাটাও কাঁপছে। বেশ স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিলাম
“আমি নুহাশকে বলে ওকে সাথে নিয়ে আসব। একা আসতে পারব না।”
“ঠিক আছে আমি নুহাশের সাথে কথা বলে নিব।”
এ কথা বলার যথেষ্ঠ কারণ ছিল যে আমি একা গেলে তারা বিষয়টা অন্যভাবে নিতে পারে। তারা ভেবে বসতে পারে আমার আর পিয়াসের মধ্যে হয়তো কোনো সম্পর্ক চলছিল। কিন্তু এখন তারা এটা বুঝবে যে বিষয়টা কেবল এক তরফা। নুহাশ যেমনেই হোক আমি তাকে নিয়ে থাকতে চাই। আর আমি একা গেলে আমার শ্বশুড় শ্বাশুড়িও বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিবে না। বিষয়টাকে জল ঘোলা করে ছাড়বে। তাই যা করতে হবে বিবেক দিয়ে। এখানে আবেগ নিয়ে কিছু করতে গেলে আমার সংসারটা ভেঙ্গে যাবে। আর আমার বাচ্চাটারও ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে। আমি মা হয়ে আমার বাচ্চার ক্ষতি চাইব না।
আবারও কল বেজে উঠল। নুহাশ কল দিয়েছ। আমি ধরতেই বলে উঠল
“একটু রেডি থাকো পিয়াসকে দেখতে যাব। বেচারার অবস্থা অনেক খারাপ। কেন জানিনা তোমাকে দেখতে চাচ্ছে। তুমি আবার বলেছো আমাকে ছাড়া যাবে না তাই ওর বাবা আমাকে কল করেছে। আমাদের যাওয়া উচিত। সুতরাং তুমি রেডি থাকো।”
কলটা কেটে গেল। আমি তৈরী হয়ে নিলাম। নুহাশের মনে আমার প্রতি একটুও সন্দেহ আসলো না ভেবে নুহাশের প্রতি এক পরম শ্রদ্ধা আমার কাজ করছে। সে সাথে তার করে আসা অবহেলা গুলোও যেন এখন ক্ষীণ লাগছে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা আমি পিয়াসের প্রতি দু্র্বলতা অনুভব করলেও নুহাশকে ঠকাতে পারব না।
কিছুক্ষণ পর নুহাশকে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম। বেশ শান্ত পরিবেশ। দেখতে হলে একা গিয়ে ২ মিনিটের জন্য দেখতে পারব। দুইজন প্রবেশ করা যাবে না। আমাকে ঢুকতে বলা হলো।
আমি কাঁপা কাঁপা পায়ে প্রবেশ করলাম। পিয়াসের দিকে তাকালাম। আমি পিয়াসকে দেখে কেঁপে উঠলাম। শরীর কেমন যেন স্তব্ধ হতে লাগল। এক ঠান্ডা হাঁড়কাপানো কাঁপুনি যেন আমাকে ঘিরে ধরল। চোখ দুটো কর্ণফুলীর কড়ালস্রোতের মতো ধারালো হতে লাগল। হার্টবিট ক্রমান্বয় গতিতে বাড়তে লাগল। শরীরের রক্ত হিম হয়ে যেন বরফ হতে লাগল। দম নিরোধক এক গতিশীল হাওয়া যেন নাক দিয়ে ঢুকে সমস্ত শরীর অবশ করে দিল।
কপি করা নিষেধ।