#বিভাবরী
পর্ব-১
সুমাইয়া আমান নিতু
আমি আর তিথি জমজ বোন হলেও আমাদের মধ্যে পার্থক্য আকাশ পাতাল। আমি পূর্ব হলে তিথি পশ্চিম, আমি উদয় হলে সে অস্ত। আমরা না দেখতে একরকম, না স্বভাবে। আমি দেখতে বাবার মতো হয়েছি। সাধারণ চেহারা, শ্যামবর্ণ কান্তি, কালো চোখ, গড়পড়তা উচ্চতা, লম্বা রেশমী চুলের আমি খুব একটা চোখে পড়ার মতো নই। তিথি মায়ের মতো। তার চেহারা আকর্ষণীয়, ফরসা গায়ের রঙ, বাদামী চোখ, মেয়ে হিসেবে বেশ লম্বা, কোকড়া চুলে তাকে ভিড়ের মধ্যেও সবার আগে চোখে পড়ে। জীবনের খুব স্বাভাবিক নিয়মেই আমি ধীরস্থির, শান্ত; আর তিথি চটপটে, জেদী স্বভাবের। মজার ব্যাপার হলো তিথি বাবার বেশি আদরের, আমি মায়ের।
দু’বোন হলেও মনের দিক থেকে ভিন্ন হওয়ায় আমরা কখনো একে অপরের খুব কাছের ছিলাম না। বরং সারাজীবন একে অপরের সাথে লোকে এত তুলনা দিত যে আমরা দু’জন দু’জনের ওপর খানিকটা বিরক্ত ছিলাম৷ যেমন ও কোনোকিছু নিয়ে জেদ করলে আমার সাথে তুলনা দেয়া হতো, আমার উদাহরণ দেয়া হতো, আবার কেউ ওর সৌন্দর্যের প্রশংসা করলে আমায় নিয়ে হা হুতাশ করত।
সময়ের সাথে সাথে আমরা বড় হতে লাগলাম। আর যত বড় হলাম, দূরত্ব যেন ততই বেড়ে চলল। আমরা দু’জন পাশাপাশি ঘরে থেকেও থাকতাম দুই পৃথিবীতে। পড়াশুনায় দু’জনেই ছিলাম ভালো। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা সাবজেক্টে পড়তাম আমরা। তিথি ছিল ইউনিভার্সিটিতে ভীষণ পপুলার, আর আমায় ক্লাসমেটরা বাদে আর কেউ চিনতও না৷ আমি যে তিথির বোন এটাই জানত হাতে গোনা কয়েকজন।
আমাদের বিয়ের বয়স হয়ে এলে বাড়ি থেকে পাত্র দেখা শুরু হলো। বলাই বাহুল্য, পাত্র দেখা হতে লাগল শুধুই আমার জন্য। তিথির জন্য তো বাড়ি বয়ে সম্বন্ধ আসত ঝাঁকে ঝাঁকে। তিথি সেসব পাত্তা দিত না। ওর ইচ্ছে ছিল ওর মতোই সুদর্শন, যোগ্য কাউকে বিয়ে করার। সেরকম ছেলে সে পাচ্ছিল না৷ ক্যাম্পাসে দু’একজনের সাথে ওর প্রেমের গুঞ্জন শুনলেও সিরিয়াস কোনো সম্পর্ক ছিল বলে জানতাম না। আর আমি ওকে কখনো জিজ্ঞাসাও করিনি।
তিথি বিয়ে নিয়ে গড়িমসি করলেও আমি রাজিই ছিলাম৷ ছেলেবন্ধু বা প্রেমিক আমার কখনোই ছিল না৷ তাই বিয়ে করে একজন সত্যিকারের সঙ্গীর স্বপ্ন দেখতাম। নিজের সংসারে থিতু হতে চাইতাম। কিন্তু আমার জন্য পাত্র দেখলেও দেখা যেত তারা পছন্দ করে ফেলছে তিথিকে৷ ওকেই বউ করে নিতে চাইছে। বাড়ির লোকের ধারণা হয়ে গেল ওকে বিয়ে না দিয়ে আমার বিয়ে দেয়া যাবে না। কিন্তু তিথি যে তার মনের মতো মানুষ পাচ্ছেই না।
আমরা যখন থার্ড ইয়ারে পড়ি তখন এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে একসাথে দুটো আকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটল, তবে ঘটল ভীষণ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে।
আমরা গিয়েছি আমাদের ফুপাতো বোনের বিয়েতে। আমার ফুপুরা বেশ বড়লোক। বিয়েতে ধুমধাম করেছে খুব। আত্মীয়স্বজন যা ছিল সবাই দাওয়াত পেয়েছে। বাড়ি ভর্তি লোকজন। গায়ে হলুদের রাতে বরাবরের মতোই তিথি সবার নজর কেড়ে নিয়েছে, আমি চুপচপ বসে আছি একধারে। ছেলের বাড়ি, মেয়ের বাড়ির লোকজন মিলে একাকার।
বহুদিন পর কাজিনরা একত্র হওয়ায় সবাই একত্রে বসে আড্ডা শুরু হলো। আমিও যোগ দিয়েছি তাদের সাথে। কথায় কথায় খেলা শুরু হয়ে গেল। চেয়ার টেনে গোল হয়ে বসে শুরু হলো খেলা। ডেয়ার গেম। সবাইকে একটা করে ডেয়ার দেয়া হবে। যে ডেয়ার সম্পূর্ণ করতে পারবে সে বেঁচে যাবে, আর না করতে পারলে তার সম্পর্কে ছোটোবেলা কিংবা বড়বেলার কোনো লজ্জার ঘটনা সবার সামনে প্রকাশ করে দেবে যে জানে সে। খেলা জমে উঠলে আমারও মজা লাগতে শুরু করল। মজার মজার সব টাস্ক পেল একেকজন৷ বিশেষ করে যে যে জিনিসটায় কম দক্ষ তাকে সেটাই দেয়া হলো।
একসময় ডেয়ারের কাটা ঘুরল আমার দিকে। আমি শুরু থেকেই ভাবছিলাম আমার সম্পর্কে বলার মতো কারো তেমন কিছু নেই৷ কিন্তু এটা মনে ছিল না যে সেখানে আমার বোনও বসেছিল। আমি যখন বললাম, “কোনো ডেয়ার ফেয়ার করতে পারব না৷ আমার ব্যাপারে যা জানিস বলতে পারিস৷” তখন তিথি দুষ্টু হেসে বলল, “সিঁথি, ক্লাস সেভেনের অঙ্ক স্যারের পরীক্ষার কাহিনী মনে আছে? বলব?”
আমি এবার ভয় পেয়ে গেলাম। ঘটনাটা ভয়াবহ। সবার সামনে বললে কোনোভাবেই আমার পক্ষে সেটা সহ্য করা সম্ভব নয়। কিন্তু তিথি তো বলে দেবেই! ক্লাস সেভেনে আমরা দু’জন একজন বয়ষ্ক স্যারের কাছে ম্যাথ পড়তাম। স্যার ভীষণ কড়া ছিলেন। পড়া না হলে চিকন বেতের বাড়ি খেতে হতো হাতের তালুতে। আমরা দু’জনেই তাকে প্রচুর ভয় পেতাম৷ একবার তিনি পরীক্ষা নিলেন৷ তিথি সেই পরীক্ষায় উতরে গেলেও আমি কেমন করে যেন সবগুলো অঙ্ক ভুল করে বসে রইলাম। স্যার গেলেন ভীষণ রেগে। তার চোখমুখ রাগে লাল হয়ে গেল। আর আমি এদিকে ভয়ে কাঁপছি। স্যার চেঁচিয়ে বলছেন, “হাত পাতো! এক্ষুনি হাত পাতো বলছি!” আমি ভয়ে ওখানে বসেই পায়জামা ভিজিয়ে ফেলেছিলাম। ঘটনাটা মনে পড়লে এখনো লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে। স্যারকে এরপর ছাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। আর সেই ঘটনার ব্যাপারেও কোনেদিন আমাদের বড়িতে কোনো কথা হয়নি। আজ তিথির সেই কথা মনে করিয়ে দেয়া আর বাঁকা হাসি দেখে আমার চোখে পানি চলে এলো প্রায়৷ আমি কোনোরকমে নিজেকে সামলে বললাম, “দাও ডেয়ার। যা বলবে করব।”
আমাকে ডেয়ার কী দেয়া হবে সেটা নিয়ে আলোচনা চলল কিছুক্ষণ। আমি যেহেতু ছেলেদের সাথে তেমন কথা বলি না, তাই টাস্ক দেয়া হবে ছেলেদের সাথে কথা বলার৷ শুধু কথাই না, কোনো এক ছেলেকে একটা গোলাপ দিয়ে হেসে বলতে হবে, “এটা আপনার জন্য।”
আমার এত খারাপ লাগছিল বলবার মতো নয়। তবুও মুখ বুজে সহ্য করে নিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “কোন ছেলেকে?”
কেউ একজন বলল, “সোজা স্টেজের দিকে যেতে থাক, ছেলেপক্ষের অনেক ছেলে ওদিকে বসে আছে। যাকে আগে পাবি তার হাতে দিয়ে দিস।”
আমি গোলাপ হাতে উঠে যন্ত্রের মতো চলতে শুরু করলাম। চোখের সামনে অনেক ছেলে। সবাই যেন সামনে থেকেও নেই। চোখের ফোকাসের মাঝে কেউই আসছে না। সব ঘোলাটে দেখছি। আমার চোখে কি পানি জমা হচ্ছে?
হঠাৎ একজন ফোকাসের ভেতর পড়ে গেল। আমি তার সাথে কথা বলার আগেই সে আমাকে জিজ্ঞেস করে বসল, “আপনি ঠিক আছেন?”
গলাটা ভীষণ গভীর, আদুরে। আমি চোখ তুলে ভালো করে চাইলাম। গভীর দুচোখ। চোখে জিজ্ঞাসার সাথে সাথে আরো কী যেন ছিল। আমি তখনো ঠিক স্বাভাবিক নেই। ডেয়ার সম্পূর্ণ করতে হবে। আমি তার দিকে ফুলটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “আপনার জন্য।”
ছেলেটা অবাক হয়ে ফুল হাতে নিল। ততক্ষণে আমি উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করেছি। চোখের পানি এখন আর বাঁধ মানছে না। বন্যার জলের মতো হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমি কাজিনদের দলের দিকে একবার চাইলাম। কে যেন থাম্বস আপ দেখাচ্ছে। ওরা দেখেছে। আমার কাজ শেষ। আমি ছুটে চলে গেলাম ওয়াশরুমে। কিছুক্ষণ মনমতো কাঁদলাম। একটু স্বাভাবিক হয়ে এলে চোখ মুছে চেহারা ঠিক করে বাইরে এলাম। তিথির ওপর রাগ কিংবা অভিমানের পাহাড় জমে রইল বুকে।
একটু পরে ফুল দেয়া ছেলেটার সাথে কথা হলো। সে নিজেই এলো। জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ আমি তাকে কেন ফুল দিলাম। আমি বললাম, “ডেয়ার ছিল।” সে ফিক করে হেসে ফেলে বলল, “ধুর!”
তারপর পরিচিত হলাম আমরা। সে বরের ছেলেবেলার বন্ধু আবির। পড়াশুনা শেষে চাকরি করছে। সুযোগে এটাও বলে দিল, বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছে সে।
তার পরদিন বিয়েতে আবিরের মা বাবা এসে আমার মা বাবকে তার সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব দিল। সবাই যারপরনাই ভীষণ খুশি হলো। ওদের নাকি আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। আর সুদর্শন, উচ্চবংশের, উচ্চপদস্থ চাকরিজীবী ছেলেকে আমার জন্য পেয়ে আমার পরিবারের আপত্তি করার প্রশ্নই ওঠে না৷
কিন্তু আপত্তি উঠল আমার পরিবার থেকেই। তাও ঘোর আপত্তি। বিয়েবাড়িতে তিথি কিছুই বলেনি, কিন্তু বাড়ি ফিরে সে জানাল, আবিরকে তার প্রথমদিনই মনে ধরেছিল। সে যেরকম ছেলে খুঁজছে আবির ঠিক সেরকম ছেলে। সে এতদিন পর যাকে খুঁজে পেয়েছে তার সাথে আমার বিয়ে সে কিছুতেই হতে দেবে না৷ আবিরকে সে নিজে বিয়ে করবে। আর আবির নাকি তাকেই পছন্দ করে। ভুল করে আমার কথা বলেছে।
সত্যি বলতে, আমি নিজেও প্রথমে ভেবেছিলাম আবির আসলে তিথিকেই পছন্দ করে। তিথির সাথে ওকে আমি হেসে গল্প করতে দেখেছি। তিথি প্রথমদিন থেকেই ওর সাথে খাতির করে ফেলেছিল। আবির যখন আমার সাথে পরিচিত হতে এলো, আমি ধরে নিয়েছিলাম ও আমার মাধ্যমে তিথিকে প্রস্তাব পাঠাবে। কিন্তু হয়ে গেল উল্টো৷
আবিরের সাথে কথা বলে এটা নিশ্চত হওয়া গেল যে সে তিথিকে নয়, আমাকেই বিয়ে করতে চায়।
তিথি রেগে আগুন হয়ে গেল। বিয়েটা যাতে না হয় সেজন্য অনেক চেষ্টাও করল সে। কিন্তু সব বাঁধা পেরিয়ে কেমন করে যেন আবিরের সাথে আমার বিয়েটা হয়ে গেল।
বিয়ের পর আমরা সুখী দম্পতির মতোই জীবন কাটাতে লাগলাম। আবির আর তার পরিবার খুবই সাপোর্টিভ। আমি এত আদরযত্ন আমার বাড়িতেও কোনোদিন পাইনি। ওরকম পরিবার, ওরকম স্বামী পাওয়া যে কারো ভাগ্যের বিষয়। তিথির তখনো বিয়ে হয়নি। আর আমি বিয়ে করে সুখের সাগরে ভাসছি, এটা আমার কাছে মাঝেমধ্যে খারাপ লাগত, আবার অবিশ্বাস্যও মনে হতো।
তিথি দিন দিন বেশ বেপরোয়া হয়ে উঠছে। মা প্রায়ই বলেন ও কোনো কথা শোনে না৷ কত রাত বাড়ি ফেরে না, কোথায় যায় ঠিকঠাক জবাব দেয় না৷ আর শাসন করতে গেলেই শুধু ভয় দেখায়, ব্ল্যাক/মেইল করে। মা বাবা ওকে নিয়ে খুবই চিন্তিত।
এদিকে আমরা চমৎকার বোঝাপড়ার সাথে দুটো বছর কাটিয়ে ফেললাম৷ আবির আমায় ভালোবাসে। ওকে বিয়ে করার পর আমি জীবনের প্রথম ভালোবাসার মানে বুঝতে পারলাম। এ যে ভীষণ সুন্দর অনুভূতি তা আমার কল্পনাতেও কোনোদিন ছিল না। শুধু ভোরে ঘুম থেকে উঠে একটা মুখ দেখতে যে কী প্রশান্তি তা কোনোদিন কাউকে গভীরভাবে ভালো না বাসলে বোধহয় উপলব্ধি করা যায় না।
আমাদের দ্বিতীয় এনিভার্সারির সময় আবিরকে অফিস ট্যুরে যেতে হলো সুইজারল্যান্ড। সে আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু ভিসা সংক্রান্ত জটিলতায় আমার আর যাওয়া হলো না। সে মন খারাপ করে একাই গেল।
আমাদের এনিভার্সারির দিন ঠিক রাত বারোটায় আমি মোবাইলেই সারপ্রাইজ পেলাম৷ এমন ভয়ানক রকমের সারপ্রাইজ যার আশা আমি কোনদিনই করিনি।
তিথির নাম্বার থেকে আমার কাছে কিছু ডকুমেন্টস এলো মেসেজে। সেখানে তিথি আর আবিরের ঘনিষ্ঠ কিছু ছবি, সুইজারল্যান্ডের হোটেলের রেজিস্ট্রারে ওদের একসাথে একই ঘরে থাকার সিগনেচার, আর সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা ছিল একটা মেডিকেল রিপোর্ট, যেটা বলছে তিথি প্রেগনেন্ট।
(চলবে)