#বিভাবরী
পর্ব-২
আমার দাদী ছোটোবেলায় বলতেন, মায়ের গর্ভের এক ফুল দুই ভাগ হয়ে দু’জন হলে তারা হয় একরকম৷ আর দুটো আলাদা ফুল থেকে যে দু’জন একসাথে হয় তারা হয় ভিন্ন রকম। দুটোই জমজ, তবে আলাদা ধরনের। আমরা হয়েছি দুটো আলাদা ফুল থেকে। তাই তো এত পার্থক্য। দাদী বলতেন, যতই পার্থক্য হোক, যারা জোড়ায় হয় তাদের মনের কোথাও না কোথাও সেই আজন্মের টান রয়েই যায়। দাদীর ঘরে বসে বসে এসব কথা মনে পড়ে। আজন্মের টান কথাটা হাস্যকর রসিকতা বলে মনে হয়। আমার নিজের আপন বোন এমন কাজ কী করে করতে পারল? সারাক্ষণ ঘুমের মাঝে গলা চেপে ধরার মতো অনুভূতি নিয়ে কেমন করে ঘুরে বেড়াচ্ছি নিজেও জানি না।
সেই রাতটা আমি পাথরের মতো বসে ছিলাম। না নড়তে পেরেছি, না কাঁদতে পেরেছি, না পেরেছি কাউকে কিছু বলতে। সেদিনই আমি ওই বাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে এসেছিলাম। তার আগে অবশ্য আবিরের সাথে কথা হয়েছিল। ওকে আমি সরাসরিই জিজ্ঞেস করেছিলাম তিথির ব্যাপারে। আবির সাফ অস্বীকার করেছে। আমি জানতাম অস্বীকার করবে। কিন্তু এতগুলো প্রমাণ আমি কেমন করে অবিশ্বাস করব?
এখনো কাউকি কিছু বলিনি৷ ও চলে যাবার এমনিতেও আমার বাপের বাড়িতে আসার কথা ছিল। তাই এখানেও কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি। তবে মায়ের বোধহয় সন্দেহ হয়েছে। এর মাঝে বেশ ক’বার জিজ্ঞেস করে ফেলেছে কী হয়েছে আমার৷ আমি নাকি স্বাভাবিক নেই। স্বাভাবিক আমি চাইলেও হতে পারব না। কিন্তু মাকে কোনোকিছু খুলে বলবার মতো মানসিক শক্তিও যে আমার নেই।
এখানে এসে দেখেছি তিথি বাড়িতে নেই। কোথায় গেছে সেটা মা বাবাকে বলে যায়নি৷ ও এত বেশি উচ্ছন্নে গেছে যে ওর ব্যাপারে মা বাবা এখন একেবারে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে। জানে ঠিকই ফিরে আসবে কিছুদিন পর৷
আবির এর মাঝে অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। আমি কোনো সাড়া দেইনি। ওরা আগে ফিরুক, যদি তিথির দাবি সত্য হয় তবে আবিরকে ডিভোর্স দিতে আমি দু’বার ভাবব না। এত লম্পট লোকের সাথে সারাজীবন থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।
আবিরের ফেরার নির্ধারিত দিনেই সে ফিরল। বাড়ি ফিরেই আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল সে৷ আমি ফোন ধরলাম না৷ সে মেসেজে লিখল, “তোমাদের বাড়িতে আসছি।”
সে এলো। একইসাথে এলো তিথি। একই দিনে একই সাথে ওদের আসাটা আমার সন্দেহ আরো বাড়িয়ে দিল। কতদিন পর তাকে দেখলাম! বিয়ের পর আমরা আলাদা থেকেছি খুব কম৷ শুধু ওর চেহারা দেখে আমি সব পিছুটান ভুলে একটা জায়গায় থেকেছি দিনের পর দিন। সেই মুখ, সেই চোখ, আমার সেই ভালোবাসার মানুষ আমায় এত বড় ধোঁকা দিতে পারে এ যেন আমার স্বপ্নেরও অতীত। অথচ ভাগ্যের ফেরে তাই হয়ে চলেছে চোখের সামনে। সে যখন মায়ের আপ্যায়নে ড্রইংরুমে বসে, তখন আমি আড়ালে থেকে তাকে পর্যবেক্ষণ করলাম বহুক্ষণ। শুধু মনে হতে থাকল, ইশ! যদি সব মিথ্যে হতো!
খানিক পর আবির আমাকে আলাদা করে নিয়ে অনেক করে বোঝাল। এসব ছবি বা রিপোর্ট নাকি জাল করা যায়। আমি যেন এসব বিশ্বাস না করি। এর একটা বিন্দুও সত্য নয়৷ এমনকি সে সুইজারল্যান্ডে তিথির সাথে ছিলও না। সে এত সুন্দর করে বোঝাল যে আমার তাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো। আমি তাকে রেখে তিথির সাথে কথা বলতে গেলাম৷
তিথি আগের থেকে আরো সুন্দর হয়েছে৷ ওর ত্বক আরো বেশি গ্লো করছে। চোখ উজ্জ্বল। আমায় দেখে হেসে বলল, “দ্যাখ, কত শপিং করেছি সুইজারল্যান্ড থেকে। তোর বর তো টাকার বস্তা উড়িয়ে দিল একেবারে!” সত্যিই ওর ঘরে দুটো বড় বড় লাগেজ।
আমি ওর কথায় প্রভাবিত না হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তুই সত্যিই প্রেগনেন্ট?”
“তোর কোনো সন্দেহ আছে?”
“আছে। ওরকম কাগজ জাল করা যায়।”
“আমি তোকে ইন্সট্যান্ট প্রমাণ দিতে পারি। আমার কাছে প্রেগনেন্সি টেস্ট কিট আছে। ওয়েট কর।”
সে একটা ফ্রেশ কিট বের করে আমাকে দেখিয়ে সেটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। একটু পর বের হয়ে আমার হাতে কিটটা ধরিয়ে দিল। দুটো স্পষ্ট লাল দাগ দেখা যাচ্ছে। ও সত্যিই প্রেগনেন্ট। আমার পায়ের নিচ থেকে আক্ষরিক অর্থেই এবার মাটি সরে গেল।
আমি কিটটা নিয়ে আবিরের কাছে গেলাম৷ ওর দিকে ওটা ছুঁড়ে দিয়ে বললাম, “এখনো অস্বীকার করবে?”
সে জিনিসটা দেখল। তারপর মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে বলল, “ও যদি প্রেগনেন্ট হয়ও, আমি সেই বাচ্চার বাবা নই।”
আমি তখন রাগে চোখে অন্ধকার দেখছি। কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লাম মেঝেতে৷ হঠাৎই সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলাম। আমার কান্নার শব্দে বাড়ির সবাই ছুটে এলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সবটা সবাই জেনে গেল। এমন বিদঘুটে পরিস্থিতি যে প্রত্যেকেই কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কী বলবে তা পর্যন্ত কেউ যেন বুঝতে পারছে না। শুধু আবির আর তিথির মধ্যেই ঝগড়া চলতে লাগল৷ আবির ক্রমাগত অস্বীকার করে গেল, আর তিথি দাবি করতে থাকল সে সত্যি বলছে৷
প্রমাণ দিতে তিথি তার মোবাইলে ওদের একসাথে আরো ডজন ডজন ছবি দেখাল। আবির সেসবও অস্বীকার করল। তিথি শেষে ব্রহ্মাস্ত্র বের করার মতো করে সোজা আবিরের দিকে চেয়ে চোখ নাচিয়ে বলল, “ফাইন! সব অস্বীকার করছো। আমি যদি এমন কিছু বলতে পারি যেটা আমার জানার কথা নয় তাহলে স্বীকার করবে তো?”
“কী বলবে তুমি এমন?”
তিথি বলে বসল, “তোমার উরুর ওপর যে লাল আর কালো পাশাপাশি দুটো তিল আছে সেটা আমি কেমন করে জানি?” তিথি এবার আমার দিকে চেয়ে বলল, “কিরে সিঁথি, আছে না বল?”
আমি হতবার হয়ে গেলাম। চকিতে একবার চাইলাম আবিরের দিকে। সে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। আমি আর সহ্য করতে পারলাম না৷ মুখ ঢেকে ফেললাম৷ বাড়ির সব বড়দের সামনে ও কেমন করে পারছে এই কথাগুলো বলতে?
আবির আর কোনো কথা না বলে গটগট করে হেঁটে চলে গেল। সে চলে গেলে তিথি বলল, “তোর বর চেয়েছিল সে গাছেরও খাবে, তলারও কুড়াবে। তোকে বিয়ে করে তোর সাথে ঘর করছিল, সাথে আমার সাথেও প্রেম চালিয়ে যাচ্ছিল। বিয়ের আশা দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু জীবনেও বিয়ে করত না৷ আমি যখন প্রেগনেন্ট হয়ে গেলাম তখন ফুসলিয়ে সুইজারল্যান্ড নিয়ে গেল এবোরশন করাতে। আমি তো কিছুতেই করাব না। কত গিফট দিয়ে, কত আদর করে বোঝাল। কিন্তু আমি এবার আর বুঝতে রাজি নই। বিয়ে করতে হবে আমায়, ব্যস! আমার বাচ্চার স্বীকৃতি চাই। আর আমি সতিনের ঘর করব না৷ তাই আগে তোকে ডিভোর্স দিতে হবে।”
এই পর্যন্ত বলার পর মা এগিয়ে এসে সজোরে একটা চড় মারলেন তিথির গালে৷ ওর ঠোঁট কেটে রক্ত গড়াল। এবার ও চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “শোনো মা, তোমার আদরের মেয়েকে বলে দিও যেন ভালোয় ভালোয় ডিভোর্সটা দিয়ে দেয়। তোমরা যদি বাড়াবাড়ি করো তাহলে আমি আ/ত্ম/হ/ত্যা করব। আর করার আগে চিঠিতে তোমার আদরের মেয়ে আর জামাইয়ের নাম লিখে রেখে যাব।”
এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যে আমি নিজেই উকিলের সাথে কথা বললাম ডিভোর্সের ব্যাপারে। আবিরকেও জানিয়ে দিলাম। সে একেবারে চুপ হয়ে গেছে। যেন আর কিছুই বলার নেই। আমাদের ডিভোর্স পেপারে সাইন করার ডেটও চলে এলো দেখতে দেখতে।
যেদিন সাইন হবে, তার আগের দিন সকালে আমি বাথরুমে মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। ডাক্তার দেখানো হলো। জানতে পারলাম, আমি নিজেও মা হতে চলেছি৷
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু