#বিভাবরী
পর্ব-৩
কিছু সত্য ছুরির চেয়েও ধারালো, তীরের ফলার চেয়েও তীক্ষ্ণ। এমন সত্য বুকে গেঁথে বেঁচে থাকার মতো অসহনীয় ব্যাপার বোধহয় পৃথিবীতে খুব কমই আছে। আমি ভেবেছিলাম ডিভোর্সটা হয়ে গেলে আমি কোথাও একটা চলে যাব। এসব কিছু থেকে অনেক অনেক দূরে। কোনো নির্জন এলাকায় যেখানে কেউ আমায় চিনবে না, অতীতের কোনো ছায়া থাকবে না৷ একটা ছোট্ট মাথা গোঁজার জায়গা পেলেই হয়ে যাবে আমার। কিন্তু ভাগ্য বিধাতার ইচ্ছে আলাদা কিছুই ছিল। তাই তো সন্তানের আগমনী বার্তা জানিয়ে ডিভোর্সটা আটকে দিল। এখন যা হবার বাচ্চা হবার পর হবে।
আমি আর তিথি একই বাড়িতে থাকি। ঠিক আগের মতো পাশাপাশি ঘরে। আমাদের ভেতর তেমন ভাব ভালোবাসা আগেও ছিল না, আর এখন তো সম্পর্কে এত গরল মিশেছে, এত তিক্ত হয়েছে যে পৃথিবীর সব ভালোবাসা ঢেলেও সেই তিক্ততা বুঝি কমানো যাবে না। অথচ আমরা দু’জন অন্তঃসত্ত্বা। কী ভয়ানক পরিস্থিতি তা না দেখলে বোঝা সম্ভব নয়।
তিথি এখন আর আমার সাথে কোনো কথাই বলে না৷ একেবারে সাইলেন্ট মোডে চলে গেছে। মা বাবার সাথেও কথা বলে না। নিজের ঘরে সারাদিন বন্দি হয়ে বসে থাকে। আমার ঘরটা ওর পাশেই হওয়ায় কখনো কখনো গভীর রাতে আমি ওর ঘর থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ শুনি। কিন্তু কখনো জানতে চাই না ঠিক কোন শোকে ও কেঁদে চলেছে।
মা আর বাবা দু’জনেই পরিস্থিতির শিকার হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মানসিক জোর কারোই অবশিষ্ট নেই। আমার বা তিথির সন্তানের কী হবে তা এক বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবার সামনে।
আমার সন্তান হবার খবর শুনে আবির যোগাযোগ করেছে। আমি তার ফোন ধরিনি প্রথমে। পরে মা বুঝিয়ে বলেছেন সন্তানের প্রতি ওরও অধিকার আছে। ওকে যেন এখন নিজের আর সন্তানের খবরাখবর দেই।
আমি তাই টুকটাক কথা বলি। ও সেদিনকার কথা, তিথির কথা কিংবা আমাদের হতে হতে থেমে যাওয়া ডিভোর্সের কথা কোনোটাই তোলে না। শুধু আমার শরীরের খবর নেয়৷ কিছু খেতে ইচ্ছে করে কি না জানতে চায়। প্রায়ই আমার পছন্দের খাবারগুলো অনলাইন শপের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়। আমার একাউন্টে টাকাও দিয়ে রেখেছে।
ওর সাথে যোগাযোগ হলেই আমার প্রবল কান্না পায়। আমাদের কত শখের সন্তান! কত আশা, কত স্বপ্ন ছিল ওকে নিয়ে! ওর জন্য আলাদা ঘর করে রেখেছিল ওর বাবা। কত রকমের প্ল্যান ছিল! এখন কি আর সেসব হবে? সে কি আদৌ বাবার আদর পাবে? একসাথে বাবা মায়ের সাথে বড় হতে পারবে? আমরাই কি আর আগের মতো ভালোবাসার সংসারে বাস করতে পারব? এসব ভেবে সারাদিন রাত বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা হয়।
একদিন আবির জানাল তার পরিবারের লোকজন আমাদের বাড়িতে আসতে চায় আমাকে বুঝিয়ে নিয়ে যেতে। তারা সবাই চায় আমি এ সময়ে তাদের ওখানে থাকি৷ এই বাড়ির পরিবেশ আমার জন্য ভালো নয়। কিন্তু আমি তাদের জোর দিয়েই আসতে নিষেধ করে দিলাম। আবিরকে বুঝিয়ে বললাম তারা এলেই এখন তিথি সিন ক্রিয়েট করবে। যা তা কান্ড করে বসতে পারে। তার থেকে তারা না আসুক। আবির অনুরোধ করে বলল, “তাহলে তুমি চলে এসো।” আমি রুদ্ধ কণ্ঠে বললাম, “না।”
“তাহলে তুমি আমার সন্তানকে আমার থেকে দূরে রাখবে?”
“আগে ও পৃথিবীতে আসুক, তারপর ঠিক হবে ও কোথায় থাকবে।”
“এতদিন একসাথে ঘর করেও তুমি আমায় চিনলে না সিঁথি? আমার ভালোবাসায় সন্দেহ করলে? চাইলে আমি প্রমাণ করে দিতে পারতাম তোমার বোন মিথ্যেবাদী। কিন্তু তুমি কেমন করে পারলে আমায় এতটা অবিশ্বাস করতে? তোমায় যদি আমি ডিভোর্স দিতামও সেটা দিতাম তোমার ওপর অভিমান করে। এত অবিশ্বাস নিয়ে সংসার করা যায় না। যে কেউ প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে কতগুলো জাল ছবি আর রিপোর্ট বানিয়ে এনে দেখিয়ে দেবে আর আমার ভালোবাসার স্ত্রী সেগুলো দেখে বিশ্বাস করে আমায় ছেড়ে চলে যাবে, এই যদি হয় সম্পর্কের ভিত তাহলে সেই সম্পর্কের ভেতরটা কতটুকু মজবুত হবে তুমিই বলো? আমার কপালটাই খুব খারাপ জানো? খুব খারাপ। আমি বোধহয় মানুষটাই ভালোবাসা পাবার যোগ্য নই।”
ওর কথাগুলো শুনে কী যে ভয়ঙ্কর খারাপ লাগল তা বলে বোঝাতে পারব না। আমি ফোন রেখে কান্নায় ভেঙে পড়লাম৷ আবার এক উভয় সংকটের মাঝে দাঁড়িয়ে পড়েছি। কোথায় যাব বুঝতে পারছি না। পুরো পৃথিবীটা অন্ধকার লাগছে।
আমি আবার কল করলাম আবিরকে।
বললাম, “ছবিগুলো প্রযুক্তির সাহায্যে বানানো বুঝলাম। কিন্তু তোমার তিলের কথাটা যে বলল সে? তার কী হবে? সেটা এমন একটা জায়গায় যেটা অন্তত ওর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কেমন করে জানে ও?”
আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সেটা আমিও জানি না।”
আমি আবারো ফোন কেটে দিলাম। কাউকে এখন আর বিশ্বাস হচ্ছে না। এমনকি নিজেকেও না। নিজের গর্ভের সন্তানকে কেন যেন ভয় পাচ্ছি আজকাল। কেন তাও বুঝতে পারছি না।
আমি ফিরে গেলাম না, বাবার বাড়িতেই রয়ে গেলাম৷ দিনগুলো কাটতে লাগল বছরের মতো। তবুও তো দিন ভালো, রাতে মনে হয় পুরো পৃথিবী আমায় গিলে খেতে আসছে। নিস্তব্ধ রাতের পটে নিশাচর কোনো পাখির ডাকেও চমকে উঠছি। তার ওপর তিথির কান্না রোজকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওর কান্না আমায় পাতালপুরীর কোনো বন্দিশালা থেকে আসা আওয়াজের মতো মনে হয়।
এমনই এক রাতে একটা মেসেজ পেলাম আমি। অপরিচিত নাম্বারের মেসেজ। “আপনার সাথে একটু কথা বলা যাবে? আমি শাহেদ।”
“কোন শাহেদ?”
“আমাকে চেনেননি ভাবি? আমি আবিরের মামাতো ভাই। আপন মামাতো ভাই না অবশ্য, একটু দূর সম্পর্কের। আপনাদের বিয়েতে দেখা হয়েছিল। আমার চোখ নীল। মনে আছে?”
আমার মনে পড়ে গেল। বললাম, “জি। আমার সাথে আপনার কী প্রয়োজন?”
“আবির আর তিথির ব্যাপারে কিছু বলার ছিল আমার।”
আমি চমকে উঠলাম ভীষণভাবে। সাথে সাথে কল করলাম শাহেদকে। শাহেদ কল ধরল না৷ মেসেজে লিখল, “স্যরি ভাবি। আমার বউ পাশে ঘুমিয়ে আছে। এখন কথা বলা যাবে না। এত রাতে মেসেজ দিয়েছি সেজন্য স্যরি। আমি আসলে ঘুমাতে পারছিলাম না৷ কিংবা বলা যায় এসব নোংরা বিষয় আমায় ঘুমাতে দিচ্ছে না। আপনাকে সব জানাতে চাই আমি। তবে মেসেজে এতকিছু বলা যাবে না। দেখা করতে পারেন?”
আমি কিছুক্ষণ ভাবলাম। আবির আর তিথির ব্যাপারে এই ছেলে নতুন করে আর কী বা বলবে? সব তো আমি জানিই। তাকে লিখলাম, “সম্ভবত আপনি যা বলতে চান সেটা আমি জানি।”
সে জিজ্ঞেস করল, “আপনি এখন কোথায়?”
“আমি আমার বাপের বাড়িতে।”
“আবিরের সাথে রাগ করে চলে গেছেন?”
“হ্যাঁ।”
“আমি শুনেছি আপনি প্রেগনেন্ট। যত যাই হোক, আবিরকে সন্তানের সুখ থেকে বঞ্চিত করাটা কি উচিত?”
আমার হাসি পেল। লিখলাম, “সে বঞ্চিত হবে না। তার দুই সন্তান একসাথে হবে। একজনকে না পেলেও আরেকজনকে ঠিকই পাবে।”
“মানে?”
“মানে তো আপনার জানার কথা।”
“আপনার কি জমজ বাচ্চা হবে?”
“না। তিথিরও বাচ্চা হবে।”
ওপাশ থেকে আর কোনো জবাব এলো না। আমি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। একসময় চোখ লেগে এলো। ঠিক তখনই তিথির ঘর থেকে চাপা কান্না ভেসে এলো। অন্যদিনের থেকে আওয়াজটা যেন আরো জোরালো।
এর কিছুদিন পর এক মেয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে আমাদের বাড়িতে এলো। ভীষণ সুন্দর সেই নারীকে দেখে আমি নিজেই অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। সে এসেছে তিথির কাছে। তিথি নিজেই তাকে খাতির করে বসাল, আপ্যায়ন করল। গল্প করে কাটাল অনেকটা সময়। এরপর আমাকে হঠাৎ ডাকল তিথি। আমি সেখানে গেলে তিথি পরিচয় করিয়ে দিল, “সিঁথি, উনি হচ্ছেন ইলিয়ানা কায়সার। আর ইলি, ও হলো সিঁথি। আবিরের বউ।”
ইলিয়ানা আমার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বাঁকা হেসে বলল, “আবিরের যোগ্য পাত্রী। এমনিতেও অত ছোটো মনের মানুষ ভালো কিছু পেতে পারে না।”
আমার মেজাজ গরম হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, “কে আপনি শুনি?”
তিথি এবার গলা চড়িয়ে বলল, “কে মানে? আমার গেস্ট। তুই কোন সাহসে আমার গেস্টের সাথে এই ভাষায় কথা বলিস?”
“তোর গেস্ট আমার পার্সোনাল বিষয়ে কথা বলছে কেন?”
ইলিয়ানা ভ্রুঁ দুটো একসাথে জড়ো করে মুখটা কৃত্রিম মলিন করে বলল, “স্যরি সিঁথি!”
তিথি এবার হেসে বলল, “তুই কি সত্যিই ইলিয়ানার কথা কখনো শুনিসনি?”
“না।”
“তুই একটা বোকা। চরম বোকা। এজন্যই তোকে সবাই ঠকায়। ইলি কে জানতে চাইলে তোর প্রাণের স্বামীকে জিজ্ঞেস করিস।”
আমি আর কোনো কথাই বললাম না। দুজনকে রূপকথার পাতা থেকে উঠে আসা ডাইনীর মতো মনে হতে লাগল। সেখান থেকে পালিয়েই চলে এলাম আমি।
আবিরকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম, “ইলিয়ানা কে?”
আবির কাঁপা গলায় পাল্টা জিজ্ঞেস করল, “ওর কথা তোমাকে কে বলল?”
“ও আমাদের বাসায় এসেছে।”
“হোয়াট? এসে কী বলেছে?”
“কী বলবে? তিথির গেস্ট হিসেবে এসেছে।”
“ওহ।”
“ও কে বললে না?”
“কেউ না।” বলে ফোন কেটে দিল আবির। আর ফোন ধরল না।
সব মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। এর মাঝে এই মেয়ে কোথা থেকে এলো? ওর ভূমিকা কী?
এর দু’দিন পর আমি সকালে খানিক হাঁটাহাঁটি করতে বের হয়ে হঠাৎ দেখলাম শাহেদ আমাদের বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। আমাকে দেখতে পেয়েই বোধহয় কোথাও একটা গায়েব হয়ে গেল। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারলাম না।
এর পরদিন দুপুরে তিথির প্রচন্ড চিৎকারে দৌড়ে ওর ঘরে গেলাম। ঘরে নেই ও। বাথরুম থেকে আওয়াজ আসছে। মাও দৌড়ে এসেছে। বাথরুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। তিথি চিৎকার করছে। সাথে বলে চলেছে, “আমার বাচ্চা! আমার বাচ্চা!”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু