#বিভাবরী
পর্ব-৪ (অন্তিম পর্ব)
দরজা ভেঙে যখন তিথিকে বের করা হলো তখন পুরো বাথরুম রক্তে ভেসে যাচ্ছে। চিৎকার করতে করতে তিথি জ্ঞান হারিয়েছে। আমরা ধরাধরি করে তাকে তুললাম৷ যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নেয়া হলো তাকে।
ডাক্তার জানালেন তিথির মিসক্যারেজ হয়েছে। প্রচুর রক্তপাত হয়ে গেছে। এখন তাকে রক্ত দিতে হবে৷ ওর আর আমার রক্তের গ্রুপ একই। আমি দিতে চাইলাম৷ কিন্তু প্রেগনেন্ট বলে আমার রক্ত নেয়া হলো না৷ এদিকে নিজে গর্ভবতী হয়ে এভাবে বোনের গর্ভপাতের দৃশ্য স্বচক্ষে দেখে আমার পুরো শরীর কাঁপছে। কোনোভাবেই স্বাভাবিক হতে পারছি না। মা কাঁদছেন। বাবা আর ভাই রক্ত ম্যানেজ করার জন্য ছোটাছুটি করছে। ভাই এক ফাঁকে এসে বলে গেল ফেসবুকে রক্তের জন্য একটা পোস্ট করতে। আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় রক্তদান সংস্থার সাথে যুক্ত ছিলাম, তাই ওদের অনেকের সাথে আমার অ্যাড আছে। সহজে তাদের রিচ করতে পারব। আমি তাই পোস্ট করে দিলাম।
পোস্ট করার কিছুক্ষণ পর শাহেদের মেসেজ এলো। “কার রক্ত লাগবে ভাবি?”
আমি উত্তর দিলাম, “তিথির।”
“কী হয়েছে ওর?”
“মিসক্যারেজ।”
শাহেদ আর কিছু লিখল না। এদিকে একজন রক্ত দিতে চাওয়া ব্যক্তি মেসেজ দিয়েছে। তার সাথে কথা বলে আসতে বললাম। লোকটার জন্য অপেক্ষা করছি, এমন সময় দেখি শাহেদ এসে উপস্থিত। জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার কি রক্তের গ্রুপ ম্যাচ করেছে?”
শাহেদ মাথা নাড়ল, “না ভাবি। তিথি কেমন আছে?”
শাহেদের দিকে ভালো করে তাকিয়ে আমি অবাকই হলাম। ওর চোখমুখ কেমন যেন উদভ্রান্তের মতো হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে তীব্র কষ্ট পাচ্ছে কোনো কারনে। কথাবার্তাও স্বাভাবিক লাগছে না৷ আমি পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম, “তোমাকে এমন লাগছে কেন? কী হয়েছে?”
শাহেদ প্রায় কেঁদে ফেলে বলল, “ভাবি ফর গড সেক বলুন তিথি কেমন আছে?”
“ভালো না। বাচ্চাটা বেঁচে নেই। অনেক ব্লিডিং হয়েছে৷ এখন রক্ত লাগবে।”
সে এবার হাঁটু গেঁড়ে মেঝেতে বসে পড়ল। আমি জিজ্ঞেস করতে লাগলাম কী হয়েছে। সে কোনো উত্তর না দিয়ে কাঁদতে লাগল। এদিকে রক্ত দেবার জন্য ছেলেটা চলে এসেছে। আরেকজনকে ম্যানেজ করে এনেছে ভাই। দু’জনেরই রক্ত ম্যাচ করে কি না পরীক্ষা করতে নিয়ে যাওয়া হলো। মা নামাজ পড়তে চলে গেছেন, বাবা ব্যস্ত, ভাইও চলে গেল। এই সুযোগে শাহেদকে আমি ধরে বসলাম। “তিথির বাচ্চার জন্য তুমি এত কাঁদছ কেন? ঘটনা কী?”
শাহেদ চোখ মুছে কী একটা বলতে যাচ্ছিল এমন সময় করিডোরের দিকে চেয়ে ওর মুখ বন্ধ হয়ে গেল। আমিও ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে চেয়ে দেখি আবির এসেছে। করিডোরের অন্য মাথায় একজন নার্সকে কী যেন জিজ্ঞেস করছে। শাহেদ বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়াল। কোনোমতে বলল, “ভাবি, আবিরকে বলবেন না আমি এসেছিলাম। প্লিজ! বলে উল্টোদিকে দৌড় দিয়ে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ওর দিকে চেয়ে আছি, এমন সময় অপর পাশ থেকে একটা হাত আমার কাঁধ ধরে তার দিকে ফিরিয়ে জাপটে ধরল। আবির!
খেয়াল করলাম আবির আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপছে। কাঁদছে সে। ওর চোখের পানিতে আমার কাঁধ ভিজে যাচ্ছে।
কতদিন পর আবার ওর সাথে আলিঙ্গন হলো। কতদিন পর! কিন্তু সে আজ আমায় ভালোবেসে জড়িয়ে ধরেনি! নিজের সন্তান হারানোর শোকে কাঁদছে! আমার নিজেকে এত অসহায় মনে হলো! আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম মূর্তির মতো।
আবির একসময় কিছুটা স্বাভাবিক হলো। আমায় ছেড়ে দিয়ে দুই হাতে আমার মুখটা তুলে বলল, ” তুমি ঠিক আছো সিঁথি?”
“হুম।”
আবিরের চোখ দিয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। সে চোখ মুছে বলল, “আমি পাগল হয়ে ছুটে এসেছিলাম৷ ভেবেছিলাম তোমার কিছু হয়েছে।”
“আমার কিছু হয়েছে কে বলল?”
“তোমার ভাই ফোনে বলল আমার বাচ্চাটা নাকি আর পৃথিবীতে নেই। আমার ভাবনাটা কি তাহলে ভুল?”
“ওটাও তো তোমার…”
আবির আমার ঠোঁটে আঙুল রেখে বলল, “চুপ! ওই কথাটা আর একবারও বলবে না। ওটা আমার বাচ্চা নয়। আমার সন্তান একটাই যে তোমার গর্ভে বড় হচ্ছে। আরেকটা কথা, ওই অভিশপ্ত বাড়িতে তুমি আর ফিরে যাবে না। এখান থেকে সোজা আমার সাথে আমাদের বাড়িতে ফিরবে।”
আমি ওর দিকে চেয়ে রইলাম। নিজেকে অনুভূতি শূন্য লাগছে। সত্য মিথ্যা সব গুলিয়ে গেছে।
তিথিকে রক্ত দেয়া হলো। ওর জ্ঞান ফিরল রাতে। এর মাঝে অনেকবার আবির আমাকে বাড়ি যেতে বলেছে, আমি যাইনি। তিথির জ্ঞান ফেরার আগে কোথাও যাওয়ার কথা ভাবতেই পারছি না। হাজার হোক, সে আমার জমজ বোন।
জ্ঞান ফেরার পর তিথি প্রথম আমাকেই দেখতে চাইল। আমি গেলাম দেখা করতে।
ওর চেহারা একদিনেই কেমন ভেঙে গেছে। ডি এন্ড সি করাতে নাকি ভীষণ কষ্ট হয়। ওর চেহারায় কষ্ট ফুটে আছে। আমি কিছুই বলতে পারলাম না ওর সামনে।
তিথি ইশারায় আমাকে কাছে ডাকল। ওর কাছে গিয়ে দাঁড়ালে ওর ক্যানোলা করা হাতটা দিয়ে আমার একটা হাত ধরল৷ আস্তে আস্তে বলল, “সিঁথি জানিস, আমার মনে হচ্ছে আমি মরে যাব।”
“এসব বলিস না।”
“জানিস, আমি প্রেগন্যান্সির পর থেকেই প্রায় রাতেই একটা স্বপ্ন দেখতাম৷ বাজে স্বপ্ন। দেখতাম আমার কোলে একটা ফুটফুটে পরীর মতো বাচ্চা। সেই ছোট্ট বাচ্চা আমার দিকে আঙুল তুলে বলত, তুমি খুব খারাপ। আমি তোমার সাথে থাকতে চাই না। আমি তোমাকে ভালোবাসি না। আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাই। তোমার মতো মা আমি চাই না। বলার সাথে সাথে আমার হাত থেকে পড়ে যেত ও৷ গভীর একটা খাঁদে তলিয়ে যেত৷ আমি চিৎকার করে জেগে উঠতাম৷ বাকি রাত ফুঁপিয়ে কাঁদতাম। মনে হতো সত্যিই বাচ্চাটা আর নেই।” বলতে বলতে চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল ওর।
আমি ওর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললাম, “আর বলতে হবে না৷ তুই রেস্ট নে।”
ও আমার হাত টেনে ধরে বলল, “না, বলব আমি। তুই শোন শুধু৷ গত এক সপ্তাহে আমি প্রতিটা রাতে স্বপ্নটা দেখেছি। সারাক্ষণ শুধু ভয় হতো মিসক্যারেজের। ভীষণ ভয়। আমি যেমনই হই না কেন আমার বাচ্চাটাকে আমি ভালোবাসতাম জানিস? ওর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারতাম আমার পুরো সত্ত্বা দিয়ে। ও আমার জন্য পৃথিবীতে আসতে পারল না৷ সব আমার দোষ।” বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে। আমি জোর করে ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, “তুই চুপ কর। পরে বলিস এসব।”
“আমি পরে মরে গেলে যে তুই কিছু জানতে পারবি না সিঁথি।”
“তুই মরবি কেন? ডাক্তার বলেছে তোর আর কিছু হবে না। বিপদ কেটে গেছে। ভয় পাস না।”
“আমি ভয় পাচ্ছি না। শুধু মনে হচ্ছে বাচ্চাটা আমায় ডাকছে। ওর কাছে যাবার আগে তোকে সব বলে যাব।”
“কী বলতে চাস?”
তিথি কাঁপা গলায় বলল, “ও আবিরের বাচ্চা ছিল না। আবিরের সাথে আমার কোনো সম্পর্কই ছিল না।”
আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। মনে হলো নিজেরই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলব। আর কিছু জিজ্ঞেস করার মতো শক্তি আমার নেই। ধীরে ধীরে কেমন যেন আঁধার হয়ে এলো চোখের সামনে।
*********
চোখ যখন খুললাম তখন আমি হাসপাতালের একটা বেডে শুয়ে আছি৷ আমার সামনে বসে আছে আবির। সে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছো এখন?”
“ভালো।”
ওর চোখের দিকে চেয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। এই চোখ, এই মুখ, এই মানুষটাকে আমি অবিশ্বাস করেছি। আবিরও বেদনার্ত মুখে চেয়ে আছে। ওর চোখে ঠিকরে পড়ছে উদ্বেগ, ভালোবাসা আর যন্ত্রণা।
আমি অস্ফুটে বললাম, “তিথি সত্যিটা বলেছে। আই অ্যাম স্যরি। আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
আবির আমার দুই হাত শক্ত করে ধরে বলল, “আমিও স্যরি।”
“কেন?”
“আগে সুস্থ হও, তারপর বলব।”
কিছুটা সুস্থ হয়ে আমি হাসপাতাল থেকে সোজা আবিরদের বাড়িতেই গেলাম। ওর আর ওর পরিবারের যত্নে দ্রুতই ভালো হয়ে উঠলাম।
একদিন আবির বলল, “তোমার কাছে আমার কিছু স্বীকারোক্তি আছে। শোনার পর যা শাস্তি দিতে চাও মাথা পেতে নেব। শুধু আমার থেকে দূরে চলে যেতে পারবে না।”
“কী স্বীকারোক্তি?”
“আমি তোমার কাছে আমার অতীত গোপন করেছি।”
“তোমার অতীত নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই আবির।”
“কিন্তু অতীত যদি বর্তমানে সমস্যা সৃষ্টি করে তাহলে তাকে যে জানাতেই হয়। আমি চাই না ভবিষ্যতে আর কোনো ঝামেলা হোক।”
“কথাটা কী?”
“তোমার সাথে আমার বিয়েটা আমার দ্বিতীয় বিয়ে। এর আগে আমার একটা বিয়ে হয়েছিল। মাত্র দু’মাস সংসার করার পর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। আমি বিয়ের সময় আমার আগের বিয়েটা গোপন করেছিলাম তোমার এবং তোমার পরিবারের কাছে। ভেবেছিলাম বললে তোমরা হয়তো পিছিয়ে যাবে। কিন্তু তোমাকে আমার এত ভালো লেগে গিয়েছিল যে… আমি স্যরি! কথাগুলো আগে বললে হয়তো ঝামেলা কম হতো।”
আমি কথাগুলো হজম করার জন্য কিছুটা সময় নিলাম। তিথির ঘটনার মতো ভয়াবহ কিছুর পর এই অতীতের ব্যাপারটা আমায় অতটাও ধাক্কা দিতে পারল না। জিজ্ঞেস করলাম, “কিন্তু সেই অতীত বর্তমানে কিভাবে ঝামেলা করল?”
আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমার প্রাক্তন স্ত্রীর নাম ইলিয়ানা কয়সার।”
আমি অবাক হয়ে গেলাম। “তার মানে…”
“তার মানে আমার সম্পর্কে যেসব তথ্য দিয়ে তিথি সবাইকে ভড়কে দিয়েছে সেসব তথ্য আসলে ইলিয়ানার থেকে পাওয়া। যেদিন শুনেছিলাম ও তিথির গেস্ট হয়ে তোমাদের বাড়িতে এসেছে সেদিনই সব বুঝে গিয়েছিলাম। কিন্তু তোমার কাছে ওর কথা গোপন করেছি বলে সেদিন কিছুই বলতে পারিনি।”
আমার কাছে সবটা এখন পরিষ্কার হয়ে গেল।
আবির আমার হাত ধরে বলল, “এই কথাটা গোপনের জন্যই আমি এতটা শাস্তি পেলাম। কথা দিচ্ছি আর কোনোদিন তোমার কাছে কিচ্ছু গোপন করব না। আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি তিথি। ভীষণ ভালোবাসি।”
“ইলিয়ানার সাথে তোমার ছাড়াছাড়ি হয়েছিল কোন?”
আবির মুখে তিক্ত একটা ভাব ফুটিয়ে বলল, “ওর একটা ছেলে বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। তার সাথে অতিরিক্ত মাখামাখি, সারাদিন কথা বলা, গায়ে হাত দিয়ে কথা বলা, তাছাড়া ওদের কিছু ছবিও দেখেছিলাম প্রেমিক প্রেমিকা যেমন ক্লোজ হয়ে ছবি তোলে তার থেকেও…ওসব আমার সহ্য হয়নি। রোজ ঝগড়া হতো। দুমাসেই একেবারে চূড়ান্ত খারাপ অবস্থা তৈরি হয়েছিল। এরপর ও চলে গেল। আমিও আর আনতে গেলাম না। ছাড়াছাড়িও হয়ে গেল। ও এখনো বলে বেড়ায় আমি নাকি ছোটো মনের, আপডেট নই, পুরানো আমলের চিন্তাধারার মানুষ। ওসব নাকি এখনকার ফ্যাশন। বিশ্বাস করো, ওর পর আমার আর কোনো মেয়েকে পছন্দ হয়নি। সবার মধ্যে আমি ইলিয়ানার ছায়া দেখতে পেতাম। ফাইনালি আমি তোমার দেখা পেলাম। আর তোমার দেখা পাবার পর আর কারো দিকে তাকাবার ইচ্ছেও হয়নি।”
আমি যেন ওর মনটা ছুঁতে পারলাম এতক্ষণে। সব ভুল বোঝাবুঝি মিটে যেতেই জড়িয়ে ধরলাম ওকে। মনে হলো কত সহস্র বছর পর প্রাণ পাখিটা তার জায়গামতো ফিরে এসেছে!
******
তিথি ওর মিসক্যারেজের পর একেবারে চুপ হয়ে গেছে। কোনো কথাই বলে না, ঘর থেকে বের হয় না। সারাদিন শুধু বসে জানালার বাইরে চেয়ে থাকে। হাতে একটা পেন্সিল থাকে, একটা খাতায় সে স্কেচ বানায়। সবই বাচ্চাদের স্কেচ।
আমার ইদানীং রাতে ঘুম হয় না। প্রেগনেন্সির লাস্ট স্টেজে চলে এসেছি। আট মাস চলছে। এখন খুব অস্থির লাগে। পেটে বাবু নড়াচড়া করে। রাতে ঘুম ভেঙে যায়। আর দুচোখের পাতা এক হয় না।
এক রাতে শাহেদের মেসেজ এলো। “ভাবি জেগে আছেন?”
উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ।”
“আপনাকে কিছু কথা বলব।”
“বলো।”
শাহেদ বলল, “কল করি?”
“উহু, আবির ঘুমাচ্ছে। কথা শুনলে উঠে পড়বে। তোমার বউ পাশে নেই?”
“না, বাপের বাড়ি। আমি যা বলার বলব। আপনাকে জবাব দিতে হবে না। শুধু শুনবেন। করি কল?”
“করো।”
শাহেদ কল করল। দীর্ঘ সময় নিয়ে সে অনেক কথা বলল। “ভাবি, আমার বিয়ে হয়েছে আট বছর হলো৷ অল্প বয়সের প্রেমের বিয়ে। বিয়ের এতদিন পরেও বাচ্চা না হওয়ায় বছর দেড়েক আগে আমরা টেস্ট করাই। আমি আর আমার স্ত্রী নিশা দু’জনেরই টেস্ট করানো হয়। নিশার সব স্বাভাবিক হলেও আমার টেস্টের রেজাল্ট হলো খারাপ। আমি নাকি কোনোদিন বাবা হতে পারব না। এটা জানার পর থেকে নিশার সাথে আমার দূরত্ব বাড়তে থাকে। আমি ডিপ্রেশনে যেতে থাকি।
এমন একটা খারাপ সময়ে আমার পরিচয় হয় তিথির সাথে। ওর সৌন্দর্য আর আকর্ষণীয় চরিত্র আমাকে চুম্বরকের মতো টেনে নেয় ওর দিকে। ও আমকে ভালোবাসত না, তবে সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিলাম আমরা। সম্পর্কটা ধীরে ধীরে গভীর হয়। আমার ব্যাপারে সব জানত ও। আমার সমস্যাটাও জানত। তাই অন্তরঙ্গ সময় কাটাবার সময় আমরা কখনো কোনো জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতাম না। জানতাম কিছুই হবে না।
ও তবুও মাঝেমধ্যে প্রশ্ন করত, যদি প্রেগনেন্ট হয়ে যাই তবে? তুমি কি নিশাকে ছাড়তে পারবে? আমি বলতাম, না। নিশাকে ছাড়া আমার পক্ষে সম্ভব না। তিথিকে ভালোবাসলেও নিশা যে আমার সংসার, আমার জীবনের অংশ৷
তিথি আর কিছু বলত না৷ এরপর একদিন তিথি আমার সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। আমি অনেক চেষ্টা করেও ওকে ট্রেস করতে পারলাম না। ও শুধু আমাকে একটা ইমেইল করেছিল। যাতে লেখা ছিল, যদি আমাকে ভালোবাসো তাহলে আমার আর তোমার সম্পর্কের কথাটা কাউকে বলো না। বললে তোমার সংসারে আগুন লেগে যাবে।
আমি তখন এটাকে সাধারণ একটা কথা ভেবে নিয়েছিলাম। আর মাথা ঘামাইনি৷ কিন্তু এর কিছুদিন পরেই ফ্যামিলিতে কানাঘুঁষা শুনতে পেলাম আবিরের সাথে নাকি ও সুইজারল্যান্ড গেছে এ জাতীয়। কিন্তু আমি জানতাম ও যায়নি৷ এটা মিথ্যে কথা। কারন সে সময়ে আমি নিজেই সুইজারল্যান্ডে ছিলাম৷ আমরা দুদিন একসাথে ঘুরেছি। আবির আমার হোটেলেই ছিল। তিথির সেখানে থাকার প্রশ্নই আসে না। এরপর শুনলাম আপনি নাকি এসবের জন্য রাগ করে চলে গেছেন। তাই আমি আপনাকে মেসেজ করেছিলাম সত্যিটা বলতে। তখনো জানতাম না তিথি যে প্রেগন্যান্ট। আপনার কাছ থেকেই প্রথম জানলাম।
এরপর আমি আর কিছু না বলে তিথিকে কন্টাক্ট করি। আমি ভেবেছিলাম নিশ্চিয়ই তিথির গর্ভে আবিরের সন্তান, কারন আমি তো বাবা হতে পারব না৷ তিথির সাথে একদিন আপনাদের বাড়ির বাইরেই দেখা করি। আপনি সেদিন আমাকে দেখেছিলেন সম্ভবত ঘোরাফেরা করতে। তিথিকে পেয়েই চেপে ধরেছিলাম৷ জিজ্ঞেস করেছিলাম সত্যিটা। ও আমায় বলেছিল ওটা আমার বাচ্চা৷ আবিরের প্রতি ওর তীব্র আকর্ষণ আর আপনার প্রতি আপনাদের বিয়ে নিয়ে রাগ ওর মনে তখনো জীবন্ত ছিল। আবিরকে সম্ভবত ও অনেকভাবে নিজের কাছে টানার চেষ্টা করেছে, আবির পাত্তা দেয়নি। তাই ওর রাগটা জেদে পরিণত হয়েছে। এখন বাচ্চাটাকে ও ব্যবহার করতে চায় আপনাদের সম্পর্ক ভাঙতে। মাঝে কিভাবে যেন ওর ইলিয়ানার সাথে যোগাযোগ হয়েছিল। ওরও সাহায্য নিয়েছিল তিথি।
সেদিনও আমার তিথির কথা বিশ্বাস হয়নি। আমি সেদিনই আমার টেস্ট আবারও করাই। রিপোর্টে সব স্বাভাবিক আসে। আমার তখন পাগল পাগল লাগছিল। বুঝতে পারছিলাম না কী হয়েছে। এরপর আমি নিশার টেস্টও আবার করাই। রিপোর্টে আসে সমস্যা আসলে নিশার ছিল। আমরা আগে যে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করিয়েছিলাম সেটা দুটো রিপোর্টই কেমন করে ভুল দিল জানি না। কিন্তু এতেই সব যেন এলোমেলো হয়ে গেল। আমি এবার নিশ্চিত হয়ে গেলাম তিথির সন্তান আমার নিজের।
আমি ওর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না৷ ঠিক সে সময়েই আপনার ফেসবুকে রক্ত চেয়ে পোস্ট আর তিথির মিসক্যারেজের কথাটা জানতে পারলাম৷
এসব আমি কাউকে বলিনি ভাবি৷ আপনাকেই প্রথম বললাম৷ নিশাকে ঠকানোর শাস্তি আমি পেয়েছি৷ নিশাকে আমি ছাড়তে পারব না৷ সন্তানের মুখও কোনোদিন দেখা হবে না। একটা সম্তান পৃথিবীতে আসতে চেয়েও এলো না। এটাই আমার সারাজীবনের শাস্তি হয়ে থাকবে।”
আমি ফোন রেখে দিয়ে চোখ বুজলাম। সবাই যার যার জায়গা থেকে শাস্তি পেল। তিথি মিথ্যে অপবাদের শাস্তি পেল, আবির ওর বিয়ের কথা গোপনের শাস্তি পেল আর শাহেদ শাস্তি পেল তার অবৈধ সম্পর্কের। কিন্তু আমি? আমি কিসের শাস্তি পেলাম? এসব কি আদৌ আমার সাথে ঘটার কথা ছিল?
ভাবতে ভাবতে কখন যেন চোখ লেগে এলো। আধো ঘুমে বহু পুরানো একটা স্মৃতি মনের পর্দায় ভেসে উঠল।
আমরা তখন ক্লাস টেনে পড়ি। ছোটো খালার বাসায় বেড়াতে গেছি৷ খালার ননদ বিদেশ থাকত। সে সময় দেশে এসেছিল বেড়াতে। তার হাতে ঝলমলে একটা হীরের আংটি ছিল। আংটিটা এত সুন্দর ছিল যে প্রথম দেখায় আমার চেখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। সেদিন দুপুরে খালার ননদ গোসল করতে যাবার সময় আংটিটা খুলে রেখে গিয়েছিলেন ড্রেসিং টেবিলের ওপরে। আমি সেটা দেখে লোভ সামলাতে পারিনি। তুলে নিয়েছিলাম৷ পরেছিলাম নিজের হাতে। কী ভালো লাগছিল! সেটা আর জায়গামতো রাখতে ইচ্ছে হচ্ছিল না৷ লুকিয়ে ফেলেছিলাম জামার ভেতর। তারপর যখন জানা গেল আংটিটা মিসিং তখন সারা বাড়িতে হৈচৈ পড়ে গেল। চারদিক খোঁজাখুঁজি, সবকিছু তল্লাশি শুরু হয়ে গেল। আমি ভয়ে কোনো উপায় না পেয়ে আংটিটা তিথির হ্যান্ডব্যাগে রেখে দিয়েছিলাম। সেটা পাওয়া গিয়েছিল তিথির ব্যাগ থেকে। কী ভীষণ অপমানিত হয়েছিল সেদিন আমরা সবাই তা আর বলার মতো নয়। তিথি প্রচন্ড মার খেয়েছিল। ও অনেবার বলেছিল ও এই কাজ করেনি৷ কিন্তু কেউ ওকে বিশ্বাস করেনি। আমার তো কিছু বলার সাহসই হয়নি। তখন থেকে ছোটো খালার সাথে মায়ের মুখ দেখাদেখিও বন্ধ।
এই একটা… এই একটাই অপরাধই করেছিলাম জীবনে। তন্দ্রা টুটে গেল আমার। চোখ মেললাম। বুঝলাম, আমিও শাস্তি পেয়েছি৷ সবাই সবার কৃতকর্মের ফল একদিন না একদিন পেয়েই যায়। প্রকৃতি সব ঋণ শোধ করে নেয়।
(সমাপ্ত)
সুমাইয়া আমান নিতু