বিয়ে পর্ব-১৫

0
905

#বিয়ে
#লেখনীতে – ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব- ১৫

অদ্রি বেশ অদ্ভুত গোছের। প্রেম-ভালোবাসায় উদাসীন একটা মেয়ে। ও আর পরশ ঠিক করে কাল-পরশু অদ্রির ড্রাইভার থেকে লম্বা লোকটার নাম্বার নিতে হবে। যদিও এগুলো ভেবে রাহাতের বেশ চিন্তা হচ্ছে, তবে প্রেম-ভালোবাসায় এসবকে তো অবশ্যই জয় করতে হবে। হুহ! নয়তো ও কিসের প্রেমিক পুরুষ?

রুক্ষ দুপুর। রোদে ঝলমল করছে পরিবেশ। অদ্রি আজ কোচিং থেকে বেশ ক্লান্ত হয়ে ফিরেছে। একেবারে দুপুরের খাবার খেয়ে শাওয়ার নিয়ে দিলো এক ঘুম। ক্লান্ত থাকায় দীর্ঘ চার ঘন্টা ও মরা’র মতো ঘুমিয়েছে। একটু আগেই ওর ঘুম ভেঙেছে। বরাবরের মতোই চোখমুখ বেশ ফুলে আছে। চুল এলোমেলো। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে ও বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। গোধূলি বিকেল। পূব আকাশে দ্যুতি ছড়াচ্ছে লালিমা মাখা আলো। হিমেল হাওয়ায় দূরের গাছগুলোর পাতা নড়ছে। চারপাশ শান্ত। সুনশাল নীরবতায় ঘিরে আছে পরিবেশ। অদ্রি মোড়ায় বসে পা তুলে দেয়। একদৃষ্টে বাইরের প্রকৃতি দেখে। আকাশের সৌন্দর্য ওকে বেশ মুগ্ধ করে। এদিকওদিক প্রকৃতি অবলোকন করার পর হঠাৎ ‘কুইকুই’ শব্দ ভেসে আছে কোথা থেকে। অদ্রি নিচে তাকায়। দেখে কাঠবাদাম গাছটার নিচে বসে আছে একটা কুকুর ছানা। অদ্রির মনে পড়ে দু’দিন আগে ধ্রুব কোথা থেকে যেন নিয়ে এসেছিলো ওকে। সারাদিন বাগানে খেলাধুলা করে। ধ্রুব বেশ যত্ম নেয় ওর। তবে খুব একটা সময় দিতে পারে না। যতীনই ওকে খাবার দেয়, দেখাশোনা করে। অদ্রি ঘর থেকে বনরুটি এনে ছুঁড়ে দেয় ছানাটার সামনে। অদ্রির দিকে তাকিয়ে কুকুরটি লাফ দেয় রুটির টুকরোর দিকে। অদ্রি হেসে ফেলে। এই দৃশ্যটা ক্যাপচার করে রাখার জন্য অদ্রি ওঠে দাঁড়ায়। ঘরে গিয়ে ফোনটা নিয়ে আসে। ক্যামেরা অন করে ছবি তুলে। যদিও এমনিতে কুকুর খুব ভয় পায়, ছুঁতে পারে না। অদ্রি ধ্রুব’র ব্যলকনিতে তাকায়। ঘরে আলো জ্বলছে না। তার মানে লোকটা এখনো অফিস থেকে ফেরেনি। অদ্রি আনমনা হয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। প্রায় রাত-ই ধ্রুব এই ব্যলকনিতে বসে কাটিয়ে দেয়। লোকটা কি ঘুমায় না? এটা কি ওর অভ্যেস নাকি অদ্রিকে পাহারা দেওয়ার জন্যই ও এমন করে? অদ্রি ভাবতে থাকে। ওর ভাবনার মাঝেই ঘরে শায়লা আসে। অদ্রিকে ডেকে বলে,
— শোন মা, আমি জরিকে নিয়ে হসপিটাল যাচ্ছি।
অদ্রি চিন্তিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে,
— কি হয়েছে? ওর কি শরীর খারাপ? নাকি তোমার কিছু হয়েছে আন্টি?
শায়লা ওর ব্যাকুলতা দেখে হেসে বলে,
— আরে না। আমার এক ভাইয়ের বউয়ের ডেলিভারি ডেইট আজকে। তো দেখতে যাচ্ছি। জরিনা বায়না করলো যেতে, তাই নিয়ে যাচ্ছি আরকি! তুই যাবি?
অদ্রি নিশ্চিত হয়ে হেসে বলে,
— নাহ। হসপিটাল যেতে আমার ভালো লাগে না। আমি না হয় একদিন বাচ্চার বাড়িতে গিয়ে ওকে আদর করে আসবো। হুম?
শায়লা ওর মনোভাব বুঝতে পেরে জোর করলো না।বলল,
— আচ্ছা। আর শোন, তোর আংকেলও অফিস থেকে ওখানে যাবে। বাড়ি ফাঁকা। আমি নাহয় ধ্রুবকে আসতে বলে দিই? ও এলে বেরিয়ে পড়বো।
অদ্রি বলল,
— দরকার নেই। আমি একা থাকতে পারবো, তোমরা যাও।
— তা হয় নাকি? ধ্রুব আসুক…
অদ্রি থামিয়ে দিয়ে বলল,
— ওনি সময় হলে আসবে। তোমরা অহেতুক আমার জন্য চিন্তা করো না। আমি থাকতে পারবো।
অদ্রির জোরাজুরিতে শায়লা জরিনাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। তবে যাওয়ার আগে ধ্রুবকে ফোন করে দ্রুত বাড়ি ফিরতে বলে দিলেন।

অফিসে আজ কাজের বেশ চাপ ছিলো। নিজেদের অফিস হওয়া স্বত্ত্বেও ইদানীং কাজের চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয় আশফাক সাহেব আর ধ্রুব’র। তার ওপর ধ্রুব’র পিএ রিমঝিম মেয়েটা ইদানীং বেশ বাড়াবাড়ি করছিলো। ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসা, ধ্রুব’র বাড়াবাড়ি রকমের প্রশংসা করা, কলিগদের কাছে ওদের ডেইটে যাওয়া নিয়ে গুজব ছড়ানোয়
ওর ওপর বেশ রেগেছিলো ধ্রুব। ওর সব ব্যাপারে এমনভাবে নাক গলায় যেন ও ধ্রুব’র গার্লফ্রেন্ড।
সেজন্য আজ বাধ্য হয়ে মেয়েটাকে অন্য কোম্পানিতে চাকরির ব্যবস্থা করে নিজের ঘাড় থেকে নামায় সে। এসব নিয়েই ওর মনমেজাজ খারাপ। ধ্রুব বিরক্তি নিয়ে ভাবে, অদ্রি তো ফিরেও তাকায় না ওর দিকে। আর অন্যরা আসে ভালোবেসে কফি বানিয়ে দিবে কিনা জিজ্ঞেস করতে। যত্তসব!
এরমধ্যে মায়ের ফোন পেয়ে অফিসের সব কাজ কোনোমতে গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ে ধ্রুব। তবুও বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বেজে যায়। ক্লান্ত শরীর নিয়ে দোতলায় ওঠতেই সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকা অদ্রিকে দেখে সে। ওর বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হয়। আহা! এই মেয়েটার মুখেই যেন লুকিয়ে থাকে ধ্রুব’র এক জীবনের সব শান্তি! অদ্রি, অদ্রি, অদ্রি; কবে সহজ হবে তুমি আমার সাথে? তখন হয়তো ধ্রুব’র দিকে আর চোখ রাঙিয়ে থাকতে পারবে না। কথাগুলো ভাবতেই নিমিষেই সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায় ওর। অদ্রি ততক্ষণে ওর পাশ কাটিয়ে নিচে নেমে যায়। ধ্রুব ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে রেলিঙে ঠেস দিয়ে। অদ্রি চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকায়৷ একসময় অবাক কন্ঠে বলে,
— এত বড় শরীরটা নিয়ে রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছেন যে ওটা তো ভেঙ্গে যাবে। হাত-পা ভাঙলে আমি কিন্তু একা একা হসপিটালে নিয়ে যেতে পারবো না।
ধ্রুব চমকে যায়। বলে,
— তুমি এসব খেয়াল করেছো?
অদ্রি বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে,
— কি খেয়াল করেছি?
— এইযে, আমি এত ড্যাশিং একটা ছেলে।
অদ্রি ব্যস্ত স্বরে বলল,
— সেভাবে লক্ষ্য করি নি। তবে এত বড় শরীরটা যে কারো চোখে পড়ারই কথা।
ধ্রুব এবার খানিকটা বিরক্তিবোধ করে। অদ্রি কখন ওকে নিয়ে একটু প্রশংসা করবে? ও নিচে নেমে আসে। অদ্রির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কঠোর গলায় বলে,
— এতদিনেও আমাকে তুমি লক্ষ্য করো নি? কবে করবে তাহলে?
অদ্রি ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
— জানি না। আর আপনাকে লক্ষ্য করারও কিছু নেই।
— কেন এমন করো আমার সাথে?
অদ্রি তীক্ষ্ণ গলায় বলল,
— প্রথমদিন আমাকে যা বলেছিলেন সব স্পষ্ট মনে আছে আমার। অফারের ব্যাপারটা, মনে আছে!
ধ্রুব সোজা হয়ে দাঁড়ায়। বলা কথা কখনো ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। মাফ চাওয়ার মতো মুখও নেই ওর। তবুও প্রচন্ড অস্বস্তি নিয়ে বলে,
— আমার মনের অবস্থা তখন ভালো ছিলো না। কেন বুঝো না? তুমি কখনোই আমাকে ভালো বলো না। কেন বলো না?
অদ্রি ভ্রু কুঁচকে বলে,
— এটা কেমন অভিযোগ? আমার ভালো না লাগলে আমি মিথ্যে কেন বলবো?
ধ্রুব আবারও আহত হয়। ওর মাথা ধরে আসে। কপালে হাত ঘষতে ঘষতে জিজ্ঞেস করে,
— রিয়েলি? আমাকে তোমার ভালো লাগে না? তুমি জানো আমার পিএ রিমঝিম সারাক্ষণ কাজ বাদ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, অফিসের সবাইকে আমাদের মিথ্যে ডেইটে যাওয়ার গল্প শোনায়, আমাকে ভালোবেসে কফি বানিয়ে দিতে চায়। ও আমার লুক্সের প্রতি এতটাই অবসেসড।
অদ্রি সব শুনে দারুণ মজা পায়। একপ্রকার হেসেই বলে ওঠে,
— তাহলে ওর কাছেই যান, আমাকে এসব শোনানোর অর্থ কি?
ধ্রুব হতাশ হয়ে বলল,
— ওকে চাকুরি থেকে বের করে দিয়েছি। আর ওর কাছে যাবো কেন? থার্ডক্লাস মেয়েমানুষ কোথাকার।
অদ্রি মনে মনে প্রচুর হাসে। ধ্রুব নিজের ব্যক্তিত্বের বাইরে গিয়ে আজ ওকে এসব কথা বলছে। অদ্রি ওর মনের অবস্থা বুঝতে পারে। বলে,
— ভালো করেছেন।
ধ্রুব জিজ্ঞেস করে,
— তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে? তোমার বন্ধু “মামার” কি খবর?
অদ্রি বলল,
— পড়াশোনা মোটামুটি চলছে। আমার বন্ধুর খবর বেশ ভালোই।
ধ্রুব ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করে,
— কোচিং-এ নিয়মিত আসে?
— নাহ। ও অন্য কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছে। সে যাইহোক। এখন আপাতত ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হোন। আমি আপনার কফি নিয়ে আসি। আন্টিরা বাসায় নেই।
ধ্রুব শুনে স্বস্তি পায়। ওই ছেলেকে অদ্রির আশেপাশে দেখলে ওর ভালো লাগতো না। এখন অদ্রির কথাতে পুরোপুরি বউ বউ ভাব মিশে আছে। ও খুশি হয়। অদ্রির আদেশ পেয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। অদ্রিও ব্যস্ত ভঙ্গিতে ধ্রুব’র জন্য কফি বানাতে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। মিনিট বিশেক পর অদ্রি কফি তৈরি করে ধ্রুব’র ঘরে আসে। আসার আগে নিজের ঘর থেকে খামে করে কিছু টাকা নিয়ে নেয়। ধ্রুব’র ঘরে নক করে জিজ্ঞেস করে,
— আসবো?
ভেতর থেকে ধ্রুব বিরক্ত হয়ে বলল,
— আসো। অনুমতি নেওয়ার কি প্রয়োজন?
অদ্রি শক্ত গলায় বলে,
— আমি তো আর আপনার মতো নই যে হুটহাট কারো ঘরে ঢুকে যাবো। দেখা গেলো আপনি চেঞ্জ করছেন। কি বিব্রতকর পরিস্থিতি…
বলতে বলতে ও ধ্রুব’র দিকে কফির মগ এগিয়ে দেয়। অদ্রি সুযোগ পেলে বারবার সেদিনের ঘটনা নিয়ে খোঁচা দেয়। ধ্রুব কেশে ফেলে। এরপর ভ্রু কুঁচকে খানিকক্ষণ সময় নিয়ে কফির মগে চুমুক দেয়। দারুণ খেতে। কিন্তু ও মুখে প্রশংসা করে না। অদ্রিকে সামনে দেখে ওর অদ্ভুত অনুভূতি হয়। বাইরে দমকা বাতাস। আর ধ্রুব’র মনের ভেতর একরাশ ভালো-লাগা। সামনে তার ভাইরাস জ্বর দাঁড়িয়ে। ধ্রুব অন্যরকম ঘোরে চলে যায়। মুখ ফসকে বলে ফেলে,
— একটু এদিকে আসবে?
অদ্রি হতচকিত হয়। ধ্রুব’র এই হাবভাব তার অচেনা। কেমন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। অদ্রি চুপ থাকতে পারে না। বিস্ময় নিয়ে বলে,
— সত্যিই আপনার আসল রুপ বোঝা বড় কঠিন। একটা মেয়েকে একা পেয়ে আবারও আপনার মনে কু-চিন্তা জেগে ওঠছে। ছিঃ ছিঃ।
ধ্রুব’র ঘোর কেটে যায়। হঠাৎ করেই কথাটা বলে থমকে গিয়েছিলো। ও ভুলে গিয়েছিলো এ মেয়ে ওর চিন্তাধারার বাইরের জগতের। অদ্রির মুখে একথা শুনে রেগে বলল,
— এমনটা সব ছেলেরই হয়।
অদ্রি যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখলো ওর থেকে। বলল,
— ওহ, আপনি বুঝি সব ছেলেদের মন নিয়ে পিএইচডি করে এসেছেন, তাইনা? ডিজগাস্টিং!
ধ্রুব রেগে বলল,
— তোমার সাথে কথা বলাই বেকার!
অদ্রি তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
— সেটাই। যাইহোক, আপনাকে কিছু দেওয়ার ছিলো।
— কি?
অদ্রি সাথে করে আনা খামটা সামনে বাড়িয়ে দেয়। ধ্রুব সেটা নিয়ে খুলতে যাবে তখনই অদ্রি থামিয়ে দিয়ে বলে,
— এখন না, আমি রুম থেকে বেরিয়ে গেলে খুলবেন। ওকে?
ধ্রুব বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— কেন?
অদ্রি শান্ত স্বরে বলল,
— কারণ খামটা দেখলে আপনি এক্ষুনি রেগে যাবেন। আমি আপনার সেই রাগী চেহারাটা দেখতে চাচ্ছি না। রাতে না ঘুমিয়ে চেহারার যে বেহাল দশা করেছেন তাতে রাগ করলে আপনাকে ভয়ংকর লাগবে।

বলে অদ্রি চলে যায়। ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা কি ধাতু দিয়ে তৈরী? এভাবে কথা বলে কেউ? ধ্রুব তো ওর জন্যই আজকাল রাতে কম ঘুমায়! নয়তো সে রাতজাগা অদ্রির এলোমেলো চেহারা, হেঁটে হেঁটে পড়া, চাঁদ দেখা, গভীর রাতে বারান্দায় বসে চা খাওয়ারত অদ্রিকে দেখা থেকে মিস করে ফেলতো। এইযে, ধ্রুব’র চোখের নিচে ডার্ক-সার্কেল পড়েছে; সেটা তো অদ্রির জন্যই! ধ্রুব ভাবনার প্রহর কাটিয়ে বিছানায় বসে। হাতে থাকা খামটা সময় নিয়ে খুলতেই ওর চক্ষু চড়ক গাছ হয়ে যায়।

[ কি হতে পারে?]

চলবে…