বিয়ে পর্ব-৩২

0
716

#বিয়ে
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩২

বাড়িতে আজ মেহমান কম, হুল্লোড় পরিবেশ নেই।
ফ্লোরা অসুস্থ, ঐশী আদিবার শ্বশুরবাড়ি থাকায় অদ্রিকে নাস্তা করতে হলো একা একা! বেশিকিছুই খেতে পারলো না, মাথা ধরে আছে। কোনোমতে নাস্তা করে ফ্লোরার ঘরে গেলো। দেখলো রুখসাত জাহান চিন্তিত ভঙ্গিতে ফ্লোরাকে খাইয়ে দিচ্ছেন, ওর চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে আছে। ভোর থেকে নাকি আবার পেটব্যথা শুরু হয়েছে। পরে শায়লার কাছ থেকে অদ্রি জানতে পারলো ওরা আজই ফিরে যাচ্ছে। এখন কিছুদিন ওরা ওদের ফুফুর বাসায় বেড়াবে। ফ্লোরা এখানের পরিবেশ আর খাদ্যের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না। অদ্রির মন বিষন্ন হয়ে গেলো। নিজেকে একা একা মনে হলো। এতোদিনে ওর সাথে ফ্লোরার বেশ ভালো বন্ডিং হয়ে গেছে।
দুপুরের দিকে ফ্লোরা আর রুখসাত জাহানকে নিতে গাড়ি পাঠালেন নাজমুল সাহেব। রুখসাত জাহান, ফ্লোরা বাড়ির সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলো। রুখসাত জাহান শায়লাকে বললেন,
— এইবার তো বউ নেওয়া হলো না, পরেরবার এসে আমি অবশ্যই ছেলের বউ নিয়ে যাবো।
শায়লা হেসে বললেন,
— অবশ্যই।
এদ্রিকে ফ্লোরা অদ্রিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে
কাঁদতে বলল,
— মিস ইউ সো মাচ…
অদ্রি বলল,
— মি টু। যাবার আগে দেখা করে যেও…
— অভিয়েসলি, আমাকে ভুলে যেও না।
অদ্রি হেসে বলল,
— মোটেও না।
ফ্লোরা এবার নিজের চোখ মুছে নিয়ে ধ্রুবকে কাছে ডাকলো। ধ্রুব আসতেই ফ্লোরা দু’জনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— তোমরা এবার নিজের বন্ডিংটা স্ট্রং করো। তাহলে খুব হ্যাপি কাপল হবে দেখো…
অদ্রি শুধু হাসার চেষ্টা করলো। ফ্লোরাদের গাড়ি স্টার্ট দিলো। বাড়ির সবাই ভেতরে চলে গেছে ততক্ষণে। গাড়িটা যতদূর অবধি দেখা যায় অদ্রি তাকিয়ে
দেখলো সেটাকে। ধ্রুব ওর থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো। ও হালকা কাশি দিয়ে অদ্রির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে বলল,
— কথা ছিলো তোমার সাথে…

অদ্রি ওর সাথে কথা বললো না, চলে এলো। ফাঁকা বাড়িতে কথা বলার মতো মানুষ নেই। অদ্রি রোকেয়ার ঘরে যায়, ওকে দেখে রোকেয়া বেগম হাসলেন। বললেন,
— কি ব্যাপার? সক্কাল সক্কাল বুড়ির ঘরে যে?
অদ্রি মুখ গোঁজ করে বলল,
— আমি একটু ঘুমাই তোমার এখানে?
রোকেয়া বেগম টিপ্পনী কেটে বললেন,
— রাতে ঘুমাস নাই? আমার কালাচাঁনে কিছু করছে নাকি?
অদ্রি অস্বস্তি নিয়ে বলল,
— তেমন কিছু না। আমার ভীষণ মাথাব্যথা করছে…
রোকেয়া বেগম নিজের পাশ থেকে বালিশ সরিয়ে অদ্রিকে জায়গা করে দিলেন। অদ্রি গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়লো। দু-চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করতে করতে জিজ্ঞেস করলো,
— আচ্ছা নানু, ধরো তোমার অনুমতি ছাড়া তোমার সাথে কেউ এমন কিছু করেছে, যেটা তুমি তার থেকে আশা করোনি। তুমি কি তাকে মাফ করবে?
রোকেয়া বেগম একটু ক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
— দেখতে হইবো সেই মানুষটা কেডা। যদি মনের মানুষ হয়, তাইলে দ্বিতীয়বার ভাইবা দেখমু কি করন যায়। আর যদি তা না হয় তাইলে ক্ষমা করনের আগে দশবার ভাবতে হইবো। কেন? তোর সাথে কে কি করছে? আমারে ক…
অদ্রি মন হালকা হলো। হাসার চেষ্টা করে বলল,
— এমনিই জিজ্ঞেস করছিলাম!
রোকেয়া বেগম বললেন,
— অহ, ঘুমা তাইলে…

কয়েক ঘন্টা পেরিয়ে গেলো। ধ্রুব এসে রোকেয়ার ঘরে হাজির। ভয় পেয়ে গেছিলো, অদ্রি না আবার রাগ করে কোথাও চলে যায়! সারা বাড়ি খুঁজে এখানে এসে পেয়ে ও আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা ফেললো এবারে। রোকেয়া বেগম বসে কোরআন শরিফ পড়ছিলেন। নাতিকে দেখে উজ্জ্বল হেসে বললেন,
— কি পাখিরে খুঁজতে আইছো নাকি?
ধ্রুব বলল,
— না মানে এমনি। ও কি ঘুমাচ্ছে?
— হ।
— থাকুক তাহলে। একটু দেখো…
রোকেয়া বেগম ভ্রু কুঁচকালেন। এরপর ধ্রুবকে নিজের কাছে ডাকলেন। নমনীয় স্বরে বললেন,
–বউরে একদম কষ্ট দিও না ভাই। মা হারা মাইয়া, বাপেও খোঁজ নেয় না, এহন তো তুমিই সব। তুমি কষ্ট দিলে ও যাইবো কই? নিজেগো মইধ্যে ঝামেলা হইলে
নিজেরাই মিটাই নিও…
ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। রোকেয়া বেগমের বিছানার পাশে একটা টুল টেনে বসলো। ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
— তুমি সবকিছু বুঝে যাও কীভাবে?
রোকেয়া বেগম আপ্লূত গলায় বললেন,
— ষাট বছরের সংসার জীবনে কতকিছুই তো
দেখলাম ভাই। এহন কারো মুখ দেখলেই বুঝবার পারি গন্ডগোল আছে। কষ্ট দিও না বউরে…
ধ্রুব নির্লিপ্ত স্বরে আনমনে বলে,
— কষ্ট দিবো না…
— অহন কও, তোমাগো মইধ্যে কি নিয়া ঝামেলা?
ধ্রুব ইতস্তত করলো বলতে। এসব কি আর বলা যায় নাকি যে একটা উড়ন্ত ফোন পেয়ে ও অদ্রির ওপর চড়াও হয়েছিলো? সেজন্য ঠোঁটে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করে বলল,
— কিচ্ছু নিয়ে না, এমনিই ছোট্ট একটা বিষয়ে ওর অভিমান হয়েছে। আমি ঠিক ওর অভিমান ভাঙিয়ে দেবো…
রোকেয়া বেগম মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন,
— স্বামী-স্ত্রীর দূরত্ব ঠিক না। শয়তানে আইসা ঘর ভাইঙা দিবো।
ধ্রুব মনে মনে বলল, শয়তান তো অলরেডি তার
কাজ করে দিয়েছে।

সন্ধ্যাবেলা! বিছানার ওপর ছড়িয়ে আছে একগাদা জামাকাপড়। অদ্রি শায়লাকে তার কাপড়
গোছানোতে সাহায্য করছে। অদ্রি সারাদিনে
একবারও ঘরে পা না রাখায় ধ্রুব’র কিছুই ভালো লাগছে না। এদিকে অদ্রি ওকে কিছু বলার সুযোগই দিচ্ছে না। শায়লার ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ও হাজারো চিন্তায় মগ্ন ছিলো। একপর্যায়ে শায়লা ওকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
— ভেতরে না এসে দরজায় দাঁড়িয়ে কেন?
ধ্রুব ভেতরে ঢুকলো। অদ্রি মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে ঘুরে নিজেকে ব্যস্ত দেখানোর চেষ্টা করলো। ধ্রুব গম্ভীর হয়ে বলল,
— আমি বাড়ি ফিরতে চাই।
শায়লা কাপড় ভাঁজ করতে করতে ভ্রু কুঁচকালেন,
— কেন?
— প্রশ্ন করো না, আই ওয়ান্ট জাস্ট লিভ..জিজ্ঞেস করতে এসেছি তুমিও কি যাবে নাকি আরও থাকতে চাও?
শায়লা ছেলেকে ঘাঁটালেন না। ওর গলার স্বর শুনেই বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা হয়েছে। তিনি অবাক হয়ে বললেন,
— আমি মানে? অদ্রিও তো আছে… ওকে নিয়ে আরও কিছুদিন থাকবো। আবার কখন আসি তার তো ঠিক নেই।
ধ্রুব রুক্ষ স্বরে বলল,
— না, ও আমার সাথে যাবে।
অদ্রি স্তম্ভিত হয়ে ওর দিকে তাকালো। ধ্রুব তাতে পাত্তা দিলো না। শায়লা আড়চোখে দুজনকে দেখলেন। বুঝতে পারলেন না ঘটনা কি! নিজের সিদ্ধান্ত বদল করে বললেন,
— তাহলে আমিও চলে যাবো।
— তুমি চাইলে থাকতে পারো…
— না। তোমার বাবার খাওয়াদাওয়ায় সমস্যা হচ্ছে। দেখলে না বিয়ের দিন, দু’দিন বাড়ি নেই, এরমধ্যে নিজে শুকিয়ে কাঠ..
ধ্রুব দিরুক্তি না করে জবাবে বলল,
— ওকে রেডি থেকো!
বলে ধ্রুব বেরিয়ে আসতে নিবে এরমধ্যে হঠাৎ শায়লা হাসানের চোখ পড়লো ধ্রুব’র বামগালে। তিনি
বসা থেকে আঁৎকে ওঠে দাঁড়ালেন। কাছে এসে ছেলের গালের আঁচড়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
— আগে খেয়াল করিনি তো! তোমার হাতেমুখে এসব কি হলো? কে করেছে এমন কাজ? নিশ্চিয়ই কোনো বাচ্চাকে রাগিয়ে দিয়েছিলে…
অদ্রির হাতে থাকা ভাঁজরত কাপড়টা পরে গেলো।শুকনো ঢোক গিললো। দ্বিধান্বিত হয়ে ভাবতে লাগলো।
রাতের ঘটনাগুলো একে একে মানসপটে ভেসে ওঠলো। ধ্রুব ওকে একপলক দেখে নিয়ে বলল,
— আরে ও কিছুনা। কত বাচ্চাই তো আছে, খেলার সময় রেগে আঁচড় দিয়েছে হয়তো! লাগে নি আমার..

অদ্রি কোথা থেকে একটা অয়েন্টমেন্ট নিয়ে এসে
দেখলো ধ্রুব নেই। আন্দাজে ছাদে গেলো। বেঞ্চিতে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে ধ্রুব। অদ্রি চোখমুখ শক্ত করে এগিয়ে গেলো। অয়েন্টমেন্টটা মুখের সামনে ধরে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
— এটা লাগিয়ে নিন…
ধ্রুব বলল,
— লাগবে না।
অদ্রি ভ্রু কুঞ্চন করে রেগে তাকালো ওর দিকে। একপর্যায়ে নিজেই ধ্রুব’র গালে, হাতে যেখানে যেখানে ক্ষত দেখলো সেখানে লাগিয়ে দিলো। ধ্রুব ততক্ষণ নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইলো। অদ্রির গা থেকে ভেসে আসা সুবাস ওকে মাতাল করে দিচ্ছে। ধ্রুব ওর হাত সরিয়ে দিয়ে কোনোমতে বলল,
— হয়েছে।
অদ্রি থামলো। অয়েন্টমেন্টটা ধ্রুবকে ধরিয়ে দিললো।আকাশে মস্ত বড় পূর্ণিমার চাঁদ।। ছাদ থেকে দূরের ধানখেত, গমখেত দেখা যাচ্ছে। আকাশে ভেসে যাচ্ছে কালো মেঘের বিশাল দল। শীতল বাতাসে দুলছে টবে লাগানো ফুলগাছগুলো। নিচ থেকে হাসনাহেনার গন্ধে ভুরভুর করে নাকে লাগছে। হেঁটে হেঁটে পুরো ছাদটা ঘুরে ঘুরে দেখলো। রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দূর থেকে অবলোকন করছিলো রাতে প্রকৃতি। একসময় টের পেলো ধ্রুব থেকে দূরত্ব বজায় রেখে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অদ্রি একপলক ওকে দেখলো। এরপর বলল,
— আপনার ফোনটা দিন…
— কেন?
অদ্রি সচকিত চোখে তাকালো। ধ্রুব নিজের পকেট থেকে ফোনটা বের করে দিলো। অদ্রি হাতে নিয়ে দেখলো ফোন লক করা,
— লকটা?
ধ্রুব ওর হাত থেকে ফোন নিয়ে “Audrizamylove”
লিখে লক খুলে দিলো। অদ্রি দেখতে পেলো না সেটা। ও সোজা কললিস্ট চেক করলো। আননোন নাম্বার থেকে যেসব ফোন এসেছিলো সেগুলো চেক করতে লাগলো। এরপর সব থেকে বেশি যে নাম্বার থেকে
ফোন এসেছে সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। দেখতে চায় কোন ছেলের উল্টাপাল্টা কথায় ধ্রুব ওকে অবিশ্বাস করেছিলো। নাম্বারটা নোট করে নিয়ে
ফোনটা ফিরিয়ে দিলো ধ্রুবকে। এরপর নিজের ফোনে নাম্বারটা তুলতেই রাহাতের নাম্বার শো করলো। অদ্রি বজ্রাহত হয়ে গেলো। ধ্রুবকে জিজ্ঞেস করলো
— আপনাকে রাহাত ফোন দিতো?
ধ্রুব এতক্ষণ ধরে ওর কার্যক্রম দেখছিলো। এবার ভ্রু কুঁচকালো রাহাত নামটা শুনে। উত্তরে বলল,
— আমি জানি না সে কে! কিন্তু তোমার পরিচিতদের কাউকে বলোনি তুমি ম্যারিড? সে তো আমাকে তোমার ভাই ভেবেছে…
অদ্রি বিস্মিত হয়ে বলল,
— এমন প্রশ্ন কখনো ওঠেইনি, আমার সাথে তো ওদের খুব একটা যোগাযোগ নেই। এমনকি ভালো করে জানেও না আমাকে। পড়াশোনার খাতিরে
যাদের সাথে আমার পরিচয় তাদেরকে আমি কেন ব্যক্তিগত জীবনে আনবো? আপনি তো ভাবেন আমি নিজেকে আনম্যারিড পরিচয় দিয়ে ছেলেদের সাথে কথা বলি, তাইনা? ওয়েট…

শেষ কথাটা শুনে ধ্রুব স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এদিকে অদ্রি ক্রুদ্ধ হয়ে রাহাতের নাম্বারে ডায়াল করলো।

অদ্রির নাম্বার থেকে রাহাতের নাম্বারে এই প্রথম ফোন এসেছে। রাহাতের মন ভারি খুশি, তবে ওর বুকের ভেতরে হৃদপিণ্ডটা কেমন রকেটের গতিতে ছুটছে। নিশ্চয়ই ওর ভাই নিশ্চয়ই ওকে কিছু জানিয়েছে, সেজন্যই ফোনটা এসেছে, সেটা ভেবেই রাহাতের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেলো। অদ্রি কি ওকে এক্সেপ্ট করবে? নাকি রিফিউজ? রাহাত দুরুদুরু মন নিয়ে ফোনটা রিসিভ করে স্বাভাবিক গলায় বলল,
— কেমন আছো?
অদ্রি শক্ত গলায় সরাসরি বলল,
— ভালো। আচ্ছা, এতদিন যাকে ফোন দিয়ে নিজের ফিলিংসের কথা জানিয়েছো তুমি কি জানো সে আমার কে হয়?
রাহাত শুকনো গলায় বলল,
— তোমার ভাই।
— ডাফার, হি ইজ মাই হাজব্যান্ড….

রাহাতের মনে হলো ওর কানে কেউ বি’ষ ঢেলে দিয়েছে!

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। বেশি দেরি হয়েছে, দু:খিত। ]

চলবে…..