বিষাদনীড়ে মায়াতরী [৩৪]
প্রভা আফরিন
_
১৯৯৮ সাল, শালুগঞ্জ
কুয়াশামাখা সকালে পুকুরে নেমে পর পর কয়েকটি ডুব দিয়ে নামমাত্র গোসল সারল পালি। ভেজা বসনে উঠে এলো ঘাটের সিড়িতে। মনে হচ্ছে পুকুরের পানি নয়, আকাশ ঝরা শিলাবৃষ্টির হিম শিলাখন্ড চেপে ধরেছে দেহের সর্বত্র। হাত-পা শিউরে উঠে কাঁপুনি দিচ্ছে। দাতে দাতে বারি খাওয়ার জোগাড়। শীতের সকালে ঠান্ডা পানিতে ডোবানোর অপ’রাধে শরীরের প্রতিটি লোমকূপ বি’দ্রো’হ ঘোষণা করে গায়ে কা’টা দিচ্ছে। পালি জামা চিপে পানি ঝরিয়ে ছুটে গেল রান্নাঘরের পেছনের ঘরখানায়।
মেহেরুন বানু গায়ে একখানা মোটা চাদর মুড়ি দিয়ে উনুনের ধারে বসে আগুন পোহাচ্ছিলেন। পালি ভেজা চুল ঝেরে পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি দাতে দাত ঘষলেন,
“টিউবওয়েল থাকতে পুশকুনিতে নামন লাগল ক্যান?”
পালি মুখ কাচুমাচু করে। মেয়েদের পুকুরে নেমে গোসল করা মেহেরুন বানু একদমই পছন্দ করেন না। পোষাক বদলাতে ভেজা গায়ে উঠান মাড়িয়ে রান্নাঘর লাগোয়া ঘরখানায় আসতে হয়। বাড়ির মূল ফটক বেশিরভাগ সময় খোলাই থাকে। পুরুষ মানুষের সামনে পড়ে গেলে আর রক্ষে থাকবে না। পালি বলল,
“গেট লাগানো ছিল।”
“বাড়িতেও পুরুষ মানুষ আছে।”
“আর হবে না।”
পালির গোমড়া মুখ দেখে মেহেরুন বানু দমে গেলেন। আজকের দিনে না বকলেও পারতেন। তবে গলার তেজ কমালেন না। আহ্লাদ দিলেই মেয়েটা পেয়ে বসে। বললেন,
“রোজদিন চুল ভিজাইতে না করছিলাম না? শীতেরদিনে বড়ো চুল সহজে হুকায় না। আক্কেল কবে হইব?”
বিপরীতে পালি এবার অমায়িক একটি হাসি উপহার দেয়। মেহেরুন বানু চুলার সামনে হাত মেলে বললেন,
“হাসি দিলে কাম হইবো না। চুলে গামছা প্যাচায় থো। রইদ আরেকটু কড়া হইলে উঠানে বইয়া হুকাইয়া নিবি।”
পালি মাথা কাত করে গা ঘেঁষে বসে। নানির ওমজড়ানো চাদরের ভেতর শীতল হাতজোড়া ঢুকিয়ে দিয়ে মিনমিন করে বলল,
“ও নানি, আজকে সবাই শাড়ি পরে যাবে। আমি পরব না?”
“সবাই পিনলে তুইও পিনবি।”
“আমার তো শাড়ি নেই।”
“আগে কবি না? এহন নতুন শাড়ি কই পামু?”
“নতুন লাগবে না। বুবুর তো অনেক শাড়ি। বুবুর কাছ থেকে নেই?”
মেহেরুন বানু একটু চুপ রইলেন। এরপর বললেন,
“থাউক, আমি দেখতাছি। তুই রইদে গিয়া মোড়া পাইত্তা ব।”
মেহেরুন বানুর আলমারিতে কারো হাত দেওয়া মানা। এমনকি একই ঘরে থাকা পালিরও। তিনি যক্ষের ধনের মতো আলমারিটা আগলে রাখেন। পালি অবশ্য এ নিয়ে কখনো আগ্রহ দেখায়নি। দামি জিনিসপত্র যেখানে থাকে সেখানে সবার হাত দেওয়া উচিৎও না। তবে আজ একটা চমকপ্রদ ঘটনা ঘটল। মেহেরুন বানু সেই আলমারি থেকে পালিকে একটি শাড়ি বেছে নিতে বললেন। পালি আলমারির সামনে কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে ছিল। সবিস্ময়ে বলল,
“তোমার এতগুলা শাড়ি আছে!”
“তর মায়ের শাড়ি।”
কথাটা শুনে সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল খানিক। মায়ের শাড়ি! তার মায়ের গা ছোঁয়ানো! পালি চোখদুটি জলে ভরে এলো। মেহেরুন বানু বললেন,
“যেকোনো একটা শাড়ি নিবি। জলদি কর!”
পালি নিঃশব্দে হাত বাড়ালো। তার হাত আটকালো কালো রঙের শাড়িটায়। মেহেরুন বানু বললেন,
“কালা? অন্য রঙ নে।”
পালি অন্য রঙ নিল না। সে শাড়িটা বের করে বুকে চেপে ধরল। মাথা নত করে নাক ডুবিয়ে রাখল অনেকটা সময়। সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কে হানা দেয় ছোট্টো একটি চর। কিছু খড়, ছন ও মাটির বাড়ি-ঘর। কাঁঠাল গাছ, ঝিঙের মাচা, কচু পাতা। খড়ের ছাউনি দেওয়া উন্মুক্ত রান্নাঘর, তার চালায় লতিয়ে আছে লাউয়ের ডগা, কুমড়োর ফুল। এক খন্ড মাটিসহ তাদের বুকে ধরে রাখা বিশাল এক মমমতাময়ী নদী। চারধারে বালুময় তীর। নদীতে ভাসে ছোট্টো ডিঙি নৌকা। তার গলুইয়ে পা দুলিয়ে বসে আছে পালি। একটি হাতে শক্ত করে ধরে আছে মায়ের হাত। অপর হাতে বুকে চেপে ধরেছে পাঠ্যবই। অপরপ্রান্তে বৈঠা বাইছে হামিদ চাচা। গন্তব্য, টালিপাড়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়। রূপালি জলের বুকে ভেসে ভেসে পালির নিজেকে মনে হয় উড়ন্ত এক পাখি। সেই মুক্ত পাখিটি এখন স্মৃতির খা’চায় ডানা ঝাপটায়। পালির চোখের পানিতে মায়ের শাড়ি ভিজে যায়। কালো শাড়িতে নাক ডুবানো কালো মেয়েটির শুভ্র কান্না দেখে মেহেরুন বানুর মনে হলো এটি ওনার দেখা জগতের সবচেয়ে মূল্যবান এক দৃশ্য। তিনি চোখ মুছিয়ে নরম গলায় বললেন,
“বুবুর কাছে যা। শাড়িডা সুন্দর কইরা পিন্দায় দিতে কবি।”
চিত্রা পালিকে শাড়ি পরাল যত্ন করে। কুচি ঠিক করে দিতে দিতে বলল,
“জানিস, ওই আলমারির শাড়িগুলো ছোটোবেলা থেকে কত চেয়েছি দাদির কাছে? কক্ষনো ছুঁতেও দেয়নি। কত রা’গ যে করেছি! এখন মনে হচ্ছে ভালোই হয়েছে দেয়নি। ওগুলোতে শুধু তোর অধিকার।”
চিত্রা উঠে দাঁড়ালো। তার গায়ে ভারী সোয়েটার। শীতের শুষ্কতায় শুভ্র মুখখানি মলিন দেখাচ্ছে। চোখের নিচে কালির ছাপ। পালি হাত ধরে বলল,
“বুবু, আজকে চলো আমার সাথে।”
“ধুর পাগল! তোর বন্ধুবান্ধবের মধ্যে গিয়ে আমি কী করব?”
“আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরবে। সারাদিন বাড়িতে বসে বই পড়তে, আর মামির সঙ্গে ঝ’গড়া করতে ভালো লাগে তোমার?”
চিত্রা হাসল। পালির ঘন চুলে চিরুনি ডুবিয়ে বলল,
“আমার কথা ভাবিস না তো। আজ তোর স্কুল জীবনের শেষদিন। এরপর সব বন্ধুবান্ধবদের আর একসাথে পাবি না। দেখাও হবে না। সবার সঙ্গে সুন্দর সময় কাটাবি। মনমালিন্য থাকলে নিজে থেকে এগিয়ে শেষ করে নিবি।”
“তুমি তো নাও না।”
ফট করে কথাটা বলেই সে চুপসে গেল। চিত্রা সে কথার বিপরীতে শুকনো হাসি দিলো শুধু।
সকালের উষ্ণ কম্বলের মতো সূর্যটাকে পিঠ দেখিয়ে উঠানে চেয়ার পেতে বসেছেন রবিউল খন্দকার। শরীরটা ভীষণ মেজমেজ করছে। পালি তৈরি হয়ে মামার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ওকে দেখে রবিউল খন্দকার আপ্লুত হলেন। আপ্লুত হলেন মেহেরুন বানুও। সেই বাল্যকালে চিত্রার গায়ে হলুদে শাড়ি পরে পুটলি হয়ে টইটই করে ঘুরেছিল মেয়েটা। এরপর আজ আবারো শাড়ি পরেছে। তবে আজ তাকে বালিকা নয়, নারী মনে হচ্ছে। তার দীঘল দেহের বাঁকে বাঁকে নিমগ্ন যৌবনের ছোঁয়া। মেয়েটা চোখের সামনেই সন্তর্পণে বড়ো হয়ে গেল! নাকি আজই তাকে বড়ো লাগছে! নিবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হঠাৎই মেহেরুন বানুর চোখ ছলছল করে ওঠে। তিনি নিজেকে সামলে বললেন,
“মামার ধারে বয়। নাশতা দিতাছি, খাইয়া যাবি।”
পালি মোড়া পেতে মামার কাছে বসল। ঠিক সেই মুহূর্তে হিমাদ আসে উঠানে। তেইশ বছরের যুবকের বলিষ্ঠ দেহ পালির ছিপছিপে দেহখানি সূর্যের আড়াল করে ফেলল। পালি ঠোঁট উলটে বলল,
“একটু সরে দাঁড়াও, হিমাদ ভাই।”
হিমাদ যেন মাত্রই পালিকে দৃষ্টিগোচর করল এমন ভঙ্গিতে এক ভ্রু উঁচু করে তাকায়। খানিক সরে গিয়ে আব্বাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আব্বা, আমার একটা মোটরসাইকেল চাই।”
“মোটরসাইকেল?” রবিউল খন্দকার ঠিক শুনলেন কিনা যাচাই করতে প্রশ্ন করলেন। হিমাদ মাথা নাড়িয়ে বলল,
“হু, এখানে এলে যাতায়াত নিয়ে আমার বেশ অসুবিধায় পড়তে হয়। গ্রামে তো আর শহরের মতো তিন-চার চাকার মোটর গাড়ি চলাচল করে না। রাস্তা বা সুবিধা কোনোটাই নেই। কিন্তু মোটরসাইকেল অনায়াসে চলাচল করতে পারবে।”
এনাম হাট থেকে ফিরে বাজার নামিয়েছে সবে। হিমাদের কথা শুনে হেসে বলল,
“শহরে থাইক্কা হিমাদ আব্বার শইল্যে মরচে পইড়া গেছে। গাড়ি ছাড়া তার চলব না।”
রবিউল খন্দকারের কপালে ভাজ পড়ল। বললেন,
“কিন্তু ওইসব মোটরযানে তো অহরহ দু’র্ঘ’টনা হয়। শহরের পিচঢালাই দেওয়া রাস্তা-ই নিরাপদ না।গেরামের ভা’ঙ্গা রাস্তায় তুই চালাইতে পারবি?”
“এসব চালানো কঠিন কিছু না। আপনিও পারবেন।”
জুলেখা নাশতা হাতে রে রে করে ছুটে এলো। বলল,
“খান্ত দেন। আমার একটাই ছেড়া। তুফানের বেগে ছুডা গাড়ি চালাইয়া বিপদ বাধানের কোনো দরকার নাই।”
হিমাদ বিরক্ত হলো। এখন শুরু হবে মায়ের তাকে নিয়ে আহাজারি। সেসব এড়াতে সে আগেভাগেই প্রস্থান করল। জুলেখার চোখ এবার পালির ওপর পড়ে। ভ্রু কুঞ্চন করে বলল,
“আর কোনো শাড়ি আছিলো না?”
“কেন মামি? খারাপ লাগছে?”
“কালা শাড়িতে মানায় ফরসা মাইনষেরে। তুই অন্য রঙ পিনতি।”
পালি মুখ নামিয়ে নিল। রবিউল খন্দকার বললেন,
“যেইডা ভাল্লাগছে, পিনছে। এত কথার কি আছে?”
“আমি কী খারাপ কিছু কইলাম?”
“না, খালি বেশি কথা কও।”
পালি নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করল। বিপত্তি বাধল স্কুলে রওনা দিতে গিয়ে। শাড়ি পরে সাইকেল কীভাবে চালাবে? এ অসম্ভব। হেটে গেলে অনেকটা দেরি হয়ে যাবে। এমনিতেই বেলা হয়ে গেছে। মামাকে না পেয়ে সে হিমাদের কাছে গেল। দরজায় টোকা দিতেই হিমাদ ভারী স্বরে বলল,
“কী চাই?”
“আমাকে একটু তোমার সাইকেলে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসবে?”
“তোর সাইকেল কই?”
পালি মাথা নিচু করে নেয়। মেঝেতে পায়ের নখ খুটে ইতস্তত করে বলল,
“ওই আসলে… চালাব না আজ। একটা ভ্যান ডেকে দিলেও হবে।”
হিমাদ কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইল। এরপর সপাটে উত্তর দিলো,
“পারব না। অন্য কাউকে বল।”
পালি মুখ গোমড়া করে উঠানে চলে গেল। সে আজও ভেবে পায় না হিমাদ ভাই মাঝে মাঝে কেন তার সঙ্গে এমন রূ’ঢ় আচরণ করে।
পালিকে স্কুলে পৌঁছে দিলো এনাম। দিনগুলো এখন বইয়ে মুখ গুজেই কা’টছে তার। আজকে অবশ্য ব্যতিক্রম। আজ তাদের স্কুল জীবনের বিদায় সম্ভাষণ। এরপর আর স্কুলে আসা হবে না। এ মাসেই ম্যাট্রিক পরীক্ষা আরম্ভ হবে।
পালিকে দেখা মাত্রই নিলয় প্রায় দৌড়ে এলো। মাথায় হাত দিয়ে বলল,
“ওরেব্বাস! পে’ত্নী আজকে শাকচু’ন্নি সাজছে দেখি!”
পালি চোখ গরম করে তাকায়। কপট রাগের ভঙ্গিতে নাক ফুলিয়ে বলে,
“আবার শুরু করলি?”
নিলয় সে কথা গায়ে মাখে না,
“দিনের বেলায় রাত নামছে। আমার কেমন ঘুম লাগতেছে।”
“আমি আমার গায়ের রঙ সম্পর্কে পূঙ্খানুপুঙ্খভাবে অবগত। তোকে উপমা দিয়ে বোঝাতে হবে না।”
“হুড় ছেড়ি! আমি কী তোর পাড়ার চাচি, যে গায়ের রঙ নিয়ে চিউচিউ করব?”
“পাড়ার চাচিদের কথায় পাত্তা দেওয়া বা না দেওয়াতে সত্যি বদলাবে না।”
“আমার কথায় মন খারাপ করলি নাকি রে?”
“তোর কথাকে কেউ আদৌ গুরুত্ব দেয় কিনা বলতে পারবি? আমি তো দেই না।”
“এই না হলো কথা! ভেতরে চল। আজ স্যারদের মা’রের হাত থেকে চিরতরে রক্ষা পাওয়ার খুশিতে আমি হাসব আর তুই আবেগের পুকুর বানিয়ে কাঁদবি।”
চলবে…
বিষাদনীড়ে মায়াতরী [৩৫]
প্রভা আফরিন
_
বেলা তখন বিকেলগামী। সূর্যের তাপ ম্লান হতে শুরু করেছে। বিদায় সম্ভাষণ শেষে আবেগঘন মন নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় আবারো বিপ’ত্তি বাধল। পালি যাবে কী করে? এনাম মামাকে তো বলাই হয়নি নিতে আসতে। নিলয় সাইকেলে উঠে ওর সামনে এসে বলল,
“চল, আমি পৌঁছে দেই।”
পালির ক্লান্ত মুখটায় আত’ঙ্ক ধরা দিলো ক্ষণেই। এক হাতের তালুতে অন্য হাত মু’ষ্টিবদ্ধ করে কি’ল দেওয়ার ইশারা করে বলল,
“নানি দেখলে কপালে শনি আছে।”
“বাড়ির মোড়ে ঢোকার আগেই নামিয়ে দেব নাহয়!”
বুদ্ধিটা মন্দ না। তবুও দ্বি’ধা আছেই। পালি ঠোঁট উল্টে বলল,
“আর বাজারের মানুষ?”
“বাজারের আগে নামিয়ে দেব, তুই হেটে বাজার পেরিয়ে ঘাটের পথে যাবি। ওদিকে মানুষ কম থাকে। বড়ো সড়ক দিয়ে যাব না।”
এবার পালি সম্মত হলো। মনে মনে ঠিক করল শাড়ি পরে আর কক্ষনো স্কুলে আসবে না। সে নিলয়ের সাইকেলে চেপে বসতেই নিলয় শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমরা কেন বড়ো হলামরে?”
“প্রকৃতির নিয়মে।”
“বড়ো হওয়া একদমই ভালো না। চেনা জগতটা জটিল হতে শুরু করে।”
পালির মন খারাপ হলো। নানি তাকে ছেলেদের থেকে দূরত্ব রাখতে বলেন। এমনকি নিলয়ের থেকেও। পাড়ার মানুষ দেখলেও আড়ালে আবডালে কপাল কুচকায়। তারওপর তার সাইকেল চালানো নিয়ে মন্তব্য তো আছেই। মেহেরুন বানুর প্রবল আপত্তির মুখেও মামা ও বুবুর সমর্থনে সে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে এসেছে। তবে সেটা স্কুল পর্যন্তই সহনীয়। পালি বিড়বিড় করে বলল,
“প্রকৃতিই আসলে জটিল।”
সাইকেলের গতির সাথে ধে’য়ে আসা বাতাসে পালি কুঁ’কড়ে ওঠে প্রতিক্ষণে। এই হাড় কাঁ’পানো শীতে একটা চাদর সঙ্গে না আনা বোকামি ব্যতীত কিছু নয়। শাড়ির আঁচল কী শীত ঠেকাতে পারে? বাজারের সামনে গিয়ে যথারিতি সে নেমে পড়ল। নিলয় সাইকেল নিয়ে ছোটো বাজারটি পেরিয়ে চলে গেল ঘাটে। পালি পায়ে হেটে বাজারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হুট করে হিমাদের সামনে পড়ে গেল। বলার অপেক্ষা রাখে না সে ভড়কেছে। হিমাদ ভ্রু কুচকে বলল,
“হেটে ফিরছিস?”
পালি আমতা আমতা করে উলটোপালটা মাথা নাড়ালো। যা হ্যাঁ বা না কোনটা নির্দেশ করে হিমাদ বুঝল না। সে গম্ভীর গলায় বলল,
“বেলা পড়ে গেছে। আয়, ভ্যান ডেকে দেই।”
পালি তড়িঘড়ি করে বলল,
“লাগবে না। আমার বন্ধু সামনে অপেক্ষা করবে। ওর সঙ্গে গল্প করতে করতে চলে যাব।”
হিমাদ আর কিছুই বলল না। নির্লিপ্ত চালে বাজারে মিলিয়ে গেল। পালি সেদিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে, “নিষেধ করেছে বলে আরেকবার সাধবে না?অদ্ভুত!”
পালিকে মোড়ের মাথায় নামিয়ে নিলয় চলে গেল। পালি সামনের পথটা হেটে বাড়িতে ঢুকতেই মামির উত্ত’প্ত কণ্ঠস্বর কর্ণগোচর হলো। আবার বেধেছে বুবুর সাথে! সে তড়িঘড়ি করে উঠান পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকল। জানতে পারল নিবাসপুর থেকে লোক এসেছিল। তারা চিত্রাকে ফিরিয়ে নিতে চায়। সংবাদটি নতুন নয়। এর আগেও বহুবার এসেছে। চিত্রা প্রতিবারই মৌনতা অবলম্বন করেছে। নির্লিপ্ততায় ডুবিয়ে রেখেছে নিজেকে। যেন জগতের কারো সঙ্গেই তার কোনো লেনাদেনা নেই। সেই থেকে জুলেখা খেপেছে। বা’জখাঁই কণ্ঠে বললেন,
“মাইয়া মাইনষের এত দেমা’গ থাকব ক্যান? জামাইর বাড়ির মানুষ যে তরে ফিরাইয়া নিতে চায় এইডা তো সাত কপালের ভাগ্য।”
চিত্রা কোনো কথা বলল না। আগের সেই চিত্রা হলে এতক্ষণে সমান আওয়াজে প্রতিটা কথার উত্তর দিত। কিন্তু বয়সের সঙ্গে তার সহ্য ক্ষমতাও বাড়ছে। বাইশ বছরের জীবনে কম তো সইতে হলো না! জুলেখা এবার জে’দের সঙ্গে কেঁদে ফেলেন। বলেন,
“পাঁচটা মাসও হউড় বাড়িত টিকতে পারল না। এই মাইয়ার লইগ্যা আমার রাইতের ঘুমডা পর্যন্ত ম’ইরা গেছে। নিজের সুখ তো ধইরা রাখতে পারলই না, আমাগো সুখও কাইড়া নিছে। এতকিছুর পরেও হেরা নিজেরতন নিতে আইতাছে যহন এত দেমা’গ কিয়ের?”
চিত্রা উঠে দাঁড়ালো। বলল,
“কাদের কাছে ফিরে যেতে বলছো? যারা আমায় ঘরভর্তি লোকের সামনে কল’ঙ্কিত করেছিল?”
জুলেখা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই চিত্রা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পালিও তার পিছু নেয়।
অস্তমিত সূর্যটিকে দেখতে লাগছে লাল টিপের মতো। পশ্চিম কোণের মেঘেরা তার লালিমা মেখে ভাসছে। দূরের ঘন ঝোপ থেকে কুয়াশা ধে’য়ে আসছে। খানিক বাদেই চারপাশ ঢেকে যাবে ধোঁয়ায়। ছাদে বেশ ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। পালি বুবুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে গোমড়া মুখে বলল,
“আমি কলেজে উঠলে এখান থেকে চলে যাব। তুমি আর আমি দূরে গিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকব। সেখানে তোমায় কেউ কথা শোনাতে পারবে না বুবু।”
চিত্রা মলিন হাসে। আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাসী গলায় বলে,
“এক নিষ্ঠুর মানুষ তার ভাগের সব সুখ আমার নামে দলিল করেছিল। অথচ সে জানতোই না বিধাতা তার কপালে কোনো সুখই লেখেননি।”
পালি বুবুর ঘাড়ে মুখ গুজে রইল। চিত্রা তাকে আরেকটু শক্ত করে ধরে বলল,
“তোকে অনেক বড়ো হতে হবে। অনেক শক্ত হতে হবে।”
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় পালিকে চেপে ধরলেন মেহেরুন বানু। তিনি শীতল চক্ষুতে তাকিয়ে বললেন,
“তুই আইজ কার লগে ইস্কুলেতন আইছোস?”
পালি ভড়কে গেল। নিজের অভিব্যক্তি লুকিয়ে বলল,
“হঠাৎ এই কথা?”
“যা জিগাইছি উত্তর দে।”
পালি নিরুত্তর। মিথ্যা বলতে তার জড়তা কাজ করে। মেহেরুন বানু ওর দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে রইলেন। পালির চোখদুটি আয়নার মতো স্বচ্ছ। সেখানে তার মনের সমস্ত অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে প্রতিবিম্ব হয়ে। এই চোখের গভীরতা যে বুঝতে পারে তার কাছে পালি হাতের তালুর মতোই পরিচিত। মেহেরুন বানুর কাছে এই মেয়েটি এখন হাতের তালুর মতোই চেনা। চেনা তার প্রতিটা গোপন অভিব্যক্তি। তিনি ক’র্কশ স্বরে বললেন,
“আমি নিষেধ করছিলাম না চেয়ারম্যানের ছেড়ার লগে বেশি মিশবি না?”
পালি তুতলে ওঠে,
“ফেরার জন্য কিছু পাচ্ছিলাম না তাই…”
“তাই হের পিছে উইঠ্যা আইতে হইব? বিয়ার বয়স হইতাছে এহনো আন্দাজ হয় নাই? মাইনষে দেখলে ভালা কইব?”
“আমরা ছোটোবেলার বন্ধু। তুমি তো ওকে চেনো।”
“হোক বন্ধু। খেলার বয়স পার হইছে তগো। এহন আর ছুডু নাই। যুবতী হইছোস, ওই ছেড়াও বড়ো হইছে। কোনোকিছু ঘটতে কতক্ষণ?”
সঙ্কোচে পালির কান-গাল গরম হয়ে যায়। চোখ ছলছল করে। মেহেরুন বানু বললেন,
“কথায় কথায় ফ্যাচফ্যাচ করবি না। আর কোনোদিন জানি না হুনি এডি। দরকারে কথা কইতে হইলে দূরত্ব রাইখ্যা কবি।”
তিনি পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন। পালি মনে মনে আওড়ায়,
“তুই ঠিকই বলেছিস নিলয়। বড়ো হওয়া একদম ভালো না।”
_____________
সকালের পেলব রোদে বসে গুনগুন করে পড়ছিলো পালি। বুবু তার পড়ার রুটিন বানিয়ে দিয়েছে। চিত্রা এক বছর গ্যাপ দিয়ে পুনরায় পড়াশোনা শুরু করেছিল। এখন স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যায়নরত আছে। পালিকে সেই আপাতত পড়ায়। হুট করে কারো গলা শুনে পালি পড়া থামালো। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল চেয়ারম্যান বদরুল আলমের বউ ও মেয়ে এসেছে। জুলেখা তাদের দেখে ব্যস্ত হলেন। পালিকে বললেন তাদের জন্য উঠানে চেয়ার পেতে দিতে। পালি ছুটে গিয়ে বসার ঘর থেকে চেয়ার বের করে দেয়। চেয়ারম্যান এর মেয়ের নাম টিয়া। সে নিলয়ের বড়ো বোন। দেখতে বেশ মিষ্টি। পালিরও মেয়েটাকে বেশ লাগে। টিয়া পালিকে দেখে হেসে বলল,
“ভালো আছো আম্রপালি?”
“খুব ভালো আছি আপু।”
“পড়ছিলে তো!”
“হ্যাঁ।”
“আমাদের নিলয়কে তো পড়তে বসানোই মুশকিল। পাশ করলে হয়।”
নিলয়ের মায়ের বোধহয় ছেলের নিন্দা সহ্য হলো না। তিনি বললেন,
“পুরুষ মাইনষের মেধা মাইয়া মাইনষের থাইকা এমনেই বেশি। আমাগো নিলয় একটু পড়লেই ভালা নম্বর তুলতে পারে।”
পালি তাদের কথা শুনে হাসল। সরে গিয়ে আবারো বইয়ে মুখ গুজল সে। নিলয়ের মা পালিকে ভালোমতো দেখেন। জুলেখাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
“মাইয়ার গায়ের রঙ এক্কেরে ময়লা। মায়ের ছিটাফোঁটা রঙও পায় নাই।”
“বাপের মতোন হইছে।”
“বাপে তো তুমগো উপরে দিয়া দিছে। ভালা ঘরে বিয়া দিতে মোটা যৌতুক দেওয়া লাগব।”
জুলেখা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“কী আর করা। এতবছর পালতাছি যহন, যৌতুকের ডরে তো আর খারাপ ঘরে দিতে পারমু না।”
পালি বইয়ে চোখ রেখে কথাগুলো সবই শুনতে পেল। মাথা ঝাকিয়ে সে আবারো পড়ায় মনোযোগ দেয়।
টিয়া বড়োদের কথার মাঝে বলে উঠল,
“হিমাদ ভাই বাসায় নেই?”
জুলেখা বললেন,
“আছে তো। এহনো ঘুমায়। মেলাদিন পর আইছে এইবার। ঢাকা শহরের হোস্টেলে থাইক্যা কী আর বাড়ির আরাম পায়? হেরলইগ্যা বেলা কইরা ঘুমায়।”
“ছেড়ারে তো দূরে ফালাইয়া রাখছো বছরভর। দেইখ্যো আবার কোনো শহুইরা মাইয়া বিয়া কইরা ওইহানেই স্থায়ী হইয়া যায় কিনা। তহন কিন্তু কাইন্দাও ছেড়ারে বাড়ির মুখী করতে পারবা না।”
“এই ডরেই তো থাকি সব সময়। গেরামে থাকব, বাপের জায়গা-জমি দেখব। এত লেখাপড়ার কুনু দরকার আছে? হেরা বাপ-ব্যাটা আমার কথারে পাত্তাই দেয় না।”
ওনাদের কথার মাঝেই টিয়া উঠে আশেপাশে হাটাহাটি শুরু করল। হিমাদ ঘুম চোখে বেরিয়ে এলো খানিক বাদেই। টিয়ার সামনে পড়ে বাসিমুখে একটা হাসি দিয়ে বলল,
“ভালো আছো টিয়া?”
টিয়া নতমুখে মাথা ঝাকায়। মিষ্টি হেসে বলে,
“আপনি দেখি আগের চেয়ে শুকিয়ে গেছেন।”
“ভেবো না, মায়ের হাতে খেয়েদেয়ে মোটা হয়ে যাব।”
“আমাদের বাড়ির দিকে তো একবারও গেলেন না এবার!”
“দুদিন হলো এসেছি, বাড়িতেই আছি। যাব সময় করে। তুমি বসো।”
হিমাদ চলে গেল হাত-মুখ ধুতে। ফিরে এসে পালিকে দরজার সামনে বই বুকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থামল সে। বলল,
“কাল যেন কোন বন্ধুর সাইকেলে চেপে ফিরেছিলি?”
পালি অবাক হয়ে তাকায়। বুঝতে অসুবিধা হয় না নানির কানে কে কথাটা তুলেছে। রাগে-দুঃখে তার চোখে জল চলে এলো। সে বলল,
“তোমার সঙ্গে আমার কীসের শত্রুতা হিমাদ ভাই? কেন দেখতে পারো না আমাকে?”
হিমাদ সে কথার উত্তর দিলো না। দেওয়ার প্রয়োজনও অনুভব করল না। পালি কিছুক্ষণ উত্তরের আশায় তাকিয়ে থেকে ফের বলল,
“তুমি যে প্রতিবার বাড়ি এসে টিয়া পাখির সাথে উড়ু উড়ু করো, তা কী আমি কাউকে বলেছি?”
পালি বইপত্র নিয়ে ভেতরে চলে গেল। হিমাদ কোমড়ে হাত দিয়ে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
চলবে…
বিষাদনীড়ে মায়াতরী [৩৬]
প্রভা আফরিন
_
“পালি!”
“আপনি?”
“আমাকে ভুলে গেলি?”
“মনে রাখার কথা না কি?”
“অবশ্যই। আমি যে তোর মনের মধ্যেই বাঁচি।”
“মনের মধ্যে বাঁচলে আপনাকে চিনতে পারি না কেন?”
“চিনতে যে মায়া প্রয়োজন।”
“আমার মনে কি তবে মায়া নেই?”
“খুঁজে দেখ। আমি যে তোর ভুলে থাকার প্রয়াস।”
সঙ্গে সঙ্গে পালির নিদ্রা বিচ্ছি’ন্ন হলো। ভারী লেপের উষ্ণতা সরিয়ে উঠে বসল সে। বুক ধ’ড়ফড় করছে। আবারও একই স্বপ্ন দেখল সে! আবারো মনের ভেতর থেকে কেউ একজন ডাকল তাকে! যাকে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না। কণ্ঠস্বরখানিও চেনা যায় না। অথচ পালি তার কথা বোঝে। তার সঙ্গে কথা বলে অবচেতনে। পালির মনে অস্থিরতা ঘিরে ধরে। কাকে চিনতে পারে না সে? কেনই বা সে আসে তার স্বপ্নে? ঘুটঘুটে আঁধারে চোখ মেলে সে কোনো দিকদিশা পায় না। এ কেমন দ’মব’ন্ধকর অনুভূতি?পালি ঢোক গিলল। তার কণ্ঠদেশ পানিশূন্যতায় শুষ্কতা ধারণ করেছে। তীব্র তেষ্টায় বুকের ভেতরটা ফে’টে যাওয়ার উপক্রম। পালি সন্তর্পণে নানিকে ডিঙিয়ে বিছানা ত্যাগ করল। পথ ঠাহর করে বেরিয়ে গেল পানি খেতে। পর পর দুই গ্লাস পানি খেয়েও তার তেষ্টা মিটল না। বুকের ভেতর এখনো কি তীব্র তেষ্টা! কি হা’হাকার! ঘুটঘুটে আঁধারে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে আবিষ্কার করল জগতের সবচেয়ে অসহায় মানুষ হিসেবে।
সিকান্দার এবার গ্রামে আছে বেশ কয়েকমাস যাবত। সাধারণত সে এত মাস গ্রামে থাকে না। গ্রামে কোনো কাজও পায় না। তার খামখেয়ালি স্বভাবের জন্য কেউ কাজে নিতেও চায় না। সিকান্দার আগে যেখানে দিন পনেরো পেরোতেই খাদ্য সংকটে গড়াগড়ি করত, এবার কাজ না করেও বেশ আরাম-আয়েশে চলাফেরা করছে। মাথার গুটিকয়েক চুলে সুগন্ধিযুক্ত গন্ধরাজ তেল মেখে, তাতে চিরুনি চালিয়ে মাঝ বরাবর সিঁথি করে, রঙিন পিরান পরে ঘুরে বেড়ায়। তার এমন বেশভূষা দেখে অনেকেই ঠাট্টা করে বলে, এই বয়সে এসে প্রেমে পড়েছে কিনা। সিকান্দার শুধু মুচকি হাসি দিয়ে এড়িয়ে যায়।
খন্দকার বাড়ির সামনে এসেই তার সাক্ষাৎ হলো পালির সঙ্গে। দূর থেকেই সে খানিক গলা উঁচিয়ে ডাকল,
“রুপালি আম! ও রুপালি আম! হুইন্যা যাও।”
পালির মুখে বিরক্তি নামল। বলল,
“আপনাকে আগেও বলেছি চাচা, আমার নাম আম্রপালি। ডাকতে না পারলে শুধু পালি ডাকুন, এসব ডাকবেন না।”
সিকান্দার দাত বের করে হাসল। ছোটো থাকতে পালিকে তুই করে ডাকত সে। এখন তুমি বলে সমিহ দেখায়। শুধু নামটাই যা বি’কৃত করে ফেলে। বলল,
“তোমার নামখানি তো আমের জাতের। ওই জাতরে আমরা রুপালি আম কইয়াই ডাকি।”
“যে জাতেরই হোক, নামটা এখন একজন মানুষের। শুধু রুপালি বলুন। পালি আরো সহজ। আম আবার কী?”
“আইচ্ছা, আইচ্ছা। রাগ কইরো না।”
“রাগ করিনি। শুধু শুধরে নিতে বললাম।”
“যাইহোউক, তা তোমার বাপের কী খবর? দেহা-সাক্ষাৎ করতে আহেনি?”
পালির থেকে কোনো উত্তর এলো না। সিকান্দার আগ্রহ নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল,
“খরচাপাতি কিছু পাডায়? না কি সবটাই মামার থাইকা নেও?”
“অন্যের ঘরের খবর জেনে আপনার কী দরকার চাচা? আপনার তো খরচ হচ্ছে না।”
চিত্রার কণ্ঠে খানিক থতমত খেয়ে গেল সিকান্দার। চিত্রা ফটক ঠেলে বেরিয়ে পালির পাশাপাশি এসে দাঁড়ায়। সিকান্দার আমতা আমতা করে বলল,
“ও তো এহন আমাগো গেরামেরই মাইয়া। ভালামন্দের খোঁজ-খবর নিতে চাইলাম আরকি।”
চিত্রা দাত বের করে ঝকঝকে একটি হাসি দিয়ে বলল,
“অন্যের হাড়ির তদারকি করতে গিয়ে আপনি যে নিজের হাড়িতেই ফা’টল ধরাচ্ছেন তা কি জানেন চাচা?”
সিকান্দার চমকে তাকিয়ে বলল,
“কী কইবার চাও?”
“নবু চাচার ইনকাম ইদানীং ভালোই বেড়েছে। সেই সুবাদে আপনারও ওদিকে যাতায়াত বেড়েছে শুনলাম? তাছলিমা চাচি ঠিকঠাক যত্ন-আত্তি করছে তো?”
সিকান্দারের চোখ তুলে তাকানোর সাহস হলো না। চিত্রার সঙ্গে কর্মচারী রনির সম্পর্কের ব্যাপারটা যেদিন রবিউল খন্দকারের কানে তুলেছিল সেদিন থেকেই সে চিত্রাকে এড়িয়ে চলে। চিত্রা নিজেও পরবর্তীতে জেনেছিল কার দ্বারা কাজটি সম্পাদিত হয়েছিল। বিনিময়ে সিকান্দার কী হাতিয়ে নিয়েছে সেটাও জানা। ফলে চিত্রা এখন আর যাইহোক লোকটাকে সহজ মানুষ ভাবে না। সিকান্দারও তা বুঝেছে। আজ পালিকে একা দেখে মনের ভেতরটা আবারো খানিক কৌতুহল প্রকাশ করতে নাড়া দিয়েছিল। কিন্তু চিত্রা যে তার আর নবু মাঝির বউ তাছলিমার গোপন অভিসারের ব্যাপারে আঁচ পেয়ে গেছে সেটা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো না। তাকে আরো সাবধান হওয়া উচিৎ ছিল। সিকান্দার নিজেই নিজেকে অ’কথ্য ভাষায় গা’লাগা’ল করল। এরপর কাজের ছুতো দিয়ে দ্রুত পদে স্থান ত্যাগ করল। চিত্রা সেদিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পালির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“মুখে মধু আর অন্তরে বি’ষ মাখানো লোকের থেকে দূরে থাকবি। এদের কাজই অন্যের জীবনের শান্তি বিন’ষ্ট করা। তাদের কথায় মন খারাপ করার কোনো দরকার নেই।”
কিন্তু পালি মন খারাপ হলো। সেই সঙ্গে মাথায় চেপে বসল আব্বার কথা। আসলেই তো! কতগুলো দিন পেরোলো, ছোটো বালিকা পূর্ণ কিশোরী হলো, আব্বা একবারও খোঁজ নিল না! দেখা করতে এলো না! তিনি কী ভুলেই গেছেন যে তার একটি সন্তান এখনো পৃথিবীর বুকে শ্বাস গ্রহণ করছে? পালি সারাটি বেলা উল্টোপাল্টা ভাবনায় মশগুল রইল। পড়াতেও মন বসল না। বিকেলে মেহেরুন বানু যখন দাওয়ায় বসেছেন সবে তখন পালি জিজ্ঞেস করল,
“আমার আব্বার কোনো খোঁজ জানো নানি?”
অনেকদিন পর পালি মুখে আব্বার কথা শুনে মেহেরুন বানু পূর্ণ মনোযোগের সঙ্গে তাকালেন। বললেন,
“খোঁজ কেমনে পামু? মহসিন তো একবারও যোগাযোগ করার চেষ্টা করে নাই।”
“একবারও না?”
জুলেখা রান্নার জন্য কুলায় চাল বেছে নিচ্ছিলেন। পালি কথা শুনে বললেন,
“খোঁজ আর নিব ক্যান? খোঁজ নিতে আইলে যদি আবার ছেড়ির দায়িত্ব নেওন লাগে! হেই ডরেই আহে না। এতদিনে আবার বিয়া-শাদি কইরা বউ-পোলাপাইন লইয়া সংসার করতাছে হইব। বিয়াইত্তা পুরুষ মাইনষের কোনো বিশ্বাস আছেনি?”
পালির মুখটা ক’রুণ দেখায়। চোখ টলমল করে। আব্বাও দায়িত্ব নেওয়ার ভয়ে তাকে জীবন থেকে মুছে দিলো? দায়িত্ব শব্দটি তার সঙ্গে ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে যেন। বাকিটা সময় পালি থম মে’রে রইল। বোবা চোখে তাকিয়ে রইল আঁধারে ডুবতে থাকা, কুয়াশা মোড়ানো ছাতিম গাছের দিকে।
সন্ধ্যার একটু পর হিমাদ বাইরে থেকে ফিরল। অন্ধকারাচ্ছন্ন উঠানে পালিকে শীতবস্ত্রবিহীন নির্জীব, নিষ্ক্রিয় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে বলল,
“অন্ধকারে মিশে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আরেকটু হলে তো ধা’ক্কা খেতাম।”
“কী করব বলো, আমার গায়ে তো তোমার ফরসা ত্বকের মতো বাতি জ্বলে না যে দেখতে পাবে।”
কথাটা শেষ করে পালি চলে যাচ্ছিলো। হিমাদ তার চুলের গাছি টেনে ধরে থামাল। বলল,
“এত বে’য়াদব হয়েছিস কবে থেকে?”
পালির গুমোট ভাবটা ধ্ব’সে সঙ্গে সঙ্গে কান্না ছিটকে বেরিয়ে এলো। হিমাদের হাত থেকে চুল ছাড়িয়ে বলল,
“তোমাদের খাই, তোমাদের আশ্রয়ে থাকি বলে আমায় এত অপছন্দ করো, তুচ্ছ করো, তাইনা? যেদিন তুমি সংসারের হাল ধরবে সেদিন থেকে আমি এ সংসারের একটা দানাও ধ্বং’স করব না, মিলিয়ে নিয়ো।”
হিমাদ ঘাড় চুলকে বুকে দু’হাত গুজল। গম্ভীর গলায় বলল,
“যদি আজ থেকেই হাল ধরি?”
পালি জে’দ ধরে বলল,
“আজ থেকেই খাওয়া ছাড়ব।”
“কী খেয়ে থাকবি তাহলে? তোর তো কামাই-রোজগার নেই। বিয়েও করিসনি যে জামাইর ঘরে গিয়ে খাবি। ছাগলের মতো ঘাসপাতা খাবি?”
পালির কান্নার বেগ বাড়ল। মুখ বি’কৃত করে বলল,
“দরকার পড়লে তাই খাব, দরকার পড়লে না খেয়ে ম’রব।”
হিমাদ কিছু বলার আগেই পালি দৌড়ে স্থান ত্যাগ করল।
______________
দিন দুই বাদে হুট করে মোক্তার গিন্নির আগমণ ঘটল শালুগঞ্জে। সঙ্গে এসেছে কাজের মেয়ে ফজিলা। রাজিয়াকে দেখে খন্দকার বাড়ির সকলেই বিস্মিত হলো। রাজিয়া গত পাঁচটি বছরে একবারের জন্যও এ বাড়িতে পা রাখেনি। জুলেখা তাকে যথেষ্ট আদর-আপ্যায়ন করে ঘরে তুললেন। যেন পূর্বে তাদের মাঝে কিছু ঘটেনি এমন স্বরেই কথা বললেন। চিত্রাও কোনোরূপ বে’য়াদবি করল না। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মাথায় আঁচল দিয়ে দাঁড়ালো। তবে মৌন রইল। খেয়াল করে দেখল রাজিয়া আগের চেয়ে বেশ নরম হয়ে গেছেন। দেহভঙ্গিমায় যে ঠাঁট বজায় রাখতেন তা নড়বড়ে। তিনি চিত্রাকে দেখা মাত্রই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। হাত ধরে অনুনয় করে বললেন,
“মা, আর কত শাস্তি দিবা আমাগো? বুড়া বয়সে এত ক’ষ্ট সহ্য করার শক্তি নাই। সংসারডা এতগুলা বছর ছন্নছাড়া হইয়া আছে। এইবার ফিরা চলো, নিজের হাতে গুছাইয়া লও।”
চিত্রা মনে মনে একটা ব্যা’ঙ্গাত্মক হাসি দিলো বটে। এই মানুষটাই একসময় খুব করে চাইত তার সংসার থেকে সে চিরতরে বিদায় হোক। অথচ আজ তারই নিকট সংসার সাজানোর আবদার নিয়ে এসেছে! চিত্রা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
“আপনার সংসার গোছাতে আমাকে কেন দরকার? ছেলেকে আবার বিয়ে দিন। আমার কোনো আপত্তি নেই।”
মেয়ের কথা শুনে জুলেখা চোখ রাঙালেন। চিত্রা অবশ্য পাত্তা দিলো না। রাজিয়া আঁচলে চোখ মুছে বললেন,
“সাম্য তো আর ফিরে নাই।”
“ফেরেনি!” চিত্রা ভ্রু কুচকায়। রাজিয়া মাথা নেড়ে বলেন,
“না। তুমি যেদিন বাড়ি ছাড়লা, হেদিনেরতন সাম্য আমাগো লগে যোগাযোগ বন্ধ করছে। এতগুলান বৎসরে একবারও বাড়িতে পাও দেয় নাই।”
চিত্রা চুপ রইল। সাম্য যে চার বছর আগেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করে তালাকের কথা জানিয়েছিল সেটা আর বলল না।
চলবে…