বিষাদনীড়ে মায়াতরী পর্ব-৪৫+৪৬+৪৭

0
349

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [৪৫]
প্রভা আফরিন
_

গ্রীষ্মের কাঠফাটা গরমে চারিদিক দপদপ করছে। গাছতলা, ঘাট কিংবা বৈদ্যুতিক পাখার নিচে বসেও শান্তি মিলছে না। বৈশাখের শুরুতে কিছুদিন টানা ঝড় উঠেছে। এরপর কয়েকদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। জৈষ্ঠ্যমাসের কিনারায় এসে তার ছিটেফোঁটাও ঝড়ছে না। আকাশে সাদা সাদা মেঘেরা পিঁপড়ের মতো পিলপিল করে এদিক থেকে ওদিকে যায়। কালো মেঘেরা যেন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এমন খরাময় দিনে একমাত্র পুকুরের টলটলে জলের তলায় গা ডুবিয়ে রাখলে যেন আরাম মিলছে।

হিমাদ জুম্মার নামাজ পড়ে সবে বাড়িতে ঢুকেছে। তার কাধে সম্পূর্ণ ভর ছেড়ে আছেন রবিউল খন্দকার। দুজনের মাথায় টুপি, গায়ে পাঞ্জাবি-পাজামা, রঙ ধবধবে সাদা। রবিউল খন্দকারের ডান পায়ে জোর এসেছে কিছুটা। এনাম রোজ দিন-রাত্রির মিলন ক্ষণে, অর্থাৎ ভোর ও সন্ধ্যায় ওনাকে নিয়ে হাটতে বের হয়। রবিউল খন্দকার ডান পায়ের পাতা ঠিকমতো ফেলতে পারেন না। থরথর করে কাঁপে। বা-পা যেন দেহের কোনো অঙ্গই নয়, জোর-তাল কিছুই নেই। বা-হাতও তাই। শুধু ডান হাতখানাই যথাযথ ব্যবহার করতে পারছেন। হিমাদ আব্বাকে দাওয়ায় পাতা চৌকির ওপর আধশোয়া করে বসিয়ে দিলো। দুজনের শুভ্র বসনে চোখ জুড়িয়ে মেহেরুন বানু সন্তুষ্ট চিত্তে বললেন,
“ব এইহানে। আমি খাওন দিতাছি।”
রবিউল খন্দকার জড়ানো গলায় জানতে চাইলেন,
“পালি কই?”
“এই ছেড়িরে আমি পালতে পারমু না। দিন দিন অবাদ্ধের অবাদ্ধ হইতাছে। হেই কুনবেলা পুশকুনিত নামছে। কোনহানতে পোলাপাইন ধইরা আইন্যা সাঁতার দৌড় লাগাইছিল। পোলাপাইন গেছেগা, হেয় এহনো উডে নাই। হের শইল্যে নাকি গরম ঢুকছে। বাইর না হওয়া পর্যন্ত উঠব না।”
মেহেরুন বানু রাগে গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে গেলেন। হিমাদ মাথার টুপি খুলে দক্ষিণে চাইলো। এখান থেকে ঘাট দেখা যাচ্ছে না। সে চুলে আঙুল চালাতে চালাতে ঘাটে গেল। হরিৎ জলাধারের আশেপাশে কাউকে দেখা গেল না। মেহগনি বন থেকে ঘুঘু পাখির ডাক ভেসে আসছে। হিমাদ খেয়াল করে দেখল পুকুরে হেলে বিশ্রামরত হিজল গাছের তলা থেকে মৃদু তরঙ্গ ছড়াচ্ছে। যা ক্রমেই বিস্তৃত হতে হতে জলের মাঝে মিলিয়ে যাচ্ছে। হিজল গাছের তলায় হিজলফুল বিছিয়ে আছে। কিছু কিছু দলছুট হয়ে ভেসে গিয়েছে আশেপাশে। হিমাদ বলল,
“উঠে আয়।”

হিজলের তলা আগের চেয়ে একটু জোরে আন্দোলিত হলো। ভেসে থাকা ফুল ও পাতার মধ্য থেকে পালি টুপ করে মাথা বের করল। ছোটো ছোটো ফুল লেপ্টে গেল তার চুল, মুখ, কাধে। সে উঠে এলো ধীরপায়ে। পানিতে অনেকক্ষণ ডুবে থাকায় তার হাত-পা কিসমিসের মতো চুপসে ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। চোখ লাল হয়ে টলটল করছে। সে এসে থামল হিমাদের একধাপ নিচের সিড়িতে। মাথা নত, ঈষৎ সংকোচ ফুটে উঠেছে সিক্ত গাত্রে। ভেজা বসন চেপে বসেছে নির্মেদ, নিটোল যৌবনের খাঁজে। গা বেয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে। ওর সংকোচ টের পেয়েও হিমাদের ভাবান্তর হলো না। সে খুব মনোযোগ দিয়ে পালির গায়ে লেপ্টে থাকা প্রতিটি হিজল ফুলে নজর বুলিয়ে নিচ্ছে। বুঝতে চেষ্টা করছে ভেজা গায়ে ঠাঁই পেয়ে ফুলের সৌন্দর্য বেড়েছে নাকি পালির! পালি ক্ষীণ স্বরে বলল,
“কী?”
“পানিতে কী?”
“ঠান্ডা।”
“ওটা শীতল র’ক্তের প্রাণীদের আস্তানা। তোর মতো উষ্ণ র’ক্তের বিচিত্র প্রাণীর নয়।”
পালি একপলক চোখ তুলেই আবার কেমন মিইয়ে গেল। বলতে ইচ্ছে করল, “তোমার স্বভাবও শীতল প্রাণীদের মতো। পুকুরটা আসলে তোমার বাসস্থান হওয়ার কথা ছিল। ভুলে মানুষের ঘরে জন্মে গেছ।”
সে মুখে কিছু বলতে পারল না। হিমাদ ভাইটার মধ্যে ইদানীং লজ্জা-শরমের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কীভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে! হিমাদ বলল,
“ঘরে যা।”
‘তুমি আগে যাও।”
হিমাদ লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে যেতেই সে ছুটে গেল রান্নাঘরের পেছনের ঘরখানায়। ভেজা কাপড় গা থেকে সরাতেই তার জমে থাকা জড়তা কে’টে গেল।

হিমাদের সঙ্গে জুলেখার সম্পর্কটা আচমকা শিথিল হয়ে গেছে। ছেলেটা আগের মতো মায়ের খোঁজ নেয় না। মায়ের আদর কিংবা শাসনে বিশেষ গাঁইগুঁই করে না। জুলেখা ছেলেকে নিয়ে বেজায় শঙ্কিত। এই ছেলেটাই সংসারে তার একমাত্র জোর। তিনি বুঝতে পারছেন হিমাদ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। এখন তাকে ধরে রাখতে ঘরে বউ আনতে হবে। বউ হবে এমন মেয়ে যে ওনার হাতের মধ্যে থাকবে, ওনাকে মান্য করবে। জুলেখা মেহেরুন বানুকে হিমাদের বিয়ের ব্যাপারে বললেন। তিনি চান চেয়ারম্যান বাড়িতে প্রস্তাব পেশ করতে। টিয়ার পরিবার রাজি থাকলে এখনই পানচিনি সেড়ে ফেলবেন। টিয়া উপযুক্ত। নিশ্চয়ই তার পরিবারও বিয়ের কথা ভাবছেন। এমন সুপাত্রী হাতছাড়া করা ঠিক নয়। খন্দকারদের সুনাম রয়েছে, দাপট রয়েছে, কিন্তু সত্যি হলো তাদের হাতে ক্ষমতা নেই। চেয়ারম্যান পরিবারের সঙ্গে সখ্যতা গড়লে উভয়েরই উপকার। মেহেরুন বানু বিপরীতে বিশেষ কিছু বললেন না।

সেসব আলাপ শোনা মাত্রই পালি হিমাদের ঘরে ছুটে গেল। এ ঘরে আজকাল তার অবাধ বিচরণ। যখন তখন ঢুকে পড়ে। নিজের হাতে ঘরের সবকিছু গোছায়, বিছানা টানটান করে পেতে দেয়। ঘরের কোথায় কি রাখা হয় সব তার নখদর্পনে। হিমাদ ভাইয়ের কোন জামাটা নোংরা হয়েছে, কোন জামাটায় দাগ লেগেছে, সে নিজ দায়িত্বেই নজরে রাখে। নিজের হাতে ধুয়ে, শুকিয়ে তুলে রাখে। হিমাদ সেসব খেয়াল করেও কিছু বলে না। ঘরে যে আরেকটা মানুষ আসে সে যেন দেখেও দেখে না। এমনও হয় পালি ঘন্টার পর ঘন্টা ঘরে আছে, হিমাদ টু শব্দটিও করেনি। ঘর ঝাড়ু দিতে গিয়ে পালিই বলে ওঠে,
“হিমাদ ভাই, পা উঁচু করো।”
হিমাদ তবুও কিছু বলে না। তার মাছের মতো স্থির দৃষ্টি কিছুক্ষণের জন্য পালির ওপর কৃপা করে আবার সরে যায়। এমন নির্লিপ্ততাকে বিরক্তি ভেবে পালি কিছুদিন দূরে সরে ছিল। তাতে বরং হিতে বিপরীত হলো। কয়েকদিন পর সে যখন আবার গেল আধোয়া জামা-কাপড় আনতে, হিমাদ তাকে একটা কাপড়ও ছুঁতে দিলো না। তার কোনো কাজে হাত দিতে দিলো না। কণ্ঠে বি’ষ ঢেলে, র’ক্তনেত্রে চেয়ে বলেছিল,
“আমার কোনো কাজ তোকে করতে হবে না। ভালো মেয়ের খেতাব পাওয়ার লোভে সকলের লেজে লেজে ঘোর গিয়ে।”
পালি কেন জানি সে কথার ধার সইতে পারেনি। হিমাদ যতক্ষণ বাড়িতে থেকেছে সে হিমাদের ঘর থেকে বের হয়নি। একপাশে মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে থেকেছে। হিমাদ একসময় বিরক্ত হয়ে বলেছে,
“এখানে কি?”
পালি না চাইতেও ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বলেছিল,
“আর হবে না। বিশ্বাস করো, আর এমন করব না।”
এরপর সবটা আবারো স্বাভাবিক। অঘোষিত ভাবে হিমাদের সব ভালোমন্দের দায়িত্ব পালির ওপর বর্তেছে। তাতে উভয়ের কারোই বিন্দুসম আপত্তি লক্ষ্য করা যায়নি। চিত্রা ব্যতীত বাড়ির আর কারো বিশেষ নজরেও পড়েনি। চিত্রা কিছু বলে না। পালিকে দেখলেই মুচকি মুচকি হেসে ওঠে। সেই হাসি দেখে পালি না চাইতেও অপ্রতিভ হয়ে ওঠে।

পালি ঘরে ঢুকে দেখল হিমাদ খালি গায়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। তার হলুদাভ ফরসা গায়ের রঙটা পালির খুব পছন্দ। মামি যে বলে তার ছেলেটি সোনার মতো তা খুব একটা ভুল নয়। সে গলা খাকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিলো। হিমাদ সজাগ কিন্তু নড়ল না। পালি পায়ের কাছটায় বসে বলল,
“তোমার বিয়ের আলাপ হচ্ছে।”
হিমাদ ঘুম জড়ানো গলায় বলল,
“ভালো।”
“তোমার টিয়া পাখির সাথে।”
“আরো ভালো।”
“খুব শীঘ্রই পানচিনি হয়ে যাবে। টিয়া পাখি এ বাড়িতে এলে তাকে তোমার সবকিছু বুঝিয়ে দেব। আমাকে আর কষ্ট করে কাপড় ধুতে হবে না।”
হিমাদ সোজা হয়ে শুলো। দেখল পালি তার দিকে পিঠ দিয়ে বসেছে। সে বলল,
“ধুতে হবে। আমার সঙ্গে আমার বউয়ের কাপড়ও ধুয়ে দিবি।”
পালি না ফিরেই উত্তর দিলো,
“আমি যেমন তোমাদের খাস দাসী?”
“ভাই-ভাবীর সেবা করবি। ক্ষতি কী?”
“তোমার সংসারে খেটে ম’রতে পড়ে থাকব নাকি? আমার কোনো ভবিষ্যত নেই? কয়েক দিন পর আমি এমনিতেই কলেজ হোস্টেলে চলে যাব।”

হিমাদ আড়মোড়া ভেঙে লম্বা হাই তুলে উঠে বসল। যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে বলল,
“এভাবে নিজের কালো পিঠ দেখিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন?”
পালি হুট করে ক্ষে’পে গেল। পিঠের ওপর চুল ছেড়ে দিয়ে নিচু অথচ রাগি গলায় বলল,
“আমার পিঠে তো শুধু কালো রঙটাই দেখো। আর টিয়া পাখির পিঠে কি দেখো? যৌবন?”
হিমাদ শক্ত হাতে পালির চোয়াল চেপে ধরল।
“লাই দিয়ে মাথায় তুলে ফেলেছি। আছাড় মে’রে নামাবো। বে’য়া’দব।”
পালি ধাক্কা দিয়ে হাত সরিয়ে দিলো। হুট করেই সে আজ বেজায় চটেছে। চলে যেতে যেতে বলল,
“আসব না আর তোমার ঘরে।”

চলবে…

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [৪৬]
প্রভা আফরিন
_

বিকেলে দুমদাম পা ফেলে বেরিয়ে আসার পর পালি সত্যি সত্যিই আর হিমাদের ঘরমুখো হয়নি। খানিক বাদে অবশ্য নিজের বলা কথাগুলোর মর্মার্থ স্মরণে আসতেই লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছিল। কোথা থেকে যে সুপ্ত রাগের ফোয়ারা বইতে শুরু করেছিল সে টেরই পায়নি। ভাষারাও বাধা মানেনি। পালি ভেবেছিল হিমাদ একবার হলেও তার খোঁজ করবে। নিজে না এলেও ডেকে পাঠাবে। কিন্তু গোটা একটা দিন চলে গেলেও তেমন কিছুই হলো না। বিকেলে সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ানোর সময় হুট করে হিমাদের মুখোমুখি হলো সে। হিমাদ বাড়ি ফিরেছে সবে। এক পলকের জন্য দৃষ্টি বদল হতেই পালি সঙ্গে সঙ্গে মুখ নামিয়ে নিল। একপাশে সরে গিয়ে তাকে ঘরে ঢোকার জায়গা করে দিলো। হিমাদ যাওয়ার সময় ছোটো স্বরে বলল,
“ঘরে আসিস একবার।”
“কেন?”
“কিছু গোছগাছ করতে হবে। সব তো নিজের কব্জায় করে রেখেছিস। নিজের ঘর অথচ নিজেই জানি না কোথায় কি আছে।”

কথাটা শুনে কেন জানি পালির লজ্জা লাগল। বলতে ইচ্ছে করল, “তোমার সম্মতি ছাড়াই কব্জা করেছি?” বলতে পারল না। হিমাদের স্থির দৃষ্টির কবলে পড়ে তার থুতনি গিয়ে ঠেকল বুকের সঙ্গে। কিন্তু গোছগাছ কেন করতে হবে তা আর জিজ্ঞেস করা হলো না। ততক্ষণে হিমাদ বড়ো বড়ো কদম ফেলে দেয়ালের আড়ালে চলে গিয়েছে। গোছগাছের কারণ জানতে পারল সন্ধ্যায়। হিমাদ নাকি কাল সকালের ট্রেনে ঢাকা যাবে। সেখানে দিনকয়েক থেকে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে, তার যেসব জিনিসপত্র রয়ে গেছে সব গুছিয়ে নিয়ে আসবে। এরপরই জুলেখা চেয়ারম্যান বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর মনস্থির করেছে। তাতে কারোই বিশেষ আপত্তি নেই। পালির মনে আবারো বর্ষার কালো মেঘ জমলো। সব তো ঠিকই চলছে, সবাই শান্তিতে আছে। সেই বোধহয় নিজেকে একটু বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে শুরু করেছিল। তা ভেবে পালির নিজেকে ভীষণ ছোটো মনে হলো। এরপর থেকে সে কেমন মনমরা হয়ে গেল। হিমাদের ঘরেও আর যাওয়া হলো না। গোছগাছ হয়েছে কিনা জানতে ইচ্ছে করলেও নিজেকে দমিয়ে রাখল।

ফজরের আযান শোনা মাত্রই পালির ঘুম ছুটে গেল। চারিদিক তখনো বার্ধক্যজনিত তমসার ভাগে। সে ওজু করে নানির সঙ্গে নামাজ পড়ে নিল। মেহেরুন বানু বললেন,
“আরেকটু ঘুমায় নে। পরে উঠিস।”

পালি কোনো উত্তর না দিয়ে বিছানায় শুয়ে রইল। হিমাদ ভাই কখন বের হবে, দরকারি সব জিনিস খুঁজে ব্যাগে ভরেছে কিনা জানতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। বাইরে তখন মৃ’তপ্রায় বৃদ্ধ আঁধারের বুক চি’রে সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুর মতো নির্মল, কোমল আলো প্রস্ফুটিত হচ্ছে। দূর থেকে বিষন্ন কাকের বিলাপ ভেসে আসছে। পালি সন্তর্পণে ঘর থেকে বেরুলো। হিমাদের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দেখল সে তোরঙ্গের ওপর উপুর হয়ে কি যেন খোঁজাখুঁজি করছে। মোটা দুটি ভ্রুর মাঝে বিরক্তির ভাজ। পালিকে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে হলো না। তার আগেই তার পায়ের রুপালি নূপুরজোড়া হিমাদের দৃষ্টিতে ঠাঁই পেল। ঘাড় বাঁকিয়ে পালির মুখের দিকে চাইল হিমাদ। চাপা অথচ কঠিন গলায় বলল,
“পায়ে শেকড় গজিয়েছে?”
পালি বুঝল হিমাদ কেন কথাটা বলেছে। কিন্তু গতকাল সে কেন আসেনি তার কারণ হিমাদ জানতেই চাইলো না। চাইলেও পালি বলতে পারত না৷ সে ভেতরে পা বাড়িয়ে বলে উঠল ,
“শেকড় গজাবে কী করে বলো? আমার তো শক্ত মাটিই নেই। মাটি ছাড়া, অন্যের ওপর নির্ভরশীল গাছকে বলে পরগাছা। আমিও তাই। বরং তোমার ডালপালা ছড়াচ্ছে। সেই ডালে এখন রঙিন পাখি বসবে।”

পাখি শব্দটা না চাইতেও মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল। হিমাদের চোখের দৃষ্টি আরো কঠিন হতে দেখে তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,
“কি খুঁজছিলে বলো। আমি বের করে দিচ্ছি।”
“সব গোছানো হয়েছে৷ বাদবাকিও একাই করে নেব। আপনাকে আর দরকার নেই।”
“আমাকে তো কারোই দরকার নেই। আমারই সবাইকে দরকার।”
কথাটা খেয়ালের বসে বললেও পালির মনে হলো আসলেই তাই। এ জগতে কোথাও তার আবশ্যিকতা নেই। সে না থাকলে দুঃখ পাওয়ার মানুষ আছে তবে শূন্য হওয়ার কেউ নেই। এতটা মূল্যহীন সে! এ পৃথিবীতে কেউ নেই যার কাছে সে সবচেয়ে মূল্যবান?

হিমাদ কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“এসব বলে কি সহানুভূতি চাস? ওটা আমায় দিয়ে হবে না। অন্যদের থেকে পাবি। হয়তো তোর এইসব আবেগ মাখানো কথায় কেউ কেঁদেও ফেলতে পারে।”
পালি মুচকি হেসে হিমাদের কাপড়চোপড় দেখে নিতে নিতে বলল,
“এত ব’দমে’জাজি হওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষ’তিকর, বুঝলে?”
“এত আবেগপ্রবণ হওয়াও ক্ষ’তিকর। অসহায়ত্ব প্রদর্শন করা মানে অন্যের কাছে নিজের ভালো থাকা সমর্পণ করা।”
পালি মুখ তুলে চাইলো। ক্ষীণ স্বরে বলল,
“আর আমার ভালো থাকা যদি তোমার ওপর সমর্পিত হয়? অসহায়ত্বের সুযোগ নেবে?”

হিমাদ এগিয়ে এলো। তার দৃষ্টি বরাবরের মতোই শান্ত, স্থির। পালির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, চোখে চোখ রেখে বলল,
“প্রতিনিয়ত আহ’ত হবি।”

হিমাদ রওনা হলো সকাল দশটায়। যাওয়ার আগে আব্বার সমস্ত রিপোর্ট সঙ্গে নিল ঢাকায় বড়ো ডাক্তারকে দেখানোর জন্য। অবস্থা বুঝে দরকার পড়লে রবিউল খন্দকারকেও নিয়ে যাবে। হিমাদের পিছু পিছু তার কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে বের হলেন মেহেরুন বানু। হিমাদ দাদির হাত থেকে ব্যাগটা নিতে নিতে বলল,
“এত এগিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। বিশ্রাম নাও গিয়ে। আমার জন্য চিন্তা কোরো না।”
“গাড়ি-ঘোড়ার রাস্তা, না চাইতেও চিন্তা হয়। দেইক্ষা-হুইন্যা যাইস ভাই।”
মেহেরুন বানু না এগোলেও পালি গেইট পর্যন্ত এগোলো। হিমাদ ভ্রু কুচকে তাকালে সে বলল,
“কবে ফিরবে?”
“দুদিন পর। তোর কিছু লাগবে?”
“নাহ, সাবধানে ফিরে এসো।”
হিমাদ কিছুক্ষণ তার মুখের ওপর নজর বুলিয়ে নেয়। ঠোঁট বেঁকিয়ে কৌতুকের স্বরে বলে,
“মিস করবি?”
পালি আর’ক্ত হয়। মুখ ভেঙচিয়ে বলে,
“এহহ! বাজে কথা। যাও!”
“মিস করা বাজে কথা?”
“আমার জন্য বাজে কথাই। তোমার মনের মানুষের জন্য ভালো কথা।”
“আমার মনের মানুষ কে তুই জানিস?”
“না জানার কি আছে? মামি যার সঙ্গে তোমার বিয়ে দিতে চায়, তুমি যার সাথে হাহাহিহি করে কথা বলো, তোমার সেই টিয়া পাখি।”

কথাটা শোনা মাত্রই হিমাদের ঠোঁটের কৌতুক সরে গেল। পালির দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে হনহনিয়ে চলে গেল। পালির নিজের ওপর রাগ উঠলো। কেন যে বারবার টিয়ার নাম মুখের ভেতর নিশপিশ করে! রওনা হওয়ার সময় হিমাদ ভাইকে চটিয়ে দেওয়া ঠিক হলো না। সে তো জানে মানুষটা কেমন রু’ক্ষ, শুষ্ক হৃদয়ের অধিকারী। তবুও কোমলতা আশা করে ফেলে। পালির হিমাদের যাওয়ার দিকে ছলছলে চোখে তাকিয়ে রইল। সেই চোখজোড়া পর্যবেক্ষণ করে মেহেরুন বানু থমকে গেলেন। উনার সন্দেহই বুঝি ঠিক হলো! যে আশঙ্কায় তিনি মেয়েটাকে বাইরের আকর্ষণ থেকে আগলে রাখতেন সেটা বাড়ির ভেতরেই অতি সন্তর্পণে ঘটে গিয়েছে। বাইরে প্রাচীর তুলতে গিয়ে তিনি ভেতরের উন্মুক্ততা খেয়াল করেননি। মেহেরুন বানু মনে মনে প্রমাদ গুনলেন। এ অসম্ভব! পালিকে যতদ্রুত সম্ভব এ বাড়ি থেকে দূরে পাঠাবেন তিনি।
____________

পরদিন দুপুরের পর বাড়িতে একজন অচেনা লোক এসে উপস্থিত হলো। তাকে প্রথমে দেখল জুলেখা। নোংরা ফতুয়া ও লুঙ্গি পরনে, পায়ে জুতোটি পর্যন্ত নেই। জুলেখা খেকিয়ে উঠলেন,
“ক্যাডা আপনে? বাড়িত ঢুকছেন কোন সাহসে?”
লোকটি কিছু বলতে গিয়েও পারলেন না। গলার কাছটায় যেন সব কথা জমে বরফ হয়ে গেছে। সংকোচে জড়োসড়ো হয়ে আছে লোকটি। জুলেখার গলা শুনে মেহেরুন বানু শ্লথ গতিতে বেরিয়ে এলেন। জীর্ণশীর্ণ, লজ্জিত মুখের মানুষটিকে তিনি আগে দেখেছেন কিনা ঠাহর করতে পারলেন না। জুলেখা আবার চ্যাচিয়ে উঠলেন,
“এনাম কই? চো’র-ছ্যাঁ’চড় বাড়িত ঢুইক্কা পড়লেও দেহি আটকানের কেউ নাই।”

পালি সবে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছিল। মামির বাজখাঁই গলা কানে বিঁ’ধতেই তার আরাম ছুটে গেল। দুরন্ত পায়ে বাইরে এসেই সে হোঁচট খেল। সম্পূর্ণ পৃথিবী যেন এক লহমায় এলোমেলো হয়ে গেল। জুলেখা মানুষটাকে প্রায় বেরই করে দিচ্ছিলেন। পালি ছুটে গিয়ে লোকটির সামনে দাঁড়ায়। নিঃশ্বাস আটকে ফিসফিস করে ডেকে ওঠে,
“আব্বা!”
সঙ্গে সঙ্গে টুপ করে একফোঁটা অশ্রু নির্গত হয়। লোকটির সংকোচ সরে গেল মুহূর্তেই। তিনি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন সম্মুখের মেয়েটির দিকে। সেই বিস্ময়ের দৃষ্টিতে শৈশব খুঁজতে কতটা সময় কে’টে গেল দুজনের কেউই বোধহয় টের পেল না। স্মৃতির উত্তাপ দুজনকেই যেন গলিয়ে দিতে লাগল। লোকটি কাঁপতে কাঁপতে পালির হাত ধরে কেঁদে ওঠেন,
“পালি… আমার মারে…”

ঠিক সেই মুহূর্তে পালি টের পেল তার স্বপ্নের ভেতর যেই অচেনা কণ্ঠস্বর ডেকে ওঠে, সেটি আসলে তার বুকের ভেতর পুষে রাখা সেই শৈশবের মায়া, যেখানে পিতৃ মমতায় সিক্ত শিশুটি ছিল জগতের সবচেয়ে সুখী মেয়ে। আর পিতার সেই শূন্যতাই তার ভুলে থাকার প্রয়াস!

চলবে…

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [৪৭]
প্রভা আফরিন
_

খন্দকার বাড়ির মানুষ মহসিনকে দেখেছিল করবীর বিয়ের দিন। সেটাই ছিল তাদের প্রথম ও শেষ দেখা। এরপর রবিউল খন্দকার ব্যতীত কেউ তাকে দেখেনি। মহসিনও কোনোদিন শ্বশুর বাড়িতে পা রাখেনি। করবীও চায়নি। যার ফলে এত বছর পর মহসিনকে দেখে কেউই চিনতে পারেনি। পালি যদি আব্বাকে চিনতে না পারত, মহসিনকে চূড়ান্ত অপমানিত হয়ে বাড়ির বাইরে বের হয়ে যেতে হতো। সে নিয়ে মেহেরুন বানু যারপরনাই লজ্জিত। এতদিনে তিনি প্রায় ভুলেই বসেছিলেন মেয়ের জামাইয়ের কথা৷ সে যে কোনোদিন আসবে সে ভাবনাও ফিকে হয়ে গিয়েছিল সময়ের সাথে। জুলেখার মাঝে কোনো ভাবান্তর নেই। তবে মহসিনকে যে তিনি পছন্দ করেননি সেটা ওনার কোঁচকানো ভ্রু-ই স্পষ্ট বলে দিচ্ছে।

পালি মামার ঘর থেকে লুঙ্গি, গামছা, নতুন একটা গায়ের সাবান এনে মহসিনকে দিলো গোসল করতে।
মহসিন অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন মেয়ের মুখের দিকে। তিনি এই মিষ্টি মেয়েটির পিতা! সেই ছোট্টো পালিটা আজ কত বড়ো হয়ে গিয়েছে! চালচলন, কথা বলার ভঙ্গিমায় কি মুগ্ধতা! এই চোখজোড়া পরিচিত না হলে তিনি বোধহয় মেয়েকে চিনতেই পারতেন না৷ মহসিনের মনে হচ্ছে এমন সুন্দর মেয়ে তিনি জীবনেও দেখেননি। আজ যদি দেখা না হতো, জগতের সবচেয়ে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের দর্শন হতে তিনি বঞ্চিত হতেন। মহসিন টের পেলেন অনেক…অনেক দিন পর যেন অল্প অল্প করে উনার ভেতরের সুপ্ত পিতৃত্ব সক্রিয় হয়ে উঠছে। পুকুরে গোসল সেড়ে উঠতেই পালি একজোড়া দুই ফিতার চটি এনে দিলো আব্বাকে। বলল,
“আপনার পায়ে তো ঘা হয়েছে আব্বা। জুতা কেন পরেন না?”
মহসিন নিজের অবস্থায় মনে মনে ভীষণ লজ্জিত ও কুন্ঠিতও বটে। পালি তা বুঝে এ নিয়ে কথা বাড়ালো না। বলল,
“আসুন, আগে খেয়ে-দেয়ে একটা ঘুম দেবেন। রাতে পায়ের মলম আনিয়ে দেব।”
পালির কণ্ঠস্বরে কোনো অস্বস্তি নেই। নেই গত কয়েক বছরের যোগাযোগ হীনতার কোনো জিজ্ঞাসা। মহসিন ইতস্তত করে বললেন,
“আমি তো থাকমু নারে মা।”
পালি প্রায় কেঁদেই ফেলে সে কথা শুনে।
“থাকবেন না?”
“না। সন্ধ্যার আগেই রওনা দিমু।”
“কোথায়?”
“খিলানচর।”
পালি আর কথা বাড়ালো না। অভিমানে টইটম্বুর চোখদুটো লুকিয়ে সে আব্বাকে নিয়ে মামার ঘরে গেল। রবিউল খন্দকার মহসিনের আগমনে ভারী অবাক, তার চেয়েও অবাক হলেন মহসিনের আবদার শুনে।
“পালি এই বাড়িতে আমার বোনের মাইয়া না, আমার মাইয়া হিসাবে বড়ো হইছে। আমার মাইয়ার চেয়ে কোনো অংশে কম স্নেহ করি না তারে। তয় তুমি তার জন্মদাতা পিতা, পালি তোমার র’ক্ত তা অস্বীকার করি না। কিন্তু এত বছর পরে এমনে এমনেই তো তোমারে মাইয়া দিতে পারি না। সে এহন খন্দকার বাড়ির মাইয়া। তার ভালোমন্দের ব্যাপারে মত দেওয়ার অধিকার আমাগোও আছে।”
“আপনে ভুল বুঝতাছেন খন্দকার সাব। আমি পালিরে একেবারে নিতে আসি নাই। আমার সামর্থ্য নাই আপনেগো মতোন ভালোমন্দ খাওয়ানো, পরানোর। আমার মাইয়া এইহানেই সবচেয়ে ভালো আছে। আপনেরাই তার অবিভাবক। আমি শুধু কয়দিনের লইগ্যা পালিরে নিজের কাছে রাখতে চাই।”
“নিতে চাও বুঝলাম, তোমার সংসার কি মানবো? সৎ মায়ের সংসার কেমন তা তো আর আলাদা কইরা ভাইঙ্গা কইতে হইব না।”
মহসিন লজ্জিত ভঙ্গিতে জিভ কা’টে। বলে,
“সংসার আর আমারে দিয়া হইব না খন্দকার সাব। এই জীবনে দ্বিতীয় কোনো নারী গ্রহণের ক্ষমতা আমার নাই। আপনের বইন দয়া করছিল বইলা আমার একখান সংসার হইছিলো।”
রবিউল খন্দকার বিস্মিত হলেন। বললেন,
“তাইলে এতবছর কই ছিলা তুমি?”
“নিজেরে নিয়া কোনোমতে বাইঁচা আছিলাম। লালন পালনের ক্ষমতা নাই, তাই সাহসও হয় নাই মাইয়ার সামনে খাড়াইতে।”
“তাইলে তো খিলানচর তোমার পরিবার, সংসার কিছুই নাই। কোন ভরসায় মাইয়ারে দেই কও?”
মহসিন মাথা নুইয়ে খানিক চুপ রইলেন। এরপর বললেন,
“পালির চাচা-চাচি আছে ওইহানে। দুইদিন পরে নাহয় দিয়া যামু।”
রবিউল খন্দকার দ্বিধান্বিত হয়ে গেলেন। যাওয়ার সিদ্ধান্ত ছেড়ে দিলেন পালির ওপর। পালি একবাক্যে রাজি হলো। সেখানে তার মা আছে, শৈশবের সেই স্নেহমাখা বাড়িটা আছে, তার ভাইটা নদীর বুকে ঘুমিয়ে আছে। আর সেই কাঁঠাল গাছটি, যার ছায়াতলে মা তার সমস্ত শৈশব আগলে ঘুমাচ্ছে, সেই গাছটি আছে তো! পালি মনে মনে উত্তেজিত হয়। নাকে এসে লাগে মমতার সুবাস। চোখ টলমল করে। মেহেরুন বানু পালির যাওয়া নিয়ে বিশেষ আপত্তি করলেন না। ভাবলেন হিমাদ আসার আগে পালির স্থানবদল হওয়া উচিৎ। উভয়ের মাঝে দূরত্ব থাকলে অনাকাঙ্ক্ষিত অনুভূতি বিস্তার লাভের সুযোগ পাবে না। অথচ তিনি জানতেন না ভাগ্য কখনো ভাবনা অনুযায়ী চলে না। সে চলে আপন গতিতে। যা কখনো দুর্বার, কখনো কোমল।

পালিকে নিয়ে মহসিন রওনা হলেন সন্ধ্যায়। মেহেরুন বানু হাজারবার থাকতে বললেও মহসিন থাকলেন না। উনার বক্তব্য, করবী বেঁচে থাকতে যেহেতু এ বাড়িতে জামাই রূপে আসতে পারেননি এখন আর জামাইয়ের আপ্যায়ন চাননা। করবীও তা কখনো চায়নি। তিনি এসেছেন শুধু পালির বাবা হয়ে।
যাওয়ার আগে মেহেরুন বানু পালির হাতে কিছু টাকা গুজে দিলেন।

দিনের আলো রাতের বুকে মুখ লুকাচ্ছে৷ নদীর ওপর প্রবাহিত হচ্ছে শীতল হাওয়া। এতক্ষণ পালির খিলানচরে যাওয়ার জন্য উত্তেজিত হলেও নৌকায় ওঠার সময় হুট করেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। হিমাদ ভাইকে জানিয়ে যাওয়া হলো না। আচ্ছা! সে ফিরতে ফিরতে কি মামি হিমাদ ভাইয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলবে? তার জন্য কেউ অপেক্ষা করবে না? হিমাদ ভাইও না? প্রায়ান্ধকারের বিষন্নতা কিশোরী মনে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করল। পাটাতনে বসা আব্বার দিকে চোখ পড়তেই দেখল তিনি ঠোঁটে নিষ্পাপ এক হাসি ফুটিয়ে পালির দিকে তাকিয়ে আছেন।
__________

খিলানচর

ভোরের আলো ফোটার আগেই পালিদের নৌকা এসে পৌঁছালো খিলানচরের ঘাটে। পালি আব্বার বাহুতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে ছিল। মহসিন মৃদু গলায় ডাকতেই জেগে উঠল। তন্দ্রাঘোরে তাকিয়ে দেখল শৈশবের চিরচেনা ভূমির দিকে। আঁধার মোড়ানো প্রাতঃকালে চারপাশ কেমন অচেনা লাগছে। সে আব্বার হাত ধরে বালু তীরে নেমে পড়ল। মহসিন মেয়েকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“ঘরে গিয়া ঘুমাইস। আজকে নদীতে মাছ ধরমু। ঘুমেরতে উইঠ্যা মাছ দিয়া ভাত খাবি।”
পালি হাসল। বলল,
“কে রাধবে?”
মহসিন যেন চিন্তায় পড়লেন। পরমুহূর্তে হেসে বললেন,
“তোর চাচি রানব।”
“উহু, আমি রাধব।”
“তুই রানতে পারোছ?”
কথাটা বলে মহসিন একটু চুপ করে গেলেন। মেয়েটা যে বড়ো হয়েছে তিনি ভুলে বসছেন। পালি বলল,
“সব পারি। আপনি খেয়ে দেখবেন।”

কাকডাকা ভোরে উঠানে পা দিয়ে পালি থমকে গেল। চারিদিক কেমন ধু ধু প্রান্তর মনে হচ্ছে। ছাউনিযুক্ত উন্মুক্ত রান্নাঘরখানা নেই। নেই ঝিঙের মাচা কিংবা কচু গাছের ঝোপ। বদলে বড়ো বড়ো ঘাস জন্মে আছে চারিদিকে। বন্যার ধকল সইতে সইতে মাথা গোজার স্থানটুকুর অবস্থাও নাজেহাল। মরচে পড়া টিনের চালে একাধিক ফুটো, ছনের বেড়াও নড়বড়ে। দরজার একটি কপাটও প্রায় ঝুলে পড়েছে। সে বলল,
“আপনি কি এই ঘরেই ঘুমাতেন আব্বা?”
মহসিন মাথা নিচু করে বললেন,
“হ। তুই চিন্তা করিস না। আমি আজকের মইদ্যে বেড়া বাইন্ধা দিমু। ততক্ষণ হামিদ চাচার বাড়িত থাকবি।”

পালির চোখ চলে গেল কাঁঠাল গাছের নিচে। জায়গাটি বাঁশের বেড়া দিয়ে আলাদা করা। পালি ধীরপায়ে হেটে সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়। কোনো ক’ব’র নেই। বন্যায় মাটি ধুয়ে সমান হয়ে গিয়েছে। তবুও জায়গাটি আলাদা করে ঘেরাও করে রাখা। বেড়ার একপাশ ভেঙে পড়েছে। পালি বাঁশ ধরে ঝুকে বসে। নাক টেনে লম্বা শ্বাস নেয়। ফিসফিসিয়ে ডাকে,
“মা, ওমা? কতদিন তোমায় দেখি না! আমায় ফেলে কি করে আছোগো? তুমি জানো? তোমার ছোট্টো পালি কত্ত বড়ো হয়ে গেছে। কত্ত বড়ো বড়ো স্বপ্ন দেখতে শিখেছে। দায়িত্ব নিতে শিখেছে। সেসব দেখার জন্য তুমি নেই মা। তোমার পালি তোমায় ছাড়া থাকতে শিখে গেছে।”

পালি নিরবে কেঁদে ওঠে। মহসিন এগিয়ে এলেন তার পাশে। ভাঙা বেড়া দেখে রেগে গিয়ে বললেন,
“আবার ভাঙছে? হেদিন মাত্র সব ঠিক কইরা দিয়া গেলাম। ছাগল কি খালি আমার বাড়ির বেড়াই চোক্ষে দেহে?”
মহসিনের হঠাৎ চিৎকারে পালি কেঁপে উঠল। অবাক হয়ে তাকালো আব্বার দিকে। মহসিনের চোখ রাগে লাল হয়ে উঠেছে। তিনি আবার বললেন,
“দুইদিনও যায় না বেড়াগুলান খালি ভাইঙ্গা যায়। আমার শান্তি কারো পছন্দ না।”
পালি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আপনি শান্ত হোন। পরে ঠিক করে নেওয়া যাবে।”
“দেখ তো মা। করবীর জায়গাতেই খালি সবাই নজর দেয়। বেড়াগুলান বাইন্ধা দিয়া একদিনও শান্তি পাই না। মানুষটারে একটু শান্তি দিলো না কেউ। ইচ্ছা কইরা করে, আমি জানি।”
পালি কথাগুলো ঠিক বুঝল না। আব্বাকে শান্ত করতেই বলল,
“বেলা হলে আমরা দুজন মিলে ঠিক করে নেবো।”
মহসিন শান্ত হলেন। বললেন,
“আয়, চাচার ঘরে কয়ডা খাইয়া ঘুম দিবি। আমি বাজারে যামু।”

সাতসকালে ঘুম ভাঙায় বেশ বিরক্ত হয়ে দরজা খুলল রোকসানা। মহসিনকে দেখে ভ্রু কুচকে বললেন,
“আপনে এতদিন বাদে কইত্তে আইলেন?”
“আমার কথা রাহো। দেহো কারে আনছি।”
“এই মাইয়া ক্যাডা?”
“আমাগো পালি।”
রোকসানা অবাক হয়ে তাকায়। পালি চাচিকে সালাম দিলো। রোকসানা মাথা নেড়ে বলল,
“আহো, ঘরে বও।”

পালিকে রেখে মহসিন গেল মাছ ধরতে। হামিদ চাচা ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। ওর পরিচয় পেয়ে বিস্মিত হলো। পালি কিছুটা সংকুচিত হয়ে আছে। আব্বার সঙ্গে যেভাবে সে জড়তাবিহীন মিশতে পেরেছে অন্যদের সাথে তা হচ্ছে না। তার আগমনে হামিদ চাচারাও যে অস্বস্তি বোধ করছে তাও পালি টের পাচ্ছে। হামিদ চাচার ছেলেটার বয়স এখন আট বছর। নাম ইমন। পালি তাকে দেখেছিল হামাগুড়ি দেওয়া বয়সে। সে পালির থেকে দূরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
“আপনে কি আমাগো মেহমান?”
পালি হেসে মাথা নাড়ল। বলল,
“হ্যাঁ, আমি তোমার বুবু হই।”
“বুবু! এতদিন কই আছিলেন তাইলে?”
“আমার মামার বাড়িতে ছিলাম।”
“এহন আমাগো বাড়িত থাকবেন?”

পালি আবারও মাথা নাড়তেই ইমন ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পালি আর ঘুমালো না। ইমন যাকে পেয়েছে তাকেই পালির কথা জানিয়েছে। খানিক বাদেই চরের মানুষরা তাকে দেখতে আসতে শুরু করল। বেশিরভাগই পালির অপরিচিত। অনেককে তার মনেও নেই। শুধু একজনকে সে নির্দ্বিধায় চিনতে পারল। খুদিবু লাঠিতে ভর করে এসেছেন। সোজা হয়ে হাটতে পারেন না। সামনের দাতগুলো পড়ে গেছে। চোখেও ভালো দেখেন না। তিনি পালিকে বহু সময় নিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন। ওর সারামুখে হাত বুলালেন। ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে বললেন,
“কার লগে আইছোস ছেড়ি?”
“আব্বার সাথে।”
“মহসিন আইছে? কই পাইলি ওই পাগলরে?”
“আব্বা মামাবাড়িতে গিয়ে আমাকে নিয়ে এসেছে।”
খুদিবু অনেকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
“নিজে গেছে?”
“হ্যাঁ।” পালি মাথা নাড়ল।
খুদিবু আফসোস করে বললেন,
“কোন দুঃখে আবার এই চরে পাও দিলিরে ছেড়ি? মাথা পাগল বাপের লগে তোর মামাবাড়ির মানুষ আইতে দিলো?”
পালি স্তব্ধ হয়ে গেল। এমন সময় মহসিন খালি হাতে এসে বলল,
“মাছ ধরতে পারলাম নারে মা। আমার তো জালই নাই।”
__________

শালুগঞ্জ

হিমাদ বাড়ি ফিরেছে দুপুরের দিকে। বাড়িতে ঢুকে একবারও পালির দর্শন পায়নি সে। দুপুর পেরিয়ে বিকেল গড়াতেও যখন মেয়েটার কোনো হদিস পেল না, মেহেরুন বানুকে জিজ্ঞেস করল,
“পালি কই?”
“সে তো খিলানচর গেছে।”
“মানে?” হিমাদ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল।
“ওর বাপে আইছিলো। লইয়া গেছে লগে কইরা।”
হিমাদ আর কিছু না বলে থমথমে মুখে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলল,
“বর্ষাকাল এসে গেছে। এখন বন্যার সময়। পালিকে নিয়ে যেতে চাইলেই যেতে দেবে?”
মেহেরুন বানু কেঁপে উঠলেন। বন্যার কথা তিনি বেমালুম ভুলে গেছিলেন। একটু ভেবে বললেন,
“তোর এত চিন্তা করন লাগব না। পালির বাপে আবার ওরে দিয়া যাইব।”

চলবে…