বিষাদ বৃক্ষ পর্ব-০৪

0
33

#বিষাদ_বৃক্ষ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৪

আনতারা কোনরকম চোখ খুলতেই দেখলো, ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পরা এক বৃদ্ধ তার সামনে বসে আছে। যার চোখে টলমলো পানি। বৃদ্ধের গায়ের রং কালো, তবুও আনতারার মনে হলো, এর চোখ মুখ থেকে নূরের মতো কোন দ্যুতি বের হচ্ছে। সে কি মারা গেছে? এই বৃদ্ধ কি ফেরেশতা? তাহলে তার বাবা কই? মনে মনে বলেই আনতারা আশে পাশে তাকালো। অস্ফুটভাবে ভাবে বলল, — আমার বাবা কই?

মারুফা দীর্ঘশ্বাস ফেললো! মারুফা ইমরুলের স্ত্রী।ইমরুল আর জাহিদ তারা ছোট বেলার বন্ধু। দু- জনেরই তিন কুলে কেউ নেই। জাহিদ সেখান থেকে পালিয়ে আসার পরে ইমরুলের সাথে পরিচয়। সেই পরিচয়’ই এখন রক্তের সম্পর্কেও হার মানায়। বিপদে -আপদে, সুখে – দুঃখে এই দু- জন দুজনের সব সময় পাশে থেকেছে।

সে দীর্ঘশ্বাস ফেলেই আনতারার মাথার পট্টিটা আবারো ভেজালো। ভিজিয়ে কপালে রাখল। গত কিছুদিন ধরে এই মেয়ের এই অবস্থা। জ্বর গা থেকে নামছেই না। ডাক্তার দেখিয়েছে, ঔষুধ খাইয়েছে। কোন কাজ’ই হচ্ছে না। ঘর সংসার সব ফেলে এখানে পড়ে আছে। কার কাছেই বা রেখে যাবে। আর এই অবস্থায় অন্য জায়গায় নেবে সেই উপায়ও বন্ধ হয়ে আছে। তাছাড়া বেশিভাগ সময়ই অচেতন। যখন জ্ঞান ফিরে হাবিজাবি বলে। সে আবসারের দিকে তাকিয়ে বলল, — চাচা এখন কি করবেন?

আবসার কথা বলতে পারল না। আসলে সে থমকে আছে। এখানে এসে যখন এই রুমে এল, সে সাথে সাথেই চমকে উঠল। এতোটাই চমকেছে যে সে পড়ে যেতে নিয়েছিল। মারুফা তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে ধরেছে। এই মেয়ে দেখতে হুবুহু আনজুমের মতো। সেই চোখ, সেই মুখ, সেই নাক, সেই আগুন ধরা রুপ। সে স্বপ্ন দেখছে না বাস্তব সে এখনো বুঝতে পারছে না। সে থমকেই আনতারার দিকে ফিরে তাকালো। আনতারা নিভু নিভু চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।

যাকে ভাগ্য একবার রাতের অন্ধাকারে তার বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে বাদ্ধ করেছিল। সেই ভাগ্যই আবার তার দৌহিত্রীকে দিনের আলোতে সসম্মানে নিয়ে যাওয়ার রাস্তা তৈরি করছে। কেন? নাকি তার না করতে পারা দায়িত্বের জন্যই এত আয়োজন।

আবাসার মনে মনে নিজেকে কঠিন করল। চোখে আসা পানি ভেতরে দমালো। এই দায়িত্বের সুযোগ তো সে দ্বিতীয়বার হারাবে না। আনজুমের দায়িত্ব সে পালন করতে পারেনি। জাহিদকে রক্ষা করতে পারিনি কিন্তু আনতারা। তাকে সে রাখবে সব কিছুর স্পর্শের বাইরে। আনতারার জীবন চক্রের বিষাদ বৃক্ষের অঙ্কুর কখনোও আর মাটি ভেদ করে উঠতেই দেবে না। কখনো না।

সে থমথমে কন্ঠে ডেকে বলল, — আহমাদ, আহমাদ, ইমাম ডাকো! আজ এই মূহুর্তে আমার আজাদের সাথে এর বিয়ে হবে।

মারুফা অবাক হলো। সেই অবাক কন্ঠে’ই বলল, — কি কন চাচা? বাপ মরলো কিছু দিন। জ্ঞান নাই, এই অবস্থায় কিভাবে বিয়া।

— এমনিই হবে বিয়ে! এর মাথায় পানি ঢালো। ভালো করে ঢালো। শুধু আমি কথা বলতে পারি এই টুকু জ্ঞান আসলেই চলবে। বাকি সব আল্লাাহর ইচ্ছা।

অলি আবসারের বন্ধুর বাসায় থেকে জাহিদ যখন পালিয়ে যায় তখন তার বয়স নয়। পালিয়ে কিছুদিন এখানে, ওখানে রাস্তায় দিন পার করেছে। তখন পরিচয় হয় ইমরুলের সাথে। সে তখন এক ভাতের হোটেলে এটা ওটা এগিয়ে দেয়। তার বিনিময়ে খাদ্য। জাহিদ কেউ সে আরেক হোটেলে ঢুকিয়ে দিলো। ব্যস এভাবেই গিয়েছে দিন। একটু বড় হয়েই ঢুকেছে ভাঙারির ব্যবসায়। সেখান থেকে কারখানায়। খুব যে খারাপ ছিল তা না। তিন কুলে কেউ নেই। এতিম মানুষ। যা কামায় তাতেই দিন ভালো ভাবেই চলে যায়। সেখান থেকেই পরিচয় হয় কবিতার সাথে। কবিতার বাবার ছিল চা, বিড়ির দোকান। কবিতাও মাঝে মাঝে বসতো। সেখান থেকেই জাহিদের সাথে পরিচয়।

জাহিদ দেখতে উঁচা, লম্বা, ফর্সা সুপুরুষ। কবিতাই প্রেমে পড়ে গেল। কবিতার বাবা শুনে মানলো না। থাক তার চায়ের দোকান। তবুও মাথা গোজার মতো নিজের একটা বাড়ি আছে। নিজের বাপ, দাদার নাম আছে। এই ছেলের কি আছে? রুপ দেখে মেয়ে ভুলতে পারে বাপের তো আর ভুললে চলে না ।

ব্যস তারা পালিয়ে বিয়ে করে ফেলল। ফেলে বলতে গেলে নিজেদের পরিচিত গন্ডি থেকে হারিয়ে গেল। টাকা পয়সা কম থাকলেও সুখের কমতি ছিল না। সেই সুখও ছিন্ন ভিন্ন হলো আনতারাকে জন্ম দিতে গিয়ে।

মৃত্যুর আগে কবিতা জাহিদের হাত ধরে বলেছিল, — আমার মেয়ের প্রতি কোন ক্ষোভ রাখবেন না। উপরওয়ালা আসমানের পরী আমার গর্ভে দিছে। বিনিময়ে তারতো কিছু লাগবোই। কথা দেন, তারে দেখে রাখবেন। কোন কষ্ট তারে ছুঁতে দিবেন না।

জাহিদ দেয়নি, বুকে আগলে রেখেছে। অবশ্য কবিতা না বললেও সে আগলেই রাখত। তার তো বেঁচে থাকার কোন সম্বল নেই। আনতারা ছিল তার সেই সম্বল।সাধ্যের মধ্যে সব সুখ পায়ের কাছে এনে রেখেছে। যেখানে মেয়ে একটু বড় হলেই বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে, সেখানে সে মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছে। এমনকি যতক্ষণ আনতারা স্কুলে থাকতো ততক্ষণ চাতক পাখির মত স্কুলের গেইটের সামনেই বসে থাকতো। সেই বসে থাকার মানুষটাই আজ নেই। সে যেমন ছিল এতিম, ঠিক তার মেয়েকেও করে গেছে এতিম।

আর সেই এতিম মেয়ের সাথে সেই দিন সেই সন্ধ্যায় সম্পূর্ণ অচেনা দু- প্রান্তের দুটো- মানুষ, যাদের
চেনা নেই, জানা নেই, চোখের দেখাও নেই। পবিত্র একটা বন্ধনে আবদ্ধ হলো। একজন সম্পূর্ণ জেনে সজ্ঞানে কবুল বলল, আরেকজন আধো আলো, আধো অন্ধকার, আধো জ্ঞান নিয়ে শুধু একটা শব্দ উচ্চারণ করল। কবুল!

সেই অস্ফুট শব্দ দু- রুমের ছোট্ট ঘরের আরেক রুম থেকে আজাদ শুনলো। শুনে তার তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। স্বাভাবিক ভাবে বলল,– যাক এক ফারা কেটেছে। বোবা না এটা নিশ্চিত। বাকি দুইটার খবর কি?

রমিজ তার পাশেই বসা। সে কোন উত্তর করেনি। করার মতো এটা অবস্থাও না। এই পাগলের সেই জ্ঞান না থাক তার আছে। সে উঠে বাইরে চলে চলে এলো। এই ছেলের পাশে থাকলেই বিপদ। সেই বিপদের চেয়ে বাইরেই ভালো। আজকে অবশ্য বৃষ্টি নেই তবে আকাশ মেঘলা।

আবসার সারা রাত নামাজ পড়েছে। একেবারে ফজরের ওয়াক্ত পরে একটু কাত হয়েছিল। বাসায় ওতো জায়গা নেই। দু- রুমের ছোট্ট বাসা। তবে ছোট্ট হলেও গোছানো, মার্জিত। জাহিদ যে তার মেয়েকে সুন্দর ভাবে আগলে রেখেছে তা পুরো ঘরেই স্পষ্ট। তাই ইমরুল তাদের বাসায় আর আজাদ, রমিজ, চলে গেছে খলিলদের বাসায়। আজমল বাবার সাথেই আছে। আর সেও বলতে গেলে থমকে আছে।

বাবা তখন ডাকতেই সে দৌড়ে গেছে। গিয়েই ধাক্কা খেয়েছে। তাদের ধর্মে দ্বিতীয় জন্ম বলে কিছু নেই। এই পৃথিবীতে আদম সন্তান একবার’ই জন্মগ্রহন করবে, একবারই মৃত্যু হবে। তা না হলে সে ধরেই নিতো জাহিদের মা ফিরে এসেছে।

আজাদরা ফিরলো সকালে। খাবার, টাবার নিয়ে। ভেতরের রুমে পাঠিয়ে বাকিগুলো সবাইকে দিলো। দিয়ে আজাদ নিজেও নিল। সে খুব স্বাভাবিক। কাল রাতে তার বিয়ে হয়েছে, পাশের ঘরে তার সদ্য বিয়ে করা নতুন বউ। সে রকম কোন হাবভাব দেখা গেল না। বরং তাকে দেখে যে কেউ ভাববে। দরকারি কাজে টাজে এসেছে। কাজ শেষ এখন যত তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরা যায়, ততই ভাল।

আবসার আজাদের দিকে তাকালো! তাকিয়ে সব সময়ের মতো শান্ত ভাবেই বলল, — আমার সিন্ধান্ত এখন তোমার গলার কাটা মনে হতে পারে দাদা ভাই। তবে বিশ্বাস কর এই সিন্ধান্ত আমার না। উপরওয়ালার। আমি শুধু মাধ্যম। আর এই সিন্ধান্তই একদিন ফুলের মালা হবে। তবে সেই দিন পর্যন্ত তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো। তাকে আমি তোমার ঘাড়ের বোঝা বানাবো না। সে আমার আমানত। আমি যত দিন বেঁচে আছি, ততদিন তাকে আমি নিজে আগলে রাখব।

আবসার যেমন সব সময়ের মতো শান্ত ভাবে বলল, আজাদও সব সময়ের মতো হাসলো! এই হাসির অর্থ অলি আবসার এবারো বুঝতে পারল না। আজকাল ছেলে মেয়েদের মাথায় কি ঘোরে সে বুঝতে পারে না। তবে তাকে অবাক করে দিয়ে আজাদ বলল, — আমি কোন কচি খোকা না দাদাভাই। আর কোন কাপুরুষও না। আমি স্বজ্ঞানে এই বিয়েতে মত দিয়েছি। আর মত যেহেতু দিয়েছি তখন থেকেই সে আমার আমানত। তাই তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো। আমার দায়িত্ব আমি তোমার ঘাড়ে ফেলবো না।

অলি আবসার হাসলেন! তৃপ্তির হাসি। হেসে মারুফাকে ডেকে বললেন, — জ্বর কমেছে?

— জ্বি চাচা একটু কমেছে।

— দাঁড়াতে পারবে?

মারুফা উপর নিচে মাথা নাড়ালো।

— আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই রওরা দেবো। যা যা দরকার গুছিয়ে দাও।

— জ্বি চাচা।

মারুফা কিছুক্ষণের মধ্যেই সব কিছু গুছিয়ে ফেললো। গুছিয়ে আনতার দিকে তাকালো। সে খাটে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। গায়ে খয়েরি চাদর। সে তাকিয়েই মনে মনে মা শা আল্লাহ বলল। মেয়েটা দুনিয়ার রুপ নিয়ে জন্মেছে। চোখ ধাদিয়ে যায়। এমন রুপবতী মেয়ে সে কমই দেখেছে। তবে পোড়াকপালী! এখন আবার কপালে কি আছে কে জানে। চেনা নাই জানা নাই, অচেনা দেশে দেশান্তর। তবে এও ভালো, এখানে থাকলে শেয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খাইতো। ধরে রাখার ক্ষমতা কি আর তাদের আছে।

চলবে……