বিষাদ বৃক্ষ পর্ব-০৫

0
33

#বিষাদ_বৃক্ষ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৫

আজাদ গাড়ি নিয়ে এসে দেখল বাড়ির সামনে বেশ লোকজন। সে ড্রাইভারকে গাড়ি সাইড করতে বলল। এই গাড়ি যাবে ঘাট পর্যন্ত। তারপরে বোট। সে সবার দিকে একবার তাকিয়ে সাইড কেটে ভেতরে গেল। আবহাওয়া গুমট। গরমে নেয়ে ঘেমে একাকার সে , শার্টের কলার পেছনে ঠেলে খাটে গিয়ে বসল।

মুস্তফা বসা আবসারের সামনে। সে আঙুল থেকে চুন মুখে নিতে নিতে আজাদের দিকে একবার তাকালো! তারপর চোখ ফিরিয়ে আবসারের দিকে তাকিয়ে বলল, — আপনারা চাইলেই তো এভাবে নিয়ে যেতে পারেন না। কে আপনারা? চেনা নেই, জানা নেই, হঠাৎ করে হাজির। ভালো না মন্দ তাও তো জানি না। দিনকালের যে অবস্থা, নিয়ে গিয়ে যে বেঁচে দেবেন না তারই গ্যারান্টি কি? মানলাম আত্মীয়! তো? এতোদিন কোথায় ছিলেন?

অলি আবসার দীর্ঘশ্বাস ফেললো! তারা বেরুবে তখনি এই লোক এসে হাজির। একা আসেনি সাথে নিয়ে এসেছে এলাকার লোকজন।

— জাহিদ আমার খাতিরের মানুষ ছিল। আমি তার কাছে মেয়ের হাত চেয়েছিলাম। ঠিক আছে সে হ্যাঁ- না বলার সুযোগ পাই নাই। তবে যেহেতু মারা গেছে। আমাদেরও তো একটা দায়িত্ব আছে। উড়ে এসে এভাবে তো নিয়ে যেতে পারেন না।

আবসারকে মারুফা সবই বলেছে। এর বখাটে ছেলে। পেছনে লেগে গেছে। জাহিদ মারা যাওয়ার পর মারুফা আনতারাকে নিজের বাসায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল । এরা দেয় নি। তাদের এক কথা, কিছু দিন যাক বাপের শোকটা একটু কমুক। তার পরে সবাই বসে দেখা যাক কি করা যায়। এলাকার মেয়ে! ছোট থেকে বড় হলো চোখের সামনে। তিন কুলে তো কেউ নাই। না থাক! তাই বলে ভেসে যেতে তো আর দিতে পারে না ।

এরকম হবে আবসার কিছুটা আগেই অনুমান করেছিল। তাই আনতারাকে কাল জ্ঞান ফিরিয়েই আগে তার বাবার চিঠি দেখিয়েছে। তারপর বলেছে, — এখানে তোমার অনেক বড় বিপদ বুবু। আশা করি তুমি বুঝবে । কিছু কিছু সময় এমন আসে দুঃখকে সাইডে রেখে নিজের জন্য ভাবতে হয়। তোমার এখন সেই সময়। এখন বলো আমার সাথে যাবে?

আনতারা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে থেকেছে। তারপর আস্তে আস্তে উপর নিচে মাথা নাড়িয়েছে।

আবসারের তখন বড় একটা পাথর বুক থেকে নেমে গিয়েছে। সে শান্তির একটা শ্বাস ফেলে আবার বলেছে, — তুমি একটা গোহার ভেতরে আছো । সেখানে অজস্র হিংস্র বিষাক্ত সাপে ভরপুর। সেখান থেকে তোমাকে বের করতে হলে শক্ত একটা দড়ি দরকার। আমার কাছে সেই দড়ি আছে। আমি সেটা বাড়িয়েই দিয়েছি, এখন তোমার পালা। তোমাকেও যে শক্ত করে ধরতে হবে বুবু। না ধরলে আমি টেনে তুলবো কিভাবে? এখন বলো, ধরবে না?

আনতারা এবারো শুধু মাথা নাড়ালো। তার সব কিছু এলোমেলো। জ্বর কিছুটা নেমেছে। নামলেও সব কিছু কেমন যেন ঘোলাটে। তবুও তার মন বলল, এই যে সাদা শুভ্র পাঞ্জাবি পরা অচেনা লোক তাকে বিশ্বাস করা যায়, ভরসা করা যায়।

— সেই দড়িটা কিন্তু চোখে দেখা যায় না, হাত দিয়ে ধরা যায় না , সেটা ধরতে হয় ছোট্ট একটা শব্দ দিয়ে। এখন বলো, তুমি ধরতে রাজি?

আনতারা তাকিয়ে রইল। সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা খুব একটা ধরতে পারে না। আর এখনতো পুরো মাথাই এলোমেলো। তাই কিছুই বুঝল না।

আবসার বুঝল, বুঝে হালকা হাসলো। এই মেয়ে দেখতেই শুধু আনজুমের মতো। কেননা আনজুম আগুনের মতো রুপের সাথে যেমন ছিল কঠিন তেমন ছিল বুদ্ধিমতি। সে হেসেই বলল, — শব্দটা হলো কবুল বুবু। এর চেয়ে শক্ত দড়ি এই পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। এই ছোট্ট একটা শব্দ, অচেনা অজানা দুটো মানুষকে এমন ভাবে বাঁধে। কখনও কখনও একে ছিঁড়তে গেলে দুনিয়া ওলট পালট হয়ে যায়। এই দড়ি ছাড়া তোমাকে এখান থেকে আমি সহজে টেনে বের করতে পারব না। এখন বলো তুমি রাজি?

আনতারা এবার বুঝল। বুঝল বলেই মাথা নাড়াতে পারল না। তবে তার চোখ থেকে টুপ করে পানি গাল বেয়ে নামলো। তার বাবা বলতো, — তোকে বিয়ে দেবো না তারা। সারাজীবন আমার কাছে রাখব। বিয়ে দিলে বাঁচবো কিভাবে বলতো। আমার কেউ আছে। তুই তো আমার সব কিছু। আর এই সব কিছু ফেলে সে’ই চলে গেল।

আবসার আনতারা মাথায় স্নেহের হাত রাখল। অনেক অনেক দিন আগে এভাবেই সে হাত রেখেছিলের আরেকজনের মাথায়। আবার সেই সময়টা হুবুহু ঘুরে এলো। আবসার মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো! ছোট্ট জীবন! তবুও এই ছোট্ট জীবনে আল্লাহ কত কিছু দেখায়।
সে শ্বাস ফেলে কোমল সুরে বলল, — একবার ভরসা করো বুবু। অনেক আগে ভরসার মর্যাদা না রাখতে পারলেও এবার আমি ঠিক রাখবো।

আনতারা কথার অর্থ এবারো বুঝল না। তার বোঝার কথাও না। জাহিদ তার অতীতের কোন ছায়া আনতারার উপরে পড়তে দেয়নি। তবে আনতারা এইটুকু বুঝলো এই পথ ছাড়া অন্য কোন রাস্তা নেই।

সে চোখের পানি মুছলো না। সেই পানি ভরা টইটম্বুর চোখ আর ভেসে যাওয়া গাল নিয়ে হালকা করে আবার মাথা নাড়ল।

অলি আবসার গতকালের কথা মনে পড়তেই মনে মনে স্বস্থির নিশ্বাস ফেললেন। ভাগ্যিস সঠিক সময়ে সঠিক সিন্ধান্ত তিনি নিয়েছেন। সে স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে বললেন , — আপনারা আমার বোনের জন্য এত ভেবেছেন, এটা আমার সৌভাগ্য। তবে একটা কথা ভুল। এর তিন কুলে কেউ নেই। আমি এর নানা। জাহিদেন মামা। বিশ্বাস না হলে দেখেন। সে মৃত্যুর আগে তার মেয়ের দায়িত্ব আমাকে দিয়ে গেছে। বলেই তিনি চিঠিটা বের করলেন।

মুস্তফা সেই চিঠি দেখলো! দেখে নির্বিকার ভাবে বলল, — এটা নকলও হতে পারে। আমরা বিশ্বাস করি না। রেজিস্ট্রি করাও নেই। থাকলে ভাবতাম ঠিক এখান থেকেই পাঠানো হয়েছে।

তখন ইমরুল বলল,– চাচা সত্য কথা বলছে। জাহিদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক একমাত্র আমার’ই ছিল। সে নিজের হাতে আমাকে এই চিঠি দিয়েছে। আর আমি দিয়েছি খলিল কে। আমি জানতাম খলিলের এক বোনের বিয়ে সেই গ্রামে হয়েছে। তাই তাকে বলছিলাম নিয়ে যেতে।

— আমরা এইটাও বিশ্বাস করি না। তুমি যে মিয়া কত কি করো আমরা জানি না বুঝি? কত টাকা খাইছো এদের কাছ থেকে আগে এটা বলো? আজকাল মেয়েদের এমনিতেই বহুত ডিমান্ড, তার মধ্যে আবার এ তো বিরাট সুন্দরী।

অলি আবসার চোখ বন্ধ করলেন। দুনিয়া দিনদিন নোংরা মানুষে ভরে যাচ্ছে কেন? কেয়ামতের আগে আবার জাহেলিয়ার যুগ আসবে। এ গুলা কি তারই আলামত।

রমিজ আবসারের সামনে দাঁড়ালো। আড়াল করে বলল, — অযথা ঝামেলা করবেন না। আমাদের যাইতে দেন। দেরি হচ্ছে, তাছাড়া আপনারাই যে ভালো চাইছেন সেই গ্যারান্টি কি?

মুস্তফা তেড়ে উঠল! তার এলাকায় এসে এত বড় কথা। তেড়ে এগিয়ে দু- কদম এগিয়ে বলল, — মুখ সামলে।

— আমাদের মুখ সামলেই আছে। আমাদের যাইতে দেন।

— না দিলে?

রমিজ উত্তর দিলো না। মুস্তফা মুখ বাঁকিয়ে হাসলো। হেসে বলল, — আমি না চাইলে মেয়েতো ভালোই, নিজের জীবন নিয়েও ফিরতে পারবি না।

আজাদ এতক্ষণ চুপচাপ ছিল! এবার উঠল। উঠে এপাশ ওপাশ করে আড়মোড়া ভাঙলো। ভেঙে সোজা মুস্তফার সামনে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে হাসলো। মুস্তফার মতো বাঁকা হাসি না। ঠোঁট ছড়ানো হাসি। হেসে বলল, — জীবনও থাকবে, মেয়েও নিবো। যা কি করবি কর, দেখি তোর ক্ষমতা কতদূর।

মুস্তফা হা হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। হেসে হেসে কেউ এভাবে হুমকি দিতে পারে তার জানা ছিল না। সে সাথে সাথেই নিজেকে সামলে তার লোকের দিকে তাকালো ।

তাকাতেই এক লোক তেড়ে এলো। আজাদ চোখের পলকে দিলো এক থাপ্পর । থাপড়ে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সে পড়তেই আজাদ পেছনের জনকে দেবে রমিজ এগিয়ে আজাদকে জাপটে ফেরালো। আর কেউ না জানুক সে জানে। আস্ত শয়তান এটা। দিন দুনিয়ার খেতা দিনে সাতবার পুড়ে।

ইমরুল ফেরালো মুস্তফার লোককে। তারা রাগে ফুঁসছে। আহমাদ এগিয়ে সবাইকে ঠান্ডা করল। ঠান্ডা করে কটমটিয়ে আজাদের দিকে তাকালো। আজাদ আবারো হাসলো। তার হাসি দেখে আহমাদ দিশেহারা হলো। বিয়ের কথা শোনার পর থেকে সে মনে মনে একটু অসন্তোষই ছিল। এমন মেয়ে! তবে এখন উল্টো এই মেয়ের জন্যই তার চিন্তা হচ্ছে। কি করবে সে এই ছেলেকে নিয়ে।

আবসার বড় একটা শ্বাস ফেলে সব সময়ের মতো শান্ত ভাবে বলল, — আমার নাতি আর আনতারার কাল বিয়ে হয়েছে। নিজ ইচ্ছায়! প্রমাণ আপনাদের এলাকার ইমাম সাব। তিনি নিজে এই বিয়ে পড়িয়েছেন। আর মেয়ের তিন কুল বলতে এখন আমি’ই। তাই অভিবাবক হিসেবে এই বিয়েতে আমি নিজে স্বীকৃতি দিয়েছি। যেখানে মেয়ে, মেয়ের বর্তমান অভিবাবক কারো কোন সমস্যা নেই। সেখানে আপনারা যদি ঝামেলা করেন তাহলে থানায় যেতে আমরা বাধ্য হবো। এখন বলুন আপনারা কি চান?

মুস্তফা রাগে ফুসলো! ফুসে বলল, — আমরা মানি না।

— আপনাদের মানায় না মানায় কিছু আসবে যাবে না। তবুও আপনাদের শান্তির জন্য আনতারা আপনাদের সামনে নিজেই সব বলবে। বলেই তিনি মারুফাকে ডাকলেন।

মারুফা আনতারাকে ধরে বের করল। তার গায়ে মাথায় চাদরে মোড়ানো। শুধু ফ্যাকাশে মুখ বেরিয়েছে আছে। দৃষ্টি নিচের দিকে। সেই নিচের দিকে তাকিয়েই আস্তে করে বলল, — আমি নিজ ইচ্ছায় তাদের সাথে যাচ্ছি। আর নিজ ইচ্ছায় এই বিয়ে করেছি।

আজাদ কন্ঠ শুনে পেছন ফিরে তাকালো। একপলক তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবে আবার সামনে ফিরল। তার হাবভাব দেখে রমিজ ঝটকাই খেল। বেহেশতের হুরের মতো বউ, এই বউকে দেখেও এ নির্বিকার। সে হা করে দাঁড়িয়ে রইল। এই তো দেখি সত্যিই পাগল।

চলবে…….