বিষাদ বৃক্ষ পর্ব-২১

0
130

#বিষাদ_বৃক্ষ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ২১

মুনিয়া বাপের বাড়িতে পা রাখল প্রায় বছর দুয়েক পরে। তার বিয়ে হয়েছে অন্য জেলাতে। সন্তানসম্ভবা হওয়ার পরে এত দূর বলে শাশুড়ি আর আসতে দেয়নি। অথচ বেশি ভাগ মেয়ের’ই প্রথম ছটি পড়ে বাপের বাড়িতে। তার মা অবশ্য অনেক চেয়েছিল। তবে বিয়ের পরে বাপের বাড়ির মানুষের চাওয়ার দাম কি আর আছে ?

আমেনা মুনিয়াকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। তার প্রথম নাড়িছেঁড়া ধন। বিয়ে দিলো তো দিলো সাত সমুদ্রের পারে। বিয়ের সম্বন্ধ এনেছিল আমজাদের বন্ধু। ছেলে শিক্ষিত, ভালো একটা চাকরিতে আছে। তাছাড়া বাপ, দাদার অবস্থাও ভালো। তাই সব বিবেচনা করে কেউ আর দ্বিমত করেনি।

তবে সমস্যা হলো মেয়েটা ইচ্ছে হলেও দৌড়ে আসতে পারে না। তবে মনের এই টুকু শান্তি মেয়েটা ভালো আছে। তিনি মেয়েকে রেখে নাতিকে কোলে তুলে নিলেন। তার ছেলে সন্তান নেই। এ জন্যই মিথির বাপের যত দুঃখ। তার মধ্যে আবার অসুখ। লোকটার ঘরের মোহ বলতে গেলে কেটেই গেছে। যা আছে শুধু তিন তিনটা কবুল, এর বাইরে আর কিছুই নেই।

তবে তার মেয়ের কোলজুড়ে আল্লাহ প্রথমেই দিয়েছে পুত্র সন্তান। আল্লাহ এরে বাঁচিয়ে রাখুক। ধনে, জ্ঞানে সব কিছুতেই আল্লাহ এরে ভরে রাখুক। বলেই তিনি নাতির পিঠে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।

বাড়ির সবাই এখন বসার ঘরে। মুনিয়া এসেছে তাই সবাই এখানে এসেই বসেছে। শবনম মুনিয়ার জন্য নাস্তা নিয়ে এলো । তার সাথে এসেছে আনতারা। আনতারার অবশ্য অর্ধেক দিনই যায় শবনমের পিছু পিছু ঘুরতে ঘুরতে।

আনতারাকে দেখেই মুনিয়া আবসারের দিকে তাকিয়ে বলল, — বুইড়া এই আসমানের চাঁদ তুমি কই পাইলা?

আবসার হাসলো! বিথী মিথি তার কাছে ঘেঁষেনা বললেই চলে। তবে মুনিয়া ছিল দাদার নেওটা। দাদার ওযুর পানি থেকে শুরু করে তার যাবতীয় কাজ সে’ই করত। আবসার হেসেই বলল, — আকাশ থেকে চুরি করে নিয়ে আইছি গো বিবিজান।

মুনিয়া আজাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, — ওই কামলার লিগা কেন তুমি চুর হইতে গেলা। ওই কামলার লিগাতো কোন কামের ছেরিই ঠিক ছিল। আশে পাশে কোন কামের ছিরি পাও নাই?

আজাদও হাসলো। তবে কিছু বলল না। সে একবার আনতারার দিকে তাকালো। আনকারার গায়ে আজ মিষ্টি রঙের শাড়ি। সে খেয়াল করেছে এই মেয়েকে একেক রঙে একেক রকম লাগে। নাকি তার কাছেই লাগে?

আনতারার অবশ্য এই দিকে খেয়াল নেই। সে গিয়ে বসেছে আমেনার পাশে। মুনিয়ার ছেলেকে কোলে নিতে চাইছে। মুনিয়া নিজেই এগিয়ে গিয়ে তার ছেলেকে আনতারার কোলে দিলো। তার ছেলের দেড় বছর। নাম মুহিন। একেবারে শান্ত শিষ্ট ছেলে। কোন রাগ, জেদ নেই। যার কোলে দেবে বুকে লেপটে থাকে। আনতারারও গেল। আনতারার খুশিতে চোখ, মুখ ঝিলমিল করতে লাগলো।

মুনিয়া হাসল! এইটুকু বয়সে মুনিয়া অনেক মানুষকেই দেখেছে, মিশেছে। দেখেছে বলেই মানুষ দেখলেই বুঝতে পারে, কোন মানুষটা কেমন। এই যে আনতারাকে দেখেই সে বুঝল। সে শুধু দেখতে ফুলের মত না। বরং ফুলের মতোই নিষ্পাপ কোমল।

সে হেসেই মুর্শিদার দিকে তাকিয়ে বলল, — বড় মা ভাবিরে ভালো দেখে একটা কবিরাজ দেখাও। এতদিন হলো আমাদের ভাতিজি, ভাতিজা আসে না কেন?

শবনম মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল! ফেলে আর বসলো না, বেরিয়ে গেল। এখন সব কথা কোন দিকে যাবে সে ভালো করেই জানে। এই দুনিয়ার সব দোষ বউদের। ছেলেরা তো সর্বগুণে গুণধর।

আর এই গুণধরকেই আঙুল তুলে দেখিয়ে তার বলতে ইচ্ছে করে, পারলে আগে তোমাদের গুণধরকে কবিরাজ দেখাও। বেটা খাটাশ! চুলে পাক ধরতাছে, তবুও বাপ হইতে শরম লাগে।

শবনমকে বেরিয়ে যেতে দেখে মুর্শিদা মুখ বাঁকালো। বংশের বাতি দেওয়ার খবর নাই, আবার দেখো তার তেজ।

শবনমের যাওয়া আসাদও দেখল। দেখে সে নিজেও মনে মনে বড় একটা শ্বাস ফেললো। শবনম আগেও তার সাথে খুব একটা যে কথা বলতো তা না। তবে আজকাল দরকার ছাড়া বলেই না। অবশ্য বিয়ের পর পর এমন ছিল না। দুষ্টুমি করত, গল্প করতে চাইত। কারণে অকারণে খিলখিল করে হাসত। ধমক খেতে খেতে এই পর্যন্ত এসেছে। তো? এরকমই তো চেয়েছিল। কলের পতুল। তাহলে বুক এতো জ্বলছে কেন?

আসাদও উঠল। শবনমকে কাছে টানলে চোখ বন্ধ করে শক্ত হয়ে পড়ে থাকে। তাই সে হয়ত খেয়ালও করেনি আসাদ কিছুদিন কোন ব্যবস্থা নেই। সে বেরুবে তখন আমজাদ বলল,– আসাদ আরেকটু বস। আসল কথা তো বললামই না।

আসাদ অনিচ্ছা নিয়েও বসল। বসতেই আজমল বলল, — বড় ভাবির কথা ঠিক। সমন্ধ ভালো। খোঁজ খবর নিয়েছি। ছেলেও ভালো। ম্যাট্রিক দিছে। দেওয়ার পর বিলেত গেছে। আয় – রোজগারও ভালো। তাহলে তোমরা পাকা কথা দিয়া দেও। তারা আসুক মেয়ে আমাগো দেখুক। যদি সব দিক দিয়া খাটে। তো আলহামদুলিল্লাহ।

মুর্শিদাও সাথে সাথে বলল, — আলহামদুলিল্লাহ। সেই ঝগড়া ঠিক হলেও মুর্শিদার মনে মনে জেদ চেপেছে। তার মেয়েকে এত বড় কথা। সেও ভালো ঘরে বিয়ে দিয়ে দেখিয়ে দেবে।

বলেই সে রমিজের দিকে তাকিয়ে বলল। দুপুরে খাইয়া রওনা দিয়া দেও। সন্ধ্যার আগে আমি শুভ সংবাদ শুনবার চাই।

— জ্বি বড় মা। আমি গিয়ে খবর একেবারে সাথে করে নিয়ে আইবো।

সেই বৈঠক সেখানেই শেষ হলো। যার যার মতো সবাই বেরিয়ে গেল। আজাদও বেরুবে। সে তার রুমে এসে শার্ট তো পেল তবে প্যান্ট কোথাও পেল না। অবশ্য এই ঘরে আজকাল সে কিছুই পায় না। আগে থাকত হাতের কাছে। এই টেবিলে আলনার উপরে। এখন এসে তো রাখে কিছুক্ষণ পরেই উধাও। সে খুঁজতে গিয়ে আলনা, আলমারি পুরো এলোমেলো করে ফেলল।

আনতারা মুহিনকে কোলে নিয়েই এসেছে। সে মুহিন কে পেয়ে মহা খুশি। ছোট বাচ্চাদের তো সে কখনো সেই ভাবে পাইনি। তাই মুহিন কে সে কোলছাড়া করছেই না। সে এসেই পুরো ঘরের অবস্থা দেখল। দেখেই মুখ কালো হয়ে গেল। আবার সব গুছাতে হবে।

সে মুখ কালো করেই তার মিহি সুরে বলল, — কি করছেন?

আজাদ সাথে সাথেই তাকালো। তাকিয়েই তার হাসি পেয়ে গেল। আনতারার ফর্সা মুখে নাকের সাদা সুতো এখন কালো হয়ে গেছে। তবুও এ মেয়ে খুলবে না। সে নাকফুল এনেছে। স্বর্ণের মধ্যে ছোট্ট লাল পাথরের। কেন জানি নাকফুলটা দেখেই তার মনে হলো, এটাই একদম ঠিক।। অন্য কিছু এই মুখে মানাবেই না। তবে এই মেয়ে ছুঁয়েও দেখেনি।

আনতারার কালো মুখ আরো কালো হলো। ভ্রু কুঁচকে বলল, — আমি বলেছিলাম আমার সামনে হাসবেন না।

আজাদ সাথে সাথেই কানে হাত দিয়ে জিহ্বা কাটলো। অবশ্য তার মুখ হাসি হাসি। সে কানে হাত দিয়েই বলল, — ভুল হয়েছে মহারাণী।

— আপনি বলেছিলেন?
— আর হবেনা। সত্যিই হবেনা। এবারের জন্য চাইলে শাস্তি দিতে পারো।

আনতারা কিছু বলল না। সে ভেতরে ঢুকে আলমারিতে উঁকি দিয়ে বলল, — খুঁজছেনটা কি?

— প্যান্ট বলেই আনতারার কোল থেকে টেনে মুহিনকে নিতে গেল। মুহিন আনতারাকে জড়িয়ে ধরে ছিল। অঘটন তখনি ঘটল। মুহিনের সাথে আনতারার কাপড়ের পুরো আঁচল চলে এলো।

আনতারা থতমতো খেয়ে গেল। লজ্জা পাওয়ার সময়টুকু অবশ্য আজাদ তাকে দেয়নি। ঝট করে মুহিনের গায়ে থেকে আঁচল ছাড়িয়ে’ই সে বেরিয়ে গেল। সে তো বেরিয়ে গেল। আর আনতারা। সে নিজের দিকে একবার তাকালো। কাপড় সে কোমরের মাঝ বরাবর’ই পরে। তবে সারা দিনের হাঁটা চলায় সেটা একেবারে শেষ সীমানায় গিয়ে ঠেকেছে। আর ঠেকেছে বলেই সে থরথর করে কাঁপতে লাগলো।

তার এই কাঁপাকাঁপি পরে থামলেও লজ্জা আর অস্বস্থি একদমই গেল না। তাই রাতে সে মুনিয়া কে বলল, — আজকে আমি মুহিনের সাথে ঘুমাই আপা?

মুনিয়া হাসলো! হেসে বলল, — এটা বলার কি হলো। ইচ্ছে হলে ঘুমাও। আনতারার কথা শুনে শবনমও বলল, — তাহলে আমিও এখানেই ঘুমাচ্ছি। বলেই মনে মনে বলল, — ওই খাটাশের পাশে শোয়ার চেয়ে এখানেই ভালো। অন্তত পতুল হয়ে থাকতে হবে না।

মিথি অবাক হয়ে বলল, — আপা এলে সব সময় আমাদের সাথে ঘুমায়। তোমরা ঘুমালে আমি আর বিথী ঘুমাবো কই?

সেই দিনের পরে বিথী শবনমের সাথে কথা বলে না। অবশ্য কখনো নিজে থেকে বলেও না। শবনমই ডেকে রাগ ভাঙিয়ে কথা বলে। তবে এবার শবনম বলেনি। তাই বিথীও আর কথা বলেনি। সে বিরক্ত মুখে বলল, — রুমের আকাল পড়ছে নাকি। বড় আপা তুমি এদের নিয়ে অন্য ঘরে চলে যাও। আমাদের সাথে ঘুমাইতে হইবো না।

মুনিয়া হাসল! ইশ! এই মিষ্টি সময় গুলো শুধু বাবার বাড়িতেই এলে বুঝি পাওয়া যায়। সে হেসেই বলল, — যদি হয় সুজন, তেঁতুল পাতায়ও ন জন। তাই আজকে আমরা সবাই এক সাথে ঘুমাবো।

রমিজ ফিরেছিল কালকে সন্ধ্যার পরে। তারা খবর পাঠিয়েছে এই শক্রবারই নাকি তারা দেখতে আসবে। ছেলের ছুটি কম। দেখা টেখার পর্ব ঠিক মত হলে, এই সপ্তাহেই নাকি বিয়ে কাজ সম্পূর্ণ করবেন। মুর্শিদা বাড়িতে ধুম লাগিয়ে ফেলেছে। ঘর ধোর পরিষ্কার থেকে বাজার সদাইয়ের মেলা লাগিয়ে ফেলেছে।

আনতারার দায়িত্ব পড়েছিল সোহাগীকে নিয়ে ঘর গোছানো আর শোকেজ থেকে কাঁচের জিনিসপত্র বের করে পরিষ্কার করা। সে সব ঠিকমতোই করেছে। তবে শোকেজ থেকে কাঁচের জিনিসপত্র নামাতে গিয়ে দুটো প্লেট হালকা ফাটিয়ে ফেলেছে।

আনতারা ভয়ে শেষ। সোহাগী, নাহার ফুপু দুজনেই তার শাশুড়ির নেওটা। এখন দেখলেই গিয়ে বলে দেবে। সে ভয়ে ঘামতে লাগল। তখনি কোথা থেকে আজাদ এলো আনতারা জানে না। সোহাগী কে সাইড কেটে তার সামনে এসে বলল, — দেখি দুটো প্লেট দাওতো। আমার একটু কাজ আছে। বলেই আনতারার হাত থেকে টেনে নিয়ে নিল। নিয়েই সব সময়ের মতো ধরুম ধারুম করে যেতে গিয়ে হাত থেকে ফেলল।

সোহাগী চেঁচিয়ে উঠল! মামি গো মামি ছোট ভাইয়ে প্লেট ভাইঙা ফেলছে।
মুর্শিদা দৌড়ে এলো। কাঁচের জিনিস সে খুবই মহব্বত করে রাখে। অতি প্রয়োজন ছাড়া শোকেজ থেকে বেরই করে না। সেই কাঁচের জিনিস ভাঙতেই তিনি আজাদের হাতে দু-টো বসালেন। ইচ্ছে মতো তুলোধুনো করলেন।
আজাদের অবশ্য তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। সব সময়ের মত শুধু ঠোঁট ছাড়িয়ে হাসলো।

আর এই দিকে আনতারা হতম্ভব। কি থেকে কি হলো সব তার মাথার উপর দিয়ে গেছে। তবে এই হতম্ভবের মাঝেও সে খেয়াল করল, এই খারাপ লোকটার হাসি আজকে এতোটুকুও খারাপ লাগছে না।

চলবে…..