#বিষাদ_বৃক্ষ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ৩৬ ( শেষ পর্ব)
আজাদ গাড়ির সামনে এসে দেখলো আনতারা সোজা চুপচাপ বসে আছে। ভেতরের স্বল্প আলোতেও সে বুঝলে আনতারার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তার ভ্রু কুঁচকে গেল। এখন এমন কোন গরম না যে এভাবে ঘামতে হবে, নাকি ভয়ে?
সে সাথে সাথেই দরজায় হাত রাখল। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সে কয়েকবার টানাটানি করেও লাভ হলো না। সে আবার আনতারার দিকে তাঁকালো। আনতারা তার দিকে না ফিরলো, না নড়লো। তবে তার নিশ্বাসের গতি ধীরে ধীরে বাড়ছে আজাদ ঠিক দেখলো।
আজাদ কাঁচের সামনে গিয়ে কোমল গলায় ডাকলো, — আনতারা।
এই এক ডাকে আনতারার ভেতর পর্যন্ত নাড়িয়ে গেল। এই প্রথম তার ইচ্ছে করল, আজাদের বুকে মিশে যেতে। আর বলতে, — আপনি আমার দেখা সবচেয়ে ভালো মানুষ।
কিন্তু, না সে ফিরলো না কিছু বলল। তবে তার গাল গড়িয়ে অবিরাম পানি পড়তে লাগলো।
আজাদ আবার আগের মতোই বলল, — আনতারা দরজা খোল।
আনতারা এবারো কিছু বলল না। আজাদ এবার একটু উঁচু গলায়’ই বলল, — দরজা খোল আনতারা।
আনতারা আগের মতোই রইল। আজাদের কেন জানি আর ধৈর্য্য হলো না। সে দাঁতে দাঁত চেপে কাঁচের গ্লাসে এক থাবা মারলো। মেরে চেঁচিয়ে বলল, — দরজা খোল আনতারা।
আবসার এখান থেকেও আজাদের কন্ঠ শুনলো। শুনে কামালউদ্দিনের ছেলেদের দিকে তাঁকিয়ে বলল, — তোমরা এদিকের সব সামলাতে পারবে?
— জ্বি দাদা।
আবসার এগুতে গিয়েও আবার ফিরে তাকালো। ছেলেগুলোর মুখের দিকে তাঁকিয়ে বলল, — পাপ সব সময় পাপই হয়। সেটা যেই কারণেই করা হোক। এখন আমরা সবাই সমান পাপের ভাগীদার। তার মানে এই না পাপ করে যেতেই হবে। সময় আমাদের বাধ্য করেছে, এই বাধ্যকে অভ্যাসে পরিণত করো না।
ছেলেগুলো কোন উত্তর দিলো না। তবে মাথা নিচু করে দাঁড়ালো। আবসারও কিছু বলল না। সে আজাদের দিকে এগিয়ে গেল। এর আবার কি হলো?
আজাদ অস্থির হয়ে কাঁচে কয়েকটা থাবা মেরে বলল, — আমি শেষ বার বলছি দরজা খোল।
আনতারা উপুর হয়ে সিটে মুখ গুঁজল। মারা যেতে কত সময় লাগে? সে মরছে না কেন? এই যে আজাদের ছটফটানি তার বুকে লাগছে। এই লাগাতো মরার চেয়েও কষ্টের।
তখনি বিকট শব্দ হলো। একবার না। পরপর দুবার। আজাদ শরীরের সব শক্তি দিয়ে সাইড থেকে ইট নিয়ে মেরেছে। কাঁচের কি আর সাধ্য আছে গুড়ো গুড়ো না হওয়ার।
আনতারা কেঁপে উঠল। তার ভেতর থেকে তখন হালকা খিঁচুনি আসছে। সে কোনরকম মাথা উঁচু করতে না করতেই আজাদ ততক্ষণে দরজা খুলে ফেলেছে।
সে খুলেই আনতারাকে টেনে সোজা করল। কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাঁকিয়েই আশে পাশে চোখ বুলালো। সিটের এক কোনে ইঁদুর মারার ঔষুধের প্যাকেট আর পানির বোতল। তাদের বাড়িতে এর চেয়ে আর বেশি পাবে কি?
সে সাথে সাথে আনতারার মুখ চেপে ধরল। আনতারা তখন চোখে ঘোলা দেখছে তবুও আজাদকে ঢেলে সরাতে চাইল। আজাদের সাথে পারলে তো? সে আনতারাকে চেপেই, জোর করে মুখ খুললো। হা করিয়ে গলায় আঙুল ঢুকিয়ে দিলো। দিতে দেরি গলগল করে বমি করতে আনতারার সময় লাগেনি। আজাদ থামলো না। পানির বোতল নিয়ে আবার জোর করে গলায় ঢাললো। ঢেলে আবার বমি।
আনতারা ততক্ষণে পুরো নিস্তেজ। পুরো গাড়ি আর আজাদ বমিতে মাখামাখি। আজাদ ডানে বামে দেখল না। তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসতে বসতে আবসারকে বলল, — আনতারাকে ক্লিনিকে নিতে হবে। তুমি ওদের সাথে এসো।
পরিমল বাবু আজাদের দিকে তাকালো। এর হুলিয়া সব সময়ই দেখার মত। আর আজ? দেখার উপরে চলে গেছে। এলোমেলো চুল, পুরো শরীর বমিতে মাখামাখি। এক হাতে সিগারেট। আগুন নেই অবশ্য। তবুও নিয়ে বসে আছে। সেই বসে থাকাও স্থির নেই। পরিমল বাবুর মনে হলো আজাদের হাত হালকা কাঁপচ্ছে।
এরকম অবস্থাও তার হাসি পেল। হাসি চেপে বলল, — আমরা সবাই মৃত্যুর পথযাত্রী। সেই যাত্রা দেখে কেন এতো হায়- হুতাশ, বিষাদ। ব্যাপরটা হাস্যকর না?
আজাদ কঠিন চোখে পরিমল বাবুর দিকে তাকালো। পরিমল বাবু এবার হেসে ফেললো। হেসে বড় একটা শ্বাস ফেলে বলল, — আনতারা প্রেগন্যান্ট ছিল।
আজাদ সিগারেট ঠোঁটে রাখল। লাইটার বের করতে করতে বলল, — থাকলে থাকবে। সমস্যা কি? আনতারা ঠিক আছে?
— হুম!
— সে ঠিক থাকলেই হবে। জ্ঞান ফিরবে কখন?
— একটু সময় লাগবে।
— এই বাচ্চার খবর এখানেই শেষ। তৃতীয় কান যেন না হয়। আর আনতারার কানে তো অবশ্যই না।
— কেন?
— আর কোন বিষাদ আমি আনতারাকে ছুঁতে দেব না।
পরিমল বাবু হাসলেন। আজাদ উঠল। বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, — রমিজের অবস্থা কি?
— রক্ত অনেকটা গেছে। তবে ভালো। আসাদ সঠিক সময়ে নিয়ে এসেছে।
— জ্ঞান আছে?
— আছে তবে ঘুমোচ্ছে।
— ঘুম থেকে উঠলে পাছার মধ্যে কয়েকটা লাথি মারবেন। গাধা! চিঠিটা গায়েব করতে বলেছিলাম। মাছের মতো ঘরে জিলিয়ে রেখেছে।
আনতারা চোখ খুলে সেই প্রথম দিনের মতো আজও আবসারকে দেখলো। আজকে অচেতন না, তবুও এই মানুষটাকে তার ফেরেশতার মতোই মনে হলো। যে ভালোবাসা বিলাতে কখনো কার্পণ্য করে না। সে রক্তের কেউ হোক আর দূরের।
আবসার আনতারার মাথায় হাত রাখল। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, — আনজুম নিজের জীবন দিয়েছিল জাহিদের জন্য। আর জাহিদ মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত সে একজনের জন্যই বেঁচেছে। সেটা তুমি! সে চেয়েছে তাদের বিষাদ বৃক্ষের কালো ছায়াটা তোমার উপরে না পরুক। যে কালো ছায়ার কালো কালিতে তাদের জীবনের গল্প লেখা হয়েছে। সেটা তোমার না হোক। সে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত চেয়েছে তুমি ভালো থাকো? সুখে থাকো। তো? আনজুমের জীবন শেষ হয়েছে বিষাদে, জাহিদের জীবনও বিষাদে। তুমিও কেন সেই রাস্তা নিয়েছো বুবু?
তুমি কি ভেবেছো, তোমার জীবন শেষ করলেই এই বিষাদের চক্র শেষ । উঁহু! রক্তের চেয়েও আরেকটা দৃঢ় সম্পর্ক আছে, যেটায় আমি তোমাদের বেঁধেছি। তোমার থেকে যেত তার কাছে, তার কাছ থেকে তার পরিবারের কাছে। এই চক্রের নামই দুনিয়া, এই চক্রের নামই সংসার, এই চক্রের নামই বেঁচে থাকা।
আমরা যদি তোমাকে নিয়ে বেঁচে থাকতে পারি তুমি কেন পারবে না? জীবনের চেয়ে কি রক্ত বড়? প্রত্যেক মানুষ আলাদা, প্রত্যেক সত্বা আলাদা। আল্লাহকে দেখ, তার কাছে বংশ নেই, রক্ত নেই, মা, বাবা, সন্তান কিছুই নেই। তার কাছে সবাই সমান। যে ভালো কাজ করে সে ভালো, যে মন্দ করে সে মন্দ। তার বংশ ভালো, তার রক্ত ভালো, তার বাবা ভালো এগুলো কিন্তু তিনি কখনো দেখেন না। দেখেন যার যার কর্ম। আমরা কেন তার মতো ভাবি না?
একবার এভাবে ভেবো আনতারা। তুমি তুমিই আনতারা। তোমার শরীরের রক্তের শেকড় কোন বৃক্ষের সেটা বড় কথা না। তুমি আনতারা! এটাই তোমার পরিচয়। এই পরিচয় টুকু নিয়ে বাকি জীবন টুকু আমার আজাদের সাথে বাঁচতে পারবে না বুবু?
আনতারার চোখে পানি। সেই পানি নিয়েই উপর নিচে হালকা মাথা নাড়ালো। আবসার হাসলো! হেসে বলল, — আল্লাহ তোমাকে নেক হেদায়েত দান করুক।
বলেই তিনি উঠলেন। উঠে বললেন, — ঐ পাগলা গরুকে গোসলে পাঠিয়েছি বুঝেছো। তা না হলে পুরো ক্লিনিক ফাঁকা হয়ে যেত। এখন এসে যদি উপর নিচ কিছু বলে সোজা আমাকে বলবে। একেবারে টাইট করে দেব।
আনতারা হালকা হাসলো। বিষাদের রঙিনে রাঙানো হাসি। চাইলেই এই বিষাদ হাসি থেকে আলাদা করা যায় না। না কখনো যাবে। আবসার বেরিয়ে যেতেই আনতারা জানালার দিকে তাঁকালো। তখনি ধরাম করে আবার দরজা খুললো। আনতারা সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে ফেললো।
বন্ধ করলেও সে বুঝলো, দরজা আবার ধরাম করে লাগনো হলো। লাগাতে না লাগাতেই তার পাশে আজাদ ধরাম করে শুয়ে পড়ল।
আনতারা নড়লো না। আজাদও ডাকলো না। এক হাত তার পেটের উপরে রেখে, কানের কাছে আরাম করে শুতে শুতে বলল, — জীবন থেকেতো ঘুম নামক জিনিসই উঠে গেছে। তাই আগে ঘুমিয়ে নিই। এতক্ষণে হিসেব কষতে থাকো, কি কি অপরাধ করেছো আজাদের তারা বেগমের সাথে। সব গুনে গুনে পাই টু পাই হিসেব নেব।
আনতারা যে ভাবে শুয়ে ছিল, সে ভাবেই শুয়ে রইল। মুখ ফেরালো বেশকিছুক্ষণ পরে। সে ভেবেছিল আজাদ ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু মুখ ফেরাতেই আজাদ তাঁকালো। তাঁকিয়ে কোমল সুরে বলল, — কি হয়েছে?
আনতারার চোখে আবার পানি চলে এলো। নিজের পানির জন্য সে নিজেই বিরক্ত হলো। এতো প্যানপ্যানানি কেন সে?
— কাঁদছো কেন?
— আমার কষ্ট হচ্ছে।
— আমি সব কষ্ট দূর করে দেব।
— আপনি পারবেন না।
— তোমার জন্য আমি সব পারি।
— কেন পারেন?
— ভালোবাসি যে তাই।
— কেন ভালোবাসেন?
— আজাদের তারা বেগম আপনি। ভালো না বেসে থাকা যায়?
— যদি অনেক অনেক দিন পরে এই ভালোবাসা না থাকে। ঘৃণা করেন আমাকে?
— ঘরে সব সময় ইঁদুর মারার বিষ এনে রাখব। যখনি দেখবে ভালোবাসা শেষ। টুপ করে কিছু সাথে গুলিয়ে খাইয়ে দেবে। শেষ কাহিনী খতম।
আনতারা মুখ ফুলালো। আজাদ হাসলো। হেসে চোখ আবার বন্ধ করতে করতে বলল, — মুখ ফুলাও আর যাই করো। শাস্তি মওকুফ নেই। এক বিন্দুও নেই। তাড়াতাড়ি হিসেব কষো।
এক বৈশাখ শুরু হয়ে মাঝে চলে গেছে কয়েকটা বৈশাখ। চলে গিয়ে আবার এসেছে আরেক বৈশাখ। এই বৈশাখের কালবৈশাখি ঝড়ের তান্ডবে এলোমেলো হচ্ছে ঘরের দরজা, জানালার পর্দা।
সেই পর্দা ভেদ করে আসা ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির কণা, আপন মনে ঘরের মেঝেতে আঁকিবুঁকি করে চলছে। সে আঁকিবুঁকির মাঝে আনতারা বসে। গায়ে তার শুভ্র সাদা কামিজ। সেই কামিজের গায়েও ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির সিলমোহর। গায়ে জড়ানো ওড়না, আর ছেড়ে রাখা চুল এলোমেলো ভাবে বাসাতে দোল খাচ্ছে । আর তার দৃষ্টি ধ্যান সব বাইরে।
তার ধ্যান বাইরে থাকলেও আরেক জনের ধ্যান ঠিক তার উপরে। আনতারা অবশ্য জানে না। বিয়ের এতদিন পরেও সে বুঝতে পারে না আজাদ কখন ঘুমায় কখন জেগে থাকে। সে এও জানে না আনতারা পাশে না আসা পর্যন্ত তার ঘুমোতে ইচ্ছে করে না। তাই ঘুমের ভান ধরে পরে থাকে। আনতারা যতক্ষণ ঘুরে বেড়ায়,যতক্ষণ আলনা গোছায়, টেবিল গোছায়, বারান্দার গাছে ঘুরে ঘুরে আঙুল ছোঁয়ায়। আজাদ তাঁকিয়ে থাকে। কি করে, না করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। দেখে যে তার মন ভরে না। এখন না সেই যে প্রথম দেখল, তখনি শুরু হলো তার এই রোগ। গায়ে স্কুল ড্রেস, কাঁধে ব্যাগ, সাদা স্কার্ফে মুড়ানো শুভ্র একটা মুখ। যেই মুখ দেখে তার পুরো দুনিয়া’ই উল্টে গেল।
তখনি ট্রিংগ ট্রিংগ করে শব্দ হলো। আনতারা সাথে সাথেই ফিরে তাঁকালো। আজকাল এই বাটন ফোনগুলো খুব বেরিয়েছে। কি সুন্দর এক জায়গার বসে আরেক জায়গার মানুষের সাথে কথা বলা যায়। চলছেও বেশ। সবার বাসাই একটা না একটা আছে। অবশ্য বেশ দাম। তবুও আজাদ দু- টো কিনে ফেলেছে। একটা থাকে আজাদের কাছে, আরেকটা ঐ বাড়িতে।
আনতারা উঠল! এগিয়ে গিয়ে ফোন ধরতেই শবনমের উচ্ছ্বাসিত কন্ঠ শোনা গেল। তার এক ছেলে হয়েছে। ছেলে দেখতে হুবুহ আসাদ ভাইয়ের মতো। এই নিয়ে তার আক্ষেপের শেষ নেই। প্রায় সময়ই কপাল চাপড়ে বলবে, — পেটে রাখলাম আমি, কষ্ট করলাম আমি। বের হলো খাটাশের মতো। এটা কোন দেশের ইনসাফ?
তার এসব হাবিজাবি কথায় আসাদ ভাই এখন আর রাও করে না। ছেলে বউ নিয়ে সে এখন মহাখুশি।
সেই উচ্ছ্বাসিত কন্ঠেই শবনম বলল — আনতারা কবে আসবে?
— আমি জানি না ভাবি।
— তুমি তো কখনো কিছু জানো না। ভেনদি। এতদিন হলো বিয়ে হয়েছে। এখনো মিউ মিউ। আর ঐ দিকে দেখো। মিথিতো ছক্কা ফাটিয়ে দিচ্ছে। বেচারা জহির ভাই। না কিছু বলতে পারে, না সইতে পারে।
— ওরা ভালো আছে তো ভাবি?
— জহিরের টা জানি না, তবে মিথি ভালো আছে। সে আঙুল যেই দিকে নাচায় জহির ভাই সেই দিকে।
আনতারা হাসলো! শবনম বিরক্ত মুখে বলল, — রাখতো তোমার হাসাহাসি। আজাদ ভাইয়ের কাছে দাও।
আনতারা আঙুল সোজা করে আজাদের বাহুতে হালকা খোঁচা দিল। বিথীর বিয়ে ঠিক হয়েছে। আসাদ ভাইয়ের পরিচিত। হাই স্কুলে নতুর জয়েন করেছে। খুবই ভালো ছেলে। অবশ্য বিথীও আগের মতো নেই। সেই বিয়ের জন্যই শবনম ভাবি মাথা ধরিয়ে ফেলছে। কবে আসবে কবে আসবে?
আজাদ আর সে এখন থাকে গঞ্জে। ক্লিনিকের উপরেই ছোট করে একটা বাসা করা হয়েছে। দুটো রুম, একটা বাথরুম, একটা রান্নাঘর আর একট বারান্দা। অবশ্য সব সময়ের জন্য না। এখন সে কলেজে। সে যখন স্কুলে ভর্তি হয়েছে তখন এসেছে । অবশ্য সে নিজে ভর্তির ব্যাপারে কিছুই বলে নি। আসাদ ভাই চেষ্টার চূড়ান্ত করে ফেলেছে। আর আজাদ তো আজাদ’ই। ওখান থেকে আসা যাওয়া অনেক কষ্টের। তাই এই ব্যবস্থা।
আনতারার এক খোঁচায়ই আজাদ উঠে বসলো। বসে স্বাভাবিক ভাবেই মোবাইল হাতে নিয়ে কানে রেখে বলল।
— বলো ভাবি?
— কবে আসবে?
— বিয়ের আগে থাকলেই তো হল।
— মা রাগ করবেন?
আজাদ হাসলো। মা এখনো ঠিকঠাক আনতারাকে মেনে নিতে পারে না। তার মধ্যে আবার এই লেখাপড়া। অবশ্য কিছু বলেও না। সে হেসেই বলল, — এসে যাব ভাবি। দাদা ভাইয়ের অবস্থা কি?
— এসো! তোমার কান মালার জন্যই বসে আছে।
— জানি! যতবার যাই, কান মলাইতো খেয়ে আসি।
— তার বুবুকে জ্বালাও খাবে না?
আজাদ আবারো হাসলো! হেসে আনতারার দিকে তাকালো। সে বসে আছে চুপচাপ। চুপচাপ বসলেই আজাদের মনে হয়, আনতারার চোখে মুখে এক বিষাদের ছায়া পড়ে। যেই ছায়ায় মেয়েটা হারিয়ে যায়। এই বিষাদ আজাদ দূর করতে পারে না কেন?
সে মনে মনে বড় একটা শ্বাস ফেলে চোখ ফিরিয়ে নিলো। নিয়ে হাই তুললো। যেন ঘুমে গলে যাচ্ছে। সে গলে যেতে যেতে বলল। — এখন তাহলে রাখি ভাবি। চিন্তা করো না এসে যাব।
— রাত ভরে কোন গুলগুটি খেলো বলো তো । দিন দুপুরে চোখে দেখ না।
— তোমার দেবরাণীকে জিজ্ঞেস করো? আমি বললে তো আবার বলবে বেশরম, মুখে লাগাম নেই।
— তোমার মুখে তো আসলেই লাগাম নেই। বদমাইশ! রাখ! বলেই শবনম ফট করে ফোন রাখলো।
আজাদ হাসলো। হেসে আনতারার দিকে তাঁকালো। সে তাঁকিয়ে আছে রাগি চোখে। কতবার বলেছে কথাবার্তা ভালোভাবে বলতে।
আজাদ শুনলে তো! সে হেসেই বলল, — কি হয়েছে?
আনতারা কিছু বলল না। উঠে চলে যেতে নিল। আজাদ এক টানে আনতারাকে নিয়েই ধপাস করে খাটে পড়ল। আনতারাকে অবশ্য আগলে পড়েছে।
তবুও আনতারা চোখ মুখে বিরক্তি নিয়ে বলল, — আমি নানা ভাই বিচার দেব। সব সময় এমন। ভালো ভাবে কোন কাজ করা যায় না। সেই দিন মশারির স্ট্যান্ড ভেঙে পড়েছে।
— তোমার উপরে তো আর পড়েনি?
আনতারা মুখে কুলুপ টেনে বসল। এর সাথে কথা বলাই বৃথা। উপরে পড়ে নি বলে সব ভেঙে চুড়ে ফেলতে হবে?
তখনি আবার ফোন বাজলো। এবার পরিমল বাবু। আজাদ উঠে ফোন ধরল। আনতারা সরতে চাইলো। আজাদ দিলে তো। একহাতে ফোন ধরে আরেক হাতে আনতারাকে শক্ত করে ধরে রাখল। রেখে বলল, —
— বলেন কাকা?
— মঈন নামের কাউকে চেনো?
— চিনি। এলাকার নতুন মাথা।
— ইব্রাহিমের না হওয়া ক্লিনিক নাকি এখন সে করবে। খুব হাবভাব নিচ্ছে।
আজাদ হাসলো! তার মন ভোলানো হাসি। হেসে বলল, — এই গ্রামে একটাই ক্লিনিক কাকা। সেটা আশা ক্লিনিক।
পরিমল বাবু হো হো করে হাসলো। হেসে বলল, — কথা সত্য। একদম সত্য।
#সমাপ্ত