বিষাদ_বৃক্ষ পর্ব-২৬+২৭

0
29

#বিষাদ_বৃক্ষ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ২৬

বৈশাখ মাস বিদায় নিয়েছে অনেক আগেই। ঝড় টর নেই বললেই চলে। এটা অলি আবসারদের ভাগ্য বলুক আর যাই বলুক। বিদায় নিয়েও যেন ঠিক কালবৈশাখীর আরেক রুপ এসে সারা রাত শুধু বিয়ে বাড়ি কেন পুরো গ্রামকেই লন্ডভন্ড করে ফেলল। এই লন্ডভন্ডে অবশ্য বিয়ের বাড়ির আমেজে কোন ভাটা পড়ল না। সকাল হতেই আবার সব শুরু ।

আজাদ সারা রাত ঘুমায়নি। সকালে রুম একটু খালি পেয়েই পটাং হয়ে শুয়ে পড়েছে। তখনি আনতারা রুমে এলো। সব সময়ের মতো ধীরে ধীরে। আজাদের গায়ে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি। গলা, ঘাড়, পিঠ সব মেহেদীর লাল রঙে রঙিন হয়ে আছে।

এই নিয়েও পুরো বাড়ি হাসাহাসিতে মাখামাখি। শবনম ভাবি আজাদকে দেখে ভ্রু নাচিয়ে বলল, — কাহিনী কি? যতদূর মনে পড়ে মেহেদীতো আনতারার হাতে দিয়েছিলাম। সেই মেহেদী আপনার গায়ে চালান হলো কিভাবে?

সব সময়ের মতো আজাদের কোন ভাবান্তর হয়নি।সে তার মতোই বলেছে। আনতারা আর আমি আলাদা নাকি? সে দিয়েছে মানেই তো আমি দিয়েছি। তার হাতে রং ফুটবে আর আমার গায়ে ফুটবে না। এমন হয় নাকি?

— ওরে বাবা তো দেখি লাইলি মজনুর প্রেম।
— উঁহু! আজাদ আর আনতারার প্রেম।

শবনম দিয়েছে আজাদের বাহুতে বিশাল এক চিমটি। চিমটি কেটে ফিসফিস করে বলেছে, — বাবাহ! এক রাতেই ঘোল খেয়ে গেছো? বাকি জীবন তো পড়েই আছে

— তোমার দেবরের রাণী’ই এমন ভাবি। বাকি জীবন নিয়ে বড়ই চিন্তিত আছি।

আনতারা তখন লজ্জায় মিশে যাওয়ার জোগাড়। এই দুজনের মুখে কোন লাগাম নেই। মানুষ দেখে না, জন দেখে না। যখন যা মুখে আসে বলতে থাকে। সে আর আজাদের সামনেই আসেনি। এখনো আসতো না। শবনম ভাবি জোর করে ঠেলে পাঠালো। তার ঘাড়ে পড়েছে তিন জনের দায়িত্ব। আজাদ, নানাভাই, আর শ্বশুর আব্বা।

কিছুক্ষণ পরেই বিথীকে গোসল দেওয়া হবে। গোসলের পরেই একেবারে বউ সাজিয়ে ফেলবে। আর এই গোসল তো গোসল না। পুরো বাড়ির মানুষ কাদা আর কালি দিয়ে মাখামাখি করছে। সে নিজেও বলতে গেলে ভূত। কাউকে নাকি বাদ রাখা যাবে না। তাই সবাইকে ভাগাভাগি করে দেওয়া হয়েছে। আর তার ঘাড়ে পড়েছে এই তিন জন।

তিন জনের মধ্যে দু- জনকে দিয়েছে সুন্দর ভাবেই।নানা ভাই কিছু বলেই নি। হেসে শুধু বলেছে, — বুবু জান খুশি তো?

আনতারা তো মহাখুশি তবে শ্বশুর বাবার জন্য একটু ভয় পেয়েছিল। তবে মানুষটা এতো ভালো। সে যখন সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সে হেসে বলল, — যা করতে এসেছো তাড়াতাড়ি করতো মা। দুনিয়ার কাজ আছে।

আনতারা হেসেই এগিয়ে গিয়েছে। আলতো করে শুধু দু- গালে লাগিয়েছে। তারপর এলো আজাদের রুমে। এখন একমাত্র এ’ই বাকি। ভাবি বলেছে একজনও যদি বাকি থাকে, সে আজকে শাড়ি পরিয়ে দেবে না। তাই আসা।

আনতারা আজকে চেয়ার টেনে বসলো না। বসলো আজাদের মাথার কাছে। বসে ভালো ভাবে বোঝার চেষ্টা করল। আজাদ ঘুমিয়েছে কি না। অবশ্য এই লোক খুবই চতুর। আনতারা একদম বুঝে না। ঘুমিয়ে আছে কি জেগে। অবশ্য জেগে থাকলেও সমস্যা নেই। কেন জানি এই লোকটাকে এখন আর ভয় করে না। তার মনে হয় নানা ভাই যেমন, আজাদও তেমন। তার কোন কিছুতেই এরা কখনো কিছু বলবে না।

সে কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে রইল তারপর কপালে হাত ছোঁয়াবে তখনি আজাদ আনতারা হাত ধরে ফেলল। ধরে সাথে সাথেই চোখ খুলল। খুলতেই হেসে ফেলল, — আনতারার পুরো মুখে কালিতে মাখামাখি। ফর্সা গায়ে কালো মুখ। লাগছে একেবারে ভূতনির মতো।

আনতারা মুখ ফুলালো। আজাদ আবারো হাসলো। হেসে বলল,
— কালকে মেহেদী আজকে আবার কালি?

— আমি মেহেদি মাখাইনি, সেটা আপনার দোষ।

— তো দোষ ছিল বলে আজকে শাস্তি দিতে এসেছো?

— শাস্তি দেবো কেন? সবাইতো সবাইকে দিচ্ছে।

— সবার ইচ্ছে হচ্ছে দিচ্ছে। তুমি কি আমাকে নিজের ইচ্ছায় দিতে এসেছো?

তখনি টুপ করে ক্যারেন্ট চলে গেল। রাত ভরে লন্ডভন্ড হলেও সকালে সূর্য উঠেনি। আকাশ এখনো অন্ধকার। ক্যারেন্টে আসছে যাচ্ছে। দিন তবুও মনে হচ্ছে সন্ধ্যা বেলা। ঘরের ভেতরে তো হারিকেন জ্বালিয়েই কাজ করতে হচ্ছে।

আজাদ জানালা খুলেনি। তাই ক্যারেন্ট যাওয়ার সাথে সাথে পুরো ঘর অন্ধকারে ডুবে গেলো। আবার যে তান্ডব শুরু হবে তা দেকেই বোঝা যাচ্ছে।

আনতারা আরেকটু চেপে বসলো। বলল, — জানালা খুলে দিন।

— এমনি ভালো আনতারা।

— অন্ধকার আমার ভালো লাগে না।

— আমি আছিতো।

— আপনি থাকলে কি হবে। আমি বাইরে যাব। জানালা খুলেন।

আজাদ শুয়েই একটু এগিয়ে জানালা খুললো। খুব একটা আলো নেই। তবুও আজাদের মুখ স্পষ্ট হলো। আনতারা হালকা হেসে বলল, — একটু কালিই তো, দেই।

আজাদ স্বাভাবিক ভাবেই বলল — দাও।

আনতারা আবারো হাসলো। হেসে দু- হাতে আজাদের গালে, কপালে, ইচ্ছে মতো মাখল। আজাদ শুধু সেই হাসি হাসি মাখা মুখটা দেখল। দেখতে দেখতেই বলল, — এই যে তোমার ইচ্ছা পূরণ করলাম। আমাকে কিছু দেবে না?

আনতারা ভালো ভাবে মাখতে মাখতে বলল, — না।

— তোমার এই না কখনো হ্যাঁ হবে?
— না।
আজাদ হাসলে! হেসে বলল, — আমার শ্বশুরের মেয়ে এতো কিপটে কেন?

আনতারার ঘষা শেষ। মুখের এক ইঞ্চিও বাদ নেই। অবশ্য দাঁড়ির জন্য খুব একটা সুবিধে হয় নি। তবুও খারাপ না। আনতারার কেন জানি খুব ভালো লাগলো। সে হেসেই বলল — আমার বাবার মেয়ে খুব ভালো। বাকি যেগুলো সেগুলো তো আজাদের তারা বেগম।

আজাদ আবারো হাসলো! দুষ্টুমি মাখা কন্ঠে বলল, — স্বামীর নাম মুখে নিতে নেই জানো না?

আনতারাও ঠোঁট টিপে হাসলো! হেসেই বলল, — স্বামী কে?

— হাহ্! কপাল।

আনতারা খিলখিল করে হাসলো! হেসে বলল, — উঠুন।

— কেন?

— আমি বলেছি তাই ।

– তুমি বললেই উঠতে হবে?

— হ্যাঁ।

— আমার কথা তো একটাও শুনো না।

— মহারাণী কারো কথা শুনে না। বরং তাদের কথা সবার শুনতে হয়।

— সত্য, বলেই আজাদ উঠল। তারা বসা একেবারে কাছাকাছি। মুখোমুখি হতেই আনতরা হাত দিয়ে মুখ ঘরিয়ে দিলো।

তাদের খাট বরাবর আলমারি। আলমারির আয়নার তাদের দু- জনের প্রতিচ্ছবি । দুজনেই কালিতে ভূত। আনতারা সেটা দেখার জন্যই উঠতে বলেছে।

আজাদ আয়নার মধ্যে তাঁকিয়ে হেসে ফেলল। আনতারাও হাসলো। আগের মতো খিলখিলানো হাসি। আজাদ সেই হাসি মুগ্ধ নয়নে দেখল। দেখে বলল, — দংশন তো করো, ওঝা হইয়া ঝাড়ো না কেন মেয়ে?

আনতারা প্রথমে বুঝে নি, খেয়াল করল পরে। করেই ভ্রু কুঁচকে তাকালো।

আজাদ আগের মতোই হেসে বলল, — কি হয়েছে?
— কি বললেন?
— আমি তো কতকিছুই বলি।

আনতারা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাঁকিয়ে রইল। তারপর উঠে দাঁড়ালো। দরজার সামনে গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, — আমাদের বিয়ের আগে কখনো আমাদের ওখানে আপনি গিয়েছিলেন?

— আমি প্রায়ই শহরে যাই আনতারা। ক্লিনিকের বিভিন্ন কাজে যেতে হয়।

— আমি শহরের কথা বলিনি। আমাদের ওখানে।

আজাদ হাসলো! হেসে আবার শুতে শুতে বলল, — জ্বি না মহারাণী। শ্বশুর বাড়ি আমি একবারই গেছি।

বর যাত্রী আসবে যোহরের পরে। আসাদ ভাহিরটা দেখে ভেতরে আসলো। পুরো বাড়ি অন্ধকারে তলিয়ে আছে। দিনের বেলায়ও হারিকেন জ্বালিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। তবুও ভালো রাতের মতো এখনো নামেনি। তবে গুমোট হয়ে আছে। এই গুমোট গুমোট ভাবে আজকে দিনটা কোনরকম গেলেই হলো। তারপর ভেসে যাক কোন সমস্যা নেই।

সে রুমে এসে পানি খেল। সকাল থেকে খাবারের সময় পাইনি। অবশ্য পেলেও কালকের মতো খেতে পারত না। সব কিছু গুছিয়ে সামনে পেতে পেতে অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। এলোমেলো ভাবে কিছুই করতে পারে না।

তার মধ্যে কাঁদা, পানি, মানুষ পুরো বাড়ি লেটকা চেচকা। সে শবনম বলে চেঁচাতে গিয়েও থেমে গেল। সে ভালো করেই জানে শবনমও আছে দৌড়ের উপর। বড় বউ সব দিকই তাকে সামাল দিতে হয়। সে বড় একটা হাঁফ ছাড়লো। অধিকাংশ ছেলেরাই বাইর বাড়ি। মেয়েরা এখন বাথরুমের সাইডে। হইচই শোনা যাচ্ছে। বিথীকে সম্ভবতো গোসল দিচ্ছে। বয়স্ক মহিলাদের গীতও শোনা যাচ্ছে। তাদের ছোট্ট বোনটা সেই দিন হাঁটি হাঁটি পা পা করে পুরো বাড়ি ঘুরে বেরাতো। আজ সে চলে যাবে। কেমন আজব এই রীতি। বাবাকে দেখলাম প্যান্ডেলের এক কোণে দাঁড়িয়ে বার বার চোখ মুছছে। আদরে একটু বাঁদর হয়েছে তবে তাদের কলিজা এই মেয়ে। পরের ঘরে ভালো থাকবে তো?

তখনি তার ভেতরটা মুচড়ে উঠল। এমন শবনমও এক বাড়ির মেয়ে। তাকেও নিশ্চয়ই এভাবে আদরে বড় করেছে। তাকে কি সে ভালো রাখতে পেরেছে? এই গত কয়েক বছরে, সে কি কখনো এই মেয়েটার খোঁজ নিয়েছে? ছোট্ট একটা মেয়ে। যার ঘাড়ে সব দায়িত্ব চেপে দিয়েছে। পারলে ভালো না পারলে ধমক। কত কথা, কত খোঁটা এমন কি?

আসাদ খাটে গা এলিয়ে দিলো। সব হিসেব আজকে তার কাছে বড়ই এলোমেলো। এজন্যই হয়ত বলে নিজের ঘাড়ে পড়লে, পরের বোঝার হিসেব বোঝা যায়। তখনি শবনম এলো। আসাদ ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো। শবনমের শরীর প্রায় আধা ভেজা। পুরো মুখ কালিতে মাখামাখি। তবে হাত পরিষ্কার। সেই পরিষ্কার হাতেই খাবার প্লেট।

সে প্লেট রাখতে রাখতে নির্বিকার ভাবে বলল, — আর কিছু লাগবে?

আসাদ নিরুত্তাপ কন্ঠে বলল, — লাগবে?

শবনম জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকালো। আসাদ সেই দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল — শবনম। উঁহু আসাদের বউ শবনম না। চঞ্চল, এলোমেলো, দুনিয়ার অকাজ করা সেই হারিয়ে যাওয়া শবনম।

শবনম নিষ্পলক ভাবেই তাকিয়ে রইল। আসাদ কথা বলে কম। যাও বলে কঠিন করে। তবে আজকের কন্ঠে ভিন্ন। আর ভিন্নতার আশা এখন আর আসাদের কাছে সে আশা’ই করে না। বিয়ের পরে করত। যতবারই করতো ততবারই ভেঙে চুরে শেষ হয়েছে। এখনতো মেনেই নিয়েছে তবে এখন আবার কেন?

সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল! ফেলে কিছু বলল না। বেরিয়ে এলো। যেতেই সামনে পড়ল আনতারা। আনতারার হাতে একগাদা কালি। সে এগিয়ে শবনমের হাতে মাখাতে মাখাতে তার মিহি সুরে বলল, — আমার তিনজন আমিতো দিয়েছি। তো আপনারটা বাদ থাকবে কেন? যদি থাকে আমি আপনার কাছে আর কখনো শাড়ি পরবো না।

শবনম হাসলো! হেসে আনতারার মতোই মিহি সুরে বলল, — শুধু কালি না। তেল আনো আনতারা। আমার আবার এতো ভালো তে পোষে না। ঘষতে ঘষতে যেন চামড়া ছিলে যায়।

আনতারা সাথে সাথে না বোধক মাথা নাড়ল। শবনম শুনলে তো। সে তেলের খোঁজে বের হলো। তার নাকি পুরোনো শবনম লাগবে। হজম করতে পারবি রে বুইড়া ব্যাটা।

আসাদ খায়নি। উঠেও নি। শবনম বেরিয়ে যেতেই কাপালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে ছিল। তখনি আবার শবনম এলো। দাঁড়ালো আসাদের সামনে। হাত অবশ্য পেছনে মোড়ানো। সে একটা ঢোক গিলে বলল, — একটু উঠবেন।

আসাদ সাথে সাথে চোখ খুলল। শবনম এসেছে সে বুঝতে পারেনি। হাত সরিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো।

— একটু উঠুন। কাজ আছে।

আসাদ উঠে বসলো। বসে কিছু বোঝার আগেই ঝড়ের গতিতে শবনম কিছু করেই দৌড়।

আসাদ হতম্বভ হয়ে গেছে। হতম্ভব কাটতেই তার স্বভাব মতো সে চেঁচিয়ে উঠল,– শবনম।

শবনম শুনলে তো। সে আর এই রুমের আশে পাশে তো ভালোই, একশো হাতের মধ্যেও নেই।

চলবে…….

#বিষাদ_বৃক্ষ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ২৭

রাতের ঝড়তো রাতের ঝড়। দুপুরের পরে গ্রামের মানুষদের খাওয়া গুছিয়ে উঠতে না উঠতে শুরু হয়ে গেছে আরেক তান্ডব। রাতের তান্ডবে বিয়ে বাড়ি আনন্দ ভাটা না পড়লেও এইটায় যেন ঠিক পড়ল। সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল। আর হলো বলেই এই লন্ডভন্ড শেষ হতে হতে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল।

বর সঠিক সময়ে রওনা দিতে পারেনি। তাই আসতেও পারেনি। তবে খবর পাঠিয়েছে তা রাস্তায়। অতি শীঘ্রই আসছে। তাদের খবর পেয়ে শান্ত বিয়ে বাড়িতে আবার আয়োজনে মত্ত হলো। এখন যে আরো বেশি কাজ। ঝড়ে সব লন্ডভন্ড হয়েছে।

একেতো সন্ধ্যা তার মধ্যে ক্যারেন্ট নেই। বউ সাজে বসে থাকতে থাকতে বিথীর অবস্থা কাহিল। এক কাহিল দুই মেজাজ উঠে আছে তুঙ্গে। যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই সমানে ধমকাচ্ছে, ঝারি মারছে। বাড়ির বাচ্চারা তার ভয়ে হুটোপাটি তো করবে দূরের কথা, টু শব্দও করছে না। মুর্শিদার মন মেজাজ এমনিতেও ঠিক নেই। এক তার মেয়েটা চলে যাবে, তার মধ্যে আবার এমন মেঘ বৃষ্টি। বসে একটু দুঃখ প্রকাশ করবে নানান চিন্তায় সেটাও পারছে না। তাই সে কয়েকবার এসে মেয়ের পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে গেছে। যদি একটু ঠান্ডা হয়।

বিথী মিথিকে ডাকল। বাথরুমে যাওয়া দরকার। কতক্ষণ একটা মানুষ এভাবে বসে থাকতে পারে। মিথি এলো নেচে নেচে। এতো ঝড় বৃষ্টি তার আনন্দে ভাটা ফেলতে পারে নি। না পেরেছে বিথীর মেজাজ। বিথীর মেজাজ সে গোনায় ধরে নাকি? সে প্রায় নেচে নেচে হারিকেন হাতে বিথীকে বাথরুমে নিয়ে গেল।

বাথরুমে ঢোকার আগে বিথী মাথার ঘোমটা খুলে ফেললো। এই ছাইয়ের জন্য মাথা পুরো ভার হয়ে আছে। না ডানে নড়ানো যায়, না বামে।

সে খুলেই মিথির হাতে ধরিয়ে হারিকেন নিয়ে গেলো। মিথির কি? সে আছে দুনিয়ার বাইরে। বিয়ে উপলক্ষে তাদের যত আত্মীয় – স্বজন আছে সবাই এসেছে। তার মধ্যে মুনিয়ার শ্বশুর বাড়ির মানুষজনও। সেই মানষজনের মধ্যে এসেছে মুনিয়ার দেবর। সেই দেবরই মিথির পেছন পেছন ঘুরছে। বিয়ে বাড়িতে এ রকম দুই – একটা পেছন পেছন না ঘুরলে বিয়ে বাড়ির মজা আছে নাকি? তাই মিথিও আছে মহা আনন্দে।

সে’ই আনন্দে নায়িকাদের মতো বিথীর মাথার ঘোমটা আকাশে বাতাসে উড়িয়ে ঘুরিয়ে ঘোমটার মতো মাথায় ফেলল। ফেলে লজ্জা মাখা মুখে একটু হাসলো। তখনি কেউ এসে তার নাক, মুখ চেপে ধরল। শুধু হাত দিয়ে না। কাপড় জাতীয় কিছু দিয়ে। সে কিছু ভাবার আগেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

বিথী বের হলো কিছুক্ষণ পরেই। সে ডানে বামে মিথিকে কোথাও দেখল না। সে বিরক্ত হলো। অবশ্য বিরক্ত সকাল থেকেই। এই মরার বৃষ্টি আর আসার সময় পেল না। সে বিরক্ত মুখেই হারিকেন হাতেই এগিয়ে গেল।

আনতারা, শবনম সবাই রুমে। তাদের দেখে বলল, — মিথি কই?

শবনম ভ্রু কুঁচকে বলল, — তোমার সাথেই না গেল।

— এই মেয়েকে আমি পেলে থাপড়ে দাঁত খুলিয়ে ফেলবো। আমার ঘোমটা নিয়ে গায়েব। ঘোমটা যদি নষ্ট হয় ভাবি আমি বলে রাখলাম, ঝড়ে যা হয়নি তাই আমি করে ফেলব। এই বাড়ি ঘর সব লন্ডভন্ড করে ফেলবো।

শবনম মনে মনে বিরক্তি নিয়ে সাথে সাথেই দাঁড়ালো। ধুর! এই মিথি আবার কোন ঢং শুরু করল। সে হারিকেন হাতে বেরিয়ে গেল।

আনতারা কি করবে বুঝতে পারল না। তবে বিথীর সামনে থাকারও সাহস হলো না। সেও একটা মোববাতি নিয়ে বেরিয়ে এল। এই অন্ধকারে তার কোথাও যাওয়ার সাহস হবে না। তাই বরং নিজের রুমে গিয়েই বসে থাকা যাক। সে এগিয়ে গেল।

প্যান্ডেল ঠিক করতে গিয়ে আজাদের কাপড় নষ্ট হয়েছে। সে এসেছে রুমে। লাইট থাকতেই সে কিছু খুঁজে পায় না। আর এই অন্ধকারে ? সে তার পকেটের লাইটার জ্বালাতেই দেখল দরজায় রাফিয়া দাঁড়িয়ে। এই বিয়েতে তাদের যত পরিচিত মানুষ আছে সবাইকেই বলা হয়েছে। রাফিয়াও বাদ যায়নি। তবে বিয়ের জন্য এতো দূর থেকে রাফিয়া আসবে আজাদ ভাবেনি। তাও আবার এই ঝড় বৃষ্টির মাথায় করে। তাকে দেখে সে অবাকই হয়েছিল, আর এখনো ও হলো। তার এই রুমে কাজ কি ?

রাফিয়া ঠোঁট টিপে হাসলো। হেসে একবার বারান্দায় তাকালো। আনতারা ধীরে ধীরে আসছে। আজাদ কিছু বলবে তার আগেই রাফিয়া দৌড়ে এলো। আজাদকে আষ্টপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। ঠিক তখনি আনতারা দরজায় এসে দাঁড়ালো। দাঁড়াতেই থমকে গেল।

শুধু সে থমকাইনি আজ নির্বিকার আজাদও থমকেছে। সে না নড়লো, না কিছু বলল। না রাফিয়াকে ধাক্কা দিয়ে সরালো। শুধু এক পলকে আনতারার দিকে তাকিয়ে রইল।

আনতারাও কোন টু শব্দ করল না। সাথে সাথেই চোখ ফিরিয়ে নিলো। । নিয়ে যেভাবে ধীরে ধীরে এসেছিল, সে ভাবেই চলে এল। পার্থক্য তখন আনতারা ছিল স্বাভাবিক। আর এখন তার শরীর থরথর করে কাঁপছে।

সেই কাঁপা শরীর নিয়েই সে বাড়ির সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। এখান থেকে বাহিরের সবই দেখা যায়। সে তাঁকিয়ে রইল। এর মাঝেই একজনের আহাজারিতে সে আবারো কেঁপে উঠল। এক মহিলা বাইর বাড়িতে বিলাপ করে কাঁদছে। তার পাশেই ছোট্ট একটা মেয়ে। তার কাঁদার ভাষা বড়ই জঘন্য। সে চিৎকার করছে আর বলছে। সে আমজাদের দ্বিতীয় বউ। আরতে রাতের পর রাত তার সাথে নাকি থেকেছে। সন্তান পেটে আসায় তাকে নাকি বিয়ে করেছে। সন্তান হয়েছে মেয়ে। এখন আর তাকে বউ বলে মানে না। তাই তার সাথে অন্যায়ের বিচার চায়। যদি না করে এখানে দাঁড়িয়েই সে আর তার মেয়ে বিষ পান করবে।

আনতারার মাথা ঘুরছে। হচ্ছে কি এ বাড়িতে। তার নানা ভাই কই? আনতারা সহ্য করতে পারল না। তার শরীর দুলিয়ে উঠল। সে পড়ে যেতে গিয়েও দরজার গ্রিল আঁকড়ে ধরল।

তখনি ইব্রাহিম তার পাশে এসে দাঁড়ালো। চিন্তিত ভাবে বলল, — কি হয়েছে আনতারা? তুমি ঠিক আছ?

আনতারা চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে। সেই অন্ধকারের মধ্যেও সে ইব্রাহিমের চোখের দিকে তাঁকালো। তাঁকাতেই কেন জানি তার শরীর হিম হয়ে এলো। সে আর দাঁড়াতে পারল না। ধপাস করে নিচে পরে গেল।

আনতারার ঘখন জ্ঞান ফিরলো তখন মধ্যরাত। মধ্যরাত হলেও এই বাড়ির প্রতিটা মানুষ নির্ঘুম। মিথিকে পাওয়া যাচ্ছে না। একদিকে মেয়ে, আরেক দিকে স্বামী আমেনা বসে আছে মূর্তির মতো। তাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে মুনিয়া। বসে আছে আরেক জনও বধু বেশে। এখন সে, না দেখাচ্ছে মেজাজ, না কাউকে ধমকাচ্ছে। শান্ত চোখে এক পলকে তাঁকিয়ে আছে হাতের মেহেদীর দিকে। তার বড় যাত্রী ফিরে গেছে। এমন বাড়ির মেয়ে তারা নেবে না।

অলি আবসার জায়নামাজে। মন তার বিক্ষপ্ত হলেই তিনি রবের দরবারে যান। আজও গিয়েছেন। শুধু যাওয়ার আগে শান্ত ভাবে বলে গিয়েছেন, — আজ থেকে আমার এক ছেলে, দুই মেয়ে। আমজাদ নামের আমার কোন ছেলে ছিল না। এই বাড়িতে তার নাম দ্বিতীয় বার উচ্চারণ হবে না। আজ থেকে আমেনা আমার দ্বিতীয় মেয়ে। সে এই বাড়িতে আমার মেয়ে হয়েই থাকবে।

মুর্শিদার গলায় এবার বিলাপ উঠে নি। কাল আরেকজন কে হেয় করতে যেই দুঃখ সবাইকে বিলাপ পেরে কেঁদে দেখিয়েছে। সেই দুঃখ আজ যেন কাউকেই দেখাতে পারল না। পারবে কি ভাবে, সেই দুঃখই তার গলায় যে ফাঁস হয়ে পড়েছে। তার মেয়ের এখন কি হবে? গাঁও গ্রামে বিয়ে ভাঙা যে একটা মেয়ের মৃত্যুর সমান। এতো এতো অহংকার যেন এক নিমিষেই ধুলিসাৎ। কার নজরে এমন হলো? সেই অস্থিরে গলা কাটা মুরগির মত সে ছটফট করতে লাগলো।

আর এই সবের মধ্যে নির্বিকার আছে আজাদ। নিজের রুমে নিচে পা ছড়িয়ে বসে । বাসায় সে কখনও সিগারেট খায় না। তবে আজ চোখ বন্ধ করে অবিরাম টানছে। সব সময় হেসে ফেলা আজাদ আজ বাইরের প্রকৃতির মতোই শান্ত, নিশ্চুপ।

জামিল এসে ইব্রাহিমের পায়ের কাছে বসলো। বসে মাথা চুলকে বলল, — জীবনে পরথম কাজে গোলমাল করে ফেললাম ভাই। অন্ধকার, চিকচিক ওড়না দেইখা ভাবলাম বউ। বাড়িত আইনা দেখি বউর বইন। এহন কি করি বলেন তো ভাইজান?

ইব্রাহিম চোখ বন্ধ করে পুকুর ঘাটে ইজিচেয়ারে শোয়া। সে সেই ভাবেই হাসলো! হেসে বলল, — আজকে তোমার সব ভুল মাফ জামিল।

জামিলও দাঁত কেলিয়ে হাসলো। হেসে বলল, — তা না হয় ঠিক আছে, তবে এই মাইয়ারে করবো টা কি?

— তার বোনের সাথে যা হওয়ার কথা ছিল তাই করো।

জামিল আবার হাসলো! হেসে উঠে দাঁড়ালো। কপাল খারাপ মাইয়া। বোনের পাপের শাস্তি নিজে পাইবো।
সে এগিয়ে গেল।

মিথির এখনো জ্ঞান ফিরেনি। বউঘোমটা জড়িয়ে এলোমেলো ভাবে খাটে পরে আছে। তার সামনে পাথরের মতো জহির বসে আছে।

জামিল জহিরের রুমে এসে বলল, — মাইয়াতো মাইয়াই। বদল হইছে তো কি হইছে। বাতি নিভাও কাজ কাম খালাস করো। আর না করলে না করো। আমার কাজ বডি দামাচাপা দেওয়া। আমি দেব। এখন যদি জিন্দা থাকে তাহলে ভাই আমার কি দোষ?

জহির মিথির দিকে তাঁকালো। তাঁকাতেই তার ভেতর কেঁপে উঠল। বিথীর অহংকার সে ভাঙতে চেয়েছিল তবে মিথির না। সে হড়বড়িয়ে বেরিয়ে এলো। ইব্রাহিমের সামনে এসে বলল, — মিথি কে যেতে দিন বড় আব্বা।

ইব্রাহিম চোখ বন্ধ করেই বলল, — সেটা সম্ভব না।

— মিথির কোন দোষ নেই।

— জানি। তবে আমি কোন ঝুঁকি নেব না। তাছাড়া ফিরে গিয়েও হবে কি? পুরো গ্রাম ছড়িয়ে গেছে। একদিকে বাপের কেলেঙ্কারি, এক দিকে নিজের। বিয়ে তো দূরের কথা কেউ ফিরেও তাঁকাবে না। এখন একমাত্রা রাস্তা গলায় দড়ি দেওয়া। তার চেয়ে এ’ই ভালো না, এভাবেই শেষ হোক। না জেনে না বুঝে মৃত্যুর চেয়ে এই দুনিয়ায় ভালো কিছু নেই।

জহির কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কি করেছে সে? নিজের জেদের জন্য নিষ্পাপ একটা মেয়ের জীবন এভাবে শেষ করল। সে ইব্রাহিমের পাশেই ধপ করে বসে পড়ল।

ইব্রাহিম মুখ বাঁকিয়ে হাসল! হেসে বলল, — রাত শেষ হচ্ছে জামিল। আলো ফোটার আগে কাজ সমাধা কর। আর একটা কথা পুরো গায়েব করবে। কোন চিহ্ন যেন না থাকে।
জহির সাথে সাথে কঠিন স্বরে বলল, — না।

ইব্রাহিম তাঁকালো! এবার অবশ্য হাসলো না। তবে আগের মতোই শান্ত ভাবে বলল, — ঝামেলা করবে না জহির। ঝামেলা আমার পছন্দ না।

— আমি এটা হতে দেব না।

ইব্রাহিম বড় একটা শ্বাস ফেলল। ফেলে বলল, — এটা আমাদের সবার জন্য ঝুঁকি। আর আমি ঝুঁকি নেই না। কারো জন্যই না। এমনি তোমার জন্যও নেবো না। ভালোয় ভালোয় মুখ বন্ধ রাখো। তা না হলে আমি তোমার ব্যবস্থাও করবো।

— যদি ঝুঁকি না থাকে?

ইব্রাহিম আবার হাসলো। হেসে বলল, — তার সাথে তো আমার কোন জনম জনমের শত্রুটা নেই। যে, যে কোন বিনিময়ে তাকে মারতেই হবে। বরং না মারলে একটা পাপ কমে। তবে ঝুঁকির গ্যারান্টি টা নেবে কে?

— আমি।
— কথা রাখতে পারবে?
— হ্যাঁ।
— বেশ! তাহলে তাই হোক।

জহির মিথির চোখে মুখে পানি দিয়ে জ্ঞান ফেরালো। ফেরতেই বলল, — তোর সামনে দু-টো রাস্তা এক. মৃত্যু দুই. বিয়ে। এখন বল মিথি তুই কি করবি?

মিথির মাথায় কিছুই ঢুকলো না। তবে তাকে ভয় জেঁকে ধরল। কারণ তার মন বলছে কিছু ঠিক নেই, কিছুই নেই। তার চোখে টলমলো পানি। সেই পানি নিয়েই সে কাতর ভাবে ডেকে বলল, — জহির ভাই আমার ভয় করছে।

জহিরের ভেতর ছিঁড়ে যেতে চাইল। কোন দুঃখে সে এই পাপের সাথে যুক্ত হয়েছিল। সে ঢোক গিলে বলল, — আমাকে বিয়ে কর মিথি। আর এই মুখ সব সময়ের জন্য বন্ধ। তা না হলে আমি তোকে বাঁচাতে পারব না।

মিথি আর টু শব্দও করল না। ভোর রাতে মিথি আর জহিরের বিয়ে হল। মিথির তরফ থেকে সাক্ষী হলো জামিল। বিয়ের পরে জামিল মিথির মাথায় হাত রেখে বলল, — এই হাতে বহুত মানুষেকে লাশ বানাইছি তবে পরথম বার বিয়ের সাক্ষী হইলাম। আজ থাইকা তুমি আমার ধর্মের মাইয়া। যে কোন বিপদে আপদে নিসঃকোচে আমারে কইবা। কোন সংকোচ রাখবা না। বলেই জহিরের দিকে তাঁকালো। তাঁকিয়ে বলল, — জামাই বাবাজি আমার মাইয়ারে দেইখা রাখবা। যদি চোখ থিকা এক ফোটা পানি পড়ছে। তুমি খতম। বলেই তার পান খাওয়া ঠোঁট ছড়িয়ে হাসলো। সেই হাসি এই ভোর রাতে জহিরের কাছে বড়ই ভয়ংকর লাগলো ।

চলবে……