বিষাদ_বৃক্ষ পর্ব-৩৫

0
32

#বিষাদ_বৃক্ষ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ৩৫

চোখে মুখে ঠান্ডা পানির স্পর্শ পেতেই আনতারা চোখ খুললো। ইব্রাহিম ভেবেছিল জ্ঞান ফিরতেই আনতারা ভয়ে গুটিয়ে যাবে। কেঁদে কেটে নাক মুখ ভাসিয়ে ফেলবে। তাই তার লোকেরা একবার বলেছিল, ” জ্ঞান ফেরানোর দরকার নেই। একেবারে শহরে গিয়েই যা করার করবেন।

তবে এ ভাবে পড়ে থাকা আনতারাকে দেখতে ইব্রাহিমের ভালো লাগছিল না। যতবারই তাঁকাচ্ছিল সে বেঁহুশ আনতারাকে না দেখছিল রক্তে মাখানো আনজুমের মুখটা। ঠিক এভাবেই আনজুম পড়ে ছিল। মাথার এক সাইড থেতলে গিয়েছে, তবুও কি সুন্দর নিষ্পাপ, পবিত্র একটা মুখ। এই মুখের দিকে তাঁকালে ইব্রাহিমের কিছু একটা হয়ে যায়। এখন না সেই যে অনেক অনেক আগে দেখল। তখনি কিছু একটা হলো। আনজুম বিবাহিত, স্বামী আছে তবুও সে নিজেকে দমাতে পারিনি। না পারলো এখন। আনতারা হাসলেই তার মনে হয়, তার সাথে অন্যায় হয়েছে। কেন সে আনজুমকে পেল না। কেন আনজুম তাকে একটা বার আপন করে নিলো না। কেন তার জীবনটা এভাবেই কেটে গেল। কেন?

অথচ সে তখন সুখ পাইনি বলে আবার ঠিক ফিরে এসেছে। তাও তার’ই চোখের সামনে তাকে জ্বালাতে। সারা জীবনটা তছনছ করে মন ভরেনি, এখন এই বয়সে এসেও শান্তি নেই। আনজুম.. এক ভালোবাসার অপরাধে আর কত জ্বালাবে?

আনতারা চোখ খুলে স্বাভাবিক ভাবেই ইব্রাহিমকে দেখল। দেখে আস্তে করে শুধু সোজা হয়ে বসলো। যেন সে জানতো চোখ খুলে সে এই মুখটাই দেখবে।

আনতারার গায়ে আজ আকাশি রঙের কাপড়। ইব্রাহিমের মনে হলো পুরো আকাশটাই যেন এই গাড়ির ভেতরে চলে এসেছে। সে মুগ্ধ চোখে তাঁকিয়েই বলল,– তোমার কি খারাপ লাগছে?

আনতারা সে কথার উত্তর দিল না। এমন সম্পর্কের এমন বয়সী একটা মানুষের এমন কাজ ভাবতেই তা ঘেন্নায় গা গুলিয়ে আসছে। সে ঢোক গিলে অন্য পাশে তাঁকালো।

— পানি খাবে?

আনতারা ফিরে তাঁকালো! হ্যাঁ না অবশ্য বলতে হলো না। ইব্রাহিমের হাতেই পানির বোতল ছিল। সে এগিয়ে ধরল। আনতারা হাত বাড়িতে পানির বোতল নিল। তবে খেল না। দু- হাতের মাঝে রেখে আস্তে করে বলল, — রমিজ ভাই কি মারা গেছে?

ইব্রাহিম কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাঁকিয়ে রইল। তারপর বলল, — আমি জানি না।

— আর কত মানুষকে মারবেন?

ইব্রাহিমের ভ্রু কুঁচকে গেল। আনতারা কোন মারার কথা বলল সে বুঝতে পারল না। সে ভ্রু কুঁচকেই বলল,– আমি রাফিয়াকে মারিনি। মেরেছে আজাদ।

আজাদের কথা উঠতেই আনতারার ভেতরটা কেন জানি ভারী হয়ে এলো। ইশ! এই একটা মানুষের জন্যই আনতারা নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করছে। সে ঢোক গিলে বাইরের দিকে আবার তাঁকালো। আশ্বিন মাস ঘরে এসেছে। দিনে গরম থাকলেও শেষ রাতে হালকা শীত শীত করে। আনতারারও করতে লাগলো। অবশ্য অনেকটাই বেশি। জ্বর আসছে কিনা কে জানে। অতিরিক্ত কষ্টের ধকল আনতারা সহ্য করতে পারে। সে জানে এখনো পারবে না। ভোর হওয়ার আগেই সে অচেতন হবে। আর অচেতন হওয়ার আগেই… সে তার আঁচলটা মুঠো করে ধরলো। আজকে ভোরটা তার এমনিতেই দেখা হতো না। তখন দরজায় শব্দ হতেই সে ভেবেছিল ভাবি। তাই লুকানোর জন্য আঁচলে বেঁধেছিল। ভাগ্যিস বেঁধেছিল।

আনতারা বাইরের দিকে চোখ রেখেই বলল, — সবাই যা বলে তাই কি সত্যি?

— ভাইজানকে জিজ্ঞেস করোনি?
— না।
— কেন?
— তারা আমার ক্ষতি হবে এমন কিছু কখনো মুখে আনবে না।

— সত্য তো সত্যই। ক্ষতি হওয়ার কি আছে। যারা তোমাকে ভালোবাসবে সত্য জেনেও ভালোবাসবে। যারা ভাসবেনা তারা কখনোও বাসবেনা। আনজুমের হাজার দোষ, হাজার কলঙ্ক নিয়েও আমি তাকে ভালোবেসেছি।

— আপনি তাকে ভালোবাসেন নি। বরং তার ভালোবাসার মানুষকে কেড়ে নিয়েছেন। কেড়ে নিয়েছিলেন তার শান্তি, কেড়ে নিয়েছিলেন তার বেঁচে থাকার চেষ্টা। কি হতো কবির তালুকদারকে না মারলে? কি হতো তাকে তার মত থাকতে দিলে? কি হতো আমার বাবার মত নিস্ব মানুষের কাছ থেকে মায়ের ছায়াটা না নিলে?

ইব্রাহিম চমকে উঠল! এই সত্য আনতারার জানার কথা না। যে সত্য ভাইজানই জানে না। সেটা আনতারা জানবে কি করে?

আনতারা আবার ফিরে তাঁকালো! সেইদিন গ্রামের মানুষের মুখ থেকে এক এক করে সব জানার পরে সে নানা ভাইয়ের কাছে গিয়েছিল। কেননা নানা ভাই ছাড়া সে আর কাউকে বিশ্বাস করেনা। কিন্তু গিয়ে কষ্ট করে আর জিজ্ঞেস করতে হয় নি। রমিজের সাথে সব কথাই সে শুনেছে।

সে তাঁকিয়ে নিষ্প্রাণ কন্ঠে বলল, — আপনি আমার দাদিকে ভালবাসতেন। বুঝলাম। তার জন্য দুনিয়া এফোঁড় ওফোঁড় করে ফেলেছেন। এমনকি মানুষকেও মানুষ মনে করেন নি। তার জন্য পুরো জীবন অনেক কষ্টের মধ্যে দিয়ে গেছেন। সেটাও বুঝলাম। কিন্তু আমার সাথে কি? আমিতো আনজুম না আনতারা। দেখতে একরকম হলেই বুঝি মানুষ এক হয়?

ইব্রাহিম নিষ্পলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, — তুমি আনজুম হও আর আনতারা। আমার কিছু আসে যায় না। আমি শুধু এইটুকু জানি। আমি ভালো নেই, তো তোমরাও কেউ থাকবে না।

আনতারা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর এক অবিশ্বাস্য কাজ করে ফেললো। এক ধলা থু থু ইব্রাহিমেন মুখের উপরে ছিটিয়ে মারলো। মেরে আদ্র কন্ঠে বলল — আপনি একটা জানোয়ার। আপনার জন্যই আমার দাদি মারা গেছেন। আপনার জন্যই আমার বাবার সারা জীবন এলোমেলো হয়েছে। আপনার জন্যই আজ আমিও সেই আমার দাদির মতো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। আর কত?

ইব্রাহিম মুখের থু থু মুছলো না। সে চোয়াল শক্ত করে আনতারার দিকে তাঁকিয়ে রইলো। তারপর শান্ত ভাবে বলল, — আমি সব কিছুর হিসেব নেব।

বলেই চোখ ফিরিয়ে সামনে তাঁকালো। তার চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তি। তারা বসে আছে ফেরি ঘাটে। এখন না প্রায় অনেকক্ষণ ধরেই। বোর্টে যাওয়া খুবই লম্বা সফর, তার মধ্যে এত রাত। এতো রাতে গ্রামে বোর্ট পাবে কোথায়? তাই তার লোকেরা কালই গাড়ির ব্যবস্থা করেছে। তবে তা খুবই কষ্টদায়ক। একতো রাস্তা নেই, দ্বিতীয় এই ফেরিঘাটের ঝামেলা। সে বিরক্ত মুখে বলল, — কালামরা আসছে না কেন?

ড্রাইভিং সিটে বসা ফিরোজ বলল,– বুঝতেছিনা ভাই। এতো সময় লাগার তো কথা না। কালকে টাকা পয়সা দিয়ে সেট করে রেখেছিলাম। তারা সব ব্যবস্থা করে রাখবে, আসা মাত্রই পার করে দেবে।

ইব্রাহিম কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসল। তারপর বলল, — কাল কখন কথা বলেছো?

— রাতে ভাই। আটটার একটু পর পর হতে পারে।

ইব্রাহিমের ভ্রু কুঁচকে গেল। এই গ্রাম থেকে বের হওয়ার দুটোই রাস্তা। এক বোর্ট, দুই এই ফেরিঘাট। আজাদ আবার কিছু করেনি তো? এই ছেলের কর্মকান্ড সে ঠিক ধরতে পারছে না। ছেলেটা গভীর জলের মাছ। তবে এইটুকু বুঝেছে তার হাত পুরো গ্রামে ছড়িয়ে আছে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গ্রাম থেকে বের হওয়া দরকার। সে আগের মতোই বিরক্ত কন্ঠে বলল, — তুমি যাও গিয়ে দেখ।

— আপনারা একা হয়ে যাবেন ভাই। কালাম বার বার বলে গেছে গাড়ি থেকে বের না হতে।

— তো কি করবো সারা রাত এখানেই বসে থাকবো?
বলেই ইব্রাহিম নিজেই বেরুলো। বেরিয়ে মুখ মুছলো। মুছে ফেরি ঘাটের দিকে এগুলো। কিছুদূর যেতেই থমকে দাঁড়ালো। বড় একটা ভুল করে ফেলেছে সে। তারা এই সুযোগের অপেক্ষায়’ই ছিল। আজাদ আনতারার সামনে কখনো এমন কোন কাজ করবে না যেটা আনতারা হজম করতে পারবে না। তার দলের লোক সব শেষ। এখন? সে পেছন ফিরে তাকালো। ঘুটঘুটে অন্ধকার! গাড়ি দেখা যাচ্ছে না। সে তাড়াতাড়িই ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। তখনি অসীম এক যন্ত্রনা তার পুরো শরীরে ছড়িয়ে গেল। সে যন্ত্রনায় কাতর হয়ে পেটের সাইডে হাত নিলো। নিয়ে পেছনে ফিরে তাঁকালো।

আজাদ দাঁড়িয়ে! তার হাতে ধারালো ছুরি। সেটাই ইব্রাহিমের পেটের সাইড থেকে ঢুকিয়েছে। ইব্রাহিম কিছু বুঝে উঠবে তখনি আরো ঢুকিয়ে মুচড়ে ঘোরালো। ঘোরাতে ঘোরাতে নির্বিকার ভাবে বলল, — ইচ্ছাটা অনেক আগের। তবে দাদাভাইয়ের মুখের দিকে তাঁকিয়ে নিজেকে দমিয়েছি। ইচ্ছাটা পূরণ করতে দেওয়ায় শুকরিয়া ইব্রাহিম দাদা ভাই।

বলেই আজাদ ছুরিটা টেনে বের করলো। করে শরীরের যত শক্তি আছে প্রয়োগ করে আবার ঢোকাল। ইব্রাহিম গুঙিয়ে উঠল। নিঃশব্দ এই রাতে ইব্রাহিমের যন্ত্রনা ভরা আর্তনাদ আনতারা গাড়ি থেকেও শুনলো। শুনলো সামনে বসা ফিরোজও। সে সাথে সাথেই দৌড়ে বেরুলো। সে বেরুতেই আনতারা আঁচল আর পানির বোতল হাতে নিলো। এই দুনিয়াতে আর কোন জাহিদ না আসুক, আর না আসুক আনতারা। তাদের বিষাক্ত রক্তের সমাপ্তি এখানেই হোক।

ফিরোজ কে দৌড়ে আসতে দেখে আজাদের মধ্যে তেমন ভাবান্তর দেখা গেল না। সে ইব্রাহিমকে ছেড়ে এগিয়ে পেট বরাবর লাথি মারলো। ফিরোজ নিচু হতেই হাত মুচড়ে ধরল। ধরে খুব স্বাভাবিক ভাবে ঘুরিয়ে কাছে টেনে আনল। তারপর মুখ চেপে আস্তে করে গলায় ছুরি চালালো। চালাতে চালাতে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, — মরতে এতো তারা কেন তোদের। আমি তো আসছিলাম’ই। বলেই ছুঁড়ে ফেলল। ফেলে গাড়ির দিকে তাঁকালো। এখান থেকে কিছুই দেখা যায় না। তাবে তার মন বলল, – কিছু একটা ঠিক নেই। সে দৌড়ে গেল।

ইব্রাহিম মাটিতে শুয়ে পড়েছে। যন্ত্রনায় তার চোখ মুখ নীল। সাদা শুভ্র পাঞ্জাবি এখন লাল রঙে রঙিন। সে চোখ বন্ধ করল। করতেই দুটো পা তার সামনে এসে দাঁড়ালো। ইব্রাহিম এতো যন্ত্রার মধ্যেও হাসলো। হেসে বলল, — ভাইজান।

— বলো ইব্রাহিম।

— আমি রুপাকে সত্যিই ভালোবাসতাম।

— জানি। আমার চেয়ে ভালো কে জানে।

— উঁহু! এই দুনিয়ায় কেউ জানে না। না কেউ জানবে।

— যেই জানা মানুষের জন্য ক্ষতিকারক সেটা না জানাই ভালো।

ইব্রাহিম হাসলো! আবসার যন্ত্রনা মাখা সেই হাসির দিকে তাঁকিয়ে বলল, — এমনটা না করলে হতোনা ইব্রাহিম? ভালোই তো ছিলাম আমরা।

— আমি কখনো ভালো থাকিনি ভাইজান। কখনো না।

আবসার বড় একটা শ্বাস ফেললো! উপরওয়ালার খেল বোঝা বড়ই মুশকিল। তা না হলে আনতারা আনজুমের মতো দেখতে হবে কেন? কেন এত বড় শহরে এতো লোকের মাছে আজাদের নজর আনতারার উপরেই পড়বে। কেন জাহিদের মৃত্যু রোগ হবে? কেন আবার আনতারা এই গ্রামেই ফিরে আসবে। কেনই আবার ইব্রাহিম পাগল হবে।

হয়তো এই শাস্তি উপওয়ালাই ঠিক করেছে। তা না হলে কবিরের সাথে ইনসাফ হতো কিভাবে ? অন্ধকারে কেউ দেখেনি। কিন্তু উপরে যে আছে সে কিন্তু ঠিক দেখেছে। দেখেছে বলেই সে ছক তৈরি করেছে। ইব্রাহিমের মৃত্যুর ছক। অথচ ইব্রাহিম ভেবেছে সে সব কিছুর উর্ধে চলে গেছে। আসলে সে এগিয়েছে ধীরে ধীরে তার পাপের শাস্তির দিকে। আল্লাহ ছাঁড় দেন তবে কখনো ছেঁড়ে দেন না।

আবসার এগিয়ে এলো। তার চোখের কোণে পানি। সে পানি নিয়েই ইব্রাহিমের মাথায় স্নেহের হাত রাখল। সবাই তার সাথে অভিনয় করতে পারে, সে তো পারে না।

ইব্রাহিম ঘোলা ঘোলা চোখে আবসারের দিকে তাঁকালো। তাঁকাতেই আবসার বলল, — অতি শীঘ্রই দেখা হবে ইব্রাহিম। আজ থেকে যে আমিও জাহান্নামী। তুমি নিজে গেলে সাথে তোমার ভাইজানকেও নিয়ে গেলে।

ইব্রাহিম আবারো হাসলো। হেসে কিছু বলতে চাইলো। কিন্তু গলা দিয়ে আর শব্দ বের হলো না। বের হলো তার শেষ নিশ্বাস। সেই নিশ্বাসের সাথে আবসারের কানে শুধু একটা শব্দই এলো, — ভাইজান।

চলবে……