#বুঝে_নাও_ভালোবাসি
#ফাহমিদা_তানিশা
পর্ব ০১
আপনার পরকিয়া করে পালিয়ে যাওয়া মেয়ের সাথে আমার একমাত্র ছেলের বিয়ে দিবো তা আপনি ভাবলেন কি করে?
বাড়িভর্তি লোকের সামনে বরের বাবা আরওয়ার বাবাকে অনেকটা তাচ্ছিল্যের সুরে কথাটা বললেন।তার বাবা মাথা নিচু করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছেন।কি জবাব দিবেন বুঝতে পারছেন না তিনি।বাবা আর ছোট মামার মাঝখানে আরওয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।এই মুহূর্তে তার কি করা উচিত সে জানে না।সে শুধু জানে বাবার অপমান হতে পারে এমন কোনো কাজ সে করেনি।
আজ আরওয়ার এনগেজমেন্ট ছিল তার বাবার কলিগ রিদুয়ান মোস্তফার ছেলে রাশেদ মোস্তফার সাথে। সকাল থেকে তাদের বাসায় মেহমানরাও চলে আসছিল।আরওয়ার বাবা জনাব আকরামুল হক আর ছোট মামা আশরাফ চৌধুরী সকাল থেকে সবকিছু দেখাশোনা করছেন যাতে কোনো কিছু হেরফের না হয়। কিন্তু মাঝখানে আরওয়া ঘটিয়ে দিলো সবচেয়ে বড় অঘটনটা।
_দেখুন ভাই, শুনেছিলাম আপনার মেয়েটা শান্তশিষ্ট খুব ভালো মেয়ে।তাই আমার ছেলের জন্য নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। এখন তো দেখছি এই মেয়ে চরিত্রহীনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এমন মেয়েকে আর যায় হোক ঘরের বউ করা যায় না। আমরা দুঃখিত।আমরা আমাদের ছেলের জন্য আপনার এই চরিত্রহীন মেয়েকে নিয়ে যেতে পারবো না।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলেন বরের সাজে দাঁড়িয়ে থাকা রাশেদের মা শেলি বেগম।ছেলের মুখের ভাবসাব বলছে সে তার মায়ের কথার সাথে একমত। অর্থাৎ সে আরওয়াকে বিয়ে করতে চায় না। আকরামুল হক নিচু গলায় বললেন:ভাবি আসলে আপনারা বুঝতে পারছেন না আমার মেয়েটাকে। এটা একটা অঘটন মাত্র।না আমার মেয়ে কারো সাথে পালিয়ে যেতে পারে, আর না আমার মেয়ে চরিত্রহীন?দুটো কথার একটা কথাও সত্যি নয়।কেউ যদি আমার মেয়েকে কলঙ্কিত করতে এমন একটা জঘন্য কাজ করে তাতে আমার মেয়ের বা আমার আর কি করার থাকতে পারে?
_সে যায় হোক ভাই। আমরা আপনার মেয়েকে আমার ঘরের বউ করতে পারবো না।
আরওয়ার ছোট মামা আশরাফ চৌধুরী তখন থেকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উভয়পক্ষের কথাগুলো শুনছেন। শুধু তিনি নন পুরো মেহমান ভর্তি বাড়ির সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনছে।কেউ কেউ কানাকানি করছে তো আবার কেউ কেউ দু-লাইন বাড়িয়ে নতুন করে কাহিনী সাজাচ্ছে। একপাশে বসে আরওয়ার মা কেঁদেই যাচ্ছেন তখন থেকে।আশরাফ চৌধুরী আর চুপ থাকতে পারলেন না। একমাত্র ছোট বোনের কান্না এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে তার বুকে লাগছে। বেশ গম্ভীর গলায় বললেন: আমাদের একটু ভেবেচিন্তে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। আমার মনে হয় আমরা ভেতরে রুমে গিয়ে বসে মাথা ঠান্ডা করে বিয়ে হবে কি হবে না এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। বাড়িভর্তি মেহমানের সামনে এভাবে মেয়ের চরিত্র নিয়ে কথা বলাটা একটু দৃষ্টিকটু বটে।
কথাটা শেষ করে আশরাফ চৌধুরী আরওয়াকে ধরে নিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসালেন। মেয়েটা কান্নার জোরে হাঁটতেই পারছে না।তার মধ্যে সকাল থেকে কত ঝড় বয়ে গেছে তার কঙ্কাল শরীরটার উপর। শান্ত চোখে আরওয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন:দেখ মা, তোকে এসব কিছু নিয়ে ভাবতে হবে না।আমরা তোকে বিশ্বাস করি।কে কি বলছে তাতে কিছু এসে যায় না।
আরওয়া নিজেও খুব ভালো করে জানে তার পরিবার তাকে বিশ্বাস করবে। কিন্তু সমাজ তো তার বাবাকে অপমান না করে ছাড়বে না।তার চেয়েও বড় সমস্যা তার ছোট বোন মারওয়ার বিয়েটা আটকে আছে তার জন্য। আজকে যদি পাত্রপক্ষ বিয়েটা ভেঙে দেয় তাহলে মারওয়াকেও তার সাথে সাথে হিমশিম খেতে হবে। নিজের চেয়েও মারওয়াকে নিয়ে চিন্তা বেশি হচ্ছে। কিন্তু তার তো কোনো উপায় নেই এখন।
আশরাফ চৌধুরীর কথায় পাত্রের বাবা রিদুয়ান মোস্তফা একটু থামলেন। কিন্তু একটু পর শেলী বেগম তাকে কড়া গলায় বললেন: এখানে বসে আছো কেন?এই মেয়েকে যদি বাড়ির বউ করে নিয়ে যেতে হয় তাহলে আমি বের হয়ে যাবো। এমন থার্ড ক্লাস মেয়ের সাথে এক ছাদের নিচে আমি কখনো থাকবো না। উনাদের বলে দাও এই বিয়েতে আমাদের কারো মত নেই।
রিদুয়ান মোস্তফা স্ত্রীর আদেশ শুনে আশরাফ চৌধুরীর দিকে একবার তাকালেন।দুজনের চোখাচোখি হতে আবার চোখ নামিয়ে নিলেন রিদুয়ান মোস্তফা। একটু থেমে বললেন: দেখেন আশরাফ ভাই, আমার পরিবারটা খুব গোছানো একটা পরিবার। আমাদের একটাই সন্তান। আমরা চাই ছেলে আর ছেলের বউ নিয়ে মিলেমিশে থাকতে। যেহেতু আমার স্ত্রী আপনার ভাগ্নিকে মেনে নিতে পারছে না তাহলে আমার পক্ষে এই বিয়েতে সম্মতি দেওয়া সম্ভব নয়।
আশরাফ চৌধুরী একটু ভাবলেন। ছেলে পক্ষের বিয়ে নিয়ে আগ্রহ নেই দেখে তিনিও বুঝতে পারছেন না কি করবেন।বিয়ে তো আর একদিনের বিষয় নয়। সারাজীবন একসাথে থাকার একটা আয়োজন। তাই সব ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু তিনি নিরুপায়।আজ যদি ভাগ্নির এনগেজমেন্টটা ভেঙে যায় তাহলে পুরো পরিবারের বদনাম হয়ে যাবে।তাই তার সিদ্ধান্ত যে করেই হোক এনগেজমেন্ট হতেই হবে। শান্ত গলায় রিদুয়ান মোস্তফাকে বললেন: এভাবে হুট করে এতো বিশাল একটা আয়োজন ভেঙে দিতে পারি না। আপনি নিশ্চয় খুব ভালো করে বুঝতে পারছেন বিষয়টা। আজকে এনগেজমেন্টটা হয়ে যাক তারপর আমরা সবাই আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবো।
আশরাফ চৌধুরীর কথা শেষ হওয়ার আগে পাত্রের মা শেলী বেগম আবারো বললেন: আপনার বোনের বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া মেয়েটা আমার ছেলের ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিতে চাইছেন তা আমি খুব ভালো করে বুঝতে পারছি।এটা আমি কখনো হতে দিবো না।
_দেখুন,আপনারা এভাবে এনগেজমেন্ট ভেঙে দিতে পারেন না। আমাদের মেয়ে নিজ ইচ্ছাতে কিছুই করেনি।জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট। সেটা আমাদের উভয় পক্ষের বুঝতে হবে।
_না আমি বুঝবো না। আপনাদের মেয়ে আপনারা বুঝুন। আমার ছেলের সাথে এই মেয়ের কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠুক তা আমি চাই না মানে চাই না।
আকরামুল হক এবার রেগে গেলেন। শক্ত গলায় বললেন:কিন্তু না চাওয়া সত্ত্বেও আপনাদের রাজি হতে হবে আর আজকে শুধু এনগেজমেন্ট নয়। বিয়ে সহ করিয়ে দিয়ে তারপর বাকিটা ভাববো।
কথাটা শোনামাত্র শেলী বেগম জোর গলায় বললেন: আমাদের পাওয়ার দেখাতে আসবেন না। মনে রাখবেন বিয়েটা একদিনের খেলা নয়। আপনার মেয়েকে দরকার হলে মাটিতে পুঁতে দিবো তবু ছেলের বউ করে নিয়ে যাবো না।
অবস্থা বেগতিক দেখে আশরাফ চৌধুরী দুজনকে থামানোর চেষ্টায় মগ্ন। বাড়ি ভর্তি মেহমানেরা সবাই চুপচাপ দেখে চলেছেন তখন থেকে। আশরাফ চৌধুরী বারবার বলছেন দুজনকে থামতে। খানিকক্ষণ পর আরওয়ার বাবা আকরামুল হক থেমে গেলেও শেলী বেগম বলেই চলেছেন। আশরাফ চৌধুরী এবার রিকোয়েস্ট করে বললেন:আপা প্লিজ থামুন এবার। আপনিও একজন মহিলা মানুষ। আপনার তো অন্তত বোঝা উচিত এভাবে এনগেজমেন্টের দিন এনগেজমেন্টটা ভেঙে গেলে আমাদের মেয়ের জীবনটা শেষ হয়ে যাবে।
শেলী বেগম সাথে সাথে জবাব দিলেন: আপনার ভাগ্নির জীবন শেষ হলে আমাদের কি?এতোই যদি ভাগ্নির জীবন নিয়ে ভাবেন তাহলে এই নষ্টা মেয়েকে আপনার ছেলের বউ করেন। মানুষের ঘাড়ে না চাপিয়ে নিজের ঘাড়ে নিন। তখন আমরাও শান্তি আর আপনি আর আপনার বোনও শান্তিতে থাকতে পারবেন।
শেলী বেগমের কথায় আশরাফ চৌধুরী কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। শান্ত চোখে একবার আরওয়ার দিকে তাকালেন। নিজেকে এখন অনেক বেশি নিরুপায় মনে হচ্ছে তার।তিনি নিজেও চান আরওয়াকে ছেলের বউ করতে। কিন্তু উপায় নেই।
আশরাফ চৌধুরীর তিন ছেলে।তার মধ্যে বড় ছেলে আর ছোট ছেলে বিয়ে করে ফেলেছে।বাকি আছে মেঝো ছেলে আহরার নির্ঝর। আশরাফ চৌধুরী আর তার স্ত্রী অনেক চেষ্টা করেছেন ছেলের জন্য বউ আনতে। কিন্তু নির্ঝর কোনো মেয়েকে পছন্দ করে না। বিয়ের কথা বললেই সে এড়িয়ে যায়। আশরাফ চৌধুরীর ধারণা তার ছেলে বিয়ে-সাধী বা প্রেম-ভালোবাসাতে বিশ্বাসী নয়।তাই তিনি চান না আরওয়াকে তার ছেলের মতো কাণ্ডজ্ঞানহীন একজন ছেলের হাতে তুলে দিতে।
শেলী বেগমের ডাকে আশরাফ চৌধুরীর ধ্যান ফিরে।
_দেখুন আশরাফ সাহেব,আমি কিন্তু আপনাকে খুব ভালো একটা আইডিয়া দিয়েছি। নিজের ভাগ্নিকে ছেলের জন্য নিয়ে যান আর আমাদের ছেলেটাকে মুক্তি দেন।এটাই একমাত্র প্রত্যাশা।
_না,তা কখনো সম্ভব নয়।
আশরাফ চৌধুরীর ধারণা নির্ঝর খুব বেশি পাষাণ,নির্দয় আর অসামাজিক একজন মানুষ।সে কখনো আরওয়াকে মানুষ হিসেবে সম্মান করবে না,সময় দিবে না,ভালোবেসে আগলে রাখবে না।যে ছেলেটা ভালোবাসা মানেই বুঝে না সে কি করে স্ত্রীকে ভালোবেসে আগলে রাখবে? আশরাফ চৌধুরী কোনো উত্তর খুঁজে পান না।তার উপর যদি তিনি জোর করে বিয়েটা দিয়ে দেন তাহলে তো নির্ঝর আরওয়াকে শায়েস্তা করে ছাড়বে।শেলী বেগম মুখের উপর পুঁতে রাখার হুমকি দিলেও তা তখন বাস্তব করবে তার ছেলে নির্ঝর। ভাবতেই আশরাফ চৌধুরীর গলা শুকিয়ে যায় মতো অবস্থা।
আশরাফ চৌধুরীর কাছে “না” শব্দটা শুনে শেলী বেগম তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে উঠে। হাসতে হাসতে বলে: আপনার মতো স্বার্থপর মানুষের গায়ের চামড়া গুলো নিয়ে জুতা বানিয়ে জাদুঘরে সাজিয়ে রাখা উচিত যাতে সবাই স্বার্থপরের উদাহরণ হিসেবে আপনাকে একপলক দেখে নিতে পারেন। এতোক্ষণ খুব করে আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিলেন। যখনি বললাম আপনার ছেলের বউ করে নিয়ে যান তখনি বুঝতে পারলেন আপনার ভাগ্নি একজন নষ্টা। তাকে আর যাই হোক ঘরের বউ করা যায় না।তাইতো?
শেলী বেগমের প্রতিটি কথা আশরাফ চৌধুরীর শিরা-উপশিরা কাঁপিয়ে দিচ্ছে। তাকে কেউ কখনো এতো জঘন্যভাবে অপমান করতে পেরেছিল কিনা সন্দেহ। নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না। গমগমে গলায় বললেন: আমার ছেলের সাথেই আজ আরওয়ার বিয়ে হবে আর এটাই ফাইনাল।আকরাম তুমি সব আয়োজন শুরু করো।
আশরাফ চৌধুরীর কথায় শেলী বেগম সহ বাড়ি
ভর্তি সবাই অবাক হয়ে গেল।আরওয়া থমকে গিয়ে উঠে দাঁড়ালো।তার মনে হচ্ছে কেউ তার বুকের ভেতর ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছে। বারবার মনে হচ্ছে কেউ তাকে চুপিসারে বলছে,”তোর মতো মেয়ে আমার সাথে কখনো যায় না। তুই তোর রাস্তায় যা। আমার সামনে কখনো আসবি না।”তার উপর গতকাল রাতে নির্ঝরের প্রতিটা আচরণ আরওয়াকে ভাবাচ্ছে।সে কি করে নির্ঝরকে বিয়ে করবে এতো কিছুর পর?
চলবে….