#বুঝে_নাও_ভালোবাসি।
#ফাহমিদা_তানিশা
পর্ব ০৪
নির্ঝরের কথা ভাবতেই আরওয়ার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। নির্ঝরকে বিয়ে করাটা কি যৌক্তিক হবে? নাকি আবারো তাকে ভালোবাসার মায়ায় পুড়তে হবে? আবারো সব লাঞ্ছনা সহ্য করতে হবে? বুঝতে পারছে না আরওয়া।
আরওয়া শুয়ে শুয়ে নির্ঝরকে নিয়ে ভাবছিল তখনি কেউ রুমের দরজায় নক করলো।আরওয়া উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই মারওয়া রুমে আসলো।তার হাতে খাবারের প্লেট। আরওয়ার জন্য এনেছে খাবারগুলো। শান্ত কন্ঠে বললো: খাবারগুলো খেয়ে নে। আম্মু পাঠিয়েছে।বলেছে সবটা শেষ করতে।
_খেতে ইচ্ছা করছে না এখন। নিয়ে যা এসব।
_খেতে ইচ্ছা করছে না বললেই হলো? কালকে থেকে কিছু খেয়েছিস? চুপচাপ খেয়ে নে।
_আমার ভালো লাগছে না কিছু। প্লিজ এসব নিয়ে যা।
_শোন আপু,এতো প্যারা নেওয়ার দরকার নাই।রাশেদ ভাইয়ার তুলনায় নির্ঝর ভাইয়া হাজার গুণ ভালো।তোর তো আরো খুশি হওয়া উচিত। যারা তোর নামে বদনাম করার জন্য এতো কিছু করলো,তোর ক্ষতি করতে চাইলো তারা না চাইতেই এখন তোর ভালো করে ফেললো।নির্ঝর ভাইয়া একটু অন্যরকম তা ঠিক। কিন্তু দেখ, কতো সুন্দর, সুদর্শন চৌকস আর্মি অফিসার।আর কি লাগে?
_এসব জ্ঞান দিতে আসিস না। আমার সমস্যা তুই কি করে বুঝবি? আমার কপালে আর কি কি আছে তা শুধু আমি জানি আর আল্লাহ জানে। জানিস,আমি কখনো চাই না আমাকে কেউ ছোট করে কিছু বলুক। আমি শুধু সম্মানটুকু চাই। শুধু সম্মান। আমার ভুল হলে আমাকে বকা দিতে পারে, কথা শোনাতে পারে। আমি শুনতে রাজি। কিন্তু অযথা কেউ আমাকে নানা ধরনের কথা বলবে, আমাকে ছোট করবে তা আমি মানতে পারবো না। নির্ঝর ভাই আমাকে সেই সম্মানটুকু দিবেন না কখনো। আমি সেটা খুব ভালো করে জানি।
কথাগুলো বলতে বলতে আরওয়া কান্না করে দিলো।মারওয়া বুঝতে পারছে আরওয়ার কথাগুলো। নির্ঝর কেন আরওয়াকে অপমান করবে?তার সাথে তো খুব সুন্দর করে কথা বলে। তাহলে আরওয়াকে কেন অপমান করবে?মারওয়া কিছু বুঝতে না পারলেও আরওয়াকে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
_এই আপু কাঁদছিস কেনো? একদম কান্না করতে হবে না।দেখবি নির্ঝর ভাইয়া ঠিক তোকে মেনে নিবে।
মারওয়া জোর করে আরওয়াকে খাবারগুলো খাইয়ে দিলো। তারপর আরওয়াকে ঘুমাতে বলে সে বেরিয়ে গেল।আরওয়াও মারওয়ার কথামতো ঘুমানোর চেষ্টা করছে।মাথাটাও অনেক বেশি পেইন দিচ্ছে। এখন ঘুমটা খুব প্রয়োজন। চোখ বন্ধ করতেই ঘুমিয়ে পড়লো আরওয়া।
সন্ধ্যার দিকে মারওয়া আসলো রুমে।এসেই দেখে আরওয়া ঘুমিয়ে আছে।সে আরওয়াকে ঘুম থেকে ডেকে দিতেই আরওয়া উঠে বসলো।
_আপু পার্লারের আপুরা এসেছেন তোকে সাজানোর জন্য। আম্মু বলেছে তাড়াতাড়ি আসতে।
_সাজবো কেন হঠাৎ?
_আরে মামা বলেছেন আজকে একেবারে সব আয়োজন শেষ করবে।আজকে বিয়েটা হয়ে যাবে।
মারওয়ার কথায় আরওয়া আকাশ থেকে পড়লো।অবাক হয়ে বললো,এই এসব কি বলছিস?আজকেই বিয়ে মানে? আমার কাবিন হয়ে গেছে।ওটা ঠিক করতে করতে অনেক সময় লাগবে।
আরওয়ার কথায় মারওয়া হাসলো। তারপর বললো:আরে,এভ্রিথিং ইজ পাওয়ার। কাবিনের ডকুমেন্ট তুই ঘুমে থাকতেই সরিয়ে ফেলেছে।চল এখন বউ সাজবি। জানিস, মামা আর আব্বু গিয়ে বিয়ের পোশাক কিনে এনেছে। অনেক সুন্দর হয়েছে তোর বিয়ের শাড়িটা।
_আমি বিয়েটা করবো না রে। প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা কর।
_সেটা আব্বুকে আর মামাকে গিয়ে বল।
_কিভাবে বলবো?
_বলতে না পারলে আমার সাথে চল সাজতে।
আরওয়া জানে সে তার বাবাকে বা মামাকে কিছুই বলতে পারবে না।বাধ্য হয়ে বিয়েটা করতে হবে তাকে অন্য কোনো অপশন নেই। একবার মারওয়ার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ হাঁটা দিলো মারওয়ার পেছন পেছন।
অনেকটা সময় ফুরিয়ে গেলো।আরওয়াকে পার্লারের মেয়েরা সাজিয়ে দিয়েছে। খুব সুন্দর লাগছে তাকে।মারওয়ার কথা আসলেই সত্যি। বিয়ের শাড়িটা খুব সুন্দর হয়েছে।তার চেয়েও বড়ো কথা শাড়িটা আরওয়াকে বেশ মানিয়েছে। খুব দ্রুত আয়োজন করায় বিয়েটা আরওয়াদের বাড়িতেই হচ্ছে।আরওয়ার সাজ শেষ হলে তাকে তার বান্ধবী নিশা রুমে নিয়ে গেলো। দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো: বান্ধবী, তোকে তো পুরো পরীর মতো লাগছে।ইস! আজকে নির্ঝর ভাই শেষ। তোকে দেখে নিশ্চয় বলবে,”ওগো সুন্দরী রমণী, তোমার চরণ ধুলায় আমারে একটু ঠাঁই কি দিবে?”
নিশার কথা শুনে আরওয়া হেসে দিলো।পরক্ষণে মনে পড়লো,”তোর মতো মেয়ে আমার সাথে কখনো যায় না।”কথাটা মনে পড়তেই আরওয়া হাসি থামিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সত্যি আজকে তাকে খুব সুন্দর লাগছে।সচরাচর সে খুব একটা সাজগোজ করে না। সাদাসিধে থাকে।তাই বলে কি সে নির্ঝরের সাথে যায় না? খুব বেশি অযোগ্য?আরওয়ার চোখে পানি চিকচিক করছে।নিশার কাছে ব্যাপারটা খুব সহজ লাগছে কিন্তু ব্যাপারটা এতো সহজ নয় আরওয়া ভালো করে জানে। নির্ঝর বাবার কথাটা ফেলতে পারেনি বলে বিয়েটা করছে কিন্তু সে এতো সহজে আরওয়াকে মেনে নিবে না।তা আরওয়া খুব ভালো করে জানে।
কিছুক্ষণ পর আরওয়ার রুমে নির্ঝরকে আনা হলো। নির্ঝরের পাশে তার বড় ভাইয়ের বউ নিশু দাঁড়িয়ে।আরওয়াকে দেখেই সে বলে উঠলো: বাহ্!আরওয়া তোমাকে তো দারুন লাগছে আজকে। আমার দেবর তো ফিদা হয়ে যাবে।
নিশুর কথা শেষ হওয়ার আগেই পেছন থেকে মিতা বলে বসলো: আহ্ ভাবি!কি যে বলছেন?আরওয়ার চেয়ে কয়েকগুণ সুন্দরী মেয়েকে নির্ঝর বয়কট করেছে। আজকে বাধ্য হয়ে আরওয়ার গলায় মালা পড়াতে হচ্ছে বেচারাকে।আর তুমি বলছো ফিদা হওয়ার কথা।
মিতা নির্ঝরের খালাতো বোন। মিতার কথা শুনে আরওয়া চোখ তুলে নির্ঝরের দিকে তাকালো। তাকাতেই সে থমকে গেল। নির্ঝর তার দিকে তাকিয়ে আছে। নির্ঝর লাস্ট কখন আরওয়ার দিকে এভাবে তাকিয়েছিল তা আরওয়ার মনে নেই।আরওয়া চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিলো। তবে তার অনুমান বলছে নির্ঝর এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। নির্ঝরের ভাবি তাকে ধরে বিছানায় নিয়ে গিয়ে বসালো। দ্রুত আয়োজন করায় আলাদা করে স্টেজ সাজানো হয়নি।তাই রুমেই বসাতে হলো নির্ঝরকে।
রাত ১১টার দিকে বিয়ের সব আয়োজন শেষ হলো। এবার বিদায়ের পালা।আরওয়া তার মাকে আর মারওয়াকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদছে।সে মা’কে ছাড়া খুব কম থাকে। আজকে থেকে মাকে ছাড়া থাকতে হবে ভাবতেই অনায়াসে চোখের জল পড়ছে তার চোখ বেয়ে।তার উপর নির্ঝরের সাথে থাকতে হবে ভেবে আরো অবস্থা খারাপ তার। নির্ঝরের বড় ভাবি নিশু আরওয়াকে ধরে গাড়িতে তুলে দিলো।সে উঠতে না চাইলেও মামার কথায় আবার উঠে বসলো গাড়িতে।তার পাশে নির্ঝর বসা।দুজনের মাঝে দূরত্ব খুব কম। কিন্তু মনের দূরত্বে যেন বিশাল ফারাক।
গাড়ি চলছে গন্তব্যের দিকে।আরওয়ার গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। একটু পর পর সে টিস্যু দিয়ে মুছছে। ড্রাইভিং সিটে নির্ঝরের ছোট ভাই রুশান বসা।হঠাৎ নির্ঝরের কড়া গলা শুনে দ্রুত গাড়ি থামালো রুশান। ভ্রু কুঁচকে বললো:কি হয়েছে ভাইয়া?
_আমি নামবো। আমাকে নামিয়ে দিয়ে তোরা চলে যা।
পেছন থেকে নির্ঝরের খালা বললো: তুই নেমে যাবি মানে?এতো রাতে কোথায় যাবি আবার?
নির্ঝর স্পষ্ট গলায় বললো: জাহান্নামে যাচ্ছি।রাত হলেও সমস্যা নাই।
নির্ঝরের কথা শুনে গাড়িতে থাকা সবাই বোকার মতো করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।আরওয়াও অবাক হয়ে আছে।সে তো কিছুই করেনি। শুধু শুধু নির্ঝর এমন করছে কেনো? সে তো শুধু কান্না করেছিল।তাও একটাও আওয়াজ পর্যন্ত করেনি। শুধু চোখের পানি মুছেছে।এতে এতো রাগ দেখানোর কি আছে?বুঝতে পারছে না আরওয়া। অসহায় চোখে একবার নির্ঝরের দিকে তাকালো। কিন্তু নির্ঝর তার দিকে না তাকিয়ে হনহন করে গাড়ি থেকে নেমে গেলো।
নির্ঝর গাড়ি থেকে নামতেই রুশান গাড়ি স্টার্ট দিলো। কিন্তু নির্ঝর গাড়ি থেকে নামার পর থেকে তার খালা বকবক করতেই আছেন।”ছেলেটার জীবনটা এক দিনের মধ্যেই শেষ করে দিলো। এমন একটা চরিত্রহীন মেয়ের সাথে হুট করে বিয়েটা করিয়ে দিলো।বাপ বলে কি যা মন চায় তা করতে পারবে?ছেলের জীবন,ছেলের সিদ্ধান্ত। নিজের চরিত্রহীন ভাগ্নিকে বাঁচানোর জন্য কিছু না ভেবে এভাবে নিজের ছেলের সাথে বিয়ে করিয়ে দিলো। এই সামান্য রাস্তায় সে এই মেয়ের পাশে বসে যেতে পারছে না। কিভাবে সারাজীবন কাটাবে কে জানে?”
নির্ঝরের খালার কথাগুলো শুনে আরওয়া বোকা বনে গেলো।ভাবছে নির্ঝর এমন কেনো করলো?সে তো কিছুই করেনি। শুধু শুধু কতগুলো কথা শুনতে হলো তাকে। তবু ভাগ্য ভালো। আশরাফ চৌধুরী এই গাড়িতে নেই।তিনি যদি এই গাড়িতে থাকতেন তাহলে হয়তো অনেক কিছু হয়ে যেতো। নির্ঝর কি একা হেঁটে হেঁটে যাবে?আরওয়া বুঝতে পারছে না তার সাথে কি হতে যাচ্ছে।
গাড়ি থামলো নির্ঝরদের বাড়ির গেইটের সামনে। গেইটে নির্ঝরের দাদা মানে আরওয়ার নানাভাই আরমান চৌধুরী দাঁড়িয়ে আছেন।তিনি আরওয়াকে খুব আদর করেন।আরওয়া নামতেই জড়িয়ে ধরলেন। তিনি বিয়েতে যাননি তাই গেইটে দাঁড়িয়ে আছেন। কোনো এক কারণে তিনি আরওয়াদের বাসায় যান না।আরওয়া গাড়ি থেকে নামতেই তিনি জড়িয়ে ধরলেন। আরওয়া নানাভাইকে ধরে কান্না করে দিলো।তার কান্না দেখে নানাভাই শান্ত কন্ঠে বললেন: কাঁদছিস কেনো?এখন থেকে তো আমি আছি তোর সাথে।তোর মাকে তোর বাবা আমার বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়ে আমাকে একা করে দিয়েছিল।আমি আজ তোকে তার কাছ নিয়ে এসে তাকে একা করে দিলাম।কি দারুন প্রতিশোধ!
কথাটা বলেই আরওয়ার নানাভাই খিলখিলিয়ে হাসছেন।
তখনি আরেকটা গাড়ি এসে থামলো। সেই গাড়িতে নির্ঝরের মা সহ কয়েকজন আছেন।আরওয়া দেখে অবাক হলো যে নির্ঝরও সেই গাড়ি থেকে নামছে।গাড়ি থেকে নামতেই আরমান চৌধুরী ডাক দিলেন নির্ঝরকে। নির্ঝর একবার রাগী দৃষ্টিতে আরওয়ার দিকে তাকিয়ে দাদার কাছে আসলো।আরওয়া বুঝতে পারছে না নির্ঝর হঠাৎ এতো রাগ দেখাচ্ছে কেনো?সে আবার কি করলো?
চলবে….