#বুঝে_নাও_ভালোবাসি।
#ফাহমিদা_তানিশা
পর্ব ১৭
আরওয়া চুপ করে আছে।সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। অসহায় মুখ করে মিসেস রুমানার দিকে তাকিয়ে থাকলো সে।
মিসেস রুমানা আরওয়ার দিকে তাকিয়ে আবারো জিজ্ঞেস করলেন:বলো, সব ভুলে গিয়ে আগের মতো হয়ে যাবে তো দুজনেই?
আরওয়া তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। শান্ত কন্ঠে বললো:মামি,ছয়টা বছর কি অনায়াসে ভুলে যাওয়া যায়? আপনার সাথে কেউ এমন জঘন্য আচরণ করলে, এভাবে অপমান করে দূরে সরিয়ে দিলে আপনি কি সব ভুলে গিয়ে তাকে ক্ষমা করে দিতে পারতেন?
মিসেস রুমানা অবাক হলো আরওয়ার কথায়।মেয়েটা খুব গম্ভীর। খুব সহজে কথা বলে না। আজকে কতো সাহস নিয়ে সে কথাগুলো বললো তাকে। মিসেস রুমানা আরওয়ার চোখের দিকে তাকালেন তারপর বললেন:আমি বলেছি তাই নির্ঝর এমনটা করেছে। নির্ঝরের কোনো দোষ নেই এতে।
_নির্ঝরের কোনো দোষ নেই?যদি নির্ঝরের কোনো দোষ না থাকে তাহলে কি সব দোষ আমার?
_না তোমার দোষ হবে কেনো?
_যদি আমার দোষ না থাকে তাহলে আমি কেনো ছয় বছর ধরে এতো কষ্ট পেলাম? আপনার ছেলে আমার ভালোবাসা না বুঝে আমাকে এভয়েট করে গেছে এতোদিন। এখন তার মন চাইছে বলে আবার আমার কাছে আসতে চাইছে। ঠিক আর কয়েক মাস পর যদি আবারো আপনার কথা শুনে আমাকে ছেড়ে দেয় তখন তার দায় কে নিবে?
_নির্ঝর কোনো কারণ ছাড়া ছেড়ে যাবে কেনো?
_আগেও তো কোনো কারণ ছাড়া ছেড়ে গিয়েছিল এখন যাবে না তা আমি কিভাবে বিশ্বাস করবো?যে একবার একটা কাজ করতে পারে তার জন্য কাজটা তখন ইজি হয়ে যায়।তাই সে বারবার সেইম কাজ করলেও আর দ্বিধা কাজ করে না।
_আরওয়া তুমি একটু বেশি বুঝছো। তুমি ছোট মানুষ। তোমার এতো কিছু বুঝতে হবে না,এতো কিছুতে কানও দিতে হবে না।
_ঠিক বলেছেন।তাই আমি কিছুতে কান দিতে চাই না। হোক সেটা আপনার কথা বা আপনার ছেলের কথা।
মিসেস রুমানা চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ।তিনি হয়তো কি বলা যায় তা বুঝতে পারছেন না। একটু পর বললেন: এরকম করে কি সংসার করা যায়?
_না যায় না। কিন্তু আগ্রহ আর বিশ্বাস ছাড়া কি সংসার করা যায়?
_তাহলে বিয়েটা করেছিলে কেনো?
_বাধ্য হয়ে করেছি। সেদিন আপনি আমাকে সকলের সামনে নষ্টা মেয়ে প্রমাণ করেছিলেন। এরকম একটা পরিস্থিতিতে আমি কিভাবে সকলের সামনে বলবো আমি আপনার ছেলেকে বিয়ে করবো না?
_তাহলে এখন কি চাইছো?
_আমার কিছু চাওয়ার নেই।
_কিছু একটা তো তোমাকে ঠিক করতে হবে।হয় সুন্দর মতো গুছিয়ে সংসার করতে হবে নয়তো বিচ্ছেদের দিকে হাঁটতে হবে।
_আমাকে যারা বিয়ে দিয়েছেন তারা সেই সিদ্ধান্ত নিবেন। আমার কিছু বলার নেই।
_সংসারটা তোমার।তাই তোমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আরওয়া মিসেস রুমানার দিকে তাকালো। একটু হাসার চেষ্টা করে বললো: আপনি আমার অনেক সিনিয়র। সংসার জীবন, বাস্তব জীবন সবকিছু নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা আমার চেয়ে অনেক বেশি। আপনি বলুন এতো কিছু ভুলে গিয়ে কি কখনো সংসার করা যায়?
_ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলে সব কিছু ভুলে থাকা যায়।
_ভুলে থাকা যায় না শুধু ভুলে থাকার অভিনয় করা যায়।
মিসেস রুমানা এবার রেগে গিয়ে বললেন: তোমার সাথে আমি কথায় পারবো না। তোমার যা মন চায় তাই করো।
মিসেস রুমানা হনহন করে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলেন।আরওয়া সেদিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। মিসেস রুমানার কথাগুলো তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বারবার একটা কথা কানে বাজছে “বিচ্ছেদের দিকে হাঁটতে হবে ।”কতো সহজ করে মিসেস রুমানা কথাটা বললেন। আসলেই কি বিচ্ছেদ এতো সহজ?দুজন মানুষ একসাথে সারাটা জীবন পাড়ি দিবে বলে বিয়ের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। অনুভূতি ছাড়া,ভালোবাসা ছাড়া, আগ্রহ ছাড়া এতো জটিল সিদ্ধান্ত কেউ নেয় না। কিন্তু অনুভূতি, ভালোবাসা, আগ্রহ সবকিছু উপেক্ষা করে দুজনে আবার আলাদা হওয়ার চিন্তা করে কি করে?আরওয়া বুঝতে পারে না। মিসেস রুমানার কাছে বিষয়টি এতো সহজ লাগলো?তার তো বোঝা উচিত ছিল আরওয়া অভিমান থেকে কথাগুলো বলেছে।তিনি চাইলেই বলতে পারতেন,”আমার ছেলেটা ভুল করেছে। একটু সময় নাও দুজনে। মিলেমিশে থাকলে ধীরে ধীরে সব ভুলে যাবে একসময়। তারপর গুছিয়ে সংসার করবে।”কিন্তু তিনি বললেন পুরো অন্যরকম কথা।যেটা কখনো মানা যায় না।
আরওয়া বসা থেকে ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ালো। এসেছিল নাস্তা করতে।তার আর নাস্তা খাওয়া হলো না।দেওয়াল ধরে ধরে সে রুমে গেলো। বিছানায় শুয়ে পড়লো তারপর।তার মামিকে আগে বেশ শান্তশিষ্ট, সহজ-সরল মনে হতো। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ তিনি। শুয়ে শুয়ে নির্ঝরকে নিয়ে ভাবছে আরওয়া। অনায়াসে চোখ দুটো বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে তার। নির্ঝর কি তাকে ভালোবাসে? যদি সত্যি ভালোবাসতো তাহলে দূরে থাকলো কি করে?একবারও কি তার কথা মনে পড়তো না? নির্ঝরকে সে এতো সহজে ক্ষমা করবে না। কখনো না। নির্ঝরকে বুঝতে হবে ভালোবাসার কষ্টটা। ভালোবাসার মানুষ উপেক্ষা করলে, অপমান করলে কতো কষ্ট হয় সেটা নির্ঝরকে বোঝাতে পারলেই আরওয়া সার্থক।
প্রায় রাত নয়টার মতো হলো। রিস্তা একটু আগে অফিস থেকে ফিরেছে। ফ্রেশ হয়ে সে আরওয়ার রুমে আসলো। রুমে আসতেই জিজ্ঞেস করলো: নাস্তা করেছো?
আরওয়া শান্ত কন্ঠে বললো:না করিনি।
রিস্তা বেশ চিল্লিয়ে বললো:কেনো?উইক হয়ে গেলে তোমার শরীর খারাপ হবে না? উফ্ আরওয়া তুমি কি ছোট বাচ্চা? নিয়মিত খাবার খেলে তবেই তো শরীর সুস্থ হবে।
তখনি নির্ঝর আসলো অফিস থেকে।রিস্তার চিল্লাচিল্লি শুনে ভ্রু কুঁচকে বললো: তুই ওর সাথে এভাবে চিল্লাচিল্লি করছিস কেনো?
_কি করবো আর?তোর বউ না খেয়ে বসে আছে।এতোগুলো ঔষুধ খেলে নিয়মিত খাবার খেতে হয়।আর সে না খেয়ে রুমে এসে বসে আছে।
রিস্তার কথায় নির্ঝর আরওয়ার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। গম্ভীর গলায় বললো: এই, তুমি কি করতে চাইছো? আবার শরীর খারাপ হলে কি করবে?
আরওয়া কোনো জবাব দিলো না। চুপচাপ বসে রইলো সে। নির্ঝর কোনো উত্তর না পেয়ে আরো রেগে গেলো। রাগে তার হাত কাঁপছে। তবু নিজেকে কন্ট্রোল করে বললো: তুমি এভাবে ইরিগুলার হলে কিভাবে সুস্থ হবে?
_সেটা তোমার লাগবে না।
নির্ঝর আরো রেগে গেলো। রাগে সে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। দ্রুত পায়ে মায়ের রুমে গেলো সে।মাকে দেখেই বললো: আপনি তো বাসায় ছিলেন।তাই না?
_হুম বাসাতেই তো ছিলাম।
_আপনি বাসায় থাকতে আরওয়া কিভাবে না খেয়ে থাকে? একজন অসুস্থ মানুষকে কি কয়েকদিন খেয়াল রাখতে পারেন না? সারাদিন বাসায় তো আর কোনো কাজ নেই। একটু সচেতন হলে তো হয়।
_তোমার বউকে তুমি খেয়াল রাখো। আমার কাজ না থাকলে আমি বসে থাকবো তবু তোমার বউয়ের খেয়াল রাখবো না।
_আপনার থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করাটা বোকামি।
_তোমার বউ মাষ্টারি করে মুখের উপর কথা বলতে পারে তাহলে নিজের যত্ন কেনো নিতে পারে না?
_আমার বউ কি আপনার সাথে মাষ্টারি করেছে?
_হ্যাঁ করেছে বলেই তো বলছি।
_কি করেছে?
_তোমার বউ থেকে জিজ্ঞেস করো।
_আমার বউ থেকে জিজ্ঞেস করবো।তার আগে আপনি বলুন। আপনার থেকে শুনি।
মিসেস রুমানা এবার কেঁদে দিলেন।আরওয়ার সাথে বলা সব কথা ছেলেকে কেঁদে কেঁদে হাজিরা দিলেন। নির্ঝর চুপচাপ সবটা শুনলো। তারপর শান্ত কন্ঠে মাকে বললো: দেখেন,আমি আর আপনি দোষ করেছি। যেহেতু আমরা তার ক্ষতি করেছি তাহলে এতোটুকু কথা বলা বিশাল কিছু নয়।অন্য মেয়ে হলে এর চেয়েও বেশি বলতো আপনাকে।
_তুমিও ওর পক্ষে আমাকে কথা শোনাতে আসছো?
_আমি কথা শোনাতে আসিনি। তবে আপনাকে বলবো, এখন আমি আর আরওয়া দুজনেই ম্যাচিউর। আমাদের জীবনের সিদ্ধান্ত আমরা নিতে পারবো।আপনি অযথা আরুর সাথে এসব নিয়ে কথা বলতে যাবেন না।এটা আমার রিকোয়েস্ট আপনার কাছে। সারাদিন অফিস করে বাসায় এসে আপনাদের এসব ঝামেলা দেখলে মেজাজ কতোটা খারাপ হয় একবার বোঝার চেষ্টা করেন।
_নিজের বউকেও একটু বোঝাবে কথাগুলো।
_আমি ওর কাছে অপরাধী।তাই ওকে কিছু বলতে পারবো না।আপনি প্লিজ আমার কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করেন।আমরা দোষ করেছি তাই আমাদের একটু মেনে নিতে হবে সবটা।আর আরু যেহেতু অসুস্থ তাই ওকে একটু খেয়াল রাখা প্রয়োজন ছিল আপনার। আপনি আমার মা হিসেবে এটা আপনার দায়িত্ব ছিল। যাইহোক যা হওয়ার হয়ে গেছে।নেক্সস টাইম যেন এমন না হয় আর।
নির্ঝর কথাগুলো বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।তার মা পেছন থেকে বললো:এটাই আমার কপাল। এতোক্ষণ ছেলের বউয়ের লেকচার শুনলাম আর এখন ছেলের লেকচার শুনতে হচ্ছে।
নির্ঝর দরজায় দাঁড়িয়ে একবার মায়ের দিকে তাকালো। তারপর হনহন করে নিজের রুমে গেলো।
আরওয়া বিছানায় বসে ছিল । নির্ঝর রুমে ঢুকতেই সে মুখ ফিরিয়ে নিলো। নির্ঝর মেজাজ কন্ট্রোল করে আরওয়ার পাশে গিয়ে বসলো।
চলবে…