বুনোফুল পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

0
62

#বুনোফুল
সমাপ্ত পর্ব
রুবাইদা হৃদি
মানুষের জীবনে বোধহয় ভালো কিছু হবার থাকে বলেই অনেকে কষ্ট নিয়েও সুখের সন্ধানে বেঁচে থাকে৷ আমার জীবনে ভালো বলতে দুটো ঘটনা আছে৷ একটা হলো এখানে পড়ার সুযোগ পাওয়া৷ আর একটা হলো এই বিদেশ বিভূঁইয়ে একটা শুভাকাঙ্ক্ষী পাওয়া৷
আমার টিউশন ফি’র বাকি টাকাটা ক্লারা দিয়েছে৷ যদিও ব্যাপার টা আমাকে অবাক করেছে৷ কারণ ও দুদিন আগেও আমাকে বলেছিলো,’নীরা আমার কাছে টাকা থাকলে তোমাকে এত ভাবতে হতো না৷’

তবে ও হুট করেই আমাকে টাকা দিলো৷ আমার দরকার ছিলো বলেই ক্লারাকে বেশি ঘাটাঘাটি করিনি৷ তবে কথা দিয়েছি আগামী মাসের মধ্যেই পরিশোধ করে দিবো৷
সামারের জন্য ভ্যাকেশন শুরু হতেই আমি আরো একটা পার্ট টাইম জবের ও ব্যবস্থা করে ফেলেছি৷ কাজের প্রেশারে একদম নাজেহাল অবস্থা৷ এর মাঝে আমি আম্মার কথা প্রায় ভুলেই বসেছিলাম৷ তবে হাতে বেতন পেতেই আম্মাকে দশ হাজারে বদলে বিশ হাজার পাঠিয়েছিলাম৷ এরপর আর আম্মার খোজ নেওয়া হয়নি৷
তবে আম্মার ব্যাপারে মনে করিয়ে দিলেন ছোট আপা৷
কাজে বের হবার জন্য মাত্রই বের হচ্ছিলাম এর মাঝে ছোট আপার ফোন পেতেই আমি বেশ অবাক হলাম৷ উনি আমাকে সহসা ফোন করেন না৷ আমি যত্রতত্র না ভেবে ফোন উঠাতেই আপার কন্ঠ ভারী শোনালো৷ আমি উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করতেই উনি কান্না করতে করতে বললেন,

‘নীরা তুমি কতো নিষ্ঠুর৷ একটা বার আম্মার খোজ নিলে না৷ যে আম্মা তোমার জন্য কতোকিছু করে দিয়ে গেলেন৷’

‘আপা আপনি কি বলছেন! আমি বুঝতে পারছি না৷ আম্মার কি হয়েছে৷’

আপাকে প্রশ্ন করতেই উনি ধমকের সুরে বললেন,

‘জানবা কিভাবে! তোমার জীবনে এখন আর আম্মার অস্তিত্ব আছে নাকি! আমার আম্মা তোমাকে নিজের সব টাকা দিয়ে দিলেন৷ নিজের জন্য কিছু রাখলেন না৷ সেই তুমি আম্মার একটা খোজ পর্যন্ত নিলে না৷’

‘আপা আম্মা কোথায়? উনি কি অসুস্থ৷ আপনি এভাবে কথা বলছেন কেনো?’

‘আম্মা গত তিন আগে দুনিয়া থেকে চলে গিয়েছে নীরা৷ আমরা তো এতিম হয়ে গেলাম৷’

আপার কথা শুনে আমার চোখে পানি জমলো৷ ভেতরে মনে হলো কেউ গলা চেঁপে ধরে আছে৷ আমি অবিশ্বাসের সাথে বললাম,

‘কি বললেন! আম্মা তো সুস্থ স্বাভাবিক ছিলেন৷’

আপার কান্না বেগ বাড়লো৷ বললেন,

‘আম্মার হঠাৎ করেই ঠান্ডা লাগলো৷ আমরা হসপিটালে নিলাম৷ উনারা বললেন কোভিড পজেটিভ৷ আমরা ভাবলাম এমনিই হয়তো৷ তবে দিন দিন আম্মার শ্বাসকষ্ট বাড়লো৷ নিঃশ্বাস নিতে পারতেন না৷ অক্সিজেন লাগতো৷ এরপর আম্মাকে বারবার আইসিউতে ভর্তি করা হলো৷ দু দিন থাকার পর উনারা বললেন আম্মা নাকি ব্রেইন স্ট্রোক করেছে লাইফ সাপোর্টে নিতে হবে৷ আম্মাকে উনারা পাঁচদিন রেখে এরপর মৃত ঘোষণা করলেন৷’

আপার কথা শুনে আমি বেশ আহত হলাম৷ আমি জিগ্যেস করলাম,

‘আপা আম্মা কবে থেকে অসুস্থ? ‘

‘গত ছয় সাত ধরেই৷’

আমি শুনে অনেক কষ্ট পেলাম৷ আম্মাকে কিছুটা ভুল বুঝেছিলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত উনি আমার ভুল ভাঙ্গিয়ে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন৷
ছোট আপাকে বুঝালাম৷ নিজের ভুলের জন্য মাফ চাইলাম৷ তবে আপা বললেন,

‘ভুল আমারো নীরা৷ তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করা ঠিক হয় নি৷ তুমি ফোন দাও নি দেখে আমি কষ্ট পেয়েছিলাম৷ তবে তোমার সাথে রাগ দেখিয়ে হবে কি! যেখানে হাবিব নিজেই আম্মার সর্বোচ্চ নিয়ে চলে গেছে৷’

‘মানে! হাবিব সাহেবের কি হয়েছে?’

ছোট আপা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন৷ বললেন,

‘কি আর বলবো নীরা! আম্মার থেকে হাবিব সব কিছু নিজের নামে নিয়ে ফেলেছে৷ এই কথা জানার পর থেকেই আম্মা আর হাবিবের মধ্যে ঝামেলা হয়৷ এরপর থেকেই আম্মা আরো অসুস্থ হওয়া শুরু করে৷ আমাদের কি হলো নীরা৷ সব তো শেষ হয়ে গেলো৷’

আমি আপাকে কি বলবো খুজে পেলাম না৷ তবে অনেক কষ্ট হচ্ছে৷
হাবিব উনার সন্তান হয়েও কিভাবে পারলো বেইমানি করতে? এই প্রশ্নের উত্তর বোধহয় কারো জানা নেই৷ আমি আপাকে বললাম,

‘এখন উনারা কোথায় আছে?’

‘ঢাকাতেই৷ তবে আমার সাথে যোগাযোগ নেই৷ বড় আপা তো হাবিবের জন্য পাগল৷ সব দোষ উনারা তোমাকেই দেয়৷’

আমি প্রসঙ্গ পাল্টে ছোট আপার খোজ খবর নিলাম৷
ফোন রাখতেই ভাবলাম দুনিয়া কতো আজব৷ আর কিছু মানুষ ভালোবাসায় কতোটা অন্ধ তাই না?
নিজের মায়ের সাথেও বেইমানি কর‍তে দুবার ভাবলো না হাবিব৷

.

বসন্ত আসার সাথে সাথে আমার জীবনের রঙ টা অনেকটা রঙিন হয়েছে৷ এর মাঝে অদ্ভুত একটা ঘটনা আমার জীবনে ঘটলো৷ আমি ক্লারার টাকা পরিশোধ করার জন্য দিতেই ও মাথা নীচু করে বললো,

‘নীরা এই টাকার মালিক আমি নই৷’

‘তাহলে কে?’

ও ভয়ে তটস্থ হলো ধীর কন্ঠে বললো,

‘আতিব দিয়েছে৷ প্লিজ রাগ করোনা৷ ও আমাকে প্রমিস করিয়েছিলো যেন আমি তোমাকে না জানাই৷’

আমি ক্লারার কথায় বেশ অবাক হলাম৷ বললাম,

‘তুমি আগে বললে না কেনো!’

‘আতিব খুব রিকুয়েষ্ট করছিলো৷ আর তুমি তো উপকৃত হয়েছো৷’

আমি ক্লারার কথায় শান্ত হলাম৷
তবে আমি নিজের করা ব্যবহারের জন্য লজ্জিত৷ তাই ক্লারার কাছেই টাকাটা দিলাম যেন আতিবকে দিয়ে দেয়৷

.
আমাদের সেমিস্টার প্রায় শেষের দিকে৷ আমি পিএইচডি করার চিন্তা ভাবনা করছি৷ তবে এর জন্য একটা ভালো জবের ব্যবস্থা আর থাকার ব্যবস্থা করাটা গলার কাটার মতো হয়ে উঠলো৷
আমি চিন্তায় ইদানীং চুপচাপ থাকি৷ আতিব হয়তো বিষয়টা লক্ষ্য করেছে৷ আমি ক্লাস রুম থেকে বের হতেই ও আমার পিছু পিছু আসলো৷ এরপর ডেকে বললো,

‘কেমন আছো নীরা?’

‘প্রত্যেকদিন তো দেখো ভালোই তো আছি৷’

আমার উত্তরে ও বেশ হাসলো৷ এরপর আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,

‘তুমি চাইলে আমি তোমাকে জবেত ব্যাপারে হ্যাল্প করতে পারি৷’

আমি অবাক হলাম৷ বললাম,

‘তুমি নিজের জন্য চেষ্টা করো আতিব৷ আমি নিজের টা পারবো৷’

ও কথা বাড়ালো না৷ আমার হাতে জোর করে একটা কার্ড দিয়ে গেলো৷ আর বলে গেলো,

‘নীরা সবার জীবনে অতীত থাকে৷ তবে অতীত থাকা ভালো৷ আর সবার জীবনের পুরুষ হাবিব হয় না৷’
আতিবের কথায় আমি বেশ চমকে উঠলাম৷ ও আর কিছু না বলেই চলে গেলো৷
তবে আমি বেশ বুঝলাম হয়তো ক্লারার কাছে বলা কথা গুলো ও আতিবকে বলেছে৷
তবে আমার জন্য বেশ সুবিধা হলো৷ বন্ধুত্ব হোক কিংবা ভালোবাসার সম্পর্ক৷ সেই ব্যাপার টা সমানে সমানে হতে হয়৷
.
শেষ পর্যন্ত এবারে আতিবের সাহায্য টা আমার দরকার হয় নি৷ আমি নিজেই একটা চাকরির ব্যবস্থা করে ফেলেছি৷ তারা আমার পারফরম্যান্স এর উপর স্যালারি বাড়াবে৷ এবং এই দেশের নাগরিক হবার জন্য সকল ডকুমেন্টস তারাই প্রস্তুত করে দিতে সাহায্য করবে৷
তবে এই খবরে আতিব ই বোধহয় বেশি খুশি হলো৷ সে আমাকে বললো,

‘নীরা আমি এই দুই বছরে সব সময় চেয়েছি তুমি নিজের মতো উঠে দাঁড়াও৷ যেন কখনো ভেঙে পরতে না হয়৷’

আমি আতিবের কথায় খুশি হলাম৷ বললাম,

‘তোমার কি অবস্থা!’

‘এইতো তোমায় ছাড়া একা একা লাগে৷ বাকিটা ভালো ভাবেই চলে যাচ্ছে৷’

আমি ওর কথায় বেশ হাসলাম৷ ছেলেটা লিমিটের বাইরে কথা বলে না৷ তবে আজ বললো৷ অনুনয়ের সুরে বললো,

‘কখনো যদি মনে হয় তোমার একা একা লাগছে৷ বা তোমার কাউকে দরকার৷ নীরা আমি কথা দিচ্ছি তুমি সব সময় আমাকে পাবে৷’

‘আর তোমার পরিবার? তারা কি মেনে নিবে!’

আমি হুট করে বলে ফেললাম৷ আতিব বললো,

‘পরিবার বলতে আমার মা অনেক আগেই মারা গিয়েছেন৷ বাবা এরপর বিয়ে করলেন৷ তারপর তো বুঝোই বাঙালি ফ্যামিলির যা অবস্থা হয় তাই আমার সাথে হয়েছে৷ আমি সম্পূর্ণ মামাদের উপর ছিলাম৷ এখানে আসতে পেরেছি তাদের জন্যই৷ তোমাকে যে কার্ড দিয়েছিলাম ওইটা আমার ছোট মামার রেস্টুরেন্টের৷’

‘আমি আজ আসি আতিব৷’

‘আমাকে ভুলে যেও না নীরা৷ তোমার জন্য আমি সব সময় আছি৷’

এরপর আমি কোনো প্রত্যুত্তর করলাম না৷ শত হোক আতিব হয়তো আবেগে এই কথা গুলো বলছে৷ তবে বাস্তবতা ভিন্ন৷

.
সময় বোধহয় আপন গতিতে চলেছে৷ আমার এ বছরেই প্রোমোশন হয়েছে৷ তবে সেই সাথে কাজের প্রেশার বেড়েছে৷
এর মাঝে গড়িয়েছে প্রায় এক বছর সাত মাস ৷ আতিবের সাথে যোগাযোগ হয় না৷
তবে আজকে সকালে আমার ফোনে আতিব একটা ভিডিও দিয়েছে৷ আমি বেশ অবাক হলাম৷ এরপর ও হাবিবের একটা ছবি দিয়ে বললো,

‘নীরা এইটা কি হাবিব?’

ছবি দেখলাম৷হ্যাঁ এইটা হাবিব৷ আমরা যেবার সমুদ্রে ঘুরতে গিয়েছিলাম সেবারের ছবি৷ ছবিটা আমিই তুলে দিয়েছিলাম৷ তবে আতিব কোথায় পেলো আমি জিগ্যেস করলাম৷ এরপর ওর মেসেজে আমার মাথায় ঝিমঝিম করে উঠলো৷ ও বললো,

‘হাবিবকে কারা যেনো খু’ন করেছে নীরা৷ ভিডিও টা দেখো৷’

আতিবের মেসেজে আমার হাত কাঁপছে৷ আমি ভিডিও টা চালু করলাম৷ দেখলাম একটা নিউজের লিংক৷ সেখানে একজন সাংবাদিক বলছে,

‘সাভার আশুলিয়ায় স্ত্রীর পরকীয়ার জোরে স্বামীকে প্রেমিক মিলে খু’ন করেছে মিতু ইয়াসমিন৷
সে হাবিব সাহেবের স্ত্রী৷ নৃংশস ভাবে খুন করে তারা দু’জন মিলে লা’শ ময়লার ড্রেনে ফেলতে গিয়ে স্থানীয় জনগণের হাতে দুজনেই হাতেনাতে ধরা পরেছে৷ তাদের কাছে থেকে নগদ আঠারো লাখ টাকা৷ চার ভরি স্বর্ণ…..

এরপরে আমি আর শুনতে পারলাম না৷ কান ঝাঁঝাঁ করে উঠলো৷ ভিডিও সরাতেই নিউজফিডে হাবিবের চাচাতো বোনের আইডি থেকে হাবিবের খণ্ডবিখণ্ড লা’শের ছবি শেয়ার করেছে৷
যা দেখার মতো না৷ হাবিবের মুখটা রক্তমাখা৷ আমি দেখে হুহু করে কেঁদে উঠলাম৷ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হলো,

‘হাবিব আমার সাথে কেনো সংসার টা করলে না? কেনো ভালোবাসায় অন্ধ হলে!’

কিন্তু প্রশ্নের উত্তর দেবার মতো হাবিব নেই৷ এই কথাটা ভাবতেই কষ্ট লাগলো৷ শত হোক আমি তো ভালোবেসেছিলাম৷

জীবন কতো সংক্ষিপ্ত তাই না? আমি ছোট আপার সাথে যোগাযোগ করে জানলাম মিতুকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে৷ যেহেতু প্রমাণ ছিলো৷
আর ওর নতুন প্রেমিকের কেসটা কোর্টে চলছে৷
.
আমি কিছুদিনের ছুটি নিয়ে বাংলাদেশে যাবার চিন্তা করলাম৷ তবে মন টানলো না৷ সব কিছু থেকেই একটা অন্যরকম বিশ্রী অনুভূতি হয়৷ তবে মানুষ তার কৃতকর্মের ফল বোধহয় আল্লাহ এই দুনিয়াতেই দেন৷
এইযে মিতুর আগামীকাল ফাঁসি হবে৷ নিউজ টা শুনে কিছুটা আফসোস আর স্বস্তি হচ্ছিলো৷
তবে আমার আফসোস হয় হাবিবের জন্য৷ ইচ্ছে হয় প্রশ্ন করি,

‘হাবিব আমার সাথে কি সংসার করা যেতো না? আমি কি তোমাকে ভালোবাসায় আগলে রাখতে পারতাম না?’

উত্তর মেলে না৷ বুকের মাঝে কষ্ট হয়৷

তবে আতিবের ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিতে ইচ্ছেটা হয় না৷ অনেক তো সংসারের স্বপ্ন দেখেছিলাম৷ আবার যদি নতুন করে ভেঙে যায়! শত হোক বুনোফুলের জীবন বলে কথা৷ নিজের জগতে খুব সুন্দর স্বপ্ন বুনে ইদানীং আমি বেশ আছি৷

আমি ছুটি নিয়ে বাংলাদেশে পাড়ি জমালাম৷ ওইদিন নিউজে দেখলাম কে বা কারা যেন একটা নবজাতক কন্যা শিশুকে ফেলে চলে গিয়েছে৷ আমি ওই এলাকার থানার কমিশনারের সাথে কথা বলে মেয়েটিকে নিজের দায়িত্বে নিতে চাইলাম৷ উনিও সায় দিলেন৷
এই উদ্দেশ্যেই পাড়ি জমানো৷ আমি প্লেনে বসে স্বপ্ন বুনলাম আমি আর আমার মেয়ে খুব ভালো থাকবো৷ এই নীরা জীবনে যা পায় নি সে সব কিছু তার মেয়েকে দিবে৷ এই প্রতিজ্ঞা করলাম৷

সমাপ্ত