বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব-১২

0
2047

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ১২
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

শ্রাবণের মেঘগুলো কয়েকদিনের বর্ষণে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছে। পুরো আকাশেজুড়ে আজ রোদকন্যার বিচরণ। পর্দার আড়াল থেকে রোদের আলো এসে পড়তেই কুচকে গেলো আমার চোখ। হাত আওড়ে বালিশের পাশ থেকে ফোন চালু করতেই নিমিষেই ঘুম কেটে গেলো আমার! সকাল ৯.৩০ টা বাজে। কাল রাতে বিদায়ের পর বেশ তাড়াতাড়িই ঘুমিয়েছিলাম। সারাদিনের ধকলে বিছানায় গা এলিয়েই রাজ্যের ঘুম চোখ এসেছিলো। ফোন রেখে আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে নামলাম আমি। ফ্রেশ হয়ে আস্তেধীরে নিজের রুম থেকে বের হলাম।

বাহিরে এসে দেখলাম আন্টি ডাইনিং টেবিলে খাবার রাখছিলেন। তাকে এসময় খাবার রাখতে দেখে অবাক হয়ে গেলাম আমি। কেউ কি খায়নি এখনও? সবাই কি আমার মতোই দেরি করে উঠেছে আজ? ভাবতে ভাবতে এগিয়ে গেলাম ডাইনিং এর দিকে। আমাকে আসতে দেখে আন্টি বললেন,

—আরে তুরফা, তুই উঠে গেছিস মা? আমি তোকেই ডাকতে যাচ্ছিলাম এখনি।

—তোমরা কেউ এখনও খাওনি, আন্টি? সবাই কি আজকে লেট করে উঠেছে আমার মতো?

—না রে। সবাই আগেই উঠেছে। খাওয়া-দাওয়াও শেষ। তুই বাকি আছিস এখন। আমি ইচ্ছা করেই ডাকিনি তোকে। তোর জন্য নাস্তা রেখেই ডাকতে যাচ্ছিলাম আমি তোকে। আয় এখন খেতে বস। অনেক লেট হয়ে গেছে।

মাথা নেড়ে চুপচাপ খেতে বসলাম আমি। খাওয়ার মাঝখানে আন্টির থেকে জানলাম আংকেল আর রায়হান ভাইয়া কোন একটা কাজে বাহিরে গেছেন। তারা রাতে বাসায় আসবেন। দাদি বাজার করতে গেছেন, কালকে রাইসার শশুরবাড়ির লোকজনকে বিয়ের পর প্রথম দাওয়াত দেওয়া হবে এ বাসা থেকে। এজন্য দাদি নিজ হাতে বাজার করতে গেছেন সব। খেতে খেতে এসব শুনছিলাম ঠিক তখনি আন্টি বলে উঠলেন,

—একটু পর রাইসার শশুড়বাড়ি যাবো আমি। সাথে কিন্তু তোকেও যেতে হবে।

রাইসার শশুড়বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে আমার গলায় খাবার আটকে গেলো। আন্টি আমাকে পানি এগিয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,

—আস্তে খা। এখনি যেতে বলছি না তোকে। ধীরে সুস্থে খেয়েই যাবি। চিন্তা করিস না।
আন্টির কথা শুনে আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। না জানি কি ভাবলেন উনি। ছিঃ!!

—আন্টি আমি যাবোনা প্লিজ। তুমিই যাও। আমার ওখানে গিয়ে কোন কাজ নেই আর আমার ভালোও লাগছেনা। আমি আমার রুমেই থাকতে চাই।

ইতস্ততভাবে অন্যদিক তাকিয়ে বললাম আমি। আমার কথা শুনে আন্টি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

—দেখ মা, আমি জানি কালকের ঘটনার জন্য মনে অনেক কস্ট পেয়েছিস তুই। এজন্যই একা থাকতে চাচ্ছিস। জানি এটা স্বাভাবিক কিন্তু বিশ্বাস কর আমরা কেউ তোকে অবিশ্বাস করিনি। রায়হানের কথা শুনেই আমি বুঝেছি এটা একটা দূর্ঘটনা ছিলো মাত্র, কারণ তোকে ছোট থেকেই চোখের সামনে মানুষ হতে দেখেছি আমি। তুই কখনোই এমনটা করতে পারিস না। আর তুই তো জানিসই আমার শাশুড়ি কিরকম, উনি মানুষের কথায় তোকে ভালোমন্দ বললেও আমরা কেউ তার কথা গায়ে মাখিনি কারণ সবাই জানে উনার স্বভাবটাই এইরকম। তাই এটা নিয়ে আর মন খারাপ করিস না প্লিজ। বিশ্বাস কর তোকে এভাবে দেখতে আমার একটুও ভালো লাগছেনা।

আন্টির কথা শুনে আমি তার দিকে তাকালাম। তার কথার সত্যতা তার চোখের দিকে তাকালেই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। অবিশ্বাস করার কোন উপায় নেই। মনে হয় যেন এখনি কেদে দিবেন। তাই হালকা হেসে উনাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,

—খারাপ আমার অবশ্যই লেগেছে আন্টি কিন্তু আমি মানুষের উপর রাগ করলেও তোমাদের উপর করতে পারবোনা। আমি বিশ্বাদ করলাম তোমরা আমার পক্ষেই ছিলে।

আমার কথায় আন্টির মুখে হাসি ফুটলো। পরম মমতায় মাথা বুলিয়ে দিলেন উনি আমার। তারপর রাইসার শশুড়বাড়ি যাওয়ার জন্য জোর করতে লাগলেন। মেয়ের শশুড়বাড়ি একা একা যেতে উনার ভালো লাগবেনা, দাওয়াতটা নিজ মুখে দিতে চান বলেই তার যাওয়া নয়তো উনারও যাওয়ার ইচ্ছা ছিলোনা শুনলাম। বড়মানুষ এতক্ষণ ধরে সামান্য একটা বিষয়ে অনুরোধ করছেন দেখে সেটা আর ফেলতে পারলাম না আমি। অবশেষে রাজি হলাম তার সাথে প্রান্ত ভাইয়াদের বাসায় যেতে।

__________

চৌধুরী ভিলা। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি আন্টির সাথে। দাড়োয়ান আমাদের দেখে সালাম দিয়ে হাসিমুখে খুলে দিলেন গেইট। আস্তেধীরেই আন্টির সাথে ভেতরে প্রবেশ করলাম আমি। ভেতরে ঢুকে গ্যারেজ পার হয়ে সামনে এগোতেই এক পাশে ছোট্ট একটা বাগান দেখলাম। রং-বেরঙের সুন্দর সুন্দর ফুল ও মানিপ্ল্যান্ট গাছ লাগানো। পাশে একটি বেঞ্চের মতো আছে বসার জন্য। হয়তো বাগানে এলে এখানে বসে গল্প করে সবাই, ভাবলাম আমি। বাগান পেরিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতেই তাদের ডু-প্লেক্স বাড়িতে ঢুকলাম আমরা। সিড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে চারদিক দেখছিলাম। পুরো বাসাতেই রুচিশীলতার ছাপ স্পষ্ট। বেশ ভালো পরিবারেই বিয়ে হয়েছে রাইসার, খুশিমনে ভাবলাম আমি।

আন্টি কলিংবেল চাপতেই আমাদের জন্য গেইট খুলে দিলেন প্রান্ত ভাইয়ার মা। হাসিমুখে আমাদের ভেতরে আসার আমন্ত্রণ জানালেন উনি। আমরাও সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ড্রয়িংরুমে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসতে বললেন আমাদের। সাথে তিনিও বসলেন। কিছুক্ষণ গল্প-গুজব করতেই রাইসা এলো আমাদের কাছে। মেরুন রঙের শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে ওকে পুরো নতুন বউ নতুন বউ লাগছে। লাজুক হেসে আমাদের সাথে বসলো ও। আন্টির থেকে শুনলাম আংকেল অফিসে গেছেন, তাহলে অবশ্যই পূর্ণ ভাইয়াও গেছেন মনে মনে ভাবলাম আমি।

প্রান্ত ভাইয়াও এলেন একটু পরে। সালাম দিলেন আন্টিকে। কিছুক্ষণ সবার সাথে কথা-বার্তা বলে কালকে বাসায় দাওয়াত দিয়ে আন্টি চলে যেতে চাইলেন কিন্তু প্রান্ত ভাইয়ার মা কিছুতেই যেতে দিবেন না আমাদের। তার কথা, বেয়াইনরা প্রথমদিন বিয়ের পর বাড়ি এসেছে না খেয়ে তিনি যেতে দিতে পারবেন না। অবশেষে তার জেদের কাছে হেরে রাজি হলেন আন্টি, থাকতে হলো আমাকেও।

আন্টিরা গল্প করছিলেন নিজেদের মধ্যে, প্রান্ত ভাইয়াও রুমে চলে গেলেন তখন রাইসা আমাকে বললো ওর শশুড়বাড়ি ঘুরে দেখাবে। বসে বসে এমনিতেও বোর হচ্ছিলাম তাই ওর কথায় রাজি হলাম আমি। যদিও রাইসা নিজেও ঠিকমতো চেনেনা কারণ ও মাত্র নতুন বউ তাও দুইজন মিলে ঘুরে ঘুরেই দেখছিলাম সব। ডু-প্লেক্স এর সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে ঘুরছিলাম আমরা। তখনি প্রান্ত ভাইয়ার কল এলো রাইসার ফোনে, ভাইয়া ওকে নিচে ওদের রুমে ডাকছে। কোন একটা কাজ আছে তার। রাইসা আমাকে উপরে ঘুরতে বলে বললো ও দুই মিনিটেই আসবে। আমিও চুপচাপ মাথা নাড়লাম।

রাইসা চলে যাওয়ার পর একাই দোতলায় ঘুরতে লাগলাম আমি। দেয়ালে বিভিন্ন পেইন্টিং, দেয়ালের পাশে ফুলদানি দেখতে দেখতে হেটে যাচ্ছিলাম। কোণার একটা রুমের সামনে দিয়ে যেতেই রুম খোলার আওয়াজে ভড়কে গেলাম আমি। সবাই তো নিচে, তাহলে এখানে কে? আমার ভাবনা-চিন্তার মধ্যেই হঠাৎ রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন পূর্ণ ভাইয়া। উনাকে এই মুহুর্তে এখানে আশা করিনি আমি তাই চমকে উঠে বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে। উনাকে দেখে মনে হলো যেন সদ্য ঘুম থেকে উঠেছেন! তার মানে অফিস যান নি উনি আজকে!

গাঢ় ধূসর রং এর গেঞ্জির সাথে কালো ট্রাউজার পড়নে উনার, সাথে ফোলা ফোলা চোখ। দেখে মনে হলো এখনও যেন ঘুমের রেশটুকু ঠিকমতো কাটেনি তার। আমাকে তার সামনে দেখে কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকে ঘুমু ঘুমু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন উনি। তারপর আবার স্বাভাবিকভাবেই আমাকে ইগ্নোর করে অন্যদিকে চলে গেলেন। উনার চলে যাওয়ার দিকে বোকার মতো গোলগোল চোখে তাকিয়ে থাকলাম আমি! আজব তো! জলজ্যান্ত একটা মানুষ প্রথমবার তার বাসায় এসেছে, মানুষ তো মুখের কথাও কিছু একটা বলে নাকি?? আমাকে নিজের সামনে দেখেও এরকম করে চলে গেলো কেন উনি?
গাল ফুলিয়ে ভাবতে থাকলাম আমি।

আমার ভাবনার মধ্যেই রাইসা চলে এলো। পূর্ণ ভাইয়াকে যেতে দেখে বললো এদিকে মনে হয় উনার রুম। আমি কিছু না বলে মাথা নাড়লাম শুধু। আরও কিছুক্ষণ উপরে ঘুরে নিচে নেমে গেলাম আমরা দুজন। নিচে নেমে ড্রয়িংরুমে আসতেই সবাইকে বসা দেখলাম। পূর্ণ ভাইয়াও বসে ছিলেন ওখানে। আমাকে দেখে এমনভাবে চোখ বড় করে তাকিয়ে আছেন যেন এইমাত্র বাসায় দেখলেন আমাকে! এই লোকটার কোন রিয়েকশনের আগা-মাথা সত্যিই কিছু বুঝিনা আমি!!

উনার তাকিয়ে থাকা দেখে আমার অদ্ভুত লাগছিলো তাই আমি পানি খাওয়ার বাহানায় উঠে এলাম ড্রয়িংরুম থেকে। একগ্লাস পানি খেতেই আমার পিছনে এসে দাড়ালেন পূর্ণ ভাইয়া। তাকে হঠাৎ এভাবে নিজের পেছনে দেখে গলায় পানি আটকে গেলো আমার। আজকে বুঝি গলায় খাবার আটকানোর দিবস আমার! সকাল থেকে তাই হচ্ছে!! কোনরকম কাশতেই উনি অবাক চোখ মাথায় হাত দিয়ে থামানোর চেস্টা করলেন আমায়। আড়চোখে উনাকে পর্যবেক্ষণ করলাম আমি। আমি স্বাভাবিক হতেই দূরে সরে গেলেন তিনি। তারপর বরাবরের মতোই গম্ভীর আওয়াজে বললেন,

—একটু আগে কি তুমি দোতলায় গিয়েছিলে?

উনার প্রশ্ন শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। বলে কি লোকটা? আমি যাবো না তো কি আমার ভুত যাবে? বিরক্ত হয়ে উনাকে বললাম,

—তো আপনার কি মনে হয় আপনি আমাকে স্বপ্নে দেখেছিলেন তখন? (চোখ পাকিয়ে)

তবে আমার কথায় উনার ভাবমূর্তির তেমন পরিবর্তন হলোনা। শুধু এক ভ্রু তুলে তাকিয়ে থাকলেন একদৃষ্টিতে আমার দিকে। এরপর বরাবরের মতোই কিছু না বলে হনহন করে হেটে গেলেন দোতলায়। আমিও উনার আচরণকে আর পাত্তা না দিয়ে চলে এলাম ড্রয়িংরুমে। এতদিনে উনার এসব অদ্ভুত ব্যবহারের অভ্যাস হয়ে গেছে আমার, তাই এখন আর বেশি অবাকও হইনা!

_________

প্রান্ত ভাইয়ার বাবা এসেছিলেন বাসায় দুপুরে। তারপর সকলে মিলে একসাথে দুপুরের খাবার খেয়ে উনাদের বাসার সবাইকে দাওয়াত দিয়ে আন্টির সাথে চলে আসছিলাম আমি। যাওয়ার আগ মুহুর্তে প্রান্ত ভাইয়ার বাবা আন্টিকে বললেন,

—কাল দাওয়াত হওয়ায় এক হিসেবে ভালোই হয়েছে, ভাবী। কালকে আমরা এমনিতেও একবার যেতে চেয়েছিলাম আপনাদের বাসায়।

—অবশ্যই আসবেন, ভাই। শুনে খুশি হলাম। তবে কোন কাজ ছিলো কি?
জিজ্ঞেস করলেন আন্টি।

—কাজ তো না তবে একটা কথা ছিলো যেটা না হয় কালকেই আলোচনা হবে।

আংকেল এর কথায় মাথা নেড়ে সায় দিলেন রাইসার মা। তারপর সেখান থেকে চলে এলাম আমরা। বাসায় যেতে যেতে ভাবতে লাগলাম আমি যে কি এমন আলোচনা করার জন্য কাল বাসায় আসতে চাইছিলেন তারা!

#চলবে