বৃষ্টির রাতে পর্ব-৩৩+৩৪

0
238

#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(৩৩)

“তোর কোন কথাই আমরা শুনছি না। বিয়ের জন্য পাগল হয়েছিস এবার নাচতে নাচতে বিয়ে করবি সংসার করবি। আজ থেকে কলেজে যাওয়া বন্ধ আর হ্যাঁ সন্ধ্যের আগেই তৈরি হয়ে থাকবি মেহমান আজানের পরপরই আসবে।”

কাটকাট গলায় কথাগুলো বলেই আয়নার মা ক্রোধান্বিত চেহারা নিয়ে প্রস্থান করলেন। মনে মনে ঠিক করে নিয়েছেন আজ সারাদিন আর মেয়ের সাথে কোন কথাই বলবেন না সন্ধ্যার আগে। একটা মেয়ে কি পরিমাণ নির্লজ্জ হলে আজ এমন দিনও দেখতে হয়! প্রথমে ভেবেছিলেন অল্পবয়সী আবেগ কতদিন আর চলবে একটা সময় হয়ত শান্ত হয়ে আসবে। তখন না হয় আবারও ভাই ভাবীকে ঠান্ডা মাথায় বলে দেখবেন তাসিনকে বোঝানোর কথা। বলতে নেই তাসিনের ফুপু মিনতি নিজেও মন থেকে চাচ্ছিলেন একমাত্র মেয়ের বিয়েটা ভাতিজার সাথেই হোক। এতে মেয়েটা চোখের সামনে থাকবে আর তার ভাবীও মেয়েটাকে যত্নেই রাখবে। কিন্তু মন্দ কপাল মেয়ে বুঝতে চাইলো না কিছু উল্টো নিজের মত পায়ে পা মাড়িয়ে ঝামেলা বাঁধালো তাসিনের সাথে। এতে সবটাই তাসার চালের মত বদলে গেল চাল। চাল বললেও ভুল হবে মিনতি কখনোই খারাপ ভাবনা নিয়ে কিছু ভাবেননি শুধু নিজের আপন মানুষের কাছে মেয়ে থাকলে ভালো হবে এটাই মনে করতেন। কিন্তু তাসিনকে নিয়ে আয়নার বাড়াবাড়িরকম নির্লজ্জতায় বাবা, মায়ের মা’থা কা’টার জো। আর এসবের মাঝেই এখন সম’স্যা সমাধানের পথ হলো যতদ্রুত সম্ভব আয়নাকে বিয়ে দেয়া। তাসিন নিজেই এক পাত্র পছন্দ করেছে। আয়নার বাবা আবদুল্লাহ্ পাত্রের নাম শুনে মুহূর্তেই চিনে নিয়েছেন৷ তাদের এলাকায় নতুন পুলিশ অফিসার মাত্রই মাস কয়েক আগে এসেছে। পাত্রের খোঁজ নিয়ে তবেই তাসিন কথাবার্তা বলেছে বাড়িতে। এতে অবশ্য রাগের মাথায় তাসিনকে দেওয়া মাস পেরিয়ে গেছে কবেই। কিন্তু সেটা মূলকথা নয়। জীবন কোন গল্প উপন্যাসের সাজানো প্লটও নয় তাই বাড়ির সবাই ভেবে চিন্তে এগোচ্ছে। এখন আবারও পরিস্থিতি ঘোলা করতে চাইছে আয়না। তার কারণেই তাসিনকে নিয়ে একটা তামাশা হতে হতে থেমেছে। সেসব ঘটনা এখনো পরিবারের ভেতরই আছে কিন্তু এসব বাড়াবাড়ি চলতে থাকলে পাঁচকান হতে সময় লাগবে না। এজন্যই আজ মিনতি মেয়েকে কড়া সুরেই শাসিয়েছেন যেন মেহমান এলে কোন নাটক না করে। আজ সেই পুলিশের বাড়ির লোকজন আসবে কয়েকজন মেয়ে দেখতে তারপর আবার মেয়েপক্ষও যাবে পাত্রের বাড়িঘর দেখতে। তাসিন ঢাকায় আছে তাকে আসতে বলা হয়েছিল। কিন্তু সে ছুটি না থাকায় আসছে না। মাছুমা অবশ্য ছেলের কাজে মনঃক্ষুণ্ন হয়ে নিশ্চুপ আছেন কিন্তু আয়নাদের বাড়ি আসবেন একটু পরই। সকল আয়োজন ননদের হাতে হাতে তিনিই করবেন।

সকাল থেকেই মনটা আনচান করছে একটা মেসেজের। কিন্তু কিছুতেই যেচে কল দেওয়া হবে না আজ। মানুষ কতোটা কঠিন হলে দুদিনেও একটা কল, মেসেজ না দিয়ে থাকতে পারে! তাসিনের ওপর ভীষণ রে’গে আছে সুপ্রভা। আজ দুদিন হলো লোকটা তাকে একটাবার কথা না বলে থাকতে পারছে অথচ সে কি যে ছটফট করছে। আজ তার পরীক্ষা নেই তাই সকাল থেকেই বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে আর বই নাড়াচাড়া করছে। আর মাত্র একটা পরীক্ষা বাকি তারপর একটা লম্বা সময় পাবে সে। ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষা অথচ তার আচরণ পরীক্ষা নিয়ে অনুভূতিশূন্য। তার সকল অনুভূতি গিয়ে জমে বরফ হয়ে আছে সেই শুভ্র রঙা শার্ট পরিহিত অগোছালো চুলের মানুষটার ওপর। থেমে থেমে শুধু চোখে ভাসে বৃষ্টির সেই রাত্রি। রাতের দ্বিপ্রহরে অচেনা লোকটার সেই উদ্ভট আচরণ তাকে সেদিন বিরক্ত করলেও এখন সেই রাতটাই বড় আদুরে এক স্মৃতির পসরা নিয়ে চোখের তারায় বসে থাকে। গত মাসের সেই ঘটনা যেদিন হোস্টেলের সামনে এসে অস্থির মুখ করে বলেছিলো, সুপ্রভা তুমি কি বিশটা মিনিট সময় দিতে পারবে এখন!” তখন না চাইতেও মনটা বলছিল বিশটা কেন আমি তো পুরো জীবনটাই আপনাকে দিতে পারি একবার চেয়েই দেখুন না!
আহা, কি ফিল্মি ইমোশন! ভাবতেই লজ্জা পেয়ে গেল সুপ্রভার। সে আজকাল একটু বেশিই উতলা হয়ে উঠছে অথচ ওই হামবড়া লোকটাও তার মত একই অনুভূতি নিজের ভেতর রেখেও অস্থির হচ্ছে না। হ্যাঁ সুপ্রভাও টের পেয়ে গেছে তাসিনের মনের হাল সেদিন যখন কথা বলতে এলো এহসানকে নিয়ে তখনই বারংবার উদাসী চোখে সুপ্রভার দিকে তাকাচ্ছিলো। মন কেমন করা দৃষ্টি সেদিন একটুও ভুল পড়েনি সুপ্রভা। সেদিনও বৃষ্টি শুরু হয়েছিলো এলোমেলো ভাবে। সুপ্রভার মন বলে ওপরওয়ালা যদি চান তবে তাসিন যেদিন তাকে মনের গোপন বিশেষ কিছু কথা জানাবে সেদিনও হবে এমন বর্ষণ। সেদিন তাসিন বলেছিলো, “আমার ফুপাতো বোন আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু আমার ধারণা এটা ভালোবাসা নয় অল্প বয়সী আবেগমাত্র। কৈশোর পার হতে হতেই এই আবেগ কাটিয়ে উঠবে সে।”

“এটাতো ভালো কথা তা এসব আমাকে কেন বলা হচ্ছে?”

তাসিনের প্রথম কথা শুনেই বুকের ভেতর মুচড়ে উঠেছিলো বিষাক্ত যন্ত্রণা। ধ্ক করে বুকটা আচমকাই নিস্পন্দন হয়ে থেমে গিয়েছিলো। বড়োই কষ্টে শ্বাসটাকে চেপে নিজের গম্ভীর স্বরটাকে বের করে বলেছিলো সুপ্রভা। সে যে গত এক সপ্তাহ কোন যোগাযোগ না করায় তাসিনের ওপর রেগে ছিল সেই রাগেও ভাটা পড়ল এ ক্ষণে। তাসিন একটুও বিচলিত না হয়ে ধীরে ধীরে সবটা বলে গেল আয়নাকে নিয়ে তৈরি হওয়া ঝামেলা। শুধু কিঞ্চিৎ লুকিয়ে গেল আজকাল তার মনে সুপ্রভাকে নিয়ে দানা বাঁধা অনুভূতিটাকে। সুপ্রভা সব শুনে বলেছিলো, “এহসান ভাইয়া খুবই ভালো ছেলে। আমার কাজিন বলে বলছি না। ভাইয়া কিন্তু যথেষ্ট সৎ মানুষ চরিত্রের দিক থেকে৷ আর আপনার বোনকে পছন্দ যদি করেই থাকে তবে বলতে হয় আপনার বোনের সৌভাগ্য।” সুপ্রভা বারবার ‘আপনার বোন’ কথাটা যেন নিজেকেই শুনিয়ে আশ্বাস দিচ্ছিলো তাসিনের মনে আয়না নেই। কি আজব! সে ঠিক সেই মুহূর্তেই যেন আয়নাকে জোর করেই এহসানের জীবনে ঢুকিয়ে দিতে চাচ্ছিলো৷ তারপর আরো অনেকটা সময় দুজন সেই রেস্টুরেন্টে বসেই আলাপ আলোচনা করলো। সুযোগ বুঝে এহসানকে ফোন করে সুপ্রভা ঠাট্টার ছলে বলে ফেলল সে আয়নার কথা জানে। কি করে জেনেছে তা জানাটা মূখ্য বিষয় না বলেই তাসিনের মাধ্যমে জানার কথাটা এড়িয়ে গেছে। এরপর আরো দু চারদিন কথাবার্তা বলে সুপ্রভা তার বড়দাকে ফোনে বলে দিল এহসান ভাইয়ের ঘটনা। দিনরাত চো’র- ডা’কাতদের জীবন ওষ্ঠাগত করা এহসান টের পেল বাড়িসুদ্ধ আত্মীয়স্বজনে তাকে নিয়ে আলোচনার ঝড় বইছে৷ তার মা উঠেপড়ে লেগেছেন তার পছন্দ করা মেয়েটাকে দেখতে। সে কিছুতেই বোঝাতে পারলো না মেয়েটা এখনো ছোট অন্তত বিয়ের জন্য উপযুক্ত নয়। মনে মনে সুপ্রভাকে একশোটা গালি দিয়ে দোয়া করলো অতি শিগ্রই যেন সুপ্রভাকে জোরজবরদস্তি বিয়ের পিড়িতে বসতে হয় তখন বুঝবে কেমন লাগে। সুপ্রভার মাধ্যমে এহসানের পরিবারে জানাজানি হলো আর ওদিকে রিমনের মাধ্যমে পরিচিত লোক লাগিয়ে এহসানের বাড়িসুদ্ধ গোষ্ঠীর খোঁজ নিলো তাসিন। আয়নাকে শুধু বিয়ে দিয়ে ঘাড় ফাঁকা করা নয় ফুপুর একমাত্র কন্যার সুন্দর ভবিষ্যতও চিন্তা করতে হবে। তার কোন প্রকার ভুল পদক্ষেপ আয়না জীবন নষ্ট করে সে বোঝা আজীবন বয়ে চলা সম্ভব নয়। তবে রিমনের তথ্য অনুযায়ী এহসান মাহমুদ আয়নার পেছনে দেওয়ানা হয়ে আছে অনেক আগে থেকেই৷ শুধু ব্যক্তিত্ব আর কর্তব্যের বিরোধী হয়ে রোমিওগিরি করতে পারছে না বেচারা। আর সুপ্রভা তো বলল এহসানের মা নাকি ছেলের পছন্দের কথা জানার পর থেকেই সুপ্রভাদের বাড়ি আসা যাওয়া করছেন খুব। উদ্দেশ্য সুপ্রভার মাকে নিয়ে যেকোন একদিন পাশের গ্রামে সেই মেয়ের বাড়ি যাওয়া। তাদের কোনপ্রকার ঝুঁকি নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হলো না। সুপ্রভার বড়দা সোহরাব মেয়ের পরিবারের খোঁজখবর নিয়ে বুঝেছেন তাদের পক্ষ থেকে ঘটক পাঠিয়ে কথা বললে হয়ত ভালো হবে৷ তাই পরিচিত এক ঘটক পাঠিয়েই মেয়ের বাড়িতে ছেলের বায়োডাটাসহ বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে৷ এই যে আজই যাবে সন্ধ্যার পর এহসানের মা, তার ফুপু মরিয়ম, তার বড় চাচী আর সুপ্রভার ভাবী মীরা। ঢাকায় বসে সব খোঁজই নিচ্ছে সুপ্রভা সেই সাথে পুলকিত মনে অপেক্ষা করছে তাসিনের ফোনের।

সূর্য অস্তমিত পশ্চিম আকাশে। কমলা রোদ এখন সিঁদুরে রঙ ধারণ করেছে। তাসিন অফিস থেকে বেরিয়েছে আরো আগেই। রুমে ফিরে ঘামে ভেজা শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে ফোনটা চেক করলো। নাহ কাঙ্খিত কোন ফোনকল নেই৷ ভেজা শার্ট হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে নিজেই ডায়াল করলো সুপ্রভার নম্বরে। এক হাতে চুলোগুলোকে নেড়েচেড়ে ভাবতে লাগবো কলটা কি প্রথমে ফুপিকে করা দরকার ছিলো! ভাবনার মাঝেই প্রথম কলটা কেটে গেল। আশ্চর্য আজ মেয়েটা কল ধরলো না! পুনরায় কল দিতে উদ্যত হতেই তাসিনের ফোনে কল এলো। ‘বড় মামী’ নামটা দেখেই ক্লান্তিমাখা মুখটা উজ্জ্বল হয়ে গেল তার। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে হাস্যজ্বল কণ্ঠস্বরে ভেসে এলো, “পথের কাঁটা সত্যিই দূর করতাছেন আব্বা?”

উজ্জ্বল মুখে এবার চওড়া হাসি জায়গা করে নিলো। আসল ঘটনা তো একমাত্র তাসিন আর মামীই জানে।

চলবে

#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(৩৪)

মফস্বলের সন্ধ্যায় গাছপালার আড়ালে ঝিঁঝির ডাক শোনা গেলেও অন্ধকার ছাপিয়ে শেয়ালের ডাক পাওয়ার অবস্থা নেই। অন্তত তাসিনদের এলাকায় শেয়ালের বাস নেই বললেই চলে। তবে একটু ভেতরের দিকের গ্রামে গেলে সেখানে প্রায় সকল বাঁশঝাড় আর কবরস্থানের আশপাশ জুড়ে জঙ্গলের দিকে থাকে শেয়ালগুলো। তাসিনের বড় মামী বহুবছর আগে তাসিনদের বাড়ি এসে শেয়াল পেটাতে দেখেছিলো। তখন ছিল বর্ষাকাল আর তাই দূরের কোন এলাকারই দু তিনটে শেয়াল এ এলাকায় ঢুকে পড়েছিল। গ্রামবাসী সেগুলোকেই পিটিয়ে আধমরা করেছে আর তাসিনের মামী বেচারি সেদিন তা দেখেই আজো ভয়ে এ এলাকায় পা রাখতে চান না। আসেন তো নিজেদের গাড়িতে করে একদম তাসিনদের গেইটের ভেতর পেরিয়ে গাড়ি থেকে বের হন। আজ দূর্ভাগ্য গাড়িটা এই ভর সন্ধ্যায় এলাকার মাঝপথে হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তার একপাশ জুড়ে ধানের ক্ষেত অন্যপাশে গজারি, কড়াই আর কাঠ গাছের একটা বাগান। এদিকটায় ঘরবাড়ি আর নেই তবে আর পাঁচ মিনিটের দূরত্বেই বাড়িঘর দৃশ্যমান। তবুও ভদ্রমহিলা আতঙ্কে চোখমুখ কুঁচকে আছেন। তাসিনের মামী সকালে রওনা দিয়েছিলেন আরো আগেই পৌঁছে যাবার কথা থাকলেও আজ রাস্তায় আরো একবার গাড়ি নষ্ট হয়েছিল। ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ আসেনি সাথে সেজন্যই যেন ভয়টা আরো বেশি লাগছে। মিনিট দশেক চেক করেও ড্রাইভার ঠিক করতে পারলো না। এদিকে সন্ধ্যা ঘন হয়ে আঁধারে ঢাকছে চারদিক। নষ্ট গাড়ির ভেতরে বসে থেকে আরো ভয় বাড়ছে যেন মামীর। তিনি ভয়ে ভয়েই গাড়ি থেকে নেমে দাড়ালেন গাড়ির গেইট বরাবর। ড্রাইভার এখনো কিসব পার্সটার্স চেক করে চলছে। নিজের হ্যান্ডপার্স থেকে ফোন বের করলেন তুহিনকে কল করতে। এই নির্জন রাস্তায় আর এক মুহূর্তও থাকার ইচ্ছে নেই তার। হঠাৎ করেই একটা বাইক সাঁই করে চলে গেল পাশ দিয়ে। মিনিট খানেক সময়ে আবার ফিরে এসেছে বাইকটা। তাতে দুজন লোক আর দুজনের গায়েই পুলিশ ইউনিফর্ম। তারা সামনে এসে দাঁড়াতেই যেন একটু স্বস্তি পেলেন মামী। ফোনের ডায়ালপ্যাডে তখন মাছুমার নাম্বার তুলে কল দিতে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে গাড়ির?”

ড্রাইভার সমস্যা বলতেই অফিসার এহসান বললেন, “আপনি কোথায় যাবেন বলুন আমি পৌঁছে দিচ্ছি।”

আফছার মীরের বাড়ি যাবে বলতেই অফিসার এহসান সতর্ক হলো। আফছার মীর মানে তুহিনের বাবা। মানে তার আয়নাবতীর মামা! যতোই হোক আয়নাদের আত্মীয় মানেই একটু অন্যরকম ব্যপার। এহসান এবার নিজেই বলল, “আপনি কি বাইকে উঠতে পারবেন?”

ভদ্রমহিলা এ জীবনে কোনদিন বাইকে উঠেনি। আজও উঠার ইচ্ছে নেই আর অচেনা এই ছেলের সাথে তো নয়ই! এহসান বোধহয় অন্ধকারেও মহিলার মনোভাব আচ করতে পারলো। গলা খাকাড়ি দিয়ে বলল, “আন্টি একটু সামনেই তুহিনদের বাড়ি চাইলে হেটেও যাওয়া যায়।”

মামী এবার একটু বিষ্মিত হলেন পুলিশের গলায় অন্যরকম আন্তরিকতা দেখে। পরমুহূর্তেই মনে পড়লো তাসিনের বলা কথা ‘এহসান পুলিশ!’

ভাগ্যিস নামটা মনে ছিলো তাই তিনি সরাসরি প্রশ্ন করলেন, “আপনার নামটা যদি বলতেন!”

“এহসান মাহমুদ”

এবার আর সন্দেহ নেই একটুও। তার মানে মূল ঘটনা তো এর মাধ্যমেই হবে। ভালো হলো ছেলেটাকেই পাওয়া গেল। সায় জানিয়ে এহসানের সাথেই তাসিনদের বাড়ির পথে রওনা হলেন তাসিনের মামী। ড্রাইভারকে সাহায্য করতে দ্বিতীয় পুলিশটি রয়ে গেলেন।

“ওদিকের খবর কি?”

“ঠিকঠাকই আছে এখনো। তোমার মা আর মামী পৌঁছে গেছেন আয়নাদের বাড়ি।

‘আয়না!’

নামটা শুনলেই কেমন যেন কলি’জাটা ধরাস করে ওঠে সুপ্রভার। বারবার মনে হয় মেয়েটা তাসিনকে ভালোবাসে। তাসিনের জন্য বেহিসেবী পাগলামি করে বেড়ায়। ক’দিন আগে তাসিনের মুখেই শুনেছে আয়নার পুরনো কীর্তি যা তাসিনকে ভালোবেসে করতো। মেয়েটা এত এত ভালোবাসে তাসিনকে সে কি একটুও আকৃষ্ট হয় না মেয়েটার প্রতি! আবার মনে হয় আকৃষ্ট হলে এত চোটপাট করে পাত্র খুঁজতো না নিশ্চয়ই! আবার মনে হয় যদি এহসান ভাইয়ার খোঁজ না পেতেন তখন কি করতেন! নিজেই বাধ্য হয়ে বিয়ে করতেন? সুপ্রভার সত্যিই আজকাল কষ্ট হয় খুব। মন বারবার উতলা হয় লোকটার জন্য অথচ লোকটা একটিবারও মুখ খোলেননি। একবারও বলেননি, সুপ্রভা আমার তোমাকে ভালো লাগে, আমি তোমায় নিয়ে কিছু অনুভব করি। কখনোই কিছু বলেন না অথচ লোকটার দৃষ্টি কত কি যে বলে যায় চুপিসারে!

তাসিন অপেক্ষা করে আছে সুপ্রভা কি বলে তা শোনার জন্য । কিন্তু সে তো অন্যমনস্ক হয়ে অন্য কিছু ভাবছে। তাসিন এবার প্রশ্ন করলো, ” কি হলো?”

সুপ্রভা বুঝতে পারলো না তাসিনের কথা, “কি হবে!”

“ওই তো যা হওয়ার ছিল।”

“কি হওয়ার ছিলো!”

“ছেলে, মেয়ে অবশ্যই না। তবে কিছু একটা হওয়ার ছিলো মনে হলো।”

শান্ত দিঘির জলের মত শীতল স্বরে বলল তাসিন। সুপ্রভা আবারও চমকালো আর এখনই বুঝতে পারলো শীতল স্বরে তাসিন মজা করছে তার সাথে। সে এবার নিঃশব্দে হাসলো। তাসিন আবার প্রশ্ন করলো, “পরীক্ষা শেষ হলে বাড়ি চলে যাবে?”

“এখানে থেকে কি করবো? আমার সব বন্ধু-বান্ধব ছুটি কাটাবে বিভিন্নভাবে যে কয়টা দিন সুযোগ আছে।”

“তা কবে যাচ্ছো বাড়ি?”

“এ সপ্তাহটা এখানেই আছি।”

“আচ্ছা! ”

আচ্ছা বলেই তাসিন চুপ হয়ে গেল। আপাতত তার বাড়ি যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। তবে সুপ্রভা চলে গেলে সে খুব মিস করবে তাকে। এই যে এখন হুটহাট কোন এক বাহানায় দেখা করে, প্রয়োজন ছাড়াও কত কি কেনার নামে দু, এক ঘন্টা একসাথে কাটায় এই জিনিসটাই মিসিং হয়ে যাবে। দুজনে থেমে থেমে এমন আরো ঘন্টা খানিক কলেই থেকে গেল। এরপরই তাসিনের ফোনে মায়ের কল আসছে দেখে বিদায় নিতে হলো সুপ্রভার কাছে। আজই সুপ্রভার ফেসবুক একাউন্টে এড হয়েছে তাসিন৷ তারপর ম্যাসেন্জারে কল করেছিল। এখন ফোন রাখলেও মনে মনে ভাবলো যখন তখন দেখার একটা সুযোগ হয়ে গেল এবার।

মাছুমা ফোন করেছেন ছেলেকে একটা কথা বলতে। পাত্রপক্ষ নাকি আয়নাকে দেখেই বায়না করছে তারা আংটি পরিয়ে যাবে আজ। অথচ মেয়েপক্ষ তো এখনো ছেলের বাড়িই দেখলো না। তাসিন শুনে বলল, “ফুপু আর ফুপা যা ভালো মনে করেন তা করতে বলো। যদি ঠিক লাগে তো করুক আর না হয় সময় নিয়ে পাত্রের সমন্ধে আরেকটু যাচাই করে বাড়িঘর স্বচক্ষে দেখে তবেই এগিয়ে যাক। তাড়াহুড়ো না করাই ভালো।”

মুখে কথাটা বললেও মনে মনে ভয় ঢুকলো এহসান ছেলেটা ভালো হবে তো আয়নার জন্য! লোকমুখে শোনা প্রশংসাই তো সব নয়। আয়না মানসিক ভাবে এহসানকে মানতে প্রস্তুত নয় এ কথা তো একটা বাচ্চাও বুঝবে। তবুও ভরসা রাখছে আল্লাহর ওপর আর রিমনদের ওপর। তারা কখনো মিথ্যে খোঁজ নেবে না। রিমন, মুরাদও আয়না আর মাইশাকে আপন বোনের মতোই স্নেহ করে। মায়ের ফোন কাটলেও মনে মনে চিন্তা জমলো এখন অপেক্ষা মামীর ফোন কলের।

মাছুমার বড় ভাবী আজ এসেছেন অনেকগুলো বছর পর। খুশিতে সে কি করবে, কি রাঁধবে এই নিয়ে বেশ উত্তেজিত হচ্ছিলো তা দেখে তার ভাবী থামিয়ে বললেন, ” তুই তো এসে দেখলাম বাড়ি নেই। তোকে কে বলল আমি এসেছি?”

“হ্যাঁ ভাবী আমি আমার ননদের বাড়ি ছিলাম। আজ আমাদের আয়নাকে দেখতে সমন্ধ এসেছে।”

“ওহ তাহলে তুই চলে এলি কেন আমি তো থাকবোই কদিন। হ্যাঁ রে মিনতির মেয়েটা বড় হয়ে গেছে তাই না একেবারে বিয়ের যোগ্য!”

মাছুমা হাসলেন, “হ্যাঁ ভাবী বড়ই মোটামুটি। এইতো কয়েক মাস পরে ইন্টার ফাইনাল পরীক্ষা দেবে। এদিকে তো এই বয়সেই বিয়ে দেয় মেয়েদের।”

“আচ্ছা তুই ও বাড়ি যা মিনতির সাথে থাক। এক কাজ করি চল আমিও যাই তোর সাথে।” মনে মনে অবশ্য আগেই ছক এঁকেছিলেন এসেই ও বাড়ি যাবে নইলে বিয়ে আগাবে কি করে! আরো আগেই আসতেন কিন্তু ব’দ মার্কা গাড়িটাই দেরি করিয়ে দিলো পথে।

মাছুমা আর তার ভাবী একসাথে বের হলেন আয়নাদের বাড়ি যাবেন বলে। মাইশা ঘরেই বসে আছে বই নিয়ে। তারও খুব মন চাচ্ছে মা আর মামীর সাথে ও বাড়ি যেতে কিন্তু মা সারাদিনেও ওদিকে যেতে দেননি৷ এখনও মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার। আয়না আপু আজ সাজবে, শাড়ি পরবে আবার হবু দুলাভাই আসবে৷ সে দেখেছে ওই পুলিশটাকে। তার ধারণা ছিলো পুলিশ মানেই পেট মোটা, মাথায় টাক আর লম্বা গোঁফ থাকবে। কিন্তু এই লোকটা একদমই তেমন নয়। খুব লম্বা আর ফিটনেসও সুন্দর। লোকটাকে দুলাভাই ডাকতে তার একটুও খারাপ লাগবে না। এই তো সেদিন তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাচ্ছিলো। হুট করেই জিজ্ঞেস করলো ‘কোন ক্লাস!’

মাইশার বান্ধবী বলেছে, “ক্লাস টেন।”

“তো এই সময় স্কুলের বাইরে কেন আপনারা!” ভয়ে ভয়ে মাইশা বলেছিল, খুব গরম তো তাই কোক খেতে…”

“এখন নিশ্চয়ই হাফ পিরিয়ড কিংবা ছুটির সময় নয়! এভাবে সময়ের আগে স্কুলের গেইটের বাইরে আসবেন না কখনো।”

তারপরই লোকটা নিজে তাদের সবাইকে আইসক্রিম খাইয়েছিলো। আহা! এটা দুলাভাই হলে মাইশা তার বান্ধবীদের কাছে কত কি বলবে।

সবুজ রঙের একটা কাতান শাড়ি পরা আয়না ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে ফোনের দিকে। ভিডিও কলে আছে তাসিন প্রায় পনেরো মিনিট ধরে। তার এক কথা, “তাসিন ভাই মনে রেখো তুমি ছাড়া অন্য কারো সাথে আমার বিয়ে হলে আমি বিয়ের রা’তেই বি’ষ খাবো।”

অনেকটা সময় পর্যন্ত তাসিন তাকে বুঝিয়েও কিছুই বোঝাতে পারলো না। অবশেষে বাধ্য হয়েই বলল, “আমি একজনকে ভালোবাসি খুব খুব খুউব ভালোবাসি।”

বাইরে বৃষ্টি নেই তবুও শো শো বাতাস বইছিলো। এই মুহুর্তে হঠাৎই যেন সে বাতাস বন্ধ হয়ে ঘরটা অক্সিজেনহীন হয়ে গেল। আর কোন টু শব্দ না করে কল কেটে দিলো আয়না। একটু আগেই তাসিন ভাইয়ের মামী তাকে শাড়ি পরিয়ে তার হাতে, গলায় কিছু গহনা পরিয়ে দিয়েছিল। ধীরে ধীরে সব গহনা খুলে শাড়িটাও খুলে ফেলল আয়না। মাথার ওপর চলতে থাকা ফ্যানটা বন্ধ করে অপলক তাকিয়ে রইলো সেটার দিকে। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা তপ্ত নোনাজল।

চলবে