#বৃষ্টিস্নাত_তুমি – (১৯)
হুযাইফা মাইশা
সকাল সকাল আরেক কান্ড বাঁধলো। সেই ফুপিমণি এসেছেন! ভদ্রমহিলার নাম রোকেয়া। ফর্সা, সুন্দর হলেও মুখশ্রীতে রাগের আভাস যেন সর্বদা লেপ্টেই থাকে। সেই রাগের আভাসটা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয় চোখের কালো মোটা ফ্রেমের চশমাটা।
বয়সে উনি ইয়াসিন সাহেবদের বড়। আগে বড় একটা বাড়িতে সবাই থাকতেন। সব চাচাতো বোনদের বিয়ে হলো, ভাইরা সকলে আলাদা বাড়ি বানাল। কিন্তু ভালোবাসা কমলোনা। আপন ভাই নেই বিধায় রোকেয়া এই তিনভাইকে আপন ভাইয়ের চোখে দেখতেন। এখানে আসার মূল কারণ ইয়াসিন সাহেবের অসুস্থতা। সাথে নতুন বউকে দেখাও।
বিয়েতে ঘটা করে বাড়ি সাজানো হলেও দাওয়াত দেয়া হয়নি কাউকে। আর উনিও ব্যস্ত ছিলেন তাই আসতে পারেননি। নতুন বউ এসেছে, এই খবর তিনি পেয়েছেন কাজলের থেকে। কাজল গতকাল সকালে জোর করে ফোন দিয়ে বলেছেন আসার জন্য। রোকেয়া আসতে চাননি কিন্তু বিকেলের দিকে আবার কাজল ফোন দিয়ে জোর করে বলেছেন,
‘ আপা, আপনার ভাই অসুস্থ। নতুন বউ ও আসবে। আপনি দয়া করে আসুন। অনেক দিন দেখিনা।’
বলাবাহুল্য এই ভাইদের তিন বউকেই তিনি অসম্ভব স্নেহ করেন, যদিও ক’ড়া ভাবটা বজায় রেখেই।
বাড়িতে ঢুকে সর্বপ্রথম পুরো বাড়িতে নজর বুলালেন উনি। সঙ্গে এসেছে উনার ছোট্ট নাতনি। ছেলে উনাদের দিয়েই চলে গিয়েছে। কাজ আছে কিনা! ছোট্ট মেয়েটা বাড়ির বাইরে ঘুরঘুর করতে ব্যস্ত হলো। কৌতুহল বেশি তার।
কাজল, সায়মা আর শায়লা হরেক পদের নাশতা আনলেন তড়িঘড়ি করে। সেসব মুখে তুললেন না রোকেয়া। বললেন,
‘ ঠান্ডা একগ্লাস পানি আইনা দাও। একদম ঠান্ডা না, গরমও না।’
শায়লা মাথা নাড়িয়ে পা বাড়ালেন।
চারদিকে চোখ বুলিয়ে রোকেয়া আবার বললেন,
‘ নতুন বউ কই? আনো তারে। দেখিনাই তো।’
‘ ডাকতেছি আপা।’
তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠলেন কাজল। পূর্ণতা ইশরাতের রুমে ছিল। ফুপিমণি আসার কথা শুনে সে বের হচ্ছিল মাত্রই। দরজার পাশটায় আসতেই তাকে দেখলেন কাজল। এগিয়ে গিয়ে বললেন,
‘ চলো, তোমার এক ফুপিমণি এসেছেন।’
বলতে বলতে নীল রঙের ফিনফিনে ওড়নাটা ঘোমটার ন্যায় নিজেই মাথায় তুলে দিলেন পূর্ণতার। পূর্ণতা মাথা খানিকটা নিচু করল। তাকে নিয়ে যেতে যেতে কাজল বললেন,
‘ উনি একটু রাগী। কিন্তু মনের দিক দিয়ে নরম। এত বছরেও উনি আমাদের কখনো কটু কথা বলেননি। শা’স’ন করেছেন ঠিকই। ভয় পাবানা কিন্তু।’
‘ ঠিকাছে মা।’ ছোট্ট জবাব পূর্ণতার।
নিচে আসতেই জড়সড় হয়ে গেল পূর্ণতা। টিপে টিপে পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে সালাম দিল। রোকেয়া সালামের জবাব দিলেন। পূর্ণতা ফের জিজ্ঞেস করল,
‘ কেমন আছেন ফুপিমণি?’
‘ ভালো আছি। তা তোমার নাম কি?’
‘ পূর্ণতা।’
‘ পূ-র্ণ-তা। সুন্দর কিন্তু কঠিন কঠিন লাগে। যাইহোক, বউ, বসো দেখি পাশে।’
সরে গিয়ে বসার জায়গা দিলেন উনি। পূর্ণতা গুটিগুটি পায়ে হেঁটে পাশে গিয়ে বসল। বাইরে শান্ত অথচ অস্থিরতা মনে মনে বিরাজমান। রোকেয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করছেন। নীল রঙের ওড়নাটা পাতলা। মুখের একাংশ একপাশ থেকে দেখা যাচ্ছে। গোলগাল মুখশ্রীতে সরু নাক, বড় বড় চোখ, আর ফোলা গালের মেয়েটাকে খারাপ লাগেনা। তবে, মেয়েটার চুলগুলো আগেকার মেয়েদের মতো লম্বা নয়। পিঠ অব্দি কালো, লতানো চুল। সেগুলো আটকানো ছোট্ট একটা হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে। গভীর পর্যবেক্ষণ শেষে রোকেয়া বলে উঠলেন,
‘ চুল কাঁ-টো?’
‘ অনেক আগে কেঁ’টেছিলাম।’ থতমত জবাব।
‘ মাইয়া মানুষরে লম্বা চুলে শোভা পায়।’
কথাটা বলে উনি কাজলের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত হলেন। ঠান্ডা পানি পান করেছেন সেই কবে। টি টেবিলের উপর রাখা হরেকরকমের নাশতা। সেগুলো খেলেন না উনি। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল ইশরাত। পড়া শেষ করেছে সবে। ফুপিমণি আসছেন দেখে সে স্কুলে যায়নি। এসেই ধপ করে রোকেয়ার অন্যপাশটায় বসলো সে। সায়মা ধ’মকে বললেন,
‘ আসতে বোস।’
রোকেয়া থামিয়ে দিলেন,
‘ ধ’ম’কে ধা’মকে এটারে ঠিক করা যাইবোনা। বিয়া দেয়া লাগবো।’
‘ ইশ! তোমার শুধু বিয়ে বিয়ে!’
বিরক্তি ঝরে পড়ল কণ্ঠ হতে। ইশরাতের সঙ্গে প্রায়শই এই ব্যাপারে মজা করেন উনি।
কাজল আর সায়মা ছুটলেন রান্নাঘরে। শায়লা গেলেন ইমতিয়াজ সাহেবের কাছে। উনি বাড়ির বড় বউ। বেশি কথাবার্তা বলেন না।
তখনি ইয়াভকিন নেমে এল সিঁড়ি বেয়ে। অবিন্যস্ত চুলগুলোকে কোনোমতে ঠিক করতে করতে এগিয়ে এল। রোকেয়াকে দেখে খুশি হয়ে বলল,
‘ তুমি কখন আসলে?’
‘ একটু আগে রে, বোস দেখি। তোরে কতোদিন পর দেখতাছি। বিয়ে কইরা দেখি বাড়িতে আসিস না।’
‘ আসি তো, আসবোনা কেন?’
‘ আমার বাড়িতে তো যাস না।’
‘ তোমার বাড়িতে গেলে তো আর আসতে মন চায়না। আর ওতো ছুটিও পাইনা। কিভাবে যাই বলো?’
‘ যাওয়ার ইচ্ছা থাকলে তো যাইতিই। বাহানা যতো দিতেছোস।’
‘ আচ্ছা, সেসব বাদ দাও। একা এসেছো?’
‘ সাবা আসছে সাথে।’
‘ তা তোমার নাতনি কোথায়?’
‘ বাইরে খেলতাছে। তা এটা বল, এ বাড়িতে নাতিপুতি আসবো কবে?’
মিটমিটিয়ে হেসে উঠল ইশরাত। পূর্ণতা ব্যাপারটা ধরল খানিক্ষণ পর।
আড়চোখে একবার লজ্জায় আড়ষ্ট হওয়া পূর্ণতাকে পরখ করে নিল ইয়াভকিন। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল,
‘ সময় হলে আসবে। এবার বলো তোমার শরীরের কি অবস্থা?’
উত্তর দিয়ে গল্পে মজলেন উনি। পূর্ণতা নিজেকে অপ্রয়োজনীয় প্রাণী ছাড়া কিছুই ভাবছেনা আপাতত। ইতস্তত করতে করতে সে উঠে দাঁড়ায়। সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে যায় রান্নাঘরে।
_
রাত। খাওয়ার পাট চুকিয়ে সাবা পূর্ণতার সাথে ভাব জমিয়েছে।
আপাতত সে পূর্ণতার পাশে পা দুলিয়ে বিছানায় বসা। হাতে পূর্ণতার ফোন। ফোনের লোভে পড়েই সে মূলত এসেছিল। এরপর পূর্ণতার সাথে কথা বলে বলে একসময় ভাব জমিয়ে ফেলে। বয়স তার পাঁচ বছর। বাবা-মাকে ছাড়া সে দাদীর সাথে এভাবে ঘুরতে পছন্দ করে ভীষণ। পূর্ণতার সঙ্গে সে কথা বলছিল, এমন সময় ইয়াভকিন রুমে ঢুকে। সাবা তাকে একবার পরখ করে নিয়ে কথা বলায় মগ্ন হয়। ইয়াভকিনের থেকে সে দূরেই থাকে। বাকিদের সঙ্গে তার ভাব। ইয়াভকিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ সাবা? ঘুমাবে না?’
‘ তাড়িয়ে দিচ্ছ কেন! যাবো না।’
তব্দা খেয়ে ইয়াভকিন পূর্ণতার দিকে তাকাল। বলল,
‘ তুমি ওকে কথা শিখিয়ে দিয়েছ!’
‘ ধ্যাত! আমি কেন শিখিয়ে দিব!’
কপট রাগ পূর্ণতার কণ্ঠস্বরে। ইয়াভকিন গা ঝাঁ’ড়া দিয়ে সাবার পাশটায় বসে। সে তৎক্ষনাৎ বলে উঠে,
‘ মামা? তুমি কোথায় ঘুমাবে?’
‘ কেন? আমার বিছানায়।’
‘ মামির সাথে ঘুমাবো আমি। জায়গা হবেনা তোমার।’
তীক্ষ্ণ চোখে পূর্ণতার দিকে তাকায় ইয়াভকিন। পূর্ণতা থতমত খেয়ে বলে,
‘ আমি শিখিয়ে দেইনি কিছু, বিশ্বাস করুন।’
ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে ইয়াভকিন বলল,
‘ আমার বিছানাটা কতো বড় সাবা! তিনজনেরই জায়গা হবে। তুমি একপাশে, আমি একপাশে। বুঝলে?’
‘ কিন্তু আমি মাঝখানে ঘুমাই।’
ঠোঁট ফুলিয়ে জবাব দিল সাবা। হাতের ফোনটা ধপ করে বিছানায় রেখে আড়াআড়ি করে হাত ভাঁজ করল। ফুঁপানোর ভঙ্গিতে বলল,
‘ আমি মামির সাথেই ঘুমাব।’
‘ ইশ, কাঁদেনা। আমার সাথে ঘুমাবা, ঠিক আছে?’
পূর্ণতা সামাল দিতে চাইল।
মাথা নাড়িয়ে চট করে বিছানায় উঠে বসল সাবা। একপাশটায় গিয়ে শুয়ে পড়ল পূর্ণতাও। না পারতে অন্যপাশে গা এলিয়ে দেয় ইয়াভকিন। লাইট তখনও জ্ব’লছে। দরজায় নক করতেই উঠে বসে ইয়াভকিন। রোকেয়া উঁকি দিয়ে বললেন,
‘ এই সাবা? আয়, আয় ঘুমাবি।’
‘ আমি এখানে ঘুমাবো দাদু। তুমি যাও।’
রোকেয়ার এতো এতো জোরাজোরির পরও সে গেলোনা। পাশ ফিরে ঝাপটে ধরল পূর্ণতাকে। কান্নার নাটক করতেই রোকেয়া চলে গেলেন। যাওয়ার আগে পূর্ণতাকে বলে গেলেন,
‘ ওরে দেইখা রাইখো, বউ। রাতে উঠে কান্না করলে আমার কাছে পাঠায়া দিবা।’
লাইট অফ করে বিরক্ত ভঙ্গিতে একপাশে গা এলালো ইয়াভকিন। খানিক সময় পর পূর্ণতা ঘুমিয়েই গেল। ইয়াভকিন ঘন্টা খানেক ফোন ঘাটল। পাশের দুই প্রাণী ঘুমিয়ে কাঁদা। ঘড়ির কাটা যখন একটায় গিয়ে ঠে’কল, তখন ইয়াভকিন উঠে বসলো। অন্ধকারে আচ্ছন্ন ঘর। উঠে দাঁড়িয়ে ঘুরঘুর করে বারান্দায় গেল। তার বারান্দা দিয়ে রাস্তার একপাশ দেখা যায়। তাদের গেটও দেখা যায় খানিকটা। গেটের দুই ধারের লাইট এখনও জ্বালি’য়ে রাখা। কিঞ্চিৎ আলো এসে বারান্দায় হাতছানি দিচ্ছে সেখান থেকে। ইয়াভকিন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রুমে আসলো।
পূর্ণতা তখন গভীর ঘুমে। মুখের কাছটায় সুরসুরি পেতেই ঘুম উবে গেল তার। চোখ খুলে পুরুষালী অবয়ব দেখে ভড়কে, চেঁচানোর পূর্বেই ইয়াভকিন মুখে চেপে ধরল,
‘ হুশ, উঠো, বারান্দায় চলো।’
‘ মাঝরাতে এসব কি?’
জবাব না দিয়ে তাকে টেনে তুললো ইয়াভকিন। দু’হাতে ঝা’পটে ধরে বারান্দায় নিয়ে গেল।
পূর্ণতার পিঠ বারান্দার গ্রিলে ঠে’কানো। ইয়াভকিন তার খুব নিকটে, ইঞ্চি কয়েক দূরত্ব। সেই দূরত্ব ঘু’চিয়ে আরও ঘনিষ্ঠ হলো ইয়াভকিন। ললাটে গভীর চুম্বন দিয়ে মুখ ঝুঁকিয়ে আনল। ফিসফিস করে বলল,
‘ তুমি আমাকে পালটে দিচ্ছ পূর্ণতা।’
পিটপিট করে তাকানো পূর্ণতা বুঝলনা। ইয়াভকিন ফের বলল,
‘ যে পূর্ণতাকে আগে সহ্য করতে কষ্ট হতো, তাকে ছাড়া এখন আমার চলছেনা। ব্যাপার কি বলো তো? তুমি কি জাদু জানো পূর্ণতা?’
চলবে।
#বৃষ্টিস্নাত_তুমি – (২০)
হুযাইফা মাইশা
ইয়াভকিনের চোখে চোখ রাখে পূর্ণতা। গাঢ় স্বরে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে,
‘ ভালোবাসেন?’
‘ এখনও বুঝলে না?’
‘ কখন থেকে?’
‘ ওসব জানিনা, শুধু জানি ভালোবাসি।’
মৃদু ধা’ক্কা দিয়ে ইয়াভকিনকে সরাল পূর্ণতা। রুমে ঢোকার আগে দাঁড়িয়ে গিয়ে ঘাড় হালকা ঘুরিয়ে বলল,
‘ আমার একটা স্বচ্ছ হৃদয় দরকার, যেখানে কেবল আমি থাকবো। আর কেউ না।’
‘ এরকম স্বচ্ছ হৃদয়ই তো তোমাকে দিতে চাচ্ছি তুমি তা গ্রহণ না করলে কি উপায়?’
আড়চোখে তাকায় পূর্ণতা,
‘ সত্যি?’
‘ বিশ্বাস করছো না? এটলিস্ট একবার করে দেখো..’
‘ বিশ্বাস অনেক আগেই করেছি। নাহলে কি এক ঘরে থাকতাম?’
‘ বিশ্বাস থেকেই কিন্তু ভালোবাসার শুরু।’
‘ শুরু অনেক আগেই হয়ে গেছে।’
বিড়বিড় করে বলে রুমে প্রবেশ করল পূর্ণতা। কিঞ্চিৎ শুনতে পেল ইয়াভকিন। হেসে পিছু পিছু ছুটল পূর্ণতার।
সাবা উঠেছে খুব ভোরে। উঠে সে চুপিচুপি রুম থেকে বেরিয়ে গেছে। ঘুরঘুর করার উদ্দেশ্যেই মূলত বের হয়েছে। ছটফটে মেয়েটা সিঁড়ির পাশটায় আসতেই রোকেয়ার নিকট ধরা খেল। বাড়ির তিন বউও উঠে গেছেন ততক্ষণে। রোকেয়া নাতনির হাত ধরে রুমে নিয়ে গেলেন। সাবা কোনোমতে মুখ ধুঁয়ে বাইরে এল। একা একা বাইরে যেতে মানা করেছেন রোকেয়া। রোকেয়ার কথা অমান্য করেনা সে। সুতরাং তার আর বাইরে যাওয়া হলোনা। নিচে সোফায় বসে কতক্ষণ থম মেরে বসে রইল। একটু পর সে রোকেয়ার পাশ ঘে’ষল,
‘ দাদু একটু বাইরে যাই?’
‘ এতো সকালে বাইরে যাওনের দরকার নাই সাবা। চুপ কইরা বয়।’
মুখ ফুলিয়ে সে রোকেয়ার সাথে থাকলো।
পূর্ণতা মুখ ধুয়ে চট করে নেমে এল। ইয়াভকিন তখন গভীর ঘুমে। এমন ভাবে ঘুমোচ্ছে যেন রাতে ঘুমোয় নি। নেমে সর্বপ্রথম সে রান্নাঘরে গেল।
_
দুপুরের পরপরই বাড়ি ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলেন রোকেয়া। ছেলে নিতে এসেছে উনাদের। সাবা খুশিমনেই বিদায় নিল। যাওয়ার আগে কেবল পূর্ণতা আর ইশরাতের নিকট হতে খুব সুন্দর করে বিদায় নিয়ে গেল। ইয়াভকিন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিল। তাকে এভাবে তাকাতে দেখে সাবা মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল। নেত্রযুগল বড় বড় করে পূর্ণতার পাশ ঘে’ষে দাঁড়াল সে। ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ তুমি ওকে এসব শিখিয়ে দিচ্ছ?’
রক্তিম চোখে একবার তাকাল পূর্ণতা। পরপরই সরে গেল কাছ থেকে।
_
সন্ধ্যাবেলা। ফ্ল্যাটে খানিক পূর্বেই ফিরেছে ইয়াভকিন আর পূর্ণতা। বিকেলের দিকটায় বেরিয়েছিল। কাল দু’জনেরই অফিস-ভার্সিটি। মিস দেয়ার মানেই হয়না। ফ্ল্যাটে ফিরতেই কাজলের ফোন এল। ধরতেই তড়িঘড়ি করে বললেন,
‘ পৌঁছেছিস?’
আস্তে করে জবাব দিল পূর্ণতা,
‘ জ্বি মা।’
‘ ইয়াভকিন কোথায়?’
পূর্ণতা ইয়াভকিনের দিকে এগিয়ে দিল ফোন। ইয়াভকিন সোফায় বসা। কালো শার্টটার টপ দু’টো বোতাম খোলা। লোমহীন আকর্ষণীয় বক্ষের একাংশ দৃশ্যমান। সেদিকে তাকিয়ে চোখ মুখ কুঁচকিয়ে মুখ ফেরাল পূর্ণতা। নিজের দৃষ্টি সংযত রাখার চেষ্টা করল। ইয়াভকিন হাত বাড়িয়ে ফোন নিতেই ওপাশ থেকে কাজলের কণ্ঠে ভেসে এল,
‘ শুনো আব্বু, আজকে বাইরে খেয়ে নিও। তোমরা দুজনেই ক্লান্ত। বুয়াও এখন আসবেনা। জানি বাইরের খাবার খাওনা, তবুও আজকে খেয়ে নিবা? বুঝছো?’
‘ হ্যাঁ, মা। বুঝেছি।’
কথা সেড়ে ফোন কান থেকে নামাল ইয়াভকিন। পূর্ণতা হাত বাড়িয়ে দিল ফোন আনার জন্য। ইয়াভকিন ফোনটা রাখল সোফার অন্যপাশে। আকস্মিক পূর্ণতার হাত টেনে কোলের উপর বসাল। এহেন কান্ডে পূর্ণতা ভড়কালো বটে। কিন্তু নড়চড় করলনা। ঘাড়ে থুতনি রাখল ইয়াভকিন,
‘ বাইরে খেতে যাবো আজ, কোথায় যাবে বলো?’
‘ যেখানে বলবো, নিয়ে যাবেন?’
‘ হু।’
‘ শহরের একটু বাইরের দিকে একটা রেষ্টুরেন্ট আছে। ছোটখাটো কিন্তু দারুণ পরিবেশ। একদম নিরিবিলি।’
‘ তুমি চেনো কি করে?’
‘ বর্ষা, আমি আর নওশিন একবার গিয়েছিলাম।’
‘ আচ্ছা যাব, একটা শর্ত পূরণ করলে তবেই।’
প্রশ্নবোধক চাহনি নিয়ে তাকাতেই ইয়াভকিন হেসে ফেলল,
‘ কাম ডাউন, এমন কিছু চাইবোনা যা তুমি দিতে পারবেনা।’
একটু থামলো ইয়াভকিন। ঘাড় থেকে থুতনি সরিয়ে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকাল। সে দৃষ্টিতে যেন কেউ নে’শা মিশিয়ে দিয়েছে। প্রেমের নে’শা! ওমন দৃষ্টিতে ভড়কে গেল পূর্ণতা। ইয়াভকিন শান্ত অথচ মনে প্রেমের ঢেউ তুলা স্বরে বলল, ‘ একটা চুমু খাবে? নিজ থেকে?’
পূর্ণতা থমকায়। উঠে যেতে চায়। ইয়াভকিন আটকে দেয়,
‘ বেশি কিছু চেয়েছি?’
সরাসরি দৃষ্টি চোখে রাখতেই পূর্ণতা কেঁপে উঠে। বাদামী রঙের চোখজোড়ায় ক্ষীণ কাত’রতা। কিছু না পাওয়ার আক্ষেপ। সময় নষ্ট না করেই পূর্ণতা মুখ এগিয়ে নিল। লজ্জা শরম ঠে’লে এক মুহূর্তের জন্য ঠোঁট ছুঁয়াল ইয়াভকিনের গালে। পর মুহূর্তেই বাঁধন ঢিলে হল। উঠে দাঁড়াল পূর্ণতা। নত মস্তকে রুমের দিকে পা বাড়াল। পেছন থেকে হাস্যোজ্জ্বল ইয়াভকিনের কথায় আরও গুটিয়ে গেল,
‘ এভাবে রোজ একটা চুমু দিলে, তোমার লজ্জা একেবারে চলে যাবে।’
পূর্ণতা রুমে এসে দরজা ভিড়িয়ে রেখে কিছুক্ষণ বসে রইল। আধ ঘন্টা পর ইয়াভকিন বাইরে থেকেই বলল,
‘ রেডি হয়ে নাও।’
‘ এত জলদি গিয়ে কি হবে?’
‘ যেতেও তো সময় লাগবে। জ্যামে যদি আটকি..’
প্রত্যুত্তর আর দিলনা পূর্ণতা। ইয়াভকিন এবার দরজা ঠেলে রুমে উঁকি দিল,
‘ মনের আদানপ-প্রদান তো শেষ, এবার কি জিনিসপত্র নিয়ে আমাদের রুমে আসবেন না ম্যাডাম?’
পূর্ণতা চমকে বলল,
‘ ওসব পরে নেব।’
‘ আচ্ছা শুনো..’
‘ হু?’
‘ ডার্ক রেড কালারের একটা শাড়ি আছেনা? সিল্কের?’
‘ আছে তো।’
‘ ওটা পড়ো এখন। জলদি।’
‘ এই রাতে শাড়ি? ধ্যাত!’
‘ পড়ো, আমি দেখবো।’
বলতে বলতে ইয়াভকিন বিদায় নিল।
পূর্ণতা একেবারে রেডি হয়ে তবেই বের হলো। সিল্কের শাড়িটা পাতলা। কনুই অব্দি ব্লাউজ। ব্লাউজের গলাটা আবার বেশ বড়। সেজন্য পিঠ অব্দি লতানো চুলগুলো ছেড়ে দিয়েছে। মুখে মেকাপ লাগায়নি।
বের হয়ে ঘুরঘুর করার কয়েক মুহূর্ত পরই রুম থেকে বের হলো ইয়াভকিন। পরনে তার সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট। হাতে কালো দামী ঘড়ি। কালো জুতো জোড়াও চকচকে। চুলগুলো সেট করা সুন্দর করে। সে পূর্ণতাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করল কিছুক্ষণ। এগিয়ে এসে বলল,
‘ কাজল দাওনি?’
‘ না।’ অপ্রস্তুত উত্তর পূর্ণতার।
‘ দিয়ে আসো যাও।’
পূর্ণতা পা বাড়াল। মিনিট কয়েকের মধ্যে ফিরেও এল। চোখ তখন হালকা কাজল দেয়া। ইয়াভকিন আলগোছে তার হাত মুঠোয় নিল। মুখ ঝুঁকিয়ে এনে বলল,
‘ পৃথিবীর মধ্যে দু’জন নারী আমার কাছে বিশ্বসুন্দরী। একজন মা, আরেকজন তুমি। এত মোহনীয় সৌন্দয্য! কিন্তু একটা কথা জানো কি? বৃষ্টিস্নাত তুমি এর থেকেও সুন্দর।’
চলবে।