বৃষ্টিস্নাত তুমি পর্ব-২৭+২৮

0
395

#বৃষ্টিস্নাত_তুমি – (২৭)
হুযাইফা মাইশা

বিথি বোনজিকে দেখে যারপরনাই খুশি হলেন। আচমকা আসার কথা শুনে অবাকই হয়েছিলেন।
পূর্ণতার পিছু পিছু ইয়াভকিন ঢুকল। কোলে প্রতিভা। গলা জড়িয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার গায়ের রঙ ইয়াভকিনের মত ধবধবে সাদা। ইয়াভকিনের অন্যহাতে মিষ্টির প্যাকেটগুলো। বিথি তাদের বসিয়ে বললেন,
‘ এসব আনার দরকার তো ছিলনা,বাবা! নিজের বাসাই তো এটা।’

ইয়াভকিন হাসলো বিনিময়ে। প্রতিভা এখনও বাবার কোলে গলা জড়িয়ে বসে আছে। বিথি কোলে নিতে চাইলে গেলনা। আরো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো ইয়াভকিনকে। ঊর্মি ঘর থেকে বেরিয়ে এল। পূর্ণতা আসায় সে শান্তি পেয়েছে খানিকটা। বিথি উনার বোনজিদের বরাবরই ভালোবাসেন। কথা ফেলেন না তেমন একটা। পূর্ণতা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। ইয়াভকিন চোখের দিকে তাকাল ওর। উশখুশ করছে পূর্ণতা। ইয়াভকিন চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলল।

একপর্যায়ে শান্ত হয়ে পূর্ণতা বলল,
‘ খালামণি, কিছু কথা ছিল। রুমে আসলে ভালো হয়।’

বিথি নাশতা গুলো রাখলেন সাজিয়ে। ঊর্মি বাবা বেরিয়ে আসলেন। খুশ গল্পে মজে গেলেন। বিথি রুমে যেতেই পূর্ণতা তাকে বসাল। নিজেও বসলো পাশে। উনার একটা হাত নিজের দু’হাতে ধরে বলল,
‘ পুরোটা শুনবে আগে, খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা।’
‘ আহহা! এত উশখুশ করলে চলে?’

জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে পূর্ণতা বলতে শুরু করে,
‘ আমার দেবর, ইয়াদ। ইন্টার্নি শেষ করে এখন ডক্টর। চেম্বারও আছে। দেখোনি বোধহয়।’

ফোন বের করে ইয়াদের ছবি দেখাল পূর্ণতা। বিথি বললেন,
‘ মাশা-আল্লাহ! সুন্দর ছেলে। কিন্তু এসব আমাকে বলছিস কেন?’
‘ তুমি নাকি ঊর্মির জন্য পাত্র খুঁজছ, তাই বলছি। পাত্র হিসেবে ও মন্দ না। সব দিক দিয়েই ভালো। আমার দেবর বলে বলছিনা। তুমি খালু কে দিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখো ভালো করে।’

বিথি আড়চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ সত্যি বল? ওদের মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক আছে?’

পূর্ণতা আমতা আমতা করে উঠে। বিথি কিভাবে টের পেলেন ভেবে পাচ্ছেনা। বিথি আচমকা বলে উঠলেন,
‘ ঊর্মি, পর্দার আড়াল থেকে ভেতরে আয়।’

ধরা পড়ে আর উপায় রইল না। গুটিগুটি পায়ে ভীত ঊর্মি চলে আসে রুমে। দরজাটা হালকা ভিড়িয়ে দিয়ে আসে সাথে। বিথি শক্ত কণ্ঠে বলেন,
‘ সম্পর্ক নেই তোদের মধ্যে? অন্য পাত্রের কথা হলে তো ছুটে কেঁদেকুটে একাকার করিস।’
‘ আছে, মা।’
ফুঁপিয়ে উঠে ঊর্মি। মিথ্যা কথা সে বলতে পারেনা মায়ের নিকট। বিথির চোখ-মুখ আরো শক্ত হয়,
‘ কতোদিনের?’

ঊর্মি নিশ্চুপ, নিরুত্তর। পূর্ণতা পড়লো বিপাকে। পরিস্থিতি বেগতিক দিকে যাচ্ছে। কিছু বলার পূর্বেই বিথি তাকে থামিয়ে দিলেন,
‘ উত্তর দিচ্ছেনা মানে অনেক দিনের সম্পর্ক। আমি ওকে ভালো করে চিনি,পূর্ণতা। ও মিথ্যা আমার সাথে বলেনা। বলতে ইচ্ছুক না হলে এভাবেই চুপ করে থাকে। এখানে এসেছিস, থাক। জামাই আর নাতনীকে দেখে খুশি হয়েছি। তবে মেয়ের কারণে নিজের কাছে নিজেই লজ্জিত হচ্ছি। কি আর করার?’

যেতে যেতে হঠাৎ থেমে গেলেন উনি,
‘ পাত্রকে বল বাবা মা সমেত আসতে। আমি চাইনা, মেয়ের বিরু’দ্ধে তাকে বিয়ে দিতে। জীবনটা তার, জানি। তবে আশাহত হয়েছি। ও যেন আমার সাথে কথা না বলে।’

বলেই প্রস্থান ঘটালেন উনি।
ঊর্মির কান্নার বেগ বাড়ল। পূর্ণতা সামলাতে চাইল,
‘ সব ঠিক হয়ে যাবে। একদিক আগে ঠিক হোক। তারপর নাহয়..’

প্রতিভা কোল থেকে নেমে ঘুরঘুর শুরু করলো। রুমের পাশে এসে গুনগুন করে কান্নার আওয়াজ কানে আসতেই সে পা বাড়াল। পর্দা সরিয়ে সে ভেতরে মাকে দেখে লাফিয়ে ঢুকল। গা ঘে’ষে দাঁড়িয়ে পিটপিট করে তাকিয়ে রইল ঊর্মির দিকে। ঊর্মি অনিচ্ছাকৃত হাসলো। চোখ মুছে বলল,
‘ কেমন আছো, বাবু?’
‘ ভালো আছি, তুমি কে?’
‘ ও তোমার খালামণি।’ পূর্ণতা জবাব দেয়।
ঊর্মি হাত বাড়ায় কোলে নেয়ার জন্যে। প্রতিভা মায়ের দিকে তাকায়। চোখের ইশারায় আদেশ পেতেই সে ঊর্মির কোলে চড়লো।
_

বাসায় এসে সর্বপ্রথম ইয়াদকে কল করলো ইয়াভকিন। ইয়াদ ছোটখাটো একটা বাসা নিয়ে থাকে বেশ দূরে। আজ হাসপাতালে যায়নি বিধায় ঘুমোচ্ছিলো অসময়ে। সন্ধ্যা তখন। ইয়াভকিনের কল ধরেই বলল,
‘ বলো, ভাই?’
‘ তুই এক্ষুনি আমার বাসায় আসবি। ত্রিশ মিনিটের ভেতর।’
‘ এত কি জরুরি? একঘন্টার ভেতর আসছি।’
‘ ত্রিশ মিনিটের ভেতর। একটু হেরফের হলে ঘাড় ধরে বাবার কাছে নিয়ে যাব। এই বয়সে চ’ড়-থা’প্প’ড়ও খেতে পারিস। ইজ্জত বাঁচানোর হলে চলে আসবি।’

থ্রে’টে ভয় পেল ইয়াদ। তড়িঘড়ি করে উঠে বসল। ফোন ছুঁ’ড়ে হুড়মুড় করে গায়ে শার্ট চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

প্রতিভাকে খাওয়াচ্ছে পূর্ণতা। ও বাসায় একটু কিছু মুখে দেয়নি। জেদ ধরে বসে ছিল, সে খাবেনা। ইয়াভকিন রুমে আসলো। বাবাকে দেখে প্রতিভা যেন খুশিই হলো,
‘ আমার আর ক্ষিদে নেই।’

পূর্ণতা একবার প্লেটের দিকে তাকাল। দুই লোকমা ভাত খেয়েছে মেয়েটা। সব এখনও বাকি। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ চুপচাপ বসে সব খাবি। নাহলে আর ভাত খেতে পারবিনা।’

প্রতিভা মুখ ফুলাল। আলগোছে উঠে ইয়াভকিনের গা ঘে’ষে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘ খাবনা।’
‘ মা বকবে।’
‘ তুমি তো ব-বকবেনা।’

ইয়াভকিন হালকা হাসে। মা মেয়ের নিত্যদিনের কান্ড এসব। পূর্ণতা উঠে এল। অন্যহাতে মেয়েকে টেনে বসিয়ে দিল বিছানায়। বলল,
‘ না খেলে বাপ মেয়ে দু’জনের আর ভাত নেই।’
এক লোকমা ভাত তুলে দিল মুখে। প্রতিভা কোনোমতে গিলে কান্না করে উঠল। পূর্ণতা রেগে গেল তাতে। কথা নেই বার্তা নেই, হুট করে কান্না করে ফেলে মেয়েটা। রেগে’মেগে বলল,
‘ কান্না করলে থা’প্প’ড় খাবে। চুপচাপ বসো।’

প্রতিভার কান্নার বেগ বাড়ল। ইয়াভকিন অস্থির পায়ে এগিয়ে এল। গায়ের কাপড়ই পাল্টায়নি এখনও। মেয়েকে সরিয়ে নিয়ে নিজের কাছে আনলো। গম্ভীর মুখে চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,
‘ সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতে পারোনা? খালি মা’রের কথা। বাচ্চা ভয় পাবেনা?’

পূর্ণতা ধপ করে কাঁচের প্লেটটা বিছানায় রাখল। কয়েকটা ভাত ছিটকে পড়লো বিছানায়। গজগজ করে বলল,’যা ইচ্ছা করো। আমাকে আর কেউ কিছু বলবেনা। আমার কথা শুনেই বা কে! যার যার মর্জি মাফিক সব চলে। আমিই শুধু শুধু যেচে আসি।’

প্লেট হাতে তুলে নিয়ে সে বেরিয়ে গেল। ইয়াভকিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। প্রতিভার কান্না থেমে গেছে। একহাতে মেয়েকে আগলে নিয়ে ইয়াভকিন জিজ্ঞেস করল,
‘ মা-মেয়ের একই স্বভাব কেন হলো?’
প্রতিভা বুঝলোনা। বাবার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল।

কলিংবেল এর শব্দে রান্নাঘর হতে ছুটে গেল পূর্ণতা। দরজা খুলতেই অগোছালো ইয়াদ প্রবেশ করলো। পূর্ণতা দরজা লাগিয়ে বলল,
‘ ডাক্তার সাহেবের এ অবস্থা কেন?’
‘ আপনার স্বামীর কারণে এ অবস্থা, ভাবি। জরুরি তলবে ছুটে আসতে হলো।’
‘ আপনি যা কান্ড ঘটালেন তাতে তো এভাবে তলব পড়তই একসময়।’

প্রশ্নবোধক চাহনি নি’ক্ষেপ করে ইয়াদ। সোফায় বসে সে। পূর্ণতা হালকা হেসে বলে,
‘ আপনার ভাই আসুক, জানবেন সব।’

ইয়াভকিন বেরিয়ে এল। প্রতিভা রুমে খেলছে।
ইয়াদ নত মস্তক তুলে তাকাল ইয়াভকিনের দিকে।
ইয়াভকিন সামনের সোফায় বসে গম্ভীর মুখে বলল,
‘ চার বছর তো কম সময় না। একবারও বুঝতে দিলিনা তুই মা’রাত্মক লেভেলের প্রেম করছিস? তাও আমার খালাতো শালির সাথে?’

প্রথমে অবাক হলেও পরমুহূর্তে ইতস্তত করে উঠে ইয়াদ। বলে,
‘ দেখো ভাই, আমি সত্যিই জানতাম না ও তোমাদের আত্মীয়। কসম করে বলছি, ও নিজেও জানতো না।’
‘ সমস্যা তো সেটা না। ওর মা বাবা যে ওর জন্য পাত্র দেখছেন, জানিস?’
‘ জানি।’ নত মস্তক ইয়াদের।
‘ জানিস যখন বাবা মাকে বলছিস না কেন? প্রেম করেছিস, বিয়ে করবিনা এখন? কালকেই মা-বাবাকে আনবি। নিজে গিয়ে আনবি, একদম সোজা খালামণির বাসায় গিয়ে বিয়েটিয়ে পাকাপোক্ত করে আসবি। ও বেচারির উপর দিয়ে কি যাচ্ছে, বিন্দুমাত্র ধারণা আছে তোর? একা প্রেম করেছে নাকি ও? তুই করিস নি?’
‘ ও আমাকে ব্ল’ক দিয়ে রেখেছে, ভাই।’
‘ কেন?’
‘ সময় চেয়েছিলাম, মাস খানেকের মত।’
‘ সময় কেন চাইবি? তুই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিস। ভালো স্যালারি পাস। তাহলে কেন?’
‘ বাবা-মাকে মানাতে..’
‘ বাবা-মা না করবেন বলে তোর মনে হয়? ওকে ফাইন, আমি রাতে কল দেব উনাদের। সব বুঝিয়ে বলবো, তুই কালকে গিয়ে উনাদের নিয়ে আসবি।’

‘ আমার বোনকে কাঁদিয়ে কি অবস্থা করেছেন, জানেন?’
পূর্ণতার কথায় আরো মাথা নুয়ায় ইয়াদ। সে নিজেও কষ্ট পাচ্ছে। মেয়েটার সাথে পুরো একটা দিন ওর কথা হয়নি। দু’জনেরই দোষ তাতে। পূর্ণতা নাশতা রেখে বলল,
‘ যত দ্রুত বিয়ে করবেন ততো ভালো। খালামণি ঊর্মির সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে।’

অসহায় চোখে তাকাল ইয়াদ। বলল,
‘ ভাবি? আপনার ফোন থেকে ওকে একটা কল দিয়ে দিবেন? নতুন তিনটা সিম থেকে কল দিয়েছি, ধরেনি একবারও।’

হেসে পূর্ণতা ছুটল রুমে। ফোন হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল। সাথে এল প্রতিভাও। ইয়াদকে দেখে বড় বড় চোখে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
‘ তুমি কি বড় চাচ্চু?’
‘ হ্যাঁ, মামনি। দেখি, এদিকে আসো। চাচ্চু তোমার জন্য কি এনেছি জানো?’

বলতে বলতে চকলেট বের করলো ইয়াদ। প্রতিভা বসল পাশে। তার হাতে চকলেট ধরিয়ে দিয়ে মিনিট কয়েক পর পূর্ণতার ফোন নিয়ে সরে আসলো। কল লাগাল ঊর্মির ফোনে।
মেয়েটা কল ধরলো সময় নিয়ে। রিসিভ করে নাক টেনে বলল,
‘ হ্যাঁ, আপু?’
‘ আমি তোমার আপু না। আমি তোমার হবু স্বামী। কালকে আসছি। ব্ল’ক দেয়ার শা’স্তি খুব শীঘ্রই পাবে। ‘

কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে ফোনের দিকে চেয়ে থেকে খট করে কল কেটে দেয় ঊর্মি।

চলবে।

#বৃষ্টিস্নাত_তুমি – (২৮)
হুযাইফা মাইশা

প্রতিভা ঘুমিয়ে পড়েছে। বাবার সঙ্গে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়েছে। পূর্ণতার প্লেট আর বাসন গুছাতেই বারোটা বাজলো। খাবার টেবিলে কথা বলে খেতে খেতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল। ইয়াদ খেয়ে হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেছে। প্রতিভার জন্মের পর পড়াশোনায় এত গ্যাপ পড়েছিল ওর! মেয়ে একটু বড় হতেই আবার সব শুরু করেছিল। বর্ষা, নওশিন প্রচুর সাহায্য করেছে সেসময়। মাস্টার্স শেষ করেছে। আপাতত চাকরি নিয়ে ভাবছে। তবে মেয়েকে কি করবে সেটা ভেবে পাচ্ছেনা, এ কারণেই কথাটা মনে চেপে রেখেছে। ইয়াভকিনকে বলেনি।

পূর্ণতা ভেবেছিল ইয়াভকিন ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু রুমে ক্লান্ত হয়ে ঢুকতেই দেখল ইজি চেয়ারটার উপর বসে আছে ইয়াভকিন। কোলে ল্যাপটপ। পুরো ঘরে আলো বলতে সেটার স্ক্রিনের আলো-ই। প্রতিভা বিছানার একপাশে। গায়ে কাঁথা জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে। যদিও এখন তেমন শীত না। আগষ্টের মাঝামাঝি সময়।

–” কাজে সাহায্য করার জন্য কাউকে রাখা উচিত।”

–” এত বছর একা করেছি,এখনও করছি। কাউকে লাগবেনা।”

–” শরীরের দিকে তো নজর দেওনা এখন আর।”

–” কেন? এখন আর ভালো লাগেনা আমাকে আগের মতো?”
কিঞ্চিৎ ঠাট্টা করেই বলেছিল পূর্ণতা। তবে ইয়াভকিন অন্ধকারেই রেগে লাল হয়ে গেল। পূর্ণতা তার ফুঁস ফুঁস নিঃশ্বাস ছাড়ার শব্দেই টের পেল। মুখ ঘুরিয়ে চুলের খোঁপা খুলল। সমান করা ছাড়া আর কখনো চুল কাটেনি ও। বর্তমানে কোমর ছাড়িয়েছে চুল। পলক ফেলার মধ্যেই উঠে আসে ইয়াভকিন। হাত থেকে চিরুনি ছাড়িয়ে বারান্দাটায় নিয়ে যায়। শ’ক্ত করে চেপে ধরে কোমর। চোখে-চোখ রেখে বলে,
–” তুমি আজকাল বাড়াবাড়ি রকমের কথা শিখেছো!”
–” কথা তো ছোট বেলায়ই শিখেছি।”
–” উলটা পালটা কথা বলার অভ্যাসটা বাদ দেয়া যায়না?”

দুদিকে মাথা নাড়ায় পূর্ণতা। মৃদু ধা’ক্কা দিয়ে বলে,
–” দেখি, ছাড়ুন। এই মাঝরাতে চুল ছেড়ে দাঁড়ালে আমাকে জ্বি’নে ধরে নিয়ে যাবে।”

ইয়াভকিন আরো পরে তাকে ছাড়ল। অধরে অধর মিলিয়েই সময় পার করলো। ছেড়ে দেয়ার পর বলল,
–” তুমি এখনও এত লজ্জা পাও!”
–” আপনার মতো বে’শ’রম আমি?” কপ’ট রাগ প্রকাশ পায় পূর্ণতার কণ্ঠে। চোখ রাঙানো তো আছেই সেই সঙ্গে। ইয়াভকিন সেদিকে বিশেষ খেয়াল দিলনা। পূর্ণতা রুমে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই বলে,
–” তোমাকে দেখলে নতুন করে প্রেমে পড়ার সাধ জাগে। যেমন করে বৃষ্টিস্নাত তোমাকে দেখে প্রেমে পড়েছিলাম। কাজল লেপ্টানো চোখগুলো এত সুন্দর লাগছিল সেদিন! যদি তুমি জানতে..বুঝতে আমার অনুভুতি, তবে এসব বলতে না কখনো!”

_

ইয়াসিন সাহেব আর কাজলকে নিয়ে এসেছে ইয়াদ। বাড়ির সকলকেই সব কিছু খুলে বলেছে সে। যদিও এর আগে ইয়াভকিন কল দিয়েছিল। ইয়াদ গাড়িতে থেকেই ফোন করলো ইয়াভকিনকে,
–” ভাই? বাবা-মাকে তো নিয়ে আসলাম, এখন?”
–” সোজা ওদের বাসায় যা। আমরাও বের হই। বাসা চিনিস? নাকি এতদিনের প্রেমে সেটাও চিনিস নাই?”
–” চিনি, ভাইয়া। এভাবে খোঁ’চা দিওনা।”

নিচুস্বরে বলে ইয়াদ।
ঊর্মিদের বাসায় পৌঁছাতে তিনটা বাজলো। আগে থেকেই জানিয়েছে পূর্ণতা। ঊর্মির সঙ্গে কথা বলছেন না বিথি। নিশ্চুপে কাজ করে যাচ্ছেন। ঊর্মিকে শাড়ি দিয়ে গেছেন পড়ার জন্য। ঊর্মি তড়িঘড়ি করে শাড়ি পড়েছে। শাড়ি পড়াটা শিখেছে সে ইয়াদের জন্যই। মেডিকেল বন্ধ থাকলে আচমকা ছেলেটা ঘুরতে যেতে চাইত। ঘুরাঘুরি বলতে ওই মেডিকেলের আশপাশের জায়গাগুলো। শাড়ি আর পাঞ্জাবি পড়ে দু’জনে অলিগলি হাঁটতো। বাদাম খেত।
ইয়াদ ধুকপুক করা হৃদয় নিয়ে,আল্লাহ’র নাম জপ করে কলিংবেল বাজায়। দরজা খুলেন ঊর্মি বাবা। সৌজন্যমূলক কথা সেড়ে তাদের নিয়ে আসেন ড্রয়িংরুমে। খানিক পরে সেখানে উপস্থিত হয় পূর্ণতা আর ইয়াভকিনও। সাথে প্রতিভা। সে বাবার কোলে ঘুমোচ্ছে। তাকে দেখে হুড়মুড় করে কোলে নিলেন কাজল। কাঁধে মাথা রেখে বসলেন। নাতনীকে এত আদর করেন উনি! ইয়াসিন সাহেব নাতনীর মুখে হাত বুলিয়ে ইয়াদের কানে কানে বললেন,
–” তোর জন্য এভাবে ছুটে আসতে হয়েছে। নাতনীকেও এসে ঠিকমতো দেখিনি।”
–” একটু স্যাক্রিফাইস তো করাই যায়, তাইনা বাবা?”

কেঁশে উঠেন ইয়াসিন সাহেব।

সেদিন সন্ধ্যায়ই বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়। সেপ্টেম্বর এর এক তারিখই বিয়ে। দিন পনেরো পর আরকি। ইয়াদ বা কেউই দেরী করতে চাচ্ছে না। বিথি মানা করেননি কিছুতে। ঊর্মিকে আনতে গিয়ে কেবল বলেছেন,” এসো।”
ঊর্মি ফুঁপিয়ে বলে,” আমাকে মাফ করা যায়না আম্মু?”
বিথি তড়িঘড়ি করে চোখ মুছে দিয়ে বলেন,” আমার নিজের কাছে নিজেকে ছোট লাগছিল। এত এত ভাবনা সব জলে গেল। তবে ছেলেটা ভালো। আচার-আচরণে বোঝা যায়। ও বাড়িতে গেলে তুমি খুশিই হবে, আশা করি।”
ঊর্মি মৃদু হেসে মাকে জড়িয়ে ধরে।
_

–” তোর বিয়ে ঠিক করে দিয়েছি, আমাদের কি লাভ হলো? কিছু খাওয়া।”

–” এক্ষুনিই তো খেয়ে আসলা, ভাই? আর কি খাবে এখন? ভাবি? আপনার স্বামী কি দিনদিন পেটুক হচ্ছে নাকি?”

পূর্ণতা পেছন থেকে চমকে তাকায়। বলে,
–” আমারও তো তাই মনে হচ্ছে।”

চোখ রাঙিয়ে তাকায় ইয়াভকিন। ইয়াদের উদ্দেশ্যে বলে,
–” আমার মেয়ে ঘুমোচ্ছে সেজন্য বেঁচে গেলি। নাহলে গালে এমন চ’ড় পড়তো!”
–” ভাই, ভেবেচিন্তে কথা বলো। আমি এখন একজন ডাক্তার। গায়ে হাত তুললে ইঞ্জেকশন পুশ করে দেব। আর তোমার বিয়েটায়ও আমি কম কি করেছি? শেরওয়ানিটা অব্দি পড়তে চাচ্ছিলে না।”
–” সত্যি? তাহলে কে পড়িয়েছিল?” অবাক কণ্ঠ পূর্ণতার। ইয়াদ মাথা চুলকে বলে,
–” বাবা মনে হয়। কান্না করছিল বিয়ে করবে না বলে।”
ইয়াভকিন হাত উঁচিয়ে ধরে। ইয়াদ হঠাৎ বলে,
–” সামনে তাকাও ভাই, মা’রবে নাকি আমাদের?”
হাত নামিয়ে সামনে তাকায় ইয়াভকিন। ড্রাইভিং এ মনোযোগ দেয়।
_

প্রতিভার কান্নায় ঘুম ভাঙে পূর্ণতার। রাত বাজে আটটার কাছাকাছি। ঊর্মিদের বাসা থেকে এসে এক ঘুম দিয়েছে। ভীষণ ক্লান্ত ছিল। কাপড়চোপড় না পাল্টিয়েই শুয়ে পড়েছিল তাই। বাবা মেয়ে কি করছিল এতক্ষণ কে জানে। প্রতিভার কান্নার আওয়াজ তীব্র হলো। ছুটে ছুটে রুমে এল। বিছানায় কোনোমতে উঠে বলল,
–” দাদু কই?”

পূর্ণতা ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে আবার মাথা ফেলে দেয়। আস্তে করে বলে,
–” দাদু তো বাড়িতে।”
–” কেন?”
–” কি কেন?”
–” দাদু বাড়িতে কেন?”
–” দাদুর বাড়িতে দাদু থাকবেনা? বোকা মেয়ে।”
–” আমি দাদুর কাছে যাব।”
–” কয়দিন পর দাদুকে পাবে সোনা। মাকে জ্বা’লিও না এখন।”
–” দাদু এসেছে?”
–” চলে গেছে তো মামনি। কালকে আবার আসবে। তোমার বাবা কই?”
–” বাবা রান্না ঘরে।”
–” কি করে?”
–” চা বানায় আর দাদুর সাথে কথা বলে।”
–” আচ্ছা তাহলে বাবাকে গিয়ে জ্বা’লাও, মা এখন ঘুমাই। ওকে?”

প্রতিভা যেভাবে কাঁদতে কাঁদতে এসেছিল, সেভাবেই ছুটলো। পূর্ণতা বালিশে মুখ গুঁজে দিল আবার। আধ ঘন্টা পর ইয়াভকিনের কণ্ঠ কানে আসতেই চোখ মুখ কুঁচকালো, “নিজের অভ্যাস ওর মধ্যে চালান করে দিচ্ছ!”
–” আমি জানি ঘুমাচ্ছোনা তুমি, উঠো। উঠে বসো।”

আবার বলে ইয়াভকিন। পূর্ণতাকে টেনে তুলে বলে,
–” মেয়েকে পাঠিয়েছ আমাকে জ্বা’লানোর জন্যে?”
–” কি হয়েছে?”
–” ও আমাকে গিয়ে বলেছে তুমি নাকি আমাকে জ্বালাতে বলেছ?”
–” ছি ছি, এসব কি বলছেন?”

ইয়াভকিন ভ্রু কুঁচকায়। ঝাপটে ধরে আচমকা। বলে,
–” কি বলছি মানে? মিথ্যা বলছি?”
–” ছাড়ুন প্রতিভা চলে আসবে।”
–” আসবেনা, ও ড্রয়িং করছে।”

চুপ থাকে পূর্ণতা। ইয়াভকিন আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়। পূর্ণতার কপালে চুমু খেয়ে বলে,
–” তুমি আমার জীবনটা পুরো পালটে দিয়েছ, পূর্ণতা।”
পূর্ণতা চোখ মেলে চায়। বলে,
–” বিয়ে না করতে চাচ্ছিলেন না?”
–” সে তো তুমিও পুরোপুরি রাজি ছিলে না। ভাগ্যিস বাবা জোর করে বিয়ে দিয়েছিল। নাহলে এত সুখ পেতাম কই?”
–” সত্যিই কান্না করেছিলেন বিয়ে না করার জন্যে?”
–” ধ্যাত! আমি কি তোমার মতো?”

খিলখিলিয়ে হেসে উঠে পূর্ণতা। ইয়াভকিনের বুকে মাথা রাখে হাসতে হাসতেই। ইয়াভকিন মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় বলে, ” মেয়ে কিন্তু অবিকল তোমার হাসিই পেয়েছে।”

চলবে।