বেসামাল প্রেম পর্ব-১৫+১৬

0
114

#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১৫
আপনাদের জীবনে কি মন ভালো করার মতোন মেডিসিন আছে? যার জীবনে মন ভালো করার মেডিসিন আছে তার জীবনটা কিন্তু সত্যি ভীষণ সুন্দর এবং রঙিন হয়৷ হৈমীর জীবনে মন ভালো করার মতো মেডিসিন আছে, তার নাম টিশা৷ এই টিশা কিন্তু শুধু হৈমীর জীবনেরই মেডিসিন নয় এই টিশা আরো অনেকের জীবনেরই মন ভালো করার মেডিসিন। তবে এই মেডিসিনটাকে একান্তই নিজের করে পেয়েছে শুধুমাত্র রউফ। টিশার স্বামী, হৈমীর দুলাভাই। সে যাইহোক আজ যে হৈমীর ভীষণ মন খারাপের দিন। এই মন খারাপটা অবশ্য গত দু’দিন থেকেই হচ্ছে। যার ফলে সে পড়াতে মন বসাতে পারছে না, কলেজে যেতেও মন সায় দিচ্ছে না। আর না সূচনার সঙ্গে মন থেকে হাসিখুশি হয়ে মিশতে পারছে৷ তার এই মন খারাপের রহস্যটা কি জানেন? মি. রুদ্র শেখ। তার ভাবির ভাই, তার বেয়াইসাহেব। আজ দিয়ে শেখ বাড়িতে তিন দিন হলো তার। সেই যে প্রথম দিন আছাড় খাওয়ার পর রুদ্রসাহেব তার দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে গেল, এরপর আর সামনে আসেনি। মূলত সমস্যাটা শুরু হলো এখান থেকেই। মেয়েরা ছেলেদের এটিটিউড দেখাতে যতটা পছন্দ করে। ঠিক ততটাই অপছন্দ করে ছেলেদের এটিটিউড দেখতে। আর হৈমী সে তো বরাবরই অ্যাটেশন সিকার। যে লোকটা ক’দিন এত পাগলামি করল তার জন্য কী সব বিশ্রী আচরণ সে কিনা হুট করে এত এভয়েড করছে তাকে! লোকটা একটু বেশিই অহংকারী হয়ে গেল না? তার মতো মেয়েকে পাত্তা টাত্তা দিতে একেবারেই যে ভুলে গেল। এটা কী ঠিক? সেই যে প্রথম দেখার পর থেকে কী সব ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল! এরপর তুলে নিয়ে বিয়ে করার মতলবও আঁটলো। কত কাণ্ডই তো ঘটালো। একটা এক্সিডেন্ট, এরপর বিয়ের প্রপোজাল থেকে রিজেক্ট, সবে মিলে লোকটা মারাত্মক এটিটিউডের ভাণ্ডার খুলে বসল। সহ্য হয় এসব? একেবারেই হয় না। মনটা আজ ভীষণ খারাপ, ভয়াবহ রকমের খারাপ। সেই মন খারাপ নিয়েই কানে ইয়ারফোন গুঁজে স্যাড সং শুনতে শুনতে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। সূচনা তখন রুমের ঝুলবারান্দায় মাহেরের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিল। তাই হৈমী রুম ছেড়ে বেরিয়ে দোতলার বারান্দার একপাশে যে বেতের চেয়ার টেবিল রয়েছে সেখানে গিয়ে আরাম করে বসল৷ গান শুনায় এতই বিভোর ছিল যে নিচে তাকাতে সময় নিল ঘন্টাখানেক। ঘন্টাখানেক পর যখন আকস্মাৎ নিচের দিকে নজর পড়ল। বুকের অতি গোপন কুটিরে কেমন করে যেন ধক করে ওঠল! একি রুদ্র যে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে কফি খাচ্ছে! কাঁপা হাতে দ্রুত গান অফ করে বারকয়েক ঢোক গিলল হৈমী। নিজেকে কিছুটা আড়াল করে পিটপিট চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগল রুদ্রর ভাবগতিক । এরপর লম্বা করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। ওঠে দাঁড়য়ে মোবাইলটা পরিহিত লেডিস শার্টের পকেটে রেখে ধীরপায়ে বারান্দায় পায়চারি করল কতক্ষণ। বিরবির করে বলল,
-” একটু বেশিই ঢং দেখাচ্ছে মনে হচ্ছে, তিনি কি হোম মিনিস্টার! বয়সে বড়ো বলে সহ্য করছি নয়তো এক থাপ্পড়ে দাঁত ফেলে দিতাম, বেয়াদব। বাড়িতে আত্মীয় এলে যে মিলেমিশে থাকতে হয় সই শিক্ষাই নেই! ”

মনে ভিতর রাগটা ক্রমাগতই বাড়তে লাগল। ইচ্ছে করল নিচে গিয়ে লোকটার মাথা ফাটিয়ে দিতে। কিন্তু এসব তো করা যাবে না৷ পাছে কেস টেস ঠুকে দেয়? নিজেকে সামলানোও কঠিন হয়ে পড়ল। শেষ পর্যন্ত সলিউশন খুঁজতে ফোন করল টিশাকে। টিশা ফোন রিসিভ করেই বলল,
-” কিরে এখন ফোন দিলি ঘুমাসনি? আমি মিষ্টি খাচ্ছি দুটো খেয়েছি, আর একটা খাব। এর বেশি খাব না। ওজন বেড়ে গেছেরে বিয়ের সময় ছিলাম পয়তাল্লিশ এখন ঊনষাট। বাবুর ওজন আড়াই কেজি৷ এই জানিস আজকাল পেটটা নিচের দিকে কেমন ভারি ভারি লাগে। বাবু এত নড়াচড়া করে। আমার কি মনে হয় জানিস দীর্ঘদিন এক জায়গায় ঘাপটি মেরে বসে থাকতে ওর ভীষণ বিরক্ত লাগছে।”

-” তা তো লাগবেই তুই এক সেকেণ্ড কোথাও বসে থাকতে পারিস না আর তো ছানাটা কত মাস এক জায়গায় পড়ে আছে ব্যাপারটা আশ্চর্যজনক! এবার আসল কথা শোন, আজ আমার খুব মন খারাপ। ”

-” সেকি! মন খারাপ কেন রে? তোর বেয়াই তো আর এখন তোকে চুম্মা টুম্মা দেয় না৷ তাহলে মন খারাপ কেন? ”

-” আর বলিস না দুঃখের কথা বেয়াই যে গিরগিটির মত রঙ বদলাইছে তা তো বলিইনি। ”

হৈমী টিশাকে পুরো কাহিনী খুলে বলার পর টিশা খুব সিরিয়াস হয়ে বলল,
-” সবই বুঝলাম, তোর সমস্যাটাও বুঝলাম। ”

-” আমার সমস্যা, আমার আবার কী সমস্যা। আমার কোনো সমস্যা নেই। শুধু রাগ লাগছে যে এই লোকটা এসব করে আমাকে অপমানও করছে। ”

-” শোন তুই যে প্রেমে টেমে পড়ে গেছিস টের পেয়েছিস। অবশ্য না পাওয়ারই কথা তোর তো অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু এই টিশার আছে। শোন, চারটা প্রেম করে একটা বিয়ে করেছি। পেটে বাচ্চা নিয়ে সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়াই, পকপক করে কথা বলি, ক’দিন পর আম্মা ডাক শুনব, তোকে খালা ডাক শুনাবো, জামাইকে আব্বা ডাকের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। এই টিশার বয়স যাইহোক অভিজ্ঞতা কিন্তু কম নেই। ”

-” তুই কী বোঝাতে চাচ্ছিস দেশে, বিদেশে শতশত হিরো টাইপ ছেলে রেখে আমি বাংলাদেশের ডিপজল, মিশা, ইন্ডিয়ান ভিলেন, চুল ঝুঁটি করা পাগলা বাবা টাইপ ছেলের প্রেমে পড়ব! যে কিনা আবেগের তাড়নায় একা পেয়ে অর্ধেক বাসর সেরে ফেলে ছিঃ ছিঃ বইন। আমার রুচি সম্পর্কে তোর এমন ধারণা। লজ্জিত হলাম ভীষণ লজ্জিত। ”

-” তোর লজ্জা ধুয়ে তুই পানি খা। আমার মুখ থেকে সত্যি ছাড়া মিথ্যা বের হয় না। তা তুই খুব ভালো করেই জানিস। আর প্রেম টেমের ব্যাপারে আমি যে পিএইচডি করা এতেও সন্দেহ নেই। আমার রগচটা জামাই যে কিনা দু-চোখে আমাকে সহ্য করতে পারতো না, বিয়ে করল মায়ের চাপে পড়ে, সে জামাইকে বশে এনেছি শুধু প্রেম, ভালোবাসা দিয়ে। এমন বশ করেছি যে এখন দিন রাত প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে অস্থির সে। ”

একদমে কথাগুলো বলে ঢোক গিলল টিশা। এরপর হৈমীকে কিছু বলতে না দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-” রুদ্র বেয়াই এখন কী করছে রে? তখন বললি ঢং ধরে কফি খাচ্ছে, শেষ হয়নি? ”

দম ছাড়ল হৈমী। রুদ্রর দিকে তাকিয়ে আহত সুরে বলল,
-” এখন কী করছে জানিস? ”

-” কী? ”

-” উনার ডান পা টি টেবিলের ওপর রাখা, সে ডান পায়ের ওপর আবার বাম পা তুলে রাখছে। ঘাড়টা সোফার মাথায় এলিয়ে চরম শান্তিতে সিগারেট খাচ্ছে। ভাবটা এমন যে সিগারেট না অমৃত খাচ্ছে। ”

-” আহা কতদিন সিগারেটের গন্ধ নেয়া হয় না। তোর দুলাভাই বাবু আসার পর থেকে সিগারেট বাদ দিছেরে। সিগারেট টা আমার জোশ লাগতো। ও যখন সিগারেট খেতো আমি কত তৃপ্তি নিয়ে শুঁকতাম। যাক সে কথা তোর এখন কেমন ফিলিংস হচ্ছে রে? একটা গান ভাইরাল হয়েছে শুনেছিস?
ছেলে তোর গোলাপ গোলাপ ঠোঁটে
যখন বিড়ির ধোয়া উঠে
সেই ধোয়া দেখিতে বড়ই ভাল্লাগে। ”

নিজে বলে নিজেই খিলখিল করে হেসে ওঠল। অথচ আজ টিশা মন ভালো করতে পারলো না হৈমীর। নিজের ব্যর্থতা টের পেয়ে টিশার জেদ হলো খুব। কেন হৈমীর মন ভালো হলো না? তার স্বামী যে বলে তার কাছে মন ভালো করার মতো জাদু আছে সেসব কথা কি মিথ্যা? উহুম তার স্বামী মিথ্যা বলতেই পারে না। যদি বলেও থাকে তাহলে সে মিথ্যাকে সত্যি করার ক্ষমতা তার আছে। তাই প্রচণ্ড সিরিয়াস হয়ে হৈমীকে বলল,
-” আমি তোকে একটা কাজ দিব পারবি? ”

-” মন ভালো হওয়ার মতো কাজ? ”

-” ইয়েস সিস্টার। ”

-” তাহলে পারব। ”

-” ভয় পাবি না তো? ”

-” তুই কি আমাকে ভীতু টাইপ মেয়ে ভাবতে শুরু করলি নাকি? ”

ঠোঁট টিপে হেসে টিশা বলল,
-” শোন রুদ্র ভাই সিগারেট খাচ্ছে তুই এখন নিচে যাবি গিয়ে ইউটিউবে ঢুকবি, এরপর ভাইরাল গানটা প্লে করে টি টেবিলের সামনে রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবি৷ রুদ্র ভাই যে ধরনের মানুষ নিশ্চয়ই বিরক্ত হবে, রেগে যাবে? চোখ গরম করে গাল দু’টো শক্ত করে তাকাবে? তুই তখন ফুড়ুৎ করে ফোনটা নিয়ে সূচনা ভাবির রুমে চলে আসবি। একেবারে সেভ এন্ড চিল। কী পারবি তো? ”

ভীষণ উত্তেজিত হয়ে মুখে হাত চেপে হেসে ওঠল হৈমী। বলল,
-” পারব না মানে? উনাকে একটু জ্বালাতেই তো মন আনচান করছে। ”

ফোন কেটে দিল টিশা। মনে মনে বলল,
-” তুমি যে মনে মনে তার সামনে যেতে চাচ্ছো , তার কাছাকাছি থাকতে চাচ্ছো তা কী আর আমি বুঝিনা চান্দু? আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে খুব শিঘ্রই তোমাদের মাখামাখি প্রেম হবে। যাই বাবা আমার জামাইটার বোধ হয় পড়া শেষ এবার ঘরে যাই। ”
____
টিশার আদেশ মতো হৈমী যখন গানটা প্লে করল।
“ছেলে তোর গোলাপ গোলাপ ঠোঁটে
যখন বিড়ির ধোয়া উঠে
সেই ধোয়া দেখিতে বড়ই ভাল্লাগে। ”

লিরিক শুনে রুদ্র সত্যি সত্যি বিরক্তিতে চোখ, মুখ কুঁচকে হৈমীর দিকে তাকাল। হৈমীর কেন জানি সাহস হলো না সামনে থাকতে। তাই চটপটে পায়ে চলে গেল রান্না ঘরে গিয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে পুনরায় ফেরত এলো। রুদ্র সিগারেট শেষ করে হৈমীর ফোনের দিকে একবার তাকিয়ে হৈমীর দিকে তাকাল। বলল,
-” প্রপোজ করছো? ইউ নো হোয়াট সেধে দেয়া জিনিস আমি নিই না। ”

দু’ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেল হৈমীর৷ সহসা তর্জনী উঁচিয়ে বলল,
-” আমি আপনাকে প্রপোজ করতে আসব আমি? প্রপোজ করার মতো কী আছে আপনার? আমি এসেছিলাম জাস্ট আপনাকে জ্বালিয়ে নিজের মনকে শান্ত করতে। ”

নিঃশব্দে ওঠে দাঁড়াল রুদ্র। ব্ল্যাক ট্রাউজার, ব্ল্যাক টি-শার্ট পরিহিত পেশিবহুল, সুঠাম দেহটি আজকে ভীষণ অভিলাষ পূর্ণ লাগছে। যেই অভিলাষী দৃশ্য হৈমীর অন্তঃকোণ শুঁকিয়ে চৈত্রের খরা সৃষ্টি করল। সেই খরায় এক ফোঁটা বৃষ্টির আশায় মাত্র একটিবার ঢোক গিলল সে। কেঁপে ওঠল দু’পায়ের পাতা, উঁচিয়ে রাখা তর্জনী। রুদ্র সন্তর্পণে হাত বাড়িয়ে সে তর্জনী নিজের মুঠোয় করে নিল। দু-চোখ শক্ত করে বুজে ঠোঁট কাঁপিয়ে হৈমী বলল,
-” আমি কিছু বলিনি, আমি কিছু করিনি। ”

প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বক্র হাসিতে ঠোঁটজোড়া চঞ্চল হলো রুদ্রর। মাথা নিচু করে হৈমীর গোলগাল ছোট্ট মুখের সম্মুখে ঠোঁটজোড়া নিয়ে সিগারেটের গন্ধযুক্ত উত্তপ্ত নিশ্বাস ছাড়ল। নিমিষেই হৈমীর বক্ষঃস্থলের ওঠানামা বেগতিক ভাবে বেড়ে গেল। শক্ত কাঠের ন্যায় চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল সে। রুদ্র তার বেসামাল চিত্তকে আরো বেশি বেসামাল করে দিতে পুনরায় উত্তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
-” আমাকে জ্বালাতে এলে নিজেই জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে সুইটহার্ট! ”

চলবে…

#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১৬
কলেজ যাবার পথে রিকশায় বসে অন্যমনস্ক হৈমী। ভাবছিল, শেখ বাড়িতে তার আয়ুকাল আর মাত্র তিনদিন। মাহের ফেরার পর নিজের বাসায় ফিরতে হবে। এই ফিরে যাওয়া আনন্দের হওয়ার কথা ছিল। যেখানে সে শেখ বাড়িতে আসতে, ক’দিন থাকতে রাজিই ছিল না, সেখানে তিনদিন পর ফেরার কথা ভাবতে খুশিতে গদগদ হওয়ার কথা। অথচ সে খুশি নয়, তার মন বিন্দু মাত্র আনন্দিত হচ্ছে না৷ বরং সুক্ষ্ম এক ব্যথায় হৃদয়স্থল চিনচিন করছে৷ যে ব্যথার উৎসে রয়েছে রুদ্র। একটি মেয়ে একটি ছেলের কাছে অ্যাটেশন পেতে চাচ্ছে, চাতক পাখির মতো কদিন ধরে ঘুরঘুর করছে একটুখানি অ্যাটেশন পেতে অথচ পাচ্ছে না। এ দহন যে বড়োই ভয়াবহ। রিকশা চলছিল তার আপন গতিতে। হৈমীও রুদ্রকে ঘিরে ভাবনার রাজ্য ডুবে ছিল। সে ডুবে থাকার মাঝেই গোলাপি কোমল ওষ্ঠজোড়া নড়িয়ে বিরবির করল,
-” আমি আপনাকে শুধু একটা চিঠি দিয়েছিলাম। চিঠির কথাগুলো যতটা না সিরিয়াস ছিল, তারচেয়ে বেশি দুষ্টুমিই ছিল। কিন্তু এর ফল আমাকে কঠিন ভাবে ভুগিয়েছেন আপনি। যে কাঠিন্যতা বিষবীজ হয়ে আমার হৃদয়ে রোপণ হয়েছিল। সে বীজ অঙ্কুরিত হতে পারল না৷ আপনি হতে দিলেন না। ভেবেছিলাম আপনাকে নিয়ে আজীবন হৃদয়ে বিষবৃক্ষ লালন করব। ঘটল উলটোটা এর জন্য আপনিই দায়ী। এবার এই ছোট্ট হৃদয়ে প্রেমতরঙ্গ বয়ে আনার অপরাধে সারাজীবন অপরাধী করে রাখব আপনাকে। একটুও ক্ষমা করব না একটুও না।”

আপনমনে ভীষণ লজ্জিত হলো হৈমী। ছোট্ট করে নিশ্বাস ছেড়ে উরুর ওপর দুহাত জোড়া করে থমথমে মুখে বসে রইল। গাল দুটো টমেটোর মতো ক্রমশ লাল হতে থাকল তার৷ শরীর জুড়ে অদ্ভুত এক শিহরণ জাগছে, নিঃশ্বাসে বাড়ছে গভীরতা। অন্তঃকোণে যেন সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ দোলায়িত। সন্তর্পণে এক ঢোক গিলল সে জ্যামে আঁটকে রইল কয়েক মিনিট। জ্যাম ছাড়ার পর পুনরায় রিকশা টান দিতেই আকস্মাৎ রুদ্রকে দেখতে পেয়ে বুকের ভিতর ধড়াস করে ওঠল৷ শহরের এক নাম করা রেষ্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে রুদ্র৷ হৈমীর বুকের ভিতর ধড়াস, ধড়াস ক্রমশ বাড়তেই থাকল। রিকশাওয়ালাকে বলল,
-” মামা মামা থামেন থামেন৷ একটু দাঁড়ান একটু দাঁড়ান। ”

রিকশা থামল। হৈমীও দূর থেকে সুক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে রইল৷ পিটপিট করে তাকিয়ে আপাদমস্তক রুদ্রকে দেখতে লাগল। মিনিট দুয়েক পর একটি রিকশা এসে থামল রুদ্রর সামনে। মুহুর্তের মধ্যেই রিকশা থেকে নেমে এলো এক সুদর্শনীয় রমণী। চঞ্চলা চিত্ত সহসা মিইয়ে গিয়ে চোখেমুখে বিবর্ণতা ফুটে ওঠল হৈমীর৷ কিঞ্চিৎ বিস্মান্বিতও হলো। রুদ্র তো অমন ছেলে নয়। আবার ভাবল কেমন ছেলে নয়? যে ছেলে অল্প পরিচয়ে তার সঙ্গে ওসব করতে পারে সে কি পারে না আরে ডজনখানেক মেয়ের সঙ্গে বেহায়াপনা করতে? তাহলে সূচনা কেন বলেছিল তার ভাই নারীবিদ্বেষী! এই কী তাহলে তার নমুনা। কেন জানি কান্না পেল খুব৷ কিন্তু কেন পেল কান্না? প্রশ্নের উত্তর মেলাতে পারল না। শেষে আপনমনেই বিরবির করল,
-” উনার এত সাহস ডজনখানেক মেয়ের সঙ্গে বদমায়েশি করবে! যদি তাই করবে আমার সঙ্গে লুতুপুতু করল কেন? আমাকে যে অতগুলো চুমু খেল তার কী হবে? প্রয়োজনে আমি মামলা করব তবুও এত মেয়ের সঙ্গে লুতুপুতু করতে দিব না৷ কিন্তু মামলা করলে তো প্রুফ লাগবে, হ্যাঁ প্রুফ আছে ঐ যে সেই ভিডিয়েটা। ”

-” কই যাবেন, রিকশা টানুম? কিছু কন না ক্যা? ”

চমকে ওঠল হৈমী। ওষ্ঠাধর ফাঁক করে লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ল। এরপর তড়িঘড়ি করে রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে মাথায় ওড়না চেপে মুখে মাস্ক লাগালো৷ ততোক্ষণে রুদ্র ধীরেধীরে আগত নারীটির সঙ্গে রেষ্টুরেন্টের ভিতরে প্রবেশ করেছে। হৈমীও ত্বরিত গতিতে রেষ্টুরেন্টের ভিতরে ঢুকল৷ দেখল রুদ্র একেবারে কর্ণারের টেবিলে মেয়েটার মুখোমুখি হয়ে বসেছে৷ দূর থেকে মেয়েটার মুখ যতটুকু দেখেছে আর পেছন থেকে যতটা দেখছে নিঃসন্দেহে মেয়েটা ভীষণ স্মার্ট এবং সুন্দরী। যার ফলে তীব্র ঈর্ষায় কপালের রগ গুলো দপদপ করে ওঠল হৈমীর৷ কোনক্রমে একপাশে গিয়ে বসে মেনুকার্ড দেখার ভাণ ধরল। আড়াল থেকে তীক্ষ্ণ নজর রাখলো পেছনের রুদ্র এবং আগত নারীটির দিকে। দশমিনিটের মাথায় এক কাপ কফি অর্ডার করল। কফি খাওয়ার মুড নেই তবুও রুদ্র আর তার সম্মুখের মেয়েটিকে কফি খেতে দেখে সে নিজেও অর্ডার করল। আধঘন্টার মতো আলাপচারিতা শেষে মৃদুহাস্য ওঠে দাঁড়াল রুদ্র। হৈমী খেয়াল করল মেয়েটার ঠোঁটেও মৃদু হাসি। হাসির ফাঁকে বার বার রুদ্রর দিকে তাকাচ্ছেও। ঘনঘন সামনে আসা চুলগুলো কানে গোঁজারও চেষ্টা করছে৷ যা দেখেই গা জ্বলে ওঠল হৈমীর৷ বিরবির করে কতক্ষণ বকলও। সুন্দরী মেয়েটা আগে আগে বেরিয়ে পড়ল। রুদ্র বিল মিটিয়ে বেরোতে যেয়েও হঠাৎ ভ্রু কুঁচকে ডানপাশে তাকাল। হৈমীর আড়চোখে রুদ্রকে তার দিকে তাকাতে দেখে খটমটে ভাব শুরু করে দিল৷ এই ওড়না টানছে, এই মাস্ক ঠিকঠাক মুখে আছে কিনা দেখছে, এই ফোন ঘাঁটছে। বিরবির করে আবার দোয়া দরূদও পড়তে শুরু করল৷ রুদ্র হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে ফোন বের করে কিছুক্ষণ পূর্বে মিট করা মেয়েটিকে ফোন করল। ওপাশে রিসিভ হতেই বলল,
-” মিসেস. নিশিতা, আমার ইমারজেন্সি একজনের সঙ্গে মিট করতে হবে। তাই আপনাকে পৌঁছে দেয়ার কথা থাকলেও পারলাম না। ”

-” ইট’স ওকে ব্যাপার না। ”

ফোনে কথা শেষ করে যেই রুদ্র হৈমীর সামনে যেতে উদ্যত হলো অমনি তড়াক করে ওঠে দাঁড়াল হৈমী৷ কোনক্রমে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করে রেষ্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। অমনি সত্বর হয়ে হৈমীর হাত টেনে ধরল রুদ্র। রেষ্টুরেন্টে কয়েক জোড়া কাপল ছিল তারা সকলেই তাকাল ওদের দিকে। কারো কারো চোখে বিস্ময়। হৈমী মুখ নিচু করে হাত ছোটানোর চেষ্টা করল। রুদ্র শান্ত গলায় শক্ত হুমকি দিল,
-” নো ছোটাছুটি ডার্লিং। এতক্ষণ যেখানে চোরের মতো বসে ছিলে এখন ঠিক সেখানে গিয়েই বসবে। একদম ভদ্র মেয়ের মতো৷ নয়তো সকলের সামনে একটি মিষ্টি, রোমাঞ্চিত সিনক্রিয়েট হবে। ”

কিঞ্চিৎ ভয়ে দেহ কেঁপে ওঠল। বারকয়েক ঢোক গিলে স্থির হয়ে গেল হৈমী৷ দুর্বোধ্য হেসে রুদ্র ইশারা করল বসতে। কাঁদো কাঁদো হয়ে হৈমী গিয়ে বসল। রুদ্রও শান্তরূপে তার সম্মুখে বসে। হৈমীর থমথমে রক্তিম মুখশ্রীতে নিবিড় চাহনি নিক্ষেপ করল। শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
-” কী অর্ডার দেব? ”

হৈমী মুখ ফিরিয়ে রইল। রুদ্র উত্তরের অপেক্ষা করল না। নিজের জন্য কফি, হৈমীর জন্য স্যান্ডউইচ অর্ডার করে দিল। হৈমী চাপা স্বরে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,
-” আমার কলেজ আছে। আমি কলেজ যাব। ”

বাঁহাতের কব্জিতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে টেবিলের ওপর দু-হাত রেখে কিছুটা ঝুঁকে বসল রুদ্র। হৈমী জড়োসড়ো হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। রুদ্র বলল,
-” ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আমার পিছু নিচ্ছ। আমি বুঝি এতটাই জরুরী? ”

-” একদম বাজে কথা বলবেন না৷ আপনার পিছু নিইনি আমি। শুনুন আমি জাস্ট আপনার আসল রূপটা দেখতে এসেছিলাম। আর কিছুই নয়। আপনি যে কত ধরনের খারাপ লোক হারে হারে টের পেয়েছি। ”

-” এত তাড়াতাড়ি কীভাবে টের পেলে? ”

তীব্র রোষাগ্নিতে তাকিয়ে হৈমী বলল,
-” আপনার গার্লফ্রেন্ড জানে তো আপনি আরেকজনের কী সর্বনাশ করেছেন? ”

ভ্রু কুঁচকে রুদ্র বলল,
-” মানে? ”

-” ওওও এখন মানে বুঝছেন না। দুধে ধোঁয়া তুলসী পাতা হয়ে গেছেন। আমার কাছে সব প্রমাণ আছে। জোর করে চুমু খেলেন আমাকে আর রেষ্টুরেন্টে এসে লুতুপুতু করছেন ঐ মেয়ের সঙ্গে! ”

চোখ বড়ো বড়ো করে চাপা ধমক দিল রুদ্র। বলল,
-” শ্যাট আপ! ক্লাস বাদ দিয়ে এখানে কেন? তোমার আদর্শ ভাই জানে এসব? ”

-” উচিৎ কথা বলছি বলে ধমকাচ্ছেন? ঐ মেয়েটা কে? রেষ্টুরেন্টে মেয়ে এনে এসব করে বেড়ান বাড়ির লোক জানে? ”

রুদ্র সোজা হয়ে বসল। মুখ গম্ভীর। হৈমী তার দিকে তাকিয়ে ছিল। রুদ্র সে তাকানোতে গম্ভীর চাহনি নিক্ষেপ করল৷ হৈমী এক ঢোক গিলে বলল,
-” আমি কলেজ যাব৷ ”

রাশভারী কণ্ঠে রুদ্র বলল,
-” ক্লাস শুরু হয়েছে আধঘন্টা আগে। ”

-” আমি বাড়ি যাব। ”

-” কোন বাড়ি? ”

-” ভাবি…”

-” এসো। ”

হৈমী ওঠে দাঁড়াল। ওঠল রুদ্র নিজেও। বিল মিটিয়ে দিয়ে বের হলো সে। গাড়ির কাছে গিয়ে হৈমীকে ইশারা করল আসতে৷ হৈমী চটপটে পায়ে এগিয়ে এসে বলল,
-” শুনুন আপনাকে আমি একটা কথা বলতে চাই। যদি শুনেন আপনারই মঙ্গল। ”

রুদ্র গাড়িতে ওঠে সামনের ডোর খুলে দিল। বলল,
-” ওঠো। ”

সিটে বসার পর ডোর লক করতে পারল না হৈমী৷ রুদ্র ঝুঁকে এসে লক করতেই হৈমী দম বন্ধ করে কাচুমাচু হয়ে বসে রইল। রুদ্র সরে যাওয়ার পর একেবারে নিঃশ্বাস ছাড়ল। গাড়ি স্টার্ট হলো শেখ বাড়ির উদ্দেশ্যে৷ হৈমী আড়চোখে গম্ভীর চিত্তে বসে থাকা রুদ্রর পানে তাকাল। স্টিয়ারিংয়ে থাকা বলিষ্ঠ হাতদুটো একবার দেখল তো আরেকবার দাম্ভিক এবং গম্ভীর মুখটায় দৃষ্টিপাত করল। এরপর বারকয়েক নিঃশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করল,
-” দেখুন আপনি কিন্তু এসব একদম ঠিক করছেন না। আমি না হয় ঘরের মেয়ে, আমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। ঘরের মেয়ের দিকে নজর যেতেই পারে তাই বলে পরের মেয়ের দিকেও নজর দেবেন? আপনি আবার ভাববেন না আমি আপনাকে পছন্দ করি। আপনার মতো মানুষকে পছন্দ করার প্রশ্নই আসে না। চুপিচুপি আপনার পিছু এসেছি বলে ভাববেন না আমি আপনার প্রতি ইন্টারেস্টেড। এসব একেবারেই নয়৷ কিন্তু আপনি আমার সাথে যেসব করেছেন ওসবও ভুলার মতো নয়৷ ঐসব ভেবেই আমি চিন্তিত। আমি শান্তশিষ্ট, ভদ্র একটা মেয়ে। আজ পর্যন্ত একটা প্রেমও করিনি৷ একটা ছেলে আমাকে ছুঁয়েও দেখেনি৷ সেখানে আপনি আমার সঙ্গে যা করেছেন তা কি ভুলার মতো? একবার ভাবুন তো কোন ছেলে এসব জানলে আমাকে বিয়ে করবে? আমার বিয়ে হবে? ”

আকস্মাৎ গাড়ির ব্রেক কষলো রুদ্র। হৈমী চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল তার দিকে। রুদ্র কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-” সারমর্ম বলো? কথার সারমর্ম জানতে চাই। ”

বারকয়েক ঢোক গিলে চটপটে গলায় বলল,
-” আপনি যেসব করেছেন এরপর আপনাকে আমার ক্ষমা করা উচিৎ না৷ শাস্তি দেয়া উচিৎ। ”

-” শাস্তি? দাও। ”

হৈমী শান্ত হয়ে এলো। রুদ্রর ভাবমূর্তি কিছু না বুঝে বলল,
-” আপনি কি এখনো আমাকে পছন্দ করেন? ”

মুহূর্তেই পরিবেশ নরম হয়ে ওঠল। একটি সহজসরল বাক্যই তৈরি করল সেই নম্রতা। রুদ্রর কান দুটো ঝিম ঝিমিয়ে রইল। হৈমীর দিকে তাকিয়ে রইল নরম চোখে নির্নিমেষে। হৈমী আমতাআমতা করে বলল,
-” ওভাবে তাকাচ্ছেন কেন? ভাবির কাছে সব শুনেছি আমি সব। আপনার হঠাৎ পরিবর্তনের কারণটাও জানি। ”

-” না পছন্দ করি না। ”

অপমানে থমথমে হয়ে বলল,
-” তাহলে কাকে পছন্দ করেন ঐ মেয়েকে? ”

বাঁকা হাসলো রুদ্র। হৈমী ক্রোধান্বিত হয়ে বলল,
-” আমি ঐ মেয়েকে সব বলে দিব। ”

-” কী বলে দেবে? ”

-” আপনি যা করেছেন। এসব জানলে নিশ্চয়ই উনি আপনার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না। ”

রুদ্র মাথা নাড়িয়ে বোঝাল না। হৈমী উল্লসিত চোখে তাকাল। রুদ্র বাঁকা হেসে সহসা হৈমীর দিকে ঝুঁকে এলো। একথোকা উত্তপ্ত নিশ্বাস হৈমীর মুখশ্রীতে ছেড়ে বলল,
-” সেবার যা ছিল সবটা ঝোঁকের বশে করে ফেলা ভুলমাত্র। আজ যা হবে একদম ঠান্ডা মাথায় সুস্থ মনে। ”

বলতে বলতেই নিমেষে হৈমীর কপোলদ্বয়ে বলিষ্ঠ হাতদ্বারা আবদ্ধ করে নিল। কেঁপে ওঠল হৈমীর কোমল ঠোঁটজোড়া। সে কাঁপা দৃশ্য দীর্ঘসময় নিয়ে দেখার ধৈর্য্য হলো না রুদ্রর৷ নিজের পুরু ওষ্ঠাধর ফাঁক করে সন্তর্পণে নরম অধর আবৃত করে নিল। এঁটে দিল হৃদয়স্পর্শী উত্তপ্ত গাঢ় চুম্বন। হৈমীর ছোট্ট নরম হৃদয়ে লিখিতভাবে নামকরণ করে দিল শুধুই রুদ্র রুদ্র রুদ্র।

চলব…