বেসামাল প্রেম পর্ব-২৪+২৫

0
114

#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২৪
রুদ্র সিদ্ধান্ত নিল এবার হৈমীকে নিয়ে শাশুড়ি, বোন জামাইয়ের মুখোমুখি হবে। কিন্তু শঙ্কিত হৈমী লাগামহীন অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। অতিরিক্ত ভয়ে মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম। নয়ন তাকে থামাতে পারছে না। সাদমান চিন্তিত ভঙ্গিতে ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে। ঝিনুক তাকিয়ে আছে রুদ্রর গম্ভীর মুখটাতে। বোঝার চেষ্টা করছে তাদের বসের মনোভাব। রুদ্র তাকিয়ে তাকিয়ে কতক্ষণ হৈমীর কান্না দেখল। এরপর বিরক্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। বিরবির করে বকা দিল হৈমীকে,
-” ইডিয়ট! ”

ক্ষণকাল পর হৈমীর কর্ণগোচর হবে এমন স্বরে দৃঢ়চিত্তে বলল,
-” কেঁদে লাভ নেই। যা ঘটার ঘটে গেছে। ”

সহসা কান্না থেমে গেল হৈমীর। নাক টেনে রুদ্রর রাশভারি মুখটায় তাকিয়ে মিনমিনে স্বরে বলল,
-” আপনার ভয় লাগছে না? ”

উত্তর দিল না রুদ্র। নিঃশব্দে ওঠে দাঁড়িয়ে বলল,
-” চলো ”

আঁতকে ওঠে হৈমী বলল,
-” কোথায়? ”

-” আমার শাশুড়ির বাড়িতে! সুসংবাদটা দিতে হবে না? ”

আতঙ্কিত স্বরে হৈমী বলল,
-” আমি যাব না। ”

-” বেশ তাহলে তোমার শশুর বাড়ি চলো। ”

দু-হাত পকেটে গুঁজে দীর্ঘাকৃতির দেহটা টান টান করে দাঁড়িয়ে কথাটা বলল রুদ্র। বিচলিত হয়ে ওঠে দাঁড়াল হৈমী। বলল,
-” আমি কোথাও যাব না। ”

এবার রুদ্রর মেজাজ খারাপ হলো। মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
-” ফাইজলামি না করে যা বলি শোনো, চলো তোমার মা, ভাইকে বুঝিয়ে ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে আসি। নয়তো কালকে গণ্ডগোল বাঁধবে। ”

হৈমী স্থির চোখে তাকিয়ে। রুদ্র কথাগুলো বলেই যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। আকস্মাৎ হৈমী বলে ওঠল,
-” না না আপনি যাবেন না। ”

ভ্রু কুঁচকে তাকাল রুদ্র। হৈমী কিঞ্চিৎ কাঁপা স্বরে বলল,
-” আমি যাব, প্লিজ আপনি যাবেন না। আমি গিয়ে ভাইয়াকে বুঝিয়ে বলব সবটা। ভাইয়া আম্মুকে বলবে। ”

-” তুমি বোঝাবে! ”

বিশ্বাস হলো না রুদ্রর। ভরসা করতেও পারল না। তাই ভ্রু কুঁচকেই জিজ্ঞেস করল,
-” বোঝাতে পারবে? বলতে পারবে তাদের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করতে পারবে না। তোমার বিয়ে হয়ে গেছে আমার সঙ্গে? ”

ঘনঘন মাথা উপর নিচ করল হৈমী। রুদ্র তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ঝিনুককে বলল,
-” ঝিনুক রিকশা ডেকে আন। ”

ক্লাব থেকে বেরিয়ে হৈমী আর নয়ন গেল টেইলর্সে। তারা রিকশায় ওঠার পর রুদ্র গাড়ি স্টার্ট দিল। হৈমীর কাজ শেষ হবার পর বাড়ির পথে রিকশা ঘুরাতেই নয়ন খেয়াল করল তাদের পেছনে রুদ্রর গাড়ি। হৈমীদের বাড়ি থেকে বেশ দূরেই গাড়ি থামাল রুদ্র। দূর থেকে দেখল হৈমী, নয়ন দু’জনই নেমে বাড়ির ভেতরে ঢুকল। এ দৃশ্য দেখে স্বস্তি মনে সে ফিরে গেল৷ হৈমীকে পৌঁছে দিয়ে নয়নও ফিরে গেল।

ঘরে বসে প্রচণ্ড ছটফট করছিল হৈমী৷ সাহস দেখিয়ে খুব তো বলল মা, ভাইকে বোঝাবে বলবে। কিন্তু এখন যে সাহস করে ওঠতে পারছে না। অদ্ভুত এক শক্তি বলে তার সমস্ত সত্তা নির্জীব হয়ে আছে। কী হবে এবার? কী করে বলবে সবটা সবাইকে? হঠাৎ করে কী সব ঘটে গেল তার সঙ্গে এবার কোনদিকে মোড় নেবে জীবন?

রাতে খাবার সময় হামিদা খেয়াল করে মেয়েটা কেমন নির্জীব হয়ে আছে। ধারণা করে নিল আগামীকাল বিয়ে তাই তার এই নির্জীবতা স্বাভাবিক। খাওয়ার ফাঁকে মাহের আর হামিদার মধ্যে বিয়ে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা চলল। হৈমীকে কিছু বলা হলে সে শুধু হু, হা করে মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিল। অতিরিক্ত চুপচাপ ভাব দেখে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে মাহের একবার তার ঘরে এলো। সস্নেহে বোনের মাথায় হাত রেখে বোঝাল অনেক কিছুই। প্রথমে হৈমী মনে মনে তীব্র সাহস জুগিয়েছিল রুদ্র আর তার বিয়ের ব্যাপারটা বলতে। কিন্তু পরবর্তীতে মাহেরের আদর, স্নেহে তার সমস্ত সাহস পালিয়ে গেল। বুকের ভিতর হুহু করে ওঠল। একি করে ফেলল সে? তার মা, ভাই জানলে যে ভীষণ কষ্ট পাবে!

আমাদের আশপাশে এমন কিছু মানুষ আছে যারা অতিরিক্ত চিন্তার ফলে রাতে ঘুমাতে পারে না। এই চিন্তা নামক ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কত মানুষ নির্ঘুম রাত কাটায় হিসেব নেই। আবার এমন কিছু মানুষ আছে যাদের অতিরিক্ত চিন্তায় শুধু ঘুম পায়। জীবনের প্রতিটা প্রতিকূল পরিস্থিতি এরা দিব্যি ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। এই মানুষদের মধ্যে হৈমীর নামটি গাঢ় করেই আঁকা। তাই তো চিন্তা, ভাবনা করতে করতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল সে। রাত সাড়ে দশটায় ঘুমানো মেয়েটার ঘুম ভাঙল একদম সকাল আটটায়। যখন তার মা, আর ভাবি মিলে তার না হওয়া বরপক্ষদের জন্য রান্নার তোরজোর শুরু করেছে। টিশার চাচাদের পক্ষ থেকে বরসহ লোক আসবে মোট ছয়জন। ছ’জনের রান্না দু’জন মিলে শুরু করল৷ মাহের বাকি থাকা টুকটাক বাজার করতে গেছে। হৈমী ঘুম থেকে ওঠে ব্রাশ করে জড় বস্তুর মতো বসে রইল বিছানায়৷ গতকাল যে ভয়াবহ ঘটনাটি সে ঘটিয়েছে তা মনে পড়তেই ক্ষণে ক্ষণে সর্বাঙ্গ শিউরে উঠতে থাকল। চিন্তা করল আর সময় নষ্ট নয় এবার সবাইকে সবটা বলতেই হবে। তীব্র সাহস সঞ্চয় করে রুম ছেড়ে বেরিয়ে ভাইকে খুঁজল। সূচনা জানাল সে নেই বাজারে গেছে। ঠুস করে সাহস ফুরাতে শুরু করল তার। কিন্তু না এবার সাহস ফুরানোর আগেই সবাইকে সবটা বলতে হবে। ভাই নেই কী হয়েছে মা আছে, ভাবি আছে। প্রচণ্ড দ্বিধায় পড়ে রান্না ঘরে ঢুকল সে৷ খাবারের গন্ধে পেটের ভিতর ক্ষুধা ভাব সৃষ্টি হলো। হামিদা মেয়ের শুঁকনো মুখ দেখে জিজ্ঞেস করল,
-” ক্ষিদে পেয়েছে? ভাত দিচ্ছি খেয়ে নয়নকে ফোন দে। পার্লার তো যাবি না। ও এসেই সাজিয়ে দিবেনি।”

-” আম্মু তোমার সাথে আমার কথা আছে একটু এদিকে এসো। ”

এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল হৈমী। হামিদা সুক্ষ্ম নজরে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এলেন। দৃঢ়ভাবে জিজ্ঞেস করলেন,
-” কী হয়েছে? ”

মা’য়ের সুক্ষ্ম দৃষ্টি, দৃঢ় কণ্ঠস্বর শুনে গলা শুঁকিয়ে গেল। বারকয়েক ঢোক গিলে কথার খেই হারিয়ে ফেলল। বলল,
-” ক্ষিদে পেয়েছে। ”

হামিদা আচমকা হেসে ফেলল। বলল,
-” আমি তো তাই বললাম। তুই পারিসও আর বড়ো হলি না। আল্লাহ কবে যে একটু জ্ঞানবুদ্ধী দেবে। আজকের পর একটাই চাওয়া আমানের সাথে থেকে থেকে তোরও যেন ওর মতো জ্ঞান হয়, বুদ্ধি বাড়ে। ”
______
হৈমীকে বউয়ের সাজে সাজিয়ে সূচনা নিজের ঘরে এলো। দেখল উন্মুক্ত বক্ষে, গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে বেলকনি থেকে ঘরে প্রবেশ করল মাহের। সূচনাকে দেখে জিজ্ঞেস করল,
-” হৈমীকে রেডি করিয়েছেন? ”

মৃদু হেসে সূচনা এগিয়ে এলো বিছানায় বসে লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলল,
-” হ্যাঁ খুবই সিম্পল সাজ কিন্তু দেখতে ভীষণ গর্জিয়াস লাগছে। ননদ আমার মাশাআল্লাহ। ”

থমথমে মুখে সূচনার পাশে বসল মাহের। বলল,
-” খুব আদরের ও আমার। এত অল্প বয়সেই আদরটাকে বিয়ে দিতে হবে ভাবতে পারিনি। ”

মাহেরের কণ্ঠ ভারী লাগল খুব। সহসা সূচনা তার হাত চেপে ধরল। ভরসার সাথে বলল,
-” চিন্তা করবেন না। হৈমীর খুব ভালো হবে দেখবেন।”

চোখ দু’টো ভার হয়ে এলো মাহেরের। মাথা নিচু করে বলল,
-” বোনটা অনেক সহজসরল সূচনা। চিন্তা এজন্যই বেশি হচ্ছে। ”

সন্তর্পণে মাহেরের কাঁধে মাথা রাখল সূচনা। বলল,
-” যারা ভালো তাদের সঙ্গে সব সময় ভালোটাই হয় মাহের। আপনি চিন্তা করবেন না। ”

ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল মাহের। ঈষৎ হেসে বলল,
-” মুখটা ক্লান্ত লাগছে আপনার। অনেক বেশি খাটুনি হলো তাই না? ”

মাথা তুলে অকপটে জবাব সূচনার,
-” কই না তো ঠিক আছি। বাড়িতে একটা আয়োজন হচ্ছে এটুকু খাটুনি কোনো ব্যাপার না। ”

-” আচ্ছা গোসল সেরে নিন বেশি সময়ও নেই আর। ”

-” আপনি যাবেন তো। আমি পরে যাই। ”

গলায় ঝুলিয়ে রাখা তোয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল সূচনা৷ মাহের থম মেরে বসে থেকে আচমকাই প্রস্তাব রাখল,
-” চলুন একসঙ্গে যাই। ”

লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে তড়াক করে ওঠে দাঁড়াল সূচনা। আমতা আমতা করে বলল,
-” আপনি যান আমার আরো কিছু কাজ আছে সেরে আসি। ”

রুম ছাড়তে ত্বরিত বেগে দুপা বাড়াল সে। চট করে ওঠে খপ করে সূচনার হাত টেনে ধরল মাহের। বলল,
-” একটা ধৈর্য্যশীল পার্টনার পেয়েছেন বলে বেশ আয়েশ করে পালাই পালাই করতে পারছেন। একটাবার ধরা দিয়ে দেখুন, এই পালাই পালাইয়ের রিভেঞ্জ কীভাবে নিই। ”

এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে পালিয়ে গেল সূচনা। চাপা স্বরে বলে গেল,
-” এজন্যই ধরা দিচ্ছি না! ”

বিস্মিত হয়ে দরজার পানে তাকিয়ে রইল মাহের। ক্ষণকাল অতিবাহিত হওয়ার পর মাথা চুলকে, ঠোঁট কামড়ে আনমনে হেসে ফেলল। বিরবির করে বলল,
-” তো ম্যাডাম এই ব্যাপার? আচ্ছা, বিষয়টা হৃদয়ে গোপন রেখে দিলাম। ”
___________
হঠাৎ করেই বাড়িতে রুদ্রর আগমন! আতঙ্কিত হয়ে পড়ল হামিদা, মাহের দু’জনই। রুদ্র খুবই সাবলীল ভঙ্গিতে এসে বসার ঘরে বসল। মাহেরকে জিজ্ঞেস করল,
-” সূচনা কোথায়? ”

মাহের এগিয়ে এসে জানাল সূচনা গোসলে গেছে। রুদ্র এরপর প্রশ্ন করল,
-” আমার বউ কোথায়? ফোন বন্ধ কেন ওর? ”

নিমিষেই পুরো বাড়িতে বজ্রপাত ঘটল। রুদ্র খুবই স্বাভাবিক, শান্ত হয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে। অশান্ত হলো মাহের। মায়ের হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলল,
-” রুদ্র সিনক্রিয়েট করবেন না। ”

সহসা ওঠে দাঁড়াল রুদ্র। হাঁক ছেড়ে ডাকল,
-” হৈমী, হৈমী, হৈমী… ”

ভেতরের ঘরে বসে থাকা হৈমীর এই হাঁকডাক শুনে
অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠল। তড়াক করে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে শুরু করল সে। নয়নকে বলল,
-” নয়ন আমার মাথা ঘোরাচ্ছে প্লিজ তুই আমাকে ধর। ”

মাহের আজ প্রচণ্ড রেগে গেল। যে কোনো সময় তাদের মেহমানরা এসে পড়বে। যে করেই হোক তার পূর্বে রুদ্রকে বিদায় করতে হবে। নয়তো সবটা মেনে নিয়ে আত্মীয় হিসেবে পাশে থাকতে হবে। সব ভেবে চিন্তে মাহের উচ্চস্বরে সূচনাকে ডাকল। এ প্রথম মাহেরের এমন ডাকে বিচলিত হয়ে ছুটে এলো সূচনা। এসেই রুদ্রকে দেখে চিত্ত চমকে ওঠল। মাহের প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে বলল,
-” প্লিজ আপনার ভাইকে বোঝান। ”

রুদ্রর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। শক্ত চোখে মাহেরের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” বউ নিতে এসেছি। কারো বোঝাবুঝি শুনতে আসিনি।”

-” ভাইয়া এসব কী বলছ! ”

সূচনার বিস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে রুদ্র বলল,
-” গতকাল আমাদের বিয়ে হয়েছে সূচনা। যেখানে আমি মরে গেলেও কেউ ওর দ্বিতীয় বিয়ে দিতে পারবে না, সেখানে বেঁচে থাকা অবস্থায় তোরা দ্বিতীয় বিয়ে দিচ্ছিস! ”

মাহের নিজের ক্রোধটুকু নিয়ন্ত্রণে এনে শান্ত গলায় রুদ্রকে বোঝাতে লাগল৷ কিন্তু রুদ্র নিজের কথায় অটল। রুদ্রর ভাবগতিক বুঝে সূচনা মাহেরকে বলল,
-” দেখুন ভাইয়া যেমনি হোক সে মিথ্যা বলার মানুষ না। আপনি প্লিজ হৈমীর কথাটা একবার শুনুন। কাল থেকে হৈমীকে খেয়াল করছি আমার মন বলছে ভাইয়ার কথাটা সত্যি। ”

সূচনার কথা শুনে হামিদা ছুটে গেল মেয়ের ঘরে। এক প্রকার হামলে পড়ল মেয়ের ওপর। চিৎকার, চ্যাঁচামেচি করে একের পর এক জিজ্ঞেস করতে লাগল। ভয়ে ঘাবড়ে গিয়ে হৈমী গতকালের বিয়েটা অস্বীকার করে দিল। দরজার বাইরে হৈমীর কথা শুনে স্বস্তি পেল মাহের। ফিরে গিয়ে রুদ্রকে কঠিন স্বরে হৈমীর অস্বীকারের কথা জানাল। বলল,
-” এবার প্লিজ আর ঝামেলা করবেন না। আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্কটা নষ্ট করবেন না। নিজের বোনের কথা ভাবুন। আপনার বাড়াবাড়ি যদি না থামে তাহলে আমাকে আমার ভদ্রতা ভুলে যেতে হবে। আপনার সঙ্গে পুরোপুরি সম্পর্ক ত্যাগ করতে বাধ্য হতে হবে। মনে রাখবেন আমার সঙ্গে আজ সূচনাও জড়িয়ে। স্ত্রী হিসেবে সে নিশ্চয়ই আমার কথার অবাধ্য হবে না। ”

মেজাজ বিগড়ে গেল রুদ্রর। দাঁতে দাঁত চেপে মাহেরকে কিছু বলতে উদ্যত হয়েও সূচনার চোখের পানি দেখে দমে গেল। কাউকে তোয়াক্কা না করে বড়ো বড়ো পা ফেলে ছুটে গেল হৈমীর রুমে। রুদ্রকে ঝড়ের গতিতে রুমে প্রবেশ করতে দেখেই হৈমীর শ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। রুদ্র সরাসরি ওর সামনে গিয়ে রক্তিম চোখে তাকিয়ে ক্রোধে চোয়াল শক্ত করে, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-” তোমার সঙ্গে বোঝাপড়া আমি পরে করব। বিয়ে যখন করেছি, বউ যখন হয়েছ প্রাইভেটলি অবশ্যই বোঝাপড়া হবে। এই অজ্ঞতার চরম মূল্য দিতে হবে তোমায়। সো বি প্রিপেয়ার্ড সুইটহার্ট! এবার তোমার মিথ্যাবাদীতার প্রমাণ দিই কেমন? ”

দরজার বাইরে এসে উপস্থিত মাহের, সূচনা, হামিদাকে দেখে ফোন করল ঝিনুককে। মিনিট দেড়েক পরই ফাইল ভর্তি কাগজপত্র নিয়ে ঝিনুক এলো। রুদ্র এবার বেশ উঁচু গলায় বলল,
-” ঝিনুক রেজিস্ট্রি পেপার গুলো দেখাও। ”

ঝিনুক একে একে দেখাল মাহেরকে। সবটা দেখে দাঁড়িয়ে থাকা মাহের শরীর ছেড়ে বসে পড়ল। হামিদা মুখে আঁচল চেপে উচ্চরবে কেঁদে দিল। রুদ্র চুপ থাকল না। কাগজপত্র দেখানো শেষে গতকালকের বিয়ের সম্পূর্ণ ভিডিয়ো দেখাল মাহের, সূচনাকে।

পুরো বাড়ি স্তব্ধ। এই স্তব্ধতাকে কাটিয়ে মাহের পকেট থেকে ফোন বের করল। আমানের বাবার নাম্বারে কল করে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। এদিকে নিজের দূর্ভাগ্যকে মেনে নিয়ে সর্ব সম্মুখে হামিদা হৈমীর গালে কষিয়ে একটা থাপ্পড় দিল। ডুকরে ওঠল হৈমী। হামিদা ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
-” অনেক বড়ো হয়ে গেছিস, নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারিস, যা তোর স্বামী এসেছে তোকে নিতে চলে যা। ”

আচম্বিত হামিদার পা দুটো জড়িয়ে ধরল হৈমী। হেঁচকি তুলে কেঁদে বলল,
-” আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও আম্মু। আমি যাব না বিশ্বাস করো আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না। ”

পা ঝাড়া দিয়ে হামিদা বলল,
-” কে তোর মা? আমার তো কোনো মেয়ে নেই। আমার মেয়ে তো মরে গেছে। যাকে ন’মাস গর্ভে ধারণ করে জন্ম দিয়েছি সে আজ থেকে আমার কাছে মৃত। ”

কথাগুলো বলেই হামিদা সূচনাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-” বউ মা, যদি আমার ছেলের সংসার করার ইচ্ছে থাকে তোমার ভাইকে বলো তার বউকে নিয়ে এক্ষুনি বেরিয়ে যেতে! ”

করুণ চোখে সূচনা রুদ্রর দিকে তাকাল। রুদ্র সূচনাকে বলল,
-” ওকে নিয়ে আয়, আর তুইও আমার সঙ্গে যাবি। ”

-” ভাইয়া প্লিজ তুমি পাগলামি করো না। মা রেগে আছে, মাহের আসুক তুমি শান্ত হও। ”

মাহের এসে তার মায়ের বক্তব্য শুনে সূচনাকে বলল,
-” আপনি হৈমীকে নিয়ে আসুন। ”

সূচনা অবাক হলো। সে অন্তত মাহেরের থেকে এ আচরণ আশা করেনি। তার অবাক দৃষ্টি দেখে মাহের বলল,
-” ভুল করেছে শাস্তি পেতেই হবে। কারণ মা’কে বোঝানোর সাধ্য আজ আমার নেই। কেন নেই এই উত্তর সেদিন পাবেন যেদিন আপনি মা হবেন। আমার মাকে ভুল বোঝার আগে মনে রাখবেন, বাবার মৃত্যুর পর তার বেঁচে থাকার অবলম্বনই ছিলাম আমি আর বোন। ”

মাহেরের কথায় হৈমীকে নিয়ে এলো সূচনা। মাহের হৈমীর মাথায় হাত রেখে বলল,
-” বোনরে ভালো থাকিস। ”

আর কিছু বলতে পারল না মাহের। ঠোঁট কামড়ে কান্না আঁটকে ঘরে চলে গেল। হৈমী বিধ্বস্ত মুখে সূচনাকে বলল,
-” আমি যাব না। ”

সূচনা বলল,
-” সব ঠিক হয়ে যাবে হৈমী। তুমি ভাইয়ার সঙ্গে যাও।”

হঠাৎ করেই রুদ্র হৈমীর হাত চেপে ধরল। সূচনাকে বলল,
-” তুই মাহেরকে সামলা, একে আমি দেখে নিব। ”

বলেই হিড়হিড় করে টানতে টানতে বেরিয়ে গেল রুদ্র। নয়ন হতবুদ্ধি শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নিজেকে ভীষণ অপরাধী অনুভব করল সে। আর এক মিনিট এখানে নয়। এক্ষুনি চলে যেতে হবে।

সূচনা যখন ঘরে এলো দেখল মাহের মেঝেতে হাত, পা ছড়িয়ে বসে আছে। স্বামীর এমন অবস্থা দেখে বুকের ভিতরটা চিনচিন করে ওঠল তার। ধীরপায়ে এগিয়ে এসে নিঃশব্দে পাশে বসল। কাঁধে হাত রেখে ক্ষীণ স্বরে বলল,
-” মাহের আপনি শক্ত হন, শান্ত হন। আমি জানি ভাইয়া উদ্ধতস্বভাবের কিন্তু অমানুষ নয়। তার মাধ্যেও ভালোবাসা আছে মায়া আছে। হৈমী কোনো ক্ষতিকারক মেডিসিন সেবন করেনি যে এভাবে ভেঙে পড়বেন। প্লিজ মাহের, প্লিজ। ”

আকস্মাৎ সূচনাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলো মাহের। সূচনাও চমকে ওঠে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। বার বার করে বলতে লাগল,
-” প্লিজ শান্ত হন, প্লিজ। ”
__________
হৈমীকে গাড়িতে বসিয়ে হঠাৎ আবার টেনে ওঠাল রুদ্র। ভয় ভয় চোখে হৈমী তাকাল রুদ্রর কঠিন মুখের দিকে। রুদ্র তার রক্তিম দৃষ্টিজোড়া তীক্ষ্ণ করে হৈমীর ডান গালটা নিরীক্ষণ করল। স্পষ্ট দেখতে পেল লালচে দাগগুলো। যা তার ক্রোধের মাত্রা দ্বিগুণ করে দিল।হৈমীর বাহু চেপে রাখা হাতটা আরো শক্ত হলো। ব্যথায় অসহনীয় হয়ে ওঠল হৈমী। রুদ্র ক্রোধী স্বরে বলল,
-” কাল যদি ভুলটা না করতাম আজ এটা দেখতে হতো না। ”

বলেই এক প্রকার ছুঁড়ে ফেলল হৈমীকে। মেয়েটা ভয়ের তাড়নায় জড়োসড়ো হয়ে বসে রইল। ডোর লোক করার পূর্বে রুদ্র আবারো বলল,
-” আশা করি এই থাপ্পড়টা জন্মের মতো এ বাড়ির স্বাদ মিটিয়ে দিয়েছে। ”

রুদ্র কখনো মায়ের ভালোবাসা পায়নি। মা’দের নিয়ে মসৃণ কোনো অনুভূতিই তার মধ্যে কাজ করে না। তাই তো হামিদার দেয়া থাপ্পড়টাকে সে অপমান, আঘাত হিসেবে ধরে নিল। অথচ হৈমী জানে কতটা তীব্র কষ্ট থেকে তার মা তার গায়ে হাত তুলেছে।

গাড়ি বাড়ির পথে স্টার্ট করলেও বাড়ি যাওয়া হলো না। কারণ মাঝপথেই দাদিন কল করে রুদ্রকে জানায়, যে বাড়িতে তাদের মেয়ে দিয়েছে সে বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করে সে বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করা তার উচিৎ হয়নি৷ যে পর্যন্ত সূচনার শাশুড়ি হাসিমুখে এই বিয়ে মেনে না নেবেন, রুদ্রকে মেয়ের জামাই হিসেবে গ্রহণ না করবেন, সে পর্যন্ত যেন শেখ বাড়ি না ফেরে। যদি ফেরে তৎক্ষনাৎ গৃহত্যাগী হবেন তিনি৷ তাই যেন ভালোই ভালোই মাহের আর হামিদার কাছে ক্ষমা চেয়ে, মাথা নত করে তাদের সন্তুষ্টি নিয়ে তাদের মেয়েকে শেখ বাড়ি নিয়ে আসে।

দাদিনের এসব কথায় ঘাড়ত্যাড়া রুদ্র কান দিল না। ক্ষমা চাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠেনা। কারণ সে ভুল কিছু করেনি। যদি ভুল কেউ করে থাকে করেছে মাহের আর তার মা। গোপনে হৈমীর বিয়ে ঠিক করে চরম অন্যায় করেছে তারা। যার শাস্তি সে তাদের দিয়ে দিয়েছে।

টাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ডে পনির আর ঝিনুক দাঁড়িয়ে ছিল। রুদ্রর গাড়ি এসে তাদের সামনে থামল। ড্রাইভিং সিট থেকে বেরিয়ে এলো সে। ঝিনুক গিয়ে বসল ড্রাইভিং সিটে পনির তার বাম পাশে বসল। রুদ্র পেছনের ডোর খুলে বধূ সাজে কাচুমাচু হয়ে বসা হৈমীর দিকে তাকাল। ধীরেসুস্থে গিয়ে বসল তার পাশে। লাল, সাদা সংমিশ্রণের বেনারসি পরিহিত হৈমীকে দেখে মেজাজ কিছুটা শান্ত হলো। বধূরূপের করুণ মুখশ্রীতে আরো একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। ভরাট গলায় বলল,
-” কী দূর্ভাগ্য আমার একটা মিথ্যাবাদীর সঙ্গে সারাজীবন কাটাতে হবে! ”

কথাটা বলেই হঠাৎ চমকে ওঠল সে। নিমিষেই মেজাজ ক্ষিপ্ত হলো। রক্তিম চোখ দুটো গরম করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-” বললে মা, ভাইকে বোঝাবে কিন্তু বোঝাওনি। একজনকে বিয়ে করে, একজনের বউ হয়ে আরেকজনের বউ সেজেছ! কার জন্য সেজেছ আমাদের বিয়ে কাল হয়েছে রাইট? তাহলে আজ সাজ কেন? হুয়াই? উহুম, নেভার এটা মেনে নেয়া যায় না। ”

কথাগুলো বলতে বলতেই হৈমীর বাহু চেপে কাছে টেনে আনল। এক এক করে ওর পরিহিত সকল গয়নাগুলোও খুলতে শুরু করল। গয়না খোলা শেষে পুরুষালি শক্ত হাতের বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে ঠোঁটে লাগানো লিপস্টিক মুছতে লাগল। হৈমীকে কিছু বলার সুযোগও দিল না। নিজের মতো সাজ মুছতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এরপর পকেট থেকে টিস্যু বের করে হাতে লাগা লিপস্টিক মুছে চোখের কাজল মুছতে উদ্যত হলো। হৈমী নড়েচড়ে, রেগেমেগে অস্বাভাবিক ভাবে শ্বাস নিল। রুদ্র বিরক্ত হয়ে বলল,
-” এ পর্যন্ত ঠিক আছে। শাড়িটা বাসায় গিয়ে খুলব।”

চলবে…

#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২৫
সময় বিকাল চারটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। সূর্যের আলো ধীরে ধীরে মলিন হয়ে আসছে৷ হিম শীতল বাতাসে শরীর কেঁপে ওঠছে। সিটে মাথা রেখে জড় বস্তুর মতো পড়ে ছিল হৈমী৷ কখন যে চোখ লেগেছে টেরও পায়নি। রুদ্রকে তার বাবা ফোন করেছিল। বাবার সাথে কথা বলার পর ফোন এসেছে রাদিফের। রাদিফের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা চলছিল। কথার ফাঁকে হৈমীর দিকে নজর পড়তেই আঁতকে ওঠে সে। হড়বড়ে হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলে হৈমীকে। ঘুমের ঘোরে গা ছেড়ে দিয়েছিল মেয়েটা। আর একটু হলেই মাথাটা গিয়ে জানালার কাঁচে লাগত! ভাগ্যিস সে দেখেছিল। সংবিৎশক্তি ফিরে পেয়ে দুর্বল চোখে তাকাল হৈমী। রুদ্র রাখছি বলে রাদিফের সঙ্গে কথার সমাপ্তি ঘটাল। রাশভারি কণ্ঠে হৈমীকে বলল,
-” ঘুমাচ্ছ কেন? ”

কিঞ্চিৎ নড়ল হৈমী৷ কিন্তু উত্তর দিল না। রুদ্র ধরে রাখা বাহু ছেড়ে দিলে সে পূর্বের ন্যায় সিটে গা এলিয়ে দিল। রুদ্র মুখ ফিরিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে রইল। হৈমীর চোখ মুখের অবস্থা দেখে অস্বস্তি হচ্ছে তার। হৈমী আবারো ঘুমে ঢুলুঢুলু। মাথা সিট থেকে বার বার পড়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। অবস্থা বুঝে চিন্তা হলো রুদ্রর। ফিরে তাকিয়ে কাছে টেনে আনল ছোট্ট, নরম, দুর্বল শরীরটাকে। বুকের কাছটায় মাথা রেখে ভরাট স্বরে বলল,
-” এভাবে থাকো। ”

হৈমী কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। চুপচাপ পড়ে রইল। শীত লাগছে তার শরীর মৃদু কাঁপছে। রুদ্রর বক্ষস্থলের উষ্ণতায় আরাম পেল বেশ৷ সে আরামে
এক সময় বিভোর ঘুমে তলিয়েও গেল। চারদিকে যখন মাগরিবের আজান ধ্বনি শোনা গেল, তখন রুদ্রর ফোনে কয়েকটি একটি ম্যাসেজ এলো। ম্যাসেজগুলো সূচনার। সে লিখেছে,
-” ভাইয়া তুমি হৈমীকে নিয়ে ঢাকা যাচ্ছ? যেখানেই যাও মাথা ঠান্ডা রেখ, মেজাজ শান্ত করো। হৈমীকে বুঝিয়ে কাছে রেখ। ও অনেক সহজসরল, শান্তভাবে বুঝিয়ে বললে সব শুনবে৷ রেগে বললে ভয় পাবে। মাহের খুব চিন্তা করছে, মায়েরও প্রেশার বেড়ে গেছে৷ প্লিজ তুমি হৈমীর খেয়াল রেখ৷ এমনিতেই বয়স কম তারওপর অতিরিক্ত বোকা। এমন একটা মেয়েকে যখন তুমি নিজের সঙ্গে জড়িয়েছ তখন তোমাকেও ধৈর্য্যশীল হতে হবে৷ বুঝিয়ে, শুনিয়ে, গুছিয়ে নিতে হবে। ইমম্যাচিওর মেয়ে বিয়ে করে প্লিজ তুমি ম্যাচিওরিটি আশা করো না। পারলে ম্যাচিওর করে নাও। একটা ছোট্ট বাচ্চাকে যেমন কোলেপিঠে করে মানুষ করতে হয় ধরে নাও হৈমীকেও তোমায় ওভাবে বুঝদার মানুষ করে নিতে হবে। আমাদের কালো অতীতের প্রভাব যেন ওর ওপর না পড়ে ভাইয়া। মাথায় রেখ ও আমার স্বামীর আদরের বোন। ওর কিছু হলে তার প্রভাব আমার ওপরও পড়বে৷ যতই আজ মা রেগে থাকুক কাল অবশ্যই মেয়ের দিকে ফিরে তাকাবেন। ভালো থেক তোমরা, রাগটা কমিও। মেয়েটা সকালে ঠিকভাবে খায়নি, ও আবার বেশিক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারে না। খেয়াল রেখ ওর নিজের খেয়ালও রেখ। আমি সময় করে ফোন দিব আল্লাহ হাফেজ। ”
________
রুদ্রর ডাকে ঘুম ভাঙল হৈমীর। চোখ মেলে রুদ্রর মুখটা দেখে চমকে ওঠল, হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে চোখ কচকালো। মাথা চেপে ধরে চারদিকে সচেতন দৃষ্টি বুলাল। মনে পড়ে গেল তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা। সেই সাথে খেয়াল করল সে রুদ্রর কোলে শুয়ে আছে। শুনতে পেল গুরুগম্ভীর মানুষটার শান্ত কণ্ঠস্বর,
-” আমাদের পৌঁছাতে আরো সময় লাগবে। খাবার আনিয়েছি হাত, মুখ ধুয়ে খেয়ে নাও। ”

ধীরেধীরে ওঠে বসল হৈমী। অমনি গায়ে জড়ানো শাড়ির অর্ধেক পড়ে গেল নিচে। বিস্মিত হয়ে দু’হাতে শাড়ি চেপে ধরল। রুদ্রর দিকে কাচুমাচু হয়ে একবার তাকিয়ে নিজের সিটে গিয়ে বসল। রুদ্র খেয়াল করল হৈমীর শাড়ির কুঁচি পুরোটাই খুলে গেছে। ঠিকঠাক হওয়ার জন্য চোখ ফিরিয়ে নিল সে বিরবির করে বলল,
-” ঘুমের ঘোরে এত যুদ্ধ করার পরও আঁচল টুকু ঠিক আছে এটাই মাথা সমান। এতেই আমি ধন্য! ”

শাড়ির বেহাল দশা দেখে হৈমী ত্বরান্বিত হয়ে খুলে যাওয়া কুঁচি কোনরকমে কোমরে গুঁজে দিল। রুদ্র অন্যপাশে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল,
-” সব ওকে? ”

হৈমী মৃদুস্বরে জবাব দিল,
-” হুম। ”

গাড়ির ডোর খুলে ঝিনুককে আসতে বলল রুদ্র। ঝিনুক এক লিটারের পানির বোতল এগিয়ে দিল। রুদ্র সেটা নিয়ে হৈমীকে দিল বলল,
-” ডোর খোলার প্রয়োজন নেই। জানালা দিয়ে মাথা বের করে মুখে পানি দাও। ”

মাথা নাড়িয়ে সম্মত হলো হৈমী৷ রুদ্র তার হাতে বোতল দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে ডোর আটকাতে উদ্যত হলো। শঙ্কিত হয়ে হৈমী বলল,
-” কোথায় যাচ্ছেন! ”

চোখ বন্ধ করে আবার মেলে তাকাল রুদ্র। দৃঢ় স্বরে বলল,
-” এখানেই আছি। ”

-” দরজা খোলা থাকুক। ”

ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল রুদ্র। এত ভয়! সিগারেট খাওয়ার জন্য কিছুটা দূরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু যাওয়া হলো না। খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়েই দ্রুততার সঙ্গে সিগারেট ফুঁকতে হলো। হৈমীও রুদ্রকে চোখে চোখে রেখে হাত, মুখ ধুয়ে বলল,
-” শেষ। ”

রুদ্র ঝিনুককে ইশারায় টিস্যু বক্স দিতে বলল। ঝিনুক টিস্যু বক্স এগিয়ে দিলে হৈমী তা নিয়ে হাত, মুখ মুছে চুপ করে বসে রইল। দু’টো সিগারেট শেষ করে পনিরের হাত থেকে খাবারগুলো নিল সে। বলল,
-” আশপাশে ঘুরে আয়। ফোন করলেই চলে আসবি।”

ওরা চলে যেতেই সে খাবারের প্যাকেট নিয়ে গাড়িতে বসল। ডোর লক করে হৈমীর দিকে খাবারের প্যাকেট দিয়ে বলল,
-” খেয়ে নাও। ”

অতিরিক্ত খিদে পাওয়াতে গা গুলাচ্ছিল হৈমীর। তাই খাবার পেয়ে আর টু শব্দটিও করল না। ভদ্র মেয়ের মতো খাবার নিয়ে খেতে শুরু করল। অর্ধেক খাওয়ার পর রুদ্রর দিকে তাকাল। নরম সুরে জিজ্ঞেস করল,
-” আপনি খাবেন না? ”

রুদ্র আড়চোখে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-” না। ”

-” আমি এতগুলো কীভাবে খাব? আপনি এই প্যাকেট নিন। ”

-” খাও তুমি। ”

-” খাবারের সাথে রাগ করতে নেই। জানেন টিশার জামাই খেতে না চাইলে টিশা জোর করে করে, গল্প শুনিয়ে, ছড়া কেটে খাওয়িয়ে দেয়। ”

দীর্ঘ একটা সময় পর হৈমীর মুখে কথা ফুটেছে। ফলশ্রুতিতে রুদ্রর বিরক্ত লাগল না। বেশ ভালোই লাগল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
-” ওকে খাচ্ছি। ”

ঈষৎ হাসল হৈমী। খাওয়া শেষ করে জিজ্ঞেস করল,
-” ভাবি ফোন করেছিল? ”

খেতে খেতে রুদ্র জবাব দিল,
-” না। ”

মনটা আবারো বিষন্ন হয়ে গেল হৈমীর। বলল,
-” আমি কবে আসব? ”

-” জানি না। ”

আর কোনো প্রশ্ন করল না সে। চুপসে গেল পূর্বের মতোই। ঢাকা পৌঁছাতে রাত সাড়ে দশটা বাজল। হৈমী তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রুদ্র বুঝল, লম্বা জার্নি করার অভ্যাস নেই ওর। পুরো পথ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিল। এবার ঘুম ভাঙাতে হবে। তাই ডাকল, একবার, দু’বার, তিনবার। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। ঝিনুককে ডেকে চাবি বের করে দিল। বলল,
-” গেট খুলে চারতালায় চলে যা। লক খুলে রাখ। ”

ঝিনুক চলে গেল পনির ড্রাইভিং সিটে বসেই গুণগুণ করে গান গাইছে। রুদ্র সন্তর্পণে হৈমীকে পাঁজাকোল করে নিয়ে গেটে ভিতরে প্রবেশ করল। মুখোমুখি হলো, দোতলার ভাড়াটিয়া আংকেলের সঙ্গে। লোকটার মুখে ভয়ের ছাপ। রুদ্র বুঝতে পেরে এগোতে এগোতে বলল,
-” আংকেল বউ নিয়ে এলাম। লং জার্নিতে শরীর খারাপ করেছে তাই ঘুমে ডিস্টার্ব করলাম না। ”

এবার লোকটার চোখ, মুখের আকৃতি পরিবর্তন হলো। বিস্ময় নিয়ে বলল,
-” বিয়ে করেছ কই কিছু শুনলাম না তো। ”

বাঁকা হেসে রুদ্র বলল,
-” আস্তেধীরে শুনে যাবেন, আসি। ”
________
রুদ্র যখন ঢাকায় আসে একাকী সময় কাটাতে উত্তরার এই বাসাতেই থাকে। তেরো শতাংশ জায়গা জুড়ে নির্মিত পাঁচতলা বিশিষ্ট বিল্ডিং। চারতলা ব্যাতীত বাকি সবগুলোই ভাড়া দেয়া। নিজের ফ্ল্যাটটি আগে থেকেই বেশ সাজানো গোছানো। তবে সংসার করার মতো সাজানো গোছানো নয়। এবার একটা ছোট্ট সংসার তৈরি করতে হবে । হৈমীকে নিজের বেডরুমে শুইয়ে দিয়ে ঝিনুক আর পনিরকে দায়িত্ব দিল আগামীকালকের ভিতরেই একটা সংসারে যা যা লাগে সব কিছুর ব্যবস্থা করতে। ওরা ব্যবস্থা করে ফেলবে এই নিশ্চয়তা দিয়ে জড়তার সঙ্গে জিজ্ঞেস করল,
-” বস ফুলের দোকান খোলাই আছে। আপনি বললে ঘন্টা খানিক সময়ের মধ্যেই বাসর ঘর সাজিয়ে ফেলব! ”

হকচকিয়ে গেল রুদ্র। চাপাস্বরে ধমক দিল ওদের। বলল,
-” বিয়ে করেই আধমরা বানিয়ে ফেলেছি, বাসর করে পুরোপুরি মেরে ফেলব নাকি! যা ফোন রাখ। ”

ফোন কেটে চাপা হাসল রুদ্র। বিরবির করে বলল,
-” বিয়ে করেছি মনের খোরাক মেটাতে ব্যস। ”

শীতের রাত তবুও লম্বা সময় নিয়ে গোসল করল রুদ্র। বাথরুম থেকে বেরিয়ে বিছানায় ঘুমন্ত হৈমীকে দেখে মনে পড়ল, ওরও গোসল করা উচিৎ। লম্বা জার্নি, ধুলাবালিতে অবস্থা শোচনীয়। গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে হৈমীকে ডাকতে গেল সে। ডাকতে ডাকতে বিরক্ত হয়ে বেশ কড়া গলায় ডাক শুরু করল। একটা মানুষের ঘুম এত গভীর কী করে হয়! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেও মেয়েটার ঘুম ভাঙাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে! শেষে বিরক্ত হয়ে ধৈর্য ধরতে না পেরে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত হৈমীকে একটানে বসিয়ে দিল। মুখ দিয়ে অল্প শব্দ করে ঢুলুঢুলু চোখে তাকাল হৈমী। রুদ্র একহাতে ওর কাঁধ ধরে বসল। বলল,
-” আমরা পৌঁছেছি অনেকক্ষণ। যাও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। ”

কর্ণে স্পষ্ট গুলো শব্দ ঢুকতেই ঘুম ছেড়ে গেল। চোখ বড়ো বড়ো করে প্রথমে সদ্য গোসল করে আসা রুদ্রকে দেখে স্থির হলো দৃষ্টিজোড়া। দীর্ঘ আকৃতির সুঠাম দেহখানা দেখে এক ঢোক চিপল। উন্মুক্ত বক্ষে দৃষ্টি পড়লে নিমিষেই লজ্জায় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। মনে মনে রুদ্রকে নির্লজ্জ বলে গালি দিল৷ এরপর পূর্ণ দৃষ্টিতে পুরো রুমটা নিরীক্ষণ করল। ধবধবে সাদা দেয়াল, সাদা টাইলস, বিশাল বিছানা, ডানপাশে কাউচ, বামপাশে কাভার্ড, ছোট্ট একটি টেবিল বেলকনির দরজা, দু’টো জানালা, সবমিলিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। সাদা সাদাতে আলোকচ্ছটা চোখে বিঁধল খুব। রুদ্র তার চাহনি খেয়াল করে বলল,
-” এসব দেখার অনেক সময় পাবে। যাও গিয়ে শাওয়ার নাও এবার। ”

পায়ের কাছে কম্বলটা টেনে গায়ে জড়িয়ে সে বলল,
-” ওমা কী বলছেন! এই শীতে রাত করে শাওয়ার নিব কেন? ”

-” বাইরের ধুলাবালি মাখিয়ে বিছানা নষ্ট করেছ। বেডশিট পাল্টাতে হবে। পরিষ্কার বেডশিটে ময়লা শরীরে থাকতে দিব না! ”

সর্বনাশ! এই লোক বলে কী? তাহলে সে কোথায় থাকবে? বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল সে। রুদ্র আবারো বলল,
-” সময় নষ্ট করো না গরম পানি আছে গোসল করে নাও। ”

হৈমী ঠোঁট উল্টে কিছুক্ষণ বসে থেকে হঠাৎ বলল,
-” কিন্তু আমি কী পড়ব! আমার জামাকাপড়… ”

সহসা চৈতন্য ফিরল রুদ্রর। সত্যি তো এতকিছুর মাঝে এদিকটা তো খেয়ালই করা হয়নি! চিন্তান্বিত হয়ে ওঠে দাঁড়াল সে। বিব্রত মুখে কয়েকবার তাকাল ঘড়ির দিকে। রাত অনেক হয়েছে এ সময় শপিংমল গুলোও খোলা নয়। তার চিন্তান্বিত গম্ভীর মুখ দেখে হৈমী বলল,
-” আজ থাক কালকে না হয় জামাকাপড়ের ব্যবস্থা করে লম্বা গোসল দিব। ”

ভ্রু কুঁচকে তাকাল রুদ্র। হৈমীর ঠোঁটে ভর করল দুষ্টু হাসি। রুদ্র সে হাসি দেখে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
-” অপরিচ্ছন্ন মানুষ আমি পছন্দ করি না। ”

বলতে বলতেই কাভার্ডের সামনে গিয়ে কপাট খুলে টিশার্ট ঘাটতে লাগল। বেশ সময় নিয়ে খুঁজে খুঁজে হলুদ রঙের একটি লম্বা হাতা টিশার্ট, সাদা রঙের ট্রাউজার বের করল। টের পেল ঐ দেড় ফিট শরীরে এসব ফিটিং হবে না৷ তবুও রাত আর সকাল টুকু এগুলো দিয়েই পার করতে হবে। হৈমীকে ওগুলো দেয়ার পর সে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
-” আপনি আর কত নিষ্ঠুর হবেন? এই রাতে এভাবে আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন? ”

-” শাস্তি! সেটা তো শুরুই হয়নি। ”

থতমত খেয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে টিশার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে বাথরুমে চলে গেল হৈমী। রুদ্র বাঁকা হেসে বেডশিট পাল্টালো। গোসল শেষ করে ঢোলা পোশাকগুলো পড়ে, ভেজা চুলে কাঁপতে কাঁপতে বের হলো হৈমী। রুদ্র ফোন থেকে দৃষ্টি ওঠিয়ে একবার দেখল ওকে। বেছে বেছে সবচেয়ে ছোটো টিশার্ট বের করেছিল সে, যেটা তার কোমরের ওপর থাকে, অথচ হৈমীর কোমর ছেড়ে হাঁটুর একটু উপর পর্যন্ত হয়েছে। তা দেখে রুদ্র হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। হৈমীর মুখটাও দেখার মতো হয়ে আছে। একদিকে টি-শার্টের লম্বা হাতা টেনে হাত বের করতে বেগ পেতে হচ্ছে। অপরদিকে ইয়া লম্বা ট্রাউজার পরে পা বের করতে মুশকিল হচ্ছে। খুব কষ্টে পা টিপে টিপে এগিয়ে আসছিল সে৷ রুদ একটি কাজে ঘরের বাইরে যেতে উদ্যত হয়েছে। এমন সময় হৈমীর মৃদু আর্তনাদ ‘না’! শুনতে পেল। চমকে ওঠে ঘুরে দাঁড়িয়ে যা দেখল এতে তার ছোটোখাটো এট্যাক হলো।

হৈমীর পরিহিত সাদা ট্রাউজার খুলে নিচে পড়ে গেছে। হাঁটু থেকে গোড়ালি অবধি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হাঁটুর একটু উপরে ধবধবে ঊরুর একটু অংশও দৃশ্যমান। হতভম্ব, আতঙ্কিত হৈমী লজ্জিত হয়ে কী করবে বুঝে ওঠতে না পেরে লম্বা টিশার্ট নিচের দিকে টেনে হাঁটু মুড়িয়ে বসে পড়ল। কাঁদো কাঁদো মুখে একবার তাকাল রুদ্রর দিকে আবার তাকাল নিজের করুণ অবস্থার দিকে। এহেন দৃশ্য দেখে আকস্মাৎ রুদ্রর যেন কী হয়ে গেল। সে বাম হাত বুকে ভাঁজ করে ডানহাতে চোখজোড়া চেপে ধরে উচ্চশব্দে হেসে ওঠল। ক্রমেই তার হাসির মাত্রা এতটা বেড়ে গেল যে হাসির শব্দেই হৈমীর হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেল রুদ্রর। বুঝবান হবার পর থেকে এভাবে কোনোদিন হাসেনি সে। এ প্রথম নিজের এমন হাসি পাওয়া দেখে নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেল। অনেক সময় পর তার হাসি থামল। বেচারি হৈমী তীব্র লজ্জায় ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে আরম্ভ করেছে। মনে মনে হাজারবার রুদ্র সম্পর্কে মন্তব্য করেছে,
-” লোকটা কত খারাপ, কত নির্দয়! ”

চলবে…