ভালোবাসার অশ্রু (ছোট গল্প)

0
411

#ভালোবাসার_অশ্রু
#Misk_Al_Maruf

মিমিকে আমি শান্ত স্বরে বলি,
“আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না, আমাকে মাফ করে দিও।”
মেয়েটি আমার কথা শুনে কিছুক্ষণের জন্য থ মেরে গেলো মনে হচ্ছে। পরমুহূর্তেই নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে ভাঙ্গা কণ্ঠে বললো,
“হঠাৎ এই কথা বলছো যে? এইতো একসপ্তাহ আগেই বললে আমার ঐ সমস্যা তুমি ঠিকই মানিয়ে নিতে পারবে আর পরিবারকেও মানাতে তেমন সমস্যা হবেনা।”
মিমির কথায় আমি কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। বেশ কিছুক্ষণ নিরবতার পর আচমকাই বলে উঠি,
“মিমি! আমি তোমাকে ভালোবাসি এতে কোনো সন্দেহ নেই, আর তখন হয়তো আবেগের বশে অনেক কিছুই বলে ফেলেছি আর তাছাড়া হুট করে তোমার ঐ মন খারাপের মুহূর্তে আমি যদি তখনি না করতাম তাহলে তুমি আরো বেশি মন খারাপ করতে। তুমি একবার বাস্তবতার দিকটাই খেয়াল করো, যখন আমার পরিবার কোনো সূত্রে জানতে পারবে যে তুমি বন্ধ্যা তখন স্বাভাবিকভাবেই তারা মুখের উপর না করে দিবে। আমি তোমাকে আমার পরিবারের কাছে অপমানিত হতে দিতে পারবো না।”
এই বলেই আমি মাথা নিচু করে থেমে যাই। আড়চোখে মিমির দিকে তাকিয়ে খেয়াল করি মেয়েটির চোখ অশ্রুতে টলমল করছে, এই বুঝি চোখের ধারা বয়ে যাবে। কিন্তু সেই সুযোগ না দিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়ন দুটো আমার থেকে খানিকটা আড়াল করে হাতে থাকা টিস্যু দিয়ে মুছে ফেললো সে।
“হুম ঠিকই বলেছো। আর তাছাড়া আমিও বা কেমন মেয়ে, বলোতো? তোমার মতো এমন প্রতিষ্ঠিত এক বয়ফ্রেন্ড পেয়েছি এটাই শুকরিয়া। আমি নাহয় মাতৃত্বের স্বাধ অনুভব করতে পারবো না তাই বলে নিজের ভালোবাসার দোহাই দিয়ে তোমাকেওতো জোর করার অধিকার আমার নেই। আমি ব্যর্থ আশায় বুক বেঁধেছিলাম, আমাকে মাফ করে দিও। আজ তাহলে আসি, আমার শরীরটা কেমন যেন ভালো লাগছে না।”
এই বলেই পার্কের বেঞ্চ থেকে মুহূর্তেই উঠে গেলো এবং সাথে সাথে সামনের দিকে হাঁটা দিলো। আমি মিমির দিকে তাকিয়ে ভালোভাবেই আঁচ করতে পারছি মেয়েটি চলার পথেই নিশ্চুপ কান্নায় নিজেকে আটকে রাখার চেষ্টা করছে।
এই প্রথম আমি ওকে এগিয়ে দেইনি অথচ অন্য দিনগুলোতে ঠিকই রিকশায় উঠিয়ে রিকশাওয়ালার ভাড়াটাও সাথে দিয়ে দিতাম।

ঘটনা একমাস আগের…
সেদিন হঠাৎ করেই মিমি আমাকে বলে যে ওর নাকি পেটে মাঝেমধ্যেই প্রচন্ড ব্যথা হয়। যদিও মেয়েটি বেশ লজ্জাবতী কেননা ওর সাথে আমার গত চারবছর ধরে সম্পর্ক থাকলেও নিজের ব্যক্তিগত শারিরীক কোনো কিছুই আমাকে শেয়ার করেনি কখনো। তাই বিষয়টিকে আমি সিরিয়াস ভেবে তখনি বলি ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে। আর গত একসপ্তাহ আগে যখন চূড়ান্ত রিপোর্ট হাতে আসে তখন সে আমাকে ফোন দিয়ে কেঁদে কেঁদে বলেছিল যে সে কখনোই নাকি মা হতে পারবেনা। আমি তখন আবেগের বশে সান্ত্বনা দিলেও দিনকে দিন আমার মাথায় ভবিষ্যত নিয়ে ভাবনাটা বাড়তে থাকে।

গভীর রাত…
মোবাইল হাতে নিয়ে বসে আছি। মন বলছে মিমিকে একটা কল দেই কিন্তু পরক্ষণেই কোনো এক অদৃশ্য সত্তা আমাকে যেন বারংবার বাধা দিচ্ছে। চোখে ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে আমি অদৃশ্য এক সুতোয় দোদুল্যমান, কোনো সিদ্ধান্তেই উপনীত হতে পারছিনা।

বাবা মা-সহ পাত্রীর বাড়িতে বসে আছি। কিছুক্ষণ বাদেই পাত্রীর ছোটবোন এসে পাত্রীর মায়ের কানের কাছে এসে কি যেন বললো। পরক্ষণেই তিনি তার মেয়ের গোপন কথা শুনে খানিকটা লজ্জা পেয়ে আমাদের দিকে তাকালেন। আমার বাবা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি বলেন,
“আসলে হয়েছে কি! আপনারাতো সব জেনেশুনেই আমাদের বাড়িতে এসেছেন। এখন আমার মেয়ে আপনাদের সামনে আসতে চাচ্ছে না, মানে ছেলের সাথে একটু আলাদা কথা বলতে চায় আরকি।”
বাবা মা নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ দৃষ্টি বিনিময় করে পরক্ষণেই আমার মা হাসিমুখে বলেন,
“আচ্ছা আচ্ছা! ঠিক আছে, সমস্যা নেই। ছেলের পছন্দইতো আমাদের পছন্দ, ওর সাথে কথা বললেই হবে।”
পরক্ষণেই মা আমার দিকে তাকিয়ে ইশারায় ভেতরের রুমে যেতে বললেন।

মেয়েটি এখনো আমার দিকে তাকায়নি, উল্টোদিকে তাকিয়েই আমাকে দাঁড়ানো অবস্থায় বলে উঠলো,
“আপনি সবকিছু জেনেশুনে আমাকে বিয়ে করতে এসেছেন তো? আপনি জানেন আমার সমস্যার কথা? আমি কিন্তু ভবিষ্যতে সন্তান জন্মদানে অক্ষম মানে মানুষ যেটাকে বলে বন্ধ্যা।”
মিমির কথা শুনেই আমি সামান্য কাশি দিয়ে বলি,
“হুম সব জেনেশুনেই এসেছি।”
আমার গলার স্বর শুনে মুহূর্তেই মেয়েটি নিজের আড়াল করা মুখখানিকে আমার মুখের সামনে এনে অবাক চিত্তে বলে,
“একি তুমি!”
আমি সামান্য হেসে বলি,
“কেন অন্য কাউকে আশা করেছিলে নাকি?”
কিন্তু আমার প্রশ্নের দিকে যেন ওর কোনো খেয়ালই নেই। সে যেভাবে তাকিয়ে আছে তাতে মনে হচ্ছে সে আমাকে আজ নতুনভাবে দেখছে।
সেদিন মায়ের কাছে যখন অকপটে মিমির সব কথা বলে দিয়েছিলাম তখন তিনি প্রথমে সামান্য কষ্ট পেলেও পরে আর দ্বিমত করেননি, আর মায়ের সিদ্ধান্তই যেখানে বাবার সবকিছু সেখানে বাবাকে রাজি করাতে বেগ পেতে হয়নি একটুও।

মেয়েটি আমাকে এখনো জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, হয়তো জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরষ্কারটি আজ তার হাতের নাগালে। এতো ঝড়ঝাপটার পরও ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার আনন্দে কোনো মেয়ে কি খুশির অশ্রু বিসর্জন না দিয়ে পারবে? হয়তো না, কখনোই না। সত্যিই জীবন কিছু কিছু সময় খুব সুন্দর।

(সমাপ্ত)