ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো পর্ব-৫৪+৫৫+৫৬

0
1351

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(৫৪)
বিয়ের প্রস্তাবের নামে হয় বোঝাপড়া। কাকা মোটেই চাননা তখন মেয়েকে বিয়ে দিতে। যেহেতু জানতে পেরেছেন তানভীর নিজেই তোকে পছন্দ করেছে তখন কাকা এমন এমন কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে যে এমন শর্ত মেনে কেউ কখনো বিয়ে করবেনা। তানভীরের পরিবার ও মানতে পারেনি। কি কি শর্ত একচুয়েলি দিয়েছে তা আমার ধারণা মাত্র যে তোকে শ্বশুড় বাড়ি তে হয়তো পাঠাবে না। বাড়ির বউ বাড়িতে থাকবেনা! ঘর জামাই থাকবে তাও আবার খান বাড়ির ছেলে! এটা কেউ এলাও করেনি। তানভীর ও বুঝতে পেরেছিলো ব্যাপারটায় অনেক হ্যাসেল হবে। জল ঘুলা করে কি লাভ! ভালো লাগা কিছুদিন পরেই কেটে যাবে। তানভীর খান হ্যাভ মেনি অপশন। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে যার কোনো পিছুটান নেই সে কেনো ভালা লাগা নিয়ে পড়ে থাকবে? পথে ঘাটে এমন ভালো অনেককেই লাগে ভুলেও যায়। কিন্তু তোকে ভুলা সম্ভব হয়ে উঠেনি। তানভীর তোকে ভুলতে পারেনি। বরং তোকে যখন ডেইলি কলেজে নিজের চোখের সামনে দেখতে লাগলো ততো উইক হয়ে গেলো। নিজের কন্ট্রোল হারিয়ে ফেললো।বলে দিলো তোকে ওর চাই। কাকার কাছে একের পর এক লোক পাঠাতে লাগলো। কাকাকে মানাতে সবাই ব্যর্থ। ব্যাপারটা ফিরোজ খানের ইগোতে লেগে গেলো। তানভীরকে কড়া ভাবে নিষেধ করলো। বড় ছেলের চিন্তা বাদ দিয়ে তানভীরকে বিয়ে দেবার জন্য উঠে পড়ে লাগলো। তানভীর তার জায়গা থেকে এক চুল বিন্দু নড়লো না। বিয়ে যদি করতে হয় তোকেই করবে । এক ঘন্টা যদি সে বিয়ে টিকে তাহলেও বিয়ে করবে। লোক পাঠানো বাদ দিয়ে নিজে উপস্থিত হলো কাকার কাছে। বিভিন্ন ভাবে কনভেন্স করার চেষ্টা করে গেলো। কাকা কানে নিলো না। তোকে নিয়ে শুরু হলো দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব। ইলেকশনে সর্বদা ব্যস্ত তানভীর। তোর কথা মনে হলেই চলে আসতো কাকার কাছে। হাত ধরে বসে থাকতো। তোকে চাইতো। কাকার পাশে থেকেই তোকে দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে নিলো। কাকা জানতো তানভীর কখনো তোর ক্ষতি করবেনা। হতেও দিবে না। এতে তার ই লস। তোকে ইমপ্রেস করে যে জিতে নিবে সে উপায় ও নেই। বাপ ভক্ত মেয়ে হয়েছিস।বাপের কথার এক চুল বাইরে নড়বিনা। নিজেও ঠিক করে ফেলেছিস বিয়ে টিয়ে কিছু করবিনা। ইলেকশনে দুর্দান্ত গন্ডগোল হলো। জেলে আটকা পড়লো তানভীর। যদিও আধাঘণ্টার মধ্যে বেরিয়ে এসেছে। এসব দেখে শুনে কাকা আরো জেদ করে বসলো। বেপারোয়া লিডার তানভীরের কাছে মেয়েকে কোন ভাবেই দিবেনা। তানভীরকে কখনো খারাপ ভাবে ইগনোর না করলেও এবার তানভীরকে মোটেই ছাড় দিলেন না। কড়াভাবে অপমানিত করে ছাড়লেন। হুঁশিয়ারী দিলেন, ‘ খবরদার আমার মেয়ের আশেপাশে আসবেনা। কোনো বেপারোয়া রাজনৈতিক লিডারের কাছে আমি কোনোদিন আমার মেয়ে বিয়ে দিবোনা। ‘
তানভীর ও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়, ‘ এক রাতের জন্য হলেও আপনার মেয়েকে আমি বিয়ে করবো। আমি ব্যতীত কেউ আপনার মেয়েকে ছুয়ার সাহস অব্দি পাবেনা। ‘
এরপরে তানভীর কখনো যায়নি তোর জন্য রিকুয়েস্ট করতে। নিরবে সংঘাত চলেছে দুজনের মধ্যে। তোর সামনে কখনোই পড়েনি তানভীর। দূর থেকেই তোকে দেখে গেছে। মাঝে মাঝে যখন বুকে তীব্র যন্ত্রনা হয়েছে আমাকে সামনে বসিয়ে একেরপর এক সিগারেটের ধোঁয়া ছুড়েছে। তবুও শান্তি পায়নি। কি যে ছটফটানি! আমি সহ্য করতে পারতাম না। বাড়ি ফিরে তোর ভাবীকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে রাখতাম। আর ভাবতাম তোর ভাবীকে যদি না পেতাম তাহলে আমিও আজ তানভীরের মতোই এক ব্যর্থ প্রেমিক হিসেবে পরিচিতি পেতাম।
আমার ধারণাই ঠিক হলো। আমিও জানতে পারলাম তোকে বিয়ের শর্ত গুলো। যখন ফাহাদের সাথে তোর বিয়ে পাকা করতে গেলাম। কাকা শর্ত বসালো, তুই কাকার কাছেই থাকবি। চাকরী করবি। সংসারের কোনো কাজে হাত লাগাতে পারবিনা। স্বাধীন লাইফ লিড করবি। তখন বুঝলাম এই শর্ত গুলোই দেওয়া হয়েছিলো ফিরোজ খানকে। তিনি সাথে সাথে রিজেক্ট করে দিয়েছেন। ফাহাদের সাথে বিয়েটা তানভীরের কাছে সুযোগ হয়ে ধরা দেয়। কৌশলে তোকে বিয়ে করে। কিন্তু কাকার সাথে তার নিরব যুদ্ধটা চুপি চুপি লেগেই আছে। বাইরে মতই সখ্যতা থাক! তানভীর সেজন্য ই চায়না তোর কাছাকাছি থাকতে। ঘরজামাই করতে চেয়েছিলো তানভীরকে এরপরেও কোন হিসেবে আসবে? যতটুকু আসা যাওয়া তোর কারণে। কাকার দিক থেকে কাকাকেও কিছু বলতে পারবোনা। একটাই মেয়ে! একমাত্র অবলম্বন। তোকে কিছুতেই আড়াল করতে চায়না। কিন্তু বাধ্য হয়ে ঠিকই পরের ঘরে তোকে তুলে দিতে হচ্ছে। কাকার দেখলাম মুখটা শুকনো হয়ে আছে। লাব্বু কাকা তোকে ভীষন ভালোবাসে। তার একমাত্র অস্তিত্ব তুই। আর তানভীর একমাত্র ভালোবাসা। এই দুজন মানুষ তোর জন্য প্রাণটাও উৎসর্গ করে দিতে পারবে। কখনো কোনদিন এই মানুষ দুজনকে কষ্ট দিবিনা। বড় হয়েছিস। নিজের সবটা দিয়ে আগলে রাখবি। তানভীর কখনোই তোকে কোন সিদ্ধান্তে বাধা দিবেনা যদি সে সিদ্ধান্ত তোর ভালোর জন্য হয়। তুই তোকে যে জায়গায় দেখতে চাস সেখানেই যেতে পারিস।তোকে কোনো কিছুতে ফোর্স করা হবেনা। ফোর্স করে কাউকে আটকানো যায়না। যদি যেতো তামিম ভাইয়ের জীবন এমন কাটতো না। ফ্লোরা তো পুলিশি হেফাজতে আছে জানিস তো? কতদিন থেকে চলছে এসব কাজ কে জানে? যাই হোক! খেয়েছিস তো? চোট লেগেছে তোর মাথায়। সেরেও গেছে প্রায়। তো এমন দুর্বল দেখাচ্ছে কেনো?’
‘ ব্যান্ডেজ খুলে আনবো ভাইয়া। যাবে?’
‘ খেয়ে আসছি। আমার আজ ঠিকমতো ব্রকফাস্ট করা হয়নি। ‘

লাবিবার ব্যান্ডেজ খুলে কবির জিপ ঘুরিয়ে তানভীরের বাড়ির দিকে টার্ন নেয়। লাবিবাকে বলে,
‘ তানভীরের লাগেজটা দিয়ে আসছি। তোরটা তো তুই পেয়ে গেছিস। ‘
‘ হু। ‘
তানভীরের লাগেজ টা লাবিবা নিজেই নিয়ে রুমে যায়। সাজানো গোছানো রুম।‌যে রুমে কাটিয়েছে সে একটা রাত। এই বিছানায় ঘুমিয়েছে দুবার। লাবিবা লাগেজটা আলমারির সামনে রেখে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসলো। চোখ বন্ধ করে দুবার শ্বাস ছাড়লো। তার ভেতরে কি হচ্ছে একমাত্র সেই জানে। অন্য কেউ তা আঁচ করতে পারবে না। লাবিবা হুট করেই তানভীরের আলমারি খুললো। হ্যাঙারে টানানো একটা শার্ট নিয়ে বুকের উপর চেপে ধরলো। অশান্ত মনটা শান্ত করতে গিয়ে আরো অশান্ত হয়ে উঠলো। শার্টে পাওয়া তানভীরের শরীরের ঘ্রাণ লাবিবাকে পাগল করে তুললো। লাবিবা মিররে তাকালো। ঘাড় বাকালে দেখা যায় পেছন দিকে শুধু ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ আছে। পুরো মাথার ব্যান্ডেজ খুলে নিয়ে এসেছে হসপিটাল থেকে। ঔষধ ও চেঞ্জ করে দিয়েছে। ফ্যাকাশে মুখটা অন্যরকম লাগছে। এমন কখনো লাগেনি। মিশ্র এক অনুভূতি লাবিবাকে ঘিরে ধরেছে। কার কাছে আগলাবে এই অনুভূতি গুলো? লাবিবার সকল অনুভুতি একটা জিনিস ই আগলে রাখে। সে হলো ডায়েরি। একটু খারাপ লাগলে সেটা লিখে রাখে। একটু ভালো লাগলেও লিখে রাখে। স্পেশাল কিছু হলে তো স্পেশাল ভাবেই লিখে। তানভীর লেখেনা? প্রশ্নটা মনে আসতেই লাবিবা ধীরে ধীরে আলমারি তে চোখ বুলালো। বন্ধ করে পুরো রুমে চোখ বুলালো। কোথাও কোনো ডায়েরি নেই। তানভীর কি ডায়েরি লিখে না? নাই লিখতে পারে। এতো বিজি মানুষ টা ডায়েরি লেখার সময় আছে? শখ ও তো থাকতে পারে। তাই বলে তাকে নিয়ে কিছুই লিখবে না? দরকার টাই বা কি লেখার? মাথায় বিভিন্ন রকম কথা ভাবতে লাগলো কিন্ত হাত চললো। লাবিবা কি মনে করে ম্যাট্রিক্সের নিচেও দেখলো। কোথাও কোনো ডায়েরি নেই। ড্রয়ার গুলো খুলে খুলে দেখলো। অধিকাংশ ড্রয়ার লক করা। খুঁজে খুঁজে আলমারির উপর থেকে চাবি পেয়ে ড্রয়ারগুলো খুলে দেখতে লাগলো। ফাইলের উপর ফাইল। লাবিবা খুব সাবধানে ফাইলের মাঝে খুজতে লাগলো। ছোট খাটো একটা ডায়েরি তো পাবে। সেটাও পেলো না। যা পেলো মাঝারি বড় সাইজের দুটো জার্নাল। লাবিবা অবাক হয়ে গেলো। মানুষটা জার্নাল ও মেক করতে পারে! এতো গুণী তাকে কে হতে বলেছিলো? পৃথিবীর সব থেকে বড় গুণটাই সে রপ্ত করে নিয়েছে। ধৈর্য্য। লাবিবার এতো ধৈর্য্য থাকা সত্ত্বেও কখনো কখনো বাঁধ ভেঙে যায়। এই মানুষটা এতো স্ট্রং কিভাবে? লাবিবা একটা জার্নাল খুলে হা করে তাকিয়ে থাকলো। এতো সুন্দর করে করা হয়েছে। তানভীরের অনেক ছবি। লাবিবা খুঁজতে লাগলো সে কোথায়? আদৌ কি আছে? অপর একটি জার্নালে তাকে খুঁজে পেলো। তাঁদের বিয়ের ছবি এটা। তানভীর আর সে একসাথে বসে। লাবিবার বুকটা ধুক করে উঠলো। অপলক তাকিয়ে থাকলো ছবিটির দিকে।

‘ লাবিবা? ফ্লোরে বসে কি করছো?’
সোহানার গলা পেয়ে ঝটপ লাবিবা হাতের জার্নালটা রেখে অপরটা ড্রয়ারে লক করে সোহানার সামনে এসে দাঁড়ালো। ‘ মামুনী। কিছুনা। এই বুকটাই নিচ্ছিলাম। ‘
‘ ও আচ্ছা। ফ্লোরে বসবেনা।পেছন ঘুরো দেখি মাথায় কি অবস্থা?’
‘ শুকিয়ে যাবে মামনী। ‘
‘ কতটুকু জায়গা চুল থাকবেনা! ইসস। শোনো বিয়েতে উপরের চুল গুলো দিয়ে মেকাপ করে নিবে। ‘
‘ এমনিতেও বোঝা যায়না মামনী। ভাইয়া কোথায়?’
‘ নিচে তোমার জন্য ওয়েট করছে। ‘
‘ তোমার ছেলে এখনো আসেনি না?’
‘ ওরে আমার মা টা আজকেই বাবা চলে আসবে। তুমি শুধু শুধু টেনশন করোনা। ‘

বাড়ি ফিরে দেখে টুকটাক আত্বীয় স্বজন আসতে শুরু করেছে। লাবিবা এদের আবার বেশিরভাগ ই চিনে না। লাবিবা ফিরতেই সাবিনা এগিয়ে এলো। প্রশ্ন করলো,
‘ ডাক্তার কি বললো? দেখি ঘুরে দাঁড়াও তো। ‘
লাবিবা বুঝেনা কি দেখবে এরা? সাবিনার চিন্তিত অস্থির মুখটা দেখে লাবিবা বুকে মাথা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। সাবিনা আরো চিন্তিত হলো।
‘ শরীর খারাপ করছে লাবিমা?’
‘ আব্বু কোথায়? ‘
‘ কমিউনিটি সেন্টারে গেছে। সব কিছু তো আর ও বাড়ির উপর চাপিয়ে দেওয়া যায়না। ‘
‘ আম্মু আমাকে ছাড়া থাকতে তোমাদের খুব কষ্ট হবে তাইনা?’
‘ রুমে যাও।‌ফ্রেশ হও। ‘
‘ কতটুকু কষ্ট হবে বলোনা। ‘
‘ লাবিমা ছাড়ো তো কাজ আছে আমার। ‘
‘ আমার সাথে তোমরা কেনো ওমন করো আম্মু?’
সাবিনার চোখে জল চলে আসে। মা সে। শক্ত হতে হবে। লাবিবার সামনে আর কাদা চলবেনা।
‘ মা হও তারপর নিজেই বুঝে নিতে পারবে। মায়েদের কতটুকু কষ্ট। ‘
‘ আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আম্মু। আমার আব্বু আমাকে ছাড়া কিভাবে থাকবে? আমার আব্বু তো সেদিন রাতে কাদছিলো। আমি বুঝতে পারিনি। একদমি বুঝতে পারিনি আব্বুর কষ্টটা। ‘
‘ এতো চেষ্টা করেও তো তোমাকে রাখতে পারলাম না মা। মেয়েদের জম্মই হয় পরের ঘরকে নিজের ঘর করে নেবার জন্য। নিজের ঘর হয় পর। তোমার পর বলতে কোনো কিছু নেই মা। সবই তোমার। সবাই তোমার। তোমাকে নিয়ে আমাদের কোনো চিন্তা নেই মা। তানভীর তোমাকে আমাদের চেয়েও বেশি বেশি ভালো রাখবে। আমাদের যখন ইচ্ছা তখন তোমাকে দেখতে চলে যাবো। তুমি চলে আসবে মন চাইলেই। শহরের বাড়িটা হয়ে গেলে একদমই কাছাকাছি থাকবো আমরা। মা রে সন্তান যত দূরেই যাক সে কখনো বাবা মার থেকে আলাদা হয়না। ‘
মা মেয়ে মিলে অনেক কান্নাকাটি করলো। রাতে লাবিবাকে জোর করে ধরে খাওয়ানো হলো। মেডিসিন নিতে হবে। খালি পেটে থাকা যাবে না। একদিকে বাবা মাকে ছেড়ে যেতে হবে আরেকদিকে তানভীরকে ভেবে ভেতরে ভেতরে ছটফট করলো লাবিবা। ফজরের নামাজ আদায় করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। এখনো অন্ধকার ছাড়েনি। তখন ই ফোন বেজে উঠলো। লাবিবার রুমে কাজিনরা ও আছে। আবেগের বসে আপুর সাথে থেকেছে আজ। লাবিবা দৌড়ে এসে ফোন তুললো। শব্দে ওদের ঘুম ভেঙে যেতে পারে। অন্তুর ঘুম একদমই পাতলা। স্কিনে ভেসে উঠলো খান সাহেব! এতো ভোরে! লাবিবার বুক জোরে উঠানামা করতে লাগলো। তিনি কি ফিরেছেন? কাঁপা কাঁপা হাতে রিসিভ করে কানে তুললো।
‘ হ্যালো। ‘
‘ সরি জান। ‘
লাবিবা ফুঁপিয়ে উঠলো। অসংখ্য বার জান বলে সম্বোধন করেছে লাবিবাকে। আজকের মতো শান্তি মেলেনি। লাবিবা আজ জানে এটা মিথ্যে নয়। কোনো আদরের ডাক ও নয়। লাবিবা সত্যিই তানভীরের জান। লাবিবাকে চুপ থাকতে দেখে তানভীর বলে,
‘ আই প্রমিজ য়্যু, তোমাকে নিয়ে এক বিকালে হাত ধরে হাটবো। নব প্রেমিক প্রেমিকার মতো অনুভূতি কুড়াবো। দশটাকার বাদামের ঠোঙা, এক প্লেট ফুচকা সেটাও ভাগ করে নিবো। তোমার সাথে আমার বহুসময় বহুপথ অতিবাহিত করা অনেক বাকি। ভোরের সূর্যদ্বয় একসাথে উপভোগ করতে চাই। চলে এসো। আমি আছি নদীর তীরে তোমার অপেক্ষায়। ‘

লাবিবা দৌড়ে এসে অন্তুর গায়ের নিচ থেকে উড়না টেনে নিলো। গায়ে পেঁচিয়ে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হু হু করে কেঁদে দিলো। ঝটপট চোখ মুছে চুলগুলো এক করে কাটা লাগালো। ফোনের ফ্ল্যাশ দিয়ে ড্রয়িং রুমে নামাজ অবস্থায় মহিলাদের পাস করে বেরিয়ে পড়লো।

নদীর কাছাকাছি যেতেই দূর থেকে গাড়ির লাইট চোখে পড়লো। লাবিবা সেদিকেই দৌড় দিলো। গাড়ির সামনে ধীরে ধীরে এক অবয়ব সচ্ছ হতে লাগলো। কালো প্যান্ট সাদা শার্টে দাঁড়িয়ে আছে তানভীর। লাবিবার দিকে এগিয়ে এলো। লাবিবা চোখ বন্ধ করে ঝাপিয়ে পড়লো তানভীরের বুকে। তানভীর তাল সামলাতে না পেরে দু পা পিছিয়ে গিয়ে গাড়ির বনেটে হাত রেখে ব্যালেন্স করলো। তানভীর কে জড়িয়ে ধরেই লাবিবা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। আচমকা এমন করাতে তানভীর ভড়কে গেলো। কপালের রগ ফুলে উঠলো। লাবিবার পিঠে হাত রেখে ঝাকালো।
‘ জান? কাঁদছো কেন? জান? কি হয়েছে বলো? আমি সরি তো না বলে গিয়েছি আর হবেনা এমনটা। জান? কি হয়েছে বলো। ‘
লাবিবা থামলো না। অনেকক্ষন জিজ্ঞেস করার পর কাঁদতে কাঁদতেই বললো, ‘ আমি তো একটু ভালোবাসতেই আপনার জন্য পাগল হয়ে যাই। আপনি কি করে পারলেন এতো গুলো বছর থাকতে আমাকে ছাড়া? ‘
লাবিবার কথা শুনে তানভীরের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। অপ্রস্তুতভাবে এদিক সেদিক তাকালো। বাবা মা ভাইয়ের পর তার কষ্টে কাঁদার মতো আরেকজনকে পেলো যে তার বউ ,লাবিবা। আর একবারো লাবিবাকে কিছু জিজ্ঞেস করলো না। লাবিবাকে কাঁদতে নিষেধ ও করলোনা। এ কান্না তানভীরের কথায় থামবে না।

চলবে ___

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(৫৫)
গাড়ির বনেটের উপর লাবিবাকে শক্ত করে জড়িয়ে তানভীর শুয়ে আছে। লাবিবার কান্না বন্ধ হয়েছে। একটু পর পর নাক টানছে। পূর্বাকাশে তখন আলোর মেলা। ডিমের কুসুমের মতো ছত্রভঙ্গ হয়ে আছে। তানভীর চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। লাবিবাও চোখ উপড় করে আকাশে সূর্য উঠা দেখছে। রাস্তার পাশের গাছের সারি। পাখিরা কিচিরমিচির করতে করতে এক গাছ থেকে অন্য গাছে উড়ে যাচ্ছে। নদীর শান্ত জল টলমল করছে। জলের উপর পূর্বাকাশের প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হয়েছে। ভোরের মৃদু মন্দ বাতাস শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির মাঝে দুজন দুজনকে জড়িয়ে আছে। দুজনেই দুজনের হার্টবিট অনুভব করতে পারছে। আজকের ভোরটা জীবনের শ্রেষ্ঠ ভোর হিসেবে স্মৃতিতে অম্লান হয়ে থাকবে। লাবিবা একটু পর পর মাথা তুলে তানভীরের গালে টুপ করে চুমু দিয়ে আবার বুকে নেমে আসছে। ভোরের আলো চোখে মুখে পড়তেই লাবিবা মাথা তুলে তানভীরের মুখের উপর চলে এসেছে। দুই গালে, নাকের ডগায় চুমু খেয়ে আবার বুকে নেমে আসছে। অতিরিক্ত কান্না করার পর মেয়েরা বাচ্চার মতো বিহেভ করে। তানভীর মোটেই বিরক্ত হচ্ছে না। বরং লাবিবার যে কোনভাবেই শান্তি পাচ্ছে না এটা বুঝতে পেরেছে। লাবিবা নাক ঘষে তানভীরের সাদা শার্ট টা ময়লা করে দিয়েছে। তানভীর মাথা তুলে একবার দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিলো। সে চায়না ঘৃণা লাগুক। বউয়ের কোন কিছুই ঘৃণা লাগা উচিত না। একমাত্র বউ তার যা ইচ্ছা তাই করুক। সে বাঁধা দিবে না। প্রচুর ধৈর্য্যশীল হতে হবে তাকে মনে মনে প্রে করলো। লাবিবা এবার মাথা তুলে সারা মুখ চুমু দিলো। গালে গাল ঘষে দিতেই ‘ আহহ ‘ করে মুখ তুলে নিলো। কয়েকদিনে দাড়ি বেড়েছে তানভীরের। তানভীর লাবিবার গালে হাত রাখলো। গাল ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ ব্যাথা পেলে?’
‘ একটু। ‘
‘ সেভ করে নিবো?’
‘ কিছুটা। ‘
‘ আচ্ছা। বুকে আসো। ‘
তানভীর শার্টটা খুলে গাড়ির সিটে ফিক্কা মারলো। সাদা গেঞ্জি গায়ে সুঠাম দেহের মাসল গুলো ফুলে উঠলো। লাবিবাকে টেনে আবার বুকের উপর নিলো। লাবিবা চুপচাপ তানভীরকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে পড়ে রইলো। তানভীর মাথায় আলতোভাবে হাত বুলাতে বুলাতে বললো, ‘ এভাবে কাঁদলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে। তুমি কি চাও না আমাদের বিয়েটা ইনজয় করি আমরা? ‘
‘ আমি আরো কাঁদবো। বাড়ি গেলেই আমার কান্না পাবে। আম্মু আব্বুকে দেখলেই আমার কান্না পাচ্ছে । এই বাড়িটা ছেড়ে যাবো ভাবলেই আমার কান্না পায়। বাড়ির আনাচে কানাচে তাকালেই আমার কান্না পায়। আমি কি করবো?সকাল হয়ে গেছে। বাড়ি যাবো।’
লাবিবা উঠে বসলো। সত্যি সত্যিই নেমে গেলো। তানভীর খপ করে লাবিবার হাত টেনে ধরলো,
‘ বাড়ি না গেলে হয়না?’
‘ কোথায় যাবো?’
‘ চলো কোথাও চলে যাই। আমার তো তেমন ছুটি নেই। তাই বিয়ের সময়টা আমরা আমরাই কাটাবো। বিয়ে তো আমাদের একবার হয়েই গেছে। আর কি দরকার? ভাইয়ার টা ভাইয়া করে নিক না। ‘
‘ ঐটা বিয়ে ছিলো? আমার গায়ে হলুদ হয়নি। মেহেন্দি হয়নি। আমি বউ সাজিনি। আলামতারা ধরেনি।বাসর হয়নি, বউভাত হয়নি। ‘
‘ ওসব কিছুই লাগেনা। কবুল বলেছো এটাই এনাফ। এবার চলো। ‘
‘ কাভি নেহি। আমি বিয়ে করবো। ‘
‘ আমি এখনি তোমাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবো।’
‘ না আমি বিয়ে করবো। ছাড়ুন।’
‘ বিয়ে অযথা প্যারা। এসব কিছু লাগবেনা। চলো। ‘
‘ না তবুও আমি বিয়ে করবো। ছাড়ুন। আব্বু!আব্বু আমি বিয়ে করবো। ‘
‘ লাব্বু প্লিজ চলো। ‘
‘ না আমি আগে বিয়ে করবো। ‘
‘ আহ! কামড়াচ্ছো কেনো?’
‘ না ছাড়লে তো কামড়াবোই। আপনার মাথায় এই ভুত চাপলো কেনো? ‘
‘ বলতে পারবো না। ‘
লাবিবা অনুসন্ধানী চোখে তাকালো। ভালোভাবে তানভীরকে পরখ করলো। তানভীর রাগ দেখিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। লাবিবা ফিক করে হেসে দিলো। মুখ চেপে ধরে বললো,
‘ আপনার হাত ধরে আমি অবশ্য ই পালাবো। তার আগে মানুষ হয়ে আসেন। চুল দাঁড়িতে এমন চেহারা বানিয়ে রাখলে আমি মানুষকে কি জবাব দিবো? লোকে বলবে লাব্বু তুই আর ছেলে পেলি না। এই পাগলটাকে নিয়েই পালাতে গেলি? আগে সেলুনে গিয়ে মানুষ হয়ে আসুন।’
‘ চলো। ‘
‘ কোথায়?’
‘ সেলুনে। ‘
‘ জেন্টস সেলুনে গিয়ে আমি কি করবো?’
‘ কিভাবে কাটলে তোমার মানুষের মতো দেখাবে সেটা বলে দিবে। আসো। ‘

মেয়েরা পার্লারে গেলে নাকি সারাদিনে বের হতে চায়না এরকম নানা রকম বুল্লি শুনতে হয় ছেলেদের মুখ থেকে। কিন্তু আজ জেন্টস পার্লারে এসে লাবিবা পুরোই বোকা বনে গেলো। ছেলেরাও পিছিয়ে নেই এদিক থেকে। এজন্যই বলে নারী পুরুষ সমান সমান। পুরোদমে উৎসুক হয়ে উঠলো দেখতে লাগলো লাবিবা। চুল কাটার সময় নিজেই কাট চুজ করলো। নির্দেশনা দিলো কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে। দাড়ির কাট টাও তার পছন্দে হলো। আফটার সেভিং জেল লাগিয়ে দিতে বললো। কিন্তু তা না করে ফেসিয়াল করে দেওয়া হলো। গুনে গুনে পাঁচ রকমের ক্রিমে ফেসিয়াল করলো মুখে। হাইড্রা ফেসিয়াল ও বাদ গেলো না। ফেস মাস্ক লাগিয়ে হাত পড়লো হেয়ারে। স্পা করে দিলো সুন্দর ভাবে। লাবিবা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা লেগে গেছে। তবুও সে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। এতো ফেসিয়াল তো সে নিজেও করেনি কোনদিন। ভাবী ছোট কাকী রেগুলার পার্লারে যাতায়াত। তারা কি কখনো করেছে? লাবিবা অস্থির হয়ে উঠলো। তানভীরকে তাড়া দিলো,
‘ শেষ? উঠুন তবে। ‘
তানভীর মুচকি হাসলো। আঙুলে ইশারায় সোফার দিকে তাক করে বললো, ‘ বসো। ‘
প্যাডিকিউর ম্যানিকিউর করে দিলো হাতে পায়ে। সেই পানিতে আবার গোলাপের পাপড়ির ছড়াছড়ি। তানভীর লাবিবাকে বললো, ‘ দুদিন ছিলাম শিপে। টেনশনে একদমই নিজের প্রতি যন্ত্র করা হয়নি। আঙুলগুলো অপরিষ্কার হয়ে গেছে কেমন! ‘
‘ ওহ।’
লাবিবা তানভীরের হাতে পায়ে আগেই খেয়াল করেছিলো। কোথায় অপরিষ্কার? সব সময় তো চকচক ই করে। লাবিবা গ্লাসের বাইরে তাকালো। দুপুরের কড়া রোদ! ফোনে সময় দেখলো ১২.০৫। পেট চো চো করছে ক্ষুধায়। যুহরের আজান দেওয়ার কিছুক্ষন পরে তানভীর বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়ালো। লাবিবা ভাবলো এইতো শেষ। এবার খাবে তারপর বাড়ি যাবে।‌ কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে তানভীর বললো,
‘ তুমি কি নামাজে যাবে? ‘
লাবিবা মাথা নাড়ালো। না। সে যাবেনা।
‘ আচ্ছা তাহলে বসো আমি নামাজটা পড়ে আসি। ‘
পার্লারের একজন সাথে সাথে বললো, ‘ ভাবী তাহলে বসেন। আমরা নামাজ শেষ করে আসছি। একা থাকতে পারবেন তো? আমার পার্লারে কোন প্রব্লেম হবে না। ‘
লাবিবা জিজ্ঞেস করলো, ‘ বাসায় যাবো না?’
‘ একটু লেট হবে। ‘
লাবিবাকে অবাক করে দিয়ে দ্বিতীয় দফায় তানভীর গিয়ে বসলো। ফুল বডি ম্যাসাজ করবে আজ। লাবিবা ভীষন ক্ষুধার্ত। তার হাতে বিরিয়ানি প্যাকেট। সামনে আরেকটা প্যাকেট রাখা। লাবিবার গলা দিয়ে আর খাবার নামলো না। তানভীর বললো খাইয়ে দিতে। লাবিবা দুই ঢুক পানি মুখে দিয়ে তার প্যাকেট থেকেই তানভীরকে খাইয়ে দিলো। খাইয়ে দেবার সময় প্রথমে অস্বস্তি হচ্ছিলো। কিন্তু লোকগুলোর মুখে কোন এক্সপ্রেশন ই খুজে পেলো না । বুঝলো তারা এসবে অভ্যস্ত। বিকাল চারটায় তানভীরের স্কিন ট্রিটমেন্ট শেষ হলো। বিল্ডিং এর চার তলায় মল। তানভীর একজনকে দিয়ে শার্ট প্যান্ট নিয়ে এলো। চেঞ্জ করে ফ্রেস একটা লুকে যখন পেমেন্ট করে লাবিবার সামনে এলো লাবিবা র মনে হলো তার চোখের পাওয়ার বেড়ে গেছে। এতো চকচকে করছে কেনো? চেহারায় কি আয়না লাগিয়ে দিয়েছে? ভাগ্যক্রমে লাবিবার এর আগে কয়েকবার চোখে পড়েছিলো। এতো ড্যাসিং লুক! লাবিবা শুকনো গলায় ঢুক গিললো। জানতে চাইলো,
‘ আপনি কি প্রায়ই এমন ট্রিটমেন্ট নেন?’
‘ হুম। কেনো?’
লাবিবা দাঁড়িয়ে গেলো। চোখ বড় বড় করে ফেললো।
‘ কি সাংঘাতিক !’
‘ কেনো?’
‘ আমি ভুল ছিলাম। বিয়েটা আপনার জন্যই খান সাহেব, আমার জন্য নয়। ‘
‘ কি বলছো?’
‘ ঠিকি বলছি। এরজন্য ই তো বলি এতো চকচক করে কেনো?’
‘ কিসব কথা বলছো? চলো। ‘

বাড়িতে ফিরতেই সাবিনা জানালা দিয়ে উঁকি দিলো। তানভীরের গাড়ি দেখে কিছু বললোনা। কিন্তু লাবিবাকে তাড়া দিলো। জলদি রেডি হতে। লেহেংগা চাপিয়ে আনতে যাবে উর্মিলার সাথে। রাত নাগাদ ফিরে এসেই ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে রওনা দিলো সবাই মিলে হলের দিকে। একদিনেই পর পর দুটো অনুষ্ঠান। সকালে মেহেন্দি বিকালেই গায়ে হলুদ। বেশী সময় নেওয়া হয়নি। নিতু ইসলামের ছেলে মেয়ে এসেছে আমেরিকা থেকে হাতে তিনদিন সময় নিয়ে। তাঁদের জন্য ই আরো তাড়াহুড়ো। এদিকে আত্মীয় স্বজন প্রায় সবাই চাকুরীজীবি। কোনভাবে ছুটি ম্যানেজ করে আসছে।

লাবিবারা পৌঁছে দেখলো রোজীরা আগেই চলে এসেছে। লাবিবাকে নিতে রোজী তখনই নিচে নেমে এলো। ব্যাগ ট্যাগ বুঝিয়ে দিয়ে ছুটলো লাবিবাকে নিয়ে হাত ধরে। ছাদের এক কোনায় নিয়ে গিয়ে থামলো। লাবিবা জিজ্ঞেস করলো,
‘ আপু কি হয়েছে?’
‘ তোমার ভাসুরের সাথে একটু কথা বলিয়ে দাও। ‘
‘ ফোন দাও। ‘
‘ আমার হাতে ফোন নেই। আর ছেলের বাড়ির সেক্টর ঐ দিকে থাকবে আর মেয়ের বাড়ির এই দিকে। সবাই বলে দিয়েছে বিয়ের আগে ছেলে মেয়ে আর নো দেখা। ‘
‘ এই আইন কখন পাস হলো?’
‘ তুমি আসার একটু আগে। ‘
‘ তাহলে এখন উপায়?’
‘ নাকিবকে বলো একটু ডেকে দিতে। আমি পেছনের ঐ রাস্তার দিকে যাচ্ছি হে? ব্যবস্থা করো একটু বোন। ‘
‘ তুমি যাও। আমি ভাইয়াকে পাঠাচ্ছি।‌ ‘
‘ হুম। ‘

তামিম একটু রেগেই আছে রোজীর কান্ডে। শুনশান এদিকটায় গাছগাছালির বাগানে গা ছম ছম করে। নির্বোধ মেয়ে কিভাবে এখানে একা একা এসে দাড়িয়ে থাকে?’ ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো তামিম। ঐতো সামনে রোজীর ছায়া দেখা যাচ্ছে। তামিম আর সেদিকে গেলো না। এখানেই দাঁড়িয়ে ডাকলো, ‘ রোজ। ‘
রোজী শুনতে পেলো। পা চালিয়ে সে তামিমের সামনে উপস্থিত হলো। তামিম পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে পা যাথাসম্ভব দূরত্বে রেখে দাঁড়ালো। শান্ত গলায় জানতে চাইলো, ‘ রোজ। ডেকেছো কেনো?’
রোজী তখনই উত্তর করলো না। কি উত্তর দিবে সে জানে। কিন্তু সংকোচ বোধ করছে। তামিম আবার বললো, ‘ রোজ। তুমি এখনো আমার সাথে ফ্রি হতে পারনি তাইনা? ‘
রোজ এবার সাহস সঞ্চয় করে প্রশ্ন করলো,
‘ আমি কি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে পারি? পার্সোনাল। আমার জানার খুব দরকার। ‘
‘ বলো। ‘
‘ ডাক্তারসাহেব। আপনাকে আমার ভীষণ ভালো মানুষ মনে হয়। আমার মনে হয় আপনার সাথে নির্ধিধায় আমি শেষ বয়স পর্যন্ত পার করতে পারবো। আপনাকে আমি আমার মনে অতিশয় জায়গাও দিবো। আপনার সাথে পরিচয় হবার দিন থেকে এখন পর্যন্ত আমার এসব ই মনে হয়েছে। আমি কোন বিশ্বাস ঘাতককে মনে রাখবো না। আপনাকে গ্ৰহণ করতে আমি অনেক দিন থেকে মনের উপর জোর খাটিয়ে বুঝিয়ে প্রায় প্রস্তুত হয়েছি। আপনি কি আমাকে গ্ৰহণ করতে প্রস্তুত?’
তামিম স্বীকার করলো, ‘ হ্যা আমি প্রস্তুত। ‘
রোজী যেনো একটু হাসলো। অস্থিরতা কমে শান্ত হয়ে গেলো। তামিমের চোখে চোখ রেখে বললো, ‘ হিরোইন ফ্লোরা যে বিদেশে অবস্থান করছে এখন আপনি জানেন?’
‘ আমিই তাকে ব্যবস্থা করিয়ে দিয়েছি। ‘
রোজী ফিকে হাসলো। এদিক ওদিক তাকালো। তামিম বললো, ‘ আমি ফ্লোরাকে ভালোবাসি রোজ। এ কথা আমি অস্বীকার করতে পারবোনা কখনো। তোমাকেও আমি আমার জীবনের একটা অংশ হিসেবে গ্ৰহণ করতে চাই। আমার ভবিষ্যৎ সঙ্গী হিসেবে পেতে চাই এটাও সত্যি। আমি হয়তো ফ্লোরার জায়গাটা তোমাকে দিতে পারবোনা। কিন্তু তোমার জায়গাটা তোমাকে ঠিকই দিতে পারবো। ‘
‘ আমার জায়গা কোথায় ডাক্তারসাহেব?’
‘ আমার পাশে। ‘
রোজী মুগ্ধ চোখে তামিমের দিকে তাকিয়ে রইলো। এটুকুই তো সে শুনতে চেয়েছিলো। এক সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসছে সে। আবার একটা সম্পর্কে অবহেলিত হতে চায় না। তামিম আচমকা রোজীর হাত টেনে তাকে বুকের উপর ফেললো। দুহাতে শীর্ণ দেহটাকে জড়িয়ে ধরলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বললো,
‘ আমাকে হেল্প করো রোজ। নিজের দিকে আমাকে টেনে নাও। আমি মনের বিরুদ্ধে আর কতো একা একা লড়ে যাবো? আমার সঙ্গী হও। অনুপ্রেরণা দাও। সুখের পথ দেখাও। তোমাকে ভালোবাসতে শেখাও। নিজের মায়ায় আবৃত করে নাও। ‘

চলবে ____

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(৫৬)
বিশাল বড় একটা হল ভাড়া করা হয়েছে। জায়গাটা শহরের একটু বাইরের দিকে। বাইপাস মোড় থেকে ডানদিকে যেতে হয়। গ্ৰামীন পরিবেশে এতো বড় হল সারাবছর ই বুকিং থাকে। রুচিশীল মানুষ যারা একটু ইউনিক ভাবে তাঁদের মেমোরিস গুলো মেমোরাবল করে রাখতে চায় তারাই বেছে নেয় হলটা। রাত জন্য জায়গাটা ঘুরে দেখা হলোনা লাবিবার। সকাল সকাল ই বেরিয়ে পড়বে দেখার জন্য ঠিক করলো। লাবিবা যে রুমে আছে সেই রুমে সব সমবয়সী মেয়েরা। কেউ কেউ ফ্রেন্ডস কেউ কেউ কাজিন। লাবিবা তানভীর কে কখন থেকে ট্রাই করে যাচ্ছে তানভীর ফোন ধরলোনা। অচেনা জায়গা গাদাগাদির ভেতরে লাবিবার আর ঘুম হবে না। লাবিবা একবার পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে নিলো। সবাই ঘুম। হটাৎ করে মনে হলো কেউ একজন নড়লো। লাবিবা এগিয়ে গেলো দেখার জন্য কে নড়লো। মুখের উপর থেকে চাদরটা সরাতেই হাত চেপে ধরলো। লাবিবা ভয় পেয়ে গেলো। রোজী সাথে সাথে কথা বললো, ‘ লাবিবা?’ লাবিবা যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো।‌নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘ আপু? ঘুমাও নি?’ রোজী ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। জীবনে এক ই রাত সে দুইবার পেলো। একই অনুভূতি। সাথে পূর্বের রাতের জন্য কিছুটা খারাপ লাগা। লাবিবা আবার ডাকলো,
‘ আপু?’
‘ আমার ঘুম আসবেনা লাবিবা। ‘
‘ আমারো ঘুম আসছে না। চলো গল্প করি। ‘
‘ আমাকে ঘুমোতে হবে। বাই। ঘুমোও লাবিবা। ‘
রোজী আবার মুখ ঢেকে ফেললো। লাবিবা অবাক হলো। ‘ এটা কি হলো?’

লাবিবা একা একা ছটফট করলো। রুম ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। লম্বা বারান্দা। এ মাথা থেকে ঐ মাথা দেখা যায়। মাথার উপর জ্বলছে এল ইডি বাল্ব। লাবিবা রুমে ফিরে আসলো। তার লাগেজ টা টেনে বের করলো লাগেজের স্তুপ থেকে। লাগেজের ভেতরে তানভীরের জার্নাল। সে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। জুতো খুলে ফ্লোরে বুড়ো আঙুলে দাগ কাটলো। একদমই চকচক করছে ফ্লোর। রাতে সবাই রুমে যাবার পর ই বোধ হয় মুছে দিয়ে গেছে। সে বসে পড়লো। জার্নাল টা খুললো। প্রথম কিছু পাতা ছোট ছোট লেখা। প্রথম পাতার উপর ছোট্ট করে লেখা ‘ বউ ‘ । লাবিবা পড়ে যা বুঝলো ভবিষ্যত বউকে নিয়ে জল্পনা কল্পনা ই এখানে লেখা। এতো ধৈর্য্য হলো না। সম্পূর্ণ স্কিপ করে খুঁজতে লাগলো লাবিবার কথা কোথা থেকে লেখা। প্রথমেই একটা ছবি পেলো। কলেজ ড্রেস পরা ছবি। মুখে ফুচকা তুলে খাচ্ছে। লাবিবা মুচকি হেসে রেলিং এ পিঠ ঠেকিয়ে দিলো। উৎসাহ নিয়ে পড়লো,
‘ কিশোরী বড্ড চঞ্চল। ‘
পরের পাতায় ধান ক্ষেতের মধ্যে হেঁটে যাওয়া ছবি। কমলা রঙের ওড়না দিয়ে ঢাকা কোমড় অব্দি। যতটুকু দেখা যাচ্ছে তা শুধুই নাক। কিন্তু ছবি তুলার ধরণটাই অসাধারণ। তার নিচে লেখা,
‘ উদাস ফাগুনে আগুন ধরিয়ে দিয়ে যায়। ‘
লাবিবা একটু নড়েচড়ে বসলো। ছোট্ট ছোট্ট লেখা তার গভীরতা জানতে গেলে খেই হারিয়ে ফেলবে।
ছাদের কিনারে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখার মুহূর্ত।পাশেই লেখা,
‘ ঐ চাঁদের চেয়ে আমার চাঁদটা আরো সুন্দর। ‘
কিছু ছবি মাঝখান দিয়ে কাটা। লেখা,’ আই ওয়ান্ট টু ফরগেট য়্যু। ‘ লাবিবা বুকটা ধুকপুক করতে লাগলো। পরের ছবিটা আরো বিচ্ছিরি করে কাটা। লেখা,’ আই উইল সুন ফরগেট য়্যু। ‘ লাবিবার বুকে যন্ত্রনা শুরু হলো। সেই সময়টুকু তানভীরের কেমন কেটেছে ভাবতেই চোখে জল ছলছল করে উঠলো।
পরের পেইজে কোনো ছবি লাগানো নেই। আছে পেন্সিলের আঁকা ক্রেচ। ছোট্ট করে একটা লাবিবা। এলোকেশী চুলে ভাঁজে পড়া শাড়ী গায়ে হাতে গলায় অলংকার। নিচের দিকে ছোট্ট করে দুই লাইন লেখা,
‘ এতো কেনো জ্বালাতন? সপ্নেও হানা দেওয়া!
ওকে ফাইন, নাউ আ’ম নট লিভিং য়্যু। ‘
নিচ থেকে আরেকটা ছবি তুলা। মাথায় ঘোমটা টানা। থুতনিটা প্রথমেই শো করছে। এদিক ওদিক কোনো লেখা নেই। উপরেই গ্লু লাগানো নিচে নেই। লাবিবা ছবিটা একটু নিচ থেকে উল্টে ধরলো । ছবির নিচে লেখা।
‘ আই ওয়ানা বাইট য়্যু। ‘
লাবিবার হাত থেকে ধপ করে পড়ে গেলো শক্ত মলাটের আবরণ টা। লাবিবা শক্ত ঢুক গিললো। প্রথম দিনের সেই বাইট ! চোখের সামনে ভেসে উঠলো।

প্রথম বিয়েতে ছিলো কষ্ট আর ভয়। কনফিউশনে ভরপুর সেই সময়। কিন্তু এবার যেনো পুরোদমে মেতে উঠেছে বর কনেরা। প্রথম বিয়ের আমেজে মাতোয়ারা। লাবিবা তো লজ্জায় লাল টুকটুকে হয়ে আছে। যখন কেউ কিছু বলছে তখনই জোর গলায় উত্তর দিচ্ছে,
‘ একদম ফাও কথা বলবেনা। আমার লাভ ম্যারেজ হচ্ছে। দশমাসের প্রেমের সম্পর্ক পরিণতি পেতে যাচ্ছে। আমি হাসিখুশি থাকবো নাতো কে থাকবে?’
সবার মাঝে হাসির রোল পড়ে যায়। রোজীকে জিজ্ঞেস করতেই রোজী ঘাবড়ে যায়। লজ্জাও পায়। শাড়ীর ঘোমটা আরো নিচে টেনে মুখ চেপে বসে থাকে। লাবিবা চেঁচিয়ে বলে,
‘ হেই রোজ কতদিন হলো? রেস্টুরেন্টে ডেটে যেদিন গিয়েছিলে সেদিন থেকে ধরবো নাকি কাল রাত থেকে? ‘
লজ্জায় রোজীর চোখদুটোও বন্ধ হয়ে এলো। উর্মিলা লাবিবার উপর ঢলে পড়লো। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভঙি করে বললো, ‘ আহা! কেয়া সিন হে হিরো হিরোইন কা ‘
লাবিবার আরো দুজন বান্ধবী এসেছে মালা তো নাকিবকে ফোন দিয়েই বসলো, ‘ হ্যালো নাকিব! দোস্তরে, কাল রাতে অন্ধকারে কেয়া সিন হে! ‘
ফোনের ঐপাশে নাকিব সহ সব মেয়েরাই হাসতে হাসতে গলে পড়লো। রোজীর ইচ্ছে করছে এখান থেকে পালিয়ে যেতে। এতোক্ষন মনটা ভীষণ খারাপ করছিলো। লাবিবা যে কি! বুঝতে পেরে কিভাবে তাকে লজ্জায় দিচ্ছে। রোজী মনে মনে লাবিবার জন্য প্রাণখুলে দোয়া করলো। কিছু কিছু মানুষ আসে জীবনে আশির্বাদ হয়ে। লাবিবা তার জন্য আশীর্বাদ। আর ডক্টর তামিম খান! রোজী লজ্জায় যেনো আজ মারাই যাবে। মেহেন্দীর জন্য মা চাচীরা এসে ঝটপট তাড়া দিয়ে যায়। মেহেন্দী অনুষ্টান হবে ছেলেপক্ষ মেয়ে পক্ষ একসাথে। কিন্তু হলুদ দেওয়া হবে আলাদা আলাদা যেহেতু হলুদের গোছল দেওয়ানো হবে। তাড়াতাড়ি একটা অনুষ্টান শেষ করলেই না পরেরটার প্রস্তূতি নিতে পারবে।

সকাল আটটায় তানভীর বেশ কয়েকদিন পর গোছল দিলো। এতোদিন ব্যস্ততায় নিজের পানচুয়াল লাইফটা পুরো ঘেটে গেছে। রেডি হতে এসেই দেখে তামিম একদম অফ হোয়াইট শেরওয়ানি পড়ে রেডি। ভীষন ভালো লাগছে তাকে। চল্লিশ ছুই ছুই মানুষটা বোঝায় যাই না। তানভীর একগাল হেসে বললো,
‘ সুন্দরী ভাবির ছোঁয়ায় ভাইয়ের কি আমার বয়সটা আরো কমে গেলো?’
তামিম ও হাসলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আতর লাগাতে লাগাতে বললো, ‘ জোকস অফ দ্যা ইয়ার। ‘
‘ আরে, বিলিভ মি। ‘
‘ কুইক রেডি হ। আমি বেরোলাম। ‘
‘ য়্যু লুক সো গর্জিয়াস ভাই। ‘
‘ থ্যাংক য়্যু। ‘

তামিম বের হবার পথে নাকিবকে ক্রস করলো। নাকিব ঝটপট একটা শপিং ব্যাগ তানভীরের সামনে রাখলো।
‘ স্যার। আপনার মেহেন্দী ড্রেস। ‘
‘ লাবিবা?’
‘ জি স্যার। কুইক রেডি হয়ে আসুন। ‘

নাকিব বেরিয়ে যেতেই তানভীর ব্যাগ থেকে ড্রেস বের করে নিলো। চোখ আটকে গেলো কটির কাপড়টার দিকে। সাত রংয়ের মিশেল ভারী সুন্দর সিকুয়েন্সের কাজ। এরজন্য ই তার বউ এতো পাগলামি করলো? সারপ্রাইজ দিবে বলে দেখালোনা পর্যন্ত! তানভীর রিয়েক্ট করতে ভুলে গেলো। কটি হাতে তুলে নিতেই কাপড়ের ভাজে সবুজ চিরকুট চোখে পড়লো।
কালো মার্কারে ছোট ছোট গুটি গুটি হাতের লেখা,
‘ এ্যা সারপ্রাইজ ইজ ওয়েটিং ফর য়্যু। ‘
তানভীর মুচকি হাসলো। পাঞ্জাবীর দিকে তাকিয়ে দু আঙুলে দু চোখের পাতা চেপে ধরে আবার হেসে উঠলো। সারপ্রাইজ সেও দিতে জানে তার বউকে । পাঞ্জাবী কটি পড়ে একদম তৈরী হয়ে গেলো। চুলগুলো সেট করে কড়া স্মেলের আতর মাখলো গায়ে। হাত ঘড়িটা পড়ে নিলো। হালকা করে গ্ৰুম বেস মেকাপটাও সেরে নিলো। তামিম ইউজ করে একদম ফেলে রেখে গেছে ভ্যানিটির উপরেই। তানভীর সেটা প্যাক করে লাগেজে ঢুকিয়ে রাখলো। সে ভালো করেই বুঝে গেছে আজ তার বউ শোধ তুলবে। এতোদিন বকা ঝকা বুঝিয়ে আঁটকে রাখা মেয়েটা কোনো বাধা মানবেনা। পুরো রেইনবো হয়ে তার সামনে ধরা দিবে। সে যদি তার মাথা ঘুরিয়ে দেয় সেও তাকে পাগল করে ছাড়বে। তানভীর একদম রেডি হয়ে আয়নায় আরেকবার এদিক সেদিক ঘুরে নিজেকে দেখে নিলো। একই বিল্ডিং এ দুজন আজ দুজনের জন্য তৈরী হচ্ছে ভেবেই তানভীরের হার্টবিট বেড়ে গেলো। এটাই চেয়েছিলো সে না? এই দিন এই সময়টাই তো চেয়েছিলো।

রোজীর পড়নে মেজেন্টা রংয়ের বড় রাউন্ড গাউন। রোজী একেবারেই অভ্যস্ত নয় এরকম ড্রেসে। রোজীর মনে হলো এই ড্রেসে লাবিবাকে সুন্দর লাগবে। লাবিবা এতে অভ্যস্ত। সে লাবিবাকেই বলবে এটা পড়তে আর লাবিবার লেহেংগা সে পড়বে। তারপর মনে পড়লো সাইজ হবেনা। অগত্যা গাউন পড়েই যতটা সম্ভব কমর্ফোর্ট দেখানো যায় চেষ্টা করে যাচ্ছে। নিতু ইসলাম এলেন লাবিবা রোজীকে নিয়ে যেতে। স্টেজে তানভীর তামিম এসে গেছে। মেয়েদের বললেন চলো তোমরা পেছনে দাঁড়াও তিনটি সারি বেঁধে। ব্রাইডদের পেছন পেছন যাবে। ক্যামেরাম্যান ভিডিওগ্ৰাফার সবাই রেডি। দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। নিতু ইসলামের সাথে তার মেয়ে এনা আর নাতনী মারিয়া। আমেরিকা থেকে এসে আজ সকালেই হলে এসেছে। এতোক্ষন অপেক্ষার পর দুই ব্রাইডকে দেখে অভিভূত হয়ে গেলো। নিতুই ইসলাম তো লাবিবাকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়ে বসলো। আদরে বললো, ‘ আমার ছোট মা। ‘
রোজীকে বুকে টেনে নিয়ে মৃদু হাসলো। কপালে চুমু খেয়ে দোয়া দিলো, ‘ স্বামী সোহাগী হও। ‘
রোজী নুইয়ে গেলো। সবাই হি হি করে হেসে উঠলো। লাবিবা বেশ মজা পাচ্ছে রোজীকে দেখে। এদিকে সে যে আরেকজন ব্রাইড তার কোনো হুস ই নেই। মনে মনে একটাই তার অস্থিরতা কখন সে তানভীর কে দেখবে? কাল থেকে কথাও হচ্ছে না। লাবিবার অনুভূতি সদ্য ফোটা কিশোরীর মতো। যখন প্রথম তার ভ্রমর এসে বসে মধু খাওয়ার জন্য। বিয়ের দশমাস বয়সে কতক্ষন পেয়েছে তানভীর কে? নয়টা রাত মাত্র! তার মাঝে পাঁচ রাত আদরে মুডিয়ে আরেক রাত কষ্ট আর বাকিগুলো _
একান্ত ভাবে প্রতিটা দিন প্রতিটা রাত প্রতিটা সময় পাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে সে। আর দুটোদিন অপেক্ষা। আগামী রাত থেকেই তো তানভীর পুরোপুরি তার। না সে তানভীর কে আর বেপারোয়া ভাবে থাকতে দিবে আর না তানভীর তাকে ছেড়ে থাকতে পারবে। স্বামী নামক মানুষটার ভালোবাসার গভীরতা কতদূর তার জানা হয়ে গেছে। বাকী যদি থাকে সেটাও জানতে দেরী নেই । লাবিবার মন টানছে। ভীষণ ভাবে মন টানছে সেই অপেক্ষারত মানুষটার জন্য।

লাবিবার হাতের আঙুল ধরলো ছোট্ট মারিয়া। লাবিবা হাই দিতেই সেও বললো, ‘ হ্যালো মামুনী। ‘
‘ কি কিউট!’
‘ তুমি ও কিউট। গুলুমুলু মারিয়ার মতো। ‘
রোজী টুকটাক কথা বলছিলো এনার সাথে। পাশ থেকে মারিয়ার গাল টেনে দিলো।

তানভীরের অপেক্ষার অবসান হতে চললো। তামিমকে ভাই ব্রাদার্স রা ধরেছে হাতে মেহেদি লাগিয়ে দিবে বলে। তানভীরকেও ডিস্টার্ব করতে চেয়েছিলো। এক চোখ রাঙানি দিতেই সবগুলো নরম সোজা তামিমকে নিয়ে পড়েছে। তামিম কোন মতে থামিয়ে রেখেছে রোজ আসুক বলে। আট নয়জন ফটোগ্ৰাফার সামনে ধীরে ধীরে পিছিয়ে আসছে। তার পরেই ব্রাইড দুজন। ঠিকভাবে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তানভীরের দৃষ্টি পড়েছে হাটার তালে ছন্দ তোলা সেই রেইনবো দোপাট্টার দিকে। ধীরে ধীরে নিকটে দৃষ্টি পরে আসছে মুহুর্ত গুনে। অবশেষে দৃষ্টি মেলালো সেই দৃষ্টিতে। একগাল লজ্জামাখা হাসি নিয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। তানভীর বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। এক হাত স্বাভাবিক রেখে আরেক হাত চলে গেলো ডান পাশে বুকের উপরে। ঠোঁটে বাঁকা হাসি রেখা টান দিতেই লাবিবা মাথা নুইয়ে নিলো। দুহাতে লেহেংগা উপুড় তুলে সিড়ি বেয়ে নেমে এলো পর পর পায়ে। একদম তানভীরের সামনে। তানভীর বাকি দূরত্বটা অনেকটাই ঘুচিয়ে নিলো এগিয়ে এসে। কপালে চুমু ফিসফিসিয়ে বললো ‘ মাশাআল্লাহ ‘।
দু পাশ থেকে ছেলে মেয়েদের মাঝে হৈ পড়ে গেলো এমন দৃশ্যে।

তামিম এক হাত এগিয়ে নিয়ে এলো রোজীকে। রোজীর লাজুক মুখের দিকে তাকিয়ে জানালো, ‘ রোজ! তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। ‘ রোজীর বিশ্বাস হলোনা তেমন তামিম তাকে এভাবে বলছে। অবিশ্বাসের সাথেই বললো, ‘ এমনটা ও না ‘ তামিম চিন্তিত হয়ে পড়লো। গম্ভীর স্বরে বললো, ‘ হুম। ওয়েটটা অনেকটাই বাড়াতে হবে। ‘ রোজীর লজ্জা মাখা মুখ ফুস হয়ে গেলো। তামিম একগাল হেসে দিলো, ‘ মন খারাপ করো না। আমি আছি কি করতে? বেশী বেশী ডোজ দিয়ে ওয়েট গেইন করিয়ে দিবো। ‘
রোজীর বুকে হাপর টানলো। কানদিয়ে ধোঁয়া বের হলো। হায় আল্লাহ, কি অসভ্য!

ব্রাইড দুজনকে ধরে বসিয়ে দিলো দুই দিকে। তাঁদের পাশে গ্ৰুম বসবে। তামিম বসতেই হৈ পড়ে গেলো। এবার তামিমকে মেহেদী পড়তেই হবে। কি বড় ঝামেলা! তামিম বোঝানোর চেষ্টা করলো ‘ আরে তোদের ভাবীকে পরা। মেহেদী মেয়েদের হাতেই মানায়। আমি কেনো?’
‘ তাতো হবেনা ভাইয়া। আগে তোমাকে পড়াবো তারপর তানভীর ভাই__’
তানভীরের কথা বলতেই তানভীর কটমট করে তাকালো। ব্যাস। সবার সাহস ফুস করে উড়ে গেলো। তামিম বললো, ‘ তারচেয়ে বল নাচতে আমি নাচছি। তবুও মেহেদী পড়তে বলিস না। ‘
সবাই বলে উঠলো এই মিউজিক ছাড়ো। মিউজিক স্টার্ট হতেই একদল ছেলে এসে দাঁড়ালো। তামিম কে উঠতেই হবে তামিম বুঝতে পারলো। রোজীকে বললো,
‘ তুমি মেহেদী পড়া শুরু করো। ‘
‘ আচ্ছা। ‘
উঠতে গিয়ে আবার বসে পড়লো,
‘ রোজ! তুমি নাচতে পারো?’
রোজী ঘাবড়ে গেলো, ‘ এই না না আমি নাচবোনা। ‘
‘ তার মানে পারো। ‘
‘ না পারিনা। ‘
‘ লাবিবা তোমাকে এতো কিছু শেখায় এটা শেখাতে পারলো না?’
‘ এমা! কি শিখাবে? কিচ্ছু শেখায় না। ‘
‘ কিচ্ছু না শেখালে গাউন পড়ে এভাবে হেঁটেও আসতে পারতে না। বসেও থাকতে পারতেনা ইজি ভাবে। ‘
রোজী বড়ো বড়ো চোখ করে তাকালো। সত্যি সত্যিই তো কাল রাতে ঘুমানোর আগে এই গাউন পড়ে অনেকক্ষন সে ছিলো। টুকটাক নাচের স্টেপ ও শিখিয়ে দিয়েছে লাবিবা। তামিম কিভাবে জানলো?

পেছন থেকে লাবিবার কোমড় চেপে ধরতেই লাবিবা একদম সোজা হয়ে গেলো। তানভীর কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে বললো, ‘ জান! চলো আমরা রুমে গিয়ে মেহেদী পড়ি। প্লিজ! ‘
যেটা ভেবেছিলো সেটাই হলো। লাবিবা ভেবেছিলো তানভীর এমন একটা কথা বলবেই বলবে। কিন্তু মেহেন্দী পড়ার আগেই যে বলে বসবে এটা ধারণা করেনি। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো অনেক ছেলে মেয়ে তাকে দেখছে। দেখবেই তো। দেখার ই কথা। যেভাবে চিপকে বসেছে না দেখে যাবে কই? তার মাঝে আবার ব্রাইড! লাবিবা মিষ্টি করে হাসলো,
‘ আপনার কি জেলাসি হচ্ছে আমার দেবর ভাইয়েরা আমাকে দেখছে বলে?’
‘ হুম। ‘
কি সহজ স্বীকারোক্তি!
লাবিবা অসহায় দৃষ্টি ফেললো। কিন্তু পাত্তা দিলো না। এখন যদি আর দু একটা কথা বলে এই বিষয় টেনে নিশ্চিৎ তাকে টেনে নিয়ে চলে যাবে। মেহেদী পড়ানো মেয়েকে বললো,
‘ মেহেদী পড়াও সুন্দর করে। আমার অনেক গুলো পিকচার নেবার আছে। ”
মেয়েটা বললো, ‘ স্যার আপনি কি পড়াবেন?’
‘ দাও স্টার্ট করে দিচ্ছি। ‘
তানভীর নিজে থেকেই হাত টেনে নিলো। ক্যামেরা ম্যান দুজন এগিয়ে এলো। তাঁদের কোন কিছু তে বলে দিতে হয়না। নিজে থেকেই সব ক্লিক করে নেয় ‌।
হাতের মাঝবরাবর তানভীর লাভ আকালো। তার মাঝে টানা টানা বড় বড় হাতের লেখায় লিখলো তানভীর+লাবিবা। মেয়েটা অবাক হয়ে বললো, ‘ স্যার আপনার টার্ন তো বেশ ভালো হয়। ‘
‘ এবার তুমি দিয়ে দাও। কনুই পর্যন্ত দিলেই এনাফ। উপরে যাবে না। ‘
লাবিবা মুখ টিপে হাসলো। তানভীর পাশ থেকে উঠলোনা। লাবিবা খুব কাছ থেকে তানভীর কে দেখতে লাগলো। আর ভাবতে লাগলো এই অসাধারণ পুরুষ টা কবে তার হলো? সে কেমন যেনো হয়ে গেলো। আশেপাশে কেউ না থাকলে এখনি চুমু খেয়ে নিতো। এতো মায়া লাগে! মনের ভেতর এতো প্রেম জাগে! কাছাকাছি এলেই লজ্জারা ঘিরে ধরে। এসব এতোকাল কোথায় ছিলো? সমস্ত আবেগ,প্রেম, অনুভূতি গুলো এই একটা মানুষের জন্য ই জমা ছিলো।

তামিম যেহেতু নিজে ছাড়া পায়নি রোজীকেও ছাড় দিবে না। রোজীর মেহেদী পড়া হয়ে যেতেই মেয়েদের জন্য জায়গা করে দিলো ছেলেরা। মেয়েরা বলতে রোজী লাবিবার ফ্রেন্ড কাজিনরা তানভীরের ফ্রেন্ড কাজিন রা। কলেজের কিছু ছাত্র ও বাদ পড়ে নি। এজন্য তানভীরের একটু লজ্জাই করছে। তবে আন্যভাবে। কলেজের ফ্রেশার কেউ বাদ পড়েনি। এলাহি আয়োজন। যেদিকেই তাকাচ্ছে সেদিকেই মানুষে গিজ গিজ করছে যার একাংশ ও আত্বীয় স্বজনরা না। পলিটিক্যাল ফেমেলির ছেলে মেয়েরাও বাদ যায়নি।

তামিম রোজকে টেনে তুললো কনুইয়ের উপরে ধরে। রোজী বলছে, ‘ না না আমি পারবোনা। ‘ তামিম অভয় দিচ্ছে, ‘ য়্যু ক্যান। কাম উইথ মি। ‘
রোজীর আত্তা শুকিয়ে গেছে। এমনিতেই গাউনটাতে কমফোর্ট না। পিঠের দিকে চুলকাচ্ছে। রোজীকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ ভাবী কোন গান ছাড়বো?’
রোজী মনে করতে লাগলো রাতে কোন গানের স্টেপ শিখেছে। লাবিবা চিল্লিয়ে বললো, ‘ খামোশিয়ান ‘ ।
‘ ভাবী কাপল ডান্স হবে কিন্তু। ‘
রোজী কখনো নেচেছে? তাও আবার কাপল! বড়লোকের কারবার সব! এখানে লাজ লজ্জাও ম্যাটার করেনা। রোজীর যখন প্রথম বিয়ে হলো লজ্জায় তাকে কেউ বের ই করতে পারেনি। বাড়ির সবাই আগলে রেখেছে। এদিক থেকে ওদিক ও হেঁটেছে ধীরে ধীরে। আর এখানে সবার সামনে কাপল ডান্স। হাত ধরে কথা বলা। রোজী অসহায় দৃষ্টি ফেললো তামিমের দিকে। তামিম এগিয়ে এসে রোজীর কটিদেশ চেপে ধরলো। মুখোমুখি হয়ে বললো, ‘ আমার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে চলা শেখো রোজ। খবরদার পা যেনো আমার আগে না চলে! আমি কিন্তু কোনো সাধারণ পরিবারের ছেলে না।’
নিরব হুমকিটা বুঝতে রোজীর দেড়ি হলোনা। সে বার বার খেই হারিয়ে ফেলে তামিমের কথায়। কনফিউশনে পড়ে যায়। তামিম কি তার জন্য পথ প্রদর্শক নাকি না?

কাপল ডান্সটা খুব ভালোভাবে শেষ করার চেষ্টা করলো দুজনেই। একেতো হাত ভরা মেহেদী তার উপর কাপল ডান্স। তামিম কতটা হেল্পফুল সেটা স্বচক্ষেই দেখে নিলো। ডান্স শেষ হতেই এনা আর এনার হাজব্যান্ড এক বান্ডিল টাকা উড়ালো। তামিম ঝুঁকে বললো, ‘ থ্যাংক য়্যু। থ্যাংক য়্যু দুলাভাই। ‘
তানভীর কে ডাকলেই তানভীর বলে উঠলো,
‘ আমার টাকাতে হবে না দুলাভাই। বউ আমার পাঁচ বছরের কঠোর সাধনার। ডলার ছাড়া উঠা যাবে না। ‘
সবাই হৈ দিয়ে উঠলো। এনার হাজবেন্ড বললো,
‘ সেটা আমরা সেট করে নিবো। তোমাকে ভাবতে হবেনা। ‘
‘ সরি দুলাভাই। বউ আমি এক সেকেন্ডের জন্য কাউকে দিচ্ছি না। ‘
‘ আচ্ছা যাও ডলার ই দিবো। সেকেন্ড এর আলাপ বাদ মিনিটে এসো। ‘
তানভীর কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো, ‘ এর থেকে আমার আরেকটা বোনের ব্যবস্থা আপনাকে করে দিবো তাও ভাই বউ চাইবেন না। আমার একমাত্র বউ দম ফুরিয়ে যাবে। বাঁচবো না। ‘
তানভীরের কথায় পুরো সমাবেশ হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়লো। দুলাভাই পেট চেপে ধরে বললো, ‘ শালা! এতো বউ পাগল কবে হলি? খালামনি খালুকেও ছাড়লি না। ‘
লাবিবা নাচের মাঝে তানভীরকে হারিয়ে ফেললো। পাশে পেলো না। চোখ জুড়া নাচের তালে তালে খোঁজতে লাগলো। তানভীরের দৃষ্টি তখন ঘুরছে নাচের তালে বৌয়ের শরীরের প্রতিটা বাঁকে। ঘাড়ের উপর উষ্ণ শ্বাস ফেলে জানালো একটি কথা।
‘ য়্যু উইল বি ফিনিশড লাবিবা। ‘

ব্যাপারটা ঠিক এমন যে আমার জানামতে প্রায় দুই হাজারের উপর পাঠক গল্পটা পড়ছেন। রিয়েক্ট পড়ে তার অর্ধেক। গ্ৰুপের রিচ মাইনাস চল্লিশে চলে গেছে। অনেক রেগুলার রিডার্সদের কাছেও পৌঁছাতে পারছেনা। এরকম করলে হবে? নিজে পড়ুন পাশাপাশি সবাইকে পড়তে বলুন। লাইক কমেন্ট করুন বেশী বেশী যাতে রিচ বাড়ে। আমি আর কতবার বলবো সবাইকে? ভালোবেসে পড়ছেন ভালোবেসে অন্যদের পড়তে সাহায্য করবেন না? এতোটা অলস প্লিজ হবেন না। পেইজটা আমার হলেও পেইজে আপনাদের ই বিচরণ। ভালোবেসে ইনভাইট করুন সবাইকে। অন্য পাঠকদের জানান গল্পটা আপনারদের কতটা ভালো লেগেছে। পেইজের রিচ বাড়াতে সাহায্য করুন।

চলবে ___