ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো পর্ব-৫৭+৫৮+৫৯

0
1274

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(৫৭)
চারপাশে শোরগোল। দলবেঁধে ছেলে মেয়েদের হাঁটাহাঁটি। কথা ছিলো ছেলেদের আলাদা জায়গায় হলুদ দেওয়া হবে মেয়েদের ও আলাদা ভাবে দেওয়া হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে মেয়ে পক্ষরা ফটোসেশনের জন্য এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছে আর ছেলেরা উঁকি ঝুকি দিচ্ছে। কেউ কেউ আবার পিছু লাগছে। ছেলেদের প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে একভাবে মেয়েদের আরেকভাবে। ফোটোসেশন দুটোতেই করতে হবে। মেয়েদের টায় ছেলেরা ঢুকতে পারছেনা। কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কিন্তু ছেলেদেরটায় মেয়েরা ঠিকই হানা দিয়েছে। বিভিন্ন পোজে ছবি তুলছে। ছেলেরা মেয়েদের দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। চিল্লিয়ে বলছে, ‘ দোস্ত বিয়ে করলে ময়দা সুন্দরীকেই বিয়ে করা উচিত। ‘
‘ কেনো?’
‘ সকালের নাস্তার টাকাটা বেঁচে যাবে। ‘
সবাই হো হো করে হেঁসে উঠে। উর্মিলা তো কটমট করে তাকায়। ছেলেরা আবার চিল্লিয়ে বলে,
‘ কি চাহনি রে! মারগায়া হায়!’
উর্মিলা স্টেজ থেকে নেমে আসে। মালার হাত ধরে বলে,
‘ চল। থাকা যাবে না এখানে। মুখ চিনে রাখ শুধু। স্যারকে বলে পরে ডলা দিবো এদেরকে। ‘
বেরিয়ে যাবার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে আঁচল টেনে ধরে। উর্মিলা ঘাড় ফিরিয়ে একটা ছেলের হাতে নিজ শাড়ির আঁচল দেখে ভীষণ রেগে যায়। আঙুল তুলে হুংকার ছাড়ে,’ এই!’
অথচ ছেলেটার কোনো রিয়েকশন নেই। মুখে চুইংগাম চিবুতে চিবুতে উর্মিলার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। উর্মিলা তুড়ি বাজায়, ‘ হে মিষ্টার, কি প্রবলেম?’
‘ ভাবীর কে হোন?’
‘ কেনো কি দরকার? প্রেম প্রস্তাব দিবেন? এখনো হিরোর মতো যে আঁচল ধরে আছেন। ‘
রাকিব আঁচল ছেড়ে দেয়। গা ঝাড়া ভাবে বলে,
‘ আমার প্রেম টেমে ইন্টারেস্ট নেই। আমি ডাইরেক্ট বিয়েতে বিশ্বাসী।আমি আবার ভাবলাম ভাবীর বোন মনে হয় আপনি অথচ আমার জানা মতে ভাবীর কোনো বোন টোন নেই। ‘
‘ আপনার কেনো মনে হলো আমি বোন হবো?’
‘ নয়তো? থ্যাংক য়্যু মিস। আপনা বেয়াই বেইনী ব্যাপারটা আবার কেমন যেনো ঘেঁটে যায়। আপনিও দূরের আমিও দূরের কাছে আসতে নো বাধা। ‘
‘ ডিসগাষ্টিং। ‘
উর্মিলা চলে যায়। আকাশ পেছন থেকে জোর গলায় বলে, ‘ হেই ময়দা সুন্দরী,আমি আকাশ। নামটাতো বলে গেলে না । ‘
উর্মিলা দ্রুত বেগে হাটলো। মালা থেকে গিয়ে আঙুলে ইশারা করে বললো, ‘ উর্মিলা। ‘

যেখানে যাচ্ছে সেখানেই উর্মিলা আকাশকে দেখতে পাচ্ছে। কি চায় ছেলেটা? এভাবে পিছু ঘুরার মানে কি?প্রেমে ইন্টারেস্টেড না। হু! চ্যাংরা পোলা! স্যারকে জানাতে হবে। যত মুসকিল সব স্যার সলভ করে দেবে। কিন্তু স্যার নেই। একদল শালা শালির অতিপ্রিয় জিজু তানভীর খান পুরো এরিয়াতে নেই। অনেক খোজেও পাওয়া গেলো না। অগত্যা উর্মিলা নাকিবকে ডেকে আনলো। নাকিব মহা ব্যস্ত।
‘ এই বল তাড়াতাড়ি কি হয়েছে? অনেক কাজ পড়ে আছে। ‘
‘ কি কাজ করছিস তুই? আমিতো দেখছি এদিক থেকে সেদিকে শুধু ঘুরঘুর করছিস। ‘
‘ তো এটা কি কাজ নয়? সবাই নজরে নজরে রাখছি। বিয়ে বাড়ি বলে কথা!কোন অঘটন যেনো না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে না?’
‘ আর এদিকে যে একটা আস্ত চেংরা পোলা আমার পিছু লাগছে সেটা খেয়াল করছিস একবার?’
‘ সত্যি দোস্ত? কনগ্ৰাচুলেশন। আমি তো ভেবেছিলাম বুড়ি হয়ে যাবি তা-ও কোনো আশিক জুটবে না। এতো তাড়াতাড়ি যে পেয়ে যাবি আমি সত্যি অভিভূত দোস্ত। খুশিতে চোখে কান্না চলে আসছে। দেখ আমি কানছি। আমার চোখে পানি টলমল করছে।’
‘ হারামি আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ। আর দুলাভাই স্যার কোথায় বলে যা। আমি সব বিচার দিবো।’
‘ জানিনা। খুঁজে নে যা। ‘
‘ একটা কল করনা। আমার ফোনে ব্যালেন্স নেই। ‘
‘ আমার ফোনেও নেই। মুডি খা। ‘
মালা ঝটপট বলে, ‘ দাড়া আমি উপর থেকে গিয়ে দেখে আসি। এখানে কোথাও থাকলে ঠিক চোখে পড়বে। ‘
সিড়ি বেয়ে উঁচু টাওয়ার টায় উঠে যায়। উর্মিলা চেঁচায়,
‘ মালা! পেলি দুলাভাইকে? ‘
‘ তোরটাকে পায়নি রে আমাদেরটাকে পেয়েছি। ঠিক তোর পেছন বরাবর ঝাউ গাছের নিচে । ‘
উর্মিলা নাকিব দু’জনেই পেছন ঘুরে তাকায়। উর্মিলা রাগে ফুঁসতে থাকে। নাকিব হো হো করে হেসে উঠে। উর্মিলাকে জ্বলাতে বলে,
‘ সাদা চামড়াটা নাকি রে? দোস্ত তোর সাথে মানাইছে। আকাশ ভাই বেশ হ্যান্ডসাম আছে। ‘
‘ নাকিবের বাচ্চা! চুপ। ‘
‘ আমি চুপ হয়লে কি আর কাহিনী আগাবো? লাভের মুখ দেখে সরে যাওয়া লোক আমি না। দোস্ত তোরা দুই সাদা মিলে বছর বছর একটা করে ফরেনার বাচ্চা পয়দা করবি আমি বিদেশে ঐগুলারে ডেলিভারী দিমু। লাভে লাভ! আইডিয়াটা দারুন না? ‘
উর্মিলা নাকিববের পিঠে ধুম ধাম লাগিয়ে দেয়। নাকিবের চিৎকার করার আগে মালা চিৎকার করে উঠে, ‘ দুলা ভাই পাইয়া গেছি। হুররে’
উর্মিলা নাকিবের কলার টেনে টাওয়ারের উপর উঠে আসে। তানভীরকে দেখতে পাওয়া মাত্রই নাকিব বলে,
‘ কতগুলা মাইর দিসছ। আকাল ভাইয়ের সাথে তোর কি সবগুলা বিচার দিবো। ‘
উর্মিলা নাকিবকে ফেলে দৌড় দেয়। সে আগে বিচার দিবে। নাকিব আগে পৌছালেই উল্টাপাল্টা বলে দিতে পারে। মাইরের শোধ তুলবে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে কিল বসিয়েছে যে। অথচ উর্মিলা আকাশ নাকি বাতাস! তাকে চেনেই না।

শাড়ি পড়ে কি দৌড়ানো যায়? নাকিব, উর্মিলা, মালাকে ঐভাবে দৌড় প্রতিযোগিতা দেয়া দেখে আকাশ ও ছুটে। আকাশের দলের ছেলেরাও ছুটে।তামিম ও পা বাড়ায়। একে একে স্টেজের প্রায় অর্ধেক ছেলেমেয়ে এগিয়ে যায়।

বিল্ডিং থেকে কিছুটা পথ। উত্তরে বয়ে চলেছে ব্রহ্মপুত্র নদ। বহু প্রাচীন বট গাছের নিচে মাঝারি দুটো নৌকা বাঁধা। পারাপারের জন্য নৌকাদুটো ব্যবহার করা হয়। একটা নৌকাতে নীল সচ্ছ আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে তানভীর। মাথার নিচে দুটো হাত ভাঁজ করে রাখা। হাঁটু ভাঁজ করে এক পায়ের উপর পা তুলে একটু পর পর বিট তুলছে। নদীর উপর নৌকাতে অনেক দিন এভাবে শুয়ে থাকা হয়না। বয়ে চলা হাওয়া সাদা পাঞ্জাবির কোনা উড়িয়ে দিচ্ছে। অদ্ভুত ভালোলাগা ঘিরে ধরেছে চারিপাশ থেকে। মানুষের ভিড় কোলাহলের থেকে একরম নীরব স্থান ঢের শ্রেয়। তানভীরের মোটেই পছন্দ নয় এসব কোলাহল। অথচ অপছন্দের কাজের সাথেই সে সম্পৃক্ত। হাজার হাজার স্টুডেন্টস, লক্ষ লক্ষ জনগণ, শত শত টেনশন সবকিছু মিলিয়ে দৈনন্দিন সিডিউল তার। শত ব্যস্ততার মাঝে তার একমাত্র সুখ কল্পনায় বিচরিত লাবিবা নামের মেয়েটা। মেয়েটাকে এখন পার্মানেন্টলি তার কাছে আনার প্রসেস চালিয়ে যাচ্ছে। আজ বাদে কাল থেকেই তাঁকে যখন তখন চোখের সামনে দেখতে পারবে। তাকে ছুঁতে পারবে। তার বুকে মাথা রাখতে পারবে। শান্তিতে ঘুমোতে পারবে। নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য হাজারটা কাজ ঘাড়ের উপর চাপাবে না। একান্ত ব্যক্তিগত সুখটাকে নিয়ে ব্যক্তিগত সময় অতিবাহিত হবে। চোখে মুখে সেই সুখের ছাপ। মস্তিষ্ক জুড়ে সেই সুন্দরী সুখটার বিচরণ। পড়ন্ত বিকালে এভাবেও যে কেউ গাছের নিচে নদীর উপর সুখের সময় অতিবাহিত করতে পারে কারো হয়তো জানা ছিলো না। তামিম ডাকলো,
‘ তানভীর?’
তানভীর ঘাড় ঘুরিয়ে হকচকিয়ে উঠলো। শুধু তামিম নয়। শূন্য দৃষ্টিতে আবার সেই দল। যাকে উপেক্ষা করে সে এখানে সুখী সময় অতিবাহিত করছে। তানভীর উঠলো না। তাকিয়ে থেকেই মুচকি হাসলো। তামিম তানভীর সম্পর্কে অবগত। সে নৌকায় পা বাড়ালো। ছোট্ট ‌বাক্যে বুঝালো, ‘ তিনটা দিন মাত্র! ওকে?’
তানভীর মাথা নাড়ালো। হাসির রেশ ধরে বললো, ‘ জি ভাইয়া। ‘ তানভীরের খারাপ লাগলো না মোটেই। জায়গাটা এতো মনোরম আর শান্ত যে তাকে নিয়ন্ত্রন করতে পারদর্শ। অভিযোগ নিয়ে এসেছিলো অনেকেই। কিন্তু নিস্তব্দ জায়গা আর শীতল বাতাসে তারাও উদাস হয়ে গেলো। উঠে এলো নৌকায়। তামিম তানভীরের পাশে বসে বললো, ‘ এতো সুন্দর একটা জায়গা আছে কাছেই জানালিনা কেনো? হৃদয় ছুঁয়ে দিলো একদম। ‘
‘ এরকম একটা জায়গায় এসে তোমার রোজকে নিয়ে কিছু ভেবো ভাইয়া। পৃথিবীর সব থেকে সুখী ব্যক্তিদের একজন মনে হবে নিজেকে। ‘
‘ দুলাভাই আমাদের লাব্বুকে ভাবছেন তাহলে। লাব্বুতো হলুদে সাজছে আপনাকে দেখাতে। ‘
‘ কিন্তু আমাদের দুলাভাই যে নদীর ঘাটে। ‘
‘ ডেকে নিলেই হয়। ‘
‘ বারণ আছে। ‘
তানভীর উঠে বসে। দলের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
‘ সুর ধর তোরা উদাস দুপুর বেলা। ‘
সবাই ‘ হৈ’ বলে উঠে। নৌকার পাটাতন, মেয়েদের নুপুর, ঠোটের শীষ হয়ে উঠে বাদ্যযন্ত্র।
তানভীর প্রথমে শুরু করে,

‘ আর উদাস দুপুর বেলা সখি
আসবে কি একলা নদীর ঘাটে রে,
দেখতে তোমায় মন চাইছে
ও কি দেখতে তোমায় মন চাইছে।।

আর একবার যদি আসো সখি
জল ভরিবার ছলে ..
মনের কথা বলবো তোমায়
বসে কদম তলে,
মনের কথা বলবো তোমায়
বসে কদম তলে। ‘

সবাই একসাথে সুর তুলে __

‘ একবার যদি আসো সখি
জল ভরিবার ছলে ..
মনের কথা বলবো তোমায়
বসে কদম তলে,
মনের কথা বলবো তোমায়
বসে কদম তলে।’

কানের কাছে সুর ভেসে আসলে লাবিবা শাড়ি ঠিক করতে করতে গিয়ে উত্তরের বন্ধ জানালা খুলে দেয়। বহু গলা মিশ্রিত সুর কানে স্পষ্ট হয়। উকি দিয়ে দেখে দূর থেকে সুর ভেসে আসছে ছেলে মেয়ের একসাথে। হলুদ, নীল আবছা রংয়ের ভিড় একটুখানি দেখা যাচ্ছে তিনতলার উপর থেকে।লাবিবার মন চঞ্চল হয়ে উঠে। তানভীরের ছাড়া গলা তো তার বেশিই পরিচিত। রোজী পেছন থেকে ডাকে,
‘ লাবিবা আসো তোমাকে ফুল লাগিয়ে দেই। ‘
মারিয়া বলে, ‘ মামুনী কাম। ‘
রোজী হাতে লম্বা গাদা ফুলের মালা হাতে দাঁড়িয়ে। তার সাজ একদম কমপ্লিট। এবার লবিবাকে কমপ্লিট হলেই বেরিয়ে পড়বে স্টেজে যাবার জন্যে। লাবিবা ঘুরে তাকায়। চিৎকার করে উঠেই দৌড়ে গিয়ে রোজীর হাত ধরে টান লাগায়। ‘ আপু এসো। ‘
‘ আরে লাব্বু কোথায় দৌড়াচ্ছো?’
‘ দৌড়াও আপু দৌড়াও। চিট করা হয়েছে আমাদের না নিয়েই গানের আসর বসিয়ে ফেলেছে। দৌড়াও। ‘

‘ তুমি সকল দুঃখ ভুলে যেও
চোখের পানে চেয়ে,
তুমি সকল দুঃখ ভুলে যেও
চোখের পানে চেয়ে,
আর শক্ত কইরা ধরিয়ো হাত
ছাইড়া যাইবার ভয়ে,
দেখতে তোমায় মন চাইছে
ও কি দেখতে তোমায় মন চাইছে।

আর উদাস দুপুর বেলা সখি
আসবে কি একেলা নদীর ঘাটে রে,
দেখতে তোমায় মন চাইছে
ও কি দেখতে তোমায় মন চাইছে।। ‘

আর না জানি মুই লিখতে চিঠি
না জানি মুই পড়তে
বাঁশির সুরে ডাকি তোমায়
আসো না গো ছুটে,
বাঁশির সুরে ডাকি তোমায়
আসো না গো ছুটে।

আর উথাল পাথাল নদীর ঢেউয়ে
বুকে জোয়ার ভাটা চলে,
উথাল পাথাল নদীর ঢেউয়ে
বুকে জোয়ার ভাটা চলে,
চেয়ে তোমার পানে,
দেখতে তোমায় মন চাইছে
ওকি দেখতে তোমায় মন চাইছে।

আর উদাস দুপুর বেলা সখি
আসবে কি একলা নদীর ঘাটে রে,
দেখতে তোমায় মন চাইছে
ওকি দেখতে তোমায় মন চাইছে।। ‘

সবাই একসাথে করতালি দেয়। নদীর পাড়ে ঘাসের উপর সারি বসেছে গানের উদ্দেশ্যে। নাকিব বলে, ‘ এরপর কে শুরু করবে?’
‘ এভাবে হবেনা। একের পর এক গান ধরতে হবে। ‘
‘ পাঁচমেশালি?’
‘ আরে ঐদিকে দেখো। আমাদের কনেরা দৌড়ে আসছে। ‘
সবাই ফিরে তাকাতেই দেখে অদূরে লাবিবা রোজীর হাত ধরে দৌড়ে আসছে। মেয়েপক্ষ হৈ হৈ করে উঠে,
‘ আরে তোমরা চলে আসলে কেনো? এখনি মুরুব্বিরা বকাঝকা করতে শুরু করবে। ‘
রোজী এতোটা দৌড়েছে কবে জানেনা। রিতীমতো হাপাচ্ছে। নৌকাতে বসে তামিম ছেলেদের বললো,
‘ এই তোদের ভাবীকে রাস্তা করে দে। ‘
লাবিবা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে হাঁটুতে হাতে ভর করে ঘাসের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে কয়েকদম শ্বাস ছাড়লো। পরক্ষনেই মাথা তুলে তানভীরের দিকে তাকালো। ঠোঁটের কোনায় ভেসে উঠলো চমৎকার এক প্রাপ্তির হাসি। এই মেয়ে সব অর্জন করে ছাড়বে। বিন্দু মাত্র ছাড়া দিতে প্রস্তুত না। তানভীরকে এলোমেলো করে দিতে একটা মিনিটও সময় নিতে জানেনা। চোখের ভাষা বুঝতে বড় ব্যাকুল হয়ে থাকে যে! মুখ খোলার কি প্রয়োজন? তানভীর উঠে দাঁড়ালো। এক নৌকা থেকে অন্য নৌকায় পা দিয়ে এগিয়ে এলো। হাত বাড়ালো। লাবিবা এগিয়ে এলো। এই নৌকার মেয়েগুলো ঐ নৌকায় তামিমের পাশে গিয়ে বসলো লাবিবার সুবিধার্থে। দু হাত মুঠোবন্ধ করেই লাবিবার পা পড়লো নৌকাতে। ফিসকাট পেডিকোট দিয়ে শাড়ী পড়ে দৌড়ানো যেমন কষ্টের বসাও তেমন কষ্টের। তানভীরের রাগ লাগলো। ‘ দৌড়ে আসার কি প্রয়োজন ছিলো? মুখ থুবড়ে পড়লে?’
লাবিবার অসহায় দৃষ্টি মেললো, ‘ তবুও তো গান শেষ হয়ে গেলো?’
‘ কিচ্ছু শেষ হলোনা। শূণ্যতা পূর্ণ হয়ে ভরে উঠলো। ‘

লাবিবার মনে হয় আজকাল তানভীর নিরামিষ থেকে আমিষ খাবারের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। নয়তো আগে থেকেই সে আমিষভোগী। যদি তাই হয় তাহলে লাবিবার দুঃখের শেষ থাকবেনা। আফসোসের ও শেষ থাকবে না। বৃথা চেষ্টা চালিয়ে গেলো শুধু শুধু। আশিক তো আগে থেকেই দেওয়ানা। ছুপা রোস্তম।

লাবিবার জায়গা হলো জানুর উপর। ভীষন লজ্জার ব্যাপার।‌ কিন্তু কেউ আমলে নিলো না ব্যাপারটা। এটাই যেনো হবার ছিলো। আগেকার দিনে একটা প্রচলন ছিলো, ‘ বিয়ের আগে ছেলে মেয়েকে আগলে রাখো। ‘ এখনকার দিনে, ‘ বিয়ে যেহেতু হবেই,যতপারো বোঝাপড়া করো। ‘ সেখানে এটাতো দ্বিতীয়বারের মতো বিয়ে। সবাই খুশি মনেই মজা লুটলো। রোজী প্রথমে লজ্জা পেলেও এখন আর পায়না। সে দেখেছে সবাই কত স্বাভাবিক। সে কেনো অস্বাভাবিক আচরণ করতে যাবে নিজের দোষে? তামিম জিজ্ঞেস করলো,
‘ গলা শুকিয়ে গেছে?’
‘ ঠিক আছি। সমস্যা নেই। ‘

এবার নাকিব গান ধরলো,
‘ বকুল ফুল, বকুল ফুল
সোনা দিয়া হাত কানও বান্ধাইলি
বকুল ফুল, বকুল ফুল
সোনা দিয়া হাত কানও বান্ধাইলি
শালুক ফুলের লাজ নাই
রাইতে শালুক ফোটে লো
রাইতে শালুক ফোটে
শালুক ফুলের লাজ নাই
রাইতে শালুক ফোটে লো
রাইতে শালুক ফোটে
যার সনে যার ভালোবাসা
যার সনে যার ভালোবাসা
সেইতো মজা লুটে লো
বকুল ফুল, বকুল ফুল
সোনা দিয়া হাত কানও বান্ধাইলি
বকুল ফুল, বকুল ফুল
সোনা দিয়া হাত কানও বান্ধাইলি। ‘

একে একে সবাই গান ধরলো,
সোনাবন্ধু, তুই আমারে করলি রে দিওয়ানা
মনে তো মানে না, দিলে তো বুঝে না
সোনাবন্ধু, তুই আমারে করলি রে দিওয়ানা
মনে তো মানে না, দিলে তো বুঝে না
সোনাবন্ধু, তুই আমারে
সোনাবন্ধু, তুই আমারে করলি রে দিওয়ানা
সোনাবন্ধু, তুই আমারে করলি রে দিওয়ানা
মনে তো মানে না, দিলে তো বুঝে না
মনে তো মানে না, দিলে তো বুঝে না
সোনাবন্ধু, তুই আমারে করলি রে দিওয়ানা
মনে তো মানে না, দিলে তো বুঝে না।

সবাই বেশ ইনজয় করছে। সব থেকে বেশি ইনজয় করছে লাবিবা। গলা ছেড়ে গান গাইছে। তালে তাল মিলিয়ে হাত নাচাচ্ছে। কাঁধ নাড়িয়ে তানভীর ও সায় দিচ্ছে। তানভীর খেয়াল করেছে তার বউটা যখন হা পা মুখ নাড়িয়ে নাচের ভঙ্গি করে ভীষন কিউট লাগে। কি এক্সপ্রেশন! শুধু দেখতেই ইচ্ছে করে। কাচা হলুদ শাড়ি ব্লাউজে খোপা করা চুলে তো একদম হলদে পরীর মতো লাগছে। এই পরীটা যখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নাচে তখন এর থেকে সুখের আর কি লাগে? তানভীর আনমনেই হাসে। ভাবনা লুকাতে এদিক ওদিক তাকাতেই তামিম রোজীকে চোখে পড়ে। তারাও হাত তালি দিয়ে মজা লুটছে। রোজীর কোলের উপর লম্বা তাজা গাদার মালা। রোজীর খোপায় হাতে গাদা ফুল। অথচ লাবিবার হাত, খোপা খালি। তানভীর হাত বাড়িয়ে মালাটা হাতে তুলে নেয়। রোজী সামান্য দৃষ্টি বিনিময়ে মুচকি হাসে। তানভীর ও হাসে। হুট করেই বগলের নিচে দিয়ে হাত তুলে পায়ের সামনের দিকে বসিয়ে দেয় উঠিয়ে। লাবিবা চমকে পেছনে তাকাতে যাবে সে মুখ ঘুরিয়ে দেয়। চুলের গাছি খোপা খুলে দেয়। ফুলের মালা গোড়া থেকে আলতো হাতে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে একদম আগা অব্দি এনে কোমড়ের উপরে ক্লিপ লাগিয়ে দেয়। দু হাতে দু হাত মুঠো করে নাক ঢুবিয়ে ঘ্রান নেয় হলদে গাদার। লাবিবা চোখ নিচের দিকে নামিয়ে রাখে। এখন ভীষন লজ্জা করছে তার।

ক্যামেরা ম্যানরা সহ বাড়ির বড়রা কখন এসে দাঁড়িয়েছে জানা নেই কারোর। সবাই নিজেদের মতো ইনজয় করতে ব্যস্ত।সময় বসে থাকে না। বেলা গড়িয়ে যাবে ভাব। মুরুব্বিরা আফসোস করে বললো, ‘ শুধু শুধু এদের আলাদা করে কি লাভ? ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর লোকের অযথা দুই জায়গায় প্যান্ডেল করতে গিয়ে খাটুনি হলো। ‘
‘ সেই তো। কাছেই এতো সুন্দর জায়গা ছিলো। এখানে করলেই হতো। ‘
নাকিব উঠে দাঁড়ালো,
‘ আমরা চাইলে এখানেই বেলা ঢুবার আগে হলুদ সারতে পারি। ‘
‘ কিভাবে?’
‘ চল স্ট্রেজ খুলে মালাগুলো নিয়ে আসি নৌকা সাজিয়ে ফেলি। ‘

শুধু নৌকা সাজানো হলোনা। মাটির কাসায় শত শত সলতে প্রদীপ আর গাদার পাপড়ি ছড়িয়ে গেলো নদীর বুকে বিস্তৃত জায়গা জুড়ে। রোজী অবাক হয়ে এতো সৌন্দর্য উপভোগ করছিলো। হুট করেই তামিমের দিকে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো,
‘ ডাক্তার সাহেব আমি জীবনেও ভাবিনি আমার জীবনে এরকম একটা দিন আসবে। আমার ভীষণ সুখ লাগছে ডাক্তারসাহেব। আমিতো লোভী হয়ে যাচ্ছি। ‘
‘ কিসের উপর?’
‘ নিজের উপর। নিজের অধিকারের উপর। ‘
‘ তোমার পাশে যে আমি বসে আছি। তোমার মনে হচ্ছে না এই লোকটা তোমার থেকে প্রায় দ্বিগুন বয়সী?’
‘ দেহের বয়স বাড়ে মনের নয়। শক্তি সামর্থ্য আল্লাহর দান। অনেক বুড়ো মানুষ কে দেখবেন যুবকের থেকে দ্বিগুন ভাড় বেয়ে নিয়ে যাচ্ছে অথচ যুবক সেটা পারছেনা। বরং আমার মনে হয় আমিই বুড়িয়ে গেছি। আমার শক্তি কম, প্রসস্ত কম, সামর্থ্য কম। ‘
‘ চিন্তাটা আমি মাথায় নিয়ে নিলাম। ‘
রোজী নিঃশব্দে হাসলো। তামিম হলুদের বাটি থেকে এক আঙুলে হলুদ নিয়ে রোজীর গালে লাগিয়ে দিলো। সবাই একযোগে হৈ করে উঠলো। রোজী লজ্জা পেলো কিন্তু তার থেকে শতগুন বেশী হাসলো।

তানভীর ইতস্তত করছে। কারণ লাবিবার হলুদে এলার্জি আছে। লাগানো উচিত কি উচিত না সেটাই ভাবছে। সাবিনা মেয়েকে লাগাতে গিয়ে সেও ভাবছে। সবাই বলছে, ‘ শুরু করুন না… আমরা লাগবো তো। ‘
তানভীর জানতে চাইলো, ‘ আম্মু কেমন এলার্জি বের হয়? ‘
‘ গুটি গুটি। প্রেসক্রিপশন আছে ঔষধ খেলে,লাগালে কিছু হয়না। তবে সাথে সাথে নিলে ভালো। ‘
‘ আমি ব্যবস্থা করবো ওকে?’
সাবিনা সায় দিলো। প্রথমে হালকা গালে ছুয়ালো। সবাই এক এক করে ঐখানেই একটু ছুঁইয়ে দিলো। লাবিবা চেচালো,
‘ একদিন লাগালে কিচ্ছু হবে না। আরে আমি ছবি নিবো তো? সুন্দর সুন্দর ছবি না থাকলে নাতি নাতনি কে কি দেখাবো?’
ভাবী হেসে ধমক দিলো। ‘ চুপ কর। মুখে কিছুই আটকায় না তোর। ‘
‘ হ্যা! যদি আটকাতো… দ্যা গ্ৰেট তানভীর খানের দিলে লাব্বুর সিলমোহর লাগতো না। কোয়ালিটি আছে বস। বুঝতে হবে। ‘

চারিদিকে হাসির রোল পড়ে গেলো। তানভীর বললো,
‘ ঘুরে বসো। ‘
‘ হ্যা?’
‘ ঘুরে বসো। পা দুটো এদিকে দাও। ‘
লাবিবাকে ঘুরিয়ে বসিয়ে পা দুটো তানভীর কোলের উপর তুলে নিলো। ক্যামেরা ম্যানকে বললো,
‘ মামা ফটাফট ক্যান্ডিড চলবে। আমার বউয়ের শখ পূরণ করি। ‘

তানভীর লাবিবার পায়ের উপর শাড়িটা একটু তুলে দিলো। হাত ভর্তি হলুদ লাগিয়ে দু পায়ে উপর থেকে নিচের দিকে পুরোটাই হলুদ মাখালো। মেয়েগুলোও থামলো না। পেছন থেকে কয়েকটা হাত গিয়ে লাবিবার গাল ছুঁইয়ে দিলো। ছবি তুলে চললো ফটাফট। হলুদ মাখানো পা দেখে তানভীরের প্রচুর লোভ লাগলো। সামলাতে না পেরে ঝুকে গিয়ে চুমু দিয়ে বসলো দুপায়ের পাতায়। সুরসুরি লাগতেই লাবিবা হলুদ মাখানো হাত খামচে ধরলো তানভীরের সাদা পাঞ্জাবি। খিল খিল হাসিতে মুখোরিত হলো চারিপাশ। ক্যামেরাবন্দি হলো প্রত্যেকটা মুহুর্ত। ইসস! এতো সুখ কেনো?

চলবে ___

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(৫৮)
বৈরী আবহাওয়া। আকাশে ছেয়ে গেছে কালো মেঘ। ছাদে আয়োজন করা হয়েছে ব্যাচেলর পার্টি। এই পার্টির খবর ব্যাচেলররা ব্যাতীত কেউ জানে না। জানার কথাও না। খুব গোপনে আয়োজন করা হয়েছে। জানাজানি হলে পার্টিটা হতো না। ফিরোজ খান অবশ্য কিছু বলতেন না। উনাকে বয়স্কদের কাতারে ফেলা যায়না। এক্সপেরিয়েন্সড পার্সন। যুবকদের উৎসাহ দিতে পিছ পা হন না। কিন্তু নাক ছিটকাতো কনেদের বাড়ির গার্ডিয়ান। তাঁদের ফ্যামিলিতে এসব এলাউড না। আত্মীয় সম্পর্ক হচ্ছে দুই স্তরের ফ্যামিলির মধ্যে। এটাই কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাঁধা।
রাত যখন নিশুতি তখন এক ব্যাগ ওয়াইন নিয়ে ফিরে এলো নাকিব। চোখে মুখে উচ্ছাস। বিদেশী ওয়াইন গুলোর প্রতি কম বেশি প্রায় সবারই লোভ। যদি হয় সুইজারল্যান্ড এর তাহলে তো কথাই নেই। অর্গানিক আঙুরের ওয়াইন। সিঁড়িতে তামিম পিঠে চাপড় মারলো। জিজ্ঞেস করলো,
‘ কেউ কিছু বুঝে নিতো?’
‘ বাইরে কেউ নেই। ‘
‘ ভদকা আছে তো?’
‘ খুব কম। মাত্র দুই বোতল। ‘
‘ চলবে। ‘

উচ্চস্বরে চলছে ডিজে বক্স। পার্টিতে উপস্থিত আছেন শহরের বড় ডিজে এ. কে. আখম। তানভীরের বসম ফ্রেন্ড। ফ্রিতে গিফট ও বলা চলে। তামিম নিজে একজন ডাক্তার। আজ সে নিজের পরিচয় থেকে বেরিয়ে এসেছে। হাতে মদের গ্লাস। গলায় উৎকণ্ঠা। পজিশন টপ ফ্লোরের মাঝ বরাবর। তামিমের ফ্রেন্ডরাও উপস্থিত। বউদের আড়ালে মাল গিলতে পেরে সবাই তামিমকে নতুন বিয়ের জন্য বাহবা দিচ্ছে। শরীর দুলাতে দুলাতে তামিমকে নিয়ে মজেছে।
‘ দোস্ত! ডোন্ট মাইন্ড। তোকে আমরা হিংসা করি। আমরা এক ফুলের মধু খেয়ে জীবন পার করছি তুই শালা দুটো ফুলের মধু চুষে নিংড়ে নিবি। ‘
‘ শালা কচি বউ পেয়ে আবার আমাদের ভুলে যাস না। ‘
‘ ভয় নেই দোস্ত তোর কচির দিকে আমরা নজর দিবো না। বন্ধুর বউ বোনের সমান। জয় বন্ধুর বউ বোনের জয়। ‘
‘ জয় বন্ধুর বোনের জয়। ‘
‘ ধুর শালা তামিমের বউয়ের জয়। ‘
তামিমের হয়তো খারাপ লাগতো। এরকম মাতলামো যুবক বয়সে সে বেশ করেছে। কিন্তু সঙ্গী ছিলো ফ্লোরা। আজ করছে রোজের জন্য। যে মেয়েটা এখান অব্দি সে আনতে পারছেনা। এসবে অভ্যস্ত নয়। খারাপ মিন করতে দুবার ভাববে না। তামিমের ফ্রেন্ডরা তামিমকে সিডিউস করলো, ‘ তোর বউকে কল দে। ‘
‘ আমার বউ আমার না। ‘
‘ তাইলে আমাক দিয়ে দে। ‘
‘ ধুর শালা!’
কলটা তামিম ঠিকই দিলো। কিন্তু বউয়ের নাম্বারে কল দিতে গিয়ে কল চলে গেলো ছোট বউ লেখা নাম্বারে। বাড়ির ছোট বউয়ের কাছে।

ঠান্ডা আবহাওয়ায় লাবিবার ঘুমটা ভীষন গাঢ় হলো। কত রাত পর আজ ঠিক সময়ে ঘুমিয়েছে জানা নেই। সারাদিনের ধকলে শরীরটা আর চলছে না বললেই চলে। ক্লান্তিতে তানভীরের খেয়ালও নেই। চোখে মুখে উপচে পড়া ঘুম। রাত আড়াইটা নাগাদ শিয়রে রাখা ফোনটা বেজে উঠে। গাঢ় ঘুম হালকা হতেও দুবার ফোন বেজে বন্ধ হয়ে যায়। তৃতীয়বারের মতো ঘুমটা হালকা হয়ে আসে। হাতরিয়ে ফোন কানে গুঁজে হ্যালো বলে। ওপাশ থেকে এমন কন্ঠ ভেসে আসে লাবিবার ঘুম ছুটে যায়। হুড়মুডিয়ে উঠে বসে। ফোনের স্কিনে তামিমের নাম্বার দেখে আতঙ্কে ঢুক গিলে। অদ্ভুদ আওয়াজ বের হয় মুখ থেকে ‘ ভাইয়া!’

মাতাল হয়ে ঢুলতে ঢুলতে একের পর একজনকে ছাদ থেকে নেমে আসতে দেখা যায়। তামিম ও আছে তাঁদের মাঝে। নিজের ব্যালেন্স টুকু রাখতে পারছে না। সিড়িতেই দুবার বসে পড়লো। লাবিবার আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগলো। এমন দৃশ্য আগে কখনো তার দেখা হয়নি। তামিম এসব খেতে পারে এটা অবিশ্বাস্য। পুরোপুরি ই অবিশ্বাস্য। অনেকক্ষন আর কাউকে না দেখতে পেরে লাবিবা আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। দৌড়ে উঠলো সিড়ি বেয়ে। ছাদে এরা মদের আড্ডা বসিয়েছিলো এটা নিশ্চিত। কিন্তু পা রাখতেই তার ধারণা পাল্টে গেলো। এখানে মদের আড্ডা না শুধু রিতীমত ডিজে পার্টি চলেছে সকলের আগোচরে। রুমের ভেতর থেকে বাহিরের শব্দ মোটেও কানে যায়না। বার ও বসানো হয়েছে। এতোকিছু ঘটে গেলো আর লাবিবা জানলোই না? ভীষন অবাক হলো। তামিমের মতো একজন ভদ্র ডাক্তার যদি ড্রিংকস করতে পারে তাহলে তানভীরকে মোটেই বিশ্বাস নেই। সেই ছেলে আগে থেকেই বারে বারে ঘুরে। না না এমন কিছু না। লাবিবার কথা ভেবে অন্তত তানভীর এসব ছুয়েও দেখবেনা। নিজে নিজে মনকে বোঝাতে লাগলো। কিন্তু কোথায় উনি? সবাই বাইরে তিনি ঘুমোচ্ছে? খটকা লাগলো। দৌড় লাগালো সেকেন্ড ফ্লোরের দিকে। তানভীরের রুমের দরজা বন্ধ। যাওয়ার ও সাহস নেই। ভেতরে নিশ্চয় তানভীর একা থাকবেনা। মাতাল ভাসুর দেবর ননদাই ও আছে। লাবিবা ডিসাইড করলো ফিরে যাবে। যেইনা ঘুরেছে ওমনি শক্ত পোক্ত কিছুর সাথে কপালে লেগে গেলো। মৃদু ব্যথায় হকচকিয়ে পিছিয়ে গেলো লাবিবা। তানভীরকে বাইরে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকে তাকালো। নেশাক্ত জোড় চোখে চোখ পড়তেই লাবিবা হাত পা ছেড়ে দিলো। তানভীর গুম সুরে টেনে ডাকলো, ‘ জান..’
সর্বনাশ। বলিষ্ঠ বাহুর বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ছটফট‌ করলো।ছাড়াতে পারলো না। মুখ থেকে উটকো অথচ মিষ্টি স্মেল পেয়ে মাথা ঘুরিয়ে গেলো। আলতো ধাক্কায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলো। কিছু বলার আগেই কমলার কোয়ার মতো ঠোঁট জোড়া তানভীর নিজ ঠোঁটের ভাঁজে নিয়ে নিলো। আগ্ৰাসী চুমুতে পিষিত হলো কোমল ঠোঁট। অবাধ্য হাতের বিচরণ পুরো কোমড় জুড়ে। তৃষ্ণার্ত কোপত কপোতী উগ্ৰ হলো দুটি দেহ। তানভীরের এমন আচরণে লাবিবা মুহুর্তেই ব্যালেন্স হারালো। একসময় ঠোঁট ছেড়ে কামড়ে ধরলো আপেলের ভাঁজে তৈরী থুতনি। ব্যথায় লাবিবার চোখে জল চলে এলো। সমস্ত শরীরের শক্তি দিয়ে তানভীরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। দু পা পিছিয়ে গেলো সে। তানভীর ছাড়লো না। ফের জড়িয়ে নিলো লাবিবার কোমড়। মুখ গুজলো বুকে। লাবিবার গা গুলিয়ে উঠলো। আবার সেই গন্ধ। যেটা অসহ্য। সে প্রতিবাদ জানালো, ‘ দূরে সরুন। এসব ছাইপাস খেয়ে আমার কাছে আসছেন লজ্জা করছে না?খান সাহেব! আপনি ড্রিংকস করেছেন আমি এটা নিতে পারছিনা। দূরে সরুন আমার থেকে।বমি পাচ্ছে আমার। ‘
তানভীর উঠে এলো। লাবিবার থেকে দুরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালো। পরক্ষনেই আবার এগিয়ে এসে দুহাতে দু গাল চেপে ধরলো। কামড় দেওয়া জায়গাটায় আলতো চুমু খেলো। আদুরে গলায় বললো, ‘ আমার বউ। সোনা বউ। ‘ লাবিবা কেঁদে ফেললো।
‘ আপনি মদ খেয়েছেন কেনো?’
‘ হুসস! কাঁদে না।‌ আমি খায়নি তো জান। ‘
‘ ঠিক করে দাঁড়াতে অব্দি পারছেন না। আবার মিথ্যে বলছেন আমাকে? আমি জানতাম আপনি এসব ছাইপাস ধরে দেখেন না। কিন্তু আপনি আজ মদ খেয়ে মাতলামি করছেন। ‘
‘ উঁহু। খায়নি তো বউ। কাদিস নারে কলিজা। ‘
‘ আপনি ছাড়ুন আমাকে। আমার সামনে আসবেন না। ‘
‘ আর কতো আড়ালে থাকবো জান? আর পারছিনা। কসম! পারবো না। ‘
হাউমাউ করে কান্না জুড়ে বসলো তানভীর। লাবিবা পড়লো মহা বিপদে । হুটহাট এরকম সিচুয়েশনে সে নিজেও পুরো ব্ল্যাংক। বার বার চুপ চুপ বলতে লাগলো। তানভীর চুপ হলে তো। আচ্ছা বিপদে পড়া গেলো। লাবিবা তানভীরকে ছেড়ে দৌড় লাগালো নিজের রুমের দিকে। সিঁড়িতে কাছে গিয়ে আবার ফিরে এলো। তানভীরকে রুমে রেখে যাবে। নয়তো বেচারা হয়তো এখানেই পড়ে থাকবে। কেউ দেখলে সর্বনাশ। লাবিবার আত্ত্বীয় স্বজন অনেক আছে এখানে। উনিশ থেকে বিশ হলেই খবরটা বাবার কানে চলে যাবে। নিশ্চিত যে জামাইকে নিয়ে এতো গুন গান করছে পরে তাকে নিয়েই রসিয়ে কষিয়ে বলবে, ‘ কিগো ইসমাইল! জামাই দেখি নেশা করে। বড়লোকের নেশাখুর পোলা দেখে মেয়েরে জলে ফেলে দিলে! ‘ তখন ইসমাইলের রিয়েকশন কেমন হবে সেটা জানা কথা। এমনিতেই তানভীরকে উনি পছন্দ করেন না।

লাবিবা রুমের দরজায় নক দিলো। দরজা খুলে গেলো হাত পড়তেই। ভেতরে লাইট অন করা কিন্তু একেবারে ফাঁকা। কেউ নেই। বাকিরা কোথায় আছে কে জানে? মাতাল হয়ে কার ঘরে ঢুকেছে। লাবিবা যেনো স্বস্তি পেলো। বুকে হাত রেখে শ্বাস ফেললো। তানভীরের কাছে গিয়ে জোড় করলো, ‘ শুনুন! আপনি ভেতরে আসুন। কাঁদবেন না। ‘
তানভীর কান্না অফ করলো। কিন্তু লাবিবাকে ছাড়লো না। আবার জাপটে ধরলো। লাবিবা জোর করে তানভীরকে ধরে নিয়ে রুমে গেলো। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে খাটে নিয়ে গিয়ে তানভীরকে বসালো। ছেড়ে দিতেই তানভীর খাটে হা পা ছেড়ে দিলো। এমন পরিস্থিতি দেখে লাবিবার বসে কাঁদতে ইচ্ছে করলো।হাত পা সোজাসুজি করে তানভীর কে শোয়ালো। চলে যেতে নিলে তানভীর লাবিবার হাত শক্ত করে মুঠোয় পুড়ে নিলো। লাবিবার মাথা চরম মাত্রার খারাপ হয়ে গেলো। হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলো,
‘ ছাড়ুন। একদম ধরবেন না আমাকে। এক্ষুনি ছাড়ুন। ‘
‘ আই লাভ য়্যু জান। ‘
‘ মাতলামো বন্ধ করুন। ‘
‘ য়্যু সাউট মি জান। ‘
মুখটা বড্ড নিষ্পাপ দেখালো। লাবিবা আর চিৎকার করতে পারলোনা। শুধু বললো, ‘ ঘুমিয়ে পড়ুন। সকালে আপনার সাথে বোঝাপড়া হবে। ‘

ঝট করে তানভীর হাত টেনে বুকের উপর ফেললো। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বুকের নিচে ফেললো লাবিবাকে। মুখ নামিয়ে গলায় নাক ঘসলো। লাবিবা বুঝে গেলো এই ছোঁয়ার মানে। এখানে আর এক মুহুর্ত থাকা ইমপসিবল। কাল বিয়ে আজ! তাছাড়া যে কোনো মুহূর্তে যে কেউ চলে আসতে পারে। লাবিবা তানভীরের মুখটা দু হাতে আগলে ধরে মুখের উপর টেনে তুললো। চোখে চোখ রেখে বললো, ‘ আমি যাচ্ছি হে? কাল সকালে বিয়ে তো। একটা দিন প্লিজ ধৈর্য্য ধরুন। প্লিজ। ‘
‘ একটা সত্যি বলি জান? ট্রাস্ট মি আমি মাতাল নয়। ‘
লাবিবার কান্না ছেড়ে এবার হাসি পেলো। শরীরের ব্যালেন্স রাখতে পারছেনা অথচ বলছে মাতাল নয়।
‘ আরেকটা কথা বলি জান?’
‘ বলুন। ‘
‘ আমার একটুও ধৈর্য্য নেই। কিন্তু তোমাকে বিয়ে করতে আমি যতটা ধৈর্য্যশীল হয়েছি তুমি না থাকলে নিজেকে এতোটা ধৈর্য্যশীল কখনোই মানতে পারতাম না। কেনো এতো অপেক্ষা করতে হয় তোমাকে নিজের করে পাবার জন্য? কোন আকাশের চাঁদ তুমি যে আমার আকাশে পৌঁছতে এতোটা সময় লাগিয়ে দিচ্ছো?’
‘ আপনার আকাশে তো আগেই যেতে পারতাম। আপনিই তো আমাকে রিজেক্ট করে দিয়েছিলেন। আপনার দোষেই এখন আপনার এতো কষ্ট। ‘
‘ আমিতো তোমাকে ভুলতে চেয়েছিলাম জান। পারলাম কই? তোমার ঐ হরিণীর চোখ, টিংটিংয়ে নাক, ছোট্ট তুলিতে আঁকা ঠোঁট আমার কল্পনায় জেঁকে বসলো। তোমার প্রত্যেকটা পদক্ষেপ আমার বুকে ঝড় তুলতে যথেষ্ট। তোমার এই নরম গরম গোলগাল দেহ! এইযে দুটো উমমমমমমমম ___’
তানভীর আর একটা কথা উচ্চারণ করতে পারলো না। লাবিবা মুখ চেপে ধরেছে তার। মৃদু শাসন করলো,
‘ অসভ্য!’

চলবে __

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(৫৯)
‘ আমি নিশ্চয় সেকেন্ড লিস্টে ছিলাম।‌ নয়তো রিজেক্ট হতাম না। ‘
‘ এটা নিয়ে এতো আক্ষেপ তোমার? জানো আমি ছোট থেকেই আমার মমের মতো একজন বউ চাইতাম। মমের পুরো পৃথিবী মানে পাপা আর আমরা। খুব সাধারণ কিন্তু তার ভেতর অসাধারণ। আমার মমের মতো ভালো, হাসি খুশি, নাটকীয় মহিলা আজ পর্যন্ত আমি দেখিনি। মম ভীষন আহ্লাদে। কিন্তু যেটা চাইবে সেটা করেই ছাড়বে তবে এতে আমাদের ই মঙ্গল হবে। পিএইচডি ধারী হয়েও মম পাপার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে। ভালোবাসা কি? ভালোবেসে কিভাবে সুখে থাকা যায় সারাজীবন একসাথে তা মম পাপাকে দেখেই শিখেছি। পাপার কাছে মম সর্বোচ্চ প্রায়রিটি ‌। যখন আমাদের প্রসঙ্গ উঠতো তখন পাপা একটাই কথা বলতো, আমি যদি গাছের যত্ন নিই ফল অবশ্যই পুষ্ট হবে। এর পর আর কোন কথা থাকে বলো? পাপার বাহিরে কাজ আর ভেতরে মম। দশ মিনিট যদি রেস্টের জন্য সময় পায় তখন হিসেব করে এই দশমিনিটে বাড়িতে পৌঁছে একবার মমকে দেখে যেতে পারবে কিনা। যদি না পারে তো ভিডিও কলে রাখবে। মমকে ভিডিও কলে রেখে হলেও পাপা চোখ বন্ধ করে রেষ্ট নিবে প্রয়োজনে। এইযে মম আজ ওমেনদের নিয়ে কাজ করছে সেটা বলতে পারো নিজ ইচ্ছা থেকে পাপার ইচ্ছেতেই। এতে মমের যেমন সময় কাটে রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলে। এসব তোমার ছোট্ট মাথায় ঢুকবেনা। মম যেখানে পাপা ঠিক সেখানেই। তাঁদের মতো সুখী কাপল আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। আমি খুঁজছিলাম মমের মতোই একজন। সাধারণের মাঝে অসাধারণ। ব্রিলিয়ান্ট! তবে যে সেক্রিফাইজ করতে জানে। জীবনে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে হলে আমাদের প্রয়োজন সুখ এবং শান্তি। আমি তাকেই চাই যার কাছে আমার শান্তি মিলবে। যাকে অনুভব করতে গিয়ে আমি সুখ অনুভব করবো। আমি পেয়ে গেলাম আমার সেই সুখ কে। তোমার কাছেই মেলে আমার শান্তি। কিন্তু জানতে পারলাম সেই সুখ আমার জন্য নয়। ভুলতে চেয়েছিলাম তোমাকে। প্রচুর চেষ্টা করেছি পারিনি। তোমার ভাই সাক্ষী। আমার চাওয়া তোমার চাওয়া কখনোই এক নয়। পরিচয় কখনোই এতোটা জরুরী নয় আমার জন্য যতটা জরুরী এক প্রহর শান্তি। দুর্গম পাহাড়ে বসবাসরত যাদের নেই কোনো কারেন্সি নেই কোনো পরিচয় লোকালয়ের কেউ চেনেনা তাঁদের তারাও পীচফুলি লাইফ লিড করে। তাঁদের মাঝেও ভালোবাসা আছে।‌ আমি মনে করি যার জন্য আমার বয়ে চলা, আমার পরিশ্রম তাকে যখন তখন দেখতে মনে চাইলে, তাকে ছুঁতে ইচ্ছে করলে,পাশে চাইলে যদি না পাই তাকে তাহলে সেটার থেকে দুর্ভাগ্য জনক কিছু হতে পারে না। আমি একদম গৃহস্থ একজন বউ চেয়েছিলাম। যে আমাকে ভালোবেসে নিজ ইচ্ছায় আমার অন্দরে প্রবেশ করবে জোরপূর্বক নয়। তোমার সম্পর্কে তোমার আব্বুর থেকে জানার পর আমার মস্তিষ্ক জানান দিয়েছে তুমি আমার জন্য নও। অত্যধিক আদরের মেয়ে যে বিয়ের পরেও বাবার নেওটা থাকবে বাকি সব ভুলে তাকে কিভাবে বউ বানাবো? আমার বউ মানে পুরোটাই আমার। আমার যেখানে বউ সেখানেই থাকবে। কিভাবে মেনে নিবো আমাকে রেখে দিনের পর দিন বাবার বাড়িতে পড়ে থাকবে? সে বউ ক্যারিয়ার ক্যারিয়ার ফ্যামিলি করে মেতে থাকবে চাকরী সূত্রে এখানে সেখানে থেকে বেড়াবে তার যদি ইচ্ছে হয় আমাকে দু একটা বাচ্চা গিফট করবে দ্যাটস ইট! মন চাইলে সে যে আমার সাথে চিট করবেনা তার কি গ্যারান্টি আছে?এমন এগ্ৰিমেন্টে সাইন করার থেকে অন্য মেয়ে বিয়ে করাই উত্তম। ‘
একরাশ রাগ ঝেড়ে দিলো তানভীর লাবিবার উপর। লাবিবা মোটেই অবাক হলো না। সে তো সারাজীবন এসবের ই সপ্ন দেখে আসছে। স্বামী সংসার তার চিন্তাধারার আশেপাশেই ছিলো না। আজ যা বুঝে বিয়ের আগ পর্যন্ত ও ততটুকু বুঝতো না। সময় সবটা বুঝিয়ে দেয়। আনকোরা মনে তাইতো এতো ভয়! তানভীরের রাগ পড়ার আগেই মনে যে প্রশ্ন উঠলো সেটাই প্রকাশ্যে জানতে চাইলো,
‘ তাহলে এখন কেনো বিয়ে করলেন আমাকে?কিছুই তো পরিবর্তন হয়নি। না আপনার চাওয়া না আমার চাওয়া। তাহলে?’
‘ সত্যিটা বললে আমাকে খারাপ ভাববে। ‘
‘ আমার হাজব্যান্ড কতটুকু খারাপ আমাকে তো জানতে হবে। ‘
‘ নরমালি নিলে বলতে পারি। ‘
‘ বলুন। ‘
‘ তোমাকে প্রথমে ভালোলেগেছিলো। কিন্তু আমি ভালোবাসি নি। ভালোবাসাটা ধীরে ধীরে হয়ে গেছে। যখন আমি তোমাকে ভুলতে চাই তোমার জায়গায় অন্য কাউকে বসাতে চাই আমার মোটেও খারাপ লাগে নি। কিন্তু আমার মস্তিষ্ক জানান দেয় এই মেয়েটার থেকে ঐ মেয়েটা ভালো ছিলো। এই আর ঐ এর মাঝে ফাটকে পড়ে যাই আমি। শত শত সুন্দরী আমার জন্য পাপা হাজির করে। তিনি দেখে শুনে বিয়ে দিবেন আমাকে। ভাইয়ার মতো ভুল যেনো না করি সজাগ দৃষ্টি দেন। ওভার স্মার্ট, বড়লোকের বেহায়া মেয়েদের ভীড়ে আমি বিরক্ত হয়ে উঠেছিলাম। এতো এতো সুন্দর মুখ অথচ কোনো মায়া নেই। মায়া পেলেও সেই মায়ায় আগে থেকে অনেকেই পড়ে আছেন। আমি কারো সাথে নিজেকে ম্যাচ করতে পারছিলাম না । বার বার তোমার কথা মনে পড়তো। আমার মনটাও আমার সাথে বেইমানি করে বসে। যখন তোমাকে দেখেছিলাম তখন তুমি যৌবনে পা রাখার ঠিক আগের সময় অতিবাহিত করছো। আর এখন পূর্ণ যুবতী। ঐ যে বলেনা? কায়া দেখলে মায়া বাড়ে? চোখের সামনে তোমার সময় পেরনো টাকে আমি নিতে পারছিলাম না। অন্য কারো প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট নেই আমার। বেহায়া চোখ দুটো শুধু তোমার উপরেই পড়ে। ছায়ার মতো ঘুরতে থাকি তোমার আশেপাশে। সাথে পাই তোমার বাবার অপমান। উনি আমাকে পছন্দ করেন না। উনার মতে রাজনৈতিক মানুষ সব সময় অসৎ। অনেক গুলো ভুল ধারণা নিয়ে বসবাস করেন। একটা জেদ চেপে বসে মনের মধ্যে। তোমাকে আমার চাই চাই। রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। আমার ঘুম কেড়ে নিয়ে তুমি দিনে দিনে আরো ফুলে ফেঁপে উঠো। মানুষের নজর থেকে যতই নিজেকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করুক তোমাকে তোমার বাবা। কিন্তু আমার থেকে পারেনি। নেহাত অতি ভদ্র বলে বেডরুম অব্দি নজর দিই নি। কিন্তু তোমার বেশীরভাগ সময় কাটানোর জায়গা ছাদে ঠিকই আমার নজর ছিলো। তোমার রাত বিরাতে ঘুরে চলা এতো কন্ফিডেন্স আমিই জুগিয়েছি। তুমি ভেবে চলেছো তোমাকে তোমার বাবা প্রটেক্ট করে আসলে তোমাকে প্রটেক্ট করি আমি । তোমার বাবা আমার হাতে মেয়েকে ছেড়ে রেখেই বেইমানীটা করে বসলো। কিন্তু আমার হাত থেকে তোমাকে রক্ষা করতে পারলো না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেয়েকে আমার হাতেই তুলে দিতে হলো। তিনি জানেন আমি তার মেয়েকে কখনোই জোর করবোনা। সেইরকম বংশের ছেলে আমি নয়। ফাইনালি তুমি আমার বউ। আমি আমার জেদটা বহাল রেখেছি। ভালোবেসেছি। কিন্তু কোনো দাবী জানায়নি। দায়িত্ব নিয়েছি। তোমাকে আগলে রাখার দায়িত্ব আমি ঠিকই পালন করে যেতাম। দিন শেষে একটাই শান্তি পৃথিবীর যেখানেই যাও আমি জানবো আমি আমার ভালোবাসাকে বিয়ে করেছি। সাকসেস লাভারদের একজন আমি। বাট ট্রাস্ট্র মি লাব্বু, য়্যু য়্যার এ্যা পয়জনাস হাফলিং। য়্যু নো হাউ টু মেক এ্যা স্যাডেল অফ হ্যাপিনেস ফ্রম রেসপন্সিবল। আমার ধারণা মাত্রই ভুল ছিলো। তুমি ভুল করেছো। ভীষন বড় ভুল করেছো। এই এগ্ৰেসিভ মানুষটাকে তোমার সারাজীবন সহ্য করে যেতে হবে। আমি ভীষণ লোভী। তোমার উপর ভীষন লোভী। তবুও তুমি যদি চাও আমি আমার লোভ সংযত করে নেবার চেষ্টা করবো। তোমার ফ্রিডমে আমি কখনো ই বাঁধা দিবো না। সপ্ন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। আমার সপ্ন আমি একটা একটা করে পূরণ করেছি। তোমাকে একান্তই নিজের করে পাওয়া ছিলো আমার সব থেকে বড় সপ্ন পূরণ। তুমি তোমার সপ্ন পূরণ করো। যদি কখনো মনে হয় আমি তোমার সপ্নের কোনো অংশে ছিলাম তবে জেনে নিও আমি অনেক আগেই তোমার হয়ে গেছি। তুমি আমার অস্তিত্ত্বের সাথে মিশে গেছো। তুমি ছাড়া আমার কারো প্রতিই কোনো ইন্টারেস্ট নেই। ‘
‘ কি বুঝাতে চান? আমি আপনাকে ছেড়ে যাবো? ‘
উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোনটা কেটে দেয় লাবিবা। গলার হার গুলো স্টেপ বাই স্টেপ পড়িয়ে দিচ্ছিলো মেয়েটা। লাবিবার কথা শুনে হাত থমকে যায়। লাবিবার ফেসের দিকে নজর রেখে জিজ্ঞেস করে, ‘ ম্যাম আপনি এভাবে ফুঁসছেন কেনো? আজকের দিনে প্লিজ স্যারের সাথে ঝগড়া করবেন না। স্যার আপনাকে ভীষণ ভালোবাসে। আপনাকে বেস্ট সাজটা দেবার জন্য আমাদের ডাবল টাকা দিয়ে ফোর্স করে এখান অব্দি নিয়ে এসেছে। ‘
‘ পার্লারের নাম কি আপনাদের?’
‘ পিংকলেট পার্লার এন্ড স্যালুন। ‘
লাবিবা বাঁকা চোখে তাকায়। অবাক হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
‘ আপনারা কবে থেকে হোম সার্ভিস দিচ্ছেন?’
‘ সরি ম্যাম। আমাদের মতো পার্লার কখনোই হোম সার্ভিস দেননা। অতিরিক্ত চার্জ এবং আমাদের ওনার স্যারের কমন ফ্রেন্ড হওয়ায় আমরা এতোদূর এসেছি। ‘
‘ বাংলাদেশের প্রত্যেকটা পাড়ায় পাড়ায় আপনাদের স্যারের ফ্রেন্ড থাকতে হবে? এ কি এজেন্সি খুলে বসেছে!’
মেয়েটা মুচকি হাসে।
‘ ম্যাম আপনি ভীষন কিউট। সব ফ্রেন্ড ছেড়ে স্যার কিন্তু আপনাকেই ভালোবেসেছে। ‘
‘ আমি বলিকি! বালিকা বুঝে কি! শুনুন আপনাকে একটা সত্য কথা বলি। আপনার স্যার মোটেই আমাকে ভালোবাসেনি। ভালোবাসলে আমার কষ্টটা চোখে পড়তো। বরং আমি ভালোবেসেছি। তার কষ্টটা সবার আগে আমিই বুঝতে পারি। বুঝেছেন?’
‘ জি ম্যাম। স্যার ঠিকি বলেছিলেন। আপনি সত্যিই স্পষ্টবাদী। যা মনে আসে তাই বলে দেন। আপনাকে আমার ই ভীষন ভালো লেগেছে। ‘
লাবিবা চোখ পিট পিট করে তাকায়, ‘ স্যার আপনাকে বলেছে?’
‘ না ম্যাম। স্যার আমাদের ওনার কে বলেছেন। আমি শুনেছি। ‘
‘ আচ্ছা। তাহলে ঠিক আছে। ‘
‘ জি ম্যাম। ‘
মেয়েটা তার পরেও মুচকি মুচকি হাসছে। লাবিবা বুঝে পায় না এতো হাসির কি মানে? অন্যরুমে রোজীকে সাজানো হচ্ছে। রোজীর বিয়ের শপিং রোজী নিজে করেছে বলে ইচ্ছা অনুযায়ী ব্রাইডাল ড্রেস নিতে পেরেছে। কলাপাতা রঙের লেহেংগাটা পড়ার পর যে কি সুন্দর লাগছিলো! ওকে তো টেনেই নিয়ে গেলো সাজাতে। ইসস লাবিবা যদি আরেকটু দেখতে পেতো! তামিমের সামনে যখন যাবে তখন তামিম কেমন করে তাকাবে? চিকনি চামেলি থেকে চোখ সরবে? আশেপাশে সব যদি ব্লক হয়ে ফোকাসটা রোজীর দিকেই হয় তাহলে কেমন সিন ক্রিয়েট হবে? এখান থেকে বেরিয়েই ক্যামেরাম্যানের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। রোজী তামিম একেবারে মুখোমুখি। রোজী লজ্জায় মাথা নিচু করে হাসছে আর তামিম হা করে গোল্লা গোল্লা চোখ বানিয়ে গিলছে আই মিন দেখছে। জোস একটা রোমান্টিক স্যুট হয়ে যাবে।

রোজী আসে কিছুক্ষন পরেই। তার সাজ কমপ্লিট। তাকে দেখেই প্রত্যেকে চিৎকার দিয়ে উঠে। মারিয়া গিয়ে জড়িয়ে ধরে, ‘ মামনি তোমাকে এতো সুন্দর লাগছে… ছোট মামনিকেও সুন্দর লাগছে। আমি প্রথম সেলফি নিবো তোমাদের সাথে। ‘
রোজী গালে গাল লাগিয়ে আদর করে দেয়। লাবিবা প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়। চোখ মেরে বলে, ‘ পাগলের ডাক্তার কি জানে তাকে সত্যি সত্যি এবার পাগল বানানোর ষড়যন্ত্র চলছে?’
রোজী হেসে জবাব দেয়,’ তাকে এটাও জানাতে হবে মেইন কালপ্রিট টা কে!’
‘ আপু!’
‘ এদিকে আসো। ‘
‘ দাঁড়াও । আস্তে হাটো। ‘
‘ আরে এসো। ‘
‘ কোথায়?’
বড় আয়নার সামনে গিয়ে লাবিবাকে দাড় করায়। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ আগে নিজেকে দেখো। তারপর আমার পেছনে লাগতে আসবে। ‘
লাবিবার চোখ একবার আয়নায় পড়তেই সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নেয়।
‘ না আপু আমি দেখবো না। ‘
‘ দেখো আগে নিজেকে। ‘
‘ অসম্ভব। ‘
লাবিবার হটাৎ এরকম চিল্লিয়ে উঠাতে উপস্থিত সবাই ভড়কে যায়। এনা খেয়াল করে লাবিবা মৃদু কাঁপছে। কেনো কাঁপছে? জিজ্ঞেস করে,
‘ লাবিবা তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?’
লাবিবা মাথা নাড়ায়। লাগছে না। তবে এটা বুঝতে পারে লাবিবার মাথার ভেতর কিছু একটা চলছে। যেটা নিয়ে সে চিন্তিত। পার্লারের মেয়েটা বলে,
‘ ম্যাম কি এখনো স্যারের উপর রাগ করে আছেন?’
‘ না। ‘
রোজী জানতে চায়, ‘ কেনো রাগ করবে?’
‘ একটু আগেই তো ম্যাম স্যারের সাথে কথা বলছিলো।’
একেকজন একেক ধারণা নিয়ে বসে থাকে। লাবিবার ভেতরে কি চলছে তা কারো জানার কথা নয়।

বউ নিয়ে যাবার একটু আগে সাবিনা হাতে প্লেট নিয়ে আসে। পোলাও এর উপর শুধু একটা রোষ্ট। মাখিয়ে ঝটপট মুখের সামনে ধরে বলে, ‘ হা করো।পরে কখন না কখন খাওয়া হবে। দুটো মুখে দেও। ‘
‘ খাবোনা আম্মু। ‘
‘ এগুলা বললে হয় মা? ঠিক মতো খাচ্ছিস না। কি কারণ?’
তানভীরের সাথে ঝগড়ার কথাটাও কানে আসে। সাবিনা অস্থির হয়ে উঠে, ‘ এভাবে সব সময় ঝগড়া ঝাটি করলে চলে? কদিন পর ই সমস্যা করিস। আজকের পর থেকে যেনো আমি এসব না শুনি। ‘
‘ আমার কি দোষ? ‘
‘ দোষ গুণ পরে হবে। চারটা লুকমা মুখে দেও লাবিমা। ‘
‘ প্লিজ । আমার গলা দিয়ে নামবে না। ‘
‘ আমি তো আর তোমার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে খায়িয়ে আসতে পারবো না। মেয়ে তুলে দিচ্ছি। প্রাণটাই দিয়ে দিচ্ছি। প্রতিদিন কে খাবে আমার হাতের লুকমা?’
লাবিবা উঠে যায়।
‘ আম্মু যাও তো এখান থেকে। আমার সামনে কাঁদবে না। আমাকে একদমি ইমোশনাল করার চেষ্টা করবে না।
বিয়ে তোমরা দিয়েছো আমি করিনি। ‘
কে শুনে কার কথা? সাবিনা একা নয়। ভাবী,কাকী,বোনেরা এসে জুড়েছে মরা কান্না। লাবিবা যথেষ্ট ডিসটেন্স মেইনটেইন করছে। ঐ দলে যাবে না। কার রাগ কাকে দেখাবে জানে না। তাকে শক্ত হতে হবে। না খাওয়া না দাওয়া। ঘুমাতে পারেনা। চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে। মিশ্র অনুভূতি। একদিকে স্বামী আরেকদিকে বাবা মা। একটা মেয়েই জানে এই সময় এই পরিস্থিতির কতটা যন্ত্রনা। যত দূরে থাকতে চাইছে বাবা মার থেকে ততো তাকে কাদাতে চলে আসছে একে একে মানুষ গুলা। সাবিনাকে ধরে নিয়ে চলে যায় অন্য রুমে। সবাই বুঝ দিতে থাকে তাকে। মেয়ে তোমার তোমার ই থাকবে। দূরে চলে তো যাচ্ছে না। এতো ভালো মেয়ে জামাই পাইছো দোয়া করো মেয়েটার জন্য যেনো সুখী হয়। চোখের জল ফেলে মেয়েটাকে কেনো দুর্বল করে দিতেছো?

ইসমাইল দাঁড়িয়ে আছে মেয়েকে নিয়ে স্টেজে যাবে বলে। লাবিবা বের হতেই ইসমাইল আরো এগিয়ে যায়। লাবিবা এক পলক দেখে নেয় তাকে। ইসমাইল কে আজ ভীষন বিদ্ধস্ত দেখাচ্ছে। মুখের দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নেয় লাবিবা। বাবার বুকে শরীর ছেড়ে দিয়ে বলে, ‘ শরীরটা ভালো লাগছে না আব্বু। ‘
ইসমাইল সাথে সাথে সাবিনাকে ডাকে, ‘ আমার মেয়েকে খাওয়াও নি? শরীর খারাপ লাগবে কেনো? কি খেয়েছো দুপুরে আব্বু?’
লাবিবা মিষ্টি হাসে। এইতো তার আব্বু। একটু আগের ভেঙে যাওয়া মানুষ এখনো মমতাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইসমাইল আবার জিজ্ঞেস করে, ‘ কি খাইছো আব্বু?’
লাবিবা উঠে দাঁড়ায়। হাতের উপর হাত রেখে বলে,
‘ আব্বু চলো। ‘
ইসমাইল মাথা নাড়ায়। লাবিবাকে নিয়ে এগিয়ে যায়। নিজের অস্তিত্বকে হস্তান্তর করতে। হাঁটতে হাঁটতে অনেক কিছু বলে, ‘ যেকোনো প্রব্লেম হলে আমাকে ফোন দিবে। আর ফোন যদি না থাকে কাছে তাহলে তোমার শ্বাশুড়ী, খালাশ্বাশুড়ী তো আছেই। ম্যাডামকে বলবে। যা যা রিচুয়াল আছে সব মানবে। আর তর্কে যাবে না। এসময় অনেকেই অনেক কিছু বলে। মাটির দিকে তাকিয়ে সব মিশিয়ে দিবে। লক্ষী মন্ত হয়ে থাকবে। কাল তো বাড়ি নিয়েই যাবো । মুখটা একটু খানি হয়ে গেছে। চিন্তা করোনা হ্যা? ‘ লাবিবা উপুড় নিচ মাথা আড়ায়। ইসমাইল আবার বলে,’ আর তানভীর তো আছে ও সব দেখে রাখবে। ‘ লাবিবা চকিতে বাবার দিকে তাকায়। হ্যা এই কথাটা তার বাবাই বলেছে।

চলবে ___