#ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো
(৬৬)
পুরোটা রাত কাটে লাবিবা বিছানায় এপাশ ওপাশ করে। ভেবেছিলো তানভীরের রুমে থাকলে অন্তত শান্তি পাবে। কিন্তু রাত যত গভীর হচ্ছে ততো যেনো তানভীরকে মিস করার পাল্লা ভারী হচ্ছে । তানভীর কে কাছে চাইছে। লাবিবা কি চায়? ভালোবাসার মানুষ টা চোখের সামনে থাকলেও শান্তি। এইযে লাবিবা সারাদিন নিজেকে স্বাভাবিক দেখায়। আদৌ কি সে স্বাভাবিক আছে? তার সুখের বাড়িতে তানভীর খান নামক চোর সিধঁ কেটেছে। মনটা তো নিয়েছেই সাথে ভাবনা, চিন্তা, খুশি সবই নিয়ে গেছে। লাবিবার ভেতরের চাঞ্চল্যকর অনুভূতি গুলো ফিকে হয়ে যাচ্ছে না? হচ্ছেই তো। শুধু অপেক্ষা আর ভয়। কাছে থাকলে লাবিবা চিন্তামুক্ত থাকতো। প্রাণ ভরে জীবনটাকে উপভোগ করতো। একটা বিষয়ে তো নিশ্চিত থাকতো- সে আছে, পাশেই আছে। তানভীরের রুম, বিছানা, বালিশে লাবিবা একটুও ঘুমোতে পারলো না। মাঝরাতে বালিশের নিচে মাথা গুঁজে দিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। চিৎকার করে ডাকতে লাগলো তানভীর কে, ‘ খান সাহেব, আই নিড য়্যু। প্লিজ টেক মি ইন য়্যুর আর্মস। আই ওয়ান্ট টু ফিল য়্যু টু ডেথ। ‘
সাউন্ডপ্রুভ রুম হওয়ায় লাবিবার চিৎকার এর সাক্ষী হলো সুসজ্জিত দেয়াল আর আসবাবপত্র।
রোজী বাড়িতে পা দেওয়া মাত্রই লাবিবার খোঁজ করলো। লাবিবা নিজের রুমে জানতে পেরে রোজী আগে ফ্রেশ হতে গেলো। রোজী রুমে ঢুকে দেখলো অনেকটা অগোছালো হয়ে আছে। তামিম হসপিটালে যাবার সময় মনে হয় অগোছালো করে রেখে গেছে। গেঞ্জি পড়ে আছে চেয়ারের উপর। টাওয়েল বিছানার উপর। ডেস্কের বই সামনে দুইটা সামনের দিকে একটু বেরিয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সাহেব খুব তাড়াহুড়োতে বেরিয়েছে। রোজী আগে রুমটা টিপটাপ করে গুছিয়ে নিলো। তারপর গেলো ফ্রেস হতে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখে জবেদা দাড়িয়ে নাস্তার ট্রে হাতে। রোজীর ক্ষুধা পায় কম। তবুও আজকাল জোর করেই খাওয়া দাওয়া করে যাতে স্বাস্থ্যটা একটু ফেরে। লম্বা চওড়া মানুষটার সাথে নিজেকে বড্ড বেশি বেমানান লাগে। দিন দিন যেতো পুতুল হয়ে যাচ্ছে। দুটো স্যান্ডুইচ আর দুটো আপেল। সাথে এক গ্লাস শরবত। এই সামান্য খাবার খেয়েই রোজীর পেট ভরপুর। একটু রেস্ট নিয়েই লাবিবার রুমে যাবে রোজী ভাবলো। কিন্তু তার আর যেতে হলো না। রোজী এসেছে খবর পেয়ে লাবিবাই রোজীর কাছে চলে এসেছে। দুজন দুজনকে পেয়ে যেনো কি ফিরে পেলো! দুজনের মুখ থেকে হাসি সরছে না। লাবিবা রোজীকে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলো, ‘ কি বড় জা? বাপের বাড়ি থাকো কেনো? আমি ভাইজানের জন্য কি মন পুরে না?’
‘ কিছু দিন থাকো এখানে তারপর দেখো বাপের বাড়ি যে গিয়ে থাকবে আর আসতেই মন চাইবে না। ‘
‘ তোমার দেবর কে ছাড়া? একদিনও না। ‘
‘ সে দেখা যাবে। ‘
‘ এতো পাষান কেনো তুমি? তারপর বলো তোমরা দুজন মিলে কেমন আছো?’
রোজী মিষ্টি হাসলো। বললো, ‘ আলহামদুলিল্লাহ। ‘
‘ সব ঠিকঠাক করে নিয়েছো?’
রোজী মাথা নাড়ালো। ‘ না ‘ ।
‘ কি প্রব্লেম? ‘
রোজী অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। লাবিবার হাত মুঠোয় নিয়ে বললো, ‘ তুমি ছিলে না আমার মনে হতো সমুদ্রে সাঁতার কাটছি। এখন একটু সাহস পাচ্ছি। ‘
‘ ওকে। টেনশন নিও না। আমি হেল্প করবো। ‘
তামিম শুনলো রোজী এসেছে। বাইরে অযথা সময় নষ্ট করলো না। বাড়ি ফিরলো গরম গরম জিলাপির প্যাকেট হাতে। রোজীর জিলাপির প্রতি দুর্বলতা আছে।এটা জানতে পেরেছিলো রোজীর এক খালাতো ভাইয়ের মুখে। বাড়ি ফিরে পেলো ফিরোজ খান কে। কোনো একটা বিষয় নিয়ে টেন্সট মনে হচ্ছে। নানান ঝামেলার মানুষটার একদন্ড টেনশন ছাড়া থাকার উপায় নেই। তামিম জবেদাকে ডেকে জিলাপির প্যাকেট হাতে দিয়ে বললো সবাইকে সার্ভ করতে আর বড়বউ, ছোটবউকে ডেকে আনতে। তামিম গিয়ে ফিরোজ খানের সামনা সামনি বসলো। ফিরোজ খান একবার তামিমের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে ‘ ওহ তামিম ‘ বলে আবার চিন্তায় মশগুল হয়ে গেলো। তামিম আশপাশ চোখ বুলালো। সোহানা নেই। সেজন্য জিজ্ঞেস করলো,
‘ মম কোথায়?’
‘ ক্লাবে গেছে। চলে আসবে। ‘
‘ পাপা তুমি কি কোনো বিষয়ে টেন্সট? ‘
‘ হুম। ‘
‘ বলা যাবে কি?’
‘ সলুশন আছে তোমার কাছে?’
‘ প্রব্লেম না জানলে সলুশন কিভাবে দেবো?’
‘ ব্যবসার দিকটা তো তুমি একটু দেখতেই পারো। ‘
তামিম নড়ে চড়ে বসলো। ‘ পাপা আমি কিভাবে?’
‘ তোমার হাতে সপ্তাহে তিন দিন সময় থাকে। সোনার ব্যবসার দিকটা দেখলেও তো আমাদের একটু উপকার হয়। পাপা আর ছোটভাই খেটে খুটে মরছে আর তুমি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আমার একটাই ছেলে। আমার দিকটা বুঝে আমার হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ‘
‘ পাপা আমি তোমার বিজনেসে ইন্টারেস্টেড নই। ‘
‘ সেটাই আমার দুর্ভাগ্য। ভেবেছিলাম বড় ছেলে আমার বাধ্য, শান্ত আর বুদ্ধিমান। সেই আমার পরবর্তী হাল ধরবে। ছোট ছেলে ছোট থেকেই অবাধ্য বেয়াড়া। তাকে উপর ভরসা রাখিনি কখনোই। আজ ছোট ছেলেই আমার জন্য করে যাচ্ছে। ‘
তামিম মাথা নিচু করে নিলো। তার কিছু বলার মুখ নেই। অতীতের সময়ের কথা মনে পড়লো। তার বাবা তাকে যেভাবে দেখতে চায় সেতো সেরকমই একজন ছেলে ছিলো। যোগ্য বাবার যোগ্য সন্তান। নিজের সপ্নের পাশাপাশি বাবাকেও সাহায্য করে যেতো। এক দমকা হাওয়ায় সব এলোমেলো হয়ে গেলো। সবকিছু।
সোহানা ফিরে এসে দেখলো ফিরোজ খান চোখ মুখ শক্ত করে বসে আছে। আর তার সামনে মাথা নিচু করে আছে তামিম। সোহানা চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ কি হয়েছে? ফিরোজ?’
উত্তর না পেয়ে সিঁড়ির দিকে তাকালো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে রোজী,লাবিবা। ইশারা করতেই তারা মাথা নাড়ালো । কিছু জানে না। সোহানা তামিমের মাথা উপর দিকে তুললো।
‘ কি হয়েছে? তামিম? ‘
তামিম সোহানার হাত মুঠোয় নিয়ে ফিরোজের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ পাপা আই এম সরি। আমার সময়টা খুবই খারাপ ছিলো। ‘
‘ এখনো খারাপ আছে? তুমি কি বলবে তোমার পাপা তোমার ভালো সময়ের জন্য কিছুই করেনি? এখন কি প্রব্লেম?’
‘ তুমি যা চাও তাই হবে পাপা। আমি তোমার ব্যবসায় সময় দিবো। তার আগে একটু নিজেকে গুছিয়ে নিতে চাই। ‘ বলেই তামিম রোজীর দিকে তাকালো। সোহানা তামিমের কপালে চুমু দিয়ে বললো, ‘ য়্যু ক্যান টেক য়্যুর টাইম। ‘
গরম গরম জিলাপী ঠান্ডা হতে হয়ে এলো। ফিরোজ খান প্লেটে হাত বাড়িয়ে একটু নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ তুমি এনেছো?’
‘ হুম পাপা। ‘
ফিরোজ খান ডাকলো, ‘ মামুনিরা এদিকে এসো। ‘
রোজী লাবিবা এগিয়ে এসে বসলো। জিলাপী দেখে রোজী মুচকি হেসে তামিমের দিকে তাকালো। তামিম আগে থেকেই তাকিয়ে ছিলো রোজীর হাসি হাসি মুখের দিক। সোহানা ফিরোজকে হুঁশিয়ার করলো কম খেতে বলে। লাবিবা একটু নিয়েই রুমের দিকে পা বাড়ালো।
লাবিবার এরকম চুপচাপ হয়ে যাওয়া মোটেই ভালোলাগছেনা সোহানার। রোজীও ঠোঁট উল্টে বসে থাকে। যতক্ষন একসাথে থাকে রোজীকে নিয়েই গল্প হয়। অথচ লাবিবার গল্পের কোনো অন্ত নেই। রুমেই থাকে বেশিরভাগ। সোহানা তানভীর কে জানানোর প্রয়োজন অনুভব করলো। কিন্তু লাবিবা সাফ সাফ জানিয়ে দিলো তার সম্পর্কে তানভীরকে কিচ্ছুটি যেনো না বলে। সে যে এখানে আছে সেটাও যেনো না জানায়। প্রচন্ড অভিমান নিয়ে সে তানভীর কে এভাবেই পানিশ করবে বলে ঠিক করলো। এইযে কথা বলে না খবর জানায় না এটা কি কম বড় পানিশমেন্ট? তানভীর তো শ্বশুড় শ্বাশুড়িকে এটাও জিজ্ঞেস করতে পারবেনা যে লাবিবা কোথায়? লাবিবার নিজের ও তো কম কষ্ট হচ্ছিলো না। তবুও জেদ ধরে বসে থাকলো। সতেরো দিনের মাথায় সোহানা লাবিবাকে জোরে জোরে ডেকে জানালো তানভীর আসছে। লাবিবা কোনো রিয়েক্ট ই দেখালো না। শ্বাশুড়ির রুম থেকে থেকে গুটি গুটি পায়ে নিজের রুমে ফিরে এলো। দরজা বন্ধ করে বিছানায় এসে বসলো। চোখ দুটো বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস টানলো। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েই ফিক করে হেসে ফেললো। ভেতরে ভেতরে প্রবল উত্তেজনা বোধ করলো। সব যেনো ঠিকরে বেরিয়ে পড়তে চাইছে। এই মুহূর্তে কেউ দেখলে লাবিবা নিশ্চিত ভীষণ লজ্জা পেয়ে বসতো। আজকাল একটুতেই লজ্জা নামক রোগটা চেপে ধরে। কি এক যন্ত্রনা! কি মনে করে উঠে ভেনিটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নিজের প্রতি গভীর নজর দিলো। হায় হায়! ডান গালে ব্রণের দুটো দাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কপালেও দুটো ব্রণ গোটা গোটা লাল হয়ে আছে। ইসস! কি বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে। সবকিছু বাদ দিয়ে লাবিবা লেগে পড়লো রূপচর্চায়। চেহারার বাজে অবস্থা একদমি রাখা যাবেনা। চুল গুলো আঠা আঠা হয়ে আছে। কবে তেল দিয়েছিলো শ্যাম্পু করা হয়নি। লাবিবা দেড় ঘণ্টা লাগিয়ে গোসল করলো। কিচেনে এসে জবেদাকে বলে খাবার গরম করে খেলো। লাবিবাকে দেখে রোজী মুচকি হাসলো। লাবিবা রোজীকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ আপু কি বেরোচ্ছো?’
রোজীর সময় নেই। তামিম বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। যেতে যেতেই বললো, ‘ তোমার ভাইয়ের সাথে। ‘
লাবিবা হাসি মুখে বিদায় জানালো। সোহানা লাবিবার মাথায় হাত রেখে প্রাণ ভরে দোয়া করলো। অবশেষে মেয়েটার হাসি মুখের দেখা পেয়েছে বলা যায়। লাবিবা অনেক বার জিজ্ঞেস করতে চাইলো তানভীর কখন এসে পৌঁছাবে বলেছে? কিন্তু বাঁধা কাটিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারছেনা। সোহানার পাশে বসে ছটফট করছে।
সোহানা খেয়াল করলো লাবিবার অস্থিরতা। মেরুন রংয়ের থ্রিপিচে মেয়েটা ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে। মেরুন শাড়িতে নিশ্চয় আরো সুন্দর লাগবে। সোহানা অফার করলো, ‘ শাড়ি পড়বে? ‘
‘ সামলাতে পারিনা। ‘
‘ দুই চারদিন পড়লেই পারবে। চলো শাড়ি পরানো শিখিয়ে দিচ্ছি। ‘
সোহানা আলমারি থেকে মেরুন রংয়ের আডং এর সুতি শাড়ি বের করে আনলো। এখনো পাটভাঙা হয়নি শাড়িটার। ভীষণ সুন্দর শাড়িটা দেখে লাবিবা বেশ খুশি হয়ে গেলো। কিন্তু সেই রংয়ের ম্যাচিং ব্লাউজ খুজে পেলো না। সোহানার চোখ পড়লো ডিজাইনার ব্লাউজ গুলোর দিকে। সেখান থেকে একটা ব্লাক স্লিভলেস ব্লাউজ বের করে নিলো। লাবিবা আমতা আমতা করতে লাগলো। সোহানাই সাহস বাড়িয়ে দিলো।
‘ শ্বশুড় আর ভাসুরের সামনে পড়লে মাথায় এমনিতেই ঘোমটা দিতে হয়। সমস্যা নেই তো। ‘
লাবিবা লজ্জা পেয়ে পেছন থেকে সোহানাকে জড়িয়ে ধরে। আদুরে গলায় বলে, ‘ মামুনি তুমি অনেক ভালো।’
‘ আই নো। ‘
তানভীর বাড়িতে ঢুকেই গিয়ে সোহানাকে জড়িয়ে ধরে। কপালে চুমু দিয়ে সোহানা বলে,’ আই মিস য়্যু বাবা। ‘
‘ মিস য়্যু টু মম। আর সব কোথায়?’
‘ বাইরে আছে। ‘
তানভীর ড্রাইভারকে লাগেজ গুলো নিজের রুমে পৌঁছে দিতে বলে সোহানাকে বলে,
‘ আমি এখটু আসছি মম। ‘
‘ কোথায় যাচ্ছো? ফ্রেশ হয়ে রেষ্ট নাও। এখন কোথাও যেও না বাবা। ‘
তানভীর তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,
‘ ওকে এনে একেবারেই রেষ্ট নিবো। আসছি। ‘
‘ কাকে এনে ? লাবিবা? আরে লাবিবা তো এখানেই। তানভীর। শোনো বাবা। ‘
ততোক্ষনে তানভীর গাড়িতে গিয়ে বসেছে। খান বাড়ির চত্বর ছেড়ে গাড়ি পাকা রাস্তায় চলতে শুরু করে। সোহানা লাবিবাকে ডাকতে ডাকতে উপরে আসতেই দেখে লাবিবা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
চলবে ___
®লাবিবা তানহা এলিজা
#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৬৭)
শ্বশুড়বাড়িতে পা রেখেই তানভীর সাবিনাকে ডাকলো। সাবিনার কানে ফোন। লাবিবার সাথে কথা হচ্ছে। একটু আগেই লাবিবা ফোন করে জিজ্ঞেস করলো তানভীর এসেছে কিনা?সাবিনা বললো, ‘ আসেনি তো। জামাইয়ের আজ ফেরার কথা না?’
‘ শোনো আম্মু। ও কিছুক্ষনের মধ্যেই যাবে বুঝেছো? রান্না করেছো না সকালে? একটু খাইয়ে দিও। এসেই চলে গেছে তোমাদের সাথে দেখা করতে। ‘
‘ কি বলিস? এতোদূর জার্নি করলো ছেলেটা। এসেই আবার দৌড়াচ্ছে। না না এটাতো ঠিক নয়। তোর আব্বুতো আমাকে নিয়ে সন্ধ্যায় ও বাড়িতে যেতে চেয়েছিলো। ‘
এরি মধ্যেই তানভীরের গলা পেয়ে সাবিনা ফোন রেখেই রুম থেকে বেরিয়ে এলো। খুশিতে কথা ভুলে গেছে সাবিনা। বিদেশ থেকে ফিরতে না ফিরতেই জামাই তাদের সাথে দেখা করার জন্য চলে এসেছে। এরকম একটা জামাই পাওয়ার জন্য সাবিনা সারাজীবন ই আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করেছে। মন থেকে চাইলে আল্লাহ কি না দেয়!
‘ আম্মু কেমন আছেন?’
‘ তুমি দেশে ছিলেনা এতোদিন ভালো ছিলাম না বাবা। তুমি চলে এসেছো এখন অনেক বেশি ভালো আছি। ‘
‘ কয়েকটা দিন ই তো আম্মু। ‘
‘ তোমার পেরেন্টস এর কাছে হয়তো নরমাল। আমাদের কাছে তো না বাবা। আমাদের তো এতোদিন কোনো ছেলে ছিলো না। তুমি ই আমাদের ছেলে। ‘
তানভীরের গলা শুনে বাচ্চা পার্টি ছেড়ে কবিরের বউ রুপসী হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো। তানভীর মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো, ‘ কেমন আছেন ভাবী?’
রূপসী পানির গ্লাসটা তানভীরের হাতে তুলে দিয়ে বললো,
‘ এইতো আলহামদুলিল্লাহ। লাবিবাকে নিয়ে এলে না কেনো? ওকেও সাথে করে নিয়ে আসতে। ‘
তানভীর পানি মুখে দ্বিতীয় ঢুক দিতে যাচ্ছিলো । রূপসীর কথা শুনে তালুতে উঠে গেলো। সমানে কাঁশতে লাগলো। সাবিনা রূপসীকে রেখেই কিচেনে চলে গিয়েছিলো। কাশির শব্দ শুনে দৌড়ে এলো। পিঠে মালিশ করতে করতে বললো, ‘ বসে খাও। এইতো ঠিক হয়ে যাবে। ‘
তানভীর গ্লাসটা এগিয়ে দিতেই রূপসী নিয়ে নিলো। লাবিবা যে এখানে নেই আর কোথায় থাকতে পারে তানভীরের বুঝা হয়ে গেছে। গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
‘ আম্মু, আব্বু আসলে বলবেন। আমি তাহলে এখন আসি। ‘
‘ আসি কি? বসো। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে তারপর বের হবে। না জানি কখন খেয়েছো। ‘
‘ আম্মু পরে আসবো। ‘
‘ একদম না। বসো। ‘
ধমক খেয়ে তানভীর সোফায় বসলো। রূপসী টিপ্পনি কাটলো, ‘ দেখলেন তো কতো তাড়া? সেজন্যই বলছি সেখানে যাবেন বউকে পকেটে করে নিয়ে যাবেন তাহলে আর তাড়া থাকবে না। ‘
‘ বউ যদি পকেটে নিয়ে ঘুরা যেতো ভাবী তাহলে সব থেকে সুবিধা বোধ হয় কবিরের ই হতো। ‘
‘ কি এমন জাদু করলেন বলেন তো আমার সহজ সরল ননদটাকে? বেচারার শ্বশুড়বাড়ি যাওয়ার এত্তো তাড়া! আপনি ছাড়া কিভাবে দিন গুলো যে কাটলো সে একমাত্র যারা দেখেছে তারাই বলতে পারবে। ‘
রূপসীর কথা শুনে তানভীর আর তাড়া অনুভব করলো না। সোফায় গা এলিয়ে বসলো। রূপসীকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ কেনো? বেশি মিস করেছে বুঝি?আপনি থাকতে বউ আমার কষ্টে ছিলো এটাতো মানতে পারলাম না ভাবী।’
‘ দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মিটে?এতোদিন তো দেখে শুনে রাখলাম। এবার তো রেহাই দিন। ‘
রূপসী লাবিবাকে নিয়ে কথার ঝুড়ি খুলে বসলো। এতোদিন কি করেছে , কি খেয়েছে, কোথায় কোথায় গিয়েছে, কে কি বলেছে সব বলতে লাগলো। সাবিনা খাবার দিয়ে গেছে। তানভীর খেতে খেতেই রূপসীর কথা শুনলো। খাওয়ার পর বেশি সময় নিলো না বেরিয়ে পড়লো। মনটা যেনো এখন বেশি অস্থির করছে। লাবিবার সান্নিধ্য না পেলে কিছুতেই শান্ত হবে না। কোমল মেয়েটা মাঝে মাঝেই তানভীরের প্রতি এতোটা কঠিন হয়ে যায় তানভীর তখন দিক খুঁজে পায় না। এইযে অভিমান করে এতোগুলো দিন ফোনটা তুললো না তার কোন খবর ই নিতে দিলো না তানভীরের কি টেনশন হয়নি? দূরত্বের যন্ত্রনা কি তার একার? তানভীর কি ভালোবাসে না? ভাবতেই তানভীর মৃদু হাসলো। ঘন্টাখানেকের পথ শেষ করে তানভীর যখন বাসায় আসলো তখন বাসায় ফিরোজ খানও উপস্থিত। বাবা ছেলে মিলে ব্যবসা সংক্রান্ত আলোচনায় বসলো। সোনাহা খাবারের কথা বললে জানালো খেয়ে এসেছে। সেজন্য কড়া করে এক কাপ কফি শুধু দিলো। তানভীর কফি টা হাতে নিয়ে একবার সিড়ির দিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো না মোটেও লাবিবার কথা। সংক্ষিপ্তে আলোচনা শেষ করতে চাইলো। এরমধ্যেই টেবিলে লাবিবার উপস্থিতি টের পেলো। তানভীরের পাশের চেয়ারটা টেনে বসলো। আড়চোখে তাকিয়ে হাতে ভাজা টিক্কা কাবাবের প্লেটটা তানভীরের দিকে এগিয়ে রাখলো। প্লেটের দিকে তাকিয়ে তানভীর মৃদু হাসলো। তুলে নিলো একটা কাবাব। লাবিবা আশা করেছিলো তানভীর তার দিকে তাকাবে। তাকিয়েই থাকবে। এতোদিন পর তাকে দেখবে, এইযে শাড়ি পড়লো সাজলো বলবেনা সুন্দর লাগছে? কিছুই হলোনা।
‘ বিদেশী মেয়েদের সাথে মিশে মাথাটা গেছে। বউ আর ভালো লাগবেই না। ‘
বিরবির করে বললেও তানভীরের খাড়া কান ঠিকই শুনতে পায়। মনে মনে হেসে কফিটা ধীরে ধীরে শেষ করে যাতে লাবিবাও খাবারটা শেষ করতে পারে। লাবিবা উঠে যেতেই ফিরোজকে বললে ফিরোজ বলে,
‘ হ্যা যাও রেস্ট নাও গিয়ে। ‘
‘ লাবিবা স্টপ। ‘ লাবিবা শুনলে তো। এক প্রকার দৌড়েই যেনো উপরে উঠছে।
‘ আমি বলেছি থামতে। ‘ লাবিবা থামেনা বরং সোহানার রুমে চলে যায়। সোহানা ভেবেছিলো ফিরোজ এসেছে তাই না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করে, ‘ তুমি কি আবার বের হবে?’
‘ মামুনি। ‘
লাবিবার ডাকে ঘাড় ফিরিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
‘ কি হয়েছে? ‘
‘ আমার ড্রেস টা কোথায় রেখেছো? শাড়ি সামলাতে পারছি না আর। চেঞ্জ করবো। ‘
চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। সোহানা যা বোঝার বুঝে গেলো। চেঞ্জ করতে চাইলে যে কোনো ড্রেস চেঞ্জ করে নিতে পারতো। আগেরটাই কেনো লাগবে? সোহানা লাবিবার উপর আদেশ করলো,
‘ শাড়ি পরেই থাকো। আর যাও রুমে যাও। তানভীরের কি লাগে গিয়ে দেখো। ‘
‘ আমাকে ড্রেসটা দাও আমি চেঞ্জ করবো। ‘
‘ বললাম না রুমে যাও। তানভীরের কি লাগবে গিয়ে শুনো। ‘
লাবিবা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। সোহানা চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। এতো বড় মেয়ে হয়েছে তাও কেমন জেদ করে। কদিন পর এদের ই ছেলে মেয়ে হবে। সামলাবে কি করে? আল্লাহ জানে। বিছানা ছেড়ে সোহানাই উঠে রুম থেকে বেরিয়ে চলে যায়। তানভীরকে এদিকে আসতে দেখে কিছু না বলেই ডায়নিং এ ফিরোজ খানের নিকট চলে যায়। তানভীর রুমে ঢুকতেই লাবিবা বেরিয়ে যাবার জন্য পা বাড়ায়। তানভীর আটকাতে যায় কিন্তু হাত পিছলে যায়। তানভীর ক্রোধ নিয়ন্ত্রন করতে পারে না। এতোদিন পর বউকে পেলো বউ এসে গলা জড়িয়ে বসে থাকবে তা নয় রাগ দেখাচ্ছে তার উপর। ধমক দিয়ে বলে, ‘ খবরদার এক পা এগুবেনা। আমি কিন্তু পাগল হয়ে যাচ্ছি এবার। ‘
লাবিবা থমকে দাঁড়ায়। তানভীরের চোখে দৃষ্টি রেখে তাচ্ছিল্য হাসে। ‘ চাতক পাখি হয়ে সতেরোটা দিন কাটিয়ে দিলাম। আপনার সতেরোটা মিনিট সহ্য হচ্ছেনা? ‘
তানভীর পা বাড়িয়ে সেকেন্ডেই জড়িয়ে ধরলো লাবিবাকে। লাবিবার পা পিছিয়ে গেলো। তিনপা পিছোতেই আলমারিতে হাত রেখে ব্যালেন্স করে দাঁড়ালো। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো দুই ফোঁটা জল। তানভীর ছাড়লো না। মিনিটের পর মিনিট পার হলো। গলায় নাক ডুবিয়ে শ্বাস টানলো। অদ্ভুত রকমের আওয়াজ কানে এলো। হাতের বাঁধন একটু আগলা করে আদুরে গলায় ডাকলো, ‘ আমার রাণী! ‘ লাবিবা চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো। কতদিন পর ডাকটা শুনে কলিজা যেনো ঠান্ডা হয়ে গেলো । তানভীর আবার তাকে চেপে ধরলো। কানের কাছে মুখটা এগিয়ে নিলো।
বললো,’ আই মিস য়্যু মোর দ্যান য়্যু। ‘ লাবিবা উত্তর করলো না। তানভীরের বাধ ভেঙে গেলো। দু হাতে আজলে তুলে সামনে নিয়ে এলো। লাবিবার চোখের জল ঠোঁট দিয়ে শুষে নিলো। ফিসফিস করে বললো,
‘ আই লাভ য়্যু । ‘ লাবিবা তানভীর কে ছাড়িয়ে নিলো। অভিমানী কন্ঠে বলল, ‘ জিততে গিয়ে আমি নিজেই নিজেকে ঠকিয়ে ফেলেছি। আপনাকে ভালোবাসা আমার একদমি উচিত হয়নি।’ বলতে বলতেই আবার অশ্রুদানা গড়িয়ে পড়লো। তানভীরের ভীষন খারাপ লাগলো। লাবিবা চলে যেতে নিলে আবার টেনে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নিলো। লাবিবা মুখ ভার করে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। না পারতে বললো,
‘ ছাড়ুন। ‘
‘ এভাবেই থাকো। যত অভিমান,অভিযোগ, নালিশ সব আমার বাহুতে রেখেই শুনবো। দূর থেকে নয়। ‘
‘ লাগবেনা আমার। কোন অভিযোগ নেই। কিচ্ছু নেই। ‘
তানভীর বিছানায় বসে লাবিবাকে টেনে নিজের কোলের উপর বসালো। বুকের উপর শক্ত করে চেপে ধরলো। লাবিবার থুতনি ধরে মুখটা উঠিয়ে টুপ করে পর পর চুমু খেয়ে নিলো। জানতে চাইলো,
‘ কি চাই আমার রাণীর? বলো। ‘
লাবিবা চুপ থাকলো। বেশ কিছুক্ষন পর নিজের মুখ খুললো। ‘ আমার পাসপোর্ট রেডি করেন। আপনার যতগুলো দেশের ভিসা আছে আমারও ততোগুলো দেশের ভিসা চাই। ‘
‘ নট পসিবল। ‘
‘ যতটা পসিবল ততোটা আপাতত চাই। ‘
‘ আমি চাইনা তোমাকে সাথে নিতে। আমি একদমি সময় দিতে পারবোনা। মাঝখান থেকে একটা টেনশনে থাকবো। ‘
‘ কাদের সময় দেবার জন্য? ‘ ঝটপট তানভীরের প্যান্ট থেকে ফোনটা বের করে গ্যালারি ওপেন করে সিঙ্গাপুরে থাকা মেয়েদের সাথে পিক গুলো বের করে মুখের সামনে ধরে বলে, ‘ এদের জন্য?’ তানভীর না চাইতেও হেসে ফেলে। এদিকে লাবিবা শুধু ফুঁসছে। ফোনটা নিয়ে পাশে রেখে দেয়। হাসি থামিয়ে বলে, ‘ জেলাসি? ট্রিপিক্যাল বউদের মতো বিহেব করছো কেনো? তুমি তো সেরকম নও জান। ওরা জাস্ট আমার কলিগ মাত্র। তুমি তো আমার রাণী। ‘
‘ আমি যা বলেছি তাই চাই। ‘
‘ আর কি চাও বলো? ‘
‘ ভালোভাবে গাড়ি চালানো শিখতে চাই। ‘
‘ শিখিয়ে দিবো। আর কি?’
‘ অস্ত্র চালানো শিখতে চাই। ‘
তানভীর চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। লাবিবা একদমি আমলে নেয় না। এমন ভাব যেনো সে ললিপপ কিনে দেবার বায়না ধরেছে। তানভীরের কপাল ভাঁজ করে জানতে চাইলো, ‘ আর?’
‘ মামুনি কোথায় যায়? মামুনীর সাথে যেতে চাই। ‘
‘ আর? ‘
‘ আপাতত এটুকুই লিস্ট। আপনার পায়ে পা রেখে চলতে চাই। ‘
তানভীর জোরে শ্বাস নিয়ে গা এলিয়ে দেয়। মাথার নিচে ক্রস করে হাত রেখে বালিশ তৈরী করে। আফসোস সুরে বলে, তোমার লিস্টে প্রয়োজন গুলো আছে কিন্তু প্রয়োজনে আমি নেই। লাবিবা ঝটপট তানভীরের বুকের উপর শুয়ে পড়ে। আদুরে গলায় বলে,
‘ আপনি আমার জীবনের প্রায়রিটি,প্রয়োজন নন। ‘
চলবে ___
®লাবিবা তানহা এলিজা