#ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো
(৬৮)
সৃষ্টি স্কুল এন্ড কলেজ। রোজীর হাত ধরে ভেতরে চললো তামিম। এখানকার তিনজন স্যার তামিমের ব্যাচম্যাট। হয়তো তাদের সন্তানরাও এখানেই লেখাপড়া করে। হারুন নামের একটা কমন ফ্রেন্ড ছিলো। তার মেয়ে এবার ভার্সিটিতে পা রাখবে। এদিকে তামিম এসেছে তার বউকে ভর্তি করাতে। ভেবেই তামিমের অসস্তি হচ্ছে। কিছু করার নেই। অসস্তি গুলো ঢুবিয়ে রেখে তাকে এগিয়ে যেতে হবে। আর যাই হোক ডক্টর তামিম খানের ওয়াইফ মূর্খ থাকবে এটা মেনে নেওয়া পসিবল না। তামিম রোজীকে একবার জিজ্ঞেস করে নিলো ‘ সার্টিফিকেট সাথে আছে তো? ‘
‘ আছে। ‘
‘ কত বছরের গ্যাপ?’
রোজী উত্তর করলো না। মাথা নিচু করে করে হাঁটতে লাগলো। টিচারগণ তামিমের সাথে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলো। বেশ কিছু আলাপচারিতার পর তাদের রোজীর দিকে নজর পড়লো। তামিমকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, ‘ কে?’
তামিম রোজীর দিকে ফিরে হাত এগিয়ে দিলো। ইশারায় এগিয়ে আসতে বললো। তামিমের একজন ব্যাচম্যাট জানতে চাইলো, ‘ এডমিশন নিবে? কোন ক্লাস?’
‘ ফাস্ট ইয়ার । ‘
‘ কি হয় তোর?’
‘ ওয়াইফ। ‘
‘ হুয়াট? ‘
রিয়েক্ট করে যেনো ব্যক্তি নিজেই অসস্তিতে পড়ে গেলো। তামিমের নিশ্চল শান্ত দৃষ্টি। রোজীর এডমিশন ফর্ম ফিলাপ করা হলো। তামিমের চোখ রোজীর হাতে কলমের উপর। হাত ঘুরানোটা একভাবে দেখে যাচ্ছে। তামিমের ব্যাচম্যাটরা মুচকি মুচকি হাসছে। তামিম ওসবে পাত্তা দিলো না। বাড়তি কিছু বললোও না। এদের মতি গতি ভালো ঠেকছে না। কখন কি মুখ ফসকে বলে ফেলে বলা যায়না। বের হবার সময় দেখে একে একে তিনজনই বেরিয়ে এলো। তামিমের পিঠে হাত রেখে বললো,’ রেস্টুরেন্টে চল। ভাবীর সাথে এই প্রথম দেখা। খাতিরদারি না করে ছাড়লে ভীষণ খারাপ লাগবে। ‘
‘ ভাবী এখন তোদের স্টুডেন্ট হয়। ‘
‘ তাতে কি? চল বেটা। ‘
রোজীকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘ আমরা চারজন একসাথে লেখাপড়া করেছি বুঝলেন ভাবী? দেওয়ানপাড়া যে স্কুল সেই স্কুলটায়। ‘
‘ ও আচ্ছা। ‘
‘ ইজি হয়ে যান ভাবী। স্কুলে আমরা স্যার হলেও বাইরে আমরা আমরা সবাই আপনার দেবর। ‘
রোজী জোর করে একটু হাসি দেয়। বেচারা এমনিতেই নিজেকে গুটিয়ে রাখে। আর এদিকে! না জানি এখন থেকে প্রতিদিন বের হবে প্রতিদিন অসস্তিতে পড়বে। এরইমধ্যেই তামিমের সাথে দুইবার চোখাচোখি হয়ে গেলো। একজন তামিমের পিঠে থাপ্পড় দিয়ে বললো,
‘ সামনে তাকা ব্যাটা। আমাদের বউও এককালে কচি ছিলো। তোর কচি বউয়ের সাথে শুধু কথাই বলছি নিয়ে যাচ্ছি না। ‘
কি বেশরম কথা! রোজী লজ্জায় মাথাটা আরো নীচে নামিয়ে নিলো। রেস্টুরেন্টে চেয়ার টেনে গুটি শুটি হয়ে বসলো।
‘ তো মামা! খুব মজায় আছোস তাইনা? ‘ চোখ দিয়ে রোজীকে ইশারা করে। তামিম বিরবির করলো, ‘ যে শুঁটকি! ধরতেও ভয় লাগে। ‘ রোজী শুনতে পেয়েই চট করে মুখ তুলে তাকালো। পরক্ষনেই ওয়েটারের রেখে যাওয়া কোল্ড কফি নিজের দিকে নিয়ে পাইপে চুমুক বসালো। নিজেই নিজেকে মানাতে চাইলো, ‘ ঠান্ডা ঠান্ডা! সব ঠান্ডা। ‘ কিন্তু তামিমদের আলাপচারিতা তাকে ঠান্ডা হতে দিলোনা। বরং গাল দুটো গরম হয়ে উঠলো একেকটা দুষ্টু দুষ্টু কথাবার্তায়। এসব শুনতে হবে জানলে রোজী গাড়িতেই বসে থাকতো। ভুলেও স্যারগুলোর সাথে আড্ডায় বসতো না। বাড়ি ফেরার পথে রোজী এটাই ভাবতে লাগলো প্রথম দিনেই যা লজ্জা পেলো পরের দিন গুলোতে স্যারদের সাথে আদৌ সহজ হতে পারবে তো? তামিম লক্ষ্য করে একবার জিজ্ঞেস করলো, ‘ রোজ? কিছু ভাবছো?’
রোজী মাথা নাড়ালো। সে কিছু ভাবছে না। মিনিট দুয়েক পর ই চাঞ্চল্য ভাব নিয়ে প্রশ্ন করে ফেললো,
‘ তখন আপনি কিছু বললেন না কেনো?’
‘ কি বলবো? বললে কি কারো মুখ চুপ থাকতো? ‘
রোজী কি উত্তর দিবে খুঁজে পেলো না। আবার চুপ হয়ে গেলো।
পুরো রাত এক ঘুমে কাটিয়েছে তানভীর। অনেক দিন পর শান্তিতে ঘুম হলো । চোখ খুলেই নরম কিছুর উপর নিজেকে আবিষ্কার করলো। চট করে মাথা তুলতেই দৃশ্যমান হলো ঘুমন্ত এক নিষ্পাপ মুখ। ঘন পাপড়িগুলো প্রত্যেকটা কথায় নেচে নেচে উঠে। এখন একদম শান্ত! ঘন নিঃশ্বাসের শব্দটাই ফিরে ফিরে আসছে। তানভীরের শরীর মনের উপর শিহরণ বয়ে গেলো। মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলো স্ত্রীকে। পুরুষ্ট ঠোঁটজোড়া নজর কাড়লো। আনমনেই বুকের উঠা নামা গুনতে লাগলো। সময়ের পর সময় বয়ে গেলো তানভীরের ঘোরের মাঝেই কাটলো। ভেতর থেকে গলাটা কেমন শুকিয়ে আসছে। এই মেয়েটার কাছাকাছি এলেই কেমন তৃষ্ণা পায়। প্রবল জোয়ারের তৃষ্ণা। তানভীর ধীরে ধীরে ঠোঁটের দিকে এগুলো। আলতো করে একটা চুমু দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে গেলো। ঘড়িতে আটটা পচিঁশ। সাড়ে নয়টার মধ্যে কলেজে উপস্থিত থাকতে হবে। এ কয়দিন ছিলো না। ভাইস প্রিন্সিপাল সব দায়িত্ব পালন করেছে। এবার জবে ফেরা উচিত। তানভীর রেডি হতে বাঁধলো বিপত্তি। তার ড্রেস সিলেক্ট করতে করতে চেয়ারে সোফায় জড়ো হলো কয়েকখানেক স্যুট। অবশেষে গ্ৰে কালার স্যুটে নিজেকে তৈরী করে নিলো। বের হবার সময় কিছুক্ষন লাবিবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। লাবিবার ঘুমে কাঁদা চেহারা দেখে এবার বেশ মায়া লাগলো। ক্রুর হেসে কপালে একটা চুমু দিয়ে বেরিয়ে পড়লো। ব্রেকফাস্ট টেবিলে গিয়ে বসতেই সোহানা ট্রে এগিয়ে দিলো। লাবিবাকে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ ছোট বউ যাবে না? ক্লাস তো শুরু হয়েছে। আজো যাবে না?’
‘ কাল থেকে যাবে। আজ একটু ঘুমোক। ‘
‘ আচ্ছা। ‘
তানভীর সোহানার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। সোহানা জিজ্ঞেস করলো, ‘ হাসছো কেনো? পাজি ছেলে!’ তানভীর আরো একবার হাসলো সোহানার ধারণার উপর। মানুষের চোখ পড়ার কৌশল তানভীর ছোট থেকেই রপ্ত করে আসছে। আর এ তো নিজের মম। সোহানা এবার চোখ পাকালো। ধমকে বললো,
‘ খাবারের দিকে তাকাও। নির্লজ্জ ছেলে। ‘
‘ থ্যাংকস মম। তোমাদের ছোট বউ তোমাদের এতো পছন্দের ছিলো কখনো তো বললে না। ‘
‘ হুম। বলি আর তুমি তুলে নিয়ে আসো। পাপার মান সম্মান খোয়াও। আবার হাসছে। খবরদার হাসবেনা। তানভীর! ‘
তানভীর খাবার শেষ করে হাত মুছে বেরিয়ে যাওয়ার আগে পেছন থেকে সোহানাকে জড়িয়ে ধরে গালে গাল মিশিয়ে দিলো।
‘ বাবাহ! বউকে ঘুমোতে দিয়েছি বলে এতো আদর?’
‘ উমমম। আগের বউকে দেখেছি ভোরে না উঠলেই তুমি ডেকে ডেকে তুলে দিতে। এই বউগুলোর সাথে তেমন করোনা কেনো বলোতো?’
‘ বউরা সকালেই উঠবে। প্রথম প্রথম জাস্ট একটু ছাড় দিচ্ছি। সারাজীবন সংসার কি আমি সামলাবো? বউদের সংসারের দায়িত্ব নিতে হবে না?’
‘ সংসারের দায়িত্ব একমাত্র তোমার ছোট বউমাই নিতে পারবে। তাকে নিজের মতো করে গড়ে নিও। ‘
তানভীর কথাটা শুনেই সোজা হয়ে দাঁড়ালো। পেছন ফিরে দেখলো তামিম আসছে। সোহানা তানভীরের কথপোকথন শুনেই মন্তব্য টা করলো। পেছন পেছন রোজীকেও দেখা গেলো। কলেজ ড্রেস পড়নে রোজীকে দেখতে একদম বাচ্চা মেয়ে লাগছে। ঘাড় থেকে ব্যাগ নামিয়ে তামিমের পাশে এসে চেয়ার টেনে বসলো। রোজীকে এডমিট করানো নিয়ে সোহানা বেশ খুশি হয়েছে। রোজী যে একটা ট্রমার মধ্যে আছে এটা তার ব্যবহারেই যেনো মাঝে মাঝে প্রকাশ পায়। তার একটা ফ্রেন্ড সার্কেল গড়ে উঠুক। তাহলে স্বাভাবিক হয়ে যাবে আশা করা যায়। পড়াশোনাটাও জরুরী। তানভীর জিজ্ঞেস করলো, ‘ তোমার কাছে এমন কেনো মনে হয় ভাইয়া? বড়বউ হিসেবে মম ভাবীকে নিজের মতো গড়ে নিতে পারে।’
‘ আপাতত আমার মন মতো গড়ে তুলতে চাই। ‘
তানভীর হেসে রোজীকে বললো,
‘ পিচ্চি ভাবী। তাড়াতাড়ি বড় হতে হবে। ‘
সোহানা রোজীর টিফিন বাটি ভরে দিলো। এতো এতো যত্ন পাওয়া সত্বেও রোজীর মন কেঁদে উঠলো। সোহানা শ্বাশুড়ি কম যেনো মা বেশি। এতো ভালোবাসা দেয় অথচ কাজ ছাড়া কথা বলেনা। কেমন যেনো বিরক্ত মুখে তাকায় তার দিকে। লাবিবার মতো যখন তখন কাছ ঘেঁষতে পারে না। জড়িয়ে ধরতে পারে না। এতো মায়া কাজ করে মানুষটার উপর। একটু মন খোলে কথাও বলতে পারে না।
লাবিবার ঘুম ভাঙ্গে বেলা দুটো নাগাদ। ঘড়ির টাইম দেখেই বিছানা ছাড়তে গেলে ব্যাথায় টনটন করে উঠে শরীর। করবে নাইবা কেনো? সারারাত আশি কেজি একটা মানুষকে নিজের উপর নিয়ে থাকলে চ্যাপ্টা হয়ে যাবে না? আস্ত আছে এটাই ভাগ্য। রুমের অবস্থা দেখে লাবিবার মাথা ঘুরে গেলো। আলমারির সব কাপড় এভাবে ফেলে রেখেছে কেনো? রাতে তো রুমটা গোছানোই ছিলো। তানভীর কি ড্রেসের উপর নিজের রাগ ঝাড়লো? লাবিবা ঘুমিয়ে ছিলো সেজন্য? লাবিবা ঝটপট কাপড় গুলো গুছিয়ে নিলো। আলমারিতে রেখে গোসল করে ডাইনিং এ দৌড়ালো। ক্ষিধেয় পেট চো চো করছে। বাসায় কেউ নেই। সবাই বেরিয়েছে। জবেদা লাবিবাকে খাবার এনে দিলো। লাবিবা জিজ্ঞেস করলো,
‘ সবাই খেয়েছে?’
‘ না। সবাই সবার কাছে। আপনে খাইয়ে নেন। জানেন নাতো বড়বউরে কি সুন্দর ই না লাগতেছিলো স্কুলের জামা কাপড় পরে। মনে হইলো মাত্রই বয়সন্ধিকালে পড়লো। ‘
‘ স্কুল কেনো?’
‘ আপনে দেখি কিছুই জানেন না। বড়বউ পড়াশোনা করবে। বড় ভাইজান তারে স্কুলে ভর্তি করে দিছে। ‘
লাবিবা আর উপরে গেলো না। রোজীর ফেরার অপেক্ষা করলো। ফিরতেই গিয়ে সামনে দাঁড়ালো। ঘুরে ঘুরে রোজীকে দেখলো। রোজীর দিকে অসহায় দৃষ্টি ফেললো। মাথা চুলকিয়ে বিড়বিড় করলো,
‘ আমার বড় জা এবার স্কুল ছাত্রী হয়ে গেলো!
চলবে___
@লাবিবা তানহা এলিজা
#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৬৯)
কুলকুচি করে ফুটপাতে পিক ফেললো রোজী। পর পর তৃতীয় বার সেম কাজটা করার সময় পাশ ঘেঁষে হেটে যাওয়া লোকটা খেঁক করে উঠলো।
‘ সাইডে পিক ফেলা যায়না? রাস্তার মধ্যে পিক ফেলে। আজকালকার ছেলেমেয়েরা ভদ্রতা কি জিনিস কিচ্ছু শিখেনি। ‘
রোজী দেখলো সে রাস্তা থেকে তিন কদম দূরে আছে। লোকটার উপর তো পরে নি। এরকম বিহেভ করার কি আছে? ছুটির পর গেট থেকে এটিএম বুথ এর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তামিম বলেছে এখানে দাঁড়াতে। সে এসে নিয়ে যাবে। দশমিনিট হতে চললো তামিমের খোঁজ নেই। পানির বোতল ব্যাগে ভরে রোজী আবার অপেক্ষা করতে লাগলো। তামিমের দেখা মিললো আরো মিনিট সাতেক পর। গেইট থেকে বের হয়ে এলো। গাড়ি কোথায়? গাড়ি ছাড়াই এসেছে নাকি? তামিম এসে কিছু না বলেই রোজীর হাত মুঠোয় নিয়ে নিলো। হাতের উল্টো পাশ গালের উপর ছুঁয়ে দেখলো। প্রশ্ন করলো, ‘ য়্যা য়্যু ফিলিং সিক?’ রোজী মাথা নাড়ালো।
‘ কই? নাতো।’
‘ ক্লাসের মাঝে তিনবার ঘুমিয়েছো। ‘
রোজী আমতা আমতা করতে লাগলো।
‘ এসো। ‘
তামিম রোজীকে নিয়ে সামান্য পেছনের দিকে হেঁটে গাড়িতে উঠলো। রোজী প্রশ্ন করলো, ‘ আপনি কি অফিস রুমে ছিলেন? আমি অনেক ক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলাম। ‘
‘ হুম। বউ যদি প্রথম ক্লাসে গিয়েই তিনবার ঘুমিয়ে পড়ে তাহলে হাজব্যান্ড হিসেবে আমার তো অফিস রুমেই থাকার কথা তাই না ? স্যার দের সামনে লজ্জা পাওয়ার জন্য। ‘
স্টিয়ারিং এ বারি দিয়ে তামিম রোজীর দিকে ঘুরে বসে। হাত দুটো দুহাতে আবদ্ধ করে তার দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে চোখে চোখ রাখলো। জিজ্ঞেস করল, ‘ টেল মি ওয়ান থিং রোজ? আমাদের নিজেদের মধ্যে ডিসটেন্স কমানোর কথা ছিলো। স্বাভাবিক সংসার জীবন যাপন করার কথা ছিলো। আমি তো কোথাও তোমাকে খুঁজে পাচ্ছি না। আমি রাত করে বাসায় ফিরে দেখি তুমি ঘুমাচ্ছো। আবার দেখি তুমি অসুস্থ। বাবার বাড়ি যাবার জন্য হাই হুতাশ করছো। ফাস্ট ডে তে তোমার নামে কমপ্লেইন এলো। দিন দিন চেহারা খারাপ করছো। কি নিয়ে এতো ডিপ্রেসড? তুমি কেনো পিছিয়ে যাচ্ছো? আমি তোমার হাজব্যান্ড। আমাকে বলতে পারো। তোমার কি এসবে ইন্টারেস্ট নেই? ‘
‘ আপনার আছে?’
‘ আমি কি তোমাকে নিয়ে পজিটিভ নই? ‘
রোজী চুপ রইলো। তামিম কি করবে? রাগ কমাতে নিজের চুল নিজেই খামচে ধরলো। গাড়ির জানালা খুলে দিয়ে ফুস ফুস করে শ্বাস ছাড়লো। মিনিট দুয়েক পর মাথা নাড়াতে নাড়াতে গাড়ি স্টার্ট করলো। বাসায় ঢুকার আগে রোজীর দিকে নিজের রুমাল এগিয়ে দিলো। ‘ চোখ মুখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে বাড়িতে ঢুকো। তোমাকে বকা দেয়া হয়নি যে সারা রাস্তা চোখের জল ফেলতে হবে। ‘ তামিমের রুঢ় ব্যবহারে রোজী আবার ফুঁপিয়ে উঠলো।
রোজী চোখে মুখে জল ছিটিয়ে মুছে ঠিকাঠাক হয়ে বাড়িতে ঢুকরো। তখনই লাবিবা এসে সামনে দাঁড়ালো । ঘুরে ঘুরে রোজীকে দেখলো। রোজীর দিকে অসহায় দৃষ্টি ফেললো। মাথা চুলকিয়ে বিড়বিড় করলো,
‘ আমার বড় জা এবার স্কুল ছাত্রী হয়ে গেলো!’
‘ স্কুল ছাত্রী না। আমি তো ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার। ‘
‘ তাহলে আমি হলাম তোমার হোম টিউটর। ‘ বলেই হাসতে লাগলো। রোজীও মুচকি হাসলো। লাবিবাকে বললো, ‘ এখানেই থাকো। আমি চেঞ্জ করে আসছি। অনেক গল্প বলার আছে। ‘
রোজীকে সাদা একটা কামিজে সাদামাটা চেহারায় লাবিবার ভালো লাগলো না। যেখানে লাবিবা নিজের গায়ে সবথেকে আনকম্ফোর্টেবল শাড়িটা সর্বদা জড়িয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেখানে রোজী কেনো এভাবে থাকবে? জবেদা নেই। রোজী নিজেই খাবার গরম করে লাবিবার পাশে খেতে বসেছে। লাবিবাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ খেয়েছো তুমি?’ লাবিবা বললো ‘ খেয়েছি। ‘
লাবিবা বসে বসে রোজীর খাওয়া দেখতে লাগলো। কিছুক্ষন পর জানতে চাইলো, ‘ আপু আমাকে দেখে কেমন লাগছে বলোতো? একদম বউ বউ না?’
‘ মাশাআল্লাহ। অনেক সুন্দর।’
‘তোমার দেবর আমার জন্য এত্তোগুলো কালারফুল ড্রেস নিয়ে এসেছে। আমাকে সাদাসিধে দেখলেই রেগে যায়। বউদের সব সময় সুন্দর সেজেগুজে পরিপাটি হয়ে থাকতে হয়। যাতে তাদের হাজব্যান্ড এর চোখে সর্বদা সবচেয়ে সুন্দরী নারী হয়ে থাকতে পারে। আমার কাকিমনি তাই বলতো। ‘
‘ ও আচ্ছা। ‘
রোজী কি যেনো মনে মনে ভাবলো। তারপর বললো, ‘ আমার কাছে আন ইজি লাগে। ‘
‘ কি?’
‘ বলতে পারবোনা। ‘
‘ চেষ্টা করো। একটু একটু করে। দেখবে ঠিকই একসময় ভাইয়া তোমার দিক থেকে নজর সরাতে চাইবেনা। একটা মেয়ের যোগ্যতা তার ব্যক্তিগত সম্পদ, আর রূপ তার ব্যক্তিগত পুরুষের সম্পদ। একটা ছাড়া আরেকটা কোনো না কোনো দিক থেকে অসম্পূর্ণ। কোনটাই হেলা করা উচিত নয়। ‘
‘ জানি। ‘
‘ তাহলে কি করতে চাইছো? ‘
‘ সময় সবকিছু ঠিক করে দেয় । ‘
বলে রোজী লাবিবার চোখে চোখ রাখলো। লাবিবা উপর নীচ মাথায় ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালো। হ্যা। সময় সবকিছু ঠিক করে দেয়।
একসময় এ বাড়িতে আসার জন্য লাবিবা কতো প্রে করেছে আজ সে এই বাড়িতে। খান সাহেবের অনুপস্থিতিতেও তার সবকিছু লাবিবাকে অনুভবে জড়িয়ে রাখে। খান সাহেব কে মানানোর জন্য কতো কি করেছে আজ খান সাহেব তার দিওয়ানা হয়ে আছে। রোজীর লাইফে কত বড় ক্রাইসিস ছিলো আজ সঠিক মানুষটার দেখা মিলেছে। শুধু পা বাড়ানোর অপেক্ষা। তামিমের জীবনের বিষ নির্মূল হয়েছে।
রোজী যেনো লাবিবার কথা শুনলো। টকটকে হলুদ রঙের একটা শাড়ি পড়ে নিলো। ফর্সা গায়ে জ্বলজ্বল করতে লাগলো । লাবিবা তাকিয়ে আছে দেখে রোজী একটু লজ্জাও পেলো। সোহানা ছেলে বউদের সাথে গল্প করার সময় খেয়াল করলো রোজী শাড়ি পড়েছে। মনে মনে হাসলো। সাথে আসতে বলে নিজের রুমে নিয়ে এলো। সিম্পল এক সেট গহনা বের করে রোজীকে পড়িয়ে দিলো। রোজী আপত্তি জানালো। বললো, ‘ মামুনী আমার আছে তো অনেক গুলো। ‘
‘ এটাতে সুন্দর লাগবে। পড়ে থাকো। ‘
রাতে তামিম এসে দেখলো রোজী ঘুমিয়ে পড়েছে। বিছানার কোনায় গুটিশুটি হয়ে কাথা মোড়ে শুয়ে আছে। নিঃশব্দে রোজীর পাশে এসে দাঁড়াল। স্নিগ্ধ মুখটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ফ্রেশ হয়ে এসে পাশেই শুয়ে পড়লো। দু চোখে ঘুম ধরা দিলো না। সিলিং এর দিকে তাকিয়ে রইলো। মনের খেয়ালে প্রাক্তনের মুখটা ভেসে উঠলো। সুন্দরী মায়াময়ী একখানা মুখ। মারাত্মক ভাবে আকর্ষন করে। ভুলে যাওয়া কি এতোই সহজ? সত্যিকারের ভালোবাসা গুলো কখনো মুছে যায়না। স্মৃতি হয়ে মনের এক কোনে পড়ে থাকে। তামিম খুব যত্ন করে তুলে রেখেছে ভালো সময়ের স্মৃতি গুলোকে। আর খারাপ সময়টাকে ভুলে এগিয়ে যেতে নিয়ে এসেছে পাশেই শুয়ে থাকা মেয়েটাকে। তামিম হাত বাড়িয়ে রোজীকে নিজের বাহুতে টেনে আনলো। মেয়েটা ঘুমিয়ে কাদা। ভারী শ্বাস ফেলছে। তামিম দু আঙ্গুলে থুতনি তুলে ধরলো। মুখের কাছে এসে ডাকলো, ‘ রোজ ? হেই রোজ? ‘। সাড়া পেলো না। এক বাহুতে আগলে নিয়ে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। সময়ের পর সময় ব্যয় করে ঠিক করলো সে এই মেয়েটির প্রতি কেয়ারিং হবে। যতোটা একজন হাজব্যান্ড তার ওয়াইফের প্রতি নরমাল বন্ডিং এ হয়। মেয়েটিকে তার দিকে টেনে আনবে। তাকে ঘিরেই চলবে এই মেয়েটির জীবন। টকটকে এই হলুদ শাড়িটার মতোন রঙিন করে তুলবে বাকিটা জীবন। মানুষের জীবনের গ্যারান্টি নেই। যতদিন বেঁচে আছে এই মেয়েটাকে নিয়েই সকল চিন্তা,ভাবনা ,সময় গুলো পাড় করবে। ভাসা জীবনের একটা ভীত গড়া চাই। যাতে এই কম বয়সী মেয়েটা তামিমের অবর্তমানে নিজেই নিজের ছাদ হতে পারে। যদিও কেউ তাকে উপড়ে ফেলার চিন্তা করবে না তবুও একটা শক্ত ভীত গেড়ে রাখা চাই। তামিম আছে। রিস্ক নেবার কোনো প্রয়োজন নেই। তামিমের ভাবনার মাঝেই রোজী একটু নড়ে চড়ে উঠলো। তামিম চিন্তিত হয়েই রোজীর কপালে চুমু দিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো।
ভোর চারটার দিকে তানভীর কাজ শেষ করলো। কতো কাজ যে জমে আছে একে একে শেষ করতে হবে। ল্যাপটপ টা বন্ধ করে বিছানায় দৃষ্টি মেললো। হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে আছে লাবিবা। গোলাপি টপস টা চেঞ্জ করেনি। সিঙ্গাপুর থেকে আসার সময় দুটো লাগেজ ভর্তি ড্রেস নিয়ে এসেছে তানভীর। সব তার এই ফুটন্ত গোলাপটার জন্য। কবিরের থেকে জানতে পেরেছিলো ইন্ডিয়া গেলেই হাতে বড় একটা লিস্ট ধরিয়ে দিতো। কসমেটিকস আর ড্রেসের। এর জন্য এক টাকাও কবিরকে সে দিতো না। গিফট বলে তর্ক করতো। উল্টো মন মতো জিনিস না হলে কেঁদে কেটে একসার করে ফেলতো। ইসমাইল অবশ্য জানার পর কবিরের হাতে টাকা ধরিয়ে দিতো। কিন্তু ঐ টাকায় তো আর হতোনা। ইসমাইল জানতো ড্রেস কেনার কথা। কিন্তু আলাদা যে চকলেট, কসমেটিকস আনা হতো কবির তো আর এতো টাকার হিসাব দিতে পারতো না। সে রোজগারের মানুষ। বোনের জন্য এনেছে এতে যদি টাকা চায় কাকার কাছে বিষয়টা কেমন লাগে? তবে তানভীরের সাথে লিংক হবার পর কড়ায় গন্ডায় সব টাকা তানভীরের থেকে আদায় করেছে। লাবিবার পছন্দ গাউন হিজাব। কবিরের নাম ধরে কত গাউন হিজাব কিনে যে লাবিবাকে পাঠিয়েছে তার হিসাব নেই। প্রাপ্তি তো তখনই হতো যখন সেই হিজাব গাউনে আবৃত নারীকে সে আড়ালে দাঁড়িয়ে চোখ জুড়িয়ে দেখতো। সেদিন রাতে অবশ্য ভালো ঘুম হতো। তানভীর এখন স্বাচ্ছন্দ্য মতো শপিং করতে পারে। লাবিবাকে সব থেকে সুন্দর দেখায় শাড়িতে তার থেকেও সুন্দর লাগে ওয়েস্টানে। গাউনে অর্ধেক সৌন্দর্য চাপা পড়ে যায়। লোকালয়ে সেটাই ঠিক আছে। শাড়ীতে ওয়েস্টানে লাবিবা শুধু তানভীরের জন্যই সাজবে।
বাহিরে আঁধার কেটে আলোর ছটা লেগেছে। একটু পরেই লাবিবা উঠে পরবে ফজর পড়তে। তানভীরের মোটেই ভালো লাগছে না। কতো গুলো রাত সে বউকে আদর করে না। কাছে পায়না। ঠিকঠাক ঘুমাতেও পারে না। আর এই মেয়ে যেই দেখেছে তানভীর বিদেশ থেকে ব্যাক করেছে। তখন থেকে শান্তিতে ঘুমিয়েই যাচ্ছে। একটা বার ও নিজে থেকে কাছে টানছে না। আর সে নাকি জামাইয়ের জন্য পাগল! এসব পাগলের নমুনা? তানভীর বসে রইল লাবিবার উঠার অপেক্ষায় । কিন্তু সে পর্যন্ত আর অপেক্ষা করতে পারলো না। অনেক ঘুমানো হয়েছে। আর না। হুট করেই তানভীর ডেকে উঠলো,
‘ জান! এই জান! জান? ‘
তানভীরের চিৎকার শুনে লাবিবা হুড়মুড় করে উঠে বসলো। চোখ খুলতে না পারলেও টেনে খুলার চেষ্টা করলো। তানভীরের আওয়াজের সাথে দৃষ্টি তাক করলো। তার থেকে কিছুটা দূরত্বে সোফায় বসে ডেকে যাচ্ছে তাকে। আচমকা এমনটায় লাবিবার হার্টবিট বেড়ে গেছে। দু হাতে বুক চেপে ধরলো। একরাশ চিন্তা স্বরে জানতে চাইলো,
‘ কি কি কি? কি হয়েছে?’
‘ আসবে কাছে?’
‘ কেনো?’
তানভীর আঙুল তাক করে দেখালো,
‘ বুকে ব্যাথা হচ্ছে। এইখানে। ‘
কয়েকটা মাস গ্যাপ থাকায় ঠিকঠাক লিখতে পারছিলাম না। চারপর্বের পর আজ লিখে নিজেকে সন্তুষ্ট করতে পারলাম। আশাকরি এবার থেকে আর অসন্তষ্ট থাকবো না রাখবো ও না। যারা এখনো জানতে পারেনি গল্পটা শুরু হয়েছে প্রিয় পাঠক তাদের জানিয়ে দিবেন। অনান্য পাঠকদের পড়ার জন্য সাজেষ্ট করবেন যেনো তারাও পড়ার সুযোগ পায়। রেসপন্স খুবই কম পাচ্ছি। কমেন্টে কেনো এতো কিপ্টামি?
চলবে___
@লাবিবা তানহা এলিজা