ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো পর্ব-৭০+৭১

0
945

#ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো

(৭০)
তানভীরের উম্মুক্ত বুকে নাক ঢুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লাবিবা। ভোরের নির্মল বাতাসে ছোট চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে। সূর্যের মৃদু আলোতে স্টেট চুলগুলো চিক চিক করছে। তানভীর চুলগুলো একসাথে করে বড় চুলের ভাঁজে নিলো। তারপর দড়ির মতো হাতে পেঁচাতে থাকলো। এখন আর উড়ছে না। কিছুক্ষন পর লাবিবাকে বললো, ‘ ঠিক আছো?’
‘ উহু। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সত্যি করে বলুন তো সত্যিই আপনার বুকে ব্যাথা নেই?’
‘ আপাতত নেই। কারণ ব্যাথার মেডিসিন এই মুহূর্তে আমার বুকে মিশে আছে। ‘
‘ এতো কেনো ভালোবাসেন আমায়? ‘
‘ আমার রাণী তুমি, ফুটন্ত লাল গোলাপ। যৌবন শেষ হয়ে গেলেও আমার নিকট তুমি প্রেমিকের ডায়েরীর ভাঁজে যত্নে রাখা শুষ্ক পাপড়ি গুলোর মতোই মূল্যবান থেকে যাবে। তোমার স্থান আমার হৃদয়মহলে। প্রতিটি কোণায় আজীবন তোমার বিচরণ। ‘
লাবিবা মুখ তুলে তাকালো। চোখে চোখ রেখে মৃদু হেসে গালে ঠোট ছুঁইয়ে দিলো। ঘাড়ে দু হাত আবদ্ধ করলো।
‘ ঘুমান নি আপনি না? ‘
‘ উঁহু। ‘
‘ কফি খাবেন? বানিয়ে আনি?’
‘ আমার অন্য কিছু চাই । ‘
‘ চা?’
তানভীর দুষ্টু হাসলো। নাকে নাক ঘষতেই লাবিবার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো । তানভীরের বুকে লজ্জায় নুইয়ে পড়লো। মৃদু স্বরে বললো, ‘ সকাল হয়ে গেছে তো। ‘
তানভীর কোমড় জড়িয়ে লাবিবাকে উপরের দিকে তুলে নিলো। সচ্ছ কাঁচের দরজায় পর্দা টেনে দিয়ে লাবিবাকে বিছানায় ছুড়ে ফেললো। এক অজানা শিহরণে লাবিবা মৃদু কাঁপতে লাগলো। নগ্ন বুকের নিচে লাবিবাকে ফেলে যেনো নিজের সাথে পিষে ফেলতে চাইলো। অত্যাচারিত থুতনি ফের অত্যাচারিত হলো। মাতাল করা ভয়েজে বললো,
‘ জান! আমি ভীষণ তৃষ্ণার্ত। ‘

দিনটা লাবিবার জন্য ঈদের মতো। সমস্ত সুখ যেনো তানভীর তার পায়ের কাছে ঠেলে দিলো। লাবিবাকে কাছ ছাড়া করলো না। জুম্মার নামাজ পড়েই লাবিবাকে নিয়ে ছাদে এসে বসলো। ছাদে বড় ছাতার নিচে গোল করে বসার জায়গা করা আছে। লাবিবার চক্করে পড়ে বাড়ির সবাইকে ছাদেই লাঞ্চ করতে হলো। ফিরোজ খান জানালেন অনেক দিন পর ছাদে এলেন। দুপুরটা খুব ভালো কাটলো। খাওয়া শেষ হলেও লাবিবার মধ্যে নামার কোনো ইচ্ছা দেখা গেলো না। ছাদ খালি করে সবাই একে একে চলে গেলো। লাবিবা হাতের টিস্যু ফেলে দিয়ে তানভীরের কোলে বসে গলা জড়িয়ে ধরলো। তানভীর জিজ্ঞেস করল, ‘ গরম লাগছে না?’
‘ উহু। আমার গরম কম। ঠান্ডা বেশি। প্রাকৃতিক বাতাসে বসতে দারুন লাগছে তাইনা?’
তানভীর গায়ের শার্ট খুলে ফেললো। তার গরম লাগছে। লাবিবা একটু সরে বসতে চাইলো কিন্তু তানভীর তা হতে দিলে তো? চেপে ধরলো নিজের সাথে। একেবারে মিশিয়ে নিলো।
‘ এখন গরম লাগছে না? ‘
‘ না। অল্পসিদ্ধ লাগছে। খাওয়ার অযোগ্য। দরকাচাঁ। ‘
তানভীরের কথা লাবিবা বুঝলো না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। তানভীর মাথা ঝাকালো। কপালে ঠুকে দিয়ে লাবিবাকে বললো ‘ টিউবলাইট ‘ । লাবিবা প্রতিবাদ জানালো, ‘ একদম না। ছোট্ট ছোট্ট কথা না বলে পুরো লাইন বললেই তো বুঝে যাই। কথা বলতে কি ট্যাক্স লাগে। ‘
‘ আমার লাগে। ট্যাক্স দাও পুরোটা সিদ্ধ করে দিবো। ‘
‘ দেশে টাকার বড্ড অভাব। ‘
‘ সুন্দরী নারীর অভাব নেই। চুমু দাও। ‘

জবেদা তানভীরকে ডাকতে এসেছিলো। বেচারা চোখের সামনে এমন কিছু দেখবে ধারণা করেনি। আচমকাই চিৎকার করে উঠলো। লাবিবা এক লাফে কোল থেকে উঠে দাঁড়ালো । তানভীর ঘাড় ফিরিয়ে জবেদার দিকে ছোট ছোট চোখে তাকালো। রোমান্সে ডিস্টার্বনেস তানভীরের মোটেই পছন্দ না। বিরক্তি নিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘ এইভাবে মরা চিৎকার দিলে কেনো? জীবনে কোনো দিন সাফের আঙ্কেলের কোলে উঠোনি? আশ্চার্য! ‘
জবেদা ভিতু চোখে তানভীরের দিকে তাকালো। ফিরোজ খানের ড্রাইভার সাফেরের সাথে যে তার চক্কর চলছে একথা তানভীর কিভাবে জানলো? তাহলে কি সবাই জেনে গেলো? সর্বনাশ!
‘ ওভাবে দাড়িয়ে আছো কেনো? বাড়িতে দু দুটো বউ এসেছে। মনে রেখো। চলা ফেরা সাবধানে। ‘
জবেদা মাথা ঝাকালো। মিনমিনিয়ে জানতে চাইলো,
‘ ছোটভাই জান আপনে কেমনে জানলেন?’
‘ আমার চোখে কিছু হাইড থাকেনা। পরের হাজব্যান্ড এর দিকে নজর দেওয়া বন্ধ করো। লোকটার সংসার আছে। তোমার সাথে যা হয়েছে অন্য একটা মহিলার সাথে যেনো তা না হয়। কেনো এসেছিলে? ‘
জবেদা সাথে সাথে উত্তর দিতে পারলো না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখের জলে নাকের জলে একেকার করতে লাগলো। তানভীর ধমকে দিতেই চমকে উঠলো। বললো,’ বড় সাহেব ডাকে। ‘
তানভীর লাবিবাকে নিয়ে ছাদ থেকে চলে আসলো। লাবিবার হাত মুঠোয় নিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে এগুলো। আড়চোখে তাকাতেই খেয়ালে এলো লাবিবা গাল ফুলিয়ে রেখেছে। তানভীর হাত ছেড়ে বাহুতে জড়িয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘ কি হয়েছে? বিদেশী টমেটো আমার পছন্দ না। দেশী টমেটোই ঠিক আছে। ‘
‘ আপনি বাড়ির সবার সামনেই এভাবে উদোম গায়ে থাকেন?’
‘ হুম। তো কি হয়েছে? বাড়িই তো। ‘
‘ বাড়িতে জবেদা আপু,এখন আপনার নতুন ভাবীও আছে। আপনি আর নির্লজ্জ মতো শার্টলেস থাকবেন না। না চাইতেও কখনো কখনো মানুষের নজর লেগে যায়। ‘
‘ সেজন্যই তো বিয়ে করে নজরফোটা আনলাম যাতে কেউ আর নজর না লাগাতে পারে। তুমিই আমার নজরফোটা। ‘
লাবিবা কথায় ভুললো না। কনুইয়ে রাখা শার্টটা নিজেই পড়িয়ে দিলো। শার্টলেস তানভীর কে দেখে সে নিজেই তো সিডিউস হয়ে যায় ‌‌। কেউ নজর না লাগাক লজ্জা পাওয়া তো বাদ যাবে না। তার মধ্যে এগিয়ে লজ্জার গোডাউন রোজী।

তানভীর আসতেই কিছু বাক বিতন্ড কানে গেলো। বসতেই ফিরোজ খান জানালো তামিম ব্যবসায় বসবে। অতি শীঘ্রই তামিম গোল্ডের বিসনেসের দায়িত্ব নিতে চায়। এতোদিন এই ব্যবসা তানভীরের আয়ত্বে ছিলো ‌ । সে যেনো তামিমকে সবটা বুঝিয়ে দেয়। সোহানা দাবী জানালো আগে তার ছেলে হানিমুন থেকে ফিরে আসবে তারপর এসব ব্যবসা ট্যাবসাতে ঢুকবে তার আগে নয়। কিন্তু হানিমুন নিয়ে তামিমের কোনো মতামত নেই। ব্যবসার ক্ষেত্রে একটাই উত্তর পাপা যা বলে তাই।
তানভীর তাদের বাক বিতন্ডে উত্তর‌ করলো না। বরং তামিমের দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকালো যে তামিম একবার চোখে চোখ রেখেই চোখ ঘুরিয়ে নিলো। দ্বিতীয় বার আর তাকালো না। তানভীর চট করে লাবিবার দিকে তাকালো। ফের রোজীর দিকে দৃষ্টি ঘুরালো। মাথাতে একটা কথাই এলো,’ এই মেয়েটা এমন মরে যাচ্ছে কেনো?’ রোজীকে কখনো হাসতে দেখেনি তানভীর। মায়াবী একটা মুখ। এই মুখে হাসি থাকলে বেশ মানাতো। প্রান্তবন্ত দেখাতো তার রাণীর মতো।
‘ ভাবীর কি মতামত? ‘
হুট করে রোজীকে প্রশ্ন করাতে রোজী চমকে গেলো। সকলের দৃষ্টি রোজীতে আটকালো। রোজী আমতা আমতা করে বললো, ‘ আমি আবার কি বলবো?’ সোহানার দিকে চোখ পড়তেই ইশারায় সোহানা তার কথাতে মত দিতে বললো। রোজী অনেক চেষ্টা করেও বলতে পারলো না। কি বলবে? শ্বশুড় দেবরকে বলবে স্বামীর ব্যবসায় বসা পরে আগে আমাদের হানিমুন? কি লজ্জা জনক ব্যাপার। রোজীর প্রতি সোহানা বিরক্ত হলো। মেয়েটাকে তার বিশ্বাস হতে চায়না। অক্ষম মেয়ে একটা। আজ পর্যন্ত একদিন ও দেখলো না সকালে গোছল সেড়েছে। সংসার ভাঙা ছেলে ফের সংসারে না বসলে বউয়ের প্রতি যত্নশীল না হলে কি ভবিষ্যত হবে ছেলের? মায়ের যে কি চিন্তা তা মা ই জানে। কি হবে এতো সুন্দরী হয়ে যদি এতোদিনেও স্বামীকে বশ না করতে পারে? কি কপাল সোহানার! অনান্য শ্বাশুড়ি চায় ছেলেকে বউয়ের আঁচলের নিচ থেকে বের করতে আর সে এই বয়সে চিন্তায় চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে ছেলেকে বউ আঁচলে বাঁধতে পারে না কেনো সেজন্য। বড় ছেলের ঘরের নাতী নাতনির মুখ দেখা তার হবে কিনা কে জানে? তার ছেলের ভবিষ্যত কিভাবে আসবে? সোহানার মনে হয় এই মুহূর্তে মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথায় ছিড়ে যাচ্ছে। বাড়ির এক বউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ম্যানম্যান করছে আরেক বউ বেশিক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতেই পারলোনা। তার পাশে বসে আছে। সোহানা কপালে হাত দিতেই লাবিবা লক্ষ্য করলো। উপস্থিত বর্গের সামনে কোনো বাক্য ব্যয় করলোনা। সোহানার হাত সরিয়ে দিয়ে নিজেই কপালে ম্যাসাজ করতে লাগলো।
তানভীর বললো, ‘ আগে হানিমুন থেকে ঘুরে আসো ভাবী। কাজের চক্করে পরে কবে সময় পাওয়া যাবে সে ঠিক নেই। ব্যবসা, ডাক্তারি একসাথে ট্যাকেল দেওয়া সহজ নয় ‌। দেশেই কোথাও ঘুরে আসো। এখন এবরড যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ‘
রোজী মাথা নাড়ালো। চোখাচোখি হলো তামিমের সাথে। সিদ্ধান্ত সেটাই নেওয়া হলো। সোহানা নিজে ঠিক করলো হানিমুন প্লেস। শ্রীমঙ্গলে রিসোর্ট বুক করলো। তার চেষ্টার কমতি নেই। হানিমুনে পাঠালে যদি তাদের মধ্যে সবটা ঠিকঠাক হয়।

বৃহষ্পতি , শুক্র, শনি তিনদিনের জন্য দুটো কটেজ বুক করা হলো। দুই ছেলেকেই পাঠাবে সে হানিমুনে। সোহানার এমন কাজে ফিরোজ খান ঘর কাঁপিয়ে হাসলো। সোহানা মিথ্যা মিথ্যা চোখ পাকালো। তারপর নিজেই হেসে দিলো। ফিরোজ বললো, ‘ মাই ডার্লি তুমি কি পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চাইছো?’
‘ তোমার মনে আছে নেতা সাহেব আমাদের একসাথে কাটানো সময় গুলোর কথা? এখান থেকে ওখানে উড়ে উড়ে বেড়াতাম দুজন মিলে। তোমার রাজনীতির স্টার্টিং এ আমাকে নিয়ে কতো ভয়! একদম চোঁখের আড়ালে রাখতে চাইতেনা। আলাদা ক্যারিয়ার না গড়ে তোমাকে নিয়েই ক্যারিয়ার গড়লাম। মহিলা সংঘের লিডার হলাম। তোমাকে ঘিরেই আমার সব। দু সন্তানের জননী হলাম। কত সুন্দর ছিলো সময় গুলো। এখনো মনে হয় এইতো কিছুদিন আগের কথা। আমাদের মধ্যে বন্ডিং বিশ্বস্ততা ভালোবাসার জোরে আমরা আজো কত সুখী। তোমার সাথে এতোগুলো বছর কাটিয়ে দিতে পেরেছি। আমরা যদি এতো ভালো সময় কাটাতে পারি আমার ছেলেরা কেনো পারবেনা? এক ছেলে ভালোবাসা হারিয়ে উম্মাদ হয়ে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিলো আরেক ছেলে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কতগুলো বছর লড়াই করে গেলো। তাদের জীবন এতো কঠিন কেনো? কেনো সহজ হয়না? তারা কেনো সুখী হবেনা বলতে পারো? ‘
সোহানা বলতে বলতেই ইমোশোনাল হয়ে পড়লো। ফিরোজ খান সোহানাকে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত হতে বললো। সোহানা আরার বলতে লাগলো,
‘ বয়স তো কম হলোনা। এই বয়সে তোমার বন্ধুরা অনেকেই আজ নেই। আল্লাহ আমাদের মেয়ে দেয়নি। দু দুটো ছেলে। তাদের সুখ দেখে যাবো না? নাতি নাতনির মুখ কি দেখা হবে না? আমি মা। আমার সন্তানদের সুখের চেয়ে বড় আমার কাছে আর কিছুই না। ‘
‘ বউ শান্ত হও। দোয়া করো সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের সন্তানরাও একদিন অনেক সুখী হবে। ‘
চলবে___
@লাবিবা তানহা এলিজা

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(৭১)
তামিম অতিরিক্ত রোগী না দেখে এগারোটা নাগাদ বাসায় ফিরলো। জবেদাকে ডিনার উপরে পাঠিয়ে দিতে বলে রুমে চলে গেলো। রুমে আজ ড্রীম লাইটের আলো জ্বালানো দেখতে পেলো না। এল ই ডি লাইটের আলোতে দিনের মতো দৃশ্যমান। তামিম রোজীকে পেলো বই হাতে বসে। নয়টার ঘরে ঘুমোতে যাওয়া রোজীকে জেগে থাকতে দেখে সামান্য অবাক হলো।
‘ ঘুমাও নি?’
রোজী তামিমের গলা পেয়ে ফিরে তাকালো। চমৎকার হেসে বই বন্ধ করলো। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
‘ আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আপনার সাথে গল্প করবো। ‘
তামিম এই কথা শুনতে একদমই প্রস্তুত ছিলো না। এতোটা চেঞ্জ? মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।
‘ ফ্রেশ হয়ে আসছি। ‘
তামিম সাওয়ার নিলো। হসপিটাল থেকে এসে সাওয়ার না নিলে গা থেকে হসপিটালের স্মেল যেতেই চায়না।

ফিরে এসে দেখে বসেই আছে তার জন্য। তার দু চোখ বন্ধ। তা দেখে তামিমের বেশ খারাপ লাগলো। জেগে থাকতে পারেনা তবুও মেয়েটা তার জন্য কষ্ট করে অপেক্ষা করছিলো। ভাবতে ভাবতেই তামিম থেমে গেলো। বিয়ের আগের কথা মনে পড়লো। তখন তো রোজী এভাবে ঘুমোতো না? এমন ও রাত গেছে সে সারারাত জেগে থাকতো। তাহলে এখন কেনো এমন হয়? রোজীর কি শরীর খারাপ? মেয়েটা তো কিছু বলেও না। তামিম গিয়ে মেডিসিন বক্স চেক করলো। নাতো। ভিটামিন ছাড়া কিছুই পেলো না। ভিটামিন ট্যাবলেট তামিম এনে দিয়েছিলো। রোজী ঠিকঠাক খায়নি দেখে বিরক্ত হলো। বিছানায় বসেই ঝিমুচ্ছে দেখে তামিম রোজীকে ঠিকঠাক শোয়ালো।‌ গাঁয়ের উপর চাদর টেনে নিজেও শুয়ে পড়লো। বেচারার গল্প হলোনা ভেবেই হেসে ফেললো। বিরক্তি রেশ কেটে চোখে ঘুম ভর করলো।

বিয়ের অনুষ্ঠানের পর এই প্রথম কলেজে আসা লাবিবার। ওড়না দিয়ে নাক অব্দি ঢেকে হাঁটছে। মোটেই আসতে চাইছিলো না। তানভীরের ধমক খেয়ে আসতে হলো। সবাই তো সব জানে। এখন কেউ যদি দেখে বলে ‘ ঐতো, ঐযে প্রিন্সিপালের বউ যাচ্ছে।’ লাবিবার লজ্জা লাগবে না? এতো লজ্জা কোথায় রাখবে ? হলোও তাই। ডিপার্টমেন্টে পা রাখতেই ফ্রেন্ডরা ঘিরে ধরেছে। ‘ আমাদের ম্যাম ইজ কামিং। ম্যাম আসুন আসুন। আপনি আসবেন আমরা ভাবতেও পারিনি। ‘
‘ কেনো?’
‘ ম্যাম আমরা ভেবেছিলাম আপনি যাস্ট এক্সাম হলে এসে এক্সামটা দিয়ে যাবেন। সরি ম্যাম। ‘
‘ ম্যাম কে? আপনি কে? লাব্বু কে?’
‘ আপনি ম্যাম। ‘
‘ ম্যাম আসুন। ‘
‘ ম্যাম আমরা নোটস করে রেখেছি। আপনি চাইলে নিতে পারেন। ‘
‘ ম্যাম কিছু খাবেন?’
লাবিবা ধমক দিলো। ‘ সেট আপ। আমি লাবিবা। তোদের দোস্ত। ‘
‘ ম্যাম শান্ত হয়ে বসুন। ‘ লাবিবা দাত কটমট করে ধপ করে বসলো। তখনি স্যার প্রবেশ করলো।
‘ কি হয়েছে? তোমরা একসাথে হয়েছো কেনো?’
স্যারের গলা পেয়ে যে যার জায়গায় তাড়াহুড়ো করে বসে পড়লো। প্রেজেন্ট নেওয়ার সময় লাবিবার অনুপস্থিতি দেখে বললো, ‘ ম্যাম আপনি অনেক দিন মিসিং। ৭৫% এটেন্ডেন্স থাকলে খুব ভালো হয়। ‘
লাবিবা মাথা ঝাকালো। স্যার তাকে সম্মান দিলো নাকি মনে মনে হাসলো বুঝতে পারলো না। ডিপার্টমেন্টের মামা থেকে শুরু করে দারোয়ান পর্যন্ত প্রত্যেকটা কর্মচারী যখন লাবিবাকে ম্যাম বলে সম্মান দিতে লাগলো তখন লাবিবা বড্ড অসহায় ফিল করলো। হুট করেই সবার সাথে ফাজলামি করা ছোট মানুষটাকে যখন এমনভাবে সম্মান দিতে থাকে তখন নিজের সাথেই নিজের প্রব্লেম ক্রিয়েট হয়। লাবিবার অবস্থা দেখে মজা নিচ্ছে উর্মিলা নাকিব। হুট করেই নাকিব চেহারা পাল্টে ফেললো। দুঃখী মানুষের এক্সপ্রেশন দিলো। ‘ আমি স্যারের একমাত্র বড় শেলক। তাদের কি উচিত না আমাকে একটু খানি সম্মান দেওয়া? স্যার না ডাকুক ভাইজান বলে তো সম্মোধন করতে পারে। তোকে বিয়ে দিয়ে কি হলো লাব্বু? যদি কোনো এডভান্টেজ ই না পাই?’
নাকিবের কথা শোনে উর্মিলা চেতে গেলো।
‘ কিহ? কত্তো বড় মিথ্যুক তুই। এডভান্টেজ খুজঁছিস? গতকালই তুই স্যারের সাথে খালি পেটে রেস্টুরেন্টে ঢুকেছিলি বের হয়ছিস ভরা পেটে সেটা কি ভুলে গেলি?’
‘ তোর জন্য যে বার্গার নিয়ে এলাম তার বেলায়?’
‘ এই তোরা থামবি? খান সাহেব কোথায়? খুঁজতে হবে।এতোদিনের পরিচিত কলেজ আমার হুট করেই অপরিচিত লাগছে। ‘
‘ নো খুজাঁখুজিঁ। আরো দুটো ক্লাস বাকি। ‘
‘ আমার পরের ক্লাস গুলো আজ করছিনা । চলে যাচ্ছি। ‘
লাবিবা উর্মিলার হাত টেনে ধরলো। ‘ কোথায় যাস? ‘
নাকিব হাসতে হাসতে বললো, ‘ কোথায় আর যাবে? ঐ রেস্টুরেন্টে। ডেট শেষ হলে আমার জন্য পার্সেল নিয়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে জাস্ট একটা কল দিস একদম হাজির। ‘
লাবিবা জানতে চাইলো, ‘ কাহিনী কি?’
‘ ঐ যে আছে না?’
‘ কি আছে?’
‘ আরে তোর কেমন জানি দেবর আকাশ। এরপর আকাশ বাতাস থেকে আমার ট্রিট পাওয়া শুরু হবে। লালে লাল বান্ধুবীদের মাল!’
‘ এতোদূর!’
উর্মিলা অপরাধী লুক দিলো। মিন মিন করে বললো,
‘ বেশী না দোস্ত। ঐ খাওয়া দাওয়া করতেছি আর কি। ‘
‘ একা একা খাওয়া ভালো না দোস্ত। চল আজ একসাথেই খাবো। ‘
উর্মিলা ভেবেছিলো লাবিবার দেবর যেহেতু লাবিবা হয়তো কোনো রিয়েক্ট করবে। তা না তার সাথে তাল মেলালো। খুশিতে আত্মহারা হয়ে লাবিবার হাত চেপে ধরলো। ‘ দোস্ত চল। অনেক ক্ষন থেকে ওয়েট করছে। আজকে মালটাকে ঢালাবো। ‘
লাবিবা উর্মিলার পেছন পেছন নাকিব ও দৌড় দিলো।

লাবিবাকে দেখে আকাশ ভাবী ভাবী বলে মুখ থেকে যেনো ফুলচন্দন পড়ছে। উর্মিলাকে কিছুক্ষনের ভুলেই গেছে। উর্মিলা কড়া চোখে আকাশের আদিক্ষ্যেতা দেখছে আর ফুঁসছে। পাশ থেকে কানের কাছে মুখ নিয়ে নাকিব পিন্চ কাটে, ‘ সুন্দরী মেয়ে দেখলে এর কি গলে যাওয়ার অভ্যাস আছে? সত্যি করে বলতো তুই জেনে শুনে পটলি কিভাবে?’
‘ কথা বলিস না। ‘
‘ এর ড্রামা তো শেষ হচ্ছে না। কিছু একটা করতে হবে। ‘
‘ ফ্রিতে ড্রামা দেখ। চুপ যা। ‘
নাকিব উর্মিলার কথা কানে তুললে তো! মাথার উপর হাত বাড়িয়ে নাড়ায়, ‘ হ্যালো ব্রাদার, আমরাও আছি। খাবার কি পাবো নাকি চলে যাবো?’
এ কি ধরনের আচরণ? লাবিবা পেছন ঘুরেই নাকিবের মুখে টিস্যু ঢুকিয়ে দিলো। মান সম্মান শেষ। এই ছেলেটা তানভীরের ক্লোজ। এর কাছেই নিজের বন্ধু খাবার চেয়ে ছ্যাড়ডামি করছে! নাকিব মুখ থেকে টিস্যু বের করে ফেললো। এমন ভাব যেনো তাকে আচমকাই এট্যাক করা হয়েছে। ‘ খাবার খেতে এসেছি,জীবাণু কেনো মুখে ঠেলে দিচ্ছিস ব্রো?’
‘ তুই ঐ টেবিলে গিয়ে বস। যত ইচ্ছা খা। সব বিল আমি দিবো। যা। এক্ষুনি যাবি। উঠ। ‘
আকাশ লাবিবাকে থামালো। ‘ আরে ভাবী কুল। নাকিব অনেক ফানি । আমি সেটা জানি। নকিব অর্ডার করো। আজকের ট্রিট আমার হচ্ছে। ভাবী স্পেশাল ট্রীট। ‘
উর্মিলার মেজাজ তুঙ্গে চলে গেলো। বসা থেকে লাফ দেবার প্রস্তুতি নিয়েছিলো। ওমনি লাবিবা হাত টেবিলের নিচে হাত চেপে ধরলো। ছেড়ে দিয়ে হাতে দুবার হাত স্পর্শ করলো। নাকিব নিজের মতে ফাস্ট ফুড অর্ডার করে খেতে লাগলো। এদিকে উর্মিলা রাগে ফুসফুস করছে। মনে মনে আকাশকের গোষ্টী উদ্ধার করছে। ভেবেছিলো মজা নিবে। এখন কদিনের ভাবী পেয়ে নিজেই মজা লুটছে। পারিপার্শ্বিক অনেক আলাপের পর আকাশ বলে, ‘ তো ভাবী বলছিলাম কি। শুনলেন ই তো বাবা অনেক স্ট্রীক পার্সন। আমার কথার ধার ধারে না। সাহসের জন্য বলতেও হয়তো পারবো না। আপনি তো জেনেই গেছেন উর্মি আর আমার সম্পর্কের কথা। আপনার বান্ধুবী আর দেবরের জন্য কিছু করবেন না?’
‘ কি করবো?’
‘ জাস্ট ভাইকে ভালো ভালো কথা বলে জানিয়ে রাখবেন। ভাইয়ের মন যেনো চেঞ্জ না হয়। বাবা যদিও কারো কথা মাথায় নেয় না। তবে ভাই বললে একবার হলেও চিন্তা করে দেখবে। ‘
আকাশের কথা শুনে উর্মিলা তো অবাক হয়ে গেলো । সে তো টাইম পাস করছিলো। আর এই ছেলে দেখি পুরো সিরিয়াস! এতোক্ষন ভাবী ভাবী বলে এজন্য মুখ থেকে মধু ঝড়ছিলো? উর্মিলা ভেবেছিলো যে ভাবে চপরচপর করে কেরেক্টারের প্রব্লেম আছে। আর এদিকে এই ছিলে তার বিয়ের প্রসেস শুরু করছে।

তানভীর লাবিবাকে কলেজে পেলো না। যেহেতু এখন সবাই তার স্ত্রী বলে জানে সেহেতু লাবিবার সব খবর ই তার কানে চলে আসে। জাফর স্যার নিজে এসে জানিয়ে গেছে এটেন্ডেন্সে লাবিবা থাকলেও ক্লাসে নেই।
ক্লাস ছেড়ে কোথায় যাবে? যেখানেই যাক জানিয়ে যাবে না? তানভীরের রাগ হতে লাগলো। ফোন চেক করলো নো কল নো টেক্সট। ছুটির পর তানভীর বেরিয়ে বাড়িতে একটা কল করলো। জবেদা ফোন তুলেছে। জিজ্ঞেস করলো, ‘ লাবিবা ফিরেছে?’
‘ না। তয় বড়বউ ফিরেছে। ‘
‘ আচ্ছা। ‘
ফোন কেটে লাবিবার নাম্বারে কল করলো। রিং হয়ে অফ হয়ে গেলো। পর পর তিনবার না পেয়ে নাকিবকে কল করলো। নাকিব জানালো,
‘ স্যার আমরা রেস্টুরেন্টে আছি।’
‘ কলেজে ফিরে আসো এক্ষুনি। ‘
‘ একটু সময় দিন স্যার। জরুরী আলোচনা চলছে। সুন্দরী উর্মিলার বিয়ে নিয়ে। ঘটক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন আপনি। ‘
নাকিবের কথা শুনে তানভীর হুট করে বিষম খেলো। নিজের সাদা গাড়িটির বনেটে চোখ ঘুরে গেলো। প্রায় বছর খানেক আগের এক ঘটনার কথা মনে পড়ে গেলো। এখানেই এমন সময়েই কালো মার্কারে গুটি গুটি অক্ষরে লাবিবার লেখা দেখতে পেয়েছিলো,
‘”আমি ভার্সিটির মেয়েদের ধরে ধরে বিয়ে দেই, ঘটক মি. তানভীর খান। ”
চলবে___
@লাবিবা তানহা এলিজা