#ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো
(১০৫ )
ভোর সকালের সদ্যস্নাত এক রুপসী ধরা দেয় তানভীরের চোখে প্রতিদিন। এই দৃশ্য মন ভরে উপভোগ করার জন্য হলেও তানভীর জেগে যাবার পরেও বিছানায় ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকে।সে এক্সারসাইজে সময় কম দিতে পারবে কিন্তু এমন দৃশ্য মিস করা যাবে না। লাবিবা টাওয়েল পেঁচিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। কেবিনেট থেকে পাট ভাঙা কচুরিপানা রঙের শাড়ি বের করে। সাথে কচুরিপানা রঙের শার্টও বের করে রাখে। যাই পড়ুক দুজনে হতে হবে ম্যাচিং ম্যাচিং। কালার অন্য হলেও কিছু একটা সিমিলিরিটি থাকতেই হবে যেনো এক দেখাতেই কেউ বুঝে নেয় দে য়্যার মোস্ট বিউটিফুল কাপল অন দ্যা ওয়ার্ল্ড। নাহলে লাবিবা মোটেও শান্তি পায় না। তানভীরের সব কিছু তার নখদর্পণে। কাপলদের সব থেকে ইম্পর্টেন্ট হলো কমফোর্টজোন। যাদের ভেতরে এই কমফোর্টজোন নেই তাদের মাঝেই লুকোচুরি খেলা চলে। তারপর জায়গা করে নেয় অবিশ্বাস। সম্পর্কের ভাঙন সৃষ্টির প্রথম ধাপ। তানভীর যদি সিগারেট ও খায় লাবিবার সামনেই খাবে। সবথেকে অপছন্দের জিনিসটা তাকে এতো ইজি করে দিয়েছে লাবিবা নিজেই। তানভীর তার লুকিয়ে চুরিয়ে সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস ছেড়েছে লাবিবা কনসিভ করার পর থেকেই। বেবীদের জন্য একদমি তা হাতে তুলে না। মাথায় যখন বেশী প্রেশার আসে একেবারে সেঁধিয়ে দেয় লাবিবার ঢেউ খেলানো কোমল নরম উদরে। বিট বিট আওয়াজ উষ্ণতায় মাথার নিউরণ গুলো ধীরে ধীরে সক্রিয় হয়ে উঠে। বউটা তার মোটা হওয়াতে সুবিধাই হয়েছে। প্রেগেন্সি টাইমে নাকি মেয়েদের সব থেকে সুন্দর লাগে! কিন্তু তানভীরের কাছে মনে হচ্ছে আফটার প্রেগেন্সি ডে বাই ডে লাবিবা সুন্দর হয়ে উঠছে । স্কিন উজ্জল হয়ে গোলাপী বর্ণ ধারণ করেছে। রুপ যেনো ঠিকরে পড়ে!
ভ্যানিটির সামনে দাঁড়িয়ে লাবিবা শাড়ি পড়ছে। বুকের উপর আঁচল টেনে আঙুলে কুঁচি দিচ্ছে। তানভীর বালিশে মুখ গুঁজে তাকিয়ে আছে। তার কাছে মনে হয় মেয়েদের এই কুঁচি করার দৃশ্য যে একবার দেখবে সে সেই কুচির ভাজেই নিজেকে সোপর্দ করবে। লাবিবার শাড়ি পড়া শেষ হলে তানভীরকে ডাকে। তানভীর চোখ দুটো বন্ধ করে নেয়। পিঠের উপর তার রুপমিনী বউয়ের ঠান্ডা শরীরের ছোঁয়া শিহরিত করে। ঘাড়ের উপর মাথা রেখে আধশোয়া হয়েছে। নরম সুরে ডাকে,
‘ এই, উঠুন না! আপনার লেট হয়ে যাচ্ছে। ‘
তানভীর নড়ে চড়ে উঠে। মুখটা বাড়াতেই লাবিবা ভেজা চুলের বাড়ি দেয়। তানভীর ভ্রু কুঁচকে ফেলে। লাবিবা মুখ টিপে হাসে।
‘ কি করছো এসব?’
‘ আমার জিনিস আমি যা ইচ্ছে তাই করবো। ‘
‘ আচ্ছা! ‘
তানভীর চট করে শাড়ির ভেতর হাত ঢুকিয়ে দেয়। লাবিবা আইঢাই করে উঠে। তানভীর হাসতে হাসতে বলে, ‘ আমার জিনিস আমি যা ইচ্ছে করবো। ‘
‘ ধ্যাত। উঠুন তো। জ্বালাবেন না একদম। ‘
‘ বউ তুমি এতো খ্যাক খ্যাক করো কেনো সব সময়? আগে কতো ভালো ছিলে। আমি ছুঁয়ে দিলেই লজ্জাবতীর ন্যায় নুইয়ে পড়তে। ‘
‘ আপনার ছোঁয়ায় আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। আগে মনে হতো এই বাঘটা আমাকে শিকার করতে এসেছে। আর এখন আমি জেনে গেছি এই বাঘের একমাত্র বাঘিনীটা হচ্ছি আমি। ‘
‘ তাই?’
‘ জি। উঠুন তো। উঠুন উঠুন। কলেজ থেকে ফিরে আমাদের সাথে বন্যা পানি দেখতে যাবেন। আপু, ফাহা, উর্মি , নাকিব আমরা সবাই মিলে বন্যা পানি দেখতে যাচ্ছি। বাচ্চাদের বাসায় রেখে যাবো। ক্লাব থেকে ত্রানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আজ এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে। ‘
‘ যাচ্ছো যাও। পানিতে ভেজো না। ‘
‘ আপনি যাবেন না? ‘
‘ না। ‘
লাবিবা নাক ফুলিয়ে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকালো। তানভীর দেখেও না দেখার ভান করে গেলো। লাবিবাকে পাত্তা দিলোনা।
বন্যার পানিতে কোমড় অব্দি ভিজে কাপড়ে লাবিবা রাত নয়টায় বাড়ি ফিরলো। তানভীর হাঁটছে তার পেছনেই। তয়্যিবা, লাবিব মাকে দেখে মাম মাম বলে দৌড়ে এলো। লাবিবা কোলে নিতে যাচ্ছিলো তার আগে তানভীর দুইহাতে দুই ছেলে মেয়েকে কোলে তোলে নেয়। কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেয় এক ধমক, ‘ যাও আগে ফ্রেশ হয়ে আসো। কত জার্মস নিয়ে এসেছো খেয়াল আছে?’
ধমকে লাবিব তয়্যিবাও চমকে উঠলো। তানভীর তৎক্ষনাত তাদের মাথা বুকের মাঝে জড়িয়ে নিলো। লাবিবা ভয় পেলো বাচ্চারা না কেঁদে উঠে। আশ্চার্য ভাবে ছিঁচকাদুনে ছেলে মেয়ে দুটো একটুও কাদঁলোনা। উল্টে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে কোলেই লাফানো শুরু করলো। তানভীর দক্ষ হাতে ব্যালেন্স রাখলো। জিজ্ঞেস করলো,
‘ আমার পাপারা খেয়েছে?’
দু’জনেই মাথা ঝুমালো। ফের গলা জড়িয়ে লাফাতে থাকলো। তানভীর তাদের নিয়ে রুমে এলো।
লাবিবা গোসল দেবার পর থেকেই কাঁপছে। তানভীর কপালে হাত রাখলো। জ্বর আসবে নিশ্চিত। জবেদাকে তাঁদের দুজনের খাবার রুমে পাঠাতে বললো। বেশির ভাগ লাবিবাকেই তানভীরকে খাইয়ে দিতে হয়। বৌ খাইয়ে দেয় আর সে জমিদারের মতো বসে বসে খায়। আজ তার উল্টোটা হলো। তানভীরকে ভাত মাখাতে দেখে লাবিবা বিছানায় মাথা সহ কম্বল মুড়ি দিয়ে বসলো। তাকে দেখতে এখন খরগোশের মতো লাগছে। লাবিব তয়্যিবাও এইভাবে বসে খেলে। তাঁদের তখন তানভীর আদর করে ডাকে বেবী বানি । আজ লাবিবাকে দেখে তার হাসি পেলো। লাবিবা জিজ্ঞেস করল, ‘ হাসেন কেনো?’
‘ তাইতো বলি আমার ছেলে মেয়েকে খরগোশের মতো লাগে কেনো? আজ জানতে পারলাম মা খরগোশের পেট থেকে হয়েছে তো? সেজন্যই খরগোশের বাচ্চার মতো লাগে। ‘
‘ দুজনের একজন ও আমার মতো হয়নি। হয়েছে আপনার মতো সাদা। ‘
‘ কেনো? আমার সাদা রং নিয়ে প্রব্লেম কি?’
‘ আপনি যদি কালো হতেন আমি হতাম পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী স্ত্রী। ‘
‘ মানে কি? তুমি সুখী নও ?’
‘ অনেক কষ্ট করে সুখী আছি। ‘
‘ আমি তোমাকে কষ্ট দেই?’
‘ না। আপনার সাদা রং আমাকে কষ্ট দেয়। ‘
‘ ঝেড়ে কাশো। ‘
‘ আপনি কি জানেন প্রতিদিন আপনাকে রেডি করিয়ে দেবার সময় আমি দোয়া দুরুদ পড়ে আপনার বুকে ফু দিই? নজর বুঝছেন? নজর। এই নজর মানুষের সংসার নষ্ট করে দেবার জন্য যথেষ্ট। আপনি কালো হলে আমার এই টেনশন টা থাকতো না যে কোন চিপা চাপা থেকে কোন নারী আমার জামাইয়ের গায়ে কুনজর দিয়ে ফেলে। পুরুষদের ড্রেসকোড যদি বোরকা নেকাপ দেওয়া হতো তাহলে তো আমার কোন টেনশন ই ছিলো না। বোরকা নেকাপ পড়িয়ে হাত ধরে নিয়ে নিয়ে ঘুরতাম। কারো নজর লাগতো না। ‘
‘ বাজে বকা শেষ?’
‘ না আরেকটু আছে।স্কিপ করে গিয়েছিলাম। ‘
‘ আর একটাও কথা না। ‘
‘ শুনুন না। পেটের ভেতর গুড়ু গুড়ু করছে। না বললে ব্যাথা যদি শুরু হয়ে যায়?’
‘ স্টপ প্লিজ। ‘
‘ আরব আমিরাতে পুরুষদের ড্রেস ঢিলেঢালা আলখাল্লা। তাতে কি? কোন লাভ আছে? সাথে নেকাপ পড়ানো উচিত ছিলোনা? চান্দের মতো সুরত টাতো দেখাই যায়। ঐটা দেখেই তো মেয়েদের মাথা নষ্ট। টিভি খুললে দেখতেই মনে চায় দেখতেই মনে চায়।’
‘ আর একটা কথা বলবি তো দুইগালে চারটা চড় খাবি। কাল থেকে তুই টিভির সামনে বসবিনা। তোর টিভি দেখা বন্ধ। ‘
‘ টিভি কি দোষ করলো?’
তানভীর অর্ধেক খেয়েছে। রাগের কারণ বাকি অর্ধেক না খেয়েই পানি ঢেলে দিলো।
সেদিন রাতে আর লাবিবা ঘুমোতে পারলো না। মুখ ফসকে যে কথা বলেছে তানভীরের রাগ মেটাতেই তার রাত, ভোর,দুপুর কেটে গেলো। কোনো ভাবেই তানভীরকে ছাড়লো। নিজে থেকেই কান ধরে উঠবস করলো। আর জীবনেও বেফাঁস কথা বার্তা বলবেনা।
তানভীর সকাল বেলা বের হবার তিন ঘন্টা পরেই লাবিবার কল আসলো। রিসিভ করতেই নাকের ফ্যাচফ্যাচানি শব্দ। তানভীর জিজ্ঞেস করলো,
‘ লাবিব আবার কি করেছে?’
‘ আপনার মেয়ে কি করেছে সেটা বলুন। কিচেনে ঢুকে ডিশ ওয়াশারের ডিশের রেক খুইয়ে বাইরে এনে ভেতরে গিয়ে বসে আছে। আমি কলেজে যাবো বলে রেডি হয়েছি।দেখি তয়্যি নেই। সারাবাড়ি খুঁজে খুঁজে শেষ। তারপর কিচেনে গিয়ে মামুনি দেখে ডিশ ওয়াশারের ভেতরে ঢুকে আছে। আমি বকা দিয়েছি আমাকে বলে,
মাম্মা ওত্তো । আমার মেয়ে কি ডিশ যে ডিশ ওয়াসারের ভেতরে গিয়ে বসে থাকবে?’
‘ আচ্ছা আচ্ছা তুমি কান্না করোনা। ওকে গোছল করিয়ে দাও। আমি প্রিন্সিপালকে ফোন করে বলে দিচ্ছি তোমার আজ কলেজে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ‘
‘ কখন আসবেন? আপনার মেয়েকে আপনি এসে সামলান। আমি আর পারবোনা। দেখো কতো ইনোসেন্ট মার্কা চেহারা বানিয়ে তাকিয়ে আছে। ‘
লাবিবা তয়্যিবার দিকে তাকিয়ে কথা বলতেই তয়্যিবা উপরের পাটি নিচের পাটি দাঁত বের করে হাসে। লাবিবার রাগ সেখানেই পড়ে যায়। বুকের ভেতর অদ্ভুত শান্তি প্রবেশ করে। পেছন থেকে ফারাহ লাবিবার গলা জড়িয়ে ধরে। তানভীর লাবিবাকে জিজ্ঞেস করে,
‘ লাবিব কোথায়?’
‘ এখানেই। ফ্লোরে বসে দুই ভাই খেলছে। ‘
‘ আচ্ছা থাকো। ওদের দেখে রাখো। আমি তাড়াতাড়ি আসবো। ‘
লাবিবা ফোন রেখে দেখে সোহানা মুচকি মুচকি হাসছে। সোহানার উপর এখন লাবিবা রাগ দেখায়।
‘ মামুনী তুমি একদম হাসবেনা। তোমার নাতিরা হাড় জ্বালিয়ে খেলো আর তোমার ছেলের কিছু যায় আসেনা। এমন ভাবে বিহেভ করে যেনো এসব নরমাল তেমন কিছুই না। ‘
সোহানা এবার উচ্চস্বরে হেসে উঠে।
‘ কার নামে অভিযোগ দিচ্ছো? যার বাচ্চা তার মতোই হয়েছে। তানভীর কি কম জ্বালিয়েছে মনে করেছো? তোমার পাপা আমি মিলে সামলাতে হিমশিম খেয়েছি।শোনো একবার হলো কি হারিয়ে গেলো। তানভীর আমার সাড়ে তিন বছরের বাচ্চা। এতো সেফ রাখি যে কখন না জানি কি ঘটায়। এমন এমন দুষ্টুমি করে যে হাত পা কেটে রক্তারক্তি অবস্থা। তাকে সামলানো বড় দায়। পুরো বাড়িতে খোঁজ করা শেষ।এতো ছোট বাচ্চা আমার কোথাও নেই। তামিমের সাথে গিয়েছে কিনা স্কুলেও খোঁজ করা হলো। তোমার মামা বাড়িতে, খালা বাড়িতেও তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো। কোথাও নেই। মুহুর্তেই খবরটা ছড়িয়ে পড়লো। সবাই খুঁজছে বাচ্চা আমার কোথাও নেই। আমি দুই দুই বার জ্ঞান হারালাম। তোমার পাপার চোখ থেকে পানি পড়ছে। তামিম ভয় পেয়ে কান্না জুড়ে দিয়েছে। ভাই মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। নিতু আর ভাবী আমাকে সামলাচ্ছে। বড় ভাগনী খবর পেয়ে ঢাকা থেকে তখনি রওনা দিয়েছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার পথে। এলাকায় লোক ছড়িয়ে গেছে। তখন আশে পাশে এতো বাড়িঘর ছিলোনা। ছিলো ধান পাট ক্ষেত। এখন তো পুরো শহর হয়ে গেছে। মাগরিবের আজানের পর খবর এলো উত্তরের মাঠে একটা বাচ্চা পাওয়া গেছে। তোমার পাপা মটর সাইকেলে করে ছুটলো। পাঁচ মিনিটেই পৌঁছে গেছে। গিয়ে দেখে ঐ ফসলি মাঠে ছোট ডোবা সামান্য বৃষ্টির পানি জমেছে। সেই ডোবায় ছেলে আমার কাঁদা মেখে ল্যাংটো হয়ে বসে আছে। বুদ্ধি করে জামা প্যান্ট ধানের শীষের উপর খুলে রেখে তারপরই নেমেছে। কাদায় মাখা ভুতের মতো ছেলেটাকে যখন ভাই কোলে করে আমার কাছে নিয়ে আসে আমার দুর্বল শরীর নিয়ে ছেলেকে তখনি পানিতে চুবাই। পরে তিনদিন আমার ছেলে জ্বরে ভুগেছে।সে তো জানেই তার বাচ্চা দুষ্টুমি করবে। তাই বাচ্চাদের দুষ্টুমি গায়ে না মাখিয়ে নরমাল থাকে। ‘
লাবিবা তানভীরের চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে ।
বউকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে তামিমের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। সুইজারল্যান্ডের টিকিট হাতে দিয়ে ভেবেছিলো রোজী এই বুঝি খুশিতে গলায় ঝুলে পড়বে। কিন্তু সে বলে বসলো ‘ দুই বাচ্চা নিয়ে এতোদূর জার্নি করা পসিবল নয়। আমরা বরং দেশেই কোথাও ছুটি কাটিয়ে আসি। ‘
আনরোমান্টিক বউ পড়েছে তামিমের কপালে। ব্যক্তি লাইফটাকে ইনজয় করতে নয় বরং খুঁজে বেড়ায় কি করলে তার সুবিধা হবে। সুবিধা ছাড়া এক পা ও নড়বেনা। তামিম রোজীকে কিছুই বললো না। না রাগ দেখালো। নিজের মতে চলতে লাগলো। যে বউ তার মন বুঝে না তার সাথে আবার কিসের কথা? রোজী বার বার তামিমের কাছাকাছি আসতে চাইলো। সরি বললো তাতেও কাজ হলোনা। রোজীর মন খারাপ করে একসময় কাঁদতে লাগলো। সোহানার কাছে গিয়ে নালিশ জানালো।
‘ বলা নাই কওয়া নাই টিকেট কেটে ফেললো। একবার আমার সাথে শেয়ার করতে পারতো। এটাতো দেশের ভেতরেই ট্যুর নয় যে বাচ্চাদের রেখে দুজনে চললাম। বাচ্চারা কান্নাকাটি করলে যখন তখন চলে আসলাম। ছোট ছোট দুটো বাচ্চা তার একবার ওদের কথা ভাববে না? রেখে যাওয়া কি সম্ভব? নিয়ে যাওয়াও তো কতো ঝামেলার। আমার সাথে রাগ করে কথা বলেনা। আমার কি কষ্ট হয়না? আমি কি মানুষ না?’
‘ বাচ্চা কখনো ঝামেলার হয়না। তাফিফ ফারাহ কে নিয়ে যাও দেখবে ওরাও কতো মজা করবে। তাফিফ টাতো এখন সব বুঝতে পারে। সুইজারল্যান্ডের ছবির মতোন একটা দেশ। আমি গিয়েছিলাম যখন তামিম আমার ক্লাভ ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষা দিলো তারপর ঘুরতে। তানভীর তখন কোলে। আমি তোমার পাপা দুই বাচ্চাকে সামলিয়েছি না? তামিম বড় হলেও তো তার হাত ছাড়তে পারিনি। আর সে কি বায়না! যা চাইতো তাই দিতে হতো। না দিলেই মাটিতে শুয়ে পড়তো। কি যে এক সমস্যা! ‘
‘ উনাকে কথা বলতে বলো মামুনি। আজ ছয়দিন হলো তোমার ছেলে আমার সাথে কথা বলেনা। তার সারপ্রাইজের মূল্য কি আমার থেকেও বেশী?’
‘ সে তোমাকে সারপ্রাইজ দিয়েছে তুমিও তাকে একটা সারপ্রাইজ দিয়ে দাও। ‘
‘ কি দিবো?’
‘ ট্রাভেলিং এর জন্য রেডি হয়ে যাও। শপিং শুরু করো। প্রয়োজনে তোমার ফ্রেন্ড কি যেনো নাম? আমিনা। আমিনাকে সাথে নাও। মেয়েটা ভীষন স্টাইলিশ আর আধুনিক। সে তোমাকে হেল্প করতে পারবে। ‘
‘ একদম না। তার ডিকশনারীতে শুধু ছোট ছোট জামা কাপড় আর ছেলেদের মতো শার্ট প্যান্ট ছাড়া কিছুই নেই। ওকে ভুলেও নেওয়া যাবেনা। উল্টো আমার থেকেও শপিং করিয়ে নিবে। ‘
রোজীর কথা শুনে সোহানা হাসে। লাবিবা রোজীকে বুদ্ধি দিলো ডিজাইনার গাউন নিতে। ফুলস্লিভ হাটু অব্দি গাউন গুলো ভীষণ মানাবে। সাথে স্কিন কালার প্যান্ট। রোজী যেহেতু ন্যাচারালি সাদা ফর্সা আর চিকন তাকে গাউন আর হুডে একদম সুইচদের মতো দেখাবে।
ফ্লাইটের আগের দিন রাতে রোজী ব্যাগ প্যাক গুছাতে লাগলো। তামিম আবাক ই হলো। তাকে অবাক করে দিয়ে রোজী তাড়া দেখালো। ‘ এই আপনার কোন শার্ট গুলো নিবো আমাকে দেখান তো। সকালেই বেরিয়ে পড়তে হবে। একদমি সময় নেই হাতে। ‘
তামিম কিছুক্ষন স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে জানতে চায়, ‘ তো তুমি যাচ্ছো? ‘
‘ তো যাবো না? এতোগুলো বছর হয়ে গেছে আমাদের হানিমুনটাই হলো না। হানিমুনে যাবার আগে বাচ্চা হয়ে গেলো। তার উপর আমার পড়াশুনা এতো দিনে শেষ হলো। এই প্রথমবার আমরা দু দুটো বাচ্চা সমেত হানিমুনে যাচ্ছি। ডাক্তার সাহেব আপনার ফিলিংস কেমন আমার সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না। ‘
তামিম ফিক করে হেসে দেয়। রোজীর নড়ে চড়ে এক্সপ্রেশন দিয়ে কথা বলার স্টাইল তাকে না হাসিয়ে পারলোনা। তানভীর লাবিবার যাওয়ার কথা থাকলেও তারা পারলোনা। তাঁরা দুজন দুজনের কাজে মহা ব্যস্ত। যতক্ষন বাসায় না থাকে বাচ্চাদের বেশির ভাগ সাবিনা, ইসমাইল ই সামলায়। ইসমাইল নাতি অন্তপ্রাণ। দিনের বেশির ভাগ সময় লাবিবের কাছে না থাকলে তিনি ভালো থাকেন না। সোহানা , রোজী তো আছেই দেখার জন্য। যদিও তারা ডিসেম্বরে মালদ্বীপ যাবে বাচ্চাদের নিয়ে ঠিক করা আছে।
সুইজারল্যান্ডে পৌঁছে দুটোদিন বাচ্চা সমেত ঘুরলো রোজী এবং তামিম। তামিমের ইউনি, ফ্ল্যাট কোথায় নিয়েছিলো, জুরিখ শহর তন্ন তন্ন করে ঘুরা শেষ। এবার তাঁদের ইচ্ছে হয়েছে ফ্রি হ্যান্ড ঘুরাঘুরি করবে। কিন্তু বাচ্চাদের কোথায় রেখে যাবে? রোজী নাকচ করে দেয়। তামিম তার এক ফ্রেন্ডের মাধ্যমে একটা ডে কেয়ারে বাচ্চাদের রেখে যাবার ব্যবস্থা করে। রোজীর ভয় হয়। সে বাচ্চাদের রেখে যেতে সাহস পায়না। আবার হাজব্যান্ড এর সাথে আলাদা সময় কাটানোর সুযোগ ও হাতছাড়া করতে চায়না। রোমান্টিক একটা জায়গায় এসে রোমান্টিক টাইম স্পেন্ড করবেনা তা কি করে হয়? আবার কখনো আসতে পারবে কিনা তারই বা কি গ্যারান্টি?ডে কেয়ারে বাচ্চাদের দিতে এসে এক সত্যের মুখোমুখি হলো রোজী।
#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(অন্তিম অংশ)_____
ফ্লোরা নির্ভেজাল অপরূপ সৌন্দর্যের এক নারী। বয়সের ভাড় তার রুপ যৌবন বিন্দুমাত্র ক্ষয় করতে সক্ষম হয়নি। একসময়কার সুন্দরী মডেল এবং অভিনেত্রী। তাকে যে না চিনবে সে সমসাময়িক সমাজ থেকে অনেক দূরে। এক দেখাতেই তাকে চিনতে অসুবিধা হলোনা রোজীর। অপছন্দের অতীতগুলো সামনে এলে যে অবস্থা হয় রোজীর এখন সেই অবস্থা। তামিমের চোখে ফ্লোরা নামক অতীত এখনো ধরা পড়েনি। সে বাচ্চাদের অন্য বাচ্চাদের সাথে মিশে খেলার জন্য বুঝিয়ে যাচ্ছে। তাফিফ বুঝমান। তাকে যা বলা হয় তাই শোনে। বড় ভাইয়ের দায়িত্বে ফারার হাত এক হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছে। ফ্লোরা রোজীকে জিজ্ঞেস করে,
‘ হ্যালো ম্যাম, হুয়ার য়্যার য়্যুর বেবী’স? ‘
রোজী উত্তর না দিয়ে দৌড়ে তামিমের কাছে যায়। তামিম ঊক পায়ের উপর ভর করে বসে বাচ্চাদের সাথে কথা বলছে। রোজী গিয়ে পেছন থেকে তামিমের দুই কাঁধের উপর হাত রাখে। তামিম জিজ্ঞেস করে,
‘ কি হয়েছে? ঐরকম দেখাচ্ছে কেনো তোমাকে?’
‘ আপনি আমাকে ভালোবাসেন?’
‘ বাসি। ‘
‘ শুধুই আমাকে ভালোবাসেন?’
‘ হ্যা। তো?’
‘ আমাকে ছেড়ে কখনো কারো কাছে যাবেন না।’
‘ যাবো না। কিন্তু এসব কেনো বলছো?’
রোজীর উত্তর দেবার প্রয়োজন পড়ে না। ফ্লোরা এসে সেখানেই দাঁড়ায়। ফ্লোরাকে দেখে তামিম একটু ধাক্কা খায় ঠিক কিন্তু নিজেকে সামলে নেয়। রোজী তামিমের গায়ের সাথে লেপ্টে দাঁড়িয়ে। তাঁদের দেখে আন্দাজ করে ফ্লোরার চোখ ভিজে আসে। জিজ্ঞেস করে,
‘ তোমার বউ?’
তামিম উঠে দাঁড়ায়। একহাতে রোজীর কাঁধ জড়িয়ে বলে, ‘ মাই হার্ট। ‘
‘ মাশাআল্লাহ। অনেক সুন্দর তোমার বউ। ‘
‘ তুমি এখানে?’
‘ ফারুকের মাধ্যমে জবটা পেয়েছি। ‘
‘ সেজন্য ই বোধ হয় ফারুক আমাকে এই ডে কেয়ারে পাঠিয়েছে।’
ফ্লোরে তাফিফ, ফারার দিকে তাকায়। ‘ তোমার বেবী?’
‘ আমাদের বেবী। ‘
ফ্লোরা অশ্রুসিক্ত চোখে ফারাহকে কোলে তুলে নেয়। তাফিফকে এক হাতে আগলে নিয়ে কপালে চুমু আঁকে।
তামিম বলে, ‘ তাফিফ, ফারাহ আন্টির কাছে থাকো কেমন? পাপা মাম্মা চকলেট আর আইসক্রিম নিয়ে আসবে। ‘
ফ্লোরা অপর হাতে তাফিফকেও কোলে তুলে নেয়। দুই বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ফ্লোরা আর নিজেকে আটকাতে পারেনা। চোখের পানি তার নাক গড়িয়ে ঠোঁটে আসে। ফ্লোরার কান্নাসিক্ত মুখ দেখে তামিম বাঁকা হাসে। ফ্লোরা বলে, ‘ হানিমুনে এসছো? যেখানে যাবে যাও। ওদের নিয়ে ভেবো না। আমি ওদের বড়মার মতো আগলে রাখবো। ‘
কথাটা শুনে তামিম খোশ মেজাজে বেরিয়ে যেতে লাগলেও রোজীর বুকে ঝড় উঠে। সে বাচ্চাদের রেখে যাবেনা। তামিম রোজীকে টেনে রাস্তায় নিয়ে আসে। গাড়িতে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়। রোজী হাউমাউ করে কান্না জুড়ে। তামিম হাসতে হাসতে বলে, ‘ বাচ্চারা ঠিক থাকবে। এতো কান্নার কি আছে?’
‘ আমার বাচ্চা। আমার স্বামী। আমি কাউকে দিবোনা। কিসের বড়মা? আমার বাচ্চাদের একটাই মা আমি।ছোটমা লাবিবা। আর কোনো মা নেই। প্রয়োজন ও নেই মায়ের। ‘
তামিমের হাসি চওড়া হলো। রোজীকে জ্বালাতে বললো, ‘ আরেকটা মা হবে। শ্বাশুড়ি মা। ‘
রোজী জামা টেনে মুখ চেপে ধরলো। তামিম বললো,
‘ এভাবে কাঁদছো কেনো? মনে হচ্ছে তোমার স্বামী আর বাচ্চাকে ফ্লোরা এসে নিয়ে গেছে। পাশেই আছি। দেশেও ফিরবো বাচ্চাদের সাথে নিয়ে। এতোটা রিয়েক্ট করার কোনো মানে নেই। ‘
রোজী কান্না থামায়। গাড়ির বাহিরে মুখ করে জানতে চায়, ‘ আপনি জানতেন তাইনা ফ্লোরা এখানে আছে?’
‘ না। ‘
‘ তাহলে এতো নরমাল কিভাবে?’
‘ তোমার কারণে। তুমি যদি আমার লাইফে না থাকতে হয়তো আমি একটু হলেও কষ্ট পেতাম। কিন্তু বর্তমানে এই বিষয়ে আমার কোনো ফিলিংস ই কাজ করছেনা।’
‘ আমাদের বাচ্চাদের কেনো উনার কাছে রেখে এলেন?’
‘ ইচ্ছে হলো। ‘
‘ আমি এসব মানবোনা। আর কেউ নেই? তার কাছেই কেনো রেখে আসতে হবে?’
‘ কারণ আমার মনে হয় এই বিদেশ ভূইয়ে আমার তোমার পর ফ্লোরার কাছেই আমাদের বাচ্চারা সব থেকে সেফ এবং কেয়ারে থাকবে। ‘
‘ সে কেনো আমার বাচ্চাদের বড় মা দাবী করবে?’
তামিম আবারো হাসে।
‘ সে যা তাই দাবী করে। আবারো বলছি এতো রিয়েষ্ট করবেনা রোজ। সবকিছু নরমালই নাও। ফ্লোরা আমার প্রথম ওয়াইফ হলেও তুমি আমার শেষ। ফ্লোরা আমাকে ভেঙেছে জন্যই তুমি গড়ার সুযোগ পেয়েছো। নয়তো কখনোই আমাকে পেতে না। তুমি আজীবন বোকাই থেকে গেলে। মন ঠিক করো। আমাকে পাশে পেয়েও তোমার মন আমার উদ্দিশ পাচ্ছে না। ‘
‘ তাকে ভুলতে পারেননি তাইনা?’
‘ মাঝে মাঝে দেখি আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে চোখের জল ফেলো। জিজ্ঞেস করলে বলো কিছুনা। আমাকে সাথে নিজের পাষ্টের তুলনা করো। কোথায় ছিলে আর কোথায় আছো কেমন লাইফ লিড করছো সেসব ভেবেই শুকরিয়া আদায় করো। কি তাই ভেবে চোখের জল ফেলো তাইনা?’
‘ আমি সেসব মনেও রাখতে চাইনা। ‘
‘ আমিও মনে রাখিনি। তোমাকে হৃদয়ে স্থান দিয়েছি। তোমার সাথে ভালো আছি। আগামীর কথা ভাবছি। সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভাবছি। কিছু কিছু সত্য আছে আমরা চাইলেও অস্বীকার করতে পারিনা। আজ তোমাকে একটা সত্য কথা বলি। ফ্লোরা স্টিল লাভস মি। ফ্লোরাকে অলওয়েজ আমি সেভ করে গেছি। তাকে সুইজারল্যান্ড এ আমিই পাঠিয়েছি। তারপর আর কোনো খোঁজ খবর রাখিনি। ফ্লোরা পবিত্র। বাকি যা জানো দেখো সব মিথ্যা। আমি চাইলেই ফ্লোরাকে আবার নিয়ে এগুতে পারতাম। আমাদের হয়তো সর্বোচ্চ সুখী কাপল বলে জানতো কিন্তু আমি সুখী হতাম না। না আমার পরিবারের কেউ সুখী হতো। যে বিশ্বাস একবার ভেঙ্গে যায় তা আর জোড়া লাগে না। ফ্লোরা মেয়েটার লোভ তাকে ধ্বংস করেছে। সাথে আমার সময়গুলোকেও। আর আমাকে সেখান থেকে ফিরিয়ে এনে ভালো রেখেছো তুমি। আমি তোমার সাথে ভালো আছি রোজ। আমার জীবনের কাঁটাযুক্ত সব থেকে সুন্দর ফুলটা তুমি। আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই।’
রোজী নিভলো। কিছুক্ষন সময় নিয়ে বললো,
‘ ফ্লোরা কাঁদছিলো। আপনার মনে কি চলছে বলুন তো?’
‘ তোমার কি মনে হয়? ফ্লোরা কেনো কাঁদছিলো?’
‘ আপনাকে আমার সাথে দেখে। ‘
‘ উহু। ফ্লোরা তোমাকে দেখে কাঁদছিলো না। তার জায়গাটা দেখে কাঁদছিলো। এই জায়গাটা তার ছিলো কিন্তু সে হারিয়ে ফেলেছে। বাচ্চাদের দেখে তার কান্না আরো বেড়েছে। কারণ তার মনে নানারকম ভাবনা চলছিলো। প্রথম ভাবনাটাই আসে আজ বাচ্চাদুটো তার ও হতে পারতো। আমার মনে হয়না ফ্লোরা বিয়ে করেছে। আর তার না কোনো বাচ্চা আছে। হতে পারে এই বয়সে বাচ্চাদের প্রতি মায়াতেই ডে কেয়ারে জব নিয়েছে। তুমি কি ভাবছো আমাদের ছেলে মেয়েরা কেমন আছে? আমি হলপ করে বলতে পারি তারা খুব যত্নে আছে। ফ্লোরা তাদের কোল থেকেই নামাচ্ছে না। কারণ সে আমাকে ভালোবাসে। তার ভালোবাসার চিহ্ন আজ তার কোলে। কোনো ভাবেই তার অযত্ন করবেনা। তুমি যেভাবে জেলাস হলে ফ্লোরা সেরকম জেলাস নয়। নদীর ঘাটে জল খেতে খেতে সে আজ এক কিনারায় পৌঁছে গেছে। হয়তো এখানেই মৃত্যু লেখা থাকবে। সুইচের মাটিতেই তাকে কবর দেওয়া হবে। দেশের কেউ তার খবর অব্দি নিবেনা। ‘
‘ মানুষটাকে কষ্ট দিয়ে কি লাভ?’
‘ আমি ওতোটাও ভালো মানুষ নই যতোটা তুমি সব সময় ভাবো। কিছু খারাপ আমার মাঝেও আছে। যার মাঝে খারাপ জিনিসটাই নেই সে মানুষ নয় অন্যকিছু। ফ্লোরা তার ভালোবাসার মানুষটির ছেলে মেয়েকে যত্ন করছে কিন্তু তার গর্ভের নয়। তুমি বুঝতে পারছো রোজ! তোমার হাজব্যান্ড কি পরিমান পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে?’
রোজী দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
‘ এমন টা নাও হতে পারে। ‘
গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে তামিমকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখে। তামিমও জড়িয়ে ধরে বলে,
‘ ভয় পেয়েছিলে?’
‘ আমার ভালোবাসা আপনি। ‘
‘ আমাকে নিয়ে কখনো মনে সংশয় রেখোনা। দেখো তোমার আর আমার মাঝে একটুও দূরত্ব নেই। কখনো সৃষ্টি হতেও দিবোনা।তুমি আমি সারাজীবন এভাবেই একে অপরের সাথে জড়িয়ে ভালোবাসার কাব্য গাথঁবো।’
লাবিবা দুই বান্ডিল পরিক্ষার খাতা দেখতে বসেছে। ফাস্ট ইয়ারের ইয়ার চেঞ্জ পরিক্ষার খাতা। চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। বাচ্চারা সাথে থাকলে দুষ্টুমি করে। সেজন্য ড্রয়িংরুমে বসেছে। লাবিব তয়্যিবার সাড়ে চার বছর চলে। আগামী বছর তাঁদের স্কুলে ভর্তি করানো হবে। দায়িত্ব বাড়বে মাম্মা পাপার। ঘরে তয়্যিবাকে খাতা আর রং পেন্সিল দিয়ে বসিয়ে এসছে। লাবিব কোথায় আছে জানা নেই লাবিবার। বিকেল বেলা তো! হয়তো নানুর ঘাড়ে চড়ে বাজার ঘুরছে আর ছাইপাশ খাচ্ছে। লাবিবা বার বার ইসমাইলকে না করে বাইরের জিনিস খাইওনা। পরে আর ছেলে ভাত খেতে চায়না। কিন্তু কে শুনে কার কথা? নাতি মুখ থেকে যেটা চাইবে সেটাই সামনে হাজির করবে। গত বার্থডে তে চল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে লাল কার কিনে দিয়েছে। নাতি তার চল্লিশ দিন ও বোধহয় চালায়নি। তাঁদের গাড়ি পুতুল এসবের জন্য ই আলাদা একটা রুম খালি করে এসব রাখা হয়েছে। লাবিবার খাতা দেখা শেষ হলো আটটা নাগাদ। বাচ্চাদের খাইয়ে ডিনারের জন্য রোজীকে হেল্প করতে হবে। রোজী রান্নাবান্নার দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নিয়েছে। তার হাতের রান্না বাড়িতে সব থেকে বেষ্ট। সবাই যখন চেটেপুটে খায় তা দেখেই রোজী আনন্দে মেতে উঠে। লাবিবা খাতাগুলো গুছিয়ে রেখে সিঁড়ি পার করে রুমে এলো। তয়্যিবাকে ডাকলো,
‘ তয়্যি মাম্মা। সী হুয়াট আর্ট মাই মাম্মা হ্যাজ ডান?’
তয়্যিবা খাতা হাতে দৌড়ে লাবিবার কাছে আসে। তয়্যিবার ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। লাবিবা ছুঁয়ে দিয়ে বলে, ‘ আমার মাম্মা সেজেছে? ‘
তয়্যিবা মাথা নাড়ে। সে সেজেছে। খাতায় একটা পুতুল এঁকেছে। পুতুল হয়নি হয়েছে অদ্ভুত কিছু। কিন্তু কালার গুলো কেমন যেনো। লাবিবা আঙুলে তুলে দেখে এগুলো তার লিপস্টিক। পার্পেল, নুড,ম্যাজেন্টা, মেরুন রেড কালার ইউজ করা। লাবিবা দৌড়ে যায় যেখানে তয়্যিবাকে বসিয়ে রেখে গিয়েছিলো। ফ্লোরে তার শখের লিপস্টিক গুলো ভেঙে পড়ে আছে। ভ্যানিটির উপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার লিপস্টিক সহ মেকাপের আই শেডো, হাইলাইট পেলেট। তয়্যিবার গালে গোলাপী ব্লাসন। লাবিবা চিৎকার করলো, ‘ কি করেছো তুমি? এসব কেনো করেছো?’
তয়্যিবা ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলো। লাবিবা নরম হয়ে মেয়েকে সামনে এনে বসালো। শাসন শুরে বললো,
‘ তোমাকে রং পেন্সিল দিয়ে গিয়েছি না? আমার লিপস্টিক কেনো নষ্ট করেছো? ‘
‘ মাম্মা দেখো বিউটিফুল কালার। আই লাইক ইট। ডু য়্যু লাইট ইট?’
‘ আমার মেকাপে কেনো হাত দিয়েছো? সব গুড়ো গুড়ো করে ছড়িয়ে ফেলেছো। ‘
‘ আমার গাল দেখো। লিপস্টিক দিছি। এখন আমি সুন্দর বেবী। মাম্মা সুন্দর। তয়্যি সুন্দর। পাপা সুন্দর। ভাইয়া সুন্দর। ‘
বলে লাফাতে লাফাতে গলা জড়িয়ে ধরে লাবিবার গালে চুমু একে দেয়। লাবিবাকে ঘায়েল করার ব্যাপারটা ছেলে মেয়ে দুটোই বাজেয়াপ্ত করেছে। লাবিবা জিজ্ঞেস করে, ‘ এসব কে শিখিয়েছে?’
‘ পাপা শিখিয়েছে। ‘ বলেই ছোট ছোট হাত দুটো মুখে চেপে ধরে হেলে দুলে হাসতে থাকে। লাবিবার রাগ গলে জল। মেয়ের সাথে সেও হাসে। কিন্তু যখনি ভ্যানিটির দিকে নজর পড়ে তখনই তার কান্না চলে আসে। মেয়েদের দুর্বলতার জিনিস হলো তাদের মেকআপ। এই মেকআপে কতভাবে সেজে গুজে লাবিবা তানভীরের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করে। বেশি বেশি ভালোবাসা কুড়োয়। অসম্ভব বায়না গুলোকেও সম্ভবে রুপান্তরিত করে। আর তার মেয়ে তার এতো বড় সর্বনাশ করলো! তানভীরকে কল করে সব রাগ তার উপর ঝাড়লো। ‘ আপনার মেয়ে আমার সব শেডের লিপস্টিক নষ্ট করেছে। মেকাপ গুলোও নষ্ট করেছে। আপনি কিছু বলেন না কেনো? আপনার বাল বাচ্চা দুটো আমাকে আর কতো জ্বালাবে?’
‘ কান্না বন্ধ করো। আগে দেখোতো লিপস্টিক খেয়েছে কিনা? মুখে দেখো হা করিয়ে। ‘
‘ লিপস্টিট ঠোঁটে লাগিয়েছে। ছড়িয়েও গেছে। খাবে কেনো?’
‘ আরে কয়েকটার টেস্ট অনেক ভালো। তুমি মুখ হা করিয়ে দেখোতো। ‘
তানভীর যা সন্দেহ করেছে তাই দেখলো। জিহবা জুড়ে লাল হয়ে আছে। লাবিবা ফোন রেখে মেয়ের মুখ ধুয়ে দিতে ছুটলো। ফিরে এসে ফোন কানে নিয়ে বললো,
‘ আপনিও কি ছোট বেলায় লিপস্টিক খেতেন? নাহলে আপনার মেয়ে খেলো কেনো?’
‘ তোমার কি ধারণা বাপে যা যা করেছে লাবিব তয়্যি ঐটাই করবে?’
‘ করবেই তো। আমার মতো লক্ষী একটাও হয় নাই। বাপের ন্যাচারেই চলে তো। ‘
তানভীর ফুস করে শ্বাস ছাড়লো।
‘ বাপে ছোট বেলায় না। বড় বেলায় লিপস্টিক খায়। আসছি। তয়্যির মা তয়্যির বাপের খাবার রেডি রেখো। ‘
‘ আরে!’
তানভীর কল কেটে দিয়েছে। লাবিবা শুকনো মুখে বসে থাকলো।
তানভীর ফিরলো দুই বক্স মেকাপ কম্বো,আলাদা আলাদা তিনটি লিপস্টিক বক্স নিয়ে। লাবিবার মন এতেই ফুরফুরে হয়ে গেলো। নেচেকুদে সে মন খারাপের ভাড় কমালো। বাচ্চারা ঘুমোলে তানভীর করিডোরে লাবিবাকে চেপে ধরল। মাতাল সুরে বললো,
‘ তয়্যির মা, তয়্যির বাপের খাবার সাজিয়েছেন তো?’
লাবিবা চোখ বন্ধ করে নিলো। রাঙা ঠোঁটে মৃদু হাসি।
তানভীর ঝুকলো।
‘ এভাবে হেসোনা। আর কতোভাবে আমাকে পাগল করবে বলোতো? বুড়ো বয়সেও এই পাগলামোর রেশ থেকে যাবে । ‘
লাবিবা এগিয়ে তানভীরের ঠোঁটে কষে একটা চুমু দিয়ে আবার দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়ালো। সর্বাঙ্গে হাসির ঝলক তুলে বললো,
‘ মনের কি আর বয়স হয় ? মন হচ্ছে চিরযৌবনধারী। সে কখনো বুড়ো হবার নয়। ‘
তাফিফ ক্যাডেট এবং ফারাহ সৃষ্টি স্কুলে পড়ছে। তয়্যিবা গার্লস এবং লাবিব জেলা স্কুলে পড়ছে। দুষ্টু হলেও তাদের ব্রেইন বড় তুখোড়। ক্লাস ফাইভের পর তানভীর তাদের ক্যাডেটে দেবার চেষ্টা করবে ভেবেছে। পাশাপাশি হওয়াতে তাদের আনা নেওয়ায় প্রব্লেম হয়না। ইসমাইল প্রথমে তয়্যিবাকে তারপর লাবিবকে নিয়ে একেবারে বাসায় ফিরে। লাবিবা বাবা মার জন্য একটা প্রাইভেট কার দিয়েছে। নাতি নাতনির জন্য দেখা যায় লাবিবা তানভীর যতক্ষন বাসায় না থাকে প্রতিদিন সাবিনা ইসমাইলকে খান বাড়িতেই থাকতে হয়। এক পলক তাদের চোখের আড়াল করা মানেই বড় সড় কান্ড ঘটাতে দেওয়া। সোহানার বাতের ব্যথা। পাজি গুলোর পেছনে একটুও দৌড়াতে পারেনা। ব্যথায় ফ্লোরেই বসে পড়ে। ইসমাইল তয়্যিবাকে নিয়ে লাবিবকে আনতে যায়। পথিমধ্যে শুনে ক্লাস ওয়ানের দুটো বাচ্চা মারামারি করছে। টিচার রা সেদিকেই ছুটছে। ইসমাইল ও দৌড় দেয়। লাবিব সেখানে আছে। এক ক্লাসমেট কে লাবিব মারতে মারতে আধমরা করে দিয়েছে। তাও যেনো তার রাগ কমেনি। টিচাররা তাকে ধরে আটকাতে পারছেনা। অসুরের শক্তি শরীরে ভর করেছে। ইসমাইল গিয়ে লাবিবকে টেনে ধরে। সবাই বলাবলি করছে এই বাচ্চা কার? মাননীয় উপমন্ত্রী ফিরোজ খানের নাতি। বাচ্চাটাকে আধমরা করে ফেলেছে। এদের নামে তো কিছু বলাও যাবেনা। ঐ বাচ্চাটাকে নিতে এসেছে তার মা। তিনি ছেলেকে ধরে কাঁদতে বসেছেন। ইসমাইল ব্যাপারটা দেখছেন। টিচারদের অনুরোধ করলেন বাবা মাকে যেনো না জানানো হয়। কিন্তু তারা বললেন অলরেডি খবর দিয়েছেন। ইসমাইলের ফোনে অনবরত কল আসছে। ইসমাইল তানভীরের ফোন রিসিভ করে,
‘ আব্বু লাবিব নাকি তার ক্লাসমেটের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে?’
‘ কে বলেছে তোমাকে? কিছুই হয়নি তেমন। আমি লাবিবকে নিয়ে বাসায় যাচ্ছি। তুমি এসোনা। ‘
‘ আব্বু আমি স্কুলের গেইটে। ‘
তানভীর এসে দেখে ছেলে তার রাগে ফুঁসছে। মাসল ফুলিয়ে বসেছে। তানভীরকে দেখে তার পাওয়ার আরো বেড়ে গেছে। তানভীর ঐ বাচ্চার মাকে শান্তনা দেয়। বোঝায় ছোট ছেলে মারামারি করেছে সে শাসন করবে। মহিলা তানভীরের উপর দিয়েই গর্জে উঠছে। বারান্দা পেরিয়ে লাবিবা দৌড়ে আসছে। একদম হাঁপিয়ে গেছে। মহিলার চোটপাট তানভীর মাথা পেতে নিলেও লাবিবা মোটেও সহ্য করেনা। ছোট বাচ্চারা মারামারি করবে, দৌড়া দৌড়ি করবে,কুস্তি খেলতে খেলতেই বড় হবে। সেজন্য এইভাবে চোটপাট দেখাবে? লাবিবার রাগ হয় তানভীরের উপর। সে কেনো মাথা পেতে নিচ্ছে? লাবিবা আহত ছেলেটাকে পরখ করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মহিলাকে বলে, অনেক কথা বলেছেন। বাচ্চারা মারামারি করতেই পারে এখন কি আপনি গার্ডিয়ান হয়ে বাচ্চাদের মতো বিহেভ করবেন? আগে কি নিয়ে মারামারি হয়েছে সেটাতো শুনবেন? আমি আমার ছেলেকে চিনি। কিছু না হলে সে কখনোই এতো রেগে যায়না। লাবিব ইসমাইলের কোল থেকেই বলে,
‘ ঠিক বলেছো মাম্মা। কতো বড় সাহস ওর? আমাকে বলে শালা? আমার বোনকে বিয়ে করতে চায়। দিবো না তোর নাকটা ফাটিয়ে। ‘
ইসমাইলের হাতের বাঁধন থেকেই লাফ দিয়ে যায় ছেলেটাকে মারতে। তানভীর ধমক দেয় লাবিবকে। লাবিব রেগে মেগে তয়্যিবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। ত্রিশ সেকেন্ড আগে জম্ম নেওয়ায় সে বড় ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করছে। তানভীর কথা বলে ব্যাপারটা মিটিয়ে নেয়। বাচ্চাদের শালা না শিখিয়ে ভালো কিছু শেখাতে বলে মহিলাকে। নিশ্চয় এই বাচ্চার সামনে কেউ শালা বলে গালিগালাজ করেছে তাই স্কুলে এসে অন্য স্টুডেন্টদের বলছে।
লাবিবা ছেলের সাথে মোটেও কথা বলছে না। আজ খাইয়েও দেয়নি। তার মতো লক্ষী একটা মেয়ের ছেলে এতো কেনো উৎশৃঙ্খল হবে? শালা নয় বলেছে তাই সে ধরে নিবে তার বোনকে বিয়ে করতে চেয়েছে? এতো বেশী বুঝতে কে বলেছে?
লাবিব একটু পর পর লাবিবার কাছে আসছে। কোলে বসছে, ঘাড়ে উঠছে, পাশে বসে জড়িয়েও ধরছে। লাবিবা শুধু তার কারবার গুলো দেখছে। লাবিবার গায়ে চুমু দিয়ে বলে, ‘ মাম্মা আই লাভ য়্যু। আই লাভ য়্যু মোর দেন পাপা। ‘
তয়্যিবা বলে, ‘ নো। আই লাভ মাম্মা মোর দ্যান পাপা। ‘
এই দুটো নিয়ে দুজনের ঝগড়া লেগে যায়। লাবিবা কান চেপে ধরে। উঠে চলে যায় ওদের থেকে। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।পিছে পিছে দুজনেই এসে দাঁড়ায়। আঁচলের দুই কোণা ধরে মনের সুখে গুন গুন করে গান শুরু করে। লাবিবার আবার কান্না চলে আসে।এইযে তার দুটো ছেলে মেয়ে একটু আগে এদের চিৎকার ঝগড়ায় সে বিছানা ছেড়ে এখানে দাঁড়িয়েছে। কেউ এখন এদের দেখে এই কথা বিশ্বাস করবে? মিনিটে মিনিটে রঙ পাল্টায় কিভাবে? এইটুকুনি বাচ্চা তার চলন বলন বড়দের মতো। স্কুলে গুন্ডামো করে আসে। মাথা ভর্তি বুদ্ধি । কথা বলে একদম স্পষ্ট। তাফিফ যেখানে এখনো র কে ল উচ্চারণ করে সেখানে এরা কথায় কথায় ইংলিশ বলছে। অন্যদের বাচ্চা কতো ভদ্র শান্ত লক্ষী। তার বাচ্চা এমন কেনো? লাবিব বলে,
‘ মাম্মা য়্যা য়্যু সেড? পাপা আসুক। আমি তোমার মন ভালো করে দিচ্ছি। ‘
লাবিবা ফিরে তাকায়।
‘ কি করবি?’
লাবিব হেসে কুটি কুটি হয়ে যায়। তয়্যিবা চিৎকার করে উঠে,’ মাম্মা বৃষ্টি। বৃষ্টি মিনস কি?’
‘ রেইন।’
দুই হাত গালে চেপে এক্সপ্রেশন দেয় ,’ ওয়াও রেইন! সো নাইস। ‘
তানভীর এসেছে লাবিবার জানা নেই। লাবিব,তয়্যিবা দু হাত টেনে লাবিবাকে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসে।
‘ মাম্মা কাম, পাপা আসছে। কাম না?’
লাবিবা গিয়ে দেখে সত্যিই তানভীর দাঁড়িয়ে আছে। তার গা পুরো ভেজা। লাবিবা চিৎকার করে উঠে, ‘ গাড়িতে ছাতা ছিলোনা? ভিজেছেন কেনো? জলদি আসুন। ‘
‘ ওরা বললো তুমি নাকি বৃষ্টিবিলাস করার জন্য কাঁদছো?’
‘ কখন কাদলাম?’
‘ তোমার ছেলে ফোন দিয়ে বললো তো। ‘
‘ লাবিব?’
ততোক্ষনে লাবিবার হাত ছেড়ে দুজনেই বৃষ্টির ভেতর দৌড় দিয়েছে। লাবিবা চিৎকার করে উঠে ফিরিয়ে আনতে যায়। তানভীর কবজি টেনে আটকায়।
‘ ভিজতে দাও। ‘
‘ আরে অসুস্থ হয়ে যাবে। সিজারের বাচ্চা দুইটা আমার।’
‘ ছোট থেকেই অভ্যাস হোক। রাজকুমার, রাজকুমারীর সাথে আমার বাচ্চাদের একদিন ভিজতে অবশ্যই ইচ্ছে হবে। তারা যদি অভ্যস্ত না হয় অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে কি তাদের কেউ স্ট্রং বলবে? বিষয়টা লজ্জাজনক হয়ে যাবেনা? বলবে পাপাস গার্ল মাম্মাস বয় অল্পতেই নুইয়ে পড়ে। তুমিও তো অভ্যাস করেছো। ‘
‘ তাই বলে রাতের বেলায়!’
‘ দেখো তারা কেমন ইনজয় করছে। ‘
লাবিবা তাঁদের দিকে তাকায়। লাইটের আলোয় বাগান সহ পুরোটাই দিনের মতো ঝকঝকা। জবা গাছ কে ঘিরে দুজনে ধরাধরি খেলছে আর লাফাচ্ছে। দেখতে দেখতেই নিচের দিকের কচি ডাল গুলোর দফারফা করে দিলো। ডাল হাতে নিয়েই খেলছে। লাবিবা তানভীরের দিকে তাকিয়ে আবার কান্না জুড়ে দিবে ভাব করলো। তানভীর বুঝতে পেরে লাবিবাকে নিয়ে বাচ্চাসহ বাড়ির এরিয়ার বাইরে চলে এলো। রাস্তায় লাইট থাকায় অসুবিধা হলোনা। ফুটপাতে জমা পানি গুলোতে তয়্যিবা লাফাতে লাগলো। লাবিবা বললো,
‘ তয়্যি কাঁদা পানিতে লাফায় না মাম্মা। পিচের উপরে উঠে আসো। ‘ লাবিব তানভীরের হাত ছেড়ে খিলখিল করে হাসতে হাসতে দৌড় দেয়। লাবিবা তানভীর দুজনেই পিছু ছুটে। ধরতে পেরে তারাও হাসে। বৃষ্টির মাঝে সেই হাসির শব্দ নিজেদের মধ্যেই থেকে যায়। তানভীর লাবিবাকে চোখ মেরে বললো,
‘ পুরোনো কিছু চোখে ভাসছে জান। ‘
লাবিবা চোখ গরম করে তাকালো। মুখে লাজুক হাসি। তানভীর বললো,
‘ লজ্জা পাচ্ছো? যখন এগ্ৰেসিভ ছিলে তখন কিন্তু বিন্দুমাত্র লজ্জাও তোমার চোখে দেখিনি। ‘
‘ কি দেখেছেন? ‘
তানভীর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললো,
‘ ফায়ার। ‘
লাবিবা অন্যদিকে মুখ ঘুরালো।লাবিব জিজ্ঞেস করলো,
‘ মাম্মা পাপা তোমাকে চুপিচুপি কি বললো?’
‘ পাপা একটা ম্যাজিক দেখাবে। ‘
তয়্যিবা বলে, ‘ আমিও দেখবো। ‘
‘ ক্লোজ য়্যুর আইস। ‘
দুজনেই চোখের উপর দুহাত রেখে চোখ বন্ধ করে।
তানভীর লাবিবা দুজনেই হাসিমুখে একে অপরের সিক্ত ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়।
‘ অপেন য়্যুর আইস। ‘
দুজনেই চোখ খুলে খিলখিল করে হেসে উঠে। লাফিয়ে পড়ে পাপা মাম্মার ঠোঁটে চুমু দেয়। লাবিবা অভিযোগ টানে, ‘ দেখেছেন আপনার বাচ্চারা কেমন দুষ্টু হয়েছে!’
লাবিব চেঞ্জ করে গিয়ে ফারাহকে খুঁজে বের করেছে। লাবিবকে দেখে ফারাহ হাতের ইশারায় ডাকে। লাবিব দৌড়ে গিয়ে বলে, ‘ মাই ডিয়ার একটা ম্যাজিক দেখবে?’
‘ কি ম্যাজিক?’
‘ ক্লোজ য়্যুর আইস। ‘
ফারাহ চোখ বন্ধ করতেই লাবিবা চুমু দিয়ে দৌড় দেয়। ফারার মোটেই মুখে চুমু দেওয়া পছন্দ নয়। সে ঠায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে থাকে।
সকাল বেলা তানভীরের পিঠের উপর লাবিব তয়্যিবা উঠে বসেছে। রাতে আর নিজেদের বেডে যায়নি। পাপা মাম্মার সাথে ঘুমোবে। দুজনের পড়নেই সাদা হাফপ্যান্ট। সাদা বেডসীট, কম্বলে ম্যাচিং হয়ে গেছে। লাবিবাকে ওয়াশরুম থেকে বেরোতে দেখেই দুজনে তানভীরের দুইপাশে ঘুমের ভান ধরে শুয়ে পড়ে। লাবিবা আজ ফজরের পর ঘুমোইনি। ঘড়িতে এখন সাড়ে পাঁচটা বাজে। দুষ্টু দুটু এতো সকালে উঠে বসে আছে লাবিবার অজানাই আছে। এতো ভোরে লাবিবার আর কাউকে ডাকতে ইচ্ছে করছেনা। উবু হয়ে ঘুমানো তানভীরের পিঠের উপর সে মাথা রাখে। ঘাড়ের নীচে আঙুলের আঁকিবুঁকি কাটতে কাটতে দুষ্টুমি মাথা চাপে। বক্স থেকে কড়া মেরুন বাই বাই লিপস তুলে নেয়। ঠোঁট রাঙিয়ে সুন্দরভাবে পর পর তানভীরের পিঠে ঠোঁটের ট্যাটু একে দেয়। লাবিব তয়্যিবা এক চোখ খুলে দেখছে তাদের মাম্মা কি করে। লাবিবা একটু সড়তেই মাথা তুলে দেখে পাপার পিঠে ট্যাটু সুন্দর দেখা যাচ্ছে। তয়্যিবা পেট উপরদিক তুলে বলে, ‘ মাম্মা আমিও। ‘
লাবিবা বিষম খেয়ে যায়। লাবিব ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে। ছেলে মেয়ে দুটোই যে জেগে আছে বুঝতে অসুবিধা হয়না। লাবিবা ঠোঁট আঙুল রাখে।
‘ হুসসসসস পাপা স্লিপিং না?’
তয়্যিবা মাথা নাড়ে। লাবিবা তয়্যিবার পিঠেও ট্যাটু একে দেয়। লাবিব পেট উপরে তুলে। তার মানে তাকেও ট্যাটু করে দাও। লাবিবা তাকেও ট্যাটু একে দেয়। তিন ট্যাটু ওয়ালাকে দেখে লাবিবা মুখ চেপে হাসে। তানভীরের ফোন নিয়ে বলে, ‘ চুপচাপ শুয়ে থাকো। নড়বেনা। পিক তুলবো। ‘
দুজনেই তানভীরের ক্লোজ হয়ে শুয়ে পড়ে। একেকটা ক্লিক করার পর ই লাফিয়ে উঠবে। ওদের পিক কেমন হলো সেটা দেখবে তারপর আবার পিক তুলতে যাবে। বার বার উঠা শুয়ায় তানভীরের ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ মেলে দেখে লাবিব শুয়ে তার পাশে পিঠে অনেক গুলো ট্যাটুর ছাপ।
‘ তুমি ছেলের পিঠ কি করেছে এগুলো? রাণী সাহেবা?’
লাবিবা ইডিটে মত্ত ছিলো। তানভীরের আওয়াজ পেয়ে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামতে যায় তার আগেই তানভীর দু পায়ের মাঝে আটকে নেয়। উঠে বসে লাবিবার কোমড় চেপে ধরে কোলে বসায়। মাম্মা ডেকে লাবিব তয়্যিবাও তানভীরের ঘাড়ের উপর উঠে বসে।
‘ কি করেছো এগুলো? দেখি?’
ফোনটা হাত থেকে নিয়ে নেয়। লাবিবা ভয় পায়। বকা ঝকা করেই নাকি? কিন্তু লাবিব ছবি দেখে হেসে দেয়। তিনজনের পিঠে সেম কারুকার্য করা হয়েছে ছবি দেখেই বুঝে। লাবিবা গাল ফুলিয়ে বলে,
‘ সুন্দর লাগছে। ‘
‘ বুঝলাম। তো আমার ইন্সটায় কি করছো?’
‘ আপলোড দিতে হবে। ‘
‘ উদোম গায়ে আপলোড দিয়ে দিবে? এইনা বলো নজর লাগবে?’
‘ লাগবে না। নজর টিকা দেখুন দুইপাশে দুটো আছে।’
পাপার রাগ নেই দেখে দু কাঁধ থেকে দুজনে পাপার গালে গাল মিশিয়ে ধরে। তানভীর একহাতে লাবিবাকে আঁকড়ে ধরে ছেলে মেয়েকে সাবধানী বাণী দেয়।
‘ পাপার গলা জড়িয়ে ধরো নয়তো পরে যাবে। ‘
তারা সাথে সাথে দুপাশ থেকে গলা জড়িয়ে ধরে।লাবিবা জিজ্ঞেস করে,
‘দিই?’
লাবিবা নয় তানভীরই তাদের ছবি ইন্সটাগ্ৰামে আপলোড করে দেয়। মুহুর্তেই লাভ রিয়েক্টের ঝড় উঠে। কমেন্টে আসে পরিচিত অপরিচিতদের হ্যাপি থাকার কিছু বাণী।
ক্যাপশনে,
‘ ট্যাটু ফ্যামিলি ।’
____ক্লিক বাই দ্যা মাস্টার অব দ্যা ফ্যামিলি। ‘
লাবিবা ঘাড় ঘুরিয়ে তানভীরের দিকে তাকিয়ে রয়। মুগ্ধ সেই দৃষ্টি। বছরের পর বছর চলে গেলো সংসারের ভালোবাসার যেনো এক ফোটা কমতি নেই। না আছে দায়িত্বের এক ফোটা গাফিলতি। তানভীর বুঝতে পেরে লাবিবার চোখে চোখ রাখে । ঐ চোখ যেনো একটা খোলা বই। তানভীরের সে বইয়ের আদ্যপান্ত মুখস্ত রয়েছে।লাবিবা জল ছল ছল চোখে হাসে। যে হাসি তানভীরকে বার বার প্রেমে পরতে বাধ্য করে। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,’কি ভাবছো রাণী সাহেবা?’ লাবিবা মাথা নাড়ায়।
‘ কতগুলো বছর কেটে গেলো খান সাহেব। এইতো সেদিন মনে হয় কলেজে ভর্তি হলাম। আমাদের বিয়ে হলো। দুজন দুজনকে পাওয়ার জন্য ভেতরে ভেতরে কতো মরিয়া ছিলাম। আমাদের সংসার হলো। কতো চড়াই উৎরাই পার করে কোল জুড়ে ফুটফুটে দুটো সন্তান এলো। তাদের হাসি কান্না দুষ্টুমির সাথে মিশে রইলাম। এখন তারা স্কুলে পড়ে। একটা সময় তারা বড় হয়ে যাবে। তাদেরও বিয়ে দিবো সংসার হবে। আমরাও বুড়ো হয়ে যাবো। আল্লাহর ডাকে পৃথিবী ছাড়বো। কথা দিন যতদিন বেঁচে আছি এভাবেই দুজন মিলে ভালোবাসার কাব্য গাথঁবো ।
‘ কথা দিলাম। তোমার ভালোবাসাই আমার শক্তি রাণী সাহেবা। আমাদের ভালোবাসা সারাজীবন অক্ষুন্ন থাকবে। ‘
এই প্রথম কোনো উপন্যাস শেষে আমার ভীষণ কান্না পেয়েছে। চোখ ছাপিয়ে গালে এসে জলের ছোয়া মিলেছে। আমার এমন বোধ হয়েছে যেনো আজ তানভীর লাবিবার মৃত্যু হলো। এখন শুধুই তাদের স্মৃতিচারণ। আমি আর কখনো নিজেকে ভেবে বাক্য গড়বো না। আমার কল্পপুরুষ খান সাহেব আর কখনো আমার কল্পনায় ধরা দিবেনা। আমার চাওয়া পাওয়া অনুভূতি মিশ্রন আর ফুটে উঠবে না। আমি শুধু স্মৃতি চারণ করবো এইনা সেই জুটি যাদের নিয়ে কাঁচা হাতে বেশ কয়েকটি ছোট বড় গল্প লিখে ফেলেছি! কতো কতো চরিত্র তাদের সাথে জুড়ে আছে কত আবেগ! এদের নিয়ে আর কোনো গল্প হবেনা।(লাবিব,ফারাহ, তাফিফ, তয়্যিবা) কে নিয়ে যারা পড়তে চান #পাজরের_টানে(২) পড়ে ফেলবেন। দুধের স্বাদ ঘোলে মিটবে।
তামিম-রোজী,ফ্লোরা, ইসমাইল-সাবিনা, কবির-রুপালী, উর্মিলা-আকাশ,নাকিব-ফাহা,ফিরোজ-সোহানা, আরো কত কত চরিত্র! দৃশ্যপট গুলো চোখে ভাসছে যেনো!এতো ভালোলাগা কেনো? আর লিখবোনা। আমার আবার কান্না পেয়ে যাচ্ছে ।
{ সমাপ্ত}