ভালোবাসার চেয়েও বেশি পর্ব-১৮+১৯

0
2607

#ভালোবাসার_চেয়েও_বেশি 💞💞
#লেখিকা- Mehruma Nurr
#পর্ব-১৮

★দেখতে দেখতে আরো একসপ্তাহ পার হয়ে গেল। এই কয়দিনে নূর একটা ব্যাপার ভালো করেই লক্ষ্য করেছে। ওর জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে এই কয়দিনে। পুরোটা না হলেও কিছুটা সুখকর হয়ে উঠেছে ওর জীবন। এর অনেকটা ক্রেডিট যায় আদিত্যের। উনি রোজ আমাকে বাসা থেকে নিয়ে যায়, আবার ভার্সিটি শেষে নামিয়ে দিয়ে যান। আর উনার শর্ত অনুযায়ী রোজ আমাকে তার সাথে খাবার খেতে হয়। কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে ওনার সাথে কাটানো সময়গুলোও মধুর লাগে এখন।রোজ রাতে ফোন দিয়ে কথা বলে।
এই কয়দিনে নূর বুঝতে পেরেছে যে,আদিত্য ওকে পছন্দ করে। আর নূরও আদিত্যের প্রতি দূর্বল হয়ে গেছে।

বাসায়ও এখন তেমন সমস্যা হয় না। ওই আন্টিটা অনেক ভালো। বাসায় আমার সাথে সময় কাটায়। আমার সব কাজে হেল্প করে। তাই এখন আর বেশি ক্লান্ত হই না। ছোট মা অবশ্য অনেকবার ওনাকে নিয়ে ঝামেলা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আন্টি কিভাবে যেন ওনাকেও পটিয়ে ফেলেন। এখন আর ছোট মা কিছু বলে না।

এসব ভাবতে ভাবতে নূর রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছিলো, আদিত্য রোজ যেখানে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করে সেখানে। আদিত্যের গাড়ির কাছে এসে, সামনে তাকাতেই কপাল কুঁচকে গেল নূরের।
গাড়িতে আদিত্যের জায়গায় অন্য একটা লোক বসে আছে। নূর একটু চমকে গেল। ভালো করে খেয়াল করে দেখলো গাড়িটা আদিত্যেরই। তাহলে লোকটা কে?আর উনার গাড়িতে কি করছে?
নূরের ভাবনার মাঝেই হঠাৎ লোকটা গাড়ি থেকে নেমে দাড়ালো।
নূর একটু ঘাবড়ে যেয়ে দুপা পিছিয়ে গেল।
লোকটা মাথা নিচু করে নম্র স্বরে বললেন।
…গুড মর্নিং ম্যাম। স্যার আপনাকে ভার্সিটি পৌঁছে দিতে বলেছেন। প্লিজ গাড়িতে বসুন।

নূর ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো।
…ক ককোন স্যার।

লোকটা আবারও একই কায়দায় বললেন।
….ম্যাম, আদিত্য স্যার বলেছেন। আপনাকে পৌঁছে দিতে।

নূর একটু অবাক হয়ে বললো।
….কেন?উনি আজ আসবেন না?

…..না স্যার আজ আসবেন না। তাই আমাকে পাঠিয়েছেন।

…..কেন? কি হয়েছে? আজ আসবেন না কেন?

…..সেটাতো বলতে পারবো না ম্যাম।আমি স্যারের ড্রাইভার। আমাকে শুধু বলা হয়েছে আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। প্লিজ ম্যাম গাড়িতে উঠে বসুন।কথাটি বলে ড্রাইভার গাড়ির পিছনের দরজা খুলে দিল।

নূরের একটু মন খারাপ হলো।প্রতিদিন আদিত্যের সাথে যাওয়ার একটা অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন একটা অপরিচিত লোকের সাথে কিভাবে যাবে। নূরের ভাবনার মাঝেই হঠাৎ ওর ফোনে একটা ম্যাসেজ আসলো। নূর ফোনটা বের করে দেখলো আদিত্যের ম্যাসেজ।

“আমি আজ আসতে পারবো না তাই ড্রাইভার পাঠিয়ে দিলাম। ওর সাথে চলে যাও।খবরদার একা যাবে না। ভার্সিটি শেষে আবার ও তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাবে। ”

নূর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর গাড়ির পিছনের সিটে উঠে বসলো। ড্রাইভার সামনে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল।
নূর বসে বসে ভাবছে, আজ কি হয়েছে?উনি আসলোনা কেন? উনি কি অসুস্থ? এসব ভেবে নূরের কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে।
একটু পরে গাড়ি ভার্সিটির সামনে এসে থামলো। নূর নেমে ক্যাম্পাসের ভেতরে চলে গেলো। ভেতরে যেয়ে দেখলো তানি একটা গাছের নিচে বসে আছে। নূর ওর কাছে এগিয়ে গেল। তানির পাশে যেয়ে চুপচাপ বসে পড়লো। তানি নূরের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো।
…..কিরে? কি হয়েছে? মুখটা এমন বাংলার পাঁচের মতো বানিয়ে রেখেছিস কেন?

নূর মাথা নাড়িয়ে বুঝালো কিছু না।
তানি আবার বললো।
….কি কিছু না? দেখতেই পাচ্ছি তোর মন খারাপ? তারপরও বলছিস কিছু না। দেখ এমনিতেই আমার মুড অফ। তারপর আবার তুইও এমন করলে কিন্তু আমার খারাপ লাগবে।

নূর তানির দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো।
….কেন? তোর আবার কি হয়েছে? তোর মন খারাপ কেন?

তানি ঠোঁট উল্টে ন্যাকা স্বরে বললো।
….কারণ আজ আবির আসেনি তাই।

নূর অবাক হয়ে বললো
…. আজ ওরাও আসেনি?

…..হুম আজ ওরা কেউই আসেনি।
তানি একটু দুষ্টু হেসে বললো।
….এক মিনিট, এক মিনিট। তারমানে তোর এইজন্য মন খারাপ। কারণ আজ আদিত্য ভাইয়া আসেনি হুম?সামথিং, সামথিং?

তানির কথায় নূর থতমত খেয়ে গেল। ও আমতা আমতা করে বললো।
….এ এএমন কিছুই না।

…..হুম, হুম। বুঝি বুঝি। কেও একজন কাওকে খুব মিস করছে।

নূর লজ্জায় লাল হয়ে গেল। মিথ্যে রাগ দেখিয়ে বললো।
….ধ্যাৎ, তুইও না।

তানি হেসে দিলো। নূর একটু কৌতুহলী হয়ে তানিকে জিজ্ঞেস করলো।
…..আচ্ছা তুই কি জানিস ওরা সবাই কেন আসেনি আজ?

…..হুম জানিতো। আবির বলেছে আমাকে।

….কি বলেছে?

তানি একটু সিরিয়াস হয়ে বললো।
….জানিস, আজ নাকি আদিত্য ভাইয়ার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী।

কথাটা শুনে নূরের বুকের ভেতর ধক্ করে উঠলো। নূর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
….উনার মা নেই?

তানি একটু অবাক হয়ে বললো।
…সেকি?তুই জানিস না?আদিত্য ভাইয়ার মাতো সেই ছোট বেলায়ই মারা গেছেন। যখন উনার বারো বছর বয়স তখন উনার মা মারা যান। আজকের দিনে উনারা সবাই আদিত্য ভাইয়ার মায়ের নামে করা বৃদ্ধ ও এতিমখানায় যায়।

তানির কথা শুনে নূরের মনের ভেতর অনেক খারাপ লাগা শুরু করলো। তার মানে আমার মতো উনারও মা নেই।

তানি আরেকটু করুন সুরে বললো।
……জানিস, আবির আমাকে বললো। আজকের দিনে নাকি, আদিত্য ভাইয়া কারোর সাথে কথা বলেন না।একদম একা একা বসে থাকেন। শুনেছি আদিত্য ভাইয়া নাকি উনার মায়ের সবচেয়ে বেশি ক্লোজ ছিল। তাই হঠাৎ করে উনার মায়ের চলে যাওয়াটা উনি মেনে নিতে পারেননি। অনেক ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলেন।

নূরের খারাপ লাগাটা আরো বেড়ে গেল।বুকের ভেতর কেমন চিনচিন ব্যাথা শুরু হলো। উনার মতো এতো স্ট্রং মানুষের ভেতরে যে এতো কষ্ট আছে তা দেখে বোঝাই যায় না।

তানি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো।
…ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। চল ক্লাসে যায়।

নূর অন্যমনস্ক হয়ে থাকায় তানির কথা শুনতে পায় না। তানি ভ্রু কুঁচকে নূরের কাঁধ ধরে হালকা ঝাকিয়ে বললো।
…কিরে?কোথায় হারিয়ে গেলি?ক্লাসে যাবি না?

নূর সম্ভূতি ফিরে পেয়ে তানির দিকে তাকিয়ে বললো।
…হুম? হ্যা চল।

————————————-

ক্লাসে বসে আছে নূর। প্রথম ক্লাস চলছে। নূরের কিছুতেই ক্লাসে মন বসছে না।মনটা ছটফট করছে। কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে। বারবার শুধু আদিত্যের কথা মনে পরছে। নাজানি কেমন আছেন উনি?এসব ভাবতে ভাবতে কোনরকমে ক্লাসটা শেষ হলো। নাহ্ আর থাকতে না পেরে প্রফেসর চলে যেতেই নূর আমতা আমতা করে তানিকে বললো।
….তানি,বলছি কি শোন না?ইয়ে মানে।

তানি ভ্রু কুঁচকে বললো।
….কি মানে মানে করছিস?যা বলবি ঠিক করে বল।

….মানে বলছি কি,চলনা আমরা ওখানে একটু যাই?

তানি ভ্রু উঁচিয়ে বললো।
…ওখানে? ওখানে কোথায়?

…..ইয়ে মানে উনার কাছে।

….উনার কাছে? এক মিনিট, তুই কি আদিত্য ভাইয়ার কথা বলছিস?

নূর মাথা ঝাকালো। মানে হ্যা।

তানি অবাক হয়ে চেয়ে রইল নূরের দিকে। যে মেয়ে আজ পর্যন্ত স্কুল কলেজ বাদ দিয়ে কোথাও যাওয়ার কথা শুনলেও ভয়ে কাঁপত।সেই নূর কিনা আজ নিজেই ক্লাস বাদ দিয়ে কোথাও যেতে চাচ্ছে। নূর যে আদিত্যের প্রতি দূর্বল হয়ে পরেছে সেটা তানি ভালোই বুঝতে পারছে। তানি দুষ্টু হেসে বললো।
…..হ্যা হ্যা তুই চাইলে তো অবশ্যই যাওয়া যায় তোর উনার কাছে। তবে ম্যাডাম আমরা যাবো কিভাবে। আমরা তো আর রাস্তা চিনিনা।

নূর একটু ভাবলো তারপর হঠাৎ বললো।
….একটা উপায় আছে।

তানি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।
…কি?

নূর তানির হাত ধরে বললো।
….তুই চল আমার সাথে তারপর বলছি।

নূর তানির হাত ধরে বাইরে নিয়ে এলো।তারপর আদিত্যের গাড়ির কাছে এসে দাড়ালো। ওদের আসা দেখে আদিত্যের ড্রাইভার তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে দাড়িয়ে নূরের সামনে মাথা নিচু করে বললো।
….ম্যাম আপনি কি এখন বাসায় যাবেন? চলুন নামিয়ে দিয়ে আসি।

নূর বললো।
….আমরা এখন বাসায় যাবো না। আপনি কি আপনার স্যারের এতিমখানা চিনেন?

ড্রাইভার মাথা বললো।
….জ্বি ম্যাম, চিনি।

….তাহলে আমাদের একটু ওখানে নিয়ে যেতে পারবেন?

…জ্বি অবশ্যই। চলুন।

নূর মুচকি হেসে তানিকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। তানি এতক্ষণ সব হা করে দেখছিল। ও র সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। গাড়িতে বসে তানি নূরকে জিজ্ঞেস করে।
….নূর এসব কি? আর এই লোকটাই বা কে?আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না।

নূর তানিকে সবটা খুলে বললো। তানি সবটা শুনে দুষ্টু হেসে বললো।
….বাব্বাহ্ তলে তলে এতোকিছু? আর আমি জানিই না।

নূর নিচের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসে।

—————————————-

গাড়িটা এতিমখানার সামনে এসে থামলো। ড্রাইভার বলে উঠলো।
….ম্যাম আমরা চলে এসেছি।

নূর আর তানি গাড়ি থেকে নেমে দাড়ালো। নূরের কেমন যেন বুকের ভেতর দুরুদুরু করছে। এখানে চলেতো এসেছে, কিন্তু এখন ভেতরে যেতে ভয় লাগছে। যদি উনি আমাকে এখানে দেখে রাগ করেন?তানি নূরের দিকে তাকিয়ে বললো।
….কিরে? এখানে দাঁড়িয়ে পরলি কেন? চল ভিতরে?

নূর তানির দিকে তাকিয়ে বললো।
…যদি উনি রাগ করেন?

…..আরে রাগ কেন করবে?এতো না ভেবে ভেতরে চল।

নূর মাথা ঝাকিয়ে সায় দিল। তারপর তানির হাত ধরে ভেতরে ঢুকলো।

ভেতরে ঢুকে নূর চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। এতিমখানাটা অনেক বড়ো। চারপাশে সুন্দর গাছগাছালিতে ভরা। জায়গায় জায়গায় বাচ্চারা খেলাধুলা করছে। আবার কিছু বয়স্ক লোকও এখানে ওখানে বসে আছে। নূরের কাছে জায়গাটা অনেক ভালো লাগছে। নূর আর তানি দেখতে পেল। আবির আর তাসির এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। নূর আর তানি ওদের দিকে এগিয়ে গেল।

ওদের দেখে আবির আর তাসির খানিকটা অবাক হয়।আবির তানির দিকে তাকিয়ে বললো।
…তোমরা এখানে? তুমিতো বলোনি যে তোমরা এখানে আসবে?

নূর একটু অস্বস্তিতে পরে গেলো। ভাবছে এখন কি বলবে? ও মাথা নিচু করে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। তানি মুচকি হেসে বললো।
….আসলে আগে কোনো প্লান ছিলোনা। হঠাৎ করে ইচ্ছে হলো তাই তোমাদের সাথে দেখা করতে চলে এলাম।তারপর তানি আবিরকে চোখ দিয়ে নূরের দিকে ইশারা করে বুঝালো আসল ব্যাপারটা।আবিরও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মুচকি হাসলো।

নূর শুধু এদিক ওদিক তাকিয়ে আদিত্যকে খুঁজছে। তাসির বিষয়টা বুঝতে পেরে নূরের উদ্দেশ্যে বললো।
….আদিত্য ওই দিকে আছে। তুমি চাইলে যেতে পারো। হাত উঠিয়ে আঙুল দিয়ে এতিমখানার পিছনের দিকে ইশারা করে দেখালো তাসির।

নূর একটু দ্বিধায় পরে গেলো। যাবে কি যাবে না তাই ভাবছে। তানি বললো।
….তুই যা দেখা করে আয়।আমি এখানেই আছি চিন্তা করিস না।

নূর মাথা ঝাকিয়ে তাসিরের ইশারা অনুযায়ী সেই দিকে হাটা শুরু করলো।

নূর যেতেই আবির চিন্তিত স্বরে তাসিরকে বললো।
….তুই যে নূরকে আদিত্যের কাছে পাঠালি।যদি আদিত্য রেগে যায়? তুই তো জানিস ও আজকের দিনে কারোর সাথেই তেমন কথা বলে না। ইভেন আমাদের সাথেও না।

তাসির আবিরকে আস্বস্ত করে বললো।
….তুই চিন্তা করিস না। দেখবি নূরই পারবে ওকে আজকের দিনে স্বাভাবিক করতে।
তাসিরের কথায় আবিরও ভরসা পেল।তাই ও আর কিছু বললো না।

নূর হাটতে হাটতে এতিমখানার পেছনের সাইটে চলে এলো। নূর দুর থেকে দেখতে পেল আদিত্যকে।একটা সাদা পাঞ্জাবি পরে একটা ব্রেঞ্চের ওপর দুহাত দুই দিকে রেখে মাথা আকাশের দিকে করে চোখ বন্ধ করে বসে আছে।

নূরের একটু ভয় লাগছে আদিত্যের কাছে যেতে। যদি উনি আমাকে এখানে দেখে রেগে যায়? নূর মনে একটু সাহস জুগিয়ে এগিয়ে গেল আদিত্যের কাছে।
নূর আদিত্যর কাছে এসে দেখলো। আদিত্য এখনো চোখ বন্ধ করে উপরের দিকে মুখ করে বসে আছে। নূর আস্তে করে আদিত্যের পাশে বসে পরলো।

আদিত্য বুঝতে পারলো ওর পাশে কেউ বসেছে। আদিত্য চরম বিরক্ত হয়ে গেলো। আজকের এই দিনটাতে ও একা থাকতে চায় এটা জানা সত্বেও কে আসলো ওকে ডিস্টার্ব করতে? সেটা দেখার জন্য আদিত্য বিরক্তি নিয়ে পাশে তাকালো।পাশে তাকাতেই আদিত্য একটা ঝটকা খেল।আদিত্য অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো নূরের দিকে।

আদিত্যকে দেখে নূর চমকে গেল। চেহারাটা কেমন মলিন হয়ে গেছে।চুলগুলো কেমন উস্ক খুস্ক হয়ে আছে। চোখ দুটোও কেমন লাল হয়ে গেছে।

কিছুক্ষণ পর আদিত্য নূরের দিক থেকে মাথা ঘুড়িয়ে সামনে তাকালো। নূরের দিকে না তাকিয়েই গম্ভীর কণ্ঠে বললো।
….তুমি এখানে কি করছো? তোমার এখানে আসা ঠিক হয়নি।

নূরের মনে মনে ভয় লাগলেও উপরে উপরে সাহস দেখিয়ে বললো।
….কি করছি মানে?রোজ যেটা করি সেটাই করতে এসেছি।আমার শাস্তি ভোগ করতে এসেছি। দেখুন আমি কখনো কথার বরখেলাপ করিনা। আমি আপনাকে কথা দিয়েছি যে রোজ আপনাকে একটা করে চুমু দিবো।তাই আজ যখন আপনি ভার্সিটি আসেননি আমিই চলে এলাম আমার কথা রাখতে। নাহলে আপনিই হয়তো কাল আবার বলবেন আমি আমার কথা রাখিনি। হয়তো আবার নতুন কোনো শাস্তিও দিতে পারেন। তাই আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না।
একদমে কথাগুলো বলে থামলো নূর। এতক্ষণ কি বলেছে ও নিজেই জানেনা। নূর শুধু আদিত্যকে একটু স্বাভাবিক করার জন্য এসব কথা বলেছে।

আদিত্য নূরের কথায় অনেক অবাক হলো। নূরকে এর আগে এতো কথা বলতে কখনো দেখিনি। নূর যে ওর মাইন্ড ডাইভার্ট করার জন্য এসব কথা বলেছে তা ও ভালোই বুঝতে পারছে। আদিত্য আবারও নূরের না তাকিয়েই গম্ভীর কণ্ঠে বললো।
…..যাই বলোনা কেন তোমার এখানে আসা উচিত হয় নি।আজকের দিনে আমার মন মেজাজ ঠিক থাকেনা। তোমাকে উল্টা পাল্টা কিছু বলে দিতে পারি। তখন তোমারই খারাপ লাগবে।তাই বলছি তুমি চলে যাও প্লিজ।আর তোমাকে এখানকার কথা কে বললো?

আদিত্যের কথায় নূর মনে মনে প্রচুর ভয় পেয়ে যায়। তবু্ও ওখান থেকে উঠে না।ওখানেই বসে থাকে।

আদিত্য আবার বলে ওঠে।
…. দেখো আমাকে কেউ সিমপ্যাথি দেখাক সেটা আমার একদম পছন্দ না। কারণ যে যতোই বলুক যে তোমার কষ্ট আমরা বুঝি। আসলে কেউই বোঝেনা।যার কষ্ট শুধু সেই বোঝে। তাই আমার এইসব অহেতুক সিমপ্যাথি খুবই বিরক্ত লাগে।

নূর আবারও একটু সাহস নিয়ে বললো।
…আমি আপনাকে কি সিমপ্যাথি দেখাবো।আপনি তাও আপনার মাকে দেখেছেন তার সাথে কতো কথা বলেছেন। তার সাথে খেলাধুলা করেছেন। তার চেহারা আপনার মনে আছে। তার শরীরের গন্ধ আপনার মনে আছে। তার সাথে জুড়ে থাকা শতশত ভালো মন্দ সব স্মৃতি আপনার মনে আছে। অথচ আমাকে দেখুন। পৃথিবীতে এসে মা জিনিসটা কি তাই চিনলাম না।তার আগেই সে চলে গেল। তাহলে আপনিই বলুন আমি কিভাবে আপনাকে সিমপ্যাথি দেখাবো। যেখানে আমিই আপনার চেয়ে বেশি হতভাগি।কথাগুলো বলতে বলতে নূরের গলা ধরে এলো।

নূরের কথা শুনে আদিত্যের বুকের ভেতর হু হু করে উঠলো। আদিত্য মায়া ভরা চোখে নূরের দিকে তাকালো। মেয়েটাতো সত্যিই বলেছে।ওর কষ্ট তো আমার চেয়েও অনেক বেশি।

আদিত্যর তাকানো দেখে নূর জোরপূর্বক একটা হাসি দিয়ে বললো।
…. সত্যি বলছি আমি কোনো কথা বলবো না। শুধু চুপচাপ এখানে বসে থাকবো।আই প্রমিজ।

আদিত্য আর না বলতে পারলো না। মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো।তারপর আবার সামনের তাকিয়ে বসে রইলো। আদিত্য যতই মানা করুক না কেন। মনে মনে সেও চায় নূর ওর পাশে থাকুক। নূর পাশে থাকলে ওর তখন শান্তি শান্তি লাগে।

কিছুক্ষণ দুজনেই ওভাবে চুপচাপ বসে রইলো। হঠাৎ আদিত্য নূরের দিকে তাকিয়ে বললো।
…নূর তুমি যদি কিছু মনে না করো আমি কি একটু তোমার পায়ের ওপর মাথা রেখে শুতে পারি?

আদিত্যের এমন কথা শুনে নূর একটু লজ্জায় পরে গেলো। ও কি বলবে বুঝতে পারছে না। নূর মাথা নিচের দিকে করে ঝাকালো। মানে সে রাজি।

আদিত্য নূরের পায়ের ওপর মাথা দিয়ে শুয়ে পরলো। পা দুটো ব্রেঞ্চের ওপর গুটিয়ে কাত হয়ে সামনের দিকে মুখ করে শুয়ে পরলো।
আদিত্য শুতেই নূরের সারা শরীর কেঁপে উঠলো।এই প্রথম কোনো ছেলে নূরের এতো কাছে এসেছে। সারা শরীরে অদ্ভুত এক অনূভুতি ছড়িয়ে পরলো।এমন অনুভূতি আগে কখনো হয়নি। নূর ওড়নার কোণা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে বসে রইলো।

আদিত্য বললো।
…মাথাটা অনেক ব্যাথা করছে। একটু চুলগুলো টেনে দিবে প্লিজ?

নূর আরো লজ্জায় পরে গেলো। কাঁপা কাঁপা হাতটা উঠিয়ে আদিত্যের মাথায় রাখলো।তারপর আস্তে আস্তে চুলগুলো টেনে দিল।নূর খেয়াল করলো আদিত্যের চুল কি সুন্দর সফট আর সিল্কি। ইচ্ছে করছে শুধু হাতাতেই থাকি।

আদিত্যরও এখন অনেক ভালো লাগছে। আদিত্য আবার বলে উঠলো।
…জানো?ছোট বেলায় আমি এভাবে আমার মায়ের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকতাম আর মা আমাকে এভাবে চুল টেনে দিতো।

নূর আগ্রহ নিয়ে বললো।
…তাই? আরো বলুন না আপনার মায়ের সম্পর্কে।

আদিত্য নূরের মুখের দিকে চেয়ে বললো।
….তুমি সত্যিই শুনতে চাও আমার মার সম্পর্কে?

নূর মাথা ঝাকিয়ে বললো।
….হুম। বলুন না।আমার মায়েদের কথা শুনতে খুব ভালো লাগে।

আদিত্য মুচকি হেসে আবার সামনের দিকে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বললো।
…ঠিক আছে। তারপর আদিত্য ওর মায়ের অনেক বলতে শুরু করলো। কথা বলতে বলতে আদিত্যের মনটা অনেক ফুরফুরে হয়ে গেলো। কথা বলতে বলতে মাঝে মধ্যে আবার ওরা হেসেও দিচ্ছে।

এদিকে দূর থেকে আবির তাসির তানি এবং সানা আর ওর বাবাও এগুলো দেখছে। সবার ঠোটেই একটা আনন্দের হাসি। আদিত্যকে এভাবে দেখে আদিত্যের বাবার চোখে খুশিতে পানি চলে এলো। সানা ওর বাবাকে জরিয়ে ধরে বললো।
….দেখেছো বাবা বলেছিলাম না ভাইয়ার জীবনেও কেউ না কেউ আসবে।যে ভাইয়ার জীবনটা রঙিন করে তুলবে।

সানার বাবাও মাথা ঝাকিয়ে বললো।
….হ্যারে মা।এখন আমিও নিশ্চিন্ত হয়ে গেলাম ওকে নিয়ে। ওর জীবনটা সাজানোর জন্য কেউ চলে এসেছে।
তারপর ওরা সবাই ওখান থেকে চলে গেল।

একটু পরে আদিত্য নূরের কোল থেকে উঠে বসে বললো।
….চলো তোমাকে আমার পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।

নূর মাথা ঝাকিয়ে বললো।
….ঠিক আছে চলুন।

নূর উঠে যেতে নিতেই আদিত্য নূরের হাত ধরে বলে উঠলো।
….যাওয়ার আগে তোমার কাজটাতো করে যাও। যেটার জন্য তুমি এসেছ।

নূর লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো।

আদিত্য বললো।
….তোমাকে আর একটা শেষ রিকুয়েষ্ট করবো। রাখবে প্লিজ?

নূর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।
…কি?

….আজকের চুমুটা আমার কপালে দিবে প্লিজ? মা সবসময় আমার কপালে চুমু দিতো।

নূর মাথা নিচু করে ঝাকালো। মানে সে রাজি।

আদিত্য খুশী হয়ে চোখ বন্ধ করে নিল।তারপর নূর আদিত্যের কপালে চুমু দিয়ে চলে গেল। আর আদিত্য বসে বসে মুচকি হাসলো।

চলবে……..

#ভালোবাসার_চেয়েও_বেশি 💞💞
#লেখিকা- Mehruma Nurr
#পর্ব-১৯

★ নূর ওখান থেকে আসতেই সানা ওর সামনে দুহাত ছড়িয়ে ওকে আটকে দিল। নূর একটু ঘাবড়ে গেল। সানা নূরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে নূরের চারিদিকে গোল গোল ঘুরতে লাগলো। যেন নূর বড়ো কোনো অপরাধী আর সানা কোনো পুলিশ। নূর বেচারিতো ভয়ে শেষ। মনে মনে ভাবছে মেয়েটা কে?আমাকে এভাবে দেখছে কেন ?আর আমার কাছে কি চায়?নূরের ভাবনার মাঝেই সানা নিজের হাতের পাঁচ আঙুলগুলো নূরের মুখের সামনে নিয়ে নাড়িয়ে নাড়িয়ে, সিআইডি সিরিয়ালের এসিপি প্রদ্যিয়ুমানের মতো করে বললো।
….”কুছ তো গরবর হে দয়া”।

নূর কনফিউজ হয়ে চেয়ে রইল সানার দিকে। সানার কথা ও কিছুই বোঝেনি। সানা আবার মাথাটা উপর নিচে হালকা ঝাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো।
….হুউউম।তাহলে তুমিই সেই মেয়ে, যে আমার ভোলাভালা ভাইটাকে দিনেদুপুরে সবার সামনে চুমু দিয়ে তার ইজ্জত হরণ করেছিলে।

নূরের তো এবার কেঁদে দেয়ার মতো অবস্থা। মনে হচ্ছে এখান থেকে একছুটে পালাতে পারলে বাঁচে। কি দরকার ছিল এখানে আসার?এখানে এসেই ফেঁসে গেলাম।এখন কি করবো?

নূরের এমন ভীতু ফেস দেখে সানার প্রচুর হাসি পাচ্ছে। মনে মনে ভাবছে মেয়েটা সত্যিই খুব সহজ সরল। নাহলে কেউ নিজের থেকে ছোট কোনো মেয়েকে এভাবে কেউ ভয় পায়।সানা আবারও বললো।
….কি হলো বলো?

এতক্ষণে আদিত্য চলে আসে। নূর আর সানাকে এভাবে দেখে ওর বুঝতে বাকি থাকে না যে, সানা নূরের সাথে দুষ্টামি করছে।আদিত্য মুচকি হেসে ওদের কাছে এগিয়ে যায়। সানার কাঁধে হাত দিয়ে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো।
…..বাচ্ কর এখন পিচ্চি। নাহলে কিন্তু ও এখনি কেদে ফেলবে দেখিস।

সানা আদিত্যের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো।
…সত্যিই???

আদিত্য মাথা ঝাকিয়ে হ্যা বুঝালো। সানা আবার নূরের দিকে তাকালো। তারপর হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।

নূর বেচারি এদের কান্ড দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। এখানে কি হচ্ছে ও কিছুই বুঝতে পারছে না। বেকুবের মতো শুধু ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো।

সানা হাসতে হাসতে নূরের কাছে এসে ওর গাল দুটো টেনে দিয়ে বললো।
…অঁওওওওও,,,ইউ আর সোওও সুইট। জাস্ট লাইক স্টবেরি আইসক্রিম। আরে আমিতো শুধু মজা করছিলাম। আর তুমি সত্যি সত্যিই ভয় পেয়ে গেছ?

আদিত্য এগিয়ে এসে নূরকে বললো।
….নূর ও আমার ছোট বোন সানা।ওর কথায় কিছু মনে করোনা। ও একটু দু্ষ্টু স্বভাবের। কিন্তু মনের দিক থেকে অনেক ভালো।

আদিত্যের কথায় এতোক্ষণে নূরের জানে পানি আসলো। নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে মুচকি হেসে বললো।
….না না কিছু মনে করিনি। ইটস ওকে।
তারপর সানার দিকে তাকিয়ে বললো।
…আর হ্যা তুমিও খুব সুইট।

সানা হেসে দিয়ে নূরকে জড়িয়ে ধরে বললো।
…থ্যাংক ইউ আপু। তোমার সাথে পরিচয় হয়ে অনেক ভালো লাগলো।

নূর প্রথমে একটু অবাক হলেও পরে সেও মুচকি হেসে সানাকে জড়িয়ে ধরে। আদিত্য কান্ড দেখে মুচকি হাসছে।
এতক্ষণে আবির তাসির আর তানিও চলে আসে ওদের কাছে । আবির সানাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো।
….কিরে তোদের ভারত মিলন শেষ হলো?

আবিরের কথা শুনে সানা নূরকে ছেড়ে দিয়ে আবিরের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকায়। সানার তাকানো দেখে আবির মিথ্যে ভয় পাওয়ার ভান ধরে বলে।
….এভাবে তাকাস ক্যান?আমি ভয় পাইনা বুঝি?আমার মতো মাছুম বাচ্চাটা যদি তোর মতো ডাইনির ভয়ে মরে যায়। তাহলে আমার হবু বউটাতো বিয়ের আগেই বিধবা হয়ে যাবে তাইনা?

আবিরের কথায় সবাই হেসে দেয়।
সানার হাসি দেখে তাসিরের বুকের ভেতর আবারও সেই ধুকধুক শুরু হয়ে যায়। যেটা এখন নতুন না তাসিরের কাছে। সেই ছোটবেলা থেকেই এই পিচ্চি মেয়েটাকে দেখলেই ওর হার্টবিট বেড়ে যায়।মনের মাঝে অনূভুতিরা এসে ঘিরে ধরে। তাসির হাজার চেষ্টা করেও এই অনুভূতি থেকে মুক্তি পায়নি।এতো বছর বিদেশে থেকেও মনের ভেতর থেকে মেয়েটাকে দূর করতে পারেনি। বরং সময়ের সাথে অনুভূতি গুলো আরো গাঢ় হয়ে উঠেছে। কিন্তু তাসির কখনো কারো সামনে সানার প্রতি ওর অনুভূতি গুলো প্রকাশ হতে দেয় নি। কারণ এমনিতেই মেয়েটা ছোট, তারপর আবার প্রিয় বন্ধুর বোন।আদিত্য জানতে পারলে যদি তাসির কে ভুল বোঝে। এসব ভেবেই তাসির নিজের অনূভুতি গুলো নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে।
হঠাৎ আদিত্যের কথায় তাসিরের ভাবনায় ছেদ পরে। আদিত্য নূরকে বললো।
…চলো তোমাকে বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।

নূর মাথা ঝাকিয়ে আদিত্যের সাথে গেল। আদিত্যর বাবা চেয়ারে বসে ওখানকার বৃদ্ধ লোকদের সাথে কথা বলছিল। আদিত্য নূরকে ওর বাবার কাছে নিয়ে যেয়ে বললো।
….বাবা,ও নূর।
আবার নূরের দিকে তাকিয়ে বললো।
…আর নূর উনি আমার বাবা।

নূর আদিত্যের বাবাকে নম্র স্বরে সালাম দিয়ে বললো।
…আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল। কেমন আছেন?

আদিত্যের বাবা মুখে একরাশ হাসি নিয়ে বললো।
…ওয়ালাইকুম আসসালাম।আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?

…..জ্বি ভালো।

ওদের মাঝে আরো কিছু টুকটাক কথা হলো। আদিত্যের বাবা নূরের সাথে কথা বলে অনেক খুশি হলেন। মেয়েটা সত্যিই অনেক ভালো।

আদিত্য নূরকে নিয়ে ওখানে থাকা বৃদ্ধদের কাছে গেল। নূর সবার সাথে খুব সহজেই মিশে গেল। সবার সাথে হাসিখুশি ভাবে কথা বললো নূর। আদিত্য শুধু মুগ্ধ হয়ে দেখছে ওকে।

একটু পরে আদিত্য আবার বললো।
… চলো তোমাকে বাচ্চাদের কাছে নিয়ে যাই।

নূরও উৎসাহ নিয়ে বললো।
…হ্যা হ্যা চলুন। আমিও বাচ্চাদের সাথে দেখা করতে চাই।

আদিত্য নূরের উৎসাহ দেখে জিজ্ঞেস করলো।
….কি ব্যাপার? বাচ্চাদের কথা শুনে এতো এক্সাইটেড হয়ে গেলে যে? বাচ্চা কাচ্চা খুব পছন্দ নাকি?

নূর মুচকি হেসে বললো।
…হ্যাঁ, আমার বাচ্চা কাচ্চা অনেক ভালো লাগে। ওদের সাথে সময় কাটাতে অনেক ভালো লাগে।

কথা বলতে বলতে ওরা মাঠের ভেতর চলে এলো। যেখানে বাচ্চারা খেলাধুলা করছে। ওঁরা দুজন ওখানে পৌঁছাতেই আদিত্য সবাইকে ডেকে বললো।
….বাচ্চারা তোমরা সবাই তোমাদের নতুন একটা আপুর সাথে পরিচিত হও। তারপর নূরকে দেখিয়ে বললো। ওর নাম হলো নূর।
সব বাচ্চারা একসাথে বলে উঠলো।
…হাই নূর আপু।

নূরও খুশি হয়ে সবার সাথে কথা বলা শুরু করলো। বাচ্চাদের নূরকে অনেক পছন্দ হলো।
ততক্ষণে বাকি সবাইও ওদের কাছে চলে এলো।
হঠাৎ বাচ্চারা বলে উঠলো ওরা কানামাছি খেলবে। নূর আর বাকি সবাইকেও ওদের সাথে খেলতে বললো। নূরও খুশি খুশি রাজি হয়ে গেলো। সানাও রাজি হয়ে বললো।
…হ্যা হ্যা চলো আমরা সবাই খেলবো। অনেক মজা হবে।

তানিও রাজি হয়ে গেলো। ব্যাঘাত ঘটালো ছেলেরা। তারা কেউই এসব বাচ্চামো খেলা খেলবে না।আবির তানির দিকে ঝুকে আস্তে করে বললো।
…..বাচ্চা পয়দা করার বয়সে কিনা বাচ্চাদের সাথে খেলবো?

তানি লজ্জা পেয়ে বলে উঠলো।
….ছিহ, অসভ্য। দেখো তুমি যদি না খেলো।তাহলে কিন্তু আর কখনো চুমু খেতে দিব না।মনে থাকে যেন। হুহ্।

আবির ভয় পেয়ে বললো।
….না না এটা কিন্তু ঠিক না।এই মাছুম বাচ্চার সাথে এতবড় অবিচার? জাতি কিন্তু সহ্য করবে না।

তানি সয়তানি হেসে বললো।
…তাহলে বলো খেলবে?

আবির গাল ফুলিয়ে বললো।
…হ্যাঁ হ্যাঁ। ঠিক আছে, ঠিক আছে। না খেলে কি আর উপায় আছে।

তাসির মানা করতেই সানা এসে ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। বেচারা আর কিছুই বলতে পারলো না। শুধু হা করে সানার দিকে তাকিয়ে রইলো।

আদিত্যকে কেউ কিছু বলার সাহস পেল না। তাই ওকে বাদ দিয়েই সবাই খেলা শুরু করে দিল। আদিত্য শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নূরকে দেখতে লাগলো।

প্রথমেই নূরের চোখ বাঁধা হলো। চোখ বাঁধার পর সবাই নূরের চারিদিকে ঘুরতে লাগলো আর পিন্চ করতে লাগলো। নূর ঘুরে ঘুরে দুহাত বাড়িয়ে সবাইকে ধরার চেষ্টা করতে লাগলো। সবাই চারিদিক থেকে আওয়াজ দিচ্ছে। নূর বুঝতে পারছে না কোনদিকে যাবে? ও এলোমেলো হাঁটছে আর সবাইকে ধরার চেষ্টা করছে।

আদিত্যের ফোন আসায় ও একটু সরে গিয়ে অন্য দিকে ঘুরে কথা বলতে থাকে।

সানা সবাইকে চোখ দিয়ে ইশারা করে কিছু একটা বুঝায়। তারপর আদিত্য যেদিকে দাঁড়িয়ে আছে ওইদিকে যেয়ে সানা নূরকে ডাকতে ডাকতে বলে।
…..নূর আপু?আমি এখানে এদিকে আসো আমাকে ধরো।নূর আপু।

নূর সানার কন্ঠ অনুসরণ করে সেদিকেই এগিয়ে যায়। সানা ধীরে ধীরে আদিত্যের দিকে যেতে থাকে আর নূরকে ডাকতে থাকে। নূরও সেদিকে যেতে থাকে। নূর আদিত্যের কাছাকাছি আসতেই সানা মাঝখান থেকে সরে যায়। আর নূর যেয়ে আদিত্যকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। তারপর খুশি হয়ে বলে।
…..ইয়েএএএ। ধরে ফেলেছি, ধরে ফেলেছি।

আদিত্য ফোনে কথা বলছিল।হঠাৎ নূরের এভাবে জড়িয়ে ধরায় আদিত্য থ হয়ে যায়। এই প্রথম নূর ওকে এভাবে জড়িয়ে ধরেছে।নূরের স্পর্শে মুহূর্তেই যেন আদিত্যের সারা শরীরে কারেন্ট বয়ে গেলো। আদিত্যর মনের ভেতর ভালো লাগার ঢেউ খেলছে। ইচ্ছে করছে সময়টাকে এখানেই থামিয়ে দিতে।

বাচ্চারা সবাই জোরে জোরে হাতে তালি দিয়ে লাফাতে লাফাতে বলে উঠলো।
…..ইয়েএএএ,, আপু ভাইয়াকে ধরে ফেলেছে। ইয়েএএ,,

বাচ্চাদের কথা শুনে নূর ঝট করে আদিত্যকে ছেড়ে দিয়ে চোখের বাঁধন খুলে ফেলে। আদিত্য নূরের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।
নূর সামনে তাকিয়ে আদিত্যকে দেখে ৪৪০ ভোল্টেজের ঝটকা খায়।লজ্জায় নূরের ইচ্ছে করছে মাটির ভেতর ঢুকে যেতে। সবসময় ওর সাথেই কেন এমন হয়?
আদিত্য নূরের লজ্জা রাঙা মুখটা দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসছে। আর
বাকি সবাই মুখ টিপে হাসছে।

আরো কিছুক্ষণ খেলা ধুলার পর সবাইকে খাবারের জন্য ডাক দিল।আদিত্যরা সবার জন্য খাবার আর উপহার এনেছে। সেগুলো ওদের সবাইকে দেওয়া হলো।

সবাই একসাথে খেতে বসলো।সবার জন্য বিরিয়ানি আনা হয়েছে। নূর বেশি ছোট বাচ্চগুলোকে নিজেই খাবার খাইয়ে দিচ্ছে। আদিত্য এসব রিচ ফুড খায় না। তাই ও বসে বসে শুধু নূরকে দেখছে। নূরের ব্যবহারে আদিত্যের বাবাও মনে মনে প্রসন্ন হলেন। যাক তার ছেলে হিরা খুঁজে বের করেছে।মেয়েটা সত্যিই খাঁটি সোনা।

হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলে আদিত্যের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
….ভাইয়া তুমি খাচ্ছো না কেন? তোমকেও কি খাইয়ে দিতে হবে? তাহলে আপুকে বলো তোমাকেও খাইয়ে দিবে। তাইনা আপু?

বাচ্চাটার কথা শুনে নূরের চোখ কপালে উঠে গেলো। কি বলে এই ছেলে?
বাকি সবাই মুখ টিপে হাসছে। আদিত্যের বাবা ছোটদের মাঝে অস্বস্তিতে পরে গেলেন। তাই তিনি বাহানা দিয়ে ওখান থেকে চলে গেলেন।

সানা দুষ্টু হেসে বললো।
….হ্যা নূর আপু ও ঠিকইতো বলেছে। ভাইয়া কখনো হাত দিয়ে খাবার খায়না। সবসময় চামচ ছুরি দিয়ে খায়।এখন এখানে তো আর ওগুলো নেই। তাই বেচারাকে মনে হয় না খেয়েই থাকতে হবে।

এতক্ষণে আদিত্য বলে উঠলো।
…এমন কিছুই না।এসব খাবার আমার পছন্দ না তাই খাচ্ছি না।

আবিরও দুষ্টু হেসে বলে উঠলো।
….আরে ভাই লজ্জা করছিস কেন? আমরা জানি তোর ক্ষিদে লেগেছে সেই সকাল থেকে কিছু খাসনি। আর কতক্ষণ খালি পেটে ক্ষিদে নিয়ে বসে থাকবি? তারপর নূরের দিকে তাকিয়ে বললো।
…নূর তুমি কিছু মনে না করলে।ওঁকে একটু খাইয়ে দিবে প্লিজ?

আদিত্যের না খেয়ে থাকার কথা শুনে নূরের একটু মায়া হলো। নূর একটা প্লেট নিয়ে আদিত্যের কাছে গিয়ে বসলো। প্রচুর লজ্জা লাগছে নূরের। তারপরও মনে সাহস যুগিয়ে হাতে এক লোকমা
বিরিয়ানি তুলে আদিত্যের মুখের সামনে ধরলো।

আদিত্য অবাক হয়ে কতক্ষণ চেয়ে রইল নূরের দিকে। তারপর নূরের দিকে তাকিয়ে থেকেই হা করে খাবার টা মুখে নিল।

সানা ফোন বের করে ওদের এই মূহুর্তটা ক্যামেরা বন্দী করে নিল।
তাসির হা করে চেয়ে আছে ওদের দিকে। ওর বিশ্বাসই হচ্ছে না আদিত্য এসব খাবার খাচ্ছে। সানা নিজের হাত দিয়ে তাসিরের থুঁতনির নিচে হাত দিয়ে তাসিরের হা বন্ধ করে দিয়ে বললো।
…..এভাবে কি দেখছেন? এটাকে বলে ভালোবাসা। আর ভালোবাসা মানুষের সবকিছু বদলে দিতে পারে।

তাসির অবাক হয়ে তাকালো সানার দিকে। এতটুকু পিচ্চি মেয়ে আবার ভালোবাসা সম্বন্ধেও বোঝে? তাহলে কি পিচ্চিটা বড়ো হয়ে গেছ? তাসির একটু তাচ্ছিল্যের সুরে বললো।
….তোমার মতো পিচ্চি মেয়ে কি বোঝে ভালোবাসার?

কথাটা শুনে সানার একটু রাগ হলো।ও রাগী স্বরে বললো।
….পিচ্চি মানে? কে পিচ্চি? আমাকে আপনার কোন দিক দিয়ে পিচ্চি মনে হয়? আমি এখন কলেজে পড়ি বুঝেছেন? আমি মোটেও পিচ্চি না হুহ্।

সানার কথা শুনে তাসির মনে মনে হাসলো। তারপর বললো।
…জ্বি জ্বি মহারানী আপনি সবার বড়ো। এখন খুশি?

সানা ভাব নিয়ে বললো।
…হুম ঠিক আছে।মনে থাকে যেন কথাটা।

খাওয়া দাওয়া শেষে নূর আদিত্যকে বললো।
….আমাদের এখন যেতে হবে। নাহলে বাসায় যেতে দেরি হয়ে যাবে।

আদিত্য বললো।
….ঠিক আছে চলো আমি নামিয়ে দিয়ে আসছি।

….কিন্তু আপনিতো বললেন আজকে যাবেন না।

…আগে বলেছিলাম কিন্তু এখন যাবো। বেশি কথা না বলে চলো আমার সাথে।

নূর আর কিছু না বলে মাথা ঝাকিয়ে আদিত্যের সাথে গেল। বাইরে আসতেই তানি নূরকে বললো।
…নূর আমি আবিরের সাথে যাচ্ছি। তুই ভাইয়ার সাথে চলে যা।

নূর মাথা ঝাকালো তারপর সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে গেলো।

আদিত্য গাড়ি চালাচ্ছে আর নূর পাশে বসে আছে। আদিত্য হঠাৎ বলে উঠলো।
…অনেক ধন্যবাদ তোমাকে নূর। আজকের দিনটা আমার পাশে থাকার জন্য। প্রতিবছর এই দিনটা অনেক ডিপ্রেশনে যায় আমার। তবে আজকে তোমার জন্য আমি অনকটা স্বাভাবিক হতে পেরেছি। থ্যাংক ইউ সো মাচ।

নূর মুচকি হেসে বললো।
….থ্যাংকস আমার আপনাকে বলা উচিৎ। আপনার জন্য আজকে এতো সুন্দর একটা দিন কাটালাম সবার সাথে। সত্যিই আজকের দিনটা অনেক স্পেশাল ছিল আমার জন্য। বিশেষ করে বাচ্চাদের সাথে সময় কাটিয়ে আমার অনেক ভালো লেগেছে।

কথা বলতে বলতে ওরা নূরের বাসার কাছে চলে আসে।
আদিত্য গাড়ি থামিয়ে বলে।
…ঠিক আছে তাহলে যাও।কাল সকালে আবার দেখা হবে ইনশাআল্লাহ।

নূর মাথা ঝাকিয়ে গাড়ি খুলে বায় বলে বের হয়ে যায়। আদিত্য নূরের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। নূর চলে যেতেই আদিত্যও গাড়ি। স্টার্ট দিয়ে চলে যায়।

চলবে…….