#ভালোবাসা_একটা_বাজি(৭)
ঝিড়ি ঝিড়ি বাতাস বইছে। আরিয়ানের চুলগুলো উড়ছে বড্ড এলোমেলো ভাবে। চোখদুটো আজ দাপটের জায়গায় বড্ড কাতর। যেনো শান্তির একটু আভাস পেলেই মিইয়ে যাবে। ছোট ছানার মতো আদর চাইবে। আরাফা নিজেকে শক্ত করে কাটকাট গলায় বলল—
-” কি চাই হ্যা? কোন সাহসে আমার বাসায় এই রাতে এসেছেন? আপনার কমনসেন্স নাই? নিজেকে কি ভাবেন? আমি কি অন্য দশটা মেয়ের মতো? যে আপনি আসবেন লু”চুগিড়ি করবেন আর চলে যাবেন। আমি আরাফা। অন্য দশটা মেয়ের সাথে আমায় মিলাতে আসবেন। যদি ভাবেন আপনি এসেছেন আর আমি ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে গলা জড়িয়ে ধরবো, তাহলে you are wrong Mr. Ariyan. এখনি চলে যাবেন বাসা থেকে। কোন লেইম এক্সকিউজ আমি শুনছি না। গেট আউট।
আরিয়ানের আজকে এমনিতেই মন খারাপ। কই একটু আসলো মন ভালো করতে আর এই মেয়ে নিজেদের ইগো নিয়ে পড়ে আছে। ভাবছে কি আমি তার সুযোগ নিব। আমার এতোও খারাপ দিন আসেনি। নিজের দুঃখগুলো মনে মনে আবার আওরালো আরিয়ান। কাতর চোখে আরাফার দিকে চাইলো। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল—
-” এক্ষুনি চলে যাবো। আমি থাকতে আসিনি। আসলে আমার ভালো লাগছিলো না।
আরিয়ানের কাতর কন্ঠ শুনে আরাফা তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিলো। চোখদুটো তে আজ অহংকার নেই আছে একরাশ দুঃখ। কে উনাকে কষ্ট দিলো? আর উনি তো ব্রেকাপের কষ্টে পাগল হবে এই টাইপের ছেলেও না। এত কাতর কেন কন্ঠ? তবুও একটা ছেলেকে এ রাতে কিছুতেই থাকতে দেয়া যাবেনা।
-” প্লিজ চলে যান। আব্বু দেখলে সমস্যা হয়ে যাবে। আমায় বকবে। চলে যান।
-” যাবই তো কে থাকতে চায়। মনটা ভালো ছিল না। মনে হলো তোমায় দেখলে ভালো লাগবে তাই এলাম। তুমি থাকো।
আরাফা নিজের রুমে চলে গেল। এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো অজান্তেই। সারাদিন চিল করা মানুষটার আজ নাকি মন ভালো নেই। যতসব লেইম এক্সকিউজ। নিশ্চয়ই ফ্লার্টিং করতে এসেছিলো।
।
মিহির ভালোই লাগছে। তার ভাইটা আর এতিম নয়। মাহি সবে ঘুমিয়েছে। আরিয়ান যাওয়ার পরেই তার মা কান্না করতে করতে শেষ। ছেলে কি তবে তাকে ঘৃণা করে? মিহি তাদের একা ছেড়ে দিয়েছে। বাড়ির একটা রুম তালা মারাই থাকতো। সেটাই আরিয়ানের মা-বাবার। কিন্তু আজ আর গুছানো হয়নি। তাই আরিয়ান যে রুমটায় আগে থাকতো, সেখানে তাদের থাকতে দেয়া হয়েছে। মিহি গিয়ে উঁকি দিলো। দরজা খোলাই আছে। তবুও দুবার নক করলো। ভেতর থেকে শায়লার কন্ঠস্বর এলো-
-” ভেতরে এসো।
মিহি রুমে ঢুকলো। এই রুমটায় আবার কতবার পড় মানুষ এলো। আরিয়ান যাওয়ার পরেই মিহি প্রতিদিন এ রুমটা গুছিয়ে রাখে। নিজের একাকি সময়গুলো কাটায়। অপেক্ষা করে মৃত্যুর জন্য। মিসেস শায়লা রহমানের চেহারায় এখনো বয়সের ছাপ নেই। তাকে দেখলে মনেই হবেনা আরিয়ানের মত একটা ছেলে আছে। চেহারায় অন্য রকম ভাব। বিদেশে থেকেই হয়তো চেহারার সৌন্দর্য টা হারায়নি। শায়লা রহমান চোখ বুজে আছেন। পাশেই মিহির জেঠু মানে শহিদ নিজেও কপালে হাত ঠেকিয়ে বসে আছে। মিহি তার উপস্থিতি বুঝাতে গলা খাঁকারি দিলো। মিসেস শায়লা চোখ খুলে তাকালো। মিহি কে দেখে একটু হেসে জিজ্ঞেস করলো –
-” মা তোমার নাম কি?
মিহিও হালকা হেসে বলল—
-” আমার নাম মেহরিন মিহি চৌধুরী।
শায়লাকে বেশ চিন্তিত দেখা গেল। তিনি কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছেন কিন্তু পারছেনা। ভয়ে না সংশয়ে? মিহি ঠোঁট ভিজিয়ে অভয় দিয়ে বলল-
-” আপনি যদি কিছু বলতে চান তাহলে বলুন। আপনি আমার মায়ের মত। এত সঙ্কিত হওয়ার কিছুই নেই। বলুন আপনি।
শায়লা অভয় পেলেন। মেয়েটাকে তার বেশ ভালো লাগলো। তিনি মিষ্টি হেসে বলল-
-” তুমি আর আরিয়ান বিয়ে করেছো কবছর। আরিয়ান তাঁর বাচ্চাটাকেও খুব ভালোবাসে।
শায়লা রহমান এর এমন আজব প্রশ্নে মিহি বোকা বনে গেল। হাসা উচিত নাকি আরিয়ান আমার ভাই এই কথাটা বলে চিল্লিয়ে ওনার কান ফাটানো উচিত? আরিয়ানের বাবা এবার চোখ খুললো। বিরক্ত হয়ে শায়লার দিকে তাকালো। এটা কেমন ধরনের প্রশ্ন। যদি ওরা স্বামী-স্ত্রী না হয়, তখন? তিনি মিহির অবাক হওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে শায়লাকে রাগত স্বরে ধমক দিলেন-
-” এই তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে। এটা কেমন প্রশ্ন। মাথার সব তাঁর বিদেশে গিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছো?
শহিদ মিহির দিকে তাকিয়ে গলা নরম করে বলল-
-” মা আরিয়ান তোমার কি হয়? তোমাদের সম্পর্ক টা কি?
মিহির শহিদের প্রশ্ন পছন্দ হলো। মুখে হাসি টেনে বলল-
-” জেঠুমনি! আমি তোমার ছোট ভাইয়ের মেয়ে। আর জন্ম থেকেই আরিয়ান আমাকে নিজের আপন বোন আর আমি তাকে নিজের আপন ভাই বলে জেনে এসেছি।
শায়লা বেগম পুরো থ হয়ে গেলেন। ওরা ভাই-বোন আর নিজে মনে মনে কতোই না উদ্ভট চিন্তা করেছিলেন। শহিদ নড়েচড়ে বলল—
-” সাদিয়া আর শফিক কোথায়? তুমি শ্বশুরবাড়ি থেকে কি বেড়াতে এসেছো?
মিহি একদম চুপচাপ হয়ে যায়। এ প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই। কি দিবে এর উত্তর। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বলে বর্ননা করবে? নাকি মানুষগুলোর ধোঁকা, প্রান’হা’নির কথামালা শোনাবে? আরিয়ান বারবার এসব বিষয়ে বলতে না করে গেছে। সময় হলে সেই জানাবে। মিহি এই মুহূর্তে খুব করে চাইছে ভাইয়া আসুক। খুব কান্না পাচ্ছে। কান্নারা গলায় দলা পাকিয়ে আসছে। মিহি ঠোক গিলে নিজেকে শান্ত করে বলল-
-” ভাইয়া আপনাদের সময়মতো এ প্রশ্নের উত্তর দিবে। আমি বলতে পারবোনা মাফ চাই জেঠিমা জেঠুমনি। আমি আসি মাহি উঠে যায় যদি। আপনাদের কিছু লাগলে আমাকে বলবেন। পাশের রুমেই আছি। আর নিচে রাহেলা আছে।
মিহি উনাদের কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ছুটে বেরিয়ে আসে। নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় উবু হয়ে কান্না করতে থাকে। এই প্রশ্ন যতবার শুনেছে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছে। দুইতিন দিন রুম থেকেই বেরুনো বন্ধ করেছে মাহিকে খাওয়ানো ছাড়া। কেন বারবার অতীত সামনে আসতে চায়। খুব করে লুকিয়ে রেখেছি। কেন বারবার মানুষ তা টেনে হিছড়ে সামনে আনবেই। তারা কি বোঝেনা কষ্ট হয় খুব।
।
পরেরদিন আরাফা বান্ধবীদের সাথে বসে বসে ভার্সিটিতে আড্ডা দিচ্ছে। আরিয়ান এসে তাদের আড্ডায় ঢুকে পড়ে। তার সাথে এসেছে সুহাস, শিহাব আর রাইয়ান ও। রাইয়ান আসতে চায়নি তাকে টেনে নিয়ে এসেছে সুহাস আর শিহাব। আরিয়ান আসার পড়েই ওরা মরাকান্না জুড়ে দিয়ে ক্ষমা চেয়েছে। আরিয়ানের ও বন্ধুদের সান্নিধ্য টা দরকার তাই সব ভুলে মাফ করে দিয়েছে। আরিয়ান আর তার বন্ধুদের দেখে অর্পিতা চমকে আরাফাকে নেড়ে বলে-
-” এই এই এই আরু! আমি কি স্বপ্ন দেখছি? আমায় চিমটি দে প্লিজ। আআআআআ।
অর্পিতা হাত ডলছে। সবাই অর্পিতার দিকে তাকিয়ে আছে। অর্পিতার নিজেকে এলিয়েন লাগছে। ইমা খুব জোরেই অর্পিতার হাতে নখ বসিয়ে দিয়েছে। অর্পিতা চোখ দিয়ে বুঝানো তোর খবর আছে। অর্পিতা মুখটা হাসি হাসি করে বলে-
-” আরে আরিয়ান যে। কেমন আছো?
আরিয়ান কিউট একটা হাঁসি দিয়ে বলে-
-” ভালোই। তবে তোমার পাশে মেয়েটা কে?
অর্পিতা হইহই করে বলে-
-” এটা আরাফা। আমার ফ্রেন্ড
আরাফা আরিয়ানের কথায় আকাশ থেকে পড়লো! ওকে চিনে না! What a drama! এই ছেলে মেয়েবাজ জানতো কিন্তু এ তো দেখছে এখন নাটকবাজ too. আরাফা রেগে যাচ্ছে। আরিয়ান আফসোস করে বলে-
-” ইশশ বাচ্চা মেয়েটা কত কিউট। আচ্ছা ওকে এই কয়বছর চোখে পড়লো না কেন?
অর্পিতা হেসেই বলে-
-” করোনার সময় বন্ধ থাকলো প্রায় দু’বছর। আরাফার তো অলটাইম মাস্ক পড়েও এক্সট্রা প্রোটেকশন এ থাকতো। আর তুমি ভার্সিটিতে আসো কয়দিন? আর আসলেও গ্যাং নিয়ে বসে থাকো। আরাফা ইদানিং আমাদের সাথে এসে আড্ডা দেয়। আগে ভার্সিটির ক্লাস টু বাসাই ছিলো ওর জীবনের লক্ষ্য। তোমরা তো ক্লাসে জীবনেও ঢোক না। কি ভেবে এবার এত রেগুলার আসছো? ফাইলান ইয়ার বলে? নাকি অন্য কিছু আছে?
আরাফার এখন চিল্লিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে। Give me the অস্কার। আমি ওটা ধরে অর্পিটার দিকে ছুড়ে মা’রবো। একটা কথা জিজ্ঞেস করলো এ আমার চৌদ্দ গোষ্ঠির ডাটা লিক করতে উঠে পড়ে লেগেছে। আরিয়ান তখন হেসে হেসে বলল—
-” বাবাহ বিল্ডিং স্টুডেন্ট এরা। আমরা কি করি আমরা কি করি।
আরাফার রাগে এবার সপ্তাকাশে। দাঁত কিড়মিড় করে বলল—
-” আগে বড় বড় কয়টা কচু গাছ খুঁজবেন। তারপর চারগোছা দড়ি জোগা করে। এই চতুর্পান্ডবের দল মিলে পায়ে দ’ড়ি লাগিয়ে ঝুলে পড়বেন। একদম স্পট ডে’ট।
আরাফা কথাটা বলে রাগে গটগট করে হাঁটা দেয়। আরিয়ান ঢং করে বলে-
-” দিলে বড় জ্বালারে কচু গাছের জ্বালা।
#চলবে
#মেঘলা_আহমেদ(লেখিকা)🤗