#ভালোবাসা_তারপর
#পর্ব:২৬
#তামান্না_শাহরিন_শশী
কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উন্মুক্ত।
অনুমতি ব্যাতিত কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
শব্দ রোদসীর লাল হয়ে যাওয়া লালচে মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকে এসে রোদসীকে ধরে চেয়ারে বসায়। রোদসী ভয়াতুর দৃষ্টিতে শব্দের দিকে তাকায়। কিন্তু এর কারণ শব্দ খুঁজে পেলো না। হঠাৎ এমন উত্তেজিত হবার কারণ কি? বা কি শুনেই মেয়েটা এতে ভয় পেলো? হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে শব্দ রোদসীকে পরক্ষ করে বলে,
-“তুই উচ্ছ্বাসকে চিনিস?”
রোদসী শব্দের পানে চমকে তাকায়। রোদসীর চোখ দিয়ে অনবরত পানি উপচে পড়ছে। কান্নার তাড়নায় গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।তবুও কোনো মতে মাথা নাড়ায়। তাই শব্দ কিছুটা উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করে,
-“মুখে বল?”
-“হ্য….হ্যাঁ। উর্জার বাবাই উচ্ছ্বাস!”
-“এতদিন তাহলে এটাই লুকেচ্ছিলি?”
-“আমি লুকোচ্ছিলাম না ভাইয়া।”
-“আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিলো যখন উচ্ছ্বাস বলেছিলো তার বউ পালিয়েছে অন্যদিকে তুই ও তোর ভাষ্যমতে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পালিয়েছিস আর উর্জাই কেনো উচ্ছ্বাসের মতো দেখতে হবে অনেক টা। তবুও আমি পাত্তা দেই নি আমার ভাবনা গুলো এবং আমি কিছু বলি’ও নি। এটা তুই কেনো করলি? ছেলেটা যথেষ্ট ভালো। ওর দোষ আমি কোথাও দেখতে পারছি না। হ্যাঁ মানছি উচ্ছ্বাসের অ্যাংগার ইস্যু আছে। তাই বলে তুই ওকে একা করে ছেড়ে চলে আসবি এভাবে?”
-“ভাইয়া তুমি আমাকে ভুল বুঝছো!”
-“ভুল? তোকে ভুল কেনো বুঝবো। ভুল তো আমার হয়েছে। তোর ব্যাপারে না জেনেই এতো দিন এখানে বোনের মতো আগলে রেখেছি।”
রোদসী শব্দের দিকে তাকায়। এতদিনের পরিচিত শব্দ আর আজকের শব্দের সাথে কোনো মিল নেই। এই শব্দকে রোদসী কখনো দেখি নি। চেনে না। শব্দ সোফায় দপ করে বসে নিজের চুল খাঁমচে টেনে ধরে। মাথায় আর একটা চিন্তা জেঁকে বসেছে। কিছুক্ষণ পর রোদসীর দিকে তাকালো। রোদসী কান্না করছে তো করছেই। কান্নার দমকে চোখ মুখ কেমন লালচে হয়ে ফুলে গেছে। রোদসী চোখ মুছে উঠে শব্দের বিপরীত পাশের সোফায় বসে বলে,
-“ভাইয়া লেট মি এক্সপ্লেইন।”
-“তুই এক্সপ্লেইন নিয়ে পড়ে আছিস এখনো! একবার চিন্তা করে দেখ তো,উচ্ছ্বাস যখন জানবে তার বউ আমার বাসায় পুরোটা বছর ছিলো। আমার বোন হয়ে, আর আমি তার বউ কে এদিক ওদিক খোঁজার বুদ্ধি দিয়েছি। তখন সে আমাকে কতটা ভুল বুঝবে? যখন সে জানতে পারবে তার বউ’ই আমার বাসায় আমার বোনের পরিচয়ে থাকছে? ভাবতে পারছিস কিছু? একটা বার শুধু ভেবে দেখ। কেনো করলি এসব বোন আমার?”
-“মাহাদী আমাকে ভালোবাসে আমি জানি। কিন্তু মাহাদী মেন্টালি আনস্টেবল ভাইয়া। ওর সাইকোপ্যাথিক সমস্যা আছে ভাইয়া। আমি ওর সাথে থাকতে না পেরে অতিষ্ঠ হয়ে পালিয়েছি ভাইয়া। মেন্টালি আর ফিজিক্যালি অত্যাচার গুলো আর আমার সহ্য হচ্ছিলো না, নিজেকে শেষ করে দেওয়ার মতোও সাহস ছিলো না আমার। ওকে যে বলবো সাইকোলোজিস্ট দেখাতে তাও সাহস হচ্ছিলো না। আর এত দিন পালানোর পর ও আমাকে সাঈফ সাহেবের সাথে দেখে ফেলেছে। ও যেকোনো সময় কিছু একটা করতে পারে আমি চাই না, আমি চাই না আমার জন্য তোমাদের ক্ষতি হোক বা সাঈফ সাহেবের কোনো ক্ষতি হোক। ভাইয়া আমি মাহাদীর কাছে ফিরতে চাই না। ও আমাকে মে*রে ফেলবে। তুমি কি পারবে যে ন’র’ক থেকে পালিয়েছি আবার’ও আমাকে সেই একই নর”কের মধ্যে ঠেলে দিতে? ও আমাকে ধরতে পারলে কি করবে আমি জানি না। ও রাগলে মানুষ খু’ন করার মতোও ক্ষমতা রাখে। সেই রাগ আমি আমার নিজ চোখে দেখিছি ভাইয়স। ও আমাকে শেষ করে ফেলবে ভাইয়া। তখন আমার নিজেকে শেষ করা ছাড়া আমার কোনো উপায় থাকবে না।
এসব বলতে বলতে রোদসী শব্দের হাত ধরে বেশ উচ্চস্বরে কান্না করে দিলো। শব্দ শেষের কথাটা শুনে বুক কেপে উঠলো। আসলেই তো শব্দ জানে উচ্ছ্বাসের অ্যাংগার ইস্যু সম্পর্কে আর ও নিজে শুনেছে উচ্ছ্বাস রোদসীকে ধরতে পারলে কি কি করতে চেয়েছে। হাজার হোক রোদসী ওর নিজের আপন বোন না হলেও তার থেকে কম কিছু নাহ।শব্দ রোদসীর মাঝে শ্রেয়াকে পেয়েছে। রোদসীকে শব্দ অনেক ভালোবাসে। শ্রেয়ার পরে শব্দের আপন বলতে যদি কেউ থেকে থাকে সেটা রোদসী। শব্দের ভাবনার মাঝেই রোদসী আবারো বলে উঠে,
-“আমি চাই না আমার জন্য বা ওর জন্য বেবির কোনো ক্ষতি হোক। আর ও এখনো জানে না বেবিটা কার। তাই আমি ওকে বাবুর আশে পাশে আসতে দিতে পারবো না। ও ঠিক নেই ভাইয়া। ও কি থেকে কি করে বসবে। আমি পারবো না।”
শব্দ চমকে উঠলো। তড়িৎ রোদসীর দিকে তাকায়। তারপর বলে,
-“কিন্তু উচ্ছ্বাস বাবুকে দেখেছে। এবং হিসাব করে বের করেছে। বেবিটা ওর। তোকে ও হন্নে হয়ে খুঁজছে। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। কার দিকে যাবো। তুই নাকি বন্ধু?”
এসব বলেই আমারো শব্দ তার মাথার চুল খামচে ধরলো। আর রোদসী যখন শুনলো উচ্ছ্বাস বেবীর কথা বুঝে ফেলেছে মাথা পুরোই ফাঁকা হয়ে গেলো। কিছুটা থম মেরে বসে থেকে হঠাৎ ই বলে উঠে,
-“ভাইয়া আমি পালাবো। হ্যাঁ, ইন্ডিয়া যাবো। আমাকে একটু সাহায্য করো। আমি ওর কাছে যেতে চাই না। আমি ওর থেকে আবারোও পালাবো। ও আমাকে আর আমার মেয়েকে মেরে ফেলবে ভাইয়া। আমি আর ওই ন’র’কে যেতে চাই না। তুমি আমাকে যেকোনো একটা ব্যবস্থা আগে করে দাও।আমি দেশ ছাড়লে তো ও আর আমাকে খুঁজে পাবে নাহ। তুমিও কখনো ওকে কিছু বলবে না।
শব্দের মনে হচ্ছে আজকে শুধু চমকানোরই দিন। এতো এতো চমকপ্রদ কথা সে হজম করতে পারছে না। উচ্ছ্বাসের বলা বউ পালানো। রোদসী থেকে জানা বরের বাড়ি থেকে পালানো। রিন্তীহাকে উচ্ছ্বাসের মতো লাগা। একই চোখ। এগুলো কখনোই কোয়েন্সিডেন্স হতেই পারে না। শব্দের আগে থেকেই সন্দেহ হতো। তবুও সম্পর্কের খাতিরে রোদসীকে জিজ্ঞেস করা হয় নি। কিন্তু এতকিছু সামনে আসার পর? কি করবে শব্দ? আচ্ছা রোদসীর জায়গায় যদি শ্রেয়া হতো? এভাবে কান্না করতে? ভাই হয়ে কি বোনের কান্না সহ্য করতে পারতো? কি করবে শব্দ? রোদসীকে সাহায্য? পরে যদি উচ্ছ্বাস জানতে পারে? কি হবে এই সম্পর্কের অদূর ভবিষ্যৎ? আর উচ্ছ্বাস কি কখনোই পারবে না তার মেয়েকে আদর করতে, একটু ধরে দেখতে? এ কেমন বাবা হলো? রোদসী উচ্ছ্বাসের বাবা হবার বেস্ট টাইমটা কেড়ে নিচ্ছে! কোন দিকে যাবে শব্দ!
———
শব্দ সকাল সকাল উচ্ছ্বাসকে কল করলে ওকে লাইনে পায় না। তাই হসপিটালে চলে যায়। রোদসীর সাথে রাতের পরে আর কথা বলে নি। শুধু মিলি খালাকে বলে এসেছে রোদসী বাসা থেকে যেন কোথাও না যায়। তারপরই সে হসপিটালে চলে আসে। এতো এতো প্রেশারের মধ্যে শব্দ ঊষাকেও সময় দিতে পারে না। এতে অবশ্য মেয়েটা ওতো আগের মতো নারাজ হয় না। এই জন্য শব্দের ঊষাকে আরো ভালো লাগে। ঊষার কথা মনে পড়তেই শব্দ হাসলো। তারপর ফোন বের করে ঊষার সাথে কথা বলে। কথা বলার এক সময় জানতে পারে। কালকে রাতে হসপিটাল থেকে বের হয়ে বাসায় যেতে না যেতেই উচ্ছ্বাসকে ব্যবসার কাজে বাহিরে যেতে হয়েছে। উচ্ছ্বাস নাকি যেতে চায় নি। তবুও জোর করে পাঠানো হয়েছে। উদয় নতুন বিয়ে করেছে ওকে তো আর একা পাঠানো যায় না। যদি রুহিকে পাঠাতে চায় তাহলে ওর পাসপোর্ট আর ভিসার জন্যও সময় লাগবে। আর এটা যেহেতু ইমার্জেন্সি তাই ইচ্ছে না থাকা শর্তেও যেতে হয়েছে। তারপর কথা শেষ করে শব্দ কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রোদসী ব্যাপারটা ভাবে। আচ্ছা যদি রোদসীকে পালাতে সাহায্য করে তাহলে কি বন্ধুর প্রতি বেশি অন্যায় হয়। এসব ভাবতে ভাবতে ডিউটি শেষ করে বাসায় আসে কিন্তু আজকেও রোদসীর দেখা পায় না। মিলি খালা থেকে জানতে পারে রোদসী প্রয়োজন ছাড়া আর ঘর থেকে বের হয় নি। রিন্তিহাকে নিয়ে ঘরেই রয়েছে। শব্দ একটা বড় শ্বাস টেনে নিজেও নিজের রুমের দিকে চলে যায়। খাওয়া দাওয়া করা ইচ্ছে করছে না। ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় কিছু সময় শুয়ে থেকে ভাবে। তারপর কি মনে করে ফোনটা হাতে নিয়ে একটা নাম্বারে ডায়াল করে।
—–
সাঈফ মাত্রই স্টাডি রুম থেকে এসে ফ্রেশ হতে যাবে তখনই তার মোবাইল ফোনটা তার যান্ত্রিক আওয়াজে বেজে ওঠে। সাঈফ সামনে এগিয়ে ফোনটা হাতে নেয়। তারপর ঘড়ির দিকে তাকায় রাত দুটোর মতো বাজে এই সময় এই নাম্বার থেকে কল আসায় কিছুটা দুশ্চিন্তা গ্রস্ত হয়। কল রিসিভ করার আগেই কল টা কেটে যায়। তাই সাঈফ কল ব্যাক করতে গেলেই আবারো একই নাম্বার থেকে কল আসে। এবার আর সময় ব্যায় না করেই সাঈফ কলটা রিসিভ করে কানে ধরতেই। অপর পাশ থেকে ভেসে আসলো এক পুরুষের উত্তেজিত কন্ঠের বলা কথা,
-“কালকে একটু বাসায় আসতে পারবেন?”
সাঈফ এবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে টেবিলের সামনে যেয়ে ক্যালেন্ডারটা দেখে। আজকে যেহেতু অফ ডে ছিলো। কালকে ডিউটি থাকতে পারে এসব ভেবেই ক্যালেন্ডার চেইক করে, না কালকে কোনো অপারেশন নেই। তাই সে জবাব করে,
-“পারবো। কিন্তু আপনার কন্ঠ কেমন দুশ্চিন্তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কিছু হয়েছে কি? রিন্তিহা ঠিক আছে? তাবাসসুমের কিছু হয় নি তো?
শব্দ এতে বিরক্তবোধ করলো। তবু বিরক্ত চেপে হাসার চেষ্টা করে বলে,
-“তেমন কিছু না। একটা ব্যাপার নিয়ে কথা বলবো তাই কালকে একটু বাসায় আসলে ভালো হতো।”
-“আচ্ছা। ঠিক আছে। আসবো।”
-“রাখছি।”
-“আচ্ছা।”
সাঈফ কল কাটার পরে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। হঠাৎ এমন কি হলো যে এতো রাতে কল করে আলোচনার জন্য সকাল সকাল এমন ভাবে বাসায় যেতে বললো কিছুই মাথায় ঢুকলো না সাঈফের। ফোনটা রাখতে যেয়েই বেড সাইডের টেবিলের পাশে এক মেয়ের ছবি পেলো সাঈফ। মেজাজটা বিগড়ে গেলো। এই মেয়েকে কত ভাবে রিজেক্ট করলো। শেষ পর্যন্ত ফুফুকেও হাত করে ছাড়লো। সাইফ একটা শ্বাস ফেলে ছবিটা ওখানে রেখেও ওয়াশরুমে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে ফোনটা হাতে নেয় ওই মেয়েকে কল দেয়া উদ্দেশ্য, সাঈফের কাছে মেয়েটার নাম্বার ছিলো। কারণ তারা একই সাথে ইন্টার্নি করেছে। কি যেনো নাম মেয়েটার? চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করলো। মনে পড়তেই চোখ খোলে, মেয়েটার নাম নাবিলা। মেয়েটা সাঈফকে প্রচন্ড রকমের পছন্দ করে। অনেকবার এপ্রোচও করে কিন্তু সাঈফ কখনো এই ব্যাপারে ভাবেই নি। তারপর কি যেনো ভেবে ফোনটা রেখে মেয়েটার ছবি হাতে নেয়। সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করে। একসময় হঠাৎ করেই রোদসীর কথা মনে পড়ে সাঈফের। আচ্ছা, রোদসী ওকে রিজেক্ট করার পর যেমন খারাপ লেগেছে এই মেয়েটারও কি তেমন খারাপ লেগেছে নাকি আরো বেশি? আচ্ছা মেয়েটাকে কি একটা চান্স দিবে? দেয়া যেতেই পারে। এসব ভাবতে ভাবতেই সাঈফ ঘুমিয়ে পড়ে।
——
সকাল সকালই সাঈফ বাসায় চলে এলো। শব্দ মিলি খালাকে বললো সে যেন একটু রোদসীকে ডেকে দেয়। মিলি খালাও শব্দের কথা মতো রোদসীকে ডাকতে চলে যায়। রোদসী প্রশ্নবিদ্ধ চোখে ড্রইং রুমে এসে দুজনকেই পরক্ষ করে। রোদসী কিছু বলতে নেয়ার আগেই শব্দ বলে সোফায় বসতে তাই সেও কোনো কথা না বলে সোফায় বসে। শব্দ দুজনের মুখের দিকে তাকায়। তারপর বলতে শুরু করে,
-“কালকে রাতে ওভাবে কল করার জন্য আমি সত্যি দুঃখিত। তবে এবারো আমার আপনার হেল্প দরকার। আপনাকে একটা দায়িত্ব দেবো। সেটা পালন করবেন। আমিই করতাম তবে। আমি যেতে পারবে না।”
এটুকু বলেই শব্দ থামলো। সাঈফ শব্দের দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে তাকিয়ে আছে। তা দেখে শব্দ হাসলো। তারপর রোদসীর দিকে তাকালো। রোদসী মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে। শব্দ চোখ সরিয়ে আবারো সাঈফের পানে তাকায়। তারপর আবারো বলতে শুরু করে,
-“লাস্ট যেদিন আপনারা রিন্তীহাকে নিয়ে হসপিটালে যান সেদিন তাবাসসুমের হাজবেন্ড আপনাদের দেখে ফেলেছে। আপনার মনে হতে পারে আমি জানলাম কি করে। তাই সহজ করে বলি তাবাসসুমের হাজবেন্ড অর্থাৎ উচ্ছ্বাস আমার ব্যাচমেট, একই স্কুল, কলেজ ও হোস্টেলে ছিলাম। বন্ধুও বলতে পারেন। কিন্তু কলেজ শেষে আর দেখা হয় নি। ওর বাসায় একজন অসুস্থ হলে হসপিটালেই আমাদের আবারো দেখা হয়। তো সেখান থেকে জানতে পারলাম যে ওর বউ পালিয়েছে। এটা ওটা করার পর কালকে রাতেই জানতে পারলাম যে, ওর বউ আর কেউই নয়। স্বয়ং তাবাসসুম’ই উচ্ছ্বাসের বউ।”
সাঈফ চমকে রোদসীর পানে তাকালো। কিন্তু তখনও রোদসী প্রাণহীনভাবে জড়বস্তুর ন্যায় সোফায় বসে আছে। শব্দ আবারো বলতে শুরু করলো,
-“আমি অনেক ভেবেছি। উচ্ছ্বাসকে আমি অনেক ভালো করে চিনি। ও এমনি এমনি থামবে না। তাবাসসুম কে পেলে কি করবে তা আমি নিজের কানে শুনেছি। তাই আমি উচ্ছ্বাসের কাছে তাবাসুসমকে পাঠানোর সাহস পাচ্ছি না। তবে ও এখন দেশে নেই, ইমার্জেন্সি কাজে ওকে বাহিরে যেতে হয়েছে। ও কবে আসবে ঠিক বলতে পারছি না। আর এখানেই আপনার সাহায্য লাগবে। আমি এখন দেশের বাহিরে যেতে পারবো না। আপনি দয়া করে তাবাসসুমকে ইন্ডিয়া নিয়ে যাবেন। কলকাতায় আমার দূরসম্পর্কের কাজিনরা থাকে। ও আপাতত ওখানেই থাকবে। মাস দুয়েক পর আমি গিয়ে নতুন ফ্ল্যাট নিবো আর ওখানে শিফট করে দিবো তাবাসসুম কে।”
শব্দের কথা শুনে রোদসীও চমকে তাকালো শব্দের পানে। সে ভাবেই নি শব্দ তাকে সাহায্য করবে। সে তো আশাই ছেড়ে দিয়েছিলো। তার তো উচ্ছ্বাসের কাছে ফিরে যেতে হবে ভেবেই দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। এখন মনে হচ্ছে আটকানো দমটা ছাড়তে পাড়লো। সাঈফও কিছুটা চমকালো মনে হলো। তা বুঝে শব্দ হাসলো। তারপর বললো,
-“আমি অনেক ভেবেছি সাঈফ সাহেব। এটা ছাড়া আমার কিছু করার নেই। আশা করি আপনি আমার সাহায্য করবেন।”
সাঈফ হাসার চেষ্টা করে বললো,
-“নিশ্চয়ই। পাসপোর্ট আর ভিসা হলেই হবে। আমার তো আছে। রোদসীর আর রিন্তীহার জন্য?”
-“সেটা আমি ম্যানেজ করবো। এক মাসের মতো লাগবে। ততদিনে সব ঠিক হয়ে যাবে।
-“আপনি যা ভালো বোঝেন।”
এখানে রোদসীর ভূমিকা কিছুটা নীরব দর্শককের মতোই। তাদের কথা বার্তা শেষ হবার পর সাঈফ বাসা থেকে বিদায় নেয়। আর শব্দও নিজের রুমে চলে যায়। রোদসী উঠে মিলি খালাকে ডেকে রিন্তীহাকে নিজের কাছে নিয়ে ঘরে চলে যায়।
——
দেখতে দেখতে প্রায় একমাস হয়ে গেলো। আর শব্দের চেনা জানা লোক থাকাতে ভিসা ও পাসপোর্ট হাতে পেতে তেমন কাঠখড় পোড়াতে হয় নি। এই মাসটা রোদসীর কাছে আতঙ্ক ছাড়া আর কিছুই মনে আসে নি। তার কাছে মনে হচ্ছিলো এই বুঝি উচ্ছ্বাস এলো। উর্জাকে তার থেকে নিয়ে যাচ্ছে। এই সব চিন্তা করে রোদসীর ঘুম উড়ে গিয়েছিলো। আজকে রোদসীর ফ্লাইট সব ঘুছিয়ে রোদসী উঠে শব্দের রুমের কাছে যায়। শব্দ ফোনে কারো সাথে কথা বলছে। কথা বলার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে কোনো সিরিয়াস জিনিস নিয়ে কথা হচ্ছে। তাই রোদসী আর শব্দকে না ডেকে রুমে চলে এসে রিন্তীহাকে নিয়ে সাঈফের অপেক্ষা করতে লাগলো। কিছুক্ষণ বাদেই সাঈফ এলো। সাঈফের বিয়ে ঠিক হয়েছে। বেচারা বহুত প্রেশার এসব ভেবেই রোদসী হাসলো। যাক লোকটা নিজের জীবন ঘুছিয়ে তো নিচ্ছে। সাঈফ এসে রিন্তীহাকে কোলে তুলে নিলো। তারপর সব নিয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করলো। সুবিধা অসুবিধা সব জিজ্ঞেস করে নিচে নেমে এলো। তখনও শব্দের দেখা নেই। রোদসী বুঝলো না। তাকে বিদায় দেয়া থেকে ফোনে কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়লো যে সে এখনো নিচেই নামতে পাড়লো না। একটু পরই শব্দ নিচে নামতেই কলিং বেল বেজে উঠলো রোদসী সবার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসে মুখে গেট খুলতেই দরজার ওপাশের ব্যক্তিকে দেখে মুখটা রক্তশূণ্য দেখালো। ভয়াত্মক ছাপ ভেসে উঠলো তার চেহারায়। ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,
-“আপনি।”
আর কিছু বলতে পারলো না। একটা ভয়ংকর থাপ্পড় পড়লো রোদসীর গালে। রোদসী কিছুটা ছিটকে দূরের মেঝেতে পড়ে। ঘরের সবাই চমকে দরজার দিকে তাকালো। দরজায় দাড়ানো ব্যক্তি’ও বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো। এসেই রোদসীর চুল গুলো মুঠোয় নিয়ে জোরে টেনে নিজের মুখের কাছে নিলো। হ্যাঁ…ঠিক এই ভয়ংকর চেহারার মানুষটা থেকে রোদসী পালিয়েছে। এই ভয়ংকর মানুষের রাগ,সন্দেহ, অতিরিক্ত ভালোবাসা এসব কারণেই রোদসী এতদিন পালিয়ে ছিলো। কিন্তু আর পারলো না। ধরা পড়েই গেলো। রোদসীর ঠোঁটের কোণা কেটে ওখানে থেকে র*ক্ত গড়িয়ে পড়লো। কিন্তু আজকে আর মায়া লাগলো না অপরপাশের সেই ব্যক্তির। শব্দের মুখটা স্বাভাবিক লাগলো সাঈফের কাছে। রিন্তীহাকে মিলি খালার কোলে দিয়ে সাঈফ বলে উঠে,
-“কে আপনি? আর ওকে মারছেন কেনো? ছাড়ুন ওকে।”
এটা বলেই এগোতে নিলে শব্দ সাঈফের হাত ধরে। সাঈফ প্রশ্নবোধক চাহনি নিয়ে শব্দের দিকে তাকালে শব্দ মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়। সাঈফের আর বুঝতে সময় লাগে নি সেই ব্যক্তি কে? সে শুধু বিড়বিড় করে বলে,
-“উচ্ছ্বাস।”
#চলবে….
#ভালোবাসা_তারপর
#পর্ব:২৭
#তামান্না_শাহরিন_শশী
কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উন্মুক্ত।
অনুমতি ব্যাতিত কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
-“কে আপনি? আর ওকে মারছেন কেনো? ছাড়ুন ওকে।”
এটা বলেই এগোতে নিলে শব্দ সাঈফের হাত ধরে। সাঈফ প্রশ্নবোধক চাহনি নিয়ে শব্দের দিকে তাকালে শব্দ মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়। সাঈফের আর বুঝতে সময় লাগে নি সেই ব্যক্তি কে? সে শুধু বিড়বিড় করে বলে,
-“উচ্ছ্বাস।”
সাঈফের কথা শুনে সাঈফের দিকে তাকালো উচ্ছ্বাস। সাঈফকে দেখে র*ক্ত মনে হলো আরো ছলকে উঠলো। উচ্ছ্বাস আবারো রোদসীর দিকে তাকালো। রোদসী উচ্ছ্বাসের দিকেই তাকিয়ে আছে। উচ্ছ্বাস রোদসীকে ছেড়ে সাঈফের দিকে এগোতে নিলেই রোদসী উচ্ছ্বাসের হাত টেনে ধরতেই উচ্ছ্বাস রোদসীক দিকে তাকায়। রোদসী শ্বাস আটকে বলে,
-“উনাকে কিছু বলবেন না। উনার এসবের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। যা বলার বা করার আমাকে বলুন।”
কথা শেষ হবার সাথে সাথেই আরো একটা থাপ্পড় পড়লো রোদসীর গালে। রোদসী বাকরুদ্ধ। উচ্ছ্বাস এসে আবারো রোদসীর চুল টেনে ধরে ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-“ওর সাথে তোর সম্পর্ক নেই? তাই না? তাহলে হসপিটাল, তোর অপারেশন সব জায়গায় এই লোকের সিগনেচার কেনো? বল? এই বলতো কিসের কমতি রেখেছি তোর? এতো ভালোবাসলাম তাও শেষে তুই কি করলি? তুই পালালি! সাথে আমার অংশকে তোর মাঝে এলো তুই ধারণ তা করছিস ঠিকি কিন্তু আমি বাবা হয়ে সেই খবর পাওয়ার যোগ্যতা রাখলাম না। তুই সেই খবরটাও আমাকে দিলি না। ফাদার হুডের সব থেকে বেস্ট টাইমটাই তুই আমার থেকে কেড়ে নিলি। কেনো? বল? ভুলটা কোথায় আমার? বল? চুপ করে আছিস কেনো? জবাব দে? এখন উত্তর দে? কি হলো।”
উচ্ছ্বাস কথা গুলো একপ্রকার চেঁচিয়ে বলে রোদসীকে আবারো ছুঁড়ে ফেললো মেঝেতে। ওখানেই বসে থেকে রোদসীও ঠিক একই ভাবে গালে হাত রেখেই কিছুটা জোরালো কন্ঠে বলে উঠলো,
-“আমার সাথে কি করছেন আপনি? আপনার যখন যা মনে চেয়েছে তাই করেছেন, ভালোবাসলে বিশ্বাস থাকার দরকার, আর আপনি আমাকে বিশ্বাস করতেই পারতেন না আর ভালবাসা? আমি আসলে আপনার ভালোবাসা না আপনার ক্ষণিকের মোহ, জেদ। আপনি আমাকে পেতে তপস্যা করেন নি, করেছেন ছলনা । এই কি ছিল আমার ভাগ্যে। কই আমি তো আপনাকে মেনেই নিয়েছিলাম। তবুও কেনো এত ইনসিকিউরিটি? অবিশ্বাস? সন্দেহ?”
ওদের চেঁচামেচিতে রিন্তীহা জেগে কান্না করে দিলো, ওর কান্নার শব্দ ভেসে আসতেই সবার টনক নড়ল। রোদসী উঠতেই যাবে তার আগেই উচ্ছ্বাস যেয়ে মেয়েকে কোলে নেয়। মেয়েকে দেখে উচ্ছ্বাস কেমন শান্ত হয়ে এলো। মেয়ের গালে, সারা মুখে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে তুললো। মেয়েও উচ্ছ্বাসের কোলে যেয়ে কেমন শান্তবাচ্চার মতো চুপ হয়ে শরীরের সাথে লেপ্টে গেলো। এখানে সাঈফ, শব্দ, মিলি খালা সবাই নীরব দর্শক। রোদসী উঠে বাবুর কাছে আসতে নিলেই উচ্ছ্বাস বলে উঠে,
-“তুই মেয়ের আশেপাশেও আসবি না। তোর জন্য আমি আমার বাবা হবার সর্বশ্রেষ্ঠ মুহুর্তের অনুভূতি অনুভব করতে পারিনি। শুধু মাত্র তোর কারণে! কোথায়, কোথায় না খুঁজেছি তোকে। আর তুই এতো কিছু লুকিয়ে এখন এদেশ থেকেই পালাবি? থ্যাংক্স টু শব্দ যে আমাকে বললো আমার মেয়ে আর বউ এখানে। ওহ হ্যাঁ,তুই তো আমার থেকে মুক্তি চেয়েছিস। তাই তো এতো লুকোচুরি তাই না? আচ্ছা যা দিয়ে দিলাম মুক্তি। তোর যেখানে ইচ্ছে চলে যা কিন্তু তুই আর মেয়ে পাবি না। এখন দু-চোখ যেদিকে যায় তুই চলে যা।”
উচ্ছ্বাসের এতে কথা শুনে মনে হলে রেদসীর দুনিয়া থমকে গেলে। মেয়ে ছাড়া সে থাকবে কি করে। রোদসী এবার শব্দ দিকে তাকালো। শব্দ কিভাবে পারলো। শব্দ বোধহয় রোদসীর মনের কথা বুঝলো। তাই বললো,
-“উচ্ছ্বাস মাথা ঠান্ডা কর। আমরা বসি। কথা বলি। প্লিজ। এদিকে আয় বস!”
উচ্ছ্বাস যেয়ে সোফায় বসে পড়ে। শব্দ আর সাঈফ ও যেয়ে বসে অপর পাশে। রোদসী কোনো মতে উঠে এসে দাঁড়ায়। শব্দ রোদসীর মুখের দিকে তাকিয়ে পাশের সোফায় বসতে ঈশারা করে। তাই রোদসীও আস্তে যেয়ে বসে পড়ে। তারপর শব্দ মুখ খোলে,
-“ভেবেছিলাম বলবো না। কিন্তু এতো বড় একটা অন্যায় আমার দ্বারা হচ্ছিলো না। গিল্টি ফিল হচ্ছিলো। বারবার মনে হচ্ছিলো আমি উচ্ছ্বাসকে ঠকাচ্ছি। ওর তো হক আছে ওর মেয়েকে আদর করার, তোকে নিয়ে শান্তিতে থাকার। আর উচ্ছ্বাস এখন পুরোপুরি সুস্থ হয়েছে কিনা জানি না তবে সে নিয়মিত কাউন্সিলং করেছে। আর তোর যেই ভয়, মেয়েকে কিছু করে ফেলবে। তুই একবার উচ্ছ্বাসের মুখের দিকে তাকা? ওকে দেখে মনে হয়? ও ওর নিজের অংশ কে কখনো কষ্ট দিতে পারবে? যে মানুষটা খবর পাওয়ার পর থেকেই এতো ছটফটিয়ে রয়েছে নিজের বাবুকে দেখার জন্য, কোলে নেয়ার জন্য, আদর করার জন্য, তা আমি নিজের চোখে দেখিছি। সেখানে উচ্ছ্বাস ওর মেয়ের থেকে বঞ্চিত থাক তা আমি পারবো না। তাই আমিই বলে দিয়েছি এবং বাসায় আসতে বলেছি।”
রোদসী বাকরুদ্ধের মতো শুধু শব্দের দিকে তাকিয়ে রইলো। অপরদিকে উচ্ছ্বাস স্বাভাবিক। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে এসব সবই জানতো। কিন্তু রোদসীর ঠিক উল্টো তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে শব্দ এতো সাহায্য করে শেষে এসে এভাবে চাল বদলিয়ে দিবে। শব্দ আবারো বললো,
-“উচ্ছ্বাস দেখ ভাই আমার তাবাসসুমের কথায় কিছু মনে করিস না। ওর মাথা ঠিক নেই। ও ট্রমাতে আছে। তাই প্লিজ এভাবে রাগা রাগি না করে তোরা ঠান্ডা মাথায় এই ব্যাপারটা ক্লিয়ার কর। তাও প্লিজ একজন আরেকজনকে ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবিস না। উর্জাকে নিয়ে ভাব। প্লিজ ভাই আমার।”
উচ্ছ্বাস মাথা নাড়লো। যে সে বিষয়টা ভেবে দেখবে। শব্দ হাফ ছাড়লো। সাঈফও উঠে দাড়ালো। তার এখানে আর কাজ নেই। তাই সাঈফ আলতো হেসে উচ্ছ্বাসকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
-“কোথা থেকে শুরু করবো আমি বুঝতে পারছি না। আমি জানি আপনার সাথে যা ঘটছে তা খুবই খারাপ হয়েছে। তবুও আমরা মানুষ, ভালো-খারাপ নিয়েই আমরা। কোনো মানুষও ভুলের উর্ধ্বে নয়। তাবাসুসম ভুল করেছে। সেই শাস্তি তাবাসুসম বা রিন্তীহাকে দেবেন না। ওরা সুন্দর একটা পরিবার ডিজার্ভ করে। আর আমার সাথে দেখে, আপনি স্বামী হিসেবে খারাপ লাগবে তা স্বাভাবিক। তাই তার জন্য আমি ভীষণ ভাবে দুঃখিত। আর সব ভুলে আশা করবো সব ভুলে আপনি তাবাসসুমকে নিয়ে সুখে থাকবেন। আমার যেতে হবে, এখানে আর আমার কোনো কাজ নেই। ভালো থাকবেন আপনারা। আর হ্যাঁ, সামনের মাসে আমার বিয়ে আপনারা অবশ্যই আসবেন।”
সাঈফ বিদায় নিয়ে চলে যেতেই শব্দও উঠে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। এখান এদের একটু ব্যাক্তিগত সময় দেয়া উচিত।
#চলবে…