ভালোবাসা তারপর পর্ব-২৮+২৯

0
241

#ভালোবাসা_তারপর
#পর্ব:২৮
#তামান্না_শাহরিন_শশী

কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উন্মুক্ত।

অনুমতি ব্যাতিত কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

সাঈফ বিদায় নিয়ে চলে যেতেই শব্দও উঠে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। এখান এদের একটু ব্যক্তিগত সময় দেয়া উচিত। রোদসী উচ্ছ্বাসের দিকে তাকালো। কিন্তু উচ্ছ্বাস রোদসীর দিকে ফিরেও তাকালো না। সে তার মেয়েকে নিয়েই ব্যস্ত। রোদসীর কেমন দম বন্ধ হয়ে এলো। নিজের কাছে নিজেই অপরাধী হয়ে গেলো। রোদসী উচ্ছ্বাসের মুখে একপ্রকার অবজ্ঞা দেখতে পেলো। রোদসীর কাছে সেটা চরম কষ্টদায়ক। আমরা যাদের চোখে সব সময় সমুদ্রের মতো স্বচ্ছ ভালোবাসা দেখি তার চোখে নিজের জন্য অবজ্ঞা বা বিতৃষ্ণা দেখি তা আমরা কখনোই মানতে পারি না। রোদসী বিনাবাক্যে উঠে উচ্ছ্বাসের কাছে আসলো। উচ্ছ্বাস বুঝলো রোদসী এসেছে তবে ইচ্ছে হলো তা সেই মুখের দিকে তাকাতে। এতো ভালোবাসার পরও এমন টা রোদসী কিভাবে করলো তা চিন্তা করলেই মাথায় রক্ত উঠে যায়। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বাবুকে নিয়ে ব্যস্থ থাকে উচ্ছ্বাস। রোদসী দেখলো উচ্ছ্বাস কোনো প্রতিক্রিয়া করছে না তাই সেও সাহস পেলো না কিছু বলার। তারই লাগেজ একটা তুলে নিজের রুমে চলে আসে। রোদসী যেতেই উচ্ছ্বাস মুখ তুলে তাকিয়ে তার যাওয়া দেখে। রোদসী রুমে এসে লাগেজ থেকে একটা শাড়ি নিয়ে ওয়াসরুমে চলে যায়। এই ভেবে একটু শাওয়ার নিলে বোধহয় শান্তি লাগবে। রোদসী গোসল দিয়ে বেরিয়ে এসে দেখে উচ্ছ্বাস বাবুকে নিয়ে বিছানায় বসে আছে। রোদসী মনে মনে কিছুটা চমকালো। তারপর কাছে আসতেই উচ্ছ্বাস বলে ওঠে,

-“বাবু মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে। কাঁদছে ওকে ফিডিং করাও।”

এটুকু বলেই উচ্ছ্বাস উঠে বারান্দায় চলে যায়। আর রোদসী অবাক হয়ে তাকায়। তখনকার উচ্ছ্বাসের সাথে এখনকার উচ্ছ্বাসের কোনো মিল নেই। যেমন টা একটা পয়সার এপিঠ-ওপিঠ ঠিক তেমনই তখন আগুনের লাভা আর এখন ভীষণ ঠান্ডা পানির স্রোত। রোদসী আর কিছু না ভেবে রিন্তীহাকে কোলে তুলে নেয় ফিডিং করানোর উদ্দেশ্য কিন্তু তার চোখ এখনো বারান্দায় দাড়িয়ে থাকা লোকটার দিকেই। লোকটা কতটা বদলে গেছে। আগের মতো আর পাগলাটে লাগছে না। আচ্ছা রোদসী কি তার সমস্ত জীবন সবথেকে বড় ভুল করেছে উচ্ছ্বাসকে এভাবে রেখে এসে? নিজের ভিতর হাঁতড়ে ও উত্তর খুঁজে পেলো না। আসলেই মানুষের জীবন সব সময় এক থাকে না। এদিন যার থেকে পালানোর জন্য রোদসী মরিয়া হয়ে উঠেছিলো আর আজকে তাকে দেখে, তার চোখে নিজের প্রতি বিতৃষ্ণা, অবজ্ঞা দেখে তা নিতে পারছে না রোদসী! ভিতর থেকে মনে হচ্ছে কেউ গলা টিপে মেরে ফেলছে। রোদসী চোখবন্ধ করে একটা বড় শ্বাস টানলো সাথেই গড়িয়ে পড়লো চোখের বিন্দু জলরাশি। আর তা উচ্ছ্বাস দেখলো বারান্দায় দাড়িয়ে তারপর চোখ সরিয়ে আবারো বাহিরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। আসলেই জীবনটা বড়’ই জটিল।

——

রাতে খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে রোদসী আর উচ্ছ্বাস রুমে চলে আসে। রুমে এসে রোদসী বিছানায় বসে আর উচ্ছ্বাস বারান্দায় চলে যায়। কিছুক্ষন পর শব্দ এসে দরজায় নক করতেই রোদসী দরজার দিকে তাকায়। তারপর চোখ ঘুড়িয়ে বারান্দায় তাকায়,উচ্ছ্বাস রুমেই দেখছিলো তাই সে এসেই দরজা খুলে দিতেই শব্দ রুমে এসে বসে। তারপর দুজনের মুখ পরক্ষ করে বলে বসতে। উচ্ছ্বাসের ইচ্ছে না থাকা স্বত্বেও বসে। শব্দ কিছুক্ষণ পর মুখ খোলে,

-“তাবাসসুম?”

রোদসী শব্দের দিকে তাকায়। শব্দ বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে,

-“আমি জানি তুই আমাকে খারাপ আর স্বার্থপর ভাবছিস। আমি এতো আয়োজন করেও শেষে ওকে বলে দিয়েছি তাই। কিন্তু তুই একবার ভাব, এই কাজটা করলে আমার অনেক গিল্টি ফিল হতো। আমি নিজের বিবেকের কাছে দিনদিন মরে যেতাম। আমি এতিম বলতে পারিস মা-বাবার আদর কখনোই পাইনি। আর যা পেয়েছি হয়তো তা ভুলেও গিয়েছি। তাই রিন্তীহাকে তার বাবার কাছ থেকে দুরে আমি পাঠাবো, একাজ ভাবতেই কেমন লাগছিলো, এগুলো আমার দ্বারা হচ্ছিলো না।

এটুকু বলেই থামে শব্দ তারপর উচ্ছ্বাসের মুখের দিকে তাকালো উচ্ছ্বাস উর্জার দিকে তাকিয়ে আছে। তাই চোখ সরিয়ে আবারো রোদসীর পানে তাকিয়ে বলতে শুরু করে,

“আমার জানা মতে, তোর শাশুড়ী উচ্ছ্বাস জন্ম হবার পরই মারা গেছে। ওর জীবনেও আদর-ভালোবাসার অনেক কমতি আছে। আবার অনেক কিছুই আছে যা আমরা দেখি তা সত্যি নয়। অনেকবার বোঝাতে যেতেও পারিনি। যদি তুই আমাকে ভুল বুঝিস তাই। এখন যেহেতু তোরা সামনেই আছিস তাই এখানেই ক্লিয়ার করছি সব। উচ্ছ্বাস মা -বাবার ভালোবাসা পায় নি। হোস্টেলে থেকে বড় হয়েছে। তাও নিজের মতো করে। ও তোকে ভালোবাসে। আর ও যে সমস্যা টা আছে তার জন্য ও নিয়মিত ডক্টর দেখিয়েছে। তুই আর রাগ করে থাকিস না সব মিটমাট করে নে।”

তারপর উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে বলে,

“তোর কোথায় সমস্যা আশা করি তুই বুঝেছিস। তোর অতিরক্তি পজেসিভনেস, অ্যাংগার ইস্যু, ইনসিকিউর ফিল করা এসব করা আসলেই উচিত নয়। আশা করবো পরের বার থেকে এগুলো সামলে চলবি। এখন তোদের মেয়ে আছে। আর যাই করিস নিজের মতো মেয়েটাকে অভাগা করিস না। তুই যে আদরটা পাসনি এখন সেই আদর থেকে উর্জাকে বঞ্চিত করবি না। মানুষের জীবনে ভুলত্রুটি হতেই থাকবে। আমরা কেউ ভুলের উর্ধ্বে নেই। তোর এসব কর্মের কারণে তাবাসসুম ভয় পেয়ে পালিয়েছে। তাই এগুলো ছাড়। তাই আশা করি যা-ই করবি মাথা ঠান্ডা রেখে করবি। দুজনই তোদের ঝামেলাটা মিটিয়ে নে। সংসার জীবন মানেই মেনে এবং৷ মানিয়ে চলা। বুঝেছিস? আর তাবাসসুম কে হাজার হলেও আমি বোনের মতো আগলে রেখেছিলাম। বোনের জায়গা দিয়েছি ওর কষ্ট আমি সহ্য করতে পারবো না। যদিও আমাদের কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। আর তোর এইসব ইস্যু কমাতে না পারলে আমি আবার আমার বোনকে নিয়ে লিগ্যাল ভাবে কোথাও চলে যাবো কিন্তু। খোঁজ ও পাবি না। এখন কি করবি ভেবে দেখ আমি গেলাম।

এটুকু বলেই শব্দ উঠে রুম থেকে চলে যায়। আর উচ্ছ্বাসও শব্দের পিছন পিছন এসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে রোদসীর দিকে তাকায়। তারপর কিছু না বলে বিছানায় এসে উর্জাকে বুকে নিয়ে শুয়ে পড়ে। আর রোদসী বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। উচ্ছ্বাস কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে সুয়ে থেকে ফোন বের করে সবাইকে জানিয়ে দেয় সে রোদসীকে পেয়েছে, সাথে রিন্তীহার কথাও জানিয়ে দেয়। এটা শুনে সবাই তাড়াতাড়ি রোদসীকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে বললে উচ্ছ্বাস জানায় কালকে বাসায় ফিরবে। উচ্ছ্বাসকে এমন স্বাভাবিক ভাবে ফোনে কথা বলতে দেখে রোদসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে যাক। এখন শান্ত হয়েছে এটাই অনেক। রোদসীও কিছুক্ষণ উর্জাকে আর উচ্ছ্বাসকে দেখে তাদের পাশেই শুয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ করতেই মনে হলো এতোদিন এই শান্তিটা তার অনুভব হয় নি। রোদসী চোখ বন্ধ করতেই উচ্ছ্বাস রোদসীর দিকে তাকায়। এই মেয়েটার জন্য উচ্ছ্বাস কত কি করলো আর মেয়েটা বুঝলোই না। এসব ভেবেই তাচ্ছিল্য হাসলো। বাবু নড়েচড়ে উঠে কান্না করতেই রোদসী হন্তদন্ত হয়ে উঠে বসেতেই উচ্ছ্বাসকে দেখে শান্ত হয়ে বলো,

-“ওকে আমাকে দিন।”

রিন্তীহাকে দিয়ে উচ্ছ্বাস ওভাবেই তাকিয়ে রইলো তার দেখে রোদসীর আড়ষ্ট লাগলো। তা বুঝে উচ্ছ্বাস মনে মনে শয়তানী হাসলো তারপর আরো গভীর দৃষ্টিতে রোদসীর দিকে তাকালো। এতে রোদসীর আরো হেজিটেড লাগলো। কিছুটা নিচুস্বরে বলে,

-“আপনি কি এভাবেই তাকিয়ে থাকবেন নাকি আমার অস্বস্তি হচ্ছে।”

উচ্ছ্বাস এবার আর প্রতিক্রিয়া করলো না। সোজা উঠে বারান্দায় চলে গেলো। কিছুক্ষণ বাদে রোদসী এসে বারান্দায় উচ্ছ্বাসের পিছনে দাঁড়ায়। রোদসী আসার আভাস পেয়েই হাতের আধখাওয়া সিগারেট টা ফেলে রোদসীকে পাশ কাটিয়ে রুমে চলে আসে। আর রোদসী অসহায় মুখ করে তাকিয়ে থাকে উচ্ছ্বাসের পানে। তারপর ভাবে, আসলেই এই জিনিস কখনো ভাব হয়নি। উচ্ছ্বাস বলতে গেলে একপ্রকার এতিমই রোদসী সেই গল্প দাদুর কাছ থেকে শুনেও এমন একটা বোকামী করলো। আর এতোকিছু হয়ে গেলো উচ্ছ্বাস কি জানে না তাকে পালাতে বিপাশা বেগম সাহায্য করেছে। না জানলে উচ্ছ্বাসের মতো লোক শান্ত থাকতো না। নিশ্চয়ই এই খবর কেউ পায় নি তাই উচ্ছ্বাস এই তান্ডব কমিয়েছে। কিন্তু যখন জানবে? এমনিতেই উচ্ছ্বাস বিপাশা বেগমকে সহ্য করতে পারে না তার ওপরে এতো গুলো কথা জানতে পারলে খোদাই জানে উচ্ছ্বাস যে কোন তান্ডব চালাবে!

#চলবে।

#ভালোবাসা_তারপর
#পর্ব:২৯
#তামান্না_শাহরিন_শশী

কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উন্মুক্ত।

অনুমতি ব্যাতিত কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

রৌদ্রজ্বল দিন। সকাল বেলা ব্রেকফাস্ট করে শব্দ জানায় সে রোদসীকে দিয়ে আসতে যাবে উচ্ছ্বাসের সাথে। এতে উচ্ছ্বাসও কোনো দ্বিমত পোষণ করে না। এটা শুনে রোদসী হাফ ছাড়ে। রোদসী ভেবেছিলো হয়তো উচ্ছ্বাস গড়িমসি করবে। এমনিতে মেনে গিয়েছে, তাই আর কিছু বললো না। সবকিছু গুছিয়ে তারা বেলা এগোরেটার দিকে রওনা হয় উচ্ছ্বাসদের বাসায়। তাদের পৌছাতে প্রায় একঘন্টার মতো লাগে। বাসায় রোদসীদের বাড়ির সবাই উপস্থিত। রোদসীরা যখন বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলো, বাসার সবাই রোদসীর দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে ছিলো। সবাই মনে হলো হচ্ছে কথা’ই হারিয়ে ফেলেছে। সব থেকে বোধহয় ঊষাই বেশি অবাক হয়। রোদসীর সাথে শব্দকে বাসায় প্রবেশ করতে দেখে। সে এক দৃষ্টিতে শব্দের দিকেই তাকিয়ে আছে। কেউ কোনো কথা বলতে পারলো না। রোদসীর মা মিসেস তানি বেগম এগিয়ে এসে উচ্ছ্বাসের কোল থেকে রিন্তিহাকে কোলে তুলে নিলো। কিন্তু রোদসীর বাবা মাহফুজ সাহেব বসে’ই আছে। সবাই রিন্তীহাকে দেখলেও মাহফুজ সাহেবের এমন শান্ত প্রতিক্রিয়াতে মনে মনে ভয় পায়। মাহফুজ সাহেব হঠাৎ বসা থেকে উঠে দাড়ালো, ধীর পায়ে রোদসীর সামনে দাড়িয়ে রোদসীর মুখের দিকে তাকায়। তারপর হঠাৎ করেই রোদসীকে চড় দিয়ে বসে। রোদসী গালে হাত রেখেই অবাক চোখে তার বাবার দিকে তাকায়। তার বাবা তার সব ইচ্ছে পূরণ করেছে কখনো বড় গলায় পর্যন্ত কথা বলে নি। সেই লোক হঠাৎ করে এমন ভাবে চড় দেয়ায় বাড়ির সবাই বাকরুদ্ধ। মিসেস তানি বেগম রিন্তীহাকে ঊষার মা’ মিসেস মালিহা বেগমের কাছে দিয়ে, এসে সে মাহফুজ সাহেবকে টেনে ধরে বলে,

-“কি করছেন? এতো বড় মেয়ের গায়ে হাত তুলছেন?”

-“তুলবো না? কি করেছে’ও? পুরো এক বছরের বেশি গায়েব থেকেছে। আমাদোর ওপর কতটা প্রেশরে রেখেছে সেটা জানে ও। আর তুমি বলছো ওকে মারছো কেন? ওকে তো মেরে ফেলা উচিত। ও পলিয়ে গেছে, আর বাহিরের মানুষ আজেবাজে কথা বলেছে আমাদের। ওর জন্য এসব কেনো শুনতে হবে আমাদের? কেনো বলতে পারো?”

এসব বলতে বলতেই মাহফুজ সাহেব উত্তেজিত হয়ে উঠে আবারো ধপ করে বুকে হাত দিয়ে সোফায় বসে পরে। রোদসী ছলছল চোখে এতক্ষণ বাবার কথা শুনছিলো। যে যখন এগিয়ে আসতে চাইলো মাহফুজ সাহেব হাত উঁচিয়ে তার কাছে আসতে বারণ করে দেয়। শব্দ এতসময় নির্বাক বাবা-মেয়ের কথপোকথন দেখছিলো তবে এবার আর চুপ থাকতে না পেরে কিছুটা এগিয়ে এসে কৈফিয়ত দেয়ার ভঙ্গিতে বলে,

-“আসসালামু আলাইকুম, আংকেল। আমি মুনীব শব্দ। ”

আর কিছু বলার আগেই মাহফুজ সাহেব বলেন,

-“জানি বাবা। উচ্ছ্বাস বাবা বলেছে, এতদিন তোমার কাছেই রোদ ছিলো। তার জন্য তোমার প্রতি আমরা অনেক কৃতজ্ঞ। আমার মেয়েটা দেখে রাখার জন্য। তবে একটা বার ভাবো, আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে চিন্তা করে দেখো তো। ও যদি কোনো খারাপ জায়গায় পৌঁছে যেতো। তখন কি হতো? তুমি ভালো মানুষ তাই ওকে আগলে রেখেছো। তোমার বদলে যদি কোনো খারাপ মানুষের খপ্পরে পড়তো? মেয়েটা এমনিই বোকা। তার মধ্যে এমন একটা বোকামী করে বসবে আমরা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ বাবা।

এটুকু বলেই সে থামে। তারপর জোড়ে শ্বাস টেনে আবারো রোদসীর দিকে তাকায়। তারপর তানি বেগমের দিক তাকািয়ে আবারো শব্দের দিকে তাকায়। শব্দ কিছুটা লজ্জিত এবং বিনীত ভঙ্গিতে মেঝের দিকে চোখ নামিয়েই বলতে শুরু করে,

-“আমার ছোটো বেলাতেই মা-বাবা মারা গিয়েছে। মানে এক কথায় আমাকে এতিম বলতে পারেন। হোস্টেলেই উচ্ছ্বাসের সাথে বড় এবং পড়ালেখা করা হয়েছে আবার। পরিবার বলতে আমার, ছিলো শুধু একটা বোন তাকেও কিছু…..

একটু থামে শব্দ। সবার মুখ দেখে, সবাই তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। তাই সে আবারো মেঝেতে দৃষ্টি নিবন্ধন করে বলে,

-“মানুষ বলবো? ওরা মানুষ হতে পারে না আংকেল! কিছু জা*নো*য়া*র* রা রে*..প করে মে*রে ফেলেছে। তারপর কত কিছু করলাম? কিণ্তু জাস্টিস পেলাম না। একদিন কাজের জন্য আমার নারায়নগন্জ যেতে হয়েছে। সেই বাসেই আমি তাবাসুসম কে পাই। ও অনেক ভয় পেয়েছিলো। বিশ্বাস করেন আংকেল….

শব্দ আবারো মাহফুজ সাহেবের দিকে তাকালো। থেমে শ্বাস নিয়ে আবারো বলতে শুরু করলো,

-“তাবাসুসম কে দেখে মনে এক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো আমি আমার শ্রেয়াকে দেখলাম। ওর সাথে কথা বলারও চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু ও অনেকটা ঘাবড়ে ছিলো। পরে একটু আধটু কথা হবার পর ও সেন্সলেস হয়। কিছু সংকোচ নিয়েই আমি ওর নার্ভ চেইক করতে যেয়ে দেখি ওর শরীরে প্রচুর জ্বর সাথে এতটা ঘাবড়ে যাওয়ার কারণে ওর প্যানিক এট্যাক হয়েছিলো। আর কিছু ভাবতে পারলাম না। তাই ওকে আমার বাসায় নিয়ে গেলাম। ও সুস্থ হবার পর জানতে পারলাম ও চট্টগ্রাম যাবার উদ্দেশ্য গাড়িতে উঠেছে। কিন্তু ও ভুলবশত অন্য বাসে উঠে পড়েছিলো। তারপর থেকেই ও আমার কাছেই থেকেছে। বিশ্বাস করুন আংকেল আমার মনে হয়েছে আমার শ্রেয়া আমার আশেপাশেই রয়েছে। শ্রেয়াকে হারিয়ে আমি আর একটা শ্রেয়াকে পেয়েছি। তারপর যখন ওর অভিযোগ শুনলাম তখন আমার নিজেরই রাগ লেগেছিলো। যার কারণে আমি নিজেই জোর করে ওকে এখানে পাঠাইনি। তবে যখন বিপাশা আন্টি অসুস্থ হলো। উচ্ছ্বাসের সাথে দেখা হলো ওর বউয়ের ব্যাপারে কথা হলো মনে মনে আমারো কিছুটা খটকা লেগেছিলো৷ কিন্তু তাবাসুসমকে জিজ্ঞেস করা হয় নি। তারপর তো এই সব ক্লিয়ার হলো। তাবাসসুম এখন আপনাদের কাছে। এখন আমি তাবাসসুম কে আপনাদের মেয়ে বলে ফিরিয়ে দিতে আসিনি। আমি এসেছি আমার বোনকে তার শ্বশুর বাড়ি যেতে। ও এখন আপনাদের কাছে একপ্রকার আমানত বলতে পারেন। এখন তাবাসসুম আমার ছোটো বোনের। আর এই বিষয়টা এখানেই শেষ করলেই ভালো হয়। যা হবার তা হয়ে গেছে। তাবাসসুম নিজেও অনুতপ্ত। ওর হয়ে আমি মাফ চাইছি। দয়া করে ওকে আর কিছু বলবেন না।”

এসব কথা একসাথে বলে শব্দ থামে তারপর সবার মুখের দিকে তাকিয়ে পরক্ষ করে নেয়। কেউ আর কোনো কথা বলতে পারে না। সবাই চুপচাপ। রোদসী এখনো একপাশে দাঁড়িয়ে শব্দ বিহীন কান্না করছিলো। আসলেই মাত্র একটা ভুলের কারণে কতকিছু হলো। আর সেই সময়ই মিসেস বিপাশা বেগম নেমে আশে তার সাথে আরো একটি মেয়ে। রোদসী সেদিকে তাকালো। এ কোন বিপাশাকে রোদসীকে দেখছে? একটা কংকালসার শরীর চোখ যেয়ে চোখের নীচে কালো দাগ পড়ে গেছে। সে ওই মেয়েকে ধরে ধরে এসে সবার মাঝেই দাঁড়ালো। তারপর সবার মুখ দেখে রোদসীর দিকে তাকালো। রোদসী তার মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলো৷ তাই বিপাশা বেগম চোখ সরিয়ে নিলো। সে যেয়ে একটা সোফায় বসে পড়লো। এখন আর আগের মতো কিছুই নেই, না শরীর না অহংকার৷ শরীরে শক্তি পায় না।

উচ্ছ্বাস একটা ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে ওই মেয়েকে দেখে বললো,

-“বর্ষা না? কেমন আছিস? কখন এলি?

বর্ষা নামের মেয়েটি কিছু বলার আগেই বৃষ্টি বলে উঠলো,

-“আপু কালকে রাতে এসেছে।”

বর্ষা মূলত বৃষ্টির কাজিন। বর্ষা অবাক হয়ে রোদসীর দিকে তাকায়। যখন হঠাৎ শুনেছিলো উচ্ছ্বাস বিয়ে করেছে সে কি কান্না। বিপাশা বেগমের কাছে কল করে পর্যন্ত কান্না করেছে। এখন মেয়েটাকে দেখে বর্ষা অবাক হলো। যার জন্য বর্ষা কান্না করে পা*গ*ল প্রায় দশা হয়েছে আর সেই পুরুষকে রেখে কেউ পালিয়ে যেতে পারে? কিছুদিন আগে যখন বিপাশা বেগম তাকে আসতে বলে সে অনেক খুশি হয়। সে বৃষ্টির কাছে শুনেছিলো উচ্ছ্বাসের বউ পালিয়েছে। তাই আরো আগেই আসতে চেয়েছিলো কিন্তু তার অনার্সের ইয়ার চেইঞ্জ পরীক্ষার জন্য আসতে পারেনি। এখন পরীক্ষা শেষ হতেই এসে পড়েছে। আর সে আসতেই এই বউকে ফেরত আসতে হলো? বর্ষার মন খারাপ হয়ে এলো। তবুও বর্ষা মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,

-“আমি ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?”

-“হ্যাঁ, ভালো। কতদিন থাকবি?”

-“ঠিক জানি না।”

ওদের কথপোকথন দেখে মনে হচ্ছিলো এখানকার পরিবেশ স্বাভাবিক। এখাানে কিছু হয় নি। একটু আগে এতো কিছু হয়ে গেলো এতে উচ্ছ্বাসের কোনো মাথা ব্যাথা নেই। সে এবার সবার দিকে তাকায়। তারপর বলে,

-“মেয়েকে আমার কোলে দেও। আমি রুমে যাচ্ছি। তারপর যার যা ইচ্ছে করুক। আর বর্ষা শোন, আমাকে একটু উর্জার খাবারটা দিয়ে যা।

নিত্যান্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সে রিন্তীহাকে কোলে নিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। সবাই ওর প্রস্থান দেখলো। আর রোদসী বোধহয় কথাই হারিয়ে ফেললো। তাকে না বলে কোন মেয়ে এসেছে তাকে অর্ডার করা হচ্ছে তাও তার মেয়ের জন্য? রোদসীর অনেক কান্না পেলো তবুও ঠোঁট কামরে কান্না আটকানো চেষ্টা করলো।

আর একদিকে বর্ষার ভিতরকার পাখিটা কেমন ছটফটিয়ে উঠলো। এর আগে এই বাসায় আসলেও উচ্ছ্বাসের সাথে দেখা অনেক কমই হয়েছে। আর উচ্ছ্বাস কখনোই বর্ষার সাথে বেশি কথা বলে নি। আজকে ডেকেছে তাই সে ঠিক অষ্টাদশী কিশোরীর মতো ছটফটিয়ে উঠে রিন্তীহার খাবারটা নিয়ে উচ্ছ্বাসের রুমের দিকে চলে গেলো। রুহি এসে রোদসীকে ধরে একটা সোফায় বসে এটা ওটা জিজ্ঞেস করে কথা বলে। কিন্তু এখানে একজনই এখনো স্তব্ধ এবং অবাক ও ঘোরের মধ্যে পড়ে আছে। আর সে হলো ঊষা। সে এতকিছু হবার পরও তার মাথায় যেন কিচ্ছুটি ঢুকছেই না। তার মুখ থেকে কোনো কথা বলতে পারলো না। সবাই কথা বার্তা মিটিয়ে নিতেই শব্দ বিদায় নিয়ে। শব্দ বাসা থেকে বের হবার সময় একবার শুধু ঊষার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।

#চলবে…..

ভুলত্রুটি ক্ষমা মার্জনীয়।