ভালোবাসা হাত বাড়ালো পর্ব-৭+৮

0
14

#ভালোবাসা_হাত_বাড়ালো
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ০৭

ছেলের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পর মীর সাহেব অনুভব করলেন ছেলে তার সত্যিই আরোহী মেয়েটাকে অনেক পছন্দ করে আর মেয়েটাও রাজি তাই ছেলের পছন্দে আপত্তি করার কোনো কারণ নেই। মীর সাহেব নিজেই দায়িত্ব নিলেন নীলের মাকে বোঝানোর জন্যে ওদিকে আরোহীও বাড়িতে জানায় ও নীলকে বিয়ে করতে চায়। এ কথা শোনার পরেই ওর মা যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে বসলো। উনি তো শুরু থেকেই চাইছিলেন তার মেয়ে যেনো বিয়েতে রাজি হয়। যদিও বোনের হঠাৎ বিয়েতে রাজি হয়ে যাওয়ার বিষয়টা আশফেরের কেমন খটকা লাগলো কারণ আশফের নিজেও আরোহীর সঙ্গে কথা বলেছিলো এ বিষয়ে। বারবার বিয়ে করতে অস্বীকার করা মেয়ে হঠাৎ বিয়েতে রাজি হয়ে গেলো? রওশন বেগমকে মীর সাহেব অনেক বোঝান, নীল নিজেও মাকে বোঝায়। কয়েকদিন বোঝানোর পর অবশেষে ছেলের খুশির কথা ভেবে রওশন বেগম বিয়েতে রাজি হন। উভয় পরিবারের মধ্যে সাক্ষাৎ পর্ব শেষ হয়ে বিয়ের পাকা কথা হয় এবং বিয়ের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। আরোহীর অনুরোধে পারিবারিকভাবেই বিয়েটা হবে বলে ঠিক করা হয়। সকলে খুশি হলেও রওশন বেগম ভীষণ বিরক্ত, বিশেষ করে আরোহীর মায়ের আচরণে উনি মনে মনে আরোহীর প্রতি আরো বিরক্ত হন এদিকে আরোহীর মা তো ডাক্তার জামাই ও বড়লোক বাড়ির ছেলে পেয়ে বেজায় খুশি। নীলের বড় বোন জাপান থেকে আসবে ভাইয়ের বিয়ে অ্যাটেন্ড করতে তাই বিয়ের ডেট সে হিসেবেই নির্ধারণ করা হলো। সবকিছুই কেমন দ্রুত হয়ে যাচ্ছে, আরোহীর মনের সেই পুরোনো ভয়টা এখনও কাটেনি। প্রথম বিয়েটাও এমন হুটহাট হয়ে গেছিলো, তার কিছু সময় বাদেই ওর জীবনে ঝড় নেমে এলো। আরোহী জানেনা এবার কি হবে, এসব নিয়ে আপাতত ভাবতেও চায়না। এ মুহূর্তে বিয়েটা করা জরুরি। পরেরদিন নীল কাজের ফাঁকে কিছুটা সময় বের করে আরোহীকে নিয়ে শপিং করতে যায়, আরোহী অতি প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস ব্যতীত তেমন কিছুই কিনলো না। নীলও জোর করেনি, আরোহীকে কোনো বিষয়েই সে জোর করতে চায়না। নীল নিজের কেনাকাটাও করে নেয়। শপিং শেষে একটা রেস্টুরেন্টে বসলো ওরা, খেতে খেতে আরোহী নীলকে বললো…

— একটা কথা জিজ্ঞাসা জিজ্ঞাসা করবো?

— বলো!

— আপনার মা কি আমার ওপর রেগে আছেন!

খাওয়া ছেড়ে চোখ তুলে তাকালো নীল…

— মা কিছু বলেছে তোমাকে?

— না, তবে ওনাকে বিরক্ত দেখাচ্ছিলো, আপনি তো আমার সম্পর্কে সব জানিয়েছেন। উনি হয়তো আমাকে মেনে নিতে পারছেন না। আপনি কি আপনার মাকে জোর করে এই বিয়েতে রাজি করিয়েছেন?

মা কে জোর করে রাজি করানো হয়েছে এই বিষয়টা নীল প্রকাশ করলো না, আরোহীর হাতে হাত রেখে আশ্বাস দিয়ে বললো…

— আরোহী, তুমি এখন আর কোনো দ্বিতীয় বিষয় নিয়ে ভেবো না। সব ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। কেউ তোমার ওপর রেগে নেই আর এখন যা হওয়ার ভালোর জন্যেই হবে

— ধন্যবাদ নীল, আপনি এতো সহজেই আমাকে সাহায্য করতে রাজি হবেন আমি ভাবিনি। আসলে আমি..আমি যদি এই মুহূর্তে এতোটা বাধ্য না হতাম তবে এই বিয়েটা…

— এখন এসব কথা থাক? যেভাবেই হোক, তুমি আমাকে বিয়েটা করছো এটাই আমার জন্যে অনেক। না পাওয়ার চেয়ে অল্প কিছু পাওয়াও একটা প্লাস পয়েন্ট!

— আরেকটা অনুরোধ ছিলো, ভবিষ্যতে আমার মা যদি কোনোদিন আপনার কাছে টাকা বা এ প্রসঙ্গত কোনো কথা বলে তাহলে আপনি না করে দেবেন প্লিজ

— কেনো? তার কোনো প্রয়োজনে যদি চায় তবে দেওয়াটা আমার দায়িত্ব, আফটার অল আমি এখন সম্পর্কে তার জামাই

— না, আমার পারিবারিক প্রয়োজনে আমি আপনার থেকে টাকা নিতে পারবো না। এমনিতেই আপনি আমার অনেক বড় উপকার করছেন, আমার ভাইয়ের মাথায় আমাকে নিয়ে যে চিন্তা ছিলো এবার সেটা দুর হয় যাবে আর এটুকুই আমার জন্যে যথেষ্ট

আরোহী যেনো প্রতিটা কথার মাধ্যমেই বুঝিয়ে দিতে চাইছে সে নীলকে শুধু প্রয়োজনে বিয়ে করছে, নীলকে আপন করে নেওয়ার ইচ্ছে ওর নেই। যদিও আরোহীর এমন কথায় নীলের খারাপ লাগার কথা, রাগও হওয়ার কথা কিন্তু তেমন কিছু হচ্ছেনা বরং এটা ভেবে কষ্ট হচ্ছে যে মেয়েটা নিজেকে কতটা একা ভাবে। যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছে তার প্রতিও ভরসা রাখতে পারছে না। নীল মলিন হেসে প্রশ্ন করলো…

— আপন করে নেওয়ার আগেই পর করে রাখছো?

— আমায় ভুল বুঝবেন না। আমি আপনাকে পর করতে চাইছি না। কিন্তু আমার পরিবারের কোনো সমস্যা হলে আমি নিজেই সেটা সামাল দিতে চাই আর খুব বেশি প্রয়োজন হয় তবে অবশ্যই আপনার কাছে সাহায্য চাইবো

— ফাইন! তবে তুমি নিজের কোনো প্রয়োজনীয় বিষয় আমার থেকে লুকাতে পারবে না। যাই প্রবলেম আসুক আমাকে সঙ্গে সঙ্গে বলবে, এরপর আমার হেল্প নেওয়া না নেওয়া তোমার বিষয় কিন্তু আমাকে জানিয়ে রাখবে। ওকে?

বিভিন্ন কথার মাধ্যমে বলে নীল আরোহীর সঙ্গে ফ্রি হওয়ার পুরো চেষ্টা করছে, যদিও সেটা একদিনে সম্ভব নয় তবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে তো আপত্তি নেই। কেনাকাটা শেষে বাড়ি ফিরতেই আরোহীর মা সব জিনিস বের করে দেখা শুরু করে, আরোহীর বিয়ের শাড়ির দাম দেখে উনি কিছুটা হতাশ স্বরে বললেন…

— আরো দামী জিনিস কিনতে পারতি তো!

মায়ের কথা শুনে হতবাক আরোহী!

— মা, তুমি কবে থেকে এমন হয়ে গেলে? আগেও তো এমন ছিলে না

— আরে বাবা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে হয় তো নাকি? বড় বাড়ির বউ হচ্ছিস, সে হিসেবেই এখন থেকে তোকে জিনিসপত্র কিনতে হবে তাইনা?

একেই হাজারো চিন্তায় চেপে আছে আরোহীর মাথায় তার ওপর মায়ের এই আচরণে ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে! মা যেসব ড্রেসের ভাঁজ খুলেছিল আরোহী সেগুলো মুড়িয়ে নিজের হাতে তুলে নিয়ে রেগে বললো…

— মা, দয়া করে এসব কথা নীলদের বাড়ির কারো সামনে বলো না। তারা তাহলে কি ভাববে আমাদের সম্পর্কে? নিজের মান সম্মানের খেয়াল তো রাখো অন্তত

মেয়ের কথায় যেনো বিন্দুমাত্র পাত্তা দিলেন না আরোহীর মা, উনি আরো নানান কথা বলতে শুরু করতেই আরোহীর আর সহ্য হলো না। ড্রেসগুলো নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো আরোহী, ওদিকে…ছেলের বিয়ের দিন যত এগিয়ে আসছে রওশন বেগমের প্রেসার হাই হয়ে যাচ্ছে। মীর সাহেব স্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করেও লাভ হচ্ছেনা।

— আচ্ছা, তুমি অন্য বিষয় নিয়ে কেনো এত ভাবছো? মূল তো মেয়ে, তার সঙ্গে কথা বলে তো ভালোই লাগলো। এছাড়া আর কে কি বললো, কে কেমন সেসব আমাদের দেখা আদৌ প্রয়োজন আছে?

— অবশ্যই প্রয়োজন আছে, তুমি মেয়ের মায়ের কথার টোন শুনেছ? আমার তো ওই মহিলাকে সুবিধার লাগলো না। তাছাড়া তোমার মতো আমি সবকিছু এতো সহজভাবে ভাবতে পারছি না। আমাদের আত্মীয় স্বজন, নীলের কলিগ..কি ভাববে তারা বলোতো? এমন একটা বাড়িতে সম্পর্ক জুড়লাম আমরা?

নীল আবার এসব কথা শুনেছে, ও ইশারায় ওর বাবাকে ওখান থেকে সরে আসতে বলে নিজে গিয়ে মায়ের পাশে বসলো…

— মা, তোমার কি আমাকে কিছু বলার আছে?

— আমি আর কি বলবো? তুই তো খুব বড় হয়ে গেছিস, নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারিস। আমার কি আর কিছু বলার আছে?

নীল মায়ের সামনে হাঁটু মুড়ে বসলো, মা যে তার বেজায় অভিমান করে আছে!

— মা, আই অ্যাম সরি! আমি জানি তুমি আমার ওপর রেগে আছো আর এভাবে হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়াও আমার উচিত হয়নি। আমার বিয়ে নিয়ে তোমার অনেক স্বপ্ন ছিলো সেটাও আমি জানি বাট ট্রাস্ট মী, আরোহী একবার এই বাড়িতে এলে দেখবে তোমার ওর প্রতি আর আমার প্রতি যতো রাগ আছে সব দুর হয়ে যাবে

ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রওশন বেগম কিছু বলতেও পারছেন না, অগত্যা বারবার আরোহীকে মেনে নেওয়ার জন্যে নিজের মনকে বুঝ দিয়ে যাচ্ছেন
__________________________________

নীল ও আরোহীর বিয়েটা ঘরোয়া ভাবেই বিবাহ সম্পন্ন হয়, বিবাহ পরবর্তী অনুষ্ঠান ও ভালোভাবেই সম্পন্ন হলো। এসবের মাঝে আরোহী নিজের শাশুড়ির প্রতিটা বিষয় লক্ষ্য করেছে। রওশন বেগম যে খুশি নন সেটা উনি নিজের কথার মাধ্যমেই প্রতিবার আরোহীকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, আরোহীর অবশ্য এ বিষয়ে কোনো আফসোস নেই। কোন ছেলের মা ই বা নিজের ছেলের বিয়ে এমন একটা মেয়ের সঙ্গে দিতে রাজি হতেন? তবে নীলের বাবা ও বড় বোন অনেক সাপোর্টিভ, স্ত্রীর আচরণে যেনো আরোহী কষ্ট না পায় তাই উনি ছেলের খুশির কথা ভেবে আরোহীর সঙ্গে ফ্রি হওয়ার চেষ্টা করছেন বটে! বিয়ে উপলক্ষেও নীল হসপিটাল থেকে বেশি ছুটি নেয়নি কারণ, সকল অনুষ্ঠান মিটিয়েই আবারো দ্রুত কাজে ফিরেছে। প্রায় এক সপ্তাহ মতো এ বাড়ি ও বাড়ি করেই কেটেছে আরোহীর, এবার থেকে নীলের বাড়িতে পার্মানেন্ট থাকতে শুরু করবে। আজ সকালেই নীল হসপিটালে চলে গেছিলো, আরোহীর সঙ্গে নীলের মা তেমন একটা কথা বলেন না তাই রান্নাঘরে এসে শাশুড়িকে দেখে আরোহী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো। পরে নিজেই এগিয়ে গেলো কাজে সাহায্য করতে, তখনই রওশন বেগম বলে উঠলেন…

— আজ নীল তো খেয়ে যায়নি, ওর খাবার প্যাক করে দিয়েছিলে?

আরোহী না সূচক মাথা নাড়তেই রওশন বেগম অবাক হয়ে তাকালেন…

— না খেয়ে গেছে দেখলে তাও খাবার দিয়ে দাওনি কেনো? ছেলেটা আমার বাড়ি থেকে খাবার না নিয়ে গেলে সারাদিনে খাওয়ার কথা মনেও করেনা।

— আসলে আমি জানতাম না নীল খাবার নিয়ে যায়, তাহলে আমি…

— থাক! বোঝা হয়ে গেছে আমার তুমি আমার ছেলের জন্যে কি করবে, বাড়ির অন্যান্য বিষয়ে অন্তত নজর রেখো। আমার ছেলের দিকে আমিই খেয়াল রাখবো

শাশুড়ির কথার কোনো উত্তর দিতে পারলো না আরোহী, কারণ নীলের সঙ্গে বসে ওর পছন্দ বা ওর সম্পর্কে জানার সেভাবে চেষ্টা কখনো আরোহী করেনি যদিও নীল অনেককিছুই জেনেছে ওর বিষয়ে। আরোহী ভেবে পাচ্ছেনা কি করবে, পরে ভেবে দেখলো বাইরের মানুষকে ওদের সম্পর্ক স্বাভাবিক আছে দেখানো দরকার তাই নীলের বিষয়ে জানার চেষ্টা করবে বলে ঠিক করলো

চলবে…

#ভালোবাসা_হাত_বাড়ালো
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ০৮

সাধারণত নতুন বিয়ে হলে মায়েরা ফোন করে মেয়েদের খোঁজখবর নেয়, শ্বশুরবাড়িতে কিভাবে কি করছে এসব জানতে চায় কিন্তু আরোহীর মা এমন কিছুই করেননি। আরোহী শ্বশুরবাড়িতে এসেছে এক সপ্তাহের বেশি হয় কিন্তু এর মাঝে মেয়ের খোঁজ নেওয়ার জন্যে উনি আগ্রহ দেখাননি। মাঝে ফোন করেছিলেন বটে তবে সেটা আরোহীর খোঁজ নেওয়ার জন্যে নয়, বরং আরোহীকে উনি এই উপদেশ দিয়েছেন যে শ্বশুরবাড়িতে টিকতে হলে শাশুড়ির মন রক্ষা করে চলতে হবে। ছোটো থেকেই মায়ের অবহেলা পাওয়াটা অভ্যাস হয়ে গেছে আরোহীর, বিশেষ করে বিগত দু বছরের মায়ের প্রতি রাগ ও অভিমান এমন তুঙ্গে পৌঁছেছে যে এখন আর মায়ের কোনো কথাতেই কোনো অনুভূতি হয় না। তাই ইচ্ছে করে মাকে ফোনও করেনা ও, এদিকে শাশুড়িও যে খুব একটা মন থেকে ওকে মানতে পারেনি সেটা প্রথমদিন এ বাড়িতে পা রেখেই বুঝেছিল আরোহী। তবে নিজের সকল প্রকার কঠিন অবস্থার জন্যেই প্রস্তুত করে নিয়েছে মেয়েটা। রাতে, নীলের ফিরতে কিছুটা দেরি হলো। রুমে ঢুকে আরোহীকে জাগ্রত অবস্থায় দেখে মনে মনে খুশিই হলো নীল। নীল আসার পরেই আরোহী ওর সকল জিনিস গুছিয়ে রাখে ও খাবারও ঘরে নিয়ে আসে। এতকিছুর মাঝে এক নীলই এখন পাশে আছে, তাই আরোহী ভেবেছে আর কিছু না পারলেও স্ত্রী হিসেবে কিছু দায়িত্ব তো পালন করতেই পারবে। ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলো নীল, আরোহী পাশেই বসেছিল। খেতে খেতে নীল বলে উঠলো…

— ইউ নো হোয়াট? আজকে আমার সত্যিই মনে হচ্ছে যে হ্যাঁ আমি বিয়ে করেছি আর আমার একটা বউ আছে! আজ হঠাৎ আমার এতো যত্ন কেনো নিচ্ছেন ম্যাডাম?

— আপনি আমার এত উপকার করছেন, তার কাছে তো এসব কিছুই না। স্ত্রী হিসেবে এটুকু আপনার জন্যে করতেই পারি

— ওহ ওয়াও! তুমিও তাহলে নিজেকে আমার স্ত্রী ভাবতে শুরু করেছো? বিয়ের আগে তুমি যে লম্বা লেকচার দিয়েছিলে, আমি ভেবেছিলাম তুমি নিজেকে আমার স্ত্রী ভাববে না

আরোহী কিছুটা সিরিয়াস ভাব নিয়ে তাকাতেই নীল বললো…

— আই ওয়াজ জোকিং! এত সিরিয়াসলি নেওয়ার মতো কিছু হয়নি। মায়ের সঙ্গে আজকে সারাদিন কেমন কাটলো তোমার?

— মন্দ না কিন্তু উনি আমাকে তেমন কিছু করতে দেন না, রান্নাও সব নিজে নিজেই করে রাখেন

— আসলে মা নিজের রান্নাঘরের প্রতি ভীষন অবসেসড। কিচেনের কোনো জিনিস এদিক ওদিক হলে ভীষন রেগে যান, ইন ফ্যাক্ট আমার বোনকেও এখন ধরতে দেয় না। ডোন্ট ওরি, আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে। এছাড়া আর কোনো প্রবলেম নেই তো?

— না! তবে, আমার আসলে কালকে ক্লাস আছে, আমি কি কলেজে যেতে পারি?

— এটা আবার পারমিশন নেওয়ার কি আছে? যেদিন ক্লাস আছে যাবে

— উম্ম! আরেকটা কথা বলতে চাইছিলাম। আমি কিছুদিন আগে একটা চাকরির জন্যে এপ্লাই করেছিলাম, এখন ইন্টারভিউয়ের জন্যে ডেকেছে। আমি যেতে চাইছি। আপনাদের বাড়ি থেকে কি চাকরি করার অনুমতি দেবে?

— এ বাড়ীতে কেউই জব সম্পর্কিত বিষয়ে বাঁধা দেবেনা। ইন ফ্যাক্ট, বাড়ির বউ চাকরি করছে বলে তারা আরো প্রাউড ফিল করবে। তুমি নিশ্চিন্তে যাও আর কবে ইন্টারভিউ দিতে যাবে আমাকে বলে দিও, আই উইল ড্রপ ইউ

— আগে মায়ের সঙ্গে একবার কথা বলা উচিত নয় কি? উনি যদি রাগ করেন?

— আমার মা নিজেও জব করতেন, এর ভ্যালু জানা আছে ওনার। উনি তোমাকে বাঁধা দেবেনা

— কিন্তু…

— তুমি এত ওভার থিংক কেনো করছো আরোহী? কেউ কিছু বলবে না আর একজন ওয়াইফের জন্যে তার হাসবেন্ডের অনুমতি সবচেয়ে জরুরি সেটা জানো তো? আমি অনুমতি দিচ্ছি, তোমার যা খুশী করো যেখানে ইচ্ছে যাও। ঘুরে তো সেই আমার কাছেই আসবে

— রাত বিরাতে আপনার মজা করার ইচ্ছে হচ্ছে?

— সারাদিন সিরিয়াস মুড নিয়ে থাকতে হয়, এতো সিরিয়াসনেস নিয়ে তো জীবন চলেনা। রিফ্রেশমেন্টের জন্যে একটু মজা তো দরকার তাইনা? তুমিও এতো রাফ এন্ড টাফ হয়ে থাকা বাদ দিয়ে হাসিখুশি থাকো। জীবনে আমরা বাঁচবই বা আর কয়দিন

যদিও নীল বিষয়টা হালকাভাবে নিচ্ছে কিন্তু আরোহীর খটকা লাগছে যে নীলের মা হয়তো আপত্তি করবে কিন্তু ওর সামনে আরোহী আর কিছু বললো না। খাওয়া দাওয়া শেষে নীল কিছুক্ষন শুয়েছিল কিন্তু আরোহীর চোখে তো ঘুম নেই। বিয়ে করা নিয়ে আফসোস নেই আরোহীর কিন্তু নীলের মতো একজনকে কি সে ডিজার্ভ করে? নীল তো আরো ভালো কাউকে পেতে পারতো। বিয়েটা করে কি নীলের জীবন নষ্ট করে দিলো? এসব ভাবনা আরোহীর মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে। এরই মাঝে হুট করে নীল উঠে বললো…

— চলো

— এতরাতে কোথায় যাবো?

— এত রাত হয়ে গেছে তাও তুমি ঘুমাতে পারছো না, চলো একটু হেঁটে আসি বাইরে থেকে। শরীর ক্লান্ত হলেই ঘুম আসবে

— এসবের প্রয়োজন নেই, আপনি মাত্র এলেন এখন আবার কেনো বাইরে যাবেন? আপনি শুয়ে পড়ুন, দরকার পড়লে আমি ঘুমের ওষুধ…

— তুমি ওষুধ খাও?

— আপনার কি মনে হয় আমার মত মানসিক অবস্থা নিয়ে কেউ স্বাভাবিকভাবে ঘুমাতে পারবে? স্বস্তির ঘুমও একটা নেয়ামত, সবার ভাগ্যে জোটেনা

আরোহীর প্রতিটা কথাতেই ওর মুখে যেনো সেই মানসিক যন্ত্রণায় কাটানো দিনগুলোর প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে, নীল চায় আরোহী এসব যন্ত্রণা থেকে বেরিয়ে আসুক। জীবনটাকে নতুন করে উপভোগ করা শিখুক!

— লুক, আগে তুমি কি করেছো আমি জানতে চাইনা। ইন ফ্যাক্ট আমি চাই তুমি নিজেও অতীতের সব কথা ভুলে যাও। এখন থেকে তুমি আর কোনো ওষুধ খাবেনা, ন্যাচারালি ঘুমানোর চেষ্টা করবে আর তার প্রথম প্রচেষ্টা শুরু হবে আজ থেকে। লেটস গো!

নীলের জোরাজুরিতে যেতে বাধ্য হলো আরোহী, সারাদিনের পরিশ্রমের পর নীল এখন ভীষন ক্লান্ত কিন্তু এ মুহূর্তে নিজের ক্লান্তির থেকেও আরোহী ওর কাছে বেশি জরুরি। ওরা যখন বেরোলো তখন নীলের বোন নিলাশা ওদের বেরোতে দেখে, রুমে নেটওয়ার্ক সমস্যা হচ্ছিল বলে নিলাশা ওর মেয়ের সঙ্গে কথা বলার জন্যে ড্রয়িং রুমে এসেছিল। ভাইয়ের বিয়ের জন্যে জরুরি ভিত্তিতে নিলাশা একাই এসেছিল। ভাইকে বউ নিয়ে বেরোতে দেখে নিলাশা তো বেজায় খুশী!

— ওয়াও! নীল ওর বউকে নিয়ে লেট নাইট হ্যাং আউট করতে যাচ্ছে? যাক! ভাই আমার একটু রোমান্টিক হচ্ছে তাহলে

নীল আরোহীকে নিয়ে বড় রাস্তায় এলো এবং প্রায় বিশ – পঁচিশ মিনিট মতো হাঁটলো, যদিও এ সময় রাস্তায় জ্যাম বা বড় গাড়ি নেই তবুও হাঁটার সময় পুরোটা সময় আরোহীর হাতটা ধরে রেখেছিল নীল। হাঁটতে হাঁটতে টুকটাক নানান বিষয়ে আরোহীর সঙ্গে কথা বলেছে নীল, ওকে কমফোর্ট ফিল করানোর চেষ্টা করেছে। প্রথমে নীল যখন হাত ধরেছিল তখন আরোহী কিছুটা অস্বস্তি বোধ করেছিলো বটে তবে কিছু সময় পর ওর অস্বস্তিবোধ কেটে যায়। আরোহী লক্ষ্য করেছে যে নীল বেশ শান্ত ও কোমল কন্ঠে কথা বলে, ওর কথা শুনলে যে কারোরই হয়তো মন মেজাজ ভালো হয়ে যাবে তেমনি এ মুহূর্তে আরোহীরও মন ভালো হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করার পে বাসায় ফেরার সময় সব মুদি দোকানই প্রায় বন্ধ হয়ে গেছিলো, তবে দু একটা খোলা ছিলো। দোকান খোলা দেখেই নীল বললো…

— একটা দোকান খোলা আছে দেখছি, কিছু খাওয়ার জন্যে কিনে নাও

নীল পকেটে হাত দিয়েই দেখলো ওয়ালেট নেই!

— ওহ নো! ওয়ালেট! ওয়ালেট আনতে ভুলে গেছি

— ইটস ওকে! আমি এখন কিছু খাবো না

— বাইরে এসেছো আর কিছু না খেয়েই চলে যাবে? তুমি দাঁড়াও, আমি ওয়ালেট নিয়ে আসছি

— প্রয়োজন নেই নীল, এমনিতেও আমি এতো রাতে কিছু খাইনা। অভ্যাস নেই, একসঙ্গে হাঁটাহাঁটি করেছি এটুকুই যথেষ্ট। থ্যাংক ইউ, আমাকে সময় দেওয়ার জন্যে

আরোহী মৃদু হেসে ধন্যবাদ জানালো, এতদিনে এই প্রথমবার নীলের সঙ্গে হেসে কথা বলেছে মেয়েটা। নীল বেশ খুশি হলো, মেয়েটাকে এভাবেই তো হাসিখুশি দেখতে চায় ও!
________________________________

গত রাতে একটু হেঁটে আসার পর ঘুম হয়েছিল আরোহীর, যদিও তেমন ভালোভাবে হয়নি তবে অন্য রাতের ন্যায় তেমন নির্ঘুম রাত কাটেনি। সকালে নীলের মা নাস্তা বানাচ্ছিল, তখন নিলাশা এসে মাকে গতরাতের কথা বলতে শুরু করলো…

— বুঝলে মা, তোমার ছেলে তোমার বৌমাকে সত্যিই অনেক ভালোবাসে। যে ছেলের কিনা বাড়ি ফিরে কোনো হুশ থাকেনা, বিছানা থেকে টেনে তোলা দায় হয় সেই ছেলে গত রাতে হাসপাতাল থেকে ফিরে আবার তার বউকে নিয়ে বাইরে গেছিলো, ভাবা যায়!

— কি! সারাদিন এত খেটে এসে নীল আবার অতো বাইরে গেছিলো! গত দুদিন ধরে তো বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হচ্ছে ছেলেটার, রাতে ঠিকমতো না ঘুমালে অসুস্থ হয়ে যাবে

— কিযে বলো না মা, নতুন বিয়ে করেছে। সারাদিন বউকে সময় দিতে পারে না, রাতেই তো সময় দেবে নাকি? নীলের ওর বউয়ের প্রতি এত ভাবনা দেখেই আমার মন খুশী হয়ে গেছে

— জানিনা আমি, আরোহীর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকেই আমার ছেলেটা যেনো কেমন অন্যরকম হয়ে গেছে। আমার অমত সত্ত্বেও জোর করে বিয়েটা করলো। না জানি মেয়েটা আমার ছেলেকে কি করেছে

— মা, তুমি একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে এসব কি বলছো! নিশ্চয়ই আরোহীকে ওর ভালো লেগেছে তাই বিয়ের জন্যে এত তাড়াহুড়ো করেছে আর ভাই আমার ভালো থাকলেই তো আমরা সবাই খুশী তাইনা

— গতরাতে কেমন ঘোরাঘুরি করলে?

— ওহ সরি! আসলে তোমরা যখন বেরোচ্ছিলে আমি দেখে ফেলেছিলাম। তোমরা তো অনেক রাতে বেরিয়েছিলে, কি কি করলে?

— তেমন বিশেষ কিছুনা, এমনি একটু হাঁটাহাঁটি করা হয়েছে

— গুড! ভাই আমার যে নিজের ক্লান্তি নিয়েও বউকে নিয়ে ঘুরতে গেছে এটা দেখেও আমি অবাক। জানো তো ও অনেক অলস, তোমার জন্যে যদি ওর আলসেমি যায় তবে তো ভালোই হয়। আচ্ছা চলো, আমরা

নিলাশা আরোহীকে গল্প করার জন্যে নিয়ে যেতে যাচ্ছিলো সেই মুহূর্তেই রওশন বেগম গম্ভীর কন্ঠে বললেন…

— গল্পগুজব পরে করা যাবে, নাস্তার সময় হয়ে যাচ্ছে। এগুলো টেবিলে নিয়ে রাখো, সবাই খেতে আসবে এখুনি

— জ্বি মা! — আরোহী খাবারগুলো নিয়ে গিয়ে টেবিলে সাজাতে শুরু করলো কারণ ও বুঝেছে যে ওর শাশুড়ি ওকে উদ্দেশ্য করেই কথাটা বলেছে। রওশন বেগমের কোনো আদেশ অমান্য করতে চায়না আরোহী!

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]