ভালোবাসি তাই পর্ব-১২+১৩

0
516

#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-১২

দুপুরের সেই ধাক্কাটা খাওয়ার পর কিছুটা নিস্তেজ হয়ে গেছিলো আশা। মাথায় শুধু ঘোরপাক খাচ্ছিলো ঘটে যাওয়া সেই ঘটনাটা। নিয়াশা অনেক ক্ষীপ্ত থাকায় ওকে কোনোরকমে সামলে বাসায় নিয়ে গেছিলো নীলা।

আশা যখন বিস্ফোরিত হয়ে নিয়াশার চলে যাওয়া দেখছিলো, তখন সাদ এসে দাঁড়িয়েছিলো আশার পাশে। আশা তখনও নিরব। দৃষ্টি সামনেই সীমাবদ্ধ। সাদ আশার মাথায় হাত রেখে মৃদু গলায় বলেছলো
“কিউটি..
আশা চমকে তাকায় সাদের দিকে। সাদ আবেশি গলায় বলে
“বাসায় যাবেনা?
আশা আবারো কিছুক্ষণ নির্বাক চোখে তাকিয়ে থাকে সাদের দিকে। এক পর্যায়ে নিরবতা কাটিয়ে সে বলে
“এটা কি করেছেন আপনি?
“কি করেছি?
“কেন সবার সামনে আপনি মিথ্যে বললেন?
“মিথ্যে না বললে ছেলেটা হয়তো তোমাকে আরো হ্যারেসমেন্ট করতো।
“তাতে আপনার কি? নিয়াশা কতটা কষ্ট পেয়েছে সেটা একবার খেয়াল করেছেন?

সাদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো
“কেউ যদি নিজ ইচ্ছেতে কষ্ট পেতে চায়, তাতে আমার কি করার থাকতে পারে?
“মানে? আপনাকেও ও ভালোবাসে, সেটা জেনেও আপনি এই সব কিভাবে বলছেন? আর আপনিও তো ওকে ভালোবাসেন।
সাদ সামান্য হেসে বললো
“ভালোবাসা কি এক রকমের হয়? ভালোবাসা অনেক প্রকার। আমি ওকে ভালো বন্ধুর মত ভালোবাসি, কিন্তু ও যেটা চায় সেটা আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব না।
আশা অবাক হয়। মনে মনে ভাবলো, ” তাহলে কি উনি নিয়াশাকে ভালোবাসে না? এই কারণেই নিয়াশা এতটা ক্ষুব্ধ হয়েছিলো?

সাদ আশার নিরবতা ভাঙ্গাতে বললো
“চলো বাসায়।
“আপনি যান, আমি পরে যাবো। গম্ভীরমুখে বললো আশা।
সাদ এবার কোনো কথা না বলে ডিরেক্ট আশার এক হাত খপ করে ধরলো। আশা অবাক চাহনিতে তাকালো সে হাতের দিকে। কিছুক্ষণ সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে পরক্ষনে আবারও সাদের দিকে তাকালো। সাদ কি যেনো মনে করে এবার হাতটা ছেড়ে দিয়ে নরম গলায় বললো
“দেখো, যা হয়েছে সেটা একটা বাজে দুর্ঘটনা। আর আমি সেটা সহ্য করতে না পেরে তোমার ভালোর কথা ভেবেই এমনটা করেছি। রাগ করে থেকোনা প্লিজ। বাসায় চলো।
আশা মলিন মুখে বললো
“চলুন….!

সাদ একটা রিক্সা ডেকে সেটাতে আশাকে উঠতে বলে নিজেও উঠে বসলো। আশা তখনও নিচে দাঁড়ানো। সে অবাক হয়ে রিক্সার সিটের দিকে তাকিয়ে রইলো। সাদ তাড়া দিয়ে বললো
“উঠে এসো কিউটি।
আশা ক্ষীণ কন্ঠে বললো
“আপনার পাশে?
“হুম, এসো।
“আমি আমার ভাইয়া ছাড়া অন্য কোনো ছেলের পাশে কখনো বসিনি।
“আমি তোমার ফ্রেন্ড। আমার পাশে বসতে সমস্যা কোথায়?
“জানিনা। তবে আমি পারবোনা আপনার সাথে এক রিক্সায় উঠতে।

সাদ এবার আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো
“আমাকে বিশ্বাস করো তো কিউটি?
“দেখুন, এখানে বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা কেন আসছে?
“যদি এমন কিছু না থেকে থাকে তাহলে উঠে এসো। সবাই দেখছে।
আশা খেয়াল করলো সত্যিই আশেপাশের সবাই ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। এ পর্যায়ে আশা আর কথা বাড়ালোনা। রিক্সায় উঠে বসে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে ওরা বসলো। সারা রাস্তা আর কেউ কারো সাথে কোনো কথাই বললো না। তবে সাদের মনে ঘোরপাক খাচ্ছিলো অন্য কিছু। এই আশা আর নিয়াশা দুজন ভালো বন্ধু৷ অথচ এ দুইজনের মধ্যে কত পার্থক্য। একজন গায়ে পড়তে উস্তাদ আর অন্যজন…
সাদের ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি দেখা গেলো। হাসিটা ঠোঁটে রেখেই সে আড়চোখে তাকালো আশার দিকে। মেয়েটার চোখদুটো ফুলে আছে। সেখানে লাল আভা স্পষ্ট। এলো চুলগুলো বাসাতে খুব উড়ছে। সাদ কিছুক্ষণের জন্য সে সৌন্দর্যে ডুবে গেলো।

বাসায় সামনে যখন এসে পৌছুলো ওরা তখন আশাকে উপরে যেতে বলে সাদ রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া মিটাতে ব্যস্ত হলো। ভাড়াটা আশার দেওয়ার তীব্র ইচ্ছে থাকলেও কথা বলতে অনিচ্ছুক থাকায় সে বাসার ভেতরে ঢুকে পরলো৷ ক্লান্ত পায়ে এক পা দু পা করে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছে সে। ক্লান্তির কোনো কাজ না করা স্বত্বেও আজ সে খুবই ক্লান্ত। এ ক্লান্তির কারণ তার জানা নেই৷ উপরে উঠামাত্রই চোখ গেলো কিচেনের দিকে। নীলা রান্না করছে। রান্নাঘর ঘেঁষে থাকা ওয়াশরুমের দরজাটা লাগানো। হয়তো নিয়াশা গেছে। আশাকে দেখে নীলা এক পলক ওর দিকে তাকিয়ে বললো
“এতো দেরি করে ফিরলে যে।
“ওই দেরি হয়ে গেছে আরকি। মলিন কন্ঠে বললো আশা।
এমন সময় ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো নিয়াশা৷ আশাকে দেখে ঘৃণায় দৃষ্টি সরিয়ে নিলো সাথে সাথে। আশা হতাশ হলো। এতোক্ষণে সাদও চলে এসেছে। আশাকে এভাবে মাঝপথে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেও আশার পিছন দিকে দাঁড়িয়ে পরলো।
বললো
“দাঁড়িয়ে রইলে যে।
আশা কোনো জবাব দিলোনা। নিয়াশা সেটা খেয়াল করে তাচ্ছিল্যের কন্ঠে বললো
“ভালোবাসা দেখছি জমে উঠেছে। ভালো তো।

এবার সাদের বেশ রাগ হলো৷ কিছু না জেনে শুধু শুধু ভুলভাল বকে যাচ্ছে মেয়েটা। যার প্রভাব গিয়ে পরছে কিউটির উপর। সাদ রেগে গেলেও সে রাগ বেশিক্ষণ রইলো না। রাগটাকে দমিয়ে আশাকে পাশ কাটিয়ে সে নিজের রুমের দিকে যাবার জন্য পা বাড়ালো। যাবার আগে এক পলক নিয়াশার দিকে তাকিয়ে বললো
“কারো ভালো করতে গিয়ে যদি আমি অন্য কারো চোখে ঘৃণার পাত্র হই, তবে সে ঘৃণার পাত্র আমি বার বার হতে চাই।
নিয়াশার গা জ্বালা করলো কথাটা শুনে। সে হনহন করে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। আশা একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে পা বাড়ালো রুমের দিকে।

সন্ধ্যের আগে ঘুম থেকে উঠলো আশা। তখন বাসায় ফিরে খাওয়া নাওয়া বাদ দিয়ে ঘুমিয়ে পরেছিলো সে। মানসিক অবস্থা এতোটাই খারাপ ছিলো যে ঘুম ছাড়া অন্য কিছুই তার মাথায় আসছিলো না। ঘুম ভাংলে সে ধীরে ধীরে উঠে বসে বিছানায়। মাথাটা ব্যাথা করছে প্রচন্ডভাবে। সেদিকে তোয়াক্কা না করে ওয়াশরুমের দিকে ছুটে সে। ফ্রেশ হতে হবে।
সন্ধ্যের পর পর নিয়াশাদের রুমের দিকে পা বাড়ায় আশা। নিয়াশার মনটা আজ প্রচন্ডভাবে ভেঙ্গে গেছে। খারাপ লাগছে আশার। সে দরজার সামনে গিয়ে টুকা দেয়। নীলা দরজাটা খুলে দিতেই ধীরপায়ে ভিতরে ঢুকে সে।

নিয়াশা উপুর হয়ে শুয়ে আছে। আশা একবার নীলার দিকে তাকায়। শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করে
“খেয়েছে কিছু?
“নাহ, অনেক জোর করেও কিছু খাওয়াতে পারিনি। ওর মন খারাপ, তাই পছন্দের রান্না করেছি বিকেলে। সেটাও মুখে তুলেনি।
আশা এগিয়ে গেলো নিয়াশার দিকে। মাথার পাশে বসে আস্তে আস্তে ওর পিঠে হাত রাখলো। অপরাধীর স্বরে বললো
“নিয়াশা।
নিয়াশা নড়লো না আশার ডাকে। আশা এবার কিঞ্চিৎ জোরে ডাকলো
“নিয়াশা, উঠছোনা কেন? তুমি কি ঘুমিয়ে আছো?
আগের মত শোয়া অবস্থায় থেকেই বাজখাঁই গলায় নিয়াশা বললো
“ওরে যাইতে কো নীলা, নইলে আমি কি কইরা বসি ঠিক নাই।

আশা অসহায়ের মতো তাকালো নীলার দিকে। নীলা চোখের ইশারায় এখনকার মতো ওকে চলে যেতে বললে ও সেটা মেনে নিয়ে চলে গেলো। আশা চলে আসার পর নীলা সামান্য ঝাঝ নিয়ে নিয়াশাকে বললো
“ওর সাথে খামোকা রাগ দেখাইতেছিস কেন শুনি? ও কি করছে? যাকে তুই পছন্দ করিস সে যদি তোরে পছন্দ না করে তাইলে সেখানে ওর কি দোষ থাকতে পারে?
“মুখটা বন্ধ কর নীলা। আমার কিন্তু সহ্য হইতাছে না কিছু।
নীলা হুংকার করে বললো
“কিছু পারিস আর না পারিস, এই যখন তখন রাগটা দেখাইতে ঠিকই পারিস।

রাতের খাবার খেয়ে দেয়ে যখন ফোন স্ক্রলিং করছিলো তখন হটাৎ ই আশার কথা মনে হলো সাদের। মেয়েটার মন খারাপ, কিছু খেয়েছে কিনা দেখা দরকার। সাদ সেই ভাবনা থেকেই আশার রুমের দিকে এলো। দরজাটা ভিড়ানো ছিলো। সাদ কোনো সাড়াশব্দ না করেই দরজাটা খুলে হুট করে ভিতরে ঢুকে পরলো। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো আশা। গায়ে ওড়না ছিলোনা তাই৷ সাদ নিজেও সেটা দেখে চোখ নামিয়ে নিলো। আমতাআমতা করে বললো
“আমি স্যরি কিউটি। আমি পরে আসছি।
আশা নিজেকে পরিপাটি করে বসে রইলো। বেশ কয়েক মিনিট পর সাদ বাইরে থেকেই প্রশ্ন করলো
“আমি আসবো?
অবাক হয়ে আশা বললো
“আপনি এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছেন?
সাদ মুচকি হেসে বললো
“হুম। আসবো?
আশার ইচ্ছে করলো মুখের উপর ঠাস করে না করে দিক। তারপরও বললো
“আসুন।

সাদ ভিতরে ঢুকে বিছানার এক প্রান্তে বসে অপরাধ প্রবণ গলায় বললো
“আমার তখন হুট করে তোমার রুমে ঢুকা ঠিক হয়নি৷ তোমার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তারপর ঢোকা দরকার ছিলো। আশা শান্ত গলায় বললো
“আচ্ছা ঠিক আছে।
সাদ এবার তাকালো আশার মুখপানে। মুখটা কেমন যেনো শুকনো হয়ে আছে। সাদ বললো
“খেয়েছো?.
“হুম।
“সত্যি?
আশা এবার রেগে গিয়ে বললো
“এতো প্রশ্ন কেন করছেন? খেয়েছি বলেছি মানে খেয়েছি। আর আপনি এখানে কি করছেন, আপনার উচিৎ নিয়াশার কাছে যাওয়া। আপনার কারণে মেয়েটার আজ কি অবস্থা।
সাদ সামান্য অবাক হলো আশার এমন ব্যবহারে। এরপর সে প্রশ্ন করলো
“নিয়াশার এমন অবস্থার জন্য তুমি আমাকে কেন দায়ী করছো?
“তো কাকে করবো?
“ও যদি একতরফা ভাবে আমাকে ভালোবেসে কষ্ট পেয়ে থাকে সেখানে আমার কি করার থাকতে পারে?
“একতরফা হতে যাবে কেন, আপনিও ওকে ভালোবাসতেন। সেটা শুধু নিয়াশা নয়, আমরাও বুঝতে পেরেছি। ভালোবাসা যদি নাই বা থাকতো তাহলে মেয়েটার সাথে এমন এমন কান্ড কেন করেছেন যেটাতে সে মানতে বাধ্য হয় যে আপনিও ওকে ভালোবাসেন!!

সাদ শান্ত গলায় বললো
“এই একই প্রশ্নের উত্তর নিয়াশার সাথেও আমি দিয়েছি। তোমার সাথে এইসব প্রশ্নের উত্তর না দিলেও চলতো, কিন্তু কেন যেনো মনে হচ্ছে তোমাকে জানানো টা জরুরি। আমার উপর তুমি অবিশ্বাস পোষণ করে থাকো, সেটা আমি মানতে পারবো না।
আশা অবাক হয়ে তাকালো সাদের দিকে। সাদ বলতে লাগলো
“আমি যেখানে বড় হয়েছি, বেড়ে উঠেছি সেখানকার লাইফস্টাইলটাই অন্যরকম। সেখানে একটা মেয়ের সাথে এমনভাবে ফ্রী হওয়া, চলাফেরা করা খুবই স্বাভাবিক। বরং ওখানকার তুলনায় এখানের এটা খুবই সিম্পল বিষয়।আমি যেহেতু সেখানকার সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠেছি, তাই খুব সহজেই ওর সাথে ফ্রী হয়েছিলাম।। কানাডায় এটা খুবই সিম্পল একটা বিষয়। তবে নেহাৎ অনেক কমই ফ্রী হয়েছি। তবে আমি ভাবিনি ও এতটা ইমোশনাল হয়ে যাবে। আর তুমিও আমাকে এভাবে ভুল বুঝবে ভাবিনি।
“আপনার ভাবা উচিত ছিলো এটা আপনার কানাডা নয়, এটা বাংলাদেশ।
“তাতে কি, বন্ধুত্ব কি কানাডা আর বাংলাদেশ মানে?
“এখনো বলছেন তাতে কি!! আপনার চোখের সামনে নিয়াশার কি হাল হয়েছে তা কি একবারও চোখে পরছেনা?

সাদ কথা ঘুরিয়ে বললো
“আচ্ছা এখন ওইসব বাদ দাও। সত্যি করে বলো, তুমি খেয়েছো তো?
আশা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসলো। কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা তার।
সাদ উঠে দাড়ালো। আশা একটু কপাল বাকালো। আঁড়চোখে তাকালো সেদিকে। সাদ রেকটা খুলে ভাতের হাড়িটা হাতে নিলো। আশা উৎকন্ঠা নিয়ে বললো
“আপনি ওখানে কি করছেন?
সাদ কোনো উত্তর না দিয়ে ভাতের হাড়ির ঢাকনা টা তুললো। পাতিলের তলায় অল্প ভাত পরে আছে, তাও ঘেমে ভিজে আছে। এটা যে সকালের ভাত তা বুঝতে আর বাকি নেই সাদের। সে কিছুটা রাগান্বিত গলায় বললো
“তুমি না খেয়ে আছো এখনো? অথচ আমি বার বার জিজ্ঞাসা করা স্বত্বেও আমাকে মিথ্যা বলছিলে।

আশা এবার উঠে দাঁড়িয়ে সাদের কাছ থেকে হাড়িটা নিতে চাইলো। সাদ দিতে চাচ্ছেনা। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে হাড়ি নিয়ে হাতাহাতি হতে লাগলো। সাদ শব্দ করে হাসছে আর হাড়িটা আশার কাছ থেকে সরিয়ে নিতে চাইছে বার বার।

এমন সময় দরজার পাশ থেক আবারও হাততালির আওয়াজ এলো৷ দুজনেই চমকে তাকালো দরজার দিকে। নিয়াশার আবারও ঘৃণার সাথে বললো
“ভেবেছিলাম আমিই বোধহয় ভুল, আশাই ঠিক। তাই নিজের ভুলটা শুধরাতে এসছিলাম। কিন্তু এতো সুন্দর একটা ড্রামা দেখতে পাবো ভাবিনি।
আশা নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো
“তুমি ভুল বুঝছো নিয়াশা।
নিয়াশা তাচ্ছিল্যের সাথে বললো
“কিছু মুহুর্ত আগেও আমি ভুল বুঝেছিলাম। ভেবেছিলাম তুই ঠিক, আমিই ভুল।।কিন্তু এবার আমি যা ভাবছি, তা আর কিছুতেই ভুল হতে পারেনা।

চলবে…..

#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-১৩

আশা স্তব্ধ হয়ে নিয়াশার দিকে তাকিয়ে রইলো। আশা একটু নরম মনের হলেও এবার বেশ রাগ হলো তার। বার বার সে বিনা কারণে ওকে ভুল বুঝে যাচ্ছে। সে কিছুটা শক্ত গলায় বললো
“সবসময় যা দেখা যায় তা ঠিক নাও হতে পারে নিয়াশা, এটা নিশ্চয়ই তুমি মানো? আর তোমার নিজের অনুমানের উপর নির্ভর করে দুনিয়া চলে না।। আমি তোমার বন্ধু, সেই হিসেবে তুমি আমাকে দু চার কথা বলতেই পারো, কিন্তু কিছু না জেনে শুধু শুধু আমাকে বারবার অপমান করার অধিকার নিশ্চয়ই তুমি রাখো না।
নিয়াশা কোনো উত্তর না দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো। আশা আবারও বললো
“আমার কথায় কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দুঃখিত। কিন্তু তখনকার সেই ঘটনার পর থেকে তুমি যা পারছো আমাকে তাই বলে যাচ্ছো। তোমার কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু তুমি এতোটাও ডিপ্রেশনে চলে যাওনি যে মুখে যা আসবে তাই বলবে।

আশা এবার সাদের দিকে তাকালো। রাগমিশ্রিত গলায় বললো
“আপনি সবটা ক্লিয়ার করুন প্লিজ। শুধু শুধু ও আমাকে ভুল বুঝছে, আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হচ্ছে। আমি চাইনা আমাদের মধ্যে কোনো ভুলবুঝাবুঝি হোক। ওকে আপনি ভালোবাসবেন নাকি বাসবেন না সেটা একান্তই আপনার পার্সোনাল ব্যাপার। কিন্তু আপনার সাথে আমার যে কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক নেই সেটা জানিয়ে দিন ওকে।

নিয়াশা এবার খানিক রেগে বললো
“ও কি বলবে, বলার মতো কোনো মুখ ওর নেই।
আশা গম্ভীরমুখে বললো
“সেটা তোমরা বুঝে নাও প্লিজ। শুধু শুধু আমার সাথে বাজে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকো৷
সাদ এবার মুখ খুলল। সে প্রথমে আশার দিকে তাকালো। অপরাধীর মতো করে বললো
“আমার কারণে তুমি অপমানিত হচ্ছো আশা, কিন্তু আমি চাইনি এটা বিশ্বাস করো। আমিতো ভেবেছিলাম, এ কথাটা বললে ওই বখাটে ছেলেটা তোমাকে আর বিরক্ত করবেনা। কিন্তু…
আশা বললো
“কিন্তু কি?
সাদ বিরক্ত নিয়ে নিয়াশার দিকে তাকালো। এরপর গম্ভীরমুখে বললো
“কিন্তু ঘরশত্রু বিভীষণ আমার জানা ছিলোনা।
সাদের মুখে এমন কথা শোনামাত্র রেগে গেলো নিয়াশা। সামান্য চিৎকার করে বললো
“মুখ সামলে কথা বলো, কি যা তা বলছো ধারণা আছে?
“এইসব কথা তোমার মুখে মানায় নিয়াশা?
সাদের পালটা প্রশ্নে বিস্ফোরিত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে নিয়াশা। এরপর হনহন করে চলে যায় সেখান থেকে।

আশা ধপ করে বসে পরে বিছানায়। চোখ বেয়ে পানি পরছে অবিরত ভাবে। কখনো সে ভাবেনি এই দিনটা তার জীবনে আসবে।। এখানে আসার পর এই নিয়াশাই তার নিঃসঙ্গতা কাটিয়েছিলো। খুব সহজেই মিশেছিলো ওর সাথে। আজ একটা সামান্য কারণে ওদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হলো। আশার মন খারাপের কারণ বেশ বুঝতে পারলো সাদ। মনটা তারও খারাপ হয়ে গেলো সাথে সাথে।। এদিকে নিয়াশার উপরও রাগ বাড়তে লাগলো ধীরে ধীরে। ভালোবাসা মানে তো জোরজবরদস্তি নয়, কিন্তু সে যা শুরু করেছে তাকে তো জোরজবরদস্তিই বলা চলে।
আশা চোখ মুছে সাদের দিকে তাকালো। শান্ত গলায় বললো
“আপনি এবার আপনার ঘরে যান, আমি ঘুমাবো।
“তুমি খাবেনা কিউটি?
“আপনাকে যেতে বললাম তো। সামান্য ধমকের সুরে বললো আশা।

সাদ কোনো কথা না বাড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আশা সাথে সাথেই দরজাটা খুব জোরে শব্দ করে লাগিয়ে ফেললো। রুমের লাইট অফ করে বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে পরলো সে। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার।
কিছুটা সময় পার হয়ে গেলো এভাবে। হটাৎ ই দরজায় টুকা পরলো। কিছুটা বিরক্ত হলো আশা, আবার কে এলো ভেবে। সে বিরক্ত মাখা গলায় প্রশ্ন করলো
“কে?
“দরজাটা খুলো আশা।
আশা তারাতাড়ি করে বিছানায় উঠে বসলো। এতো রাতে আন্টি কেন ডাকছে?
এর মাঝে আবার ডাকলে উনি। আশা এবার বিছানা ছেড়ে নেমে লাইটটা জ্বালিয়ে দরজা খুলে দিলো।

সাদের আম্মু একটা পেকেট হাতে নিয়ে আশার রুমে ঢুকলো। আশা উনাকে বসতে বললে উনি বসলো বিছানায়। আশার চোখমুখ ফোলা দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন উনি। হন্তদন্ত হয়ে বললেন
“এমা, তোমার কি হয়েছে আশা? চোখমুখ ফুলে আছে যে? অসুস্থ তুমি?
আশা কথা কাটিয়ে বললো
“না আন্টি। এমনিতেই মাথাটা ব্যাথা করছিলো।
“ওহ।
কথাটা বলে কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে হাতে থাকা পেকেট টা আশার দিকে বাড়িয়ে দিলেন তিনি। আশা খানিক বিস্ময়ে পেকেটটা হাতে নিয়ে বললো
“এটা কি আন্টি?

সাদের মা সামান্য হেসে বললেন
“এটাতে কি আছে আমিতো জানিনা। তবে সাদ আমাকে এটা দিলো। তুমি নাকি সন্ধ্যায় ওকে টাকা দিয়েছিলো তোমাকে কিনে এনে দেওয়ার জন্য? ছেলেটার মনে ছিলো না। এখন এনে দেখে তোমার রুম লাগানো, লাইটও অফ। তাই আমাকে দিয়ে পাঠালো।
আশা পেকেকটা হাতে নিয়েও এবার বিপাকে পরলো৷ এখন সে বলতেও পারেবনা সে কোনো টাকা দেয়নি, সাদ নিজ থেকেই এগুলো পাঠিয়েছে। বললে হয়তো আন্টি অন্য কিছু ভাবতে পারে। বলাতো যায় না, কার মনে কি আছে।

আশা তাকালো প্যাকেটটার দিকে। প্যাকেটে কি আছে সে জানেনা, কিন্তু এতে যে খাবার আছে এটা সে নিশ্চিত। কারণ হোটেল থেকে কিছু আনলেই সাধারণত এইসব প্যাকে করে দেয়। সাদের মা এবার উঠতে উঠতে বললো
“আমি যাচ্ছি আশা। দরজাটা লাগিয়ে দিও।
আশা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো।

উনি চলে গেলে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে প্যাকেট টার দিকে তাকিয়ে রইলো আশা। এক পর্যায়ে প্যাকেকটা সে খুললো কি আছে দেখার জন্য। দুটো নান রুটি আর চিকেন গ্রিল। আশা কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে এক পর্যায়ে প্যাকেট টা টেবিলের উপর রেখে শুয়ে পরে। কিছুক্ষণ যাবার আবার উঠে বসে। খিদে পেয়েছে খুব, সেই সকালে খেয়েছিলো। এতোক্ষণ খিদেটা ধামাচাপা দিয়ে রাখলেও এবার খাবার দেখার পর, বিশেষ করে নান আর গ্রিল দেখার পর খিদেটা আরো বেশি করে চেপে ধরেছে। আশা একবার ভাবলো শুয়ে পরুক, পরক্ষনে আবার ভাবলো খাবার সামনে রেখে না খেয়ে থাকলে খাবার পাপ দিবে।
সে আর কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই খেতে শুরু করলো।

পরের দিন সকালে ব্রাশ হাতে নিয়েই আশার রুমে চলে এলো সাদ। আশা কিছু বললো না আর। সে নিজের মতো বই নিয়ে বসে রইলো। একবার সাদের দিকে তাকালোও না পর্যন্ত। সাদ প্রশ্ন করলো
“খেয়েছিলে রাতে?
আশা উত্তর দিলোনা। সাদ এবার কিছু না বলে টেবিলে রাখা ঠোঙ্গাটায় হাত বাড়ালো। নাহ, ঠোঙ্গাটা চুপসানোই আছে। ভেতরেও ফাঁকা। তারমানে খেয়েছে। সে আশার দিকে তাকালো। আশা এখনো নিজ মনেই বই পড়ে যাচ্ছে। সাদ ভ্রু বাকিয়ে বললো
“আমার দিকে তাকালে কি পাপ হবে?.
আশা চোখ তুললোনা। সাদ আবারও বললো
“অন্তত কথা তো বলো, সেটা তে নিশ্চয়ই পাপ হবেনা।

আশা এবার সাদের দিকে তাকালো। শান্ত গলায় বললো
“আপনি এখন যান, আমি রেডি হবো।
“কোথায় যাবে?
“ভার্সিটি যাবো, আর কোথায় যেতে পারি আমি।
“আজ যেও না কিউটি।
“কেন? ভ্রু বাকালো আশা।
সাদ অন্যমনস্ক হয়ে বললো
“গতকাল একটা কান্ড হয়ে গেছে। ছেলেটাও বেশ রেগে গেছিলো। আজ তোমার না যাওয়াটাই বেটার হবে।
আশা কোনো কথা বললো না। সে এক সেট জামা হাতে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে ছুটলো। সাদ হা হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। মনে মনে ভাবলো, ‘কিউটি এতো রেগে আছে কেন আমার উপর?’

সেদিন সারাদিন আর কোনো সমস্যা হয়নি আশার। যদিও নিয়াশা নীলাকে নিয়ে আগেই চলে গেছিলো, যার দরুন একাই যেতে হয়েছিলো আশাকে। রাস্তায় যাওয়ার পথে খুব ভয়ে ছিলো সে, এই বুঝি রানা নামের ছেলেটা ওকে একা পেয়ে কোনো ক্ষতি করে বসে। কিন্তু না, এমন কিছুই হয়নি। বাসায় আসার পথেও রানাকে কোথাও দেখতে পায়নি আশা। যার ফলে বাসার সামনে আসামাত্র একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়েছিলো সে।

বাসার ভিতরে ঢুকে দরজাটা খুলে ফ্রেশ হলো আশা। রুমে এসে একটু রেস্ট করার জন্য বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। এমন সময় বাইরে থেকে একটা মিষ্টি মধুর ডাক কানে এলো তার। শ্রুতিমধুর কন্ঠে সে কন্ঠস্বর থেকে নিসৃত হলো
“আশামনি…
আশা লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো। হটাৎ ভাইয়ের গলার আওয়াজ পেয়ে চমকিত হলো সে। কন্ঠস্বর ফলো করে সেদিকে তাকিয়ে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো । আদিব বাইরে দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। আশা হতবিহ্বল হয়ে এক লাফে আদিবের কাছে চলে গেলো। খুশিতে আত্মহারা হয়ে আদিবকে জরিয়ে ধরে বললো
“ভাইয়া তুই,
আদিব মুচকি হেসে পরম যত্নে আদরের বোনকে একহাতে জরিয়ে ধরলো। এদিকে ভাইকে জরিয়ে ধরেছে তো ধরেছেই, ছাড়ার আর নাম নেই। আদিবও ছাড়ছেনা বোনকে। এতদিন পর বোনটাকে দেখেছে সে।

সকাল সকাল খাওয়া দাওয়া করে বাইরে ঘুরাফেরার জন্য বেরিয়ে গিয়েছিলো সাদ। সারাদিন ঘুরাফেরা করে এই মাত্রই বাসায় ফিরেছে সে। ফুরফুরে মেজাজে শিষ বাজাতে বাজাতে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠা মাত্রই জমে গেলো হটাৎ। আশাকে কোনো ছেলের সাথে জড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ রাগ হলো তার। কিছুটা জেলাসও ফীল করলো। সে ধীরপায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো তাদের দিকে। আশা আর আদিবের কাছাকাছি গিয়ে কিছুক্ষণ দুজনার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু একটা বিশ্লেষণ করতে থাকলো সে। এক পর্যায়ে সাদ আদিবের মুখের কাছে আঙ্গুল নিয়ে তুড়ি বাজাতে থাকলো। ততক্ষণে আশাকে ছেড়ে দিলো সে।

সাদ কপাল কুচকে তাকালো আদিবের দিকে৷ পা থেকে মাথা পর্যন্ত অবলোকন করে বললো
“এখানে এইসব এলাও না আপনি কি জানেন না?
আদিব প্রশ্ন করলো
“কে আপনি?
সাদ হা হয়ে বললো
“মশকরা হচ্ছে, আমি কে মানে? আমি ওর ফ্রেন্ড। আর আপনি কে? কথা নেই বার্তা নেই কিউটিকে এসে জরিয়ে ধরলেন!! জানেন, আমি এখন আপনার কি করতে পারি?
আদিব হাতদুটো বেধে দাঁড়িয়ে বললো
“আচ্ছা, কি করতে পারেন?
সাদ আত্মবিশ্বাসের সাথে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আশা আদিবের দিকে তাকিয়ে বললো
“ঘরে আয় ভাইয়া। শুধু শুধু উনার সাথে তর্ক করিস না, উনার মাথায় গন্ডগোল আছে।।।

চলবে…..