ভালোবাসি তাই পর্ব-১৮+১৯

0
524

#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-১৮

সাদ একটু এদিক ওদিক তাকালো। এক পর্যায়ে কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই সে আচমকা বলে উঠলো
“আমাকে বিয়ে করবে কিউটি? সারাক্ষণ তোমাকে নিজের কাছে রাখবো, প্লিজ করবে বিয়ে বলো?….
আকস্মিক সাদের মুখে এমন কথা শোনায় অবাক হলো আশা। প্রচন্ড শকড হলো সে। ঘাবড়ে গিয়ে বলল
“কি যা তা বলছেন আপনি?
“যা তা নয় কিউটি বিশ্বাস করো। আমি বেশ উপলব্ধি করতে পারছি তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি, এও জানি তোমাকে ছাড়া আমি একটা মুহূর্তও থাকতে পারবোনা। যে কারণে ঢাকা থেকে ছুটে এসেছি তোমার বাড়ি। যখন এখানে এসেছি তখনও আমি জানতাম না, কিসের টানে আসছি। কিন্তু এখন আমি কনফার্ম, আর কোনো দ্বিধা নেই যে আমি তোমাকে ভালোবাসি।
আশা দুপা পিছিয়ে গেলো। আমতাআমতা করে বললো
“এটা আপনার আবেগ ছাড়া আর কিছুই নয়। আর আবেগ দিয়ে জীবন চলেনা।
সাদ হতাশ চোখে তাকালো আশার দিকে। ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো তার দিকে। দুহাতে আশার দুই বাহু শক্ত করে ধরে বললো
“বিয়ে করবে কিনা বলো?
আশা মাটির দিকে তাকালো। কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে বললো
“আমার একটা ফ্যামিলি আছে। মা আছে, ভাই আছে। আমার ব্যাপারে যত সিদ্ধান্ত আছে তারাই নিবে। আর বিয়ের ব্যাপারটাও উনারাই দেখবে। আমি কখনো এতে দ্বিমত করবো না।
সাদ নিরাশ গলায় বললো
“অন্তত তোমার বিয়ের ব্যাপারেও তো তোমার নিজস্ব একটা মতামত থাকা প্রয়োজন।
“আমার ফ্যামিলি নিশ্চয়ই আমার খারাপ চাইবে না। উনাদের প্রতি যথেষ্ট বিশ্বাস আমার আছে।

সাদ কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বললো
“আমাকে কি উনারা মেনে নিবেন না?
“সেটা উনারাই জানেন।
সাদের মনে পরলো গতরাতের কথাগুলো। যখন আদিব কোনো একজনকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলো কোনো বিদেশে অবস্থানরত ছেলের কাছে তার বোনের বিয়ে দিবেনা। সে আশাহত হয়ে চোখ বন্ধ করলো। আশা এক পলক তাকালো সেদিকে। ওরও খুব খারাপ লাগছে, ইচ্ছে করছে বলে দিক সেও প্রচন্ড ভালোবাসে তাকে। কিন্তু বলবে না।
অনেক কষ্টে মা আর ভাই মিলে ওকে বড় করেছে। সে চায় না তার কোনো কর্মকাণ্ডের ফলে ওর ফ্যামিলি কষ্ট পাক। সমাজের মানুষ ওর পরিবারের দিকে আঙ্গুল তুলে একটা কথা বলুক। আশা বাইরে চলে আসার জন্য পা বাড়ালো। পিছন থেকে নরম গলায় সাদ বললো
“আমার কানাডা যাবার সময় হয়ে গেছে কিউটি। কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে চলে যেতে হবে।।
কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলো আশা। বুকে প্রচন্ড ঝড় উঠেছে। সে ঝড়ে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে ভেতরটা। না পারছে কাউকে বলতে আর না পারছে সইতে।

সাদ একপা একপা করে এগিয়ে এলো আশার কাছে। আশা তখনও উল্টো দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। সাদ নরম স্পর্শে পেছন থেকে আশাকে জরিয়ে ধরলো। ঝড়ের বেগে নিজেকে সে হাতের বন্দি থেকে ছাড়িয়ে নিলো আশা। প্রবল আর্তনাদে বলে উঠলো
“করছেন টা কি আপনি? যখন তখন এভাবে ধরার মানেটা কি। এটা আপনার শহর নয়, এটা একটা গ্রাম। আর গ্রামে মেয়েদের চরিত্রের অনেক দাম। একবার যদি সে চরিত্রে দাগ পরে যায় তাহলে তা সহজে মুছা যায় না। আম চাই না, আমার চরিত্রে কোনো দাগ লাগুক। আপনি কি আমার চরিত্রে দাগ লাগাবার জন্য উঠে পরে লেগেছেন?
সাদ আশার এই কথার কোনো প্রতিবাদ না করে ভারী গলায় বললো
“ভালোবাসি কিউটি, বড্ড ভালোবাসি। ফিরিয়ে দিও না আমায় প্লিজ।

কথাটা বুকে গিয়ে বিধলো আশার। কিভাবে সে ফিরিয়ে দিবে সে তার ভালবাসার মানু্ষটিকে? তবে সে তার কথায় অনড়। সাদ বলল
“কিছু বলবে না?
“আপনি চাইলে আমার ফ্যামিলির সাথে কথা বলে দেখতে পারেন।
সাদ আশাহত হয়ে বললো
“কিন্তু উনারা তো কোনো বিদেশে অবস্থানরত ছেলের কাছে তোমাকে বিয়ে দেবে না।।
আশা চোখ বুঝলো। সে অবস্থায় থেকে বললো
“আপনার কানাডা যাত্রা শুভ হোক।
সাদ বিষন্ন চোখে তাকালো আশার দিকে। কিন্তু আশা আর ফিরে তাকালো না। এক দৌড়ে চলে গেলো সেখান থেকে। তার ভেতরেও যে ঝড় চলছে।।

________
দেখতে দেখতে সপ্তাহখানেক কেটে গেছে। এবার আশার ঢাকায় ফেরার পালা। বিয়ের আমেজ কেটে গেছে পুরোটাই। আত্মীয়স্বজনেরা যে যার মতো চলে গেছে আরো আগেই।। ভাবীও মোটামুটিভাবে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে এই পরিবারের সাথে। ধীরে ধীরে হয়তো পুরোপুরি জড়তা কেটে যাবে তার। এ কয়দিন ভাবীর সাথে তার সময়টা খুব ভালো গেলেও মনের মধ্যে একরাশ হাহাকার পুরোটা সময় বিরাজ করেছে। সাদের সেই আকাঙ্ক্ষিত মুখটা বার বার ভেসে আসছিলো তার চোখে।

সমস্ত গোছগাছ শেষ হলে আশাকে নিয়ে রওনা করে আদিব। যদিও সে চেয়েছিলো একাই চলে আসতে, নতুন বিয়ে করেছে তাই ভাবীকে তার সময় দেওয়া দরকার। কিন্তু কে শুনে কার কথা। আদরের আশামনিকে সে একা এতোটা দুরের রাস্তায় ছাড়বে না। বাসায় এসে যখন পৌছুলো তখন বিকেল হয়ে এসেছে। আশা চারিপাশটায় তাকায়। কেউই নেই এই মুহূর্তে বাসায়। নিয়াশাদের রুমটা তালা লাগানো, আন্টির রুমও বন্ধ৷ আন্টি অফিসে বোধহয় আর সাদ…..
আশা একরাশ হতাশায় ঘরের তালা খুলে রুমে ঢুকে। কয়েক মুহূর্ত পর আদিবও চলে আসে আশার বাসা থেকে। তাকে আবার বাড়ি ফিরতে হবে। পুরো বাসায় সে একা। মুহুর্তে একাকীত্ব তাকে ঘিরে ফেলে বিশ্রীভাবে। প্রচন্ড শূন্যতায় কাতরাতে থাকে সে। একটা সময় ঘুমের গভীরে তলিয়ে যায় আশা।।

যখন ঘুম ভাংগে তখন রাত প্রায় আটটা। আশা ধীরপায়ে বেরিয়ে আসে রুম থেকে। আন্টির রুমের দরজা খুলা। আচমকা তার দেহে যেনো প্রাণ ফিরে আসে। সে দ্রুতপায়ে এগিয়ে যায় আন্টির রুমের দিকে। আন্টির জন্য নয়, এক নজর সাদকে দেখার জন্য। এতোক্ষণে বোধহয় বাসায় চলে এসেছে সে। হয়তো তার উপর রেগে আছে কিছুটা, কিন্তু এ রাগ তাকে দেখার পর আর থাকবেনা এই আত্মবিশ্বাস নিয়েই সে রুমে ঢুকে।। রুমটা ফাঁকা। কাউকেই দেখতে পাচ্ছেনা আশা। চারিপাশটায় সে চোখ বুলায়। রান্নাঘর থেকে কিছু একটার আওয়াজ আসছে। সে এগিয়ে যায় রান্নাঘরের দিকে। আন্টি খুব মনোযোগ সহকারে রান্না করছে।

সে সামান্য কাশি দিয়ে ডাক দেয় আন্টিকে..
“আন্টি…..
লুৎফুন্নাহার আশার দিকে ফিরে তাকায়। এক গাল হেসে বলে
“ঘুম ভাংলো?
“জি আন্টি। নিচের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয় আশা।
“কখন এসেছো?
“বিকেলে।
“তোমার ভাই দিয়ে গেছে বুঝি?
“জি।
“বড্ড ভালো ছেলেটা। তোমার মা কেমন আছেন?
“ভালো আছে।
“আর তোমার নতুন ভাবী?
“উনিও বেশ ভালো।
“আলহামদুলিল্লাহ! শুনে ভালো লাগলো। আমি বাসায় ফিরে তোমায় দেখতে পেয়ে ডেকেছিলাম।।এতোটাই ঘুমের ঘোরে ছিলে যে আমার ডাক তোমার কান অব্দি পৌঁছায় নি। তাই বেশি ডাকাডাকি করিনি।

আশা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো আগের যায়গাতেই। ইচ্ছে করলো একবার জিজ্ঞেস করুক সাদের কথা, মানুষটা কোথায় আছে, কেমন আছে জানতে ইচ্ছে করছে খুব। কিন্তু আন্টির কাছে তার ছেলের কথা জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করলোনা। উনি কি ভাববেন একথা জিজ্ঞাসা করার পর। কয়েক সেকেন্ড পর জড়তা কাটাতে আশা বললো
“কি রান্না করছেন আন্টি?
“আর বলো না, ছেলেটা আবদার করেছে তার নাকি বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছে করছে। তাই এটাই রান্না করছি।
আশার মুখ হটাৎ লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। হয়তো সাদের কথা মনে পরে গেছে তাই। পরক্ষনেই আবার মুখে আধার নেমে এলো। সেদিন এভাবে উনাকে না বললেও হতো। যতই মুখে না করুক না কেন, আগে থেকেই একটা ফিলিংস কাজ করতো সাদের প্রতি। ধীরে ধীরে সেটা ভালোবাসায় রুপান্তরিত হয়েছে। তবুও কখনো বলতে পারেনি। ওই যে কথায় আছে, মেয়েদের বুক ফাটলেও মুখ ফুটে বলতে চায় না। আশারও হয়েছে তাই। তবে এটা ভেবে ভালো লাগছে যে সাদও ওকে ভালো বাসে।

আশা আর কিছুটা সময় সেখানে থেকে চলে এলো নিজের রুমে। ফোন বের করে আরেকদফা বাড়িতে কথা বললো। এরপর নিয়াশার নাম্বারটা বের করে কয়েকবার চোখ বুলালো নাম্বারটায়। এই কয়দিনে বেশ কয়েক বার ওকে কল করা হয়েছে৷ কিন্তু রিসিভ করেনি। আশা আবার ট্রাই করলো এখন। সেই আগের মতোই ফোন বেজেই চলেছে। কিন্তু রিসিভ করছেনা। এক পর্যায়ে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে নিলার ফোনে ট্রাই করলো সে। দুবার রিং হতেই ফোনটা রিসিভ হলো।।
কোনো কথা না বাড়িয়ে আশা সরাসরি বলল
“কোথায় আছো তোমরা?
“কেন! তুই চলে এসেছিস বাসায়?
“এসেছি তো সেই বিকেলে। কেউ বাসায় ছিলোনা। এখন অবশ্য আন্টি এসেছে। উনার ছেলের জন্য রান্না করছে। সে যাইহোক, তোমরা কোথায় বলোতো, ফিরবে কখন বাসায়?

আশার কথা শুনে কিছুক্ষণ থমকে রইলো নীলা। আশা জিজ্ঞাসা করলো
“কি হলো, কথা বলছো না কেন?
“আচ্ছা, তুই কি ড্রিংক করে এসেছিস বাড়ি থেকে?.
“হটাৎ এ কথা বলছো কেন? ঠোঁট উল্টিয়ে বললো আশা।
নীলা ভারী গলায় বলল
“তাহলে আন্টি ছেলের জন্য রান্না করছে এই কথা বলছিস যে।
“রান্না করছেই তো। কেন রান্না কি করতে পারেন না উনি?
“সে রান্না করতেই পারে। কিন্তু ছেলের জন্য নয়, নিজের জন্য করছে বল।
“পাগল হইছো, আন্টি নিজে আমাকে বলছে উনার ছেলের জন্য রান্না করছে।
নীলা হটাৎ বলে উঠলো
“সেটা কি করে সম্ভব। আন্টির ছেলে মানে সাদ ভাইয়া তো গত তিনদিন আগেই কানাডা চলে গেছে।
কথাটা তীরের মতো গিয়ে বিধলো আশার বুকে। মুহুর্তেই হাত থেকে ফোনটা ধপাস করে নিচে পরে গেলো।

একরকম পাথরের মতো কিছুটা সময় বসে রইলো আশা। ওপাশ থেকে নীলা অনবরত হ্যালো হ্যালো বলেই চলেছে। সেদিকে কোনো হুশ নেই আশার। ওর মাথায় শুধু একটা কথায় ঘুরছে, সাদ চলে গেছে। ওকে ছেড়ে চলে গেছে। ওর কাছ থেকে অনেকটা দূরে চলে গেছে। এতটাই দূরে গেছে যে সে চাইলেই সাদকে দেখতে পাবেনা, কথা বলতে পারবেনা। আর কখনো সেই মিষ্ট গলায় কিউটি ডাকটি সে শুনতে পাবেনা। হটাৎ কয়েক ফোটা অশ্রু গাল বেয়ে পরতে লাগলো। আশা উঠে দাঁড়ালো। হাতের উল্টোপিঠে চোখদুটো মুছে তরিৎ বেগে ছুটে চললো আন্টির রুমে। ওর এখনও বিশ্বাস সাদ যায়নি। নীলা মজা করে কথাটা বলেছে ওকে।।
আশাকে হাপাতে দেখে প্রশ্ন করলো লুৎফুন্নাহার।
“এভাবে নিশ্বাস নিচ্ছো কেন আশা, তুমি কি শরীর খারাপ বোধ করছো?
আশা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো
“নাহ।
আন্টি আবার রান্নায় মন দিলেন।। রান্নার ফাঁকে বললেন
“তুমি কি আমায় কিছু বলতে চাও?
“কার জন্য বিরিয়ানি রান্না করছেন আন্টি?
উনি হেসে বললেন
“তখন বললাম তো আমার ছেলের জন্য রান্না করছি।

আশা কয়েক সেকেন্ড পর আবারও বললো
“কিন্তু নীলা তো বললো সাদ ভাইয়া চলে গেছে।
উনি আবারও হেসে ফিরে তাকালেন আশার দিকে। সুমিষ্ট গলায় বললেন
“সাদ চলে গেছে, কিন্তু আমার আরো একটা ছেলে আছে সেটা নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয়!!

চলবে……

#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-১৯

লক্ষ কোটি তারা ভেদ করে চাঁদের সুমিষ্ট আলো ধরণীর বুকে উঁকি মেরে আছে। চাঁদের সেই ক্ষীন আলো গায়ে মাখিয়ে অনেকেই হয়তো জোছনা বিলাস করছে। অনেকেই আবার এ চাঁদের সংকীর্ণ আলোতে নিজের মনের মানুষকে আহবার করায় ব্যস্ত। তবে ব্যস্ততা নেই আশার বুকে।। আশার মনের পুরোটাই নিরাশায় ছেয়ে আছে। প্রবল আর্তনাদে বুক ফেটে হাহাকার হয়ে যাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে মুষড়ে পরছে সে। না পারছে কাউকে কিছু বলতে, আর না পারছে কিছু সইতে।

পরের দিন সকাল সকাল ঘুম ভাংলে ভার্সিটির জন্য রেডি হয় সে। অনেকগুলো দিন মিস হয়ে গেছে। প্রচুর সময় নিয়ে এগুলো কভার করা লাগবে। যদিও কিছুটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আশা ঘরের দরজা লাগিয়ে নীলাদের রুমে চলে গেলো। ওরা গতরাতেই ফিরে এসেছে। তবে অনেক রাত হওয়ায় আশার সাথে দেখা হয়নি। সকালে দেখা হয়েছে। নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুধুমাত্র ভালো মন্দই জিজ্ঞাসা করা হয়েছে। তাও শুধুমাত্র নীলার সাথে, নিয়াশা তো তাকিয়েও দেখেনি।
আশা তবুও গেলো ওদের কাছে। নীলা রেডি হয়ে বসে আছে বিছানায়। নিয়াশা রেডি হচ্ছে। আশা সামান্য শব্দ করে বললো
“তোমরা এখনই বেরোবে তো?
“হ্যাঁ। ছোট্র করে উত্তর দিলো নীলা।
আশা মুচকি হেসে ঘরের ভেতরে গিয়ে ঢুকলো। নীলার পাশে বসতে বসতে নিয়াশাকে উদ্দেশ্য করে বললো
“তোমার আর কতটুকু সময় লাগবে রেডি হতে?

আশার কথার কোনো উত্তর দিলোনা নিয়াশা। তবে সে ঝাঝালো ভাবে তাকালো নীলার দিকে। ক্ষীপ্ত গলায় বললো
“তুই কি আমার সাথে যাইবি নাকি ওর সাথে?
নীলা সামান্য রাগ নিয়ে বললো
“মেজাজটা ঠিক কর। সবসময় এইরকম মেজাজ ভালো লাগেনা।।
নিয়াশা আবারও বললো
“আমার মেজাজ যখন এতই খারাপ, তুই চইলা যা ওর সাথে। আমারে জ্বালাইস না।।
নীলা রাগে ফেটে পরছে। এ নিয়াশা তো আগে এমন ছিলোনা। সামান্য ভুল বুঝাবুঝির কারণে এতটা চেঞ্জ মানুষ কিভাবে হতে পারে।
আশা মুচকি হাসলো। নীলার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো
“আমি কখনোই চাইবো না, আমার কারণে তোমাদের দুইজনের এতদিনের বন্ধুত্ব নষ্ট হোক। তোমরা চলে এসো, আমি নাহয় একাই চলে যাচ্ছি।
“তুই একা কেন যাবি, আমাদের সাথেই যাবি তুই। শক্ত গলায় বললো নীলা।। তখনই নিয়াশা হুংকারে বলে উঠলো
“হয়তো ওর সাথে যাবি, আর নয়তো আমার সাথে।

নীলা হতাশ হলো এবার। তবে আশা তেমন কোনো রিয়েক্ট না করে নিয়াশার দিকে তাকিয়ে হাসলো। এরপর নীলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পরলো একাই।

চারিদিকে কোলাহল, গাড়ির হর্ণে কান ফেটে যাবার অবস্থা। কর্মব্যস্ত মানুষের যাতায়াত আর ফুতপাতে অসংখ্য মানুষের আহাজারি, সবাইকে পেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে আশা। একটা সময় পৌঁছে যায় কলেজের কাছাকাছি। এদিকের রাস্তাটা খানির নিরব, নিস্তব্ধ। শুধুমাত্র ভার্সিটির স্টুডেন্টদের আনাগোনাই বেশি দেখা যায় এদিকে।। আশা যখন ভার্সিটির কাছাকাছি চলে আসে তখন হটাৎ সামনে চোখ পরতেই সে থমকে যায়। ভার্সিটির গেইটের ঠিক সামনে বাইকে হেলান দিয়ে বসে আছে রানা। চোখে কালো চশমা, হাতে ব্রেসলেট, গলায় মোটা চেইন, এক কানে দুল, মাথায় পট্রি বাধা। কোনো অংশে কোনো ভদ্র ছেলেদের কাতারে রাখা যায় না তাকে। পুরোই বখাটে।
আশা সেসব ইগ্নোর করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। তার চোখেমুখে ভয় নেই, আছে স্পষ্ট রাগ। সেদিনকার সেই দুর্ব্যবহার সে কোনো দিনও ভুলবে না। আশা যখন ভার্সিটির গেইটে পা রাখবে ঠিক তখনই কারো হ্যাচকা টানে সে নিচে পরে যায়।

চারদিকের স্টুডেন্টরা ওর দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। মাটিতে পরে থেকেই সে রানার দিকে তাকায়। রানা তার ঠিক পাশেই দাঁড়ানো। এমনভাবে সে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে যেনো, আশাকে পরে যেতেও সে দেখেনি। আশার মেজাজ খারাপ হয়, কারণ এটা যে রানার কাজ তাতে কোনো সন্দেহ নয়। তবুও আশা কোনো কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ উঠে পরে। একরাশ ঘৃণা নিয়ে আবারও ভার্সিটির গেইটে পা দিতে যায়, তখন আবারও আগের মত হ্যাচকা টান দেয় আশাকে। তবে এবার সে আর নিচে পরে না। কোনো রুপ নিজেকে সামলে নেয়। এবার আর রাগকে দমিয়ে রাখতে না পেরে ঝাঝালো গলায় প্রশ্ন করে
“কেন বার বার আমার সাথে এমন করছেন আপনি?
রানা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে
“আজ নাগরকে দেখছি না, নাগর উড়াল দিলো নাকি!

আশা আবারও রেগে যায়। মাটিতে ঘৃণার সাথে একরাশ থুথু ফেলে বলে
“আমি আপনাকে মুখ সামলানোর জন্য বলবোনা, এইসব বাজে কথা বলার জন্য মানাও করবোনা। ইনফ্যাক্ট ভদ্র হবার জন্যও আহবান করবো না। কারণ আমি জানি, আমি যতই কুকুরের লেজ সোজা করতে যাই না কেন, সেটা বাকাই থাকবে। সোজা হবেনা কখনো। তাই শুধু শুধু নিজের এনার্জি লস করার কোনো মানেই নেই।
আশার কথা শোনার পর প্রচন্ডভাবে রেগে যায় রানা। সকলের সামনে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে কষিয়ে চর বসিয়ে দেয় আশার গালে। আশা ছিটকে পরে মাটিতে। পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ গালে স্পষ্ট ভেসে উঠে। আশা নির্বাক, একটা মানুষ এতটা খারাপ কিভাবে হতে পারে।
চারিদিকের নির্বাক দর্শকের ভীড়ে আশা কারো পায়ের আওয়াজ পায়, সেদিকে চোখ মেলে তাকায় সে। নিয়াশা দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। আশার এবার খুব কান্না পায়, হাজার অপরিচিত মানুষের ভীড়ে হটাৎ কোনো কাছের মানুষকে দেখলে ধরে যেমন প্রাণ আসে, আশারও মনে হলো, এই মুহূর্তে নিয়াশাই যেনো ওর প্রাণ।

আশা কাতর চোখে নিয়াশার দিকে তাকিয়ে থাকে। নিয়াশাও কিছুক্ষণ অবিরামভাবে দেখতে থাকে আশাকে। এক পর্যায়ে আশাকে অবাক করে দিয়ে ওকে পাশ কাটিয়ে ভার্সিটির ভিতরে ঢুকে যায় নিয়াশা। স্তব্ধ হয়ে যায় আশা, সে জানতো নিয়াশা ওর প্রতি রেগে আছে, কিন্তু এতটা ঘৃণা করে ওকে সেটা জানা ছিলো না। আশা ধীরপায়ে উঠে দাঁড়ায়। এক পলক রানার দিকে তাকায়। রানা রহস্যময় হাসি হেসে বলে
“প্রিয় বান্ধবীটাও পাশ কাটিয়ে চলে গেলো তো? নাগরটাও রেখে চলে গেছে। এভাবে সবাই যাবে, তোকে একা করে দিয়ে। কাউকে পাবিনা তুই। শেষে এমন এক যায়গায় গিয়ে পৌছুবি, কোনো উপায় না পেয়ে তোকে আমার কাছেই আসতে হবে। তখন আমি তোকে আমার ব্যক্তিগত দাসী করে রাখবো।
“মানুষ চাইলে কিনা স্বপ্ন দেখতে পারে, আপনিও দেখুন। আমি মানা করবো না। কেউ যদি কোনো অবাস্তব কল্পনা দেখে বিন্দুমাত্র সুখ পায়, আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই।

আশা চলে গেলো ভার্সিটির ভেতর। রানার চোখেমুখে স্ফুলিঙ্গ। প্রচন্ড রাগে তার কপালের রাগ ক্ষণে ক্ষণে ফুলে উঠছে। হাতের আঙ্গুলগুলো বার বার মুঠোবন্দী করছে সে।

ভার্সিটি থেকে বাসার ফেরার পরে খুবই ক্লান্ত শরীরে রুমে প্রবেশ করে আশা। কিন্তু রুমে ঢোকার পর প্রবলভাবে চমকিত হয় সে। রুমের হাল খুবই খারাপ। পুরো রুমে ময়লা আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দুর্গন্ধে রুমে টিকে থাকা দায়। আশা খেয়াল করলো ভাত তরকারির রেকটা খুলা। ওর স্পষ্ট মনে আছে সকালে সে এটা লাগিয়ে গিয়েছিলো। আশা ওটা লাগাতে গিয়ে দেখলো ভাত তরকারির হাড়ির ঢাকনা পরে আছে মেঝেতে ময়লার সাথে। আশা সেগুলো তুলে নেয় বিরক্তির সাথে। হটাৎ রুমের অবস্থা এমন হলো কিভাবে?
সে ঢাকনাগুলো হাতে নিয়ে বাইরে গিয়ে পরিষ্কার করতে যাওয়ার পথে হটাৎ কি যেনো মনে করে ফিরে আসে। রেক থেকে ভাত তরকারির হাড়িগুলো বের করে আরেক দফা চমকে যায় সে।। পাতিলগুলোতে ভাত তরকারি নেই, তার বদলে রয়েছে ডাস্টবিনের নোংরা পঁচে যাওয়া ময়লা।

সে ভাবতে থাকে এগুলো কোথা থেকে এলো। ঠিক সেইসব ভাবতে থাকার এক পর্যায়ে ফোনের মেসেজ টোন বেজে উঠে। আশা পাতিলগুলো নিচে রেখে মেসেজটা ওপেন করে। রানা মেসেজ পাঠিয়েছে। সেখানে লেখা আছে
“এটা শুধু ট্রেইলার। এরচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি তোর জন্য অপেক্ষা করছে সামনে। এভাবেই একটু একটু করে তোর জীবনটা আমি নরকের চেয়েও ভয়াবহ করে তুলবো। তুই শুধু দেখে যা, আমি কি কি করতে পারি।

মেসেজের লাইনগুলো পড়ে সে খপ বিছানায় বসে পরে আশা। সারা শরীর প্রচন্ডভাবে ঘেমে গেছে। আরেক দফা সে মেসেজটা পড়ে। আশার মনে শুধু ঘোরপাক খেতে থাকে একটা কথায়, ও যতটুকু যানে রানা ওর বাসা চিনতো না, তাহলে কিভাবে সে এখানে এসে এমন করতে পারে? আর তাছাড়া রুম তো তালা লাগানো ছিলো, আর চাবিও একমাত্র ওর কাছেই আছে। ইনফ্যাক্ট বাসায় ফিরেও সে রুম তালাবদ্ধ অবস্থাতেই পেয়েছে। তাহলে এতসব কিভাবে ঘটলো?
আশা আর ভাবতে পারে না। আবর্জনার দুর্গন্ধে বমি আসছে। এগুলো আগে পরিষ্কার করতে হবে। যা ভাবার পরেও ভাবা যাবে।
আশা এক এক করে সবকিছু পরিষ্কার করে নেয়। এরপর রুমটা ভালো করে ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে মুছে ফ্যান ছেড়ে দেয় শুকানোর জন্য। হাড়ি পাতিলগুলো নিয়ে যায় পরিষ্কার করার জন্য। অতঃপর সেগুলো পরিষ্কার করা শেষ হলে ফ্রেশ হবার জন্য ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়। এতসব ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করার দরুন গা ঘিন ঘিন করছে তার। এই মুহূর্তে গোসল করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

আশা কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমের ঢুকার আগ মুহুর্তে ওর ঠেলে দিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ঢুকে পরে নিয়াশা। আশা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। অনেক আগেই নিয়াশা বাসায় ফিরেছে। এতটা সময় আশা যখন কাজে ব্যস্ত ছিলো তখন সে রুমে শুয়ে বসে সময় কাটাচ্ছিলো। আশাকে আবর্জনা পরিষ্কার করতে সে দেখেছেও। তারপরও সে কেন এমনটা করলো…!!
রাতে খাওয়া দাওয়া করে বিশ্রাম নেবার পর বিছানায় গা এলিয়ে দেয় আশা। এমন সময় আবারও ফোনের মেসেজ টোন বেজে উঠে। আশা দেখলো রানা আবারও মেসেজ পাঠিয়েছে। হতাশ হলো আশা। এই ছেলে কেন তার সাথে বার বার এমন করছে? আশা পড়তে শুরু করলো মেসেজটা,
“আমার পরবর্তী পরিকল্পনার অংশ হওয়ার জন্য তৈরি হয়ে যা।।

আশা এবার রাগ সামলাতে না পেরে উঠ বসে পরে। কয়েক বার জোরে জোরে নিশ্বাস ছেড়ে একবার ফোনের দিকে তাকায়। এরপর সিম কার্ডটা ফোন থেকে খুলে সেটাকে ভেঙ্গে কয়েক টুকরো করে ফেলে। টুকরো গুলো ময়লার ঝুড়িতে ফেলে সে রাগে ফুসতে থাকে। কিছুটা সময় কেটে যাবার পর আশার মনে হয় সে সিম কার্ড ছাড়া বাড়িতে কিভাবে কথা বলবে!
এই ভাবনা থেকে সে বোরকাটা পরে বাসার বাইরে বেরিয়ে আসে। বাসার পাশেই একটা সিমের দোকান আছে। সেখানে গিয়ে কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হয় তাকে। দোকানে প্রচন্ড ভীড়। একটা সময় ভীড় কমলে আশা নিজের নামে রেজিস্ট্রি করে একটা সিম নেয়। বাসায় এসে সিমটা ফোনে সেট করে বাড়িতে কথা বলে নেয় আগে।

এবার সে নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে পরে। এবার আর যাইহোক, ফোনে আর জ্বালাতন করতে পারবেনা রানা।
পরের দিন সারাদিন পার হয়ে যায় ভালোই ভালোই। ভার্সিটির পথে রানাকে দেখা যায়নি আর। সারাদিনের ব্যস্ততা দূর করে বিকেলে রান্না করে সামান্য রেস্ট নেয় আশা। রাতে পড়ার এক ফাঁকে হটাৎ একটা কল আসে। যেহেতু সিম নতুন, আর নাম্বারটাও বাড়ির কেউ ছাড়া আর কেউ জানেনা, তাই আশা নিশ্চিন্তে নাম্বার চেক না করেই কল রিসিভ করে। ভাই ছাড়া আর কেউ কল করবে না এটা সে নিশ্চিত। কিন্তু আশাকে অবাক করে দিয়ে ফোনের ওপাশ থেকে একটা কর্কশ গলার হাসির আওয়াজ ভেসে আসে। আশা কপাল কুচকায়। ওপাশের হাসির আওয়াজ এখনো থামছেনা। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে আশা বলে
“কথা না বলে নিজের এই বীভৎস হাসিটা শোনানোর জন্য কল করছেন!! কে আপনি?.
“কি ভেবেছিলি, সিম কার্ড চেঞ্জ করলেই আমি তোকে আর ফোন করতে পারবোনা? ভাবলি কি করে তুই এটা?
আশা থমকে গিয়ে প্রশ্ন করে
“নাম্বার কোথায় পেলেন আপনি?
আবারও সেই বীভৎস হাসিটা হেসে রানা বলতে লাগলো
“আমি রানা, আমি সব করতে পারি। যেখানে তোর বাড়ির এ টু যেট আমার জানা, সেখানে সামান্য একটা নাম্বার যোগার করা আমার জন্য কোনো দুঃসাধ্য বিষয়ই নয়।

চলবে….