ভালোবাসি তাই পর্ব-৪২

0
580

#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-৪২

আশা এক নজরে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। মানুষটাকে তার চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু স্পষ্টভাবে চিনতে পারছেনা। মুখে কালো গ্লাস আর মাস্ক থাকার কারণে সেই সাথে মাথায় ক্যাপ থাকার কারণেও চেহারাটা স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছেনা। আশার মনে প্রশ্ন উদয় হয়,
“কে হতে পারে এই মানুষটা?
এইসব ভাবতে ভাবতেই লোকটি চলে আসে হলুদের স্টেজের কাছাকাছি। আশা মাথা নিচু করে এবার, চুপচাপ বসে থাকে নিজ যায়গায়।
ছেলেটি স্টেজের কাছে এসে আদিবের দিকে তাকায়। আদিব মুচকি হেসে আশার পাশে গিয়ে বসার জন্য চোখে ইশারা করে।
ছেলেটি আশার দিকে তাকায়। সে ধীরপায়ে স্টেজে গিয়ে উঠে।
যারা ভিডিও করছে ইভেন ফটোশুট করছে তাদের দিকে তাকিয়ে আদিব বললো
“এখনকার ছবি আর ভিডিওগুলো যেনো স্মুথলি করা হয়।।

আশা নিরবে বসে রইলো। ছেলেটা হলুদের বাটিয়ে থাকা হলুদ গাঁদা ফুলটা হাতে নিয়ে তাতে সামান্য হলুদ লাগালো। এরপর আশার দিকে তাকিয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ড। এক সময় সে হাসলো, মাস্ক পরনে থাকলেও হাসছে সেটা স্পষ্ট হলো। আশা অবাক হয়ে তাকালো ছেলেটার দিকে। আশার তাকানো দেখে ছেলেটি হাসি থামিয়ে দিলো। পরক্ষণে আশাও চোখ সরিয়ে নিলো। ছেলেটি গাঁদা ফুলটা নরম হাতে আশার কপালে স্পর্শ করালো, এরপর গালে আর হাতে ছুয়ালো। সামনে থাকা প্লেট থেকে কাটা চামচ দিয়ে সামান্য মিষ্টি নিয়ে আশার মুখের সামনে ধরলো।। ভদ্রতার সাথে আশা সেটি মুখে পুরে নিলো।
এরপর কয়েক সেকেন্ড আবারও চুপচাপ বসে রইলো। আশা এখনো নিশ্চুপ। এবার ছেলেটি আশার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো
“কিউটি..
চমকে উঠলো আশা, বিস্ময়ে তাকালো সাদের দিকে।।
সাদ আবারও হাসলো। মৃদু গলায় বললো
“আমায় খাওয়াবে না?
আশা অতি বিস্ময়ে বলে উঠলো
“আপনি?

সাদ নরম গলায় বললো
“আমার বউকে হলুদ দিতে এসেছি।
আশা প্রচন্ড অবাক। সে ঝট করে আদিবের দিকে তাকালো। আদিব কিছুটা দুরেই দাঁড়িয়ে আছে। সে হেসে চোখের ইশারায় জানান দিলো সাদের আসার ব্যাপারে সবটা সে জানে। আশা আবারও ফিরে তাকালো সাদের দিকে। বললো
“আপনি আসবেন আমাকে তো বলেন নি!
“সারপ্রাইজ।
আশা নিচের দিকে তাকিয়ে বললো
“আপনাকে প্রথমে দেখেই আমার কিছুটা চেনা লাগছিলো।। মুখ ঢেকে রাখার কারণে চিনতে পারছিলাম না।।
“আমার কিউটি আমায় চিনতে পারেনি, এটা আমার জন্য অত্যন্তই দুর্ভাগ্যজনক বিষয়।
আশা মিহি গলায় বললো
“কিভাবে চিনবো.. চোখমুখ ঢেকে ডাকাতের মতো এসেছেন যে।।
আশার কথা শুনে বিষম খেলো সাদ। এরপর বড় বড় চোখ করে ওর দিকে তাকিয়ে বললো
“আমাকে ডাকাতের মত লাগছে?
আশা মুচকি হেসে বললো
“হুম, তবে হ্যান্ডসাম ডাকাত।
সাদ এবার হাসলো।

বেশ কিছুটা সময় কেটে গেলে আশার কানে কানে সাদ বললো
“এবার আমায় যেতে হবে কিউটি।।
আশা কিছুটা চিন্তায় পরে গেলো, এরপর অস্থির গলায় বললো
“এত রাতে কিভাবে যাবেন একা একা? আর এখন গাড়িই পাবেন কোথায়?
সাদ হেসে বললো
“একা নয়, আমার সাথে আমার বোনের বর এসেছে। মানে আমার দুলাভাই। আর দুলাভাই এর নিজের গাড়ি আছে, আমরা সেটাতে করেই এসেছি।
আশা একটু নড়েচড়ে বসলো। এরপর বললো
“আপনার দুলাভাই মানে তো আমারও দুলাভাই?
“হুম। হেসে বললো সাদ।
“তাহলে উনি কোথায়? দেখতে পেলাম না যে।
“উনি গাড়িতে বোধহয়।।
“সেকি কথা। উনি বাড়িতে আসেন নি? বাইরেই বসে আছেন এতটা সময়?
সাদ হেসে বললো
“উনাকে নিয়ে তোমার টেনশন করতে হবে না। বর্তমানে উনার সমস্ত দায়িত্ব আমার সম্বন্ধী ভাইয়ের উপর।
আশা আর কোনো কথা বাড়ালো না।
সাদ যখন আশার কাছ থেকে উঠে আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তখন আশা মুচকি হেসে বললো
“সাবধানে যাবেন।
“অবশ্যই সাবধানে যাবো। তুমিও সাবধানে থেকো কিউটি, কাল আবারও আসবো। তোমায় রাণী করে নিয়ে যেতে। তৈরি থেকো..

কিছু সময়ের মধ্যেই সেখান থেকে ফিরে আসার জন্য রওনা করলো সাদ। আদিব আর আশার কাছে বিশেষভাবে অনুরোধ করে এলো যেন এদের আসার কথা কেউ না জানে।

পরের দিন খুব ভোর থেকেই সবার ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেলো। ফজরের আগেই বিশাল সাইজের এক গরু জবাই করা হয়েছে, অনেকে মিলে সেই গরু পিস পিস করে কাটায় ব্যস্ত। আদিব মাঝেমধ্যে এসে সেখানকার তদারকি করে যাচ্ছে। এক ভাবে বসে থাকতে পারছেনা, ওকে সবদিক সামলাতে হচ্ছে তাই। মৃদুলাসহ আরো অনেক মহিলারা মিলে রান্নাঘরে ব্যস্ত সময় পার করছে, দিলারাও আজ বসে নেই। বাইরে উঠোনে মাটি গর্ত করে চুলো বানিয়ে বিশাল সাইজের হাড়ি বসানো হয়েছে। সেই বিশাল সাইজের হাড়িগুলো তে বাবুর্চিরা রান্না করছে৷
বেলা কিছুটা হলে পার্লার থেকে দুজন মেয়েকে আনানো হয়েছে। যেহেতু আজ অনেক কাজ, তাই আশাকে পার্লারে নিয়ে যাবার মতো কেউ ছিলো না। সেই দিক ভেবেই মৃদুলা আদিবকে এই কথাটা বললে আদিব আর দুইবার চিন্তা করে না। বেশি টাকা লাগলে লাগুক, তবুও আজকের দিনটায় বোনকে আরো বেশি সুন্দর লাগা চাই। গতকাল রাতে সাদ আর তার বোন জামাই আশার জন্য কেনা বিয়ের জিনিসপত্র, শাড়ি.. সবকিছুই সাথে করে নিয়ে এসেছিলো। পরে আদিবকে বাড়ির লোকেরা জিজ্ঞাসা করলে বলেছিলো, ও বাড়ি থেকে কোনো একজন এসে দিয়ে গেছে।

ওদিকের সমস্ত আয়োজন শেষ। সাদকেও রেডি করা হয়ে গেছে। বাকিরাও তৈরি, এবার রওনা করার পালা। লুৎফুন্নাহার বেশ ব্যস্ত, তবে তিনি কর্মব্যস্ততার মাঝেও ছেলের দিকে বার বার চোখ বুলাচ্ছেন। সাদকে শেরওয়ানিতে আজ কোনো দিক দিয়ে রাজকুমারের চাইতে কম লাগছেনা। চোখ জুরিয়ে যাচ্ছে লুৎফুন্নাহারের। বার বার আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছেন, যেনো কারো বদ নজর না লেগে যায়। বেরোনোর আগে সাদ রুম থেকে এসে নিয়াশার খোঁজ করে, গতকাল সন্ধ্যের পরেও ওর সাথে কথা হয়েছে সাদের, সে কথাও দিয়েছে বরযাত্রী যাবে সে। কিন্তু আজ নিখোঁজ, যদিও সকাল থেকে এই অব্দি তার সাথে দেখা হয়নি নিয়াশার। ব্যস্ত থাকার কারণে সেও আগ বাড়িতে খোঁজ নিতে পারেনি, কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা, ইনফ্যাক্ট রুমের দরজায়ও তালা দেওয়া।
সাদের কপালে সুক্ষ্ম চিন্তার রেখা৷ সে দাঁড়িয়ে থেকে ভাবতে লাগলো কোথাত যেতে পারে নিয়াশা৷

সাদকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর দিকে এগিয়ে আসে সাইমা। মুচকি হেসে বললো
“এখানে দাঁড়িয়ে আছিস যে, আমাদের এবার রওনা করতে হবে।
সাদ হেসে বললো
“এমনি দাঁড়িয়ে আছি।।
কয়েক সেকেন্ড পর সাইমাকে সাদ বললো
“এ রুমে যে একটা মেয়ে ছিলো, ও কোথায় গেছে বলতে পারিস আপু?
সাইমা বললো
“নিয়াশার কথা বলছিস?
“হুম।
“ওকে তো দেখলাম খুব ভোরেই ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে গেছে। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম কোথায় যাচ্ছে, বললো ওর মা নাকি অসুস্থ তাই বাড়ি যাচ্ছে।
সাদ কপাল কুচকে বললো
“আজ আমার বিয়ে, আর ও চলে গেলো! তুই আটকাতে পারলি না?
“আমিতো থেকে যেতে বলেছিলাম, কিন্তু ওর মায়ের অসুখ, জোর করে রাখি কি করে।
সাদ আর কথা বাড়ালো না। সাইমা ওকে তাড়া দিয়ে বললো তারাতাড়ি রুমে আসার জন্য। এবার রওনা করবে।

সাইমা রুমে চলে যাবার পরও সাদ আগের যায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো। স্পষ্ট বুঝতে পারলো নিয়াশার চলে যাবার কারণটা কি। মায়ের অসুখ, সেটা তো উছিলা মাত্র।
সাদ এক দুই আর না ভেবে রুমের দিকে পা বাড়ালো।
রওনা করার আগে মায়ের পায়ে ধরে সালাম করলো সাদ। এরপর মাকে জরিয়ে ধরে হাসিমুখে বললো
“আমার নতুন জীবনের জন্য দোয়া করবে না মা?
লুৎফুন্নাহার হেসে সাদের কপালে চুমু খেয়ে নরম গলায় বললো
“মায়ের দোয়া মন থেকেই হয়ে যার রে পাগল, মুখে বলতে হয় না। তবুও আমি বলছি, তোর নতুন জীবনে আল্লাহ যেনো তোর সহান হোন। আল্লাহর ইচ্ছায় তোরা সুখী হো।।
সাদ আবারও জরিয়ে ধরলো মাকে।
এবার সাইমা পাশ থেকে বললো
“তোমাদের ভালোবাসা শেষ হলো? রাস্তাটা কিন্তু অনেক দুরের, সেখানে গিয়ে বিয়ের কাজ কমপ্লিট করে আবার আমাদের ফিরেও আসতে হবে।
লুৎফুন্নাহার মুচকি হেসে সাদকে ছাড়লো। এরপর আবারও কপালে চুমু খেয়ে বললো
“আল্লাহ যেনো তোদের ভালোই ভালোই ফিরিয়ে নিয়ে আসে।

আশাদের বাড়িতে যেতে যেতে প্রায় দুপুরের মতো হয়ে যায়। বিশাল বিয়ের গেইটের সামনে দাড়িয়ে আছে বরযাত্রীরা। সাদ এখনো গাড়িতেই। গেইটের অন্যপাশে কনেপক্ষরা দর কষাকষি করছে। বিশাল অংকের টাকার আবদার তাদের, টাকা পেলেই গেট ছাড়া হবে। সাদের বোন জামাই আর ওর বড় ভাই সাঈম হিসেবে বেশ পাকাপোক্ত। ওরাও ছাড়ার পাত্র নয়, বেশ হৈ-হুল্লোড় পড়ে গেছে সেখানে। ছেলেপক্ষরা যেমন হিসেবে পাকা, তেমনই মেয়ে পক্ষরাও নাছোরবান্দা। অবশেষে মেয়ে পক্ষের কাছে হার মেনে ওদের নায্য দাবী পুরণ করেই ভেতরে ঢুকতে পেরেছে তারা।

এর ফাঁকে আদিব এলো সেখান টায়। ওর সাথে দিলারাও এসেছে। তিনি গাড়ির কাছে গিয়ে প্রথমে সাদকে মিষ্টি মুখ করালেন, এরপর একটা সোনার আঙটি পরিয়ে গাড়ি থেকে নামালেন সাদকে। সাদ গাড়ি থেকে নেমে সর্বপ্রথম দিলারাকে সালাম করলো, এরপর আদিবকেও করতে যাচ্ছিলো। কিন্তু আদিব কপাল কুচকে পিছিয়ে যায়৷ কপালে ভাজ এনে বলে
“আমি এখনো বুড়ো হই নি।
আদিবের কথায় সাদ হাসে, দিলারাও আচলের আড়ালে মুখ ঢেকে হাসেন।

স্টেজে বসানো হয় সাদকে। বাকিদেরকে প্যান্ডেলে বসিয়ে খাবারের আয়োজন করা হয়। সাদসহ আরো কয়েক জন, ওর দুলাভাই, ওর বড় ভাই.. আর কিছুজন যারা স্টেজে বরের সাথে ছিলো তাদের সেখানেই একটা বড় থালাতে করে খাবার দেওয়া হয়। সেখানেও কনেপক্ষরা হাত ধোঁয়ানোর টাকা নিয়ে আরেক দফা কথা কাটাকাটি করে আসে।
মেয়েপক্ষদের তর্কের কাছে হেরে গিয়ে তাদের দাবী পূরণ করতে হয় ছেলেপক্ষদের।

অবশেষে সমস্ত ফর্মালিটি কমপ্লিট করে কাজী সাহেব সাদকে দিয়ে একটা পেপারে সিগ্নেচার করিয়ে কবুল বলার জন্য বলে। সাদ মুচকি হেসে বিনা দ্বিধায় কবুল বলে নেয়।
এবার আশার পালা। আশার ওখানে গিয়ে কাজী সাহেব যখন ওকে কবুল বলার জন্য বলে তিখন আশার মনে কাঁপন ধরে, সারা শরীরেও কাঁপুনি উঠে তার। এক অজানা অনুভুতি তাকে জরিয়ে ধরে চারিদিক থেকে। আশা কাঁপছে। মৃদুলা তাকে সামান্য নাড়া দিয়ে বলে
“বলো আশা।
আশা মৃদুলার দিকে তাকায়। মৃদুলা তাকে চোখের ইশারায় আস্বস্ত করে কবুল বলার জন্য অনুরোধ করে।
আশা চোখ বন্ধ করে এবার। এরপর মনে মধ্যে জোর এনে বলে
“কবুল।।
কাজী সাহেব বলে উঠেন
“আবার বলো মা।
আশা আবারও বলে উঠে। একে একে তিনবার করে এই কথাটা বলানো হয়।

বিদায় বেলা আশার কান্না যেনো থামছেই না। একবার মাকে জরিয়ে ধরে কাঁদছে তো একবার ভাইকে। দিলারা মেয়ের শোকে বার বার জ্ঞান হারানোর দশায় চলে যাচ্ছেন। মৃদুলা উনাকে বেশ কষ্টে সামলাচ্ছেন। আদিব বোনকে জরিয়ে ধরে, আশাও শক্ত কর জড়িয়ে ধরে তার ভাইকে। আদিবের চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরে যাচ্ছে। তবুও বোনকে সাহস যোগাতে বলছে..
“কাঁদিস না আশামনি, তুই নিজের ঠিকানায় যাচ্ছিস। নিজের সংসারে পা দিচ্ছিস। সেখানে তোর হাসিমুখে যাওয়া উচিৎ।
আশা কেঁদেই যাচ্ছে বার বার। ওকে শান্তনা দেওয়ার মতো আর কোনো ভাষাও খোঁজে পাচ্ছেনা আদিব। সে নিজেও মর্মাহত হচ্ছে,নিজের বুকও ফেটে যাচ্ছে। অবশেষে সাদের হাতের মুঠোয় আশার হাতটা রেখে হাতদুটো বন্দি করে দেয় আদিব। কান্নাজড়িত গলায় সাদের নিকট আবদারের স্বরে বলে
“বেশি কিছু চাই না, শুধু আমার আশামনিকে ভালো রেখো।
সাদ আদিবের হাতটা শক্ত করে ধরলো। এরপর আদিবকে শান্তনা দিয়ে বললো
“আমি নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসি কিউটিকে। ওর কষ্ট হলে আমার নিজেরই কষ্ট হবে বেশি। কারণ ও আমার শ্বাস প্রশ্বাস। নিজেকে সামলান ভাইয়া, আমি কখনোই চাইবো না আমার শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাক।

চলবে…..