ভালোবাসি তোকে সুহাসিনী পর্ব-২১+২২

0
204

#ভালোবাসি_তোকে_সুহাসিনী
পর্ব,,,২১
মৌমো তিতলী

সকাল ৭:২০ মিনিট। হন্তদন্ত হয়ে সিটি হসপিটালের ভেতরে প্রবেশ করে সাহিত্য। হসপিটালের বাইরে পুলিশের গাড়ির বহর। প্রেস মিডিয়ার লোকেরাও ভিড়ে জায়গা করে নিয়েছে। কারো বিপদ তো কেউ সেই বিপদের খবর সংগ্রহ করে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে,কেউ কেউ সেই ঘটনার ইনভেস্টিগেশন করছে। হসপিটালের ভেতরে সব ডক্টর নার্সরা এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। মনে হচ্ছে পেসেন্টের থেকে বেশি জরুরি এমপি সোহরাব সাহিত্য মির্জার এই হসপিটালে আসাটা। যেন সাহিত্য কে জামায় বরণ করতে পারলেই তাদের শান্তি‌। অধৈর্য হয়ে একজন ডক্টরকে ধমক দেয় সাহিত্য।

:- আপনারা প্লিজ এগুলো বন্ধ করুন আর বলুন আমার বন্ধু তিয়াশের কন্ডিশন এখন কেমন? আমি কি একবার দেখা করতে পারব??

ডঃ মজুমদার সেই সময় আইসিইউ থেকে বেরিয়ে আসেন।(এখন যেন আবার কেউ আমারে জিজ্ঞাসা কইরেন না আইসিইউ এর ফুল মিনিং কি) 🤭🤭
তাকে দেখে সেদিকে এগিয়ে যায় সাহিত্য। তিয়াশের কন্ডিশন জানতে চাইলে তিনি এগিয়ে এসে বলেন,,

:- চিন্তা করবেন না এমপি সাহেব। পেসেন্ট এখন আউট অফ ডেঞ্জার!! তবে তিনি এখন কথা বলতে পারবেন না। কড়া ঘুমের ইনজেকশন দেয়া হয়েছে। অনেক জায়গায় বড় বড় ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। যে মেরেছে সে খুবই নির্মমভাবে ছুরি দিয়ে কোপ গুলো মেরেছে। পেসেন্ট যে শেষ পর্যন্ত সারভাইভ করছে সেটাই একটা মিরাক্কেল ,এবং আল্লাহর রহমত। দোয়া করুন যেন তাড়াতাড়ি সবকিছু ঠিক হয়ে যায়। এটা বলেই ডক্টর চলে যান তার চেম্বারের দিকে।

ডক্টর যেতেই পাশে রাখা চেয়ারে ধপ বসে পড়ে সাহিত্য ।কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার। ঠিক এই ভয়টাই পেতো সব সময়। তার জন্য না তার বন্ধুদের কখন বিপদ হয়। সব সময় ভয় তাড়া করে বেড়ায় কখন বন্ধুদের কোন ক্ষতি হয়ে যায়!!আর সেটায় হলো। অরুদ্ধ আর তিয়াশকে সাফার করতে হচ্ছে তার জন্য। এমন সময় অরুদ্ধ আর সিফাত এসে বসে সাহিত্যের পাশে। অরুদ্ধের ডান হাতে প্লাস্টার করা। ভেঙেছে সেটা।

সকালে অরুদ্ধই ফোন করে সাহিত্য কে বলেছিলো তার আর তিয়াশের ওপর আমজাদ তালুকদারের লোকেরা হামলা করেছে। খবরটা শোনা মাত্রই ছুটে এসেছে সাহিত্য।
অরুদ্ধ সাহিত্যর কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত করে। থম মেরে বসে আছে সাহিত্য। চোখমুখ শক্ত করে জিজ্ঞাসা করে,,

:- কি করে হলো এসব?

:- কাল রাতে আমি আর তিয়াশ পার্টি অফিস থেকে বেরিয়ে নদীর ঘাটের দিকে গেছিলাম। শুনেছিলাম আমজাদ তালুকদারের লোকেদের মধ্যে কিছু বখাটে ছেলেরা ওখানে উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েদেরকে বন্ধুত্বের নাম করে নিয়ে যায়। তারপরে নেশা থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনৈতিক কাজের সাথে যুক্ত করে। এভাবেই অনেক যুবসমাজের মাঝে নেশাদ্রব্য ছড়িয়ে দিয়েছে তারা। অনেক মেয়েদের খারাপ পথে পরিচালিত করেছে।এই খবর পেয়েই আমি আর তিয়াশ গিয়েছিলাম সত্যতা যাচাই করার জন্য। গিয়ে দেখেছিলাম কথাটা সত্যি। ওখানে বড় আখড়া আছে ওদের। কিন্তু কোনোভাবে ওরা টের পেয়ে গিয়েছিলো। ওখান থেকে বেরোনোর আগেই কয়েকজন পেছন থেকে এসে হামলা চালায়। আমি একটু আড়ালে ছিলাম তাই আমাকে সহজে চোখে পড়ে নি ওদের। তিয়াশ সামনেই ছিলো ,তাই ওর উপরেই আঘাতটা বেশি করেছে। পরে আমি বাধা দিতে গেলে একজন আমার হাতে আঘাত করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই এসব কিছু ঘটে গেছে।

পুলিশ এলে অরুদ্ধের স্টেটমেন্ট, সাথে তিয়াশের কন্ডিশনের বেপারে ডক্টরের স্টেটমেন্টও নেয়। সাহিত্য পুলিশের সাথে কথা বলে আমজাদ তালুকদারের লোকেদের অনৈতিক কাজের তথ্য এবং শাস্তি নিশ্চিত করে। পুলিশ ফোর্স আগেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে ঘটনাস্থলে।
সাহিত্য এসে দাঁড়ায় আইসিইউয়ের দরজার সামনে। দরজার ওপরে ছোট্ট কাঁচের ফাঁক দিয়ে তাকায় ‌। ভেতরে সারাক্ষণ কথার ফুয়ারা ছড়ানো ছেলেটার নিথর দেহটা পড়ে আছে বেডে। বুকটা মুচড়ে ওঠে সাহিত্যের। এই তিনজন বন্ধু তার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের আঘাত করে অনেক বড় ভুল করেছে আমজাদ তালুকদার। ছেড়ে দেবে না সাহিত্য। কখনো ছাড় দিবে না। চোয়াল শক্ত হয় সাহিত্যর। তিয়াশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে শপথ করে সাহিত্য,,তার কাছের মানুষদেরকে যে বা যারা আঘাত করবে,তাদের প্রত্যেক কে সে কঠিন যন্ত্রণার মৃত্যু দিবে।

_____

তিয়াশ ছেলেটার বাবা নেই। মাকে নিয়েই তার পরিবার। ভাই বোন কেউ নেই। সাহিত্যের সাথেই পড়াশোনা করেছে কলেজ, ভার্সিটিতে। ভালো চাকরির সুযোগ থাকলেও করেনি সে। সাহিত্যর লেজ ধরেই থেকেছে সবসময়। এটা নিয়ে অবশ্য তিয়াশের মায়ের কোন অভিযোগ ছিলো না। সাহিত্যকে তিনিও খুব ভালোবাসেন। একমাত্র ছেলের এই অবস্থায় খুব ভেঙে পড়েছিলেন ভদ্র মহিলা। ছেলেটা ছাড়া তো আর তার কেউ নেই।
রাতের দিকে জ্ঞান ফিরেছে তিয়াশের। মির্জা পরিবারের সকলে এসে দেখে গেছে তাকে।সুহাও এসেছিলো তাদের সাথে। আয়েশা সিদ্দিকার সাথে রান্না করে নিয়ে এসেছিলো সকলের জন্য। তিয়াশের মাও অবাক হয়। সাহিত্য এত বড় দায়িত্বে আছে। একজন এমপি, অথচ বন্ধুকে ভাইয়ের মতো ট্রিট করে। তার পরিবারও কতটা অহংকার মুক্ত। ছেলের এত সুন্দর মনের বন্ধুরা আছে জেনে মনে মনে শান্তি পান তিনি।
সাহিত্য এখনো বসে আছে তিয়াশের পাশে। আস্তে করে তিয়াশের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তিয়াশের। কথা বলতে চেয়েছিলো কিন্তু সাহিত্যের ধমক শুনে তাই আপাতত চুপ আছে। নয়তো চুপ থাকার মতো ছেলে সে নয়।

__________

কেটে গেছে দুইটা দিন। তিয়াশ এখন মোটামুটি সুস্থ। আর মাত্র চারদিন বাকি মেহরাবের বিয়ের। আজ মির্জা পরিবারের সকলে শপিংয়ে এসেছে। টুকটাক শপিং আগেই করা হয়েছে। এখন শুধু মেহেন্দি, হলদি আর বিয়ের জন্য কেনাকাটা করতে হবে।
সামনে পেছনে চারটা গাড়িতে গার্ডেরা মাঝখানের গাড়িতে মির্জা পরিবারের সকলে। ড্রাইভ করছে মেহরাব, তার পাশে বসেছে তার বাবা আহাদ মির্জা।পেছনে শেফালী বেগম।সাহিত্য মায়ের সাথে মাঝের সারিতে বসে ।আয়েশা সিদ্দিকার আর সাহিত্যের মাঝে একটা সিট খালি। সাহিত্য জায়গাটা সুহার জন্য রেখেছে। নীলিমা আহ্লাদী কন্ঠে আয়েশা সিদ্দিকা কে বলে,,,

:- মামিমনি তোমার পাশে তো জায়গা খালি আছে, তুমি একটু সরে বসো না!!আমি এই পাশে বসি। মূলত সে সাহিত্যর পাশে বসতে চেয়েছিলো। কিন্তু তার প্ল্যান চৌপাঠ করে আয়েশা সিদ্দিকা বলেন,,

:- সেকি নীলি,,তোমার মায়ের পাশে দুটো সিট খালি আছে। সেখানে না বসে তুমি এখানে বসতে চায়ছো। মা কে একা একা পেছনে বসিয়ে রাখতে ভালো লাগবে তোমার? যাও মায়ের কাছে বসো।

আয়েশা সিদ্দিকার কথা শুনে মুখটা চুপসে যায় নীলিমার। রাগে গজগজ করতে করতে মায়ের পাশে গিয়ে বসে। সুহা তখনও বের হয়নি। সাহিত্যের একটা ফোন আসলে গাড়ি থেকে বেরিয়ে কথা বলে সাহিত্য। তখনই বেরিয়ে আসে সুহা। সাদা একটা গোল জামা পরেছে মেয়েটা। মাথায় কালো রঙের হিজাব বাধা। প্রেয়সীকে দেখে অন্তর প্রশান্তিতে ভরে যায় সাহিত্যের। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে তার ফুলের দিকে।
সুহা আড় চোখে দেখে প্রিয়তমের সেই মুগ্ধ দৃষ্টি। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি খেলে যায় তার। সুহা গিয়ে আয়েশা সিদ্দিকার পাশে বসতেই সাহিত্য এসে বসে পড়ে সুহার পাশে। ডোর লক করে মেহরাব কে গাড়ি স্টার্ট করতে বলে।
এদিকে নীলিমা সুহাকে সাহিত্য আর আয়েশা সিদ্দিকার মাঝে বসতে দেখে দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে। ঈর্ষায় জ্বলে যায় বুকের ভেতর টা।
মেয়ের বাড়ির লোকেরাও এসে তাদের সাথে যোগ হয় শপিংমলে। আরশির বাবা-মা ভাই সকলেই এসেছে। আরশি একটা কলাপাতা রংয়ের থ্রি পিস করে মাথায় হিজাব করে এসেছে। সুহাকে দেখে ভীষণ খুশি আরশি। কেনাকাটা বাদ রেখে দুজন বসে গুটুর গুটুর গল্প শুরু করেছে। এদিকে মেহরাব বারবার তাকাচ্ছে প্রেয়সীর দিকে। মেয়েটার যেন কোন খেয়ালই নেই তার দিকে। আর তো চারদিন।একবার বিয়েটা হোক তারপর ইগনোর করার ফল হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিবে মেয়েটাকে। মনে মনে ফন্দি আঁটে মেহরাব।

কেনাকাটার বিরাট আয়োজন চলছে। শাড়ি, লেহেঙ্গা, জুয়েলারি সহ যা যা প্রয়োজন সবই কেনা হচ্ছে। শাড়ি লেহেঙ্গার দোকানে এসে আয়েশা সিদ্দিকা,রত্না খান আর শেফালী বেগম সকলের জন্য পছন্দ করে কিনতে লাগলো।

গল্প করতে করতে সুহার নজর যায় একটা পুতুলের গায়ে জড়ানো অফ হোয়াইট কালারের লেহেঙ্গার দিকে। লেহেঙ্গা টা খুউব সুন্দর দেখতে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সেদিকে সুহা।

এদিকে আয়েশা সিদ্দিকা একটা বেবি পিন্ক কালারের শাড়ি হাতে নিয়ে সাহিত্য কে ইশারা করে। পাশেই একটা চেয়ারে বসে ছিলো সাহিত্য। মায়ের ইশারা বুঝতে পেরে অদুরে বসে থাকা হৃদয়স্পর্শী মেয়েটার দিকে একবার তাকায় সাহিত্য। মেয়েটার নজর কোথাও আঁটকে আছে। এটা দেখে সুহার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাতেই দেখতে পায় মেনিকুইনের গায়ে জড়ানো অফ হোয়াইট কালারের লেহেঙ্গাটা। মাকে শাড়িটা নিতে ইশারা করে সাহিত্য। তারপর উঠে গিয়ে এগিয়ে যাই লেহাঙ্গাটার দিকে। সাহিত্য হাত বাড়িয়ে লেহেঙ্গাটা নিতে যাবে তখনই নীলিমা এসে খপ করে লেহেঙ্গাটা নিয়ে নেয়। তারপর ন্যাকামো করে বলে,,,

:- ওয়াও লেহাঙ্গাটা কি সুন্দর তাই না সোহরাব?? এটা আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। প্লিজ এটা আমাকে কিনে দেবে? না করো না প্লিজ প্লিজ প্লিজ!!
সাহিত্য আড় চোখে সুহার দিকে তাকায়। ইতিমধ্যেই মুখটা মলিন হয়েছে মেয়েটার। প্রেয়সীর মলিন মুখ দেখেই মাথাটা দপ করে গরম হয়ে যায় সাহিত্যর। নীলিমার কাজে বড্ড বিরক্ত সে।

এদিকে নীলিমা আড়ালে শয়তানি হাসি দেয়। সে অনেকক্ষণ ধরে সুহা আর সাহিত্যের দিকে নজর রেখেছিলো। সুহার জন্য সাহিত্যর মনে যে কিছু একটা আছে সেটা আগেই আঁচ করেছিলো নীলিমা। আর আজ সেটা নিশ্চিত হলো। মনে মনে হিংসায় ফেটে পড়ে নীলিমা। লেহাঙ্গাটা হাতের মুঠোয় কুঁচকে ধরে। মনে মনে বলে
_এই ভাবেই তোমার পছন্দের এক একটা জিনিস আমি কেড়ে নেব সুহা। হোক সেটা এই লেহাঙ্গা বা সোহরাব। কোনটাই আমি তোমাকে পেতে দেবো না। এত সহজেই আমার এই সবকিছু হাতছাড়া হতে পারে না। কিছুতেই না

ঠিক তখনই মেহরাব দুহাতে দুটো চা নিয়ে হাজির। আয়েশা সিদ্দিকা কে উদ্দেশ্য করে বলে,,
:- মা তুমি চা খেতে চেয়েছিলে না? তাই নিয়ে এসেছি। বলেই দ্রুত নীলিমা আর সাহিত্যকে পাশ কেটে আসতে নিতেই পা হড়কে যায়। ফলস্বরূপ হাতের চা সম্পূর্ণ গিয়ে পড়ে নীলিমার হাতের লেহাঙ্গাটার উপর। সেদিকে তাকিয়ে মেহেরাব জোর করে হাসি দিয়ে বলে,,,

:- এই যাহ!! এটা কি হলো? সরি নীলিমা, লেহেঙ্গা টা নিশ্চয়ই তোমার খুব পছন্দ হয়েছিলো ।আর আমার হাতের চা টা পড়ে তো এটা নষ্ট হয়ে গেলো প্লিজ কিছু মনে করো না!! তুমি না হয় আরেকটা পছন্দ করে নিও। আমি খুব সরি হ্যাঁ !!বুঝতে পারিনি কিসে যেন পা টা বেঁধে গেলো!!

ঘটনাটা আসলেই এতটাই কোইন্সিডেন্টলি ঘটেছে যে সকলের মনে হলো আসলেই এটা একটা দুর্ঘটনা। এমন কি নীলিমাও বিন্দুমাত্র সন্দেহ করতে পারলো না ঘটনাটা ইচ্ছাকৃত নাকি আসলেই দুর্ঘটনা। কারণ ঘটনাটা মেহরাবের হাত দিয়ে ঘটেছে। তাই নীলিমাও মেনে নিয়ে বলে,,

:- ইটস ওকে ভাইয়া । আমি কিছু মনে করিনি। ঠিক আছে আমি অন্য একটা পছন্দ করে নেবো।

তারপর হাতের লেহাঙ্গাটা দোকানী কে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করে এর আর কোন কপি আছে কিনা। কিন্তু দোকানদার জানায় এটার মাত্র দুটো কপিই ছিলো ,কিন্তু কিছুক্ষণ আগে সেটা বিক্রি হয়ে গেছে। নিশ্চিন্ত হয় নীলিমা। সে তো আসলেই লেহেঙ্গাটা পছন্দ করে নিতে চাইনি ।সুহা যেন লেহেঙ্গা টা না পায় সেজন্যই নিয়েছিলো। এখন এর কপিও বিক্রি হয়ে গেছে। তাই সে আর কোন সিনক্রিয়েট করলাম না। অন্য একটা লেহেঙ্গা পছন্দ করে কিনে নিলো। ঘটনার আকষ্মিকতায় হতভম্ব সুহা।কি হলো এতক্ষণ সবটাই যেন মাথার উপর দিয়ে গেলো।

এদিকে মেহরাব আড়ালে সাহিত্যর হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দেয়। হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে, অল দ্য বেস্ট!!
তারপর একটা মিচকে হাসি দিয়ে সরে যায় সেখান থেকে। সাহিত্য প্যাকেটটা হালকা খুলে দেখে অবাক হয়ে তাকাই বড় ভাইয়ের দিকে। মেহরাবের ঠোঁটে তখনো প্রাণ খোলা হাসির ছোঁয়া। হাসি ফুটে ওঠে সাহিত্যর ঠোঁটেও।

চলবে,,,,

#ভালোবাসি_তোকে_সুহাসিনী
পর্ব,,,২২
মৌমো তিতলী

আলোয় ঝলমল করছে মির্জা ম্যানশন। আজ মেহরাব আরশির মেহেন্দি। মির্জা ম্যানশনেই মেহেন্দি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বাড়ির বড় আকারের লিভিং রুমে সুন্দর করে ডেকোরেশন করা হয়েছে। সোনালী, সাদা পর্দা,,নানা রকমের ঝাড়বাতি,মরিচ বাতি জ্বলছে চারদিকে।
বাইরে থেকে নামকরা সব সেফদের আনা হয়েছে রান্নার জন্য। পার্লার থেকে ডিজাইনাররা এসেছে মেহেন্দী পরাতে।

আরশি আর মেহরাবকে মেরুন কালারের ড্রেস পরানো হয়েছে। আরশি মেরুন কালারের লেহেঙ্গা আর মেহরাব মেরুন কালারের পাঞ্জাবি। পার্লারের মেয়েরা গর্জিয়াস করে সাজিয়ে দিয়েছে আরশি কে। একটা ছোটখাটো পুতুলের মত লাগছে তাকে। ঠোঁট জুড়ে লাজুক হাসি। মেহেরাব বিভোর হয়ে তাকিয়ে রয়। এই মেয়েটা শুধুমাত্র তার ভাবতেই সারা শরীরে শিহরণ বয়ে যায় মেহরাবের। অপলক মুগ্ধ চোখে দেখতে থাকে প্রিয়সীকে।

________

আজকে যদি কেউ ইচ্ছে মতো মন খুলে সেজেছে, সেটা হলো নীলিমা‌। মেকাপের জাদুতে পুরো ফরেইনার দের মত লাগছে তাকে। কালো রঙের স্লিভলেস গাউন পড়েছে নীলিমা। সাথে ডায়মন্ডের নেকলেস আর কানের দুল। হাতেও একটা ডায়মন্ডের ব্রেসলেট। নীলিমার সাজ অনেকটা মডেলদের মত লাগছে। মেহেন্দি অনুষ্ঠানে নীলিমার এমন উদ্ভট সাজের কারণ খুঁজে পেল না কেউ। তবে তাকে কেউ কিছু বলল না। দেখতে খারাপ লাগছে না।
তবে এত কিছুর মধ্যেও নীলিমাকে টোন মারলো অরুদ্ধ। দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,,,

:- কি ব্যাপার নীলিমা। কোথাও শো এর অফার পেলে নাকি?? তোমার সাজ দেখে মনে হচ্ছে ramp walk করবে। অন্তত সাজ দেখে তো তাই মনে হচ্ছে।

অরুদ্ধের টিটকারীতে রেগে যায় নীলিমা।

:- হোয়াট ননসেন্স। আমি কেন রেম্প ওয়াল্ক করতে যাবো?
এটাকে গর্জিয়াস সাজ বলে। মেয়েদের সাজের ব্যাপারে আপনি এত কি বুঝবেন?

অরুদ্ধ তাচ্ছিল্য হেসে বলল,,,

:- হ্যাঁ সেই সেই। আমরা আর কি বুঝবো! তবে মেহেন্দি অনুষ্ঠানে এমন মডেলদের মত গর্জিয়াস সাজতে আমি কাউকে দেখিনি। তারপর সেখান থেকে চলে যেতে যেতে মুখ বাঁকিয়ে বলে,, উইমেন 😂🤣

রাগে গা জ্বলে নীলিমার। সেদিকে অত পাত্তা না দিয়ে খুঁজতে থাকে সাহিত্যকে।

এদিকে নিজের রুমেই রেডি হচ্ছিলো সুহা। বেডের ওপর নজর পড়তেই দৃশ্যমান হয় চমৎকার অফ হোয়াইট কালারের লেহেঙ্গাটা। কাল সাহিত্যের থেকে এটা পেয়ে অবাকের শেষ পর্যায়ে গেছিলো মেয়েটা। এই লেহাঙ্গাটা নিয়েই তো শপিংমলে কত কিছু ঘটে গেলো । দোকানদার তো নীলিমা আপুকে বলেছিলো এর আরেকটা কপি বিক্রি হয়ে গেছে। সাহিত্য তো সেই সময় সেখানেই দাঁড়িয়েছিলো । তাহলে সে এই লেহেঙ্গাটা কখন কিনলো? তাছাড়াও লেহাঙ্গাটা যে সুহার পছন্দ হয়েছে সেটা এমপি সাহেব কি করে বুঝলো?? এতগুলো প্রশ্ন নিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিল সাহিত্যর দিকে। মনে পড়ে কাল রাতের কথা।

গতকাল রাতে
************

সারাদিন শপিং করে ফিরতে রাত হয় সবার। একেবারে ডিনার করে সবাই বাড়িতে ফেরে ‌এই মুহূর্তে সবাই খুব ক্লান্ত। কেউ কোন দিকে না তাকিয়েই যে যার রুমে গিয়ে ঘুমাতে পারলেই বাঁচে।
সুহাও তার ব্যতিক্রম নয়। সেও একটা হাই তুলে নিজের ঘরে ঢুকতেই যাবে তখনই পাশের রুম থেকে সাহিত্য বেরিয়ে আসে। খপ করে সুহার হাত টেনে নিজের ঘরে ঢুকেই দরজা আটকে দেয় সাহিত্য। এদিকে ঘুমঘুম চোখে হুট করে হাতে টান পড়ায় ঘুম ছুটে যায় সুহার। দরজা আটকাতে দেখে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে সাহিত্যর দিকে।
সাহিত্য পেছন ফিরে সুহাকে এমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিঃশব্দে হেসে দেয়। সুহার এই লুকটা খুব ভালো লাগে সাহিত্যর। কেমন বাচ্চা বাচ্চা ফেস করে তাকিয়ে থাকে। দেখলেই মনে হয় বুকের মাঝে ঢুকিয়ে নিতে। সুহার হাত টেনে নিয়ে বেডের উপর বসিয়ে দেয়। আলমারি থেকে একটা প্যাকেট বের করে এনে সুহার কোলের উপর রাখে। জিনিসটা কি বুঝতে না পেরে মুখে একটা বড় জিজ্ঞাসা চিহ্ন নিয়ে সাহিত্যের দিকে তাকায় সুহা। সাহিত্য ইশারা করে বলে,,

:- খুলে দেখ!!

সুহা প্যাকেট টা খুলে দেখেই অবাক হয়ে সুহা। চকচকে চোখে তাকায় সাহিত্যর দিকে। চাপা খুশিতে চিৎকার করে বলে,,
:-এটা আপনি কোথায় পেলেন??

সাহিত্য দুহাতের আজলে সুহার মুখটা তুলে ধরে নরম সুরে বলে,,,

:- যে জিনিসটা আমার পদ্ম ফুলের পছন্দ হয়েছে সেটা তো আনতেই হতো।

:- আপনি কি করে বুঝলেন এটা আমার পছন্দ হয়েছে? আমি তো আপনাকে বলিনি।

সুহার কথায় জবাব দেয় না সাহিত্য শুধু নিঃশব্দে হাসে।।

জবাব না পেয়ে আবারো প্রশ্ন করে সুহা,,

:- বলুন না এটা আপনি কোথায় পেলেন?? নীলিমা আপুকে তো দোকানি বলেছিল এটা বিক্রি হয়ে গেছে!

সাহিত্য হালকা ধমক দিয়ে বলে,,

:- তোর এত জেনে কাজ নেই। পছন্দের জিনিসটা পেয়েছিস। এখন খুশি খুশি এটা নিয়ে ভাগ। আর কাল মেহেন্দির অনুষ্ঠানে যেন এটাই তোর পরনে দেখি।

সুহা মুখ গোমড়া করে তাকাই সাহিত্যর দিকে। সেটা দেখে সাহিত্য সোহাকে কাছে টেনে এনে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলে,,

:- এটা মেহরাব ভাইয়া কিনে রেখেছিলো। তোর লেহেঙ্গা টা পছন্দ হয়েছে বুঝতে পেরেই আমি ওটা নিতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু নীলিমা সেটা বুঝে ইচ্ছে করেই নাটক শুরু করেছিলো। মেহরাব ভাইয়া সেটা বুঝেই তখন এটা কিনে রেখেছিলো ।পরে আমার কাছে দিয়েছিলো। এবার বুঝতে পেরেছিস কোথায় পেয়েছি ?? হ্যাপি?

সুহা সন্তুষ্ট হেসে মুগ্ধ নয়নে তাকাই প্রিয়তমের মুখের দিকে। সে দৃষ্টিতে আটকাই সাহিত্য।ঢোক গিলে মনে মনে ভাবে,
_ এই রাতে নিরিবিলি ঘরে সুহাকে তার সাথে আর বেশিক্ষণ রাখা যাবে না। ভুল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ১০০%। এমনিতেই মেয়েটা কাছে আসলে সে আর হুশে থাকে না আজকাল। বড্ড বেসামাল হয় অবাধ্য মনটা।

সাহিত্য তাড়া দেয় সুহা কে। বলে,,

:- অনেক হয়েছে। অনেক বেশি ক্লান্ত তুই। এখনই গিয়ে ঘুমিয়ে পড়, নয়তো কাল কিন্তু সাজলে ভালো লাগবে না। চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়ে যাবে।
আঁতকে ওঠে সুহা,, না না খারাপ দেখা গেলে তো চলবে না। সর্বোচ্চ সুন্দর করে উপস্থাপন করতে হবে তার প্রিয়তমের সামনে। এমপি সাহেবের চোখ যেন শুধু তার উপরেই থাকে। আর কোন শাকচুন্নির দিকে যেন তার নজর না যায়। তৎক্ষণাৎ লেহেঙ্গাটা বুকে চেপে প্রস্থান করে সুহা। সুহার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে সাহিত্য।

বর্তমান
******

সোহা লেহাঙ্গাটা পরে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে উপরের ব্লাউজের পেছনে ফিতা বাঁধতে গিয়ে। তার হাত কিছুতেই ঠিকঠাক ভাবে ম্যানেজ করতে পারলো না ফিতাটা। এদিকে বাইরে অসংখ্য মানুষ গিজগিজ করছে। কিন্তু সুহা কাউকেই চেনে না। একজন মেয়ে হলে ভালো হতো। তার একটু হেল্প দরকার। সুহা ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে দরজাটা হালকা একটু ফাঁক করে দেখার চেষ্টা করে হেল্প পাওয়া মতো কাউকে পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু কয়েকজন ছোট ছোট বাচ্চারা ছাড়া কাউকে দেখতে পেলো না। তার মধ্যে থেকে ছোট একটা বাচ্চাকে ডাক দিল সুহা।

:- এই যে পিচ্চি!! এদিকে একটু শোনো।

বাচ্চাদের মধ্য থেকে গোলুমোলু দেখতে একটা বাচ্চা ছেলে এগিয়ে এলো। জানতে চাইলো কেনো ডেকেছে?

সুহা ছেলেটাকে বলল,,

তোমার নাম কি বাবু?

:- আমার নাম পুপলু।

:- আচ্ছা পুপলু সোনা। আমাকে একটা কাজ করে দিবে?

:- আমি কেন তোমার কাজ করে দিতে যাবো?

সুহা বুঝলো বাচ্চাটা সহজে মানবে না। তাই কৌশল খাটিয়ে বলল,,

:- তুমি যদি এই ছোট্ট কাজটা আমায় করে দাও তাহলে তোমাকে আমি এত্তগুলো চকলেট দেবো!!

প্রলোভনে কাজ হলো। ছেলেটা ফোকলা হেসে এগিয়ে এসে বললো,,

:- বলো কি করতে হবে?

:- শোনো তুমি নিচে গিয়ে একটু আয়েশা আন্টিকে ডেকে দিবে? বলবে ওপরের ঘরে সুহা ডাকছে।

:- হ্যাঁ কিন্তু আয়েশা আন্টিটা কে??

সুহা পড়লো বিপাকে। আসলেই তো বাচ্চাটা কে? কার সাথে এসেছে? বা সবার নাম জানে কিনা এটা তো সুহার মাথায় আসেনি। তবে না ঘাবড়ে বললো ,,

:-তুমি কার সাথে এসেছ অনুষ্ঠানে পুপলু?

ছেলেটা বললো,,

:- আমি তো আব্বুর সাথে এসেছি। আব্বুর বন্ধুর বিয়ে তো তাই।
সুহা বুঝলো মেহরাব ভাইয়ার কোন বন্ধুর ছেলে পুপলু।
সুহা আবার জিজ্ঞাসা করলো,,

:- তুমি তোমার মেহরাব আঙ্কেলের মাকে চেনো??

ছেলেটা ঘাড় নেড়ে বললো ,,

:-চিনি তো !!

স্বস্তির শ্বাস নেয় সুহা। তারপর ছেলেটাকে বলে,,

:- তুমি মেহেরাব আঙ্কেলের মাকে গিয়ে বলো যে আমি ডেকেছি।
ছেলেটা আচ্ছা বলে নিচে চলে যায়।

সুহা আবারো হাত পেছনে দিয়ে ফিতাটা বাধার চেষ্টা করতে থাকে। সেই সময়ই দরজায় খট করে শব্দ হয়। সুহা ভাবে হয়তো আয়েশা আন্টি এসেছে। তাই না তাকিয়েই বলে,,,

:-আন্টি দেখোনা,,, পেছনের ফিতাটা বাঁধতে পারছিনা।তুমি একটু হেল্প করো প্লিজ!!( আয়েশা সিদ্দিকার অমায়িক ব্যবহারে আর ভালোবাসায় সুহা উনার সাথে কথা বলতে তুমিতে নেমে এসেছে অনেক আগেই)

এদিকে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাহিত্য। নজর তার সুহার উন্মুক্ত ফর্সা পিঠের দিকে। গলা শুকিয়ে আসে,মাথাটা ঝিমঝিম করতে থাকে সাহিত্যের।
তখন পুপলুকে দৌড়ে নিচে নামতে দেখে সাহিত্য পুপলুর কাছে জানতে চাইলে সে বলে ,,,

উপরের ঘরে একটা কিউটি আছেনা? তার মনে হয় হেল্প লাগবে। এই জন্য আয়ু দিম্মাকে ডাকতে বললো।

পুপলুর কথা শুনে সাহিত্য বুঝতে পারে সে সুহার কথাই বলছে। নয়তো সুহা ছাড়া তার মাকে কেউই হেল্পের জন্য ডাকবে না। সেই জন্যই সাহিত্য এসেছিলো সুহার কি প্রয়োজন সেটা দেখতে। কিন্তু এখানে আসাটাই তার চরম ভুল হয়েছে। এখানে এসে যে এমন কিছু পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে সেটা একবারও মাথায় আসেনি এমপি সাহেবের। তবে এখন পা দুটো উঠিয়ে ফিরেও যেতে পারছে না। সামনে প্রেয়সীর সাহায্যের জন্য আহ্বান ,আর এদিকে এক পা বাড়ালে প্রেমিক পুরুষের সর্বনাশ। কি করবে দোটানায় পড়ে সাহিত্য। এদিকে মন চাইছে তার পদ্মফুলকে কাছে টানতে। মস্তিষ্ক বলছে বেরিয়ে যা সাহিত্য,,, এই ঘর থেকে এখনই বেরিয়ে যা। নয়তো আজ তোর প্রেয়সীর চরণতলে তোর প্রেমোমরণ নিশ্চিত।

সুহা আবারো আওয়াজ দেয়।

:- আন্টি তাড়াতাড়ি ফিতাটা বেঁধে দাও। কখন নিচে যাবো আমি?? দেরি হচ্ছে তো।

মুহূর্তেই পিঠে কারো আলতো হাতের স্পর্শ পেয়ে কেঁপে ওঠে সুহা। চোখ তুলে সামনের ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় চোখ রাখতেই শিউরে ওঠে সমস্ত কায়া। প্রিয়তমের মুগ্ধ দৃষ্টি চক্ষু গোচর হয়। সাহিত্য যেন ঘোরে আছে। সুহা কে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বুকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে। হাত দুটো পেছনে দিয়ে আলগোছে ফিতাটা বেঁধে দেয়। সুহার শরীরের মিষ্টি গন্ধে পাগল প্রায় অবস্থা সাহিত্যের ।সুহার গলায় নাক দিয়ে স্লাইড করে শ্বাস টেনে নেয় সাহিত্য। সাহিত্যর এমন গভীর স্পর্শ কেপে কেঁপে ওঠে সুহা। দু হাতে লেহেঙ্গার কিনারা খামচে ধরে। সুহার কোমরে হাত রেখে নিজের সাথে আরেকটু নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে সাহিত্য। এক হাতে সুহার গাল ধরে ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার ফুলের মুখের দিকে। সুহার তিরতির করে কাঁপতে থাকা ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে হুস উড়ে যায় সাহিত্যের ।আগুপিছু না ভেবেই সুহার অধরে অধর ডুবিয়ে দেয়‌। বেসামাল হয়ে শুষে নিতে থাকে প্রিয়তমার অধর সুধা। সাহিত্য যেন হুঁশে নেই। শ্বাস আটকে আসে সুহার। সাহিত্যের থেকে ছাড়া পেতে ছটফট করে ওঠে মেয়েটা। সুহার ছটফটানি টের পেতেই ঠোঁট ছেড়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বড় বড় শ্বাস নেয় সাহিত্য। সুহারও একই অবস্থা। সাহিত্যর এতোটুকু ছোঁয়ায় নিস্তেজ হয় মেয়েটা। সাহিত্য ফিচেল কন্ঠে বলে,,

:-আই লাভ ইউ বেইবি! আই লাভ ইউ সো মাচ!!

সাহিত্য কে আরেকটু খিচে আঁকড়ে ধরে সুহা।

__________

নীলিমা অনেকক্ষণ ধরে সাহিত্যকে খুঁজে যাচ্ছে। কোথায় গায়েব হয়ে গেলো এমপি মহোদয়! সে যে এতো লাস্যময়ী ভাবে সেজেছে সেটা তো একমাত্র সোহরাবের জন্যই। সে না দেখলে তো তার এই নজর কাড়া সাজ সব বৃথা যাবে।

সাহিত্যকে খুঁজতে খুঁজতেই উপরের সিঁড়ির দিকে তাকাতেই চোখ আটকে যায় নীলিমার। সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে সাহিত্য। তার পাশাপাশিই নামছে সুহা। কিন্তু বড় আশ্চর্যের বিষয় সেটা নয়, নীলিমা আশ্চর্য হয়েছে সুহার গায়ে জড়ানো লেহাঙ্গাটা দেখে। কাল যে শপিংমলে সে এত নাটক করলো শুধুমাত্র সুহা যেন লেহেঙ্গা টা না পাই সেই জন্য। কিন্তু ফলাফল কি হলো? শূন্য একেবারেই শূন্য। দোকানদার যে বলেছিলো এর কপি বিক্রি হয়ে গেছে! তাহলে এটা কোথায় পেলে সুহা? কে দিলো তাকে?
তার মানে কালকের ঘটা ইনসিডেন্স টা মোটেও দূর্ঘটনা ছিল না। ইচ্ছাকৃত ঘটানো হয়েছিলো ।ধোকা! মেহরাব-সোহরাব দুই ভাই’ই তাকে ধোঁকা দিয়ে এভাবে বোকা বানালো??

রাগের থরথর করে কাঁপতে থাকে নীলিমা। ক্রোধ আর ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায় সে। পাশেই রাখা ফ্লাওয়ার ভাঁসটাতে জোরে থাবা দিয়ে খামচি মেরে ধরে নীলিমা। তার মন চাইছে এই মুহূর্তে সুহার শরীর থেকে লেহেঙ্গাটা টেনে টেনে সবার সামনে খুলে দিতে। আবার সোহরাব কে দেখো! সুহার সাথে মিলিয়ে অফ হোয়াইট কালারের পাঞ্জাবি পায়জামা পড়েছে। দেখে দুজনকে কাপল মনে হচ্ছে। অসহ্য লাগে নীলিমার। হিংসাই মস্তিষ্ক ধবধব করতে থাকে। প্রতিশোধ! হ্যাঁ প্রতিশোধ সে নিবেই। এই সুহা মেয়েটাকে সে কিছুতেই শান্তি পেতে দেবে না। তাকে নাকানি চুবানি না খাইয়ে দম নেবে না নীলিমা। সুহার ঠোটের লেপটানো হাসিটা যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছে তার। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নীলিমা,, এখন যত পারো হেসে নাও, তোমার এই মুখের হাসি যদি আমি কান্নাই পরিবর্তন না করতে পারি তাহলে আমার নামও নীলিমা নয়। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ!! তোমার নাকের পানি আর চোখের পানি আমি এক করে ছাড়বো। ভেবে সেখান থেকে প্রস্থান নেয় নীলিমা।

**********

সুহা লেহাঙ্গা দু’হাতে উঁচু করে ধরে হাসিমুখে আরশির পাশে গিয়ে বসে। আরশি তো ভীষণ খুশি। এক হাতে সুহাকে জড়িয়ে ধরে বলে,,

:- এত দেরি করে এলে কেন? কখন থেকে অপেক্ষা করছিলাম তোমার।
সুহা একবার আড় চোখে সাহিত্যর দিকে তাকায়। সাহিত্য হেসে হেসে কথা বলছে গেস্টদের সাথে। সুহা আবার আরশির দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,,

:- আসলে আমার রেডি হতে একটু দেরি হয়ে গেল।একা একা রেডি হয়ে ছিলাম তো তাই।

তখনই পার্লারের দুজন মেয়ে আসে আরশির হাতে মেহেন্দি পড়াতে। দুজন দুহাত ধরে মেহেদি পড়াতে শুরু করে। নানা খুনসুটি আর হাসিতে ভরে ওঠে জায়গাটা। দুহাতের মাঝে মেহরাবের নাম লিখতে ভোলে না তারা। লজ্জায় রাঙ্গা হয় আরশির মুখ। একে একে সবাই মেহেন্দি পড়তে থাকে নীলিমাও মেহেন্দি পরবে বলে আসে। কিন্তু মেহেন্দি শেষ। আয়েশা সিদ্দিকা এগিয়ে এসে সুহাকে বলে,,

:- সুহা মা! আমার ঘরে গিয়ে দেখো দুটো মেহেদির পাত্র আছে। একদম অর্গানিক। সেটা নিয়ে এসেই কোন বানিয়ে হাতে দিলেই হবে।
সুহাও আন্টির কথা মত উপরে গিয়ে মেহেদির বাটি দুটো নিয়ে আসে। পথে মধ্যেই দেখা হয় পুপলুর সাথে। সুহা খেয়াল করে পুপলু বাথরুমের সামনে দাঁড়িয়ে কেমন ছল ছল চোখে তাকিয়ে আছে। সুহা হাতের মেহেন্দির বাটি দুটো পাশে একটা টেবিলে রেখে এগিয়ে যায় পুপলুর দিকে।
সুহাকে দেখে যেন আরো ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দেয় পুপলু। সুহা বিচলিত হয়। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,,

:- কি হয়েছে পুপলু সোনা?? এখানে দাঁড়িয়ে কাঁদছো কেন?

কান্না মাখা কন্ঠে পুপলু বলে,,

:- দেখো না কিউটি !আমার খুব জোর এক নাম্বার পেয়েছে। কিন্তু কিছুতেই পায়জামার ফিতা টা খুলতে পারছি না।
পুপলুর কথা শুনে ভিষণ হাসি পায় সুহার। কিন্তু সে হাসেনা। অবস্থা ভীষণ সিরিয়াস। এখন হাসলে পুপলু কষ্ট পেতে পারে। সুহা অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখে পুপলুর পায়জামার ফিতাটা খুলে দেয়। ফিতাটা খুলতেই পুপলু হুড়মুড় করে ঢুকে যায় বাথরুমে। পুপলু বাথরুমে ঢোকার সাথে সাথেই সুহা জোরে খিল খিল করে হেসে দেয়।

তারপর টেবিলের ওপর থেকে মেহেদির বাটি দুটো তুলে আরশিদের কাছে ফিরে আসে। সুহা আসতেই নীলিমা বাটি দুটোর ভেতর থেকে নীলচে রঙের বাটিটা রেখে সাদা রঙের বাটিটা সুহার হাত থেকে টান দিয়ে নিয়ে নেয়। সুহা হতচকিয়ে তাকালে নীলিমা হাসিমুখে বলে,,

:- আমরা দুজনই তো মেহেন্দি দিতে বাকি আছি। তাই একটা বাটি তুমি নাও একটা আমি নিই।

সুহাও আর কিছু মনে করলো না। সে তার হাতের বাটিটা পার্লারের মেয়েটার কাছে দেয়। মেয়েটাও মেহেন্দিটা একটা কোণে ভর্তি করে বসে। সুহার হাতে সুন্দর করে মেহেন্দি ডিজাইন করে দেয়। ওদিকে নীলিমা দু হাত ভর্তি মেহেন্দি দিয়ে সাজে।
কিন্তু বিপত্তি ঘটে সুহার মেহেন্দি অর্ধেক পড়ার পর। ডিজাইন করা হাতে কেমন একটা জ্বলে যাচ্ছে। প্রথমে খুব একটা আমলে না নিলেও এক সময় জ্বলন বৃদ্ধি পায়। হঠাৎ করেই সুহা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। লিভিং রুম ভর্তি মেহমান। সকলের নজর এখন সুহার দিকে। সুহা দুহাতে অনবরত ফু দিচ্ছে আর কেঁদে যাচ্ছে। সুহার চিৎকার কানে পৌঁছতেই থমকে যায় সাহিত্য। বুকের ভিতর উথাল-পাথাল হয় ।পড়ি মরি করে সুহার কাছে ছুটে আসে সাহিত্য।
এসেই দেখতে পায় দুহাত অনবরত নেড়ে যাচ্ছে আর কাঁদছে সুহা। সাহিত্য দৌড়ে গিয়ে সুহার হাত টেনে ধরে দেখতে থাকে। অস্থির হয়ে জিজ্ঞাসা করে,,,

:- কি হয়েছে সুহাসিনী? কাঁদছিস কেন? কি হচ্ছে ফুল? বল আমাকে ?কোথায় কষ্ট হচ্ছে?

সুহা চোখ নিচে বন্ধ করে অনবরত বলতে থাকে,,

:- জ্বলে যাচ্ছে আমার হাত জ্বলে যাচ্ছে!!
বলছে আর চিৎকার করে কাঁদছে সুহা।

সাহিত্য চিৎকার করে গর্জন করে ওঠে,,

:- কে এনেছে এই মেহেন্দি??মেহেন্দি কে পড়িয়েছে?

আয়েশা সিদ্দিকা এগিয়ে আসে ছেলের কাছে। বলে,,

:- মেহেদি দুটো তো আমার ঘরেই রাখা ছিলো।একদমই অর্গানিক। আমি নিজে ব্লেন্ড করেছি। এর ভেতরে জ্বলার মত কিছুই থাকার কথা নয়। কিন্তু বুঝতে পারছি না সুহার হাত জ্বলছে কেন? সুহা তো নিজেই নিয়ে এলো মেহেদির বাটি দুটো। একটা বাটি থেকে তো নীলিমাও দিয়েছে হাতে। ওর তো কিছু হয়নি।মনে মনে ভীষণ কষ্ট পান তিনি।

মায়ের কথায় টনক নড়ে সাহিত্যর। ফট করে সে তাকাই নীলিমার দিকে। নীলিমার ঠোঁটে কেমন ক্রুর হাসি। সাহিত্যকে তাকাতে দেখেই কাঁদো কাঁদো মুখ করে নীলিমা। যেন সুহার হাতের এই অবস্থা হওয়াতে খুব কষ্ট পেয়েছে সে। কিন্তু মেয়েটাকে সে হাড়ে হাড়ে চিনে। কোথাও না কোথাও মনের ভিতরে একটা খটকা লাগে সাহিত্যের ।আপাতত সেদিকে মন না দিয়ে সুহার হাত টেনে নিয়ে যায় বেসিনে। তারপর ঠান্ডা পানি ঢালতে থাকে। ঠান্ডা পানির ছোঁয়া পেয়ে কিছুটা আরাম বোধ করে সুহা ।কিন্তু পানি ঢালা বন্ধ করলেই আবার জ্বলে যাচ্ছে। সাহিত্য ধৈর্য নিয়ে অনবরত পানি ঢালতে থাকে সুহার হাতে। এই মুহূর্তে সাহিত্যকে দেখে মনে হচ্ছে সে একদম শান্ত, স্থির ।অথচ কেউ জানলো না মনে মনে কতটা ভয়ংকর পরিকল্পনা করছে সে। তার প্রেয়সীকে যে কষ্ট দিয়েছে সেই অপরাধে কতটা কঠিন শাস্তি ভোগ করবে সে সেটার জানা হলো না কারোর।

সুহার হাতে পানি ঢালতে ঢালতেই আস্তে করে জিজ্ঞাসা করে,,

:- মেহেদির বাটি দুটো ওপর থেকে আনার সময় কোথাও বাটি দুটো একা ছেড়েছিলি ফুল?

নাক টানে সুহা। মস্তিষ্কে চাপ দিতেই মনে পড়ে তখন বাটি দুটো টেবিলের উপরে রেখে পুপলুর কাছে গিয়েছিল সে। অকপটে সেটা জানায় সাহিত্যকে। ব্যাস!! দুয়ে দুয়ে চার করতে সময় লাগে না তীক্ষ্ণ মস্তিষ্কের চতুর এমপি সাহেবের।
পরবর্তী পদক্ষেপ ভেবেই ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি খেলে যাই সুহার শান্ত মস্তিষ্কে অশান্ত প্রেমিক পুরুষটার।

চলবে,,,,