ভুল শুধু ভুল পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
9

#ভুল_শুধু_ভুল (শেষ)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

বিয়ের তিন বছরের মাথায় মায়ার পরিবার জানতে পারে মায়ার স্বামীর প্রবাসে এক স্ত্রী রয়েছে। শুধু তাই নয়, দেশেও তার একজনের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। এসব বিষয়গুলো যখন সামনে আসে তখন মায়া তার বাবা মায়ের উদ্দেশ্য বলে,“টাকা, পয়সা সবই তো আছে আমার। কিন্তু যেটা নেই সেটা মানসিক শান্তি। মানসিক সুখ। তারপরও বলবে টাকা, পয়সা থাকলেই সবাই সুখী হয়?”
মায়ার এই কথার জবাবে তার বাবা, মা মানিয়ে চলতে বলে। তাদের কথা স্বামী তো তাকে ভালোবাসে। সম্পদ তো কম নেই। দুই স্ত্রীকে ভাগ করে নিবে। উল্টো মায়াকে এখন পরামর্শ দেয় স্বামীর থেকে কিছু সম্পত্তি নিজের নামে লিখে নেওয়ার। এসব দেখে মায়া হাসে। হাসি মুখেই বলে,“সব বাবা, মায়ের সিদ্ধান্ত সঠিক হয় না। সব বাবা, মা সন্তানের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কিছু কিছু বাবা, মা সন্তানের সঙ্গে অন্যায়ও করে।”
মায়া এসব বলে ম্লান হাসে। নিজের মনের কষ্টগুলো সে কাউকে বোঝাতে পারে না। তাকে এখন সারাজীবনের মতো তার বাবা, মায়ের একটি ভুলকে সঙ্গী করে চলতে হবে। তার জীবনের সবটাই ভুল হলো। শুধুমাত্র ভুল। আজও তার সেদিনের কথা মনে পড়ে, যেদিন আদালত তাকে নাবালক বলে পলাশকে দোষী বানিয়েছে। পলাশকে শা স্তি দিয়েছে। মিথ্যা অপহরণের মামলায় পলাশকে শা স্তি পেতো হলো।
___
অতীত,
আশরাফ যখন দুই লাখ টাকার অফার দেয় তখন কবির শান্ত গলায় বলে,“বিয়ে করার খুব তাড়া বুঝি?”
আশরাফ কবিরের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করে।পাশ থেকে মায়ার বাবা তাকে বলে,“কী করছো? যদি ভালো পুলিশ হয় তাহলে তো তোমাকেই মামলা দিয়ে দিবে।”

“চিন্তা করবেন না। বয়স তো কম হলো না। ভালো, খারাপের পার্থক্য আমি বুঝি।”
আশরাফের কথায় ভরসা পেয়ে মায়ার বাবা চুপ হয়ে যায়। আশরাফ কবিরকে উদ্দেশ্য করে বলে,“পাঁচ লাখ?”
কবির এবার মাথা নাড়ায়। সে রহস্যময় এক হাসি দিয়ে বলে,“আপনারা কী চান?”
আশরাফের কথা মায়া নাবালক এটা দেখিয়ে পলাশ যে তাকে অপহরণ করেছে। তাদের থেকে মুক্তিপণ দাবি করেছে এমনভাবে মামলাটি সাজিয়ে দিতে। কবির রাজি হয়। পরবর্তীতে আদলাতে সবকিছু পলাশের বিপক্ষে দেখে মায়া বারবার চিৎকার করে বলে,“না। এসব মিথ্যা। আমি পলাশকে ভালোবাসি। পলাশ আমার সাথে কোন জোর-জবরদস্তি করেনি।”

যেহেতু আদালতে মায়াকে নাবালক হিসাবে দেখানো হয়েছে। তাই তার কথার বিশেষ একটি মূল্য ছিলো না। তাছাড়া কবির খুব সুক্ষ্ণ ভাবে মামলাটি সাজায়। এরমাঝে পলাশের পরিবার মায়ার পরিবারের সাথে মিমাংশা আসতে চাচ্ছিলো। কিন্তু মায়ার পরিবার রাজি হয়নি। অতঃপর মায়াকে আদালত থেকে জোর করে টেনে হিচড়ে নিয়ে আসা হয় বাড়ি। বাড়িতে এসে মায়ার বাবা তার গালে কয়েকটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। রাগান্বিত গলায় বলে,“তুই আমার মান, সম্মান সব ডুবিয়েছিস। ছিহ। তোর মতো মেয়ে জন্ম দেওয়াই পাপ ছিলো। নয়তো এভাবে লোকের সামনে আমার মান সম্মান ডোবাতি।”

“বাবা। পলাশ কিছু করেনি। ও খুব ভালো ছেলে। ওকে এভাবে ফাঁসিও না। মামলাগুলো তুলে নাও।”
মায়ার বাবা মেয়েকে আরও কয়েকটা থাপ্পড় দিয়ে বলে,“চুপ। তোর বিয়ে ঠিক করছি। বিয়ে কর। তোর কপাল ভালো, এভাবে মান সম্মান ডুবানোর পরও তোকে আশরাফ মেনে নিয়েছে। অন্য কোন ছেলে তো তোকে বিয়ে করতেও চাইবে না।”
বাবা এসব কথা বলে চলে যায়। মায়া কিছুতেই বিয়ে করতে রাজি হয় না। তার মা তাকে নানাভাবে বোঝায়। কিন্তু মায়া রাজি হয় না। সে বারবার পলাশকে ছেড়ে দিতে বলে। তার কথা আদালতে তো তাকে নাবালক বলেছে তারা তাহলে তাকে এখন বিয়ে দিতে চায় কিভাবে? সে এবার পুলিশ ডাকবে। সে ছোট তো বিয়ে দিচ্ছে কেন? এসব কথায় মায়ার বাবা, মা একটু ভয় পায়। তাই তো কৌশলে মেয়েকে রাজি করানোর সিদ্ধান্ত নেয়। মায়ার মা মেয়েকে খাবার খাইয়ে দিতে এসে বলে,“কেন এমন পাগলামি করছিস?”

“মা আমাকে প্লীজ ছেড়ে দাও। এভাবে ঘরবন্দি করে রেখো না। আমাকে পলাশের কাছে যেতে দাও। একটাবার তার সাথে দেখা করতে দাও।”

“এটা সম্ভব না। আশরাফ ভালো চোখে দেখবে না।”
মায়ের এই কথা শুনে মায়া রেগে যায়। তার সামনে ঐ বুড়োর নাম নেওয়ায় সে ভীষণ রেগেমেগে মায়ের মুখের দিকে তাকায়। তার মা বুঝতে পেরে শান্ত গলায় বলে,“পলাশের বাবা, মা মামলাটি নিয়ে বেশ ভুগছে। এর কাছে ওর কাছে ছুটছে। তুই কী চাস পলাশ মুক্তি পাক?”
মায়া তৎক্ষনাৎ মাথা নাড়ায়। হ্যাঁ সে চায় পলাশ মুক্তি পাক। এখানেই তার মা তাকে একটি শর্ত দিয়ে দেয়। শান্তভাবে বলে,“যদি এটাই চাস তাহলে এই বিয়েতে রাজি হয়ে যায়।”

“কি!”
মায়া অবাক হয়ে তার মায়ের দিকে তাকায়। তার মা বলে,“তোর বাবার এটাই শর্ত। তুই নিজ ইচ্ছায় এই বিয়ে করলে পলাশের বিরুদ্ধে থাকা সব মামলা তুলে নেওয়া হবে। সে তার পরিবারের সাথে তার মতো থাকবে।”
মায়া এসব শুনে মায়ের হাতে-পায়ে ধরে। কিন্তু মা জানায় এখানে সে নিরুপায়। এভাবে কয়েকটা দিন কেটে যায়। মাঝে পলাশের বাবা, মা আসে। তাদের মায়ার বাবাই ডেকে পাঠায়। তাদের মায়াকে বোঝাতে বলে। মায়া বিয়েতে রাজি হলে তারা পলাশকে ছেড়ে দিবে এই কথা শুনে পলাশের বাবা, মায়ও মায়ার কাছে অনুরোধ করে। তাদের ছেলেটাকে ছেড়ে দিতে বলে। মায়াই পারছে ছাড়তে। এখানে এমন এক মানুষকে বিয়ে করলে মায়ার জীবনে কি দূর্ভোগ হবে সেটা কল্পনা করে, তারা নিজের স্বার্থ দেখে। এনাদের কি দোষ। যেখানে মায়ার পরিবারই মেয়েকে জলে ফেলে দিচ্ছে। মায়া অনেককিছু ভেবে রাজি হয়। বিশেষ করে নিজের জন্য পলাশকে শা স্তি পেতে দিতে চায় না সে। তাই বাবার কাছ থেকে কথা নেয়, পলাশকে সত্যি ছাড়বে তো। বাবা, আশরাফ যখন জানায় ছাড়বে। তখন মায়াও বিয়েতে দ্বিমত পোষণ করে না।

অতঃপর মায়া এবং আশরাফের বিয়ে হয়। বাসর ঘরে আশরাফ যখন তার বউকে নিয়ে দেখা তার স্বপ্নগুলোর কথা বলছিলো তখন সেসব মায়ার কাছে বিষের মতো লাগছিলো। প্রথমদিন আশরাফ কাছে আসতে চাইলে মায়া বাধা দেয়। সেদিন অবশ্য আশরাফ কিছু বলে না। তবে দ্বিতীয় দিন বাধা শোনে না। মায়া যখন বলছিলো,“আমাকে সময় দিন।” তখন আশরাফ স্বাভাবিক গলায় বলে,“স্বামী, স্ত্রীর বন্ধন অনেক শক্ত বন্ধন। আমরা যত মেলামেশা করবো তত আমাদের মাঝে ভালোবাসা বাড়বে। তুমিও ঐ গরিব ছেলেটাকে ভুলে যেতে পারবে। তাছাড়া বিয়ে করেছি একা থাকার জন্য নয়। আর আমি পুরুষ মানুষ। এটা নিশ্চয় মেনে নিবো না, আমার স্ত্রী আমাকে কাছে ঘেষতে না দিয়ে অন্য এক ছেলের কথা ভাবছে। স্যরি এটা সম্ভব নয়।”
এসব বলে আশরাফ মায়ার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়। এভাবেই মায়ার অমতে সংসার জীবন শুরু হয় তার। পলাশকে চোখের দেখা না দেখলেও সে যে জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে এই খবর মায়া পেয়েছে। এটা শুনেই খুশি হয়।এভাবে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে একজনের সঙ্গে সংসার করতে হয় মায়ার। তিন বছর সংসার জীবনে কখনো ঐ লোকটার জন্য মায়ার মনে মায়া হয়নি। হবে কিভাবে? এই লোক কখনো মায়ার ইচ্ছা, খুশির মূল্য দেয়নি। তার কিশোরী মন যা পছন্দ করে তা তার কাছে আদিখেতা। এক কথায় দুজনার মানসিকতা মিলে না। তার মাঝে তিন বছর পর খবর পায় প্রবাসে আশরাফের স্ত্রী আছে। প্রবাস জীবন ছেড়ে দেশে এসে ওঠায়, তার প্রবাসের স্ত্রীও দেশে চলে আসে। সেই স্ত্রী আসায় সবটা জানতে পারে মায়া।
বর্তমান,
___
আশরাফের একজন স্ত্রী আছে এটা জেনেও মায়ার পরিবার তাকে সংসার করতে বলছে। এর কারণ অবশ্য একটাই। সেটা হলো টাকা। আশরাফের সাথে বিয়ে হওয়ায় মায়া মানসিক সুখ, শান্তি পাক বা না পাক তার বাবা, মা একটা বড়লোকি লাইফস্টাইল পেয়েছে। নিজের থেকে বড় জামাইয়ের টাকায় সুন্দরভাবে জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখেই তো মায়াকে একটা ভুল জীবনে ঠেলে ফেলেছে তার বাবা, মা। সেখানে তারা সফল। তাই তো বাবা, মায়ের জন্য না চাইতেও সতীনের সংসারও করতে হচ্ছে মায়াকে। তবে আশরাফ তাদের একসাথে রাখেনি। তার যেহেতু শহরে দুটো বাড়ি। সেই দুই বাড়িতে দুই বউকে রাখছে। মায়ার আশরাফের চারিত্রিক সমস্যা আছে সেটা জানার পর থেকে এতদিনের সংসারে বিন্দু পরিমান যে মায়া জন্ম নিয়েছিলো সেটাও শেষ হয়ে যায়। এখন আশরাফের জন্য তার শুধু ঘৃণা হয়। এখন সে কাছে আসলে মায়ার দমবন্ধ লাগে। যেমন বিয়ের প্রথম এক বছর লাগছিলো। মায়া যখন এসব মেনে নিতে না পেরে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। তখন তার মস্তিষ্ক মাঝে মাঝে কাজ করা বন্ধ করে দেয়। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে আশরাফকে উল্টাপাল্টা কথা বলতে শুরু করে। যার ফলস্বরূপ সংসারে অশান্তি। আশরাফ মায়ার গায়ে হাতও তোলে। এত সবকিছু জেনেও মায়ার বাবা, মা চুপ। এসব দেখে মায়া তার বাবা, মাকেও গালাগালি করতে শুরু করে। যেটা শুনে তার মা বলে,“মারে আমরা বুঝতে পারছি আমরা ভুল করেছি। কিন্তু এখন কিছু করার নাই। আশরাফ যেভাবে বলছে সেভাবে চল। তাহলেই তো সে গায়ে হাত তোলে না। সে তো কোন কৃপণতা করছে না। দুই স্ত্রীকেই তার টাকা, পয়সা সবকিছু ভোগ করতে দিচ্ছে। তাহলে তুই পারছিস না কেন মানিয়ে নিতে?”
মায়া আর কথা বাড়ায় না। সে জানে এখন আশরাফকে ছাড়তে চাইলে তার বাবা, মাকে আশরাফের ভোগ করা টাকা ফেরত দিতে হবে সেই ভয়েই তার বাবা, মা সব বুঝেও তাকে সংসার করতে বলছে। তার সম্পত্তিতে নিজের নাম লেখাতে বলছে। মায়ার বাবার কথা কোনভাবে আশরাফের ব্যবসা তার নামে হলেই হলো। তারপর বিন্দাস লাইফ। এদিকে বিদেশে, দেশে এসে ব্যবসার পাশাপাশি যে এত মেয়ের সঙ্গে অবৈধ মেলামেশা ছিলো আশরাফের এসব কথা তার বাবা, মা গায়েই লাগায় না। অগাধ্য শহরের বুকে কোন এক বদ্ধ ঘরের ভেতর দমবন্ধ এক সংসার করে যেতে হচ্ছে মায়াকে। না চাইতেও যার একটি দুটি সন্তানও হয়ে গেছে। অথচ সন্তানের বাবার প্রতি তার কোন ভালোবাসা আজও জন্ম নিচ্ছে না। এভাবেই যুগ পেরিয়ে যায়। দুই ঘরের স্ত্রী এবং সন্তানদের সাথে আশরাফ বেশ ভালোই আছে। শুধু ভালো নেই মায়া। হয়তো আশরাফের প্রথম স্ত্রীও ভালো নেই। মায়ার তার সাথে কথা হয়নি। তাই জানে না। নিজের স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে হয়তো সেও মেনে নিতে পারেনি। মায়ার মতো হয়তো দ্বায়ঠেকা অথবা সম্পদের আশায় সবকিছু মেনে নিচ্ছে সে।

পরিশেষে, এই সমাজে যেমন কিছু উগ্র, উচ্ছৃঙ্খল, বেয়া দব সন্তান রয়েছে। যারা নিজেদের জন্মকে বাবা, মায়ের ভুল বলে। তেমন কিছু বাবা, মায়ও রয়েছে। যারা নিজেদের স্বার্থে সন্তানের সঙ্গে ভুল করে। পৃথিবীর সকল বাবা, মা বেষ্ট। না ভাই। এই কথাটি সত্যি নয়। পৃথিবীর সকল বাবা, মা বেষ্ট নয়। কিছু বাবা, মা স্বার্থপর, সুযোগসন্ধানীও আছে। আসলে বাবা, মা ঠিকই ভালো। কিন্তু যেসব বাবা, মা এমন তারা মূলত বাবা-মা শব্দের গভীরতা, সন্তানের প্রতি নারীর যে অন্যরকম টান থাকে সেটা অনুভব করতেই পারে না। এক কথায় তাদের মাঝে পুরুষ, নারী সত্তাই রয়েছে সেটা পেরিয়ে তাদের মাঝে বাবা, মা সত্তাটার জন্ম হয়নি। তাই তো তারা এভাবে ভাবতে পারে। যদি বাবা, মা সত্তাটা তাদের মাঝে থাকতো তাহলে তারা অবশ্যই সন্তানের সুখটাই ভাবতো। সন্তানের জন্য বাবা, মায়েরা যে কতশত ত্যাগ করে সেই ত্যাগটা তারাও করতো।

(সমাপ্ত)