ভেতরে বাহিরে পর্ব-১৩

0
856

#ভেতরে_বাহিরে
পর্বঃ১৩
লেখিকাঃ #রুবাইদা_হৃদি
আকাশে ঘন কালো মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ থেকে থেকে বিস্তৃর্ণ ভাবে ধরা দিচ্ছে রোদের ঝলকানি।মসৃণ বাতাসে শীতলতা এনে দিচ্ছে৷ তীব্র ফিনাইলের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে পরিবেশে৷ আবেশ পৌছেই ইরার খোজ করছে৷ তার হাঁত-পাঁ কাপছে ৷ ইরা হঠাৎ ওইভাবে ফোন দিয়ে কান্না করছিলো তার উপর সব ধোঁয়াশায় রেখে কল কেটে দেওয়াতে আবেশের ভয়ের মাত্রা আরো বাড়ছে ৷ বাড়িতে ফোন দিয়ে কাউকে পায় নি সে। যার জন্য বেশি ভয় লাগছে ।রিসেপশনে গিয়ে’ই সরাসরি প্রশ্ন করলো,

‘ ডাক্তার ইরা এহসান কোথায়,আছেন?’

রিসেপশনিস্ট অল্প বয়সী তরুণী৷ আবেশকে দেখে থতমত খেয়ে গেলো ৷ আড়চোখে তাকিয়ে বাক্যহীন হয়ে রইলো৷ আবেশ বেশ বিরক্ত হলো মেয়েটার চাহনীতে৷ সামনে থাকে কাচে টোকা দিয়ে বিরক্তি নিয়েই বলল,

‘ হ্যালো মিস.তাকিয়ে না থেকে কাইন্ডলী একটু ইরা এহসানের ইনফরমেশন টা দিন৷’

‘ হ্য..হ্যাঁ..ডাক্তার ইরা কেবিনে আছেন৷ উনার ফ্যামিলির কেউ বোধহয় গুরুতর অসুস্থ৷’

আবেশের ভয়ের মাত্রা বাড়লো৷ হেয়ালি না করে বলল,

‘ কতো নাম্বার কেবিন?’

মেয়েটা আবারো আবেশের দিকে তাকিয়ে আছে ৷ আবেশ রাগ দেখিয়ে বলল,

‘ মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার জন্য আপনাকে রাখা হয়েছে?’

মেয়েটা লজ্জা পেলো বোধহয়৷ দ্রুত চোখ নামিয়ে কম্পিউটারে চেক দিয়ে বলল,

‘ ১২ নাম্বার কেবিন,স্যার৷’

আবেশ অপেক্ষা করলো না৷ দ্রুত ছুটলো সেইদিকে৷ তার বুকে দ্রিমদ্রিম আওয়াজ হচ্ছে৷ সে ধরেই নিয়েছে মাধুর্যের কিছু হয়েছে৷ অস্থিরতা নিয়েই পৌছালো ১২ নাম্বার কেবিনের সামনে৷ নক ছাড়া ঢুকেই দেখলো ইরা সোফায় বসে কাঁদছে ৷ দরজার আওয়াজ পেতেই ইরা তাকালো তারদিকে৷ আবেশকে দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল,

‘ আবেশ..ফয়েজ..’

আবেশ তাকিয়ে দেখলো ফয়েজ বেডে শুয়ে আছে৷ পায়ে ব্যান্ডেজ করা ৷ ফর্সা মুখ মসৃণ হয়ে আছে।ক্লান্ত দেহ ল্যাপ্টে আছে বেডে।হাতে স্যালাইন লাগানো৷ আবেশ দ্রুত ফয়েজের কাছে গিয়ে অস্থির কন্ঠে বলল,

‘ ভাইয়া..ভাইয়া এখানে কেন? ভাবী কী হয়েছে ওর!’

‘ ট্রেনিং-এর সময় পায়ে গুলি লেগেছে কাল রাতে৷ ওখানে থেকে পাঠিয়ে দিয়েছে ওনাকে৷ তোমার ভাই কাউকে ফোন করে নি এবং তারা করতে চাইলেও করতে দেয় নি৷ আমি হসপিটালে আসার আগে ওনি ফোন দিয়ে বলেন,সে হসপিটালে আছে। আম্মা অসুস্থ হয়ে পড়বেন বলে দ্রুত বেরিয়ে এসেছিলাম কিছু না বলেই।’

আবেশ ফয়েজের পাশে বসলো৷ ফয়েজের মাথায় হাত দিতেই তাকালো ফয়েজ ৷ একগাল হেসে বলল,

‘ আমাকে ছাড়াই বিয়ে টিয়ে করে নিয়েছিস৷ বাহ!’

‘ গুলি কী-ভাবে লেগেছে,ভাই?’

‘ আমাদের কাজেই তো গুলি নিয়ে খেলা৷ বাদ দে তো৷ এইবার বল,বউ নিয়ে নতুন সংসার কেমন কাটছে?’ফয়েজ শেষের কথাটা চোখ টিপে বলল৷ ইরা রেগে উঠে বলল,

‘ আবেশ তোমার ভাইকে আমি খুন করে দিবো৷ সকাল থেকে আমি টেনশনে আধমরা আর ও হাসছে৷’

‘ ভাই একদম ঠিক করো নি মুচকি হেসে৷ তোমার উচিৎ ছিলো জোরে জোরে হাসা৷’ আবেশ নিজেও দুষ্টুমি করে বলল ৷ ইরা রেগে গেলো আরো ৷ আবেশ হাসি থামিয়ে সিরিয়াস ভাবে বলল,

‘ তোমার ফোন পেয়ে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম আমি৷ টেনশনে গাড়িও চালাতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছি৷’

ইরা মুখ কাচুমাচু করে বলল,

‘ তখন তোমার ভাই অপারেশন থিয়েটারে ছিলো৷ আমি কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না৷’

‘ আমি ভেবেছি বাসার কারো কিছু হয়েছে!’

‘ কারো কিছু বলতে তোর বউয়ের কথা বুঝিয়েছিস,তাই না আবেশ! আমি তোর ভাই আধমরা হয়ে আছি এইটা দেখে তোর তো কেঁদে কেটে গড়াগড়ি দেওয়ার কথা ছিলো৷’

‘ ভাবী ওকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়াও তো৷’

ইরা কিছু বললো না৷ ফয়েজের দিকে কান্নাভেজা চোখে তাকিয়ে রইলো৷ আবেশ ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে বলল,

‘ ডাক্তার কী বলেছে? এনিথিং সিরিয়াস!’

‘ বেড রেস্ট নিতে বলেছে আর মেডিসিন৷ একটু আগেই কেবিনে দিয়ে গেছেন অটি থেকে৷ বাসায় বিকেলে নিয়ে যাবো৷ আর তুমি আম্মাকে কিছু বলো না,আবেশ৷’

আবেশ রিপোর্ট দেখছিলো ফয়েজের৷ রিপোর্ট দেখতে দেখতেই বলল,

‘ তুমি ভাইয়াকে নিয়ে যেতে পারবে!না আমাকে আসতে হবে?’

‘ পারবো৷’

‘ ওকে দ্যান,টেক কেয়ার অফ হিম৷ আমি চলে যাচ্ছি৷ ইম্পোর্ট্যান্ট কাজ আছে৷’

আবেশ রিপোর্ট রেখে ফয়েজের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো ৷ ফয়েজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ ও এতো গম্ভীর কেন,বলো তো ইরা!সারাদিন শুধু কাজ৷’

‘ ঘুমাও তো! কতোটা ব্লিডিং হয়েছে সে খেয়াল আছে তোমার?’

ইরা শাসনের সুরে বললতেই৷ ফয়েজ হাত উঁচিয়ে ডেকে বলল,

‘ কাম ইরা বাবু! কতোদিন দেখি না তোমায়৷আসো একটু দেখি মন-প্রাণ ভরে৷’

ইরা না চাইতেও হেসে উঠলো৷ গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো ফয়েজের দিকে৷ তার মাত্রাতিরিক্ত টেনশন হচ্ছিলো বলেই আবেশকে ফোন দিয়েছিলো ৷ সকাল সকাল ফয়েজের ফোন পাওয়ার পরেই দুনিয়া অন্ধকার হয়ে উঠেছিলো তার৷ না পেরেছিলো কাউকে বলতে না পেরেছিলো জোরে কাঁদতে ৷ রাতের ঘুম ভালো হলেও সকালে তার দুনিয়া ঘুরে গিয়েছিলো ফয়েজের ফোন পেয়ে। যার জন্য কেঁদেকেটে চোখ ফুলে গেছে তার।

___________

আধঘন্টা যাবৎ জ্যামে বসে থেকে বিরক্তিতে আবেশের মুখ কুঁচকে এলো ৷ কাঁদা ভেজা রাস্তার জন্য’ই এই হাল৷ কোথাও কোথাও হাঁটু সমান পানি উঠে বিশ্রী অবস্থা৷ আবেশে গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলে হাত ঠেকিয়ে বসে আছে৷ গলায় ঝুলছে রোদচশমা৷ হাতের ঘড়ির দিকে বারবার বিরক্তির চোখে তাকাচ্ছে৷ তার ইচ্ছা হচ্ছে, সময় টাকে পজ করে দিতে৷ সময় কেন থমকে যায় না? সময়ের বেড়াজালে কেন সুখ ধরা পড়ে না? সুখ কী তবে মরীচিকা! ভেবেই চোখ বুলালো ব্যস্ত শহরে।

আশেপাশে ব্যস্ত ভাবে তাকিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে৷ হুট করেই নজর কাড়লো বেলীফুলের মালা আর রজনীগন্ধা ৷ সাথে সাথেই মনের ক্যানভাসে ভেসে উঠলো মাধুর্যের মেঘমালায় জড়ানো বেলীফুল৷ রজনীগন্ধা হাতে খিলখিল করে হাসছে সে৷
আবেশ গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো৷ ফুল বিক্রেতা একটা ছোট মেয়ে৷ আবেশকে দেখে বলল,

‘ ফুল লিবেন সার! দাম বেশি না৷ কোনডা লিবেন দেখেন৷’

‘ সবগুলো বেলীফুলের মালা আর রজনীগন্ধা দাও।’ আবেশ অন্যমনস্ক হয়েই বললো৷ তার চোখে মাধুর্যের হাসিমুখ ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ বুকের মাঝে চিনচিনে ব্যথা করছে৷ শুধু মনে হচ্ছে,মেয়েটা হাসে না কতোকাল৷ তার হাসিরা কাঁদছে!

‘ লেন সার৷’

আবেশ হাত বাড়িয়ে নিয়ে দাম জিগ্যেস করে পকেট থেকে টাকা বের করে দিলো৷ যাওয়ার আগে কী মনে করে পেছনে ঘুরে বলল,

‘ এই পিচ্চি! এই ফুল দেখে হাসিরা আবার হাসবে?’

মেয়েটা ভ্রু কুঁচকে তাকালো৷ আবেশের কথা বুঝতে না পেরেও মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল ৷ ‘ না ‘ বললে যদি ফুল না নেয় এইভেবে৷
আবেশ ফুল গুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে৷ তার অনুভূতির বাইরে কাজ করেছে আজ৷ গাড়িতে বসার পর টনক নড়লো,’ এই ফুল মাধুর্যকে কী করে দিবে? মাধুর্য তার মাধবীলতা নয়৷ তার মাধবীলতা হারিয়ে গেছে সময়ের স্রোতে। বহুকাল আগেই হারিয়ে গেছে! আর যে আছে সে হচ্ছে মাধুর্য৷ যার প্রতি তার করুনা হয় ৷ যার প্রতি তার মায়া হয়৷ অনুভূতি হয় না৷ কারণ সেই অনুভূতি গুলো সেই নিজ হাতে সেই দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিলো।’

পিনপতন নীরবতা চারদিকে৷ পায়ের ঘর্ষণের আওয়ায় ছাড়া বাহ্যিক কোনো শব্দ নেই ৷ খোলা আকাশে মেঘ ঘণীভূত হয়েছে৷ বাইরের থমথমে পরিবেশের মতোই বাসার ভেতরকার পরিবেশ৷ মাধুর্য দ্রুত নীচে নামছে সিড়ি বেয়ে ৷ নাজিফা বাইরে বের হচ্ছে৷ মাধুর্যকে ডান পাশে থেকে আসতে দেখে কঁপাল কুঁচকে ফেললো সে৷ কলেজ ব্যাগ ঝুলিয়ে ছুটে গেলো ডানদিকে৷ উঁকি দিয়ে দেখলো,কাচ ঘেরা রুমটা খোলা৷ সাথে সাথেই জিভ কেটে সিড়ির সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চাস্বরে বলল,

‘ ছোট ভাবী.. তুমি কী কাচের রুমটায় গিয়েছিলে?’

নাজিফার কথায় থমকে দাঁড়ালো মাধুর্য৷ ঘুরে তাকিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

‘ হ..হ্যাঁ গিয়েছিলাম৷ ওই রুমটা কার নাজিফা?’

‘ ওইটা ছোট ভাইয়ার রুম৷ ভাইয়া জানতে পারলে তোমাকে সহ আমাকেও ছুঁড়ে ফেলবে ছাদ থেকে৷’

‘ কেন? কী আছে ওই রুমে!’

নাজিফা দ্রুত সিড়ি বেয়ে নেমে মাধুর্যের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ জানি না তো! তবে সেই রুমে কেউ ঢুকতে পারে না৷ আমার কী মনে হয়,জানো?’

মাধুর্য রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো৷ নাজিফার কথা শুনে উত্তেজনায় তার হাঁত-পাঁ কাপছে৷ নাজিফা ফিসফিস করে বলল,

‘ ওই রুমে ভাইয়ার আরেকটা বউ আছে৷ যাকে হাইড করে রেখেছে আমাদের থেকে৷’

নাজিফার বাচ্চামো কথায় মাধুর্য প্রতিউত্তর দিলো না৷ লাল কভারের মলাটে তার মন পড়ে আছে৷ নাজিফাকে পাশ কাটিয়ে মাধুর্য বলল,

‘ নাজিফা পরে কথা হবে,তোমার সাথে৷’

নাজিফা মাধুর্যের যাওয়ার দিকে হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো৷

মাধুর্য সোজা চলে গেলো মাহফুজার কাছে৷ মাহফুজা কিচেনে কাজ করছে৷ মাধুর্য কিচেনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বুক ফুলিয়ে শ্বাস টেনে নিলো৷ তার ভেতর কাঁপছে ৷ মাহফুজার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ স্বরে ডাক দিয়ে বলল,

‘ আম্মু’মা! আমার কিছু কথা ছিলো৷’

মাহফুজা ঘুরে তাকিয়ে মুখে হাসি টেনে কঁপালে লেগে থাকা ঘাম মুছে বলল,

‘ কী বলবি বল!আর টেবিলে দেখ তোর পছন্দের সবজি নুডলস রাখা৷’

মাধুর্য শুকনো ঢোক গিললো৷ কী করে!কোথা থেকে,শুরু করবে ভেবে পেলো না৷ তবুও সাহস জুটিয়ে বলল,

‘ লাইব্রেরির রুমে একটা ফাইল…’

‘ লাইব্রেরি রুম! মাধুর্য তুই অনুমতি ছাড়া ওই রুমে কেন ঢুকেছিস?’ মাহফুজা অবাক আর রাগান্বিত স্বরে বলল৷ তার চোখেমুখে চিন্তার রেখা আছড়ে পড়ছে৷ মাধুর্য আবারো ভড়কে গেলো ৷ মাহফুজা বললেন,

‘ ওই রুমে কেন গিয়েছিলি,মাধু? ওইটা তোর আঙ্কেলের কাগজপত্র রাখার রুম৷ সেখানে ঢোকার কারো অনুমতি নেই৷’

‘ আমি বুঝতে পারি নি আম্মু’মা৷ দরজা খোলা ছিলো আর বই দেখে ঢুকে গিয়েছিলাম৷’ মাধুর্য মিনমিনে কন্ঠে বলল৷ মাহফুজা অবাক হয়ে বললেন,

‘ দরজা খোলা! কে খুলেছে ওই রুমের দরজা!’

‘ আমি জানি না৷ সেখানে একটা লাল রঙের ফাইল আছে আম্মু’মা৷’

মাহফুজা চমকে উঠলেন৷ বড় বড় চোখ করে তাকালেন৷
প্রশ্নসূচক চোখে তাকিয়ে বললেন,

‘ ফাইল কীসের ফাইল!’

‘ নানা ভাইয়ের ছবি যুক্ত ফাইল,আম্মু’মা৷ দলিল জাতীয়৷’

মাহফুজা স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললেন,’ আ..আমি কি..চ্ছু জানি না৷’

‘ নানা ভাইয়ের অস্পষ্ট ছবি ফাইলের উপরে৷ বলো আম্মু’মা ওই ফাইলটা কীসের!’

মাহফুজার কঁপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঘাম৷ অস্থির হয়ে উঠেছেন তিনি৷ যে ভয়টা পাচ্ছিলো সেটাই পূর্ণ এতো জলদি হবে কখনো ভাবেন নি সে৷ দমে না গিয়ে বললেন,

‘ কাগজের ব্যাপার আমি বলবো কী করে? তুই কোন ফাইলের কথা বলছিস সেটাই তো আমি বুঝতে পারছি না৷’

মাধুর্য হাত নেড়ে বলল,

‘ লাইব্রেরির রুমে লাল মলাট বাধাঁনো ফাইল,আম্মু’মা৷’

মাহফুজা হাতের কাজ রেখে মাধুর্যের দিকে একনজর তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে উঠলেন৷ তার ভেতর কাঁপছে৷ মাধুর্য যদি সন্দেহ করে? তাহলে সে সামলাবে কী করে?

‘ ভুল দেখেছিস,মাধু৷ ওইটা মনে হয় অন্যকারো ছবি৷’

‘ আমি স্পষ্ট ভাবে দেখেছি৷ আর নানা ভাইয়ের ছবি আমি চিনবো না? এইটা কখনো হয়!’

মাহফুজা চুপ হয়ে গেলেন৷ হাত দিয়ে বারবার ঘাম মুছেছেন৷ মাধুর্য আবারো বলল,

‘ ওইটা কী সেই দলিল, আম্মু’মা? যে দলিলের কথা আব্বু বারবার বলতো! আর তুমিও বলেছিলে সেদিন? যদি তাই হয়ে থাকে,তাহলে সেই দলিল এই বাড়িতে কেন?’

‘ ও..ইই..ওই দলিল হতে যাবে কেন? মেহরুনের কাছে সেই দলিল৷’

মাহফুজা অগোছালো ভাবে বলল৷ মাধুর্য সব ভুলে গিয়ে পাগল হয়ে উঠলো৷ প্রত্যেকটা বিভৎস দিনের কথা এক এক করে মনে পড়তে শুরু করলো তার৷ বারবার মনের কোণে জানান দিয়ে উঠলো,’তার আম্মু’মা মিথ্যা বলছে৷’
অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ তুমি আমায় মিথ্যা কথা বলছো,আম্মু’মা৷ তুমি সব জানো৷ জেনেও কেন লুকিয়ে ফেলছো?’

‘ আমি মিথ্যা কথা বলছি না,মাধু৷ সত্যি বলছি৷ তুই ভুল বুঝছিস আমাকে৷’

মাহফুজার কথায় মনের উঠা সন্দহের ঝড় থামলো না মাধুর্যের৷ মাহফুজার অস্থির লাগছে৷ মাধুর্য রাগ করে বলল,

‘ তোমাকে আমার সন্দেহ হচ্ছে,আম্মু’মা৷ কেন হচ্ছে জানি না৷ তবে আমার মন বলছে সেই ফাইলের ভেতরকার দলিলটা সেই দলিল৷ যার জন্য আব্বু আমাকে মারতো৷’

মাহফুজা কিছুটা ভড়কে গেলেন৷ মাধুর্যের চোখেমুখে জানার আগ্রহ৷

সে কী ভাবে সব মাধুর্যকে বলবে? তাদের ভুলের জন্য মাধুর্যের জীবন বিষিয়ে গিয়েছে!
মাহফুজা কন্ঠের খাদ নামিয়ে বললেন,

‘ মাধুর্য,ভুল বুঝিস না তোর আম্মু’মাকে৷ সে কখনো তোর ক্ষতি চায় নি৷ আর ওই দলিল….

‘ এখানে কী ভাবে এলো সেটা? আম্মু’মা আমি কিছু বুঝতে পারছি না৷ কিচ্ছু না!’

মাহফুজার কথার মাঝেই অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো মাধুর্য৷ মাহফুজা ভেবে পেলেন না কীভাবে সব সামলাবেন!
মাধুর্য হুট করেই মাহফুজাকে জড়িয়ে ধরলো ৷ ডুকরে কেঁদে উঠলো৷ মাহফুজা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন৷ মাধুর্য মাহফুজাকে ছেড়ে দিয়ে অতি করুন কন্ঠে বলল,

‘ আম্মু’মা আমার দোহাই লাগে।বলো,ওই দলিল এই বাড়িতে কেন? আমার আম্মু কোথায় আম্মু’মা৷’

মাহফুজার গলা কেঁপে উঠলো৷ সত্য কখনো চাঁপা থাকে না সে খুব ভালো করেই জানে৷ ভেতরের কলুষিত সত্য গুলো যখন বেরিয়ে আসবে তখন মাধুর্যের চোখের দিকে কী করে তাকাবেন তিনি?

‘ আচ্ছা কিছু বলতে হবে না,তোমাকে৷ এক কাজ করো আমাকে মেরে দাও৷ আমি মুক্তি পেতে চাই এই জীবন থেকে৷’

মাহফুজা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন মাধুর্যকে৷ চোখ বোজে ফেললেন৷ সাথে সাথে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনাজল৷ মাধুর্য কাঁদছে আর বারবার এক কথা জিগ্যেস করছে ৷ মাহফুজা কাঁপা গলায় বললেন,

‘ সব বলবো তোকে৷ সব! কিন্তু কথা দে মাধুর্য,তু ই আবেশ,ফয়েজ ওদের কিছু বলবি না৷ আমাকে ভুল বুঝবি না৷’

মাধুর্য অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো৷ মাধুর্যকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মাহফুজা স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন৷ সে শাড়ির আঁচল মুখে চেপে কাঁদছে ৷
মাধুর্য তার কাছে গেলেই মাহফুজা বললেন,

‘ ভেতরে কলুষিত অধ্যায় আছে,মাধু! হয়তো তোর আম্মু’মা তোর চোখে আজ খারাপ হয়ে যাবে৷ সবচেয়ে জঘন্য হয়ে উঠবে৷’

মাধুর্য অবাক হলো৷ কী এমন সত্য যার জন্য তার আম্মু’মা এইসব কথা বলছে?
তবে সে শুনতে চায়,জানতে চায়! মুক্তি পেতে চায় ভেতরে বাহিরের টানাপোড়েন থেকে৷ মাহফুজা কান্না থামিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলা আরম্ভ করলে মাধুর্যের পায়ের নীচে মাটি সরে যাওয়ার মতো অনুভূতি হতে শুরু করে……

চলবে….