ভেতরে বাহিরে পর্ব-১৪

0
854

#ভেতরে_বাহিরে
পর্বঃ১৪
লেখিকাঃ #রুবাইদা_হৃদি
অন্ধকারে আবৃত রুম৷ ক্ষীণ আলো আসার বিন্দুমাত্র রেশ নেই৷ রুমের এককোণে হাঁটুতে মাথা গুজে ডুকরে কাঁদছে মাধুর্য৷ এলোমেলো শাড়ি গড়িয়ে আছে ফ্লোরে। সন্ধ্যার নিজস্ব আলো ধূসর রঙ ছড়াচ্ছে৷ পাখিরা নীড়ে ফিরে যাচ্ছে৷ মাধুর্যের যেন নীড় থেকেও নেই৷ নিজের প্রতি তীব্র ধিক্কার আসছে তার ৷ চুল গুলো টেনে খুলে ফেললো মাধুর্য৷ চুল টেনে ধরে কাঁদছে৷ বাইরে থেকে দরজায় করাঘাতের শব্দ ভেসে আসলো সেই সাথে আবেশের কন্ঠ,

‘ মাধুর্য ওপেন দ্যা ডোর৷ কী ধরণের পাগলামি এইগুলো!’

আবেশের কথা মাধুর্যে কর্ণগোচর হতেই সে আরো কেঁদে উঠলো৷ আবেশ দরজায় অনবরত কড়া নাড়ছে৷ ভয় পাওয়া কন্ঠে বলল,

‘ মাধুর্য আর ইউ ওকে! দরজা আটকে কী করছো,তুমি?’

আবেশের কন্ঠে চিন্তার রেশ৷ নীচে ড্রয়িংরুমে মাহফুজাকে কাঁদতে দেখে জিগ্যেস করেও লাভ হয় নি৷ রুমে এসে দেখলো দরজা আটকানো৷ কী হচ্ছে তার বাসায়!
মেজাজ খারাপ হচ্ছে আবেশের৷ দরজায় আবারো বারদুয়েক হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে অস্থির কন্ঠে বলল,

‘ মাধুর্য,রুমে কী করছো তুমি? দরজা খুলবে,না আমি ভাঙ্গবো!’

মাধুর্যের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না৷ মুখ চেপে কাঁদছে সে৷ আবেশ বিরক্ত হয়ে উচ্চস্বরে বলল,

‘ আম্মা…আম্মা…কী হয়েছে তোমাদের? মাধুর্য দরজা খুলছে না কেন!’

মাহফুজা সোফায় বসে ছিলেন৷ আবেশের ডাক শুনে ভড়কে গেলেন৷ মাধুর্য তার কাছে সব শোনার পর দৌড়ে রুমে চলে গিয়েছিলো ৷ মাহফুজা ভয় পেলেন ৷ উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত গেলেন রুমের সামনে৷
আবেশ কপালে আঙুল ঘষছে আর পায়চারি করছে ৷ মাহফুজাকে দেখে বললেন,

‘ বাসায় তামাশা চলছে,আম্মা? কী হয়েছে বলো তো৷’

‘ মাধু,দরজা খোল আম্মু৷’

মাহফুজার করুন কন্ঠ শুনে মাধুর্য নড়েচড়ে উঠলো৷ লম্বা শ্বাস টেনে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা চালালো ৷ তবুও যেন থামছে না কান্না৷ সে কী করে মেনে নিবে এই তিক্ত সত্যি? তার জীবন নরকীয় এক নাটকে পরিণত হয়েছে ৷ যার জন্য তার অর্ধের জীবন কেটেছে অন্ধকারে৷

‘ মাধুর্য আমি লাস্ট ওয়ার্ণিং দিচ্ছি৷ তুমি এখন এই মুহূর্তে দরজা না খুলে দাও আমি ভেঙে ফেলবো৷ তোমার ধারণা বাইরে আমার রাগ কতোটা ভয়ানক৷’

মাধুর্য চোখ মুছে দাঁড়ালো৷ ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই মাহফুজা বিস্ময় নিয়ে বলল,

‘ ঠিক আছিস,তুই!এইভাবে দরজা আটকে বসে আছিস কেন!’

মাহফুজার স্বাভাবিক কন্ঠ শুনে শ্লেষ চোখে তাকালো মাধুর্য৷ আবেশ পকেটে হাত গুজে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ হোয়াট হ্যাপেন,মাধু! তোমার প্রবলেম টা কোথায়? তোমাকে বারবার বলছি রিলাক্সে থাকবে৷ ওইসব মনে করবে না৷ তাও কেন করছো?’

‘ এতো সহজ!’ মাধুর্য বসে যাওয়া কন্ঠে বলল৷ আবেশ কনফিডেন্স নিয়ে বলল,

‘ অভিয়াসলি,তুমি চাইলে সব সম্ভব৷’

‘ কিছু সহজ না,আবেশ৷ আপনার ভেতর আর বাহির অন্ধকারে ডুবে আছে৷ চোখ খুলে বাস্তবতা দেখুন৷ সব এতোটা সহজ নয়৷ আপনার সামনে যা ঘটছে তা সহজ নয়৷’

‘ কী বলতে চাইছো,তুমি?’ আবেশ প্রশ্নসূচক চোখে তাকিয়ে বলল৷ মাহফুজা খানিক ভয় পেলেন৷ মাধুর্য যদি সব বলে দেয় আবেশের কাছে! তাহলে? কী হবে!
তিনি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বললেন,

‘ দুনিয়া বড্ড কঠিন৷ আমাদের মানিয়ে নিতে শিখতে হয়৷ আর কথা বাড়িয়ো না আবেশ৷ ফ্রেশ হয়ে খেতে আসো৷’

মাধুর্য নির্বাক ভাবে তাকিয়ে আছে৷ তার ভাষা আজ শূন্য৷ মাহফুজা করুন চোখে তাকিয়ে আছে মাধুর্যের দিকে৷ তার চোখে আকুতি৷ মাধুর্য কী পারবে,সেই আকুতি রাখতে! তার যে ইচ্ছা হচ্ছে,সব ছেড়ে চলে যেতে৷ সত্যটা টেনে বের করতে৷
আবেশ মাধুর্যকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে চলে গেলো৷ আবশ যেতেই মাহফুজা খপ করে ধরলেন মাধুর্যের হাত৷ অনুনয় করে বললেন,

‘ ওকে কিছু বলিস না মাধুর্য ৷ আমি তোর কাছে অপরাধী৷ আমি চিরকাল অপরাধবোধে ডুকরে মরছি৷ আমি চাই না আমার ছেলে মেয়েরা আমাকে ভুল বুঝুক৷’

মাধুর্যের ভেতর শূন্য হয়ে আসছে৷ হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে৷ মাহফুজা মাধুর্যের হাত ধরে নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে আছে ৷ মাধুর্য সেই চোখের দিকে তাকিয়ে বুক ফুলিয়ে শ্বাস টেনে বলল,

‘ তুমি চিন্তা করো না,আমি কিচ্ছু বলবো না৷’

মাহফুজা যেন স্বস্তি পেলেন ৷ মাধুর্য মুখে হাসি ফুঁটিয়ে বলল,

‘ তোমার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ৷ যে কৃতজ্ঞতা কখনো কমার নয়৷ আর যাই হোক,আমাকে নরক থেকে তো বের করেছো৷ এইটাই বা কম কীসের৷ তাই নিশ্চিন্তে থাকো তুমি৷’

‘ আমি জানি মাধুর্য আমার প্রতি তোর রাগ আছে৷ আমি চেয়েও কিছু কর‍তে পারি নি৷’

মাধুর্য কিছু বলল না৷ নির্বিকার ভাবে চেয়ে রইলো তার সামনে দাঁড়ানো সুন্দর মুখশ্রীর দিকে ৷ আদেও কী সত্য বলেছেন তার আম্মু’মা তাকে? না’কী ভেতরে সব লুকিয়ে নতুন কাহিনী তৈরি করলেন তার চোখে!

____________
আঁধার নেমেছে ভুবনে৷ কালো আঁধারে বিশাল আকাশে অর্ধচন্দ্র জ্বলজ্বল করছে৷ বৃষ্টিভেজা কচিপাতা গুলো নুইয়ে আছে নীচ দিকে ৷ রজনীগন্ধার সুবাস ভেসে বেড়াচ্ছে সর্বদিকে৷ মাধুর্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে৷ তার ভেতরে প্রশ্নের জটলা ঘুরপাক খাচ্ছে ৷ মাহফুজার বলা প্রত্যেকটা কথা মনে দোল খাচ্ছে৷ রজনীগন্ধার সুবাসিত সৌরভ অনুভব হতেই খানিক মোহাচ্ছন্নতা ঘিরে ধরলো মাধুর্যকে। আশেপাশে তাকিয়ে ফুল খুজলো ৷ নিজের মনের ভুল ভেবে টলটলে চোখে সামনে তাকালো ৷ এখনো যেন,মাহফুজার কথা কানের মাঝে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে। চোখ বন্ধ করে স্তব্ধ হয়ে রইলো মাধুর্য।
ভাবার চেষ্টা করলো সব। মনে মনে আওড়াচ্ছে সবটা। মাহফুজার ভাষ্যমতে,
মেহরুন আর শাহেদ মানে তার বাবা আর আম্মু পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন৷ শাহেদ আর মেহরুন মামাতো-ফুঁপাতো ভাইবোন৷ তাদের হুট করে পালিয়ে যাওয়ার জন্য মেহরুনের বাবা দায়ী করেন শাহেদের মা মানে মেহরুনের ফুপুকে ৷ কারণ তার ধারণা,সব সম্পত্তি নিজের করার জন্য এই কুরুচিপূর্ণ কাজটা করেছেন শাহেদের মা৷ যার জন্য তার ভাগের সবটুকু সম্পত্তি আত্মসাৎ করেন মেহরুনের বাবা৷
বিশাল জমিদারি উত্তরাধীকার সূত্রে পেয়েছিলেন তিনি৷ জমজমাট ছিলো অনেক৷ অঢেল সম্পত্তির মালিক ছিলেন তারা৷ রাজকীয় সাম্রাজ্য।
নিজের অহংকারের জন্য তাদের সম্পর্ক মেনে নেয় নি আফতাব মোর্শেদ৷ তবে শেষ বয়সে এসে সব সম্পদের উইল করে মেহরুনের নামে৷ একমাত্র মেয়ে ছিলেন মেহরুন৷ ভেবেচিন্তে সব গুছিয়ে দিয়ে যান৷
শাহেদ আর মেহরুনের সংসারে তখন কষ্টের হিসেব দিয়ে পরিপূর্ণ৷ হুট করে আফতাবের এমন সিদ্ধান্ত যেন হাতে চাঁদ পাবার মতো ৷ কিছুদিন বাদে আফতাব মোর্শেদ হঠাৎ করেই মারা যান ৷ কী করে মারা গিয়েছিলেন কেউ কিছু জানেনা ৷ মেহরুন ফিরে যান নিজ বাড়িতে ৷ মাহফুজা আর নজরুলকে থাকতে দেন তাদের সাথেই ৷
মেহরুন সব পেয়ে নিজেকে পরিবর্তন করা শুরু করেন ৷ শাহেদ বারবার বুঝিয়ে লাভ হয় নি ৷
মাহফুজা সব জেনেও চুপ ছিলো৷শাহেদকে সম্পূর্ণ রুপে বঞ্চিত করার অদম্য খেলায় মেতে উঠেন মেহরুন।উঁচু ঘরের এক ছেলের সাথে জড়িয়ে পড়ে পরকীয়ায় ৷ মাহফুজা সব জেনেও বাধা দেয় নি মেহরুনকে৷ এইটাই তার দোষ ছিলো৷ নজরুল আর তার টানাপোড়েনের সংসার তখন! নিজেদের সুখের জন্যই মেহরুনের সকল দোষ চেপে গেছেন৷
মেহরুন সকল সম্পত্তি বিক্রি করতে চাইলে বাধা দেন শাহেদ৷ মেহরুন শোনে নি! তবে বিক্রিও করতে পারে নি৷ কারণ,তার বাবা মেহরুনের সন্তানের অর্ধেক সম্পত্তির অধিকার উইলে উল্লেখ করে গিয়েছিলেন৷সেইজন্য শাহেদের সাথে আবার সম্পর্কে ভীত মজবুত করে মেহরুন৷
সব ঠিকঠাক হয়ে যায়৷ গোছালো,সুন্দর! হাসিতে মেতে উঠা জীবন ৷ জমি-জমা ছিলো আফতাবের৷ ক্যাশ কোনো টাকা ছিলো না৷ কোটি টাকার সম্পদ ছিলো মাটি ৷অল্প সংখ্যক কিছু বিক্রি করতে পেরেছিলেন মেহরুন৷
তবে মেহরুন হঠাৎ করেই পাগলাটে হয়ে উঠে৷ ক্ষিপ্র আচরণ শুরু করে৷ তখনও মাহফুজারা রুপগঞ্জ ছিলেন৷ এর মাঝে নজরুল হুট করেই ঠিক করলেন তারা সিলেট আসবে৷ এখানে আসলে নিজেদের পরিবর্তন আনতে পারবেন৷
তাদের সিলেট চলে আসার পর মেহরুন ছুটে আসে একদিন৷ তুলে দেন সব কিছু নজরুলের হাতে৷ আর বলে যান,শাহেদ তাকে মারার চেষ্টা করছে! আর মাধুর্যকে নিয়ে আসতে বলেন তাদের কাছে ৷ তারপরেই হারিয়ে যান কোথাও৷ মাহফুজা সেদিনও আটকান নি মেহরুনকে৷ তবে
মাধুর্যের খোজ তারা করেছিলো রুপগঞ্জে৷ কিন্তু পান’নি ৷
এতোকিছু একসাথে পেয়ে নজরুল সামলাতে পারে নি নিজেকে৷ তাই দুইনম্বরি উপায়ে সব বিক্রি করে দিয়েছিলেন ৷ সেটার একটা কপি দলিল অমীমাংসিত হয়ে পড়ে আছে লাইব্রেরি তে৷
এই কাজের জন্য মাহফুজা প্রচন্ড অনুতপ্ত হয়৷ তবে,এতো বছর পর নজরুল যখন মাধুর্যের খোজ পায় তখুনি নিয়ে আসতে চান মাধুর্যকে ৷ মাধুর্যকে দিতে চায়নি রাব্বী। তাই তো,আবেশের সাথে বিয়ে ঠিক করেন নজরুল মোটা টাকার বিনিময়ে৷ যার সবটা নিয়েছে রাব্বী ৷
মাহফুজা আরো বলে শাহেদ নজরুলকে বলেছেন,মাধুর্য তার সন্তান নয় ৷মেহরুন তার কাছে অন্যের সন্তান দিয়ে নিজে সব আত্মসাৎ করেছে৷
এই কথাটুকু একদম মানতে পারছে না মাধুর্য৷ তার কিচ্ছু চাই না! মাহফুজা আমানত ধরে রাখতে পারে নি বলে লজ্জিত হয় অনেক৷ এইসব সম্পদের সব টাকা যে মাধুর্যের তা আবেশ আর ফয়েজ জানতে পারলে সে মুখ দেখাবে কী করে?
এইসব বলে মাধুর্যকে অনুনয় করেন ৷ আরো বলেন,সব সম্পদ তার নামেই উইল করা আছে৷ শুধু সুন্দর জীবনের আশায় আমানতের খেয়ানত করেছিলেন নজরুল৷
মাধুর্য চোখ বন্ধ করেই কেঁদে উঠে৷ তার কোনো সম্পদ লাগবে না! তার আফসোস হচ্ছে নিজের জীবনের প্রতি ৷ সে না’কী তার আব্বুর মেয়ে না! তার আম্মু কোথায় আছে কেউ জানে না৷ হুট করে সব অন্যকে দিয়ে উধাও হয়ে গেলেন ৷ কোথায় গিয়েছেন কেউ জানে না! সে বুঝে পায় না,মাহফুজা তাকে খুজে কেন পেলো না? যেখানে আবেশ প্রতিনিয়ত চিঠি দিতো।
তার নানাভাই আফতাব কী ভাবে মারা গেছেন? সেটাও অমীমাংসিত ৷ একটা দলিল আর সম্পদের জন্য তার জীবন ভাসমান হয়ে গেছে৷ এটাও কী সম্ভব! এর পেছনে সব দায় মেহরুন মানে তার আম্মুর। মনের মধ্যে ধুকধুক করছে ৷ বারবার মনে হচ্ছে শাহেদ হয়তো কিছু জানে ৷
তবে মাহফুজার কথা বিশ্বাস না করেও উপায় নেই তার৷ মানুষের চোখ কখনো মিথ্যা বলে না৷ মাহফুজার চোখে মাধুর্য সত্যতা দেখেছে৷
এই সব সম্পদের হিসেব তার লাগবে না ৷ কিন্তু তার আম্মু কোথায়? সে কার সন্তান!
সামাজিক অর্থে সে জারজ সন্তান ৷ এই কথাটা তীরের মতো বিঁধছে মাধুর্যের ৷ তার আব্বু তাকে মারতো বেশ করতো ৷ কে চাইবে অন্যের সন্তান বড় করতে!
তার আম্মু বেইমানি করছে ৷ বেইমানি করেছে তার জীবনের প্রতি৷ সে চাইলেই পারতো সুস্থ একটা জীবন তাকে উপহার দিতে ৷ এখানে সে কারো দোষ খুজে পাচ্ছে না। সব দোষ তার জীবনের।
তবে সে কাল যাবে শাহেদের কাছে ৷ শেষবারের মতো গিয়ে ধন্যবাদ দিবে আর জিগ্যেস করবে,সত্যি কী আমি আপনার মেয়ে নই!
মাধুর্য আজ কাঁদছে না৷ জীবন তার কাছে নাটকীয় মনে হচ্ছে৷ যার পরিচালনা তার মা মেহরুন শুরু করেছিলেন ৷ যে সব ধোঁয়াশা রেখে উধাও হয়ে উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন নাট্যমঞ্চ৷

আবেশ ফ্রেশ হয়ে দাঁড়িয়েছে রুমে ৷ মাধুর্যকে রুমে দেখতে না মাথা মুছতে মুছতে চারদিকে চোখ বুলালো ৷ বাতাসে রজনীগন্ধার সৌরভ ভেসে আসতেই চট করে মনে পড়লো সে ফুল এনেছিলো৷ সাথে সাথেই দ্রুত পায়ে বাইরে চলে গেলো আবেশ৷ বাইরে সু কেবিনেটের উপর রাখা আছে ফুলের প্যাকেটটা ৷
ফুলের প্যাকেট হাতে নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায় আবেশ৷ কী ভাবে দিবে এইগুলা,মাধুর্যকে! ভেবে নিলো ফুলগুলো মাধুর্যের হাতে দিয়ে বলবে,

‘ ফয়েজ ভাইয়া এইগুলা তোমার জন্য এনেছে৷’

মাধুর্য কী বিশ্বার করবে তার কথা? কী জন্য যে আনতে গেলো ফুলগুলো৷ ভেবে আফসোস হচ্ছে৷ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বারান্দার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো আবেশ ৷ মাধুর্য তখন সামনে তাকিয়ে আছে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে৷
আবেশ ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো মাধুর্যের দিকে৷ মাধুর্যে পেছনে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ মাধুর্য..!’

আবেশের ডাক শুনে শূন্য চোখে ঘুরে তাকালো মাধুর্য৷ আবেশ থমকে গেলো ৷ নিষ্প্রাণ মুখশ্রী৷ আধখোলা খোঁপা ঝুলে আছে ঘাড়ের উপর ৷ টানা টানা চোখে আজ কান্না নেই,নেই কোনো চঞ্চলতা ৷ আবেশের কী হলো সে নিজেও বুঝতে পারলো না৷ হঠাৎ করেই তার মনে হলো,ফুলগুলো দিলে মাধুর্য হাসবে,নয়তো কাঁদবে৷
সে মাধুর্যের রিয়্যাকশন নিজ মনে ভেবে ফুলের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘ এখানে তোমার কান্না,হাসির মেডিসিন আছে৷ তবে আমি চাই হাসিরা আজ হাসুক৷ প্রাণ খুলে বাঁচুক৷’

মাধুর্য বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলো৷ তার কিছু ভালো লাগছে না ৷ ইচ্ছা হচ্ছে,এখান থেকে লাফিয়ে মরে যেতে৷ আবেশ প্যাকটটা ধরে রেখেই বলল,

‘ ধরো!’

‘ কী আছে?’ মাধুর্য নীচু কন্ঠে বলল৷ আবেশ থমকালো আবার ৷ শীতল হয়ে উঠলো তার শরীর৷ বিজনেস ডিল হ্যান্ডেল করা যতোটা সহজ,নিজের বউকে ফুল দেওয়া যুদ্ধ করার থেকে কঠিন ঠেকলো আবেশের কাছে ৷ নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল,

‘ বললাম তো তোমার হাসি বা কান্না আছে৷’

‘ আমার চাই না৷’ মাধুর্য চোখ ঘুরিয়ে সামনে তাকিয়ে বলল৷ আবেশ ভ্রু কুঁচকে ফেললো৷ কিছুক্ষণ স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থেকে টেনে ধরলো মাধুর্যের হাত৷ ঘুরিয়ে নিলো তাকে সামনে৷
মাধুর্যের চোখে কোনো ভাবান্তর নেই৷ তবে বেশ অবাক হয়ে তাকালো আবেশের দিকে৷
আবেশের আজ কেমন যেন লাগছে৷ নিজেকে নিজের জায়গায় অগোছালো লাগছে ৷ ফুলের প্যাকট গড়িয়ে পড়ার আগে ধরলো আবেশ৷ বিনম্র চোখে তাকিয়ে রইলো মাধুর্যের শুষ্ক চোখ-মুখ সেই সাথে ঠোঁটের দিকে৷ বাতাসে কম্পয়মান আধখোলা চুল৷ দুলছে নিজ গতিতে৷ বাতাসে বেলীফুল আর রজনীগন্ধার তীব্র সৌরভ৷ আবেশের চোখে আজ নিস্তব্ধ ঘোর৷ নিজেকে কেমন হালকা লাগছে ৷ নিজের ভেতরকার অস্তিত্ব আজ খুজে পেয়েও যেন হারিয়ে ফেলছে৷
মাধুর্য অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আবেশের দিকে৷ যার শক্ত চোয়াল আজ স্বাভাবিক৷ গম্ভীর চোখে আজ মুগ্ধতা ৷
মাধুর্যকে ওইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবেশ ঝুকে এগিয়ে গেলো ৷ মাধুর্য থমকেছে তবে ক্রমেই তার হার্টবিট বেড়ে চলেছে থেকে থেকে…
আবেশ মোহাচ্ছন্ন কন্ঠে বলল,

‘ কেন প্রতারণা করেছিলে! কেন ঠকিয়েছিলে আমায়?’

চলবে…