ভেতরে বাহিরে পর্ব-১৮

0
825

#ভেতরে_বাহিরে
পর্বঃ১৮
লেখিকাঃ #রুবাইদা_হৃদি
নিশুতি রাতের আঁধার৷ চারদিকে থমথমে পরিবেশ৷ ছোট একটা শব্দ ভয়ানক ঠেকছে মাধুর্যের কাছে৷ নাজিফা শক্ত করে চেপে ধরে আছে মাধুর্যের হাত৷ ভয়ে সে কাঁপছে অনবরত৷ মাধুর্যের ভেতরের শব্দ যেন ধুপধাপ শব্দ বিমোহিত করছে তার কান৷ ভয়ে ঘেমে উঠেছে সে! ধীরপায়ে এগিয়ে যাচ্ছে ডানপাশের বড় রুম গুলোর দিকে৷ হলুদ,নীল বাতি জ্বালানো সারিবদ্ধভাবে৷ আবছা আলোয় অস্পষ্ট সব ৷ সাজানোর জন্য বিভিন্ন গাছগুলোকে কেমন নিষ্প্রাণ,বিমূঢ় লাগছে মাধুর্যের কাছে৷ কান্নার ক্ষীণ আওয়াজ এখনো আসছে৷ নাজিফা ভয়ে কেঁপে উঠে ফিসফিস করে বলল,

‘ ভাবী..আমার হাত ছাড়ো! আমি রুমে যাবো৷’

‘ নাফিজা ভয় পেয়ো না৷ নাবিহা আপুর রুমে গিয়েই ফিরে আসবো আমরা ৷ আমার মনে হচ্ছে,আপু অসুস্থ৷’

‘ আপু কাঁদবে কেন,ভাবী! আর অসুস্থ হলে মাহমুদ ভাই ফোন দিয়ে আমাদের জানাতো।ওকে দেখো না কেমন গম্ভীর থাকে৷ আমার মনে ওর কান্নার সিস্টেম অফ ৷ এইটা ভুত কাঁদছে৷ কেমন শীতল আওয়াজ৷ এমন আওয়াজ মানুষের হতে পারে না৷’

মাধুর্য থমকে দাঁড়ালো৷ নাজিফার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ আপুর সাথে কখনো মন খুলে কথা বলেছো,নাজিফা!’

নাজিফা কিছুক্ষণ ভেবে মাথা চুলকিয়ে বলল,

‘ আপু কারো সাথে কথা বলে না৷ আমাদের বাসায় কখন আসে কখন যায় আমরা কেউ বুঝতেও পারি না৷ এসেই তার রুমে ঢুকে যায় ৷ মাঝেমধ্যে তো খাবার ও খায় না৷’

‘ কেন! মাহমুদ ভাইয়া নিতে আসে না?’

‘ আগে আসতো৷ তবে আপু দরজা খুলতো না৷ তখন ভাইয়া ফিরে যেতো৷ ভাইয়া আপুকে অনেক ভালোবাসে কিন্তু আমার আপু ভাইয়াকে একদম ভালোবাসে না৷’

নাজিফার কথায় চুপ করে রইলো মাধুর্য৷ তিন ভাইবোনের মধ্যে নাবিহা আপু সবার বড়৷ আগে তো চঞ্চল ছিলো৷ হাসি-খুশি ছিলো! কেন কাঁদবে সে।
আবারো কান্নার আওয়াজ নাজিফা ছুটে পালাতে চাইলে মাধুর্য আকড়ে ধরে অনুনয়ের সুরে বলল,

‘ প্লিজ! আমার সাথে চলো৷’

‘ ওকে! আমি আপুর রুমের বাইরে পর্যন্ত যাবো তারপর উল্টো দৌড় দিবো৷ আমার হার্ট কতো জোরে বিট করছে সেটা তোমার ধারণার বাইরে ভাবী৷ মনে হচ্ছে,পেছন থেকে ভুত এসে মেরে দিবে৷’

মাধুর্য কথা বাড়ালো না৷ এগিয়ে গেলো নাবিহার রুমের দিকে৷ যতো রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কান্নার আওয়াজ স্পষ্ট হচ্ছে৷ মাধুর্য ভাবছে,যে মানুষটা নিজেকে এতো গম্ভীর আর স্ট্রিক্ট দেখায় সে কেন কাঁদবে! আর মাহমুদ নিজেও নাবিহাকে প্রচন্ড ভালোবাসে যেটা মাধুর্য নিজ চোখে দেখেছে৷ বাড়ির সবার সাথে নাবিহার সম্পর্ক নেই বললেই চলে! বাড়ির বড় মেয়ে আসবে আর তার কেউ খোজ নেয় না! এইটা অদ্ভুত লাগলো মাধুর্যের ৷
দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করা৷ মাধুর্য কান পাতলো দরজায়। নাজিফাও মাধুর্যের দেখাদেখি কান পেতে চুপ করে রইলো ৷ মাধুর্য ঠিক আঁচ করেছে! নাবিহা কাঁদছে৷ খুব করুন স্বরে কাঁদছে৷

‘ ভাবী আপু কাঁদ..’ নাজিফা বলার আগেই মাধুর্য তার মুখে হাত দিয়ে চুপ থাকতে বলল৷ নাবিহা কান্নার সুরে কিছু একটা বলছে৷ মাধুর্য আবারো শোনার চেষ্টা করলো নাবিহা কী বলছে! নাবিহা কান্নার সুর সেই সাথে অস্পষ্ট ভাবে ভেসে এলো,

‘ আল্লাহ! আমার কী অপরাধ বলো? কেন আমায় এতোবড় শাস্তি দিলে ৷ মাহমুদকে আমি কোনোভাবেই কষ্ট দিতে চাই না! কিন্তু ও আমাকে কেন ছেড়ে দেয় না৷ কেন ও ওর বাবা-মায়ের কাছে চলে যাচ্ছে না৷ ও জানে আমি কখনো ‘ মা ‘ হতে পারবো না কখনো তাকে পিতৃত্বের অনুভূতি জাগানোর জন্য ছোট একটা প্রাণ দিতে পারবো না৷ তবুও,সে বুঝতে চায় না কেন! আমার সব থেকেও যে নেই,আল্লাহ৷ আমি সমাজের চোখে বন্ধ্যা নারী৷ আমি প্রতিনিয়ত তোমার দরবারে হাত তুলে কাঁদি তোমার মনে আমার জন্য করুনা হয় না,আল্লাহ? হয় আমাকে মেরে ফেলো নয়তো মাহমুদের জন্য এমন কাউকে পাঠাও যে তাকে সন্তান দিতে পারবে৷ নারী মানেই যে কারো মা,কারো বোন বা কারো স্ত্রী৷ সেই মা হওয়ার ক্ষমতা না থাকলে তাকে যে সবার কাছে হেয় হতে হয়৷ মাহমুদ আমার জন্য তার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন৷ আমার জন্য আমার আম্মা সমাজে মুখ দেখাতে পারে না৷ আমি বাঁচতে চাই না আল্লাহ! নারী মানে শুধুই কী সন্তান জন্ম দেওয়ার একটা মাধ্যম? আমাকে নিয়ে কেন সবাই হাসাহাসি করে কেন অপমান করে! দিনের আলোয় আমি থাকলেও রাতের আঁধার যে আমার অক্ষমতা মনে করিয়ে দে…’

নাবিহার করুন কন্ঠের বলা অস্পষ্ট কথা শুলো শুনে মাধুর্য আর নাজিফা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ নাজিফা কাঁদছে! তারমানে তার আপু কাঁদতো এইসব কষ্ট লুকিয়ে৷ সে বোন হয়ে তাকে ভয় পেয়ে গেছে৷ কখনো তার ভেতরে কষ্ট দেখতে চেষ্টা করে নি! বাইরে থেকে এতো স্ট্রিক্ট মানুষটাকে দেখে কখনো তার মাথায় আসে নি তার আপু ভেতরে গুমরে মরছে৷ তাকে মানুষ পিষে ফেলছে সমাজের নিয়ম দেখিয়ে৷

‘ আপু কেন মা হতে পারবে না,নাজিফা?’

মাধুর্য কান্নাভেজা গলায় প্রশ্ন করলো৷ নাজিফা মুখে হাত দিয়ে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করে বলল,

‘ জানি না ভাবী! তবে আপু হাসিখুশি ছিলো জানো? হঠাৎ করে একদিন হসপিটাল থেকে আসার পর নিজেকে গুটিয়ে নেয়৷ মাহমুদ ভাইয়ার মা আপুকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়৷ তখন আমি খুব ছোট৷ তবে মাহমুদ ভাই তাদের ছেড়ে আপুকে নিয়ে অন্য জায়গায় বাসা নেয়৷ আমি এতোটুকু জানি৷ এরপর থেকে আপু কেমন হয়ে যায়৷’

মাধুর্য অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে আছে দরজার দিকে৷ এর ভেতরে গুমরে মরছে এক নারী৷ মাধুর্য দরজায় হাত দিতে চেয়েও থমকে যায় ৷ নাজিফা আপ্লূত হয়ে ভেতরে যেতে চাইলে মাধুর্য বলল,

‘ আপুকে একা থাকতে দাও নাজিফা৷ হুট করে আমাদের দেখলে রাগ করতে পারেন৷ সে রাতের আঁধার বেছে নিয়েছে তার কষ্ট লুকাতে৷ আমরা যদি লুকায়িত জিনিস দেখে নেই তাহলে সে অপ্রস্তুত হয়ে যাবে৷’

নাজিফা কথা বাড়ালো না৷ সে ফুঁপিয়ে কাঁদছে৷ তার খুব করে মনে আছে,একদিন তারা বাইরে গেলে এক মহিলা তার আপুকে অনেক কিছু বলছিলো৷ বারবার বলছিলো,’তুমি অপবিত্র৷ মাহমুদকে ছেড়ে যাও না কেন৷’
সে তখন অতশত না বুঝে নাবিহার দিকে তাকিয়ে দেখেছিলো নাবিহা টলমল চোখে কান্না লুকানোর চেষ্টা করছে৷
সে ছোট বলে কিছু জানার চেষ্টা করে নি৷ দিনের পর দিন তার আপু কেঁদেছে এই বদ্ধ রুমে সে বুঝে নি৷ এইজন্যই তো তার আম্মা আর ভাইয়েরা চুপ থেকে কথা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে৷ হয়তো নাবিহাকে ভালো রাখার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা৷

___________

প্রত্যুষের আলো ছুঁয়েছে ধরণী ৷ সোনালি আভা ফুঁটে উঠেছে নীলাভ শূন্যে৷ বৃষ্টির পর হিমশীতল বাতাসে গাছের পাতাগুলো ঝরঝর শব্দ তুলছে৷ ক্ষীণ আওয়াজে একটা পাখি ডাকছে ৷ কিচকিচ শব্দ ঘুরেফিরে ফিরে আসছে বারেবারে ৷ সকালের শুভ্র প্রহরের রেশ সদ্য ঘুমানো মাধুর্যের চোখেমুখে কোমল ভাবে উষ্ণতার ছোঁয়া দিচ্ছে ৷ কেঁপে ওঠা বিশাল পর্দাটার দাপট ছড়াচ্ছে ঘরের মাঝে৷ মাধুর্যের ঘুমের মাঝেই মনে হচ্ছে তাকে কেউ দেখছে৷ খুব গভীর ভাবে৷
কাল রাতে নাবিহার রুমের বাইরে থেকে ফেরার পর ঘুমের বিন্দুমাত্র রেশ তার চোখে ধরা দেয় নি৷ নাজিফা কাঁদতে কাঁদতে কিছুক্ষণ বাদেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলো ৷ এর পরেও কান্নার আওয়াজে মাধুর্য কেঁদেছে৷ ছুটে যেতে চেয়েছে নাবিহার কাছে৷ তবে রুমের বাইরে থেকে বারেবারে ফেরত এসেছে ৷ সবাই যখন ঘুমে মগ্ন থাকে নাবিহা নিজের কষ্ট তখন বিসর্জন দেয় ৷ হয়তো কাওকে দেখাতে চায় না বলেই! নানা কিছু ভেবে ভোরের আলো ফোঁটার সাথে সাথেই ঘুম ধরা দিয়েছেলিণমাধুর্যের চোখে৷ বিছানার সাথে হেলান দিয়েই বসে ঘুমোচ্ছে সে ৷ তবে ঘুমের মাঝেই তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবে তার মস্তিষ্কে জানান দিচ্ছে,

‘ তোমায় কেউ দেখছে! তোমার দিকে সে তাকিয়ে আছে৷’

ঘুম ছুটে গেলো মাধুর্যের৷ পশ্চিমা জানালা দিয়ে শুভ্র রাশি ছুঁয়েছে তার মুখে৷ পিটপিট চোখে তাকালো সে৷ ঘুম চোখেই সামনে তাকিয়ে খুজলো কাওকে৷ কাওকে না দেখে আবারো চোখ বোজতেই সামনে থেকে ভেসে এলো,

‘ আমার ঘুম কেঁড়ে নিয়ে কেন ঘুমাচ্ছো,তুমি!’

ক্লান্ত কন্ঠস্বর।যেন হাজার টনেক ক্লান্তি ভর করে আছে কন্ঠে। কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির কন্ঠস্বরে হুড়মুড় করে উঠে বসলো মাধুর্য। ঠিক সামনেই সোফার বসে সামনে রাখা ছোট টেবিলের উপর পা দিয়ে কঁপালে হাত ঠেকিয়ে বসে আছে আবেশ। গায়ে তার ধূসর রঙের শার্ট।চুল গুলো অগোছালো হয়ে ছেয়ে আছে কপালে।চোখ লাল হয়ে আছে। মাধুর্য আবেশকে দেখে চোখ হাত দিয়ে মুছে আবার তাকালো। হ্যাঁ! এখন ঠিক দেখছে। আবেশ সত্যি’ই এসেছে।
তবে মাধুর্য মুখ ঘুরিয়ে বালিশ টেনে শুতে গেলেই আবেশ ক্লান্ত গলায় বলল,

‘ তুমি আমাকে উপেক্ষা করছো,মাধুর্য!’

‘ কাওকে উপেক্ষা করার শক্তি আমার নেই।আমার ঘুম পাচ্ছে আমি ঘুমাবো!’ মাধুর্য কাট কাট গলায় জবাব দিলো।আবেশ সোজা হয়ে বসে টাইয়ের নব ঢিলে করে বলল,

‘ এইযে এখনো তো করছো! আচ্ছা সমস্যা নেই,আগে বলো মেডিসিন নিয়েছো? খেয়েছো? ঘুমিয়েছো ঠিক মতো?’

‘ আস্তেধীরে এক এক করে বলুন। আমি যন্ত্র নয় যে সব উত্তর একবারে দিবো।’

মাধুর্যের কথায় থম মেরে রইলো আবেশ। তার গলায় তেজ।কেমন পরিবর্তন। আবেশ বেশ খুশি হলো মাধুর্যের পরিবর্তন দেখে। নিজের চুল গুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,

‘ কাল থেকে আমি ছিলাম না,মিস করো নি আমাকে?’

আবেশের এহেন কথায় মাধুর্য ভড়কে গেলো। শোয়া থেকে উঠে বসে এদিকওদিক তাকালো। আবেশ হুট করে এমন একটা প্রশ্ন করবে সে ভাবতেই পারে নি।
মাধুর্যের অস্থিরতা দেখে মৃদু হাসলো আবেশ। সাথে সাথে হাসি আড়াল করে উঠে দাঁড়ালো। ধীরপায়ে মাধুর্যের দিকে এগিয়ে গিয়ে পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ আই নো ইউ মিস মি!’

‘ কে বলেছে আপনাকে?’ মাধুর্য অন্যদিকে তাকিয়ে বলল। আবেশ আরো এগিয়ে গেলো মাধুর্যের দিকে। পাশে নাজিফা্র দিকে তাকিয়ে স্বস্তি নিয়ে দুইহাত রাখলো মাধুর্যের দুইপাশে। তার আর মাধুর্যের মাঝামাঝি দূরত্ব কয়েক ইঞ্চির। মাধুর্য ভড়কে গেছে। পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে বুঝতে পারলো তার পেছনে জায়গা নেই!
ভয়ে মুখ ছোট করে কাঁপা কন্ঠে বলল,

‘ স.সরুন..কী করছেন! সামনে থেকে সরে দাঁড়ান।’

‘ ইউ মিস মি!’

‘ ন..না! আমি কাওকে মিস করি না। আমার সামনে থেকে সরুন আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।’

আবেশ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মাধুর্য তাকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করছে। তবে সে হাল না ছেড়ে মাধুর্যের থুতনিতে হাত দিয়ে তার মুখ তার দিকে ঘুরিয়ে বলল,

‘ দশটার দিকে রেডি হয়ে থাকবে।তোমার জীবনের চলার পথে সব বাধা মুক্ত পাবে।বিশাল বড় একটা সারপ্রাইজ দিবে তোমায় তোমার সেই আবেশ যাকে তুমি ভয় পাও না,ঘৃণা করো না,একরাশ বিশ্বাস করো।’

চলবে….