ভেতরে বাহিরে পর্ব-৩২+৩৩

0
767

#ভেতরে_বাহিরে
পর্বঃ৩২
লেখিকাঃ #রুবাইদা_হৃদি

শুভ্র কুয়াশার চাঁদরে আচ্ছাদিত প্রকৃতি৷ আকাশের কালো রঙের মাঝে সাদা ধবধবে বিশাল চাঁদর দল বেয়ে নেমে এলো ধরণীর বুকে ৷ মৃদু হাওয়ার তালে দোল খাচ্ছে ঝুলানো আর্টিফিশিয়াল ফুল গুলো৷ মাধুর্য নির্বাকচিত্তে দাঁড়িয়ে আছে নাবিহার কথা শুনে৷ অবাকের রেশ তখনো তার কাটে নি৷ নাহিবা তাকে তাড়া দিয়ে বলল,

‘ ভাবী..জলদি করো৷’

‘ না..না নাবিহা তুমি ফাজলামো করছো৷’

‘ আরে বাবা! তিন সত্যি৷ আজ তোমার আর ভাইয়ার হলুদ,কাল বিয়ে আর বাসর তারপর রিসেপশন৷ নাবিহা বলে কিছুটা দম নিয়ে জিহবা কাটলো৷ মাধুর্য বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে তার দিকে ৷
এর মাঝেই ইরা রুমে ঢুকে তাড়া দিয়ে বলল,

‘ কী’রে নাবু,তোকে সেই কখন পাঠিয়েছি মাধুর্যকে নিয়ে নীচে নামার জন্য৷ ওইদিকে সব গেস্ট এসে পরেছে৷’

ইরার কথা শুনে ভাবশূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নির্বাক হয়ে৷ সব যেন ঘোলাটে৷

_______
আকস্মিক হাওয়ার তোড়ে বৃক্ষরাজি মাথা নোয়াচ্ছে৷ শীতের শুভ্র প্রহর মুক্তোর ন্যায় ঝড়ছে৷ কেঁপে উঠা ঠোঁট আর গায়ে থাকা চাদর টেনে মাহমুদ ধীরপায়ে ব্যাক ইয়ার্ডে এগিয়ে যাচ্ছে৷ হাতে ধোঁয়া উঠা কফির মগ৷
ঝিরিঝিরি বাতাস প্রবাহিত প্রকৃতিতে৷ সামনে থাকা সেগুনবাগিচা যেন দানবীয় বৃক্ষ দুঃখের সুর তুলছে৷ তাদের মন ভালো নেই৷ কথাটি আওড়াতেই নাজিফার দুচোখ বেয়ে অশ্রুবিন্দু টুপ করে ঝড়ে পড়লো৷ মাহমুদ অতি সপ্তপর্ণে কফির মগটা পাশে নামিয়ে শ্লেষাত্মক কন্ঠে বলল, ‘ তার মন ভালো নেই৷’
নাজিফা কয়েকদফা কেঁপে উঠে দমিয়ে রাখা কান্না গুলো বহিঃপ্রকাশ করতেই মাহমুদ নরম হাতে চোখ মুছিয়ে দিয়ে আদুরে গলায় বলল,

‘ শোনো নাজিফা,দিন দুনিয়া রসাতলে যাক আমার জীবনে তুমি’ই প্রথম তুমি’ই শেষ৷’

নাজিফা চোখ বোজে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো৷ এই মানুষটার ভালোবাসার ঋণ সে শোধ দিতে পারবে না৷ মাহমুদের বুকের বাঁ পাশে মাথা ঠেকিয়ে অম্লান কন্ঠে বলল,

‘ আমি মা ডাক শুনতে চাই মাহমুদ৷’

মাহমুদ লম্বা শ্বাস টেনে বলল, ‘ পিতামাতা হীন সন্তানের মা হবে নাজিফা? তাদের কোনো একজনকে আমরা সুন্দর ভবিষ্যৎ উপহার দিয়ে একটু সুখ খুজে নেই,কী বলো?’

নাজিফা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে রইলো৷ সে জানে কলুষিত উচ্চাকাঙ্খী সমাজে পালিত সন্তানের অবহেলা কতোটা ভয়াবহ৷ কারণ সে নিজেও তথাকথিত পালিত সন্তান মাহফুজা আর নজরুলের৷ তবে তার ছোটবেলা জঘন্য হলেও তার ঘরে যে আসবে তাকে সে আগলে রাখবে,ভালোবাসবে৷ একটু না’হয় অসামাজিক হবে সমাজের প্রতি৷ তাতে ক্ষতি কী! ক্ষতি নেই বরং ভালোভাবে বেঁচে থাকা যাবে ৷

____

সুগন্ধী রজনীগন্ধার সৌরভে মাতোয়ারা হয়ে আছে সর্বকোনাচে। আবেশ সাদা আর হলুদ মিশ্রিত পাঞ্জাবি পরে বাগানের ঠিক মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। আর নির্বাকচিত্তে হাত ঘড়ি দেখে কপাল কুঁচকে ফেলছে। সুঠাম দেহে আঁটসাঁট পাঞ্জাবিতে তাকে সুপুরুষের কাতারে অনায়াসে ফেলা যায়। শ্যাম বর্ণ কপালে ছেয়ে আছে কয়েকটা চুল। বক্র দৃষ্টি যেন ঘায়েল করার ক্ষমতা রাখে। বিরক্ত রেশে চেয়ে পরিবর্তন মুখমণ্ডল যেন আরো আকর্ষণীয়। গম্ভীর মুখমণ্ডল হ্ঠাৎ করেই নম্রতা ঘিরে ধরলো। চোখে উঁপচে পড়ছে খুশির রেশ । চিকচিক করছে সেই দৃষ্টি। অবশেষে অপেক্ষার অবসান।
নাবিহা গাড়ি থেকে নেমেই শাড়ি গুছিয়ে নিলো সযত্নে। কয়েকগোছা চুল কানের পিঠে গুজে দিয়ে হাসিমুখে বলল,

‘ সামনে তোমার রাজকুমার দাঁড়িয়ে আছে,ভাবী।’

নাবিহার কথার সুর যেন হু হু করে মাধুর্যের কম্পনের মাত্রা তীব্র হারে বাড়িয়ে দিলো। অর্ধেক খোলা জানালা দিয়ে মুখ উঁচিয়ে সামনে তাকালো সে। ফোন হাতে আবেশ জানালার দিকেই তাকিয়ে আছে। মাধুর্য সাথে সাথেই দৃষ্টি নামিয়ে মৃদু হেসে উঠলো। বিড়বিড় করে বলল,

‘ মাধুর্য এবার হয়তো তোর সমস্ত দুঃখ সুখ পাখি হবে।’

‘ ভাবী দ্রুত নামো।’ মাধুর্যের ভাবনার মাঝেই নাবিহা দ্রুত ভাবে বলল।

মাধুর্যের মুখের ভাষারা আজ নির্বাসন গিয়েছে। তার শুধু মনে হচ্ছে সব স্বপ্ন। এই বুঝি চোখ খুললে স্বপ্নরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে।
দুরুদুরু মনের কোঠা।সব যেন ঘুমন্ত রাজ্যের স্বপ্ন। আবেশ ইতিমধ্যে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। নাবিহাকে দেখে নাকমুখ কুঁচকে বলল,

‘ এমন ভুত সেজেছিস কেনো।’

‘ ছোট ভাইয়া ! তুমি সব সময় এমন করো।’ নাবিহা গাল ফুলিয়ে বলতেই আবেশ তার মাথায় গাট্টা মেরে বলল,

‘ ভাগ এখান থেকে।’

নাবিহা মুখে দুষ্টুমির হাসি টেনে বাঁ ভ্রু উঁচিয়ে কিছু একটা বলতে নিলেই আবেশ দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,

‘ উল্টাপাল্টা কোনো কথা না। ডিরেক্ট বাসার ভেতর ঢুকে যাবি।’

আবেশের হুমকি কর্ণকুহরে পৌঁছুতেই নাবিহা লেহেঙ্গা হাতের মুঠোয় ধরে বাসার ভেতরের দিকে অগ্রসর হয়।
আবেশ বিনাবাক্যে গাড়ির কাঁচে মৃদু টোকা দিয়ে মাথা সামনের দিকে নত করে সুমিষ্ট কন্ঠে বলল,’ আমার সাম্রাজ্যে নতুন নিয়মে,নতুন রুপে স্বাগতম আমার রাণী।’
আবেশের কন্ঠ যেন শিরশিরে অনুভূতিতে গ্রাস করে নেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা রাখে। মাধুর্য জমে আছে মূর্তির ন্যায়। এক হাতের তালুতে আরেক হাতের তালু ঘষছে অনবরত। ঠোঁট কেঁপে উঠছে বারেবারে। সে স্থবির হয়ে গাড়ির সিটে ঠাই বসে রইলো। আবেশ বুকের বাঁ পাশে হাত দিয়ে মৃদু হাঁসছে।
চারদিকে আলোকচ্ছটার ছড়াছড়ি। বাগানে মানুষের সমাগমে মুখরিত। তবুও মাধুর্যের মনে হচ্ছে, সব থমকে গেছে। সে শুকনো ঢোক গিলে মাথা কিছুটা উঁচু করতেই আবেশের মুখোমুখি হলো। ইতিমধ্যে আবেশ গাড়ির দরজা খুলে কখন যে তার সামনে মুখ বাড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে খেয়াল করে নি।
তার হৃৎপিন্ড ক্রমাগত দ্রিমদ্রিম আওয়াজ তুলছে। ওষ্ঠদ্বয় কম্পয়মান মাধুর্যের। কন্ঠনালী দিয়ে মৃদু আওয়াজ তুলে বলল,

‘ বা…বাসায় যাবো।’

‘ আগে তোমাকে দেখবো।’ আবেশ স্বভাবসুলভ হেসে বলল। মাধুর্য পিটপিট চোখে তাকিয়ে লজ্জায় আবৃত হয়ে ঠায় বসে রইলো। আবেশ মুগ্ধ চোখে দৃষ্টি বোলাচ্ছে তার প্রেয়সীর স্নিগ্ধ মুখমণ্ডলে। কাঁচা হলুদ শাড়িতে অপরুপা লাগছে তার মাধবীলতাকে।
মাধুর্যের কপালে ছড়িয়ে থাকা চুল গুলো সরিয়ে দিয়ে আলতো ভাবে ঠোঁটের পরশ দিতেই মাধুর্যের চোখ বেয়ে নোনাপানি টুপ করে ঝড়ে পড়ে। এযেন অনাবৃত সুখ !
আবেশ তার গালে হাত রেখে রাশভারী গলায় বলল,

‘ সুখ তোমার হোক।আমি দায়িত্ব নিলাম আমার সুখ তোমায় যেন মুড়িয়ে রাখে। সমস্ত কালো অধ্যায়ের সৃতি দিনের আলোর ন্যায় প্রস্ফুটিত হয়ে পিষে যাক অতল গহব্বরে।’

আবেশের কথা অনুভব করার পূর্বেই বাড়ির ভেতর থেকে ডাক আসে ভেতরে যাওয়ার। আবেশ সপ্তপর্ণে মাধুর্যের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে এগিয়ে গেলো ভেতরে। আজ মাধুর্যের চারদিকে কেমন সুখ সুখ অনুভূত হচ্ছে। এই বুঝি সব বলল,’ মাধুর্য তোর সুখ তো উঠানে। পা বাড়িয়ে কুড়িয়ে নেওয়ার সময় এসেছে যে।’

___

নতুন রঙ,নতুন দিন,সুখেরা আজ নীড়
ভালোবাসি..ভালোবাসি সখী

‘এরপর কী? ‘ মাধুর্য হুট করেই প্রশ্ন করে বসলো৷ আবেশের মুখভঙ্গি দেখার মতো৷ সে নিজ মনে ছন্দ প্রস্তুতে ব্যস্ত ছিলো ৷ তবে মাধুর্য মাঝে থেকে প্রশ্ন করে সব ছন্দ গুলিয়ে দিয়েছে৷
মাধুর্যের উৎসাহ আকাশসম৷ সে পিটপিট চোখ করে অবলোকন করছে আবেশের কাটা কাটা চেহারা,কপালের ভাজ৷

প্রায় দীর্ঘসময় তারা হলুদের অনুষ্ঠান থেকে মুক্তি পেয়ে খোলা আকাশের নীচে তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে একাকী ৷ এই সুযোগ ফয়েজ নিজে করে দিয়েছে৷ এইজন্য আবেশ পারলে ফয়েজকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে নেয়৷
ইদানীং তার কিশোর হতে ইচ্ছা হয়৷ যে বয়সের প্রেমে মাদকতা আছে,আছে সুদূর খামখেয়ালি চিন্তা৷ আর অঢেল ভালোবাসা সাথে প্রেয়সীকে আগলে রাখার হাজারো বাহানা ৷ যেইসব দিন যেন মধুর৷ এখন দায়িত্বের সাথে ভালোবাসা৷ যা রক্ষা করা বড্ড কঠিন৷
আবেশকে চুপ থাকতে দেখে মাধুর্য ভড়কে গেলো৷ কম্পয়মান সরু কন্ঠে বলল,’ আপনি রাগ করেছেন?’
মাধুর্যের স্বর আবেশের কর্ণগোচর হতেই সে বিনাবাক্য মাধুর্যের কপালে নিজের অধর ছুঁয়ে গাঢ় চুম্বন এ লিপ্ত হয়৷ মাধুর্য নির্বাক,হতভম্ব৷ তার হৃদয় থমকে আছে৷
আবেশ ততোক্ষণে কিছুটা দূরত্ব রেখে সরে দাঁড়িয়েছে৷ মাধুর্যের অধরে স্মিত হাসি ৷ এ হাসি যেন প্রাণনাশের ৷ এ হাসি যেন সুখের৷ তবে বুঝি সুখেরা নীড়ে ফিরলো?

চলবে….

#ভেতরে_বাহিরে
পর্ব:৩৩
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি

শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে

তোমারি সুরটি আমার মুখের ‘পরে, বুকের ‘পরে ॥

পুরবের আলোর সাথে পড়ুক প্রাতে দুই নয়ানে–

নিশীথের অন্ধকারে গভীর ধারে পড়ুক প্রাণে।

নিশিদিন এই জীবনের সুখের ‘পরে দুখের ‘পরে

শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে…

রক্তিম বিকেলের কুয়াশা আচ্ছাদিত নম্র রোদ লাল শাড়ি পরিহিতা রমণীর সৌন্দর্য যেন দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সদ্য ঘুম ভাঙ্গা চোখে আধো জাগ্রত অবস্থায় এলোমেলো পা ফেলে আবেশ এগিয়ে গেলো তার প্রেয়সীর দিকে।
মাধুর্য তখনো সামনের দিকে ফিরে আছে দু-চোখ বন্ধ করে। নিজস্বতায় ঘিরে ধরেছে গ্রাম্য প্রকৃতি। এ যেন অনাবিল সুখের সাম্রাজ্য।
যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকেই সবুজের ছোঁয়া।
আবেশ মাধুর্যের কোমর স্পর্শ করতেই খানিক কম্পয়মান হয় মাধুর্যের সমস্ত ইন্দ্রিয় । আবেশ তাকে আলগা বাধনে নিজের সাথে আঁকড়ে ধরে ঘুম কন্ঠে বলল,

‘ মিষ্টতা তোমারি মতো কন্ঠের উচ্চারিত প্রত্যেকটা গানের লাইন।’

মাধুর্যের অধরে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা ফুঁটে উঠলো। এইতো গত দুইমাস আগেই আবারো বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলো তারা। এর মাঝে সবকিছু রঙ্গিন ফানুসের মত উড়ে গেছে সময় অতীতেত পাতায়। অবশ্য তার জীবনের সেরা দু’টি মাস সে কাটিয়েছে। আবেশের সাম্রাজ্য ঘিরে মাধবীলতার বসবাস। মাধুর্য হাসির রেখা টেনেই বলল,

‘ আজ বাইরে যাবেন না ?’

‘ রেডি হয়ে নাও।’

‘ কেন !’ মাধুর্য প্রশ্নসূচক চোখে ঘুরে তাকিয়ে বলল। আবেশ কিছু না বলে মাধুর্যকে তার হাতের বাঁধন থেকে মুক্ত করে দিয়ে বলল,

‘ আজকে আরেকটা স্পেশাল দিন হতে চলে তোমার জন্য ।’

‘ আজ তো কোনো স্পেশাল ডেট নেই।’

‘ আমার রাণী যে বোকা সেটা জানতাম তবে এতোটা বোকা এইটা তো জানতাম না।’

আবেশের এহেন কথায় ফুঁসে উঠে মাধুর্য । রোষানল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আবেশের দিকে । আবেশ ভয় পাবার অভিনয় করে বলল,

‘ চোখের দৃষ্টিতে ঝলসে দিবে তো। তখন এই ঝলসানো ব্যক্তিকে তোমার মনে ধরবে,বুঝি !’

আবেশের কথা শুনে দৃষ্টি শিথিল করে মাধুর্য । নিজের কার্যে লজ্জা পেয়ে মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল,

‘ আজকে কী জন্য স্পেশাল?’

‘ মেডিকেলের রেজাল্ট দিবে আজ। সেটা ভুলে গেলে?’

আবেশের কথা শুনে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে মাধুর্য । আসলেই ! আজ রেজাল্ট বেরুবে। সে কী করে ভুলে গেলো!
ইতিমধ্যে তার হাঁত-পা কাঁপছে। বাসার সবার আশা না রাখতে পারলে কী হবে ভাবতেই শীতল হয়ে আসছে তার হৃৎপিন্ড ।
মাধুর্যের এহেন অবস্থা দেখে আবেশ হাসিমুখে বলল,

‘ টপ টুয়েন্টি তে আমার বউ থাকবে। তবে সে কেন অস্থির হয়ে আছে?’

‘ আমার ভয় হচ্ছে আবেশ।’

আবেশ মাধুর্যের কথায় কোনো উত্তার দিলো না । সে জানে মাধুর্যের রেজাল্ট। একটু আগেই তার ফোনে মেসেজ এসেছে । এবং সে বাসার সবাইকে মেসেজের মাধ্যমেই খবর টা দিয়ে মাধুর্যের জন্য সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছে ।

ঘন্টা দুই বাদে মাধুর্য ধীরপায়ে সিড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তার বুক ঢিপঢিপ করছে । হয়তো সে ফেইল করেছে । বা তার রেজাল্ট আসেই নি। উদ্ভট সব চিন্তা করতে করতে সিড়ি দিয়ে আনমনে নামছে সে । নীচে নামতেই মাহফুজা তাকে জড়িয়ে ধরে উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,

‘ আমার নবাগত ডাক্তার মেয়ে। গর্বে আমার বুক ফুলে উঠছে মাধু। এতোখুশি দেওয়ার জন্য তোর কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’

মাধুর্য বুঝতে না পেরে আবেশের দিকে তাকালো। আবেশ বড় একটা কাগজ উঁচিয়ে দেখালো। সেখানে স্পষ্ট ভাবে লেখা,

‘ তুমি পেরেছো।’

মাধুর্যের চোখে পানি। বাকি সবাই তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। খুশি গুলো জাপটে ধরে আছে যেন। সবার হাসিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে আরেকটা বেদনাদায়ক কথা মনের কোণে জানান দিলো,
এই মানুষ গুলোকে ছেড়ে অচেনা শহরে,অচেনা ভীড়ে হারাতে হবে।
____________

সিলেট ছেড়ে সবাইকে রেখে একদম যেতে ইচ্ছা করছে না মাধুর্যের৷ কেমন শূন্যতা বিরাজ করছে তার মাঝে৷ আনমনে সব প্যাকেজ করছে সে৷ ঢাকার মেডিকেল কলেজে চান্স পাওয়াটা নিঃসন্দেহে তার কাছে দিবাস্বপ্ন মনে হচ্ছে৷ আদেও কী সে এতোটা সুখ পাবার যোগ্য?
ইদানীং সব সুখ যেন উঁপচে তার কাছে পড়ছে৷ বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো তার৷

‘ ভাবী ঢাকা গিয়ে নতুনদের ভীড়ে আমায় কিন্তু ভুলে যে-ও না৷’ নাজিফা মন খারাপ করে বলল৷ মাধুর্যের মন আরো বিষিয়ে উঠলো৷ সে কী করে থাকবে তার আম্মু’মা কে ছেড়ে,বান্ধবীর মতো নাজিফাকে ছেড়ে৷ সাথে ইরার মতো বড় বোন আর ফয়েজের মতো বড় ভাইকে ছেড়ে৷ সবথেকে বড় কথা আবেশকে ছেড়ে গত দুই মাস সে একফোঁটাও থাকে নি ৷ আবেশ তার অভ্যাস৷ অভ্যাস কী-করে ত্যাগ করবে সে?
এইসব ভেবে চোখের কোণা বেয়ে অশ্রুবিন্দু টুপ করে ঝড়ে পরতেই নাজিফা মাধুর্যকে জাপটে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে৷ মাধুর্য নাজিফার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

‘ নাজু বুড়ি তোমার ছোট ভাইয়াকে বলে দিয়ো,আমি চলে যাচ্ছি বলে সে যেন কিন্তু আমায় ভুলে না যায়৷’

নাবিহা মাধুর্যের কথায় হেসে উঠলো৷ মাধুর্য নিজের কথায় নিজেই লজ্জা পেয়ে মিইয়ে যায়৷ তবুও দমে না গিয়ে মুখ ফুলিয়ে বলল,

‘ তাকে বলে দিয়ো,তাকে ছাড়া থাকতে আমার বড্ড কষ্ট হবে৷ সাথে বাসার সবাইকে ছেড়ে৷’

‘ নাজু তাকেও বলে দিয়ো কষ্ট হলেও থাকতে হবে৷ আমি ডাক্তার মিসের মাধুর্য এহসানকে দেখতে চাই৷’

আবেশ রুমে ঢুকে নির্লিপ্ত গলায় বলল পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে৷ মাধুর্য নাজিফাকে ছেড়ে মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে রইলো৷ আবেশের ও বড্ড কষ্ট হচ্ছে৷ তবুও তার মুখে কাঠিন্যে ভাব বজায় রেখে বলল,

‘ গোছানো শেষ তোমার? দ্রুত রেডি হয়ে আসো৷ লেট হয়ে যাচ্ছে৷’

‘ দেখলে নাজিফা কেউ একজন চায় আমি যেন দ্রুত বাসা থেকে দূরে চলে যাই৷’ মাধুর্য কান্না আটকিয়ে বলল৷ আবেশ ইদানীং কেমন কঠোর হয়ে উঠেছে৷ সে চলে যাচ্ছে তবুও তার কষ্ট হচ্ছে না,বুঝি?
মাধুর্য মুখ বুজে দাঁড়িয়ে রইলো৷ আবেশ ঘুরে দাঁড়ালো৷ তার চোখ জ্বলছে৷ তবুও গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হয়৷ এখন তুমি আমাদের সাথে যে সময় গুলা কাটাতে সেই সময় গুলা হারাচ্ছো৷ তবে এই হারানো গুলোই একসময়ের সাফল্য হবে তোমার৷’

‘ আমার তো সাফল্য চাই না…’

‘ সেটা তোমার চাইতে হবে মাধুর্য৷ টিকে থাকতে হলে চাইতেই হবে৷’

আবেশের কথার মানে বুঝতে না পেরে মাধুর্য স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো৷ নাজিফা মাধুর্যকে ধরে রেখেই ভাঙা গলায় বলল,

‘ যখুনি বন্ধ পাবে আমাকে ফোন দিবে আমি তোমাকে গিয়ে নিয়ে আসবো৷ কারো বারণ শুনবো না৷’

মাধুর্য নির্লিপ্ততা নিয়ে বলল,

‘ আচ্ছা৷’

নাজিফা আর কিছু না বলেই রুম থেকে চলে যেতেই আবেশ মাধুর্যের হাত ধরতেই মাধুর্য রাগ দেখিয়ে হাত টেনে সরিয়ে নেয়৷ আবেশ নিজের কাজে অনড়৷ সে আবারো মাধুর্যকে টেনে নিয়ে তার সাথে মিশিয়ে মাধুর্যের কনিষ্ঠ আঙুল টেনে ধরে বলল,

‘ আমার রাজ্যজুড়ে আপনার বসবাস মাধবীলতা৷ আপনাকে ভুলে যাওয়া মানে আমার অস্তিত্ব ভুলে যাওয়া৷ আমার সর্বাংশে তে আপনি বিরাজমান৷ যার কোনো ভুল নেই৷’

আবেশের নির্বিঘ্নে বলা প্রত্যেকটা কথা মাধুর্যের কান্নার গতি বাড়িয়ে দিলো৷ আবেশ ঝুঁকে মাধুর্যের মাথায় চুমু খেয়ে আবার বলল,

‘ আপনাকে আমি বড্ড ভালোবাসি মাধবীলতা৷ আমার কাছে,আমার ঘরে দ্রুত ফিরে আসবেন ইন-শাহ্-আল্লাহ৷ তবে ডাক্তার হয়েই৷’

মাধুর্য মাথা নীচু করে সম্মতি দিতেই আবেশ আবারো গভীর চুম্বনে লিপ্ত করলো মাধুর্যের কপাল৷ এ যে স্বর্গীয় এক অনুভূতি৷ যা ভাষায় প্রকাশ করা দায়৷

_______________

সমস্ত ফর্মালিটি শেষে আবেশ এসে দাঁড়ালো মাধুর্যের সম্মুখে৷ ফর্সা মুখ লালাভ বর্ণ ধারণ করেছে মাধুর্যের৷ বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে উঠছে বারেবারে ৷ হোস্টেলের বাইরে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে তারা৷ কিছুটা দূরের রাস্তা থেকে গাড়ির শোরগোল ভেসে আসছে৷ এতো হট্টগোল মাধুর্যের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা৷ ভয়ে গুটিয়ে আছে সে৷ আবেশ বুঝতে পেরে বলল,

‘ ভয় পাচ্ছো কেন!’

‘ আমি থাকতে পারবো না আবেশ৷’

‘ পারতে তোমাকে হবেই মাধবীলতা৷’

আবেশের কন্ঠস্বর কম্পয়মান৷ সে নিজেকে সামলে মাধুর্যের মাথায় হাত রেখে বলল,

‘ ৪০৪ নাম্বার রুমটা তোমার৷ যেখানে তুমি তোমার মতো সব গুছিয়ে নিবে৷ আর সিলেটের বাড়িতে তোমার রুমটা আমাদের ৷ আর কিছুদিন এরপরে আমরা মিলে আমাদের হয়ে থাকবো৷’

‘ আপনি আসবেন না আমাকে দেখতে?’ মাধুর্য শ্লেষ মাখা কন্ঠে বলল৷ আবেশ মুখে কিয়ৎ হাসি ফুঁটিয়ে বলল,

‘ মহারাণী যখন হুকুম দিবেন আমি তা তামিলের জন্য হাজির হয়ে যাবো৷’

আবেশের কথার ধরণে হেসে দেয় মাধুর্য৷ আবেশ এইবার প্রশান্তি পায়৷ মাধুর্য ক্রন্দনরত মুখশ্রী যেমন তার হৃদয়ে বেদনার ঝংকার তুলে তেমনি হাসিমাখা মুখ আকাশসম খুশির ফোয়ারা এনে দেয়৷
আবেশ বিদায় নিতেই মাধুর্য আবারো কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে৷ শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের নীচে জমে থাকা পানিটুকু মুছে দৃঢ়তার সাথে নিজমনে বলল,

‘ আমি পারবো৷ আবেশ আপনার জন্য হলেও আমার পারতেই হবে৷ অনেক হিসেব বাকি আছে যে৷’

_____________

দো-তলা বিল্ডিংয়ের সাদা রঙ কিছুটা জীর্ণ৷ সিড়ি দিয়ে উঠেই ডান পাশে লম্বা করিডোর ধরে এগিয়ে যেতেই ৪০৪ নাম্বার রুমটা নজরে আসে মাধুর্যের৷ কিছুটা ভয় আর উত্তেজনা সম্মেলনে এগিয়ে চলেছে সে৷
আশেপাশের মেয়েরা নিজেদের কাজে ব্যস্ত৷ তার দিকে ঘুরে তাকানোর সময়টা কারো নেই বোধহয়৷ মাধুর্য লম্বা শ্বাস টেনে রুমের দিকে এগিয়ে যায়৷ তার স্বপ্ন পূরণের দ্বিতীয় ধাপ ৷
প্রথম ধাপ ছিলো এডমিশন৷ সেইসব দিনের কথা মনে পড়লে সুখ অনুভব হয় তার৷ আবেশ নিজের অফিস সামলে তাকে পড়াতো নিজে বসে থেকে৷ কতো রাত জাগার সৃতি সেই সাথে দুষ্টুমির বহিঃপ্রকাশ ৷
সেসব যেন একঝাঁক উড়ো সুখ৷ মাধুর্যের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে বাজখাঁই প্রশ্নের মুখে পড়ে৷

‘ নতুন? ‘

সামনে থাকা একটা মেয়ে তাকে দেখে কিছুটা ধমকের সুরেই বলল কথাটা৷ মাধুর্য ছিটকে উঠে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো৷ মেয়েটা আবারো ধমকে উঠে বলল,

‘ ওই তুই কী বোবা? না মুখ সেলাই৷ বেয়াদবি করিস আমার সাথে? জানিস আমি কে!’

মাধুর্য চোখ তুলে তাকিয়ে বারদুয়েক মাথা হেলিয়ে ছোট করে উত্তর দিলো ৷ মেয়েটার চোখেমুখে অসন্তুষ্টির ছাপ ৷ বিশ্রী একটা গালী দিয়ে আবার বলল,

‘ যা জিগ্যেস করব মুখ খুলে কথা বলবি৷ না হলে মর্গে নিয়া আটকায় রাইখা আসবো৷’

মাধুর্য ভয় পেয়ে সামনের দিকে পা বাড়াতেই মেয়েটা ইচ্ছাকৃত ভাবে মাধুর্যকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় ৷ মেঝেতে পড়ে গিয়ে ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলেই আশেপাশের দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েরা উচ্চস্বরে হেসে উঠে৷ মাধুর্য ব্যথা সহীত অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অচেনা সব মুখের দিকে৷ এইদিকে তার হাত ফেঁটে রক্ত বের হচ্ছে ৷ আবারো নরক যন্ত্রণা তার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে সে খুব ভালো ভাবেই উপলব্ধি করলো….
চলবে….