ভেতরে বাহিরে পর্ব-৩৯ এবং শেষ পর্ব

0
1792

# ভেতরে_বাহিরে
পর্বঃ৩৯
লেখিকাঃ #রুবাইদা_হৃদি

নাবিহার প্রত্যেকটা তীরের ন্যায় আঘাত হানলো উপস্থিত প্রত্যেক মানুষের হৃদ গহীনে৷ আবেশ উচ্চবাচ্য করলো, ‘ যা বলছো ঠান্ডা মাথায় বলছো তো আপু৷’

‘ মাথা গরমের কোনো প্রশ্ন বা কথা এখানে উঠে নি আবেশ৷ আমি সজ্ঞানে সব বলছি৷’

নাবিহা ভিজে উঠা চোখদুটো মুছে নির্মল হাসলো৷ মাধুর্য উঠে দাঁড়ানোর শক্তি যেন খুইয়েছে৷ ভীতিকর পরিবেশ যেন আঁকড়ে ধরে আছে সর্বকোণ৷ অস্ফুটস্বরে মাধুর্য বলল,

‘ আপ..ন.. আপন তো আপনজন’ই হয়৷’

‘ কিছু আপনজন নিজের স্বার্থের জন্য নিকৃষ্ট হতেও দ্বীধাবোদ করে না বোন৷ যেমন আবেশ এহসানের বাবা৷’

নাবিহা আবেশের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল৷ মাহমুদ নাবিহাকে মৃদু শাসিয়ে বলল,

‘ উল্টাপাল্টা বকছো কেন তুমি৷’

‘ মাহমুদ আর কেউ জানুক আর না জানুক তুমি নিশ্চয়ই জানো আমি সব সময় সঠিক টা বলি৷’

আবেশের মুখমণ্ডল রক্তিম হয়ে উঠলো৷ সে তার বাবাকে আদর্শ মানে৷ তার জানামতে তার বাবা এতোটা নিম্ন কাজ জীবনে করবে না৷ সে রাগ মিশ্রিত সুরেই নাবিহার দিকে প্রশ্নবাণ ছুড়লো,

‘ এই ধরণের কথা কোন লজিকে বলছো তুমি আপু৷ কি প্রমাণ আছে তোমার কাছে! ভুলে যেয়ো না উনি তোমার পালক পিতা৷ যথেষ্ট করেছেন তোমার জন্য৷’

‘ আবেশ তুমি বিচক্ষণ মানুষ৷’ নাবিহার নম্র কন্ঠ৷ আবেশ দমে গেলো মুহূর্তেই৷ নাবিহা আবার বলল,

‘ কখনো ভেবেছো! তোমার বাবার সম্পত্তির উৎস কোথা থেকে শুরু হয়েছে৷’

‘ বাবা নিজের পরিশ্রমে সবটা দাঁড় করিয়েছে৷’

‘ ভুল জানো তোমরা৷ সবটা ভুল৷ মিসেস মাহফুজা এহসান নিজেও জানেন এইসব কিছু তার বোন নামক মেহরুনের সম্পদ৷’

উপস্থিত সবাই চরম অবাক হলো। মাধুর্য বিমূর্ত হয়ে দাঁড়িয়েই আছে।
আবেশ অসন্তোষ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে নাবিহাকে। মাহমুদ ও একই ভাবে তাকিয়ে আছে। সবার অসন্তোষ দৃষ্টি দেখে নাবিহা ভেতরের রুমে চলে যায়। আবেশ মাহমুদ কে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘ আপু পাগল হয়ে গিয়েছে দুলাভাই।’

মাহমুদ প্রত্যুত্তর করলো না। মাধুর্য আবেশের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার পূর্বেই নাবিহা এসে দাঁড়ায়। হাতে তার ফোন। কোনো কথা না বলেই ডায়াল করে নজরুল এহসানের নাম্বারে।
মাহমুদ জিগ্যেস করলো,’ কাকে ফোন…’
এর পূর্বেই নাবিহা হাতের ইশারায় তাকে কথা বলতে বারণ করে। আবেশের ধৈর্যের বাধ ভাঙ্গছে। এইসব তার সহ্য সীমার বাইরে অবর্তন করছে এখন। তবুও মাহমুদের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে আছে। আর সমস্ত সমীকরণ মাধুর্যের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
নাবিহার ফোন নজরুল উঠাতেই নাবিহা ফোন স্পিকারে দিয়ে ভদ্রতার সহীত সালাম দেয়। নজরুল সালামের উত্তর দিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘ এতো সকালে
ফোন দেওয়ার কারণ।’

‘ আমি আমার সমস্ত কথা রেখে অনুশোচনায় ভুগছি। আপনার পাপের বোঝা আমার ঘাড়ে আমি আর বইতে পারবো না।’

‘ এইগুলা বলতে ফোন দিয়েও তোমার লাভ নেই নাবিহা।’ নজরুল সাহেবের ঠান্ডা কন্ঠ।
সবাই রুদ্ধশ্বাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষীণ উত্তেজনা সবার মাঝে বিরজয়মান।

‘ যদি আমি সব সত্যি আপনার ছেলেদের আর মেয়েকে বলে দেই তবে।’ নাবিহা বললো। নজরুল সাহেব হাসলেন। সে ফিসফিস করে বলল,

‘ কি বলবি তুই।’

‘ সবটা বলবো। আপনি মেহরুনকে খুন করিয়েছেন,তার স্বামীকে খুন করিয়েছেন,লতা বেগমের জীবন নষ্ট করেছেন লাস্ট তাকেও খুন করিয়েছেন। গোটা পরিবার ধ্বংস করেছেন শুধুমাত্র সম্পত্তির জন্য। আর মাধুর্য আপনার মেয়ে নাজিফার মতো তাকেও ছাড় দেন নি। তার সম্পর্কে ভুল বুঝিয়েছে নির্যাতন করিয়েছেন। রাব্বীর মতো ভালো ছেলেটাকে নষ্ট করে দিয়েছেন। বলেন করেন নি এইসব ! কেন এতো লোভ আপনার।’

নজরুল উচ্চস্বরে হাসলেন। তার হাসির শব্দে সবাই কেমন কেঁপে উঠলো। মাধুর্য আবেশের হাত খাঁমচে ধরে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। আবেশ তারদিকে আড়চোখে তাকিয়ে রইলো। নজরুল সাহেব হাসতে হাসতেই বললেন,

‘ আমার প্রাপ্য ছিলো এইগুলা তাই আমি পেয়েছি। সেটা খুন করেই হোক বা ছিনিয়ে নিয়ে। আমি আর আমার পরিবার ভালো আছি এইটাই বড় আমার কাছে। আর তোর মনে আছে তো! তুই মুখ খুললেই মাহমুদকে হারাবি।’

‘ হারানোর ভয় এখন আমার আর হচ্ছে না।’

নাবিহার কথা শুনে আবার হাসলো সে। কিছুটা গম্ভীর কন্ঠেই বলল,

‘ মেয়েকে দেখে রাখিস।’

নাবিহা সেই কথার প্রত্যুত্তর না করে প্রশ্ন করলো,

‘ আপনি বাহিরে যতোটা ভালো ভেতরে এতো নিকৃষ্ট কেন।’

‘ তোর কাছে যদি অঢেল সম্পত্তি থাকতো তবে বুঝতি। আমার কতো সাধনার ফল এই সম্পদ,এই সম্মান।’

‘ সব তো আমার মায়ের। যাকে আপনি আমার সামনে খুন করেছিলেন সিলেট থেকে তাকে তার বাসায় দেওয়ার সময়।’

নজরুল সাহেব কিছুটা দম নিলেন। শান্ত স্বরে বলল,

‘ মেহরুনের প্রচন্ড দেমাগ ছিলো। ও আমাকে কথা দিয়ে কথা রাখে নি। আমি ওর ভাই হই সেটা ভুলে ও সমস্ত সম্পদ ওর স্বামীর নামে করতে চেয়েছিলো। এতোই সহজ সব। বেইমানি করেছে তাই বেইমানীর ফল পেয়েছে।’

‘ তারমানে আপনি স্বীকার করছেন এই সমস্ত খুন আপনি করেছেন।’

‘ আরো দুইটা করবো। একটা মাহফুজার আরেকটা রাব্বীর কারণ দুই হারামি আমার করা সম্পদ খেয়ে আমার পেছনে বেইমানি করেছে।’

আবেশ বিমূর্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই সমস্তের ভেতরে এতো নিকৃষ্টতা সে বুঝতেই পারে নি। আর তার আদর্শ তার বাবাই এইসবের ভেতরে ভাবতেই নিজেকে অপরাধী লাগছে। মাধুর্য আবেশের হাত ধরেই নিস্তব্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সে যাকে নিজের বাবার আসনে বসিয়েছিলো সে এমন হবে কল্পনাতেও ভাবে নি সে। মাহমুদ নাবিহার কাছে এগিয়ে গেলো। নাবিহা ইতিমধ্যে কল কেটে আবেশের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বলল,

‘ আরো হাজার কল রেকর্ড আছে তুমি শুনে নিতে পারো।’

‘ তুমি সব জানতে !’

‘ মায়ের সাথে যখন ঝগড়া হয়েছিলো আমি তখন তেরো বছরের। আমার সামনেই সমস্ত সম্পদ চান উনি মা অস্বীকার করলেই উচ্চবাচ্য করেন তোমার বাবা। মা রেগে পুলিশের কাছে যেতে চাইলেই আমার সামনে আমার মাকে খুন করান। আর জানো আমাকে পেটে আঘাত করে বলেছিলো কাউকে কিছু জানালে পতিতা পল্লিতে বিক্রি করে দিবেন।আমি বড্ড ভীতু,ঘরকোণা স্বভাবের। আশ্রয়ের জন্য তার সমস্ত অপরাধ নিশ্চুপে দেখতে দেখতে বড় হলাম। এরপর মাহমুদ আসার পর তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিতো। ব্যাস আমিও ভয়ে আবারো তার অপরাধ মেনে নিতাম। কে জানতো সমস্ত অপরাধ সে আমার পরিবারের সাথেই করেছে আর করে যাচ্ছে।’

নাবিহার কথা শুনে ঢুকরে কেঁদে উঠলো মাধুর্য। তার জীবনের সমীকরণ এমন কেন ! সব পেয়ে বারবার হারায় সে।
নাবিহা মাধুর্যকে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘ আমি আর ভয় পাবো না। আমি এর বাইরে টা দেখতে চাই। তোর আমি আছি মাধু।সব ঠিক করে নিবো আমরা।’

__________________

রাতের আধার যখন ভোরের আলো ছুঁয়ে ধরণীকে নতুন রুপে সজ্জিত করে তখনি নব্য দিনের সূচনা হয়। সেই সূচনা দীর্ঘ। তবে স্মৃতির পাতা যেন বলে বেড়ায় কাহিনীটা কিছু মুহূর্ত আগের । যন্ত্রণা গুলো জীবিত। শরৎ আর মেঘমালা শাই শাই করে নীলাভ আকাশে বিচরণ করছে। ধূলিশায়ী এই ধরণীর বুকে কতো নাটকীয় কাহিনী বিদ্যমান। এরপর.. এরপর কী হবে জানার আগ্রহে সবাই যখন বিমুখ হয়ে বসে থাকে তখনি যেন কাহিনীর ইতি ঘটে। সূচনা হয় আরেকটা দীর্ঘ কাহিনীর।
দূর আকাশে আজ মেঘ রাশি নিজস্বতা ছড়াচ্ছে। সরু সূর্যের কিরণ ।
আট বছরের মেয়েটা মায়ের কোলে বসে বলল,

‘ এরপর সেই পঁচা লোকটার কি হয়েছিলো আম্মু।’

‘ তারপর সেই লোকটার মস্ত বড় শাস্তি হয়েছিলো। ফাঁসি হয়েছিলো।’

ছোট নিয়ানা পিটপিট চোখে তার বাবার দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে বলল,

‘ আমরা ওই রাজবাড়িতেই যাচ্ছি বাবা ?’

নিয়ানার প্রশ্ন শুনে তার বাবা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। গাড়ি চালাতে চালাতে জবাব দিলো। নিয়ানা মায়ের কোলে বসেই আবারো বলল,

‘ সবাই কি এরপর সুখে শান্তিতে ছিলো মাম্মাম?’

‘ মোটেও না। নজরুল সাহেবের সমস্ত পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সবাই ওই এহসান বাড়ি ছেড়ে পাড়ি জমায় অন্যান্য জায়গায়। রয়ে যায় শুধু মাহফুজা। সে এখনো সেই এহসান বাড়িতে আছেন।’

নিয়ানা বিচক্ষণতার সাথে প্রশ্ন করলো,’ আমি নিয়ানা এহসান ডটার অফ আবেশ এহসান। তবে কি সেই এহসান বাড়িটা আমাদের মাম্মাম?’

মাধুর্য মেয়ের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। হ্যাঁ সেটা সেই অভিশপ্ত এহসান বাড়ি। আজ বারো বছর পরেও সেই সব কলুষিত দিনের স্মৃতি গুলো চোখে স্পষ্ট ।আবেশ পাশে থেকে একহাতে মেয়ে আর বউকে জড়িয়ে নিয়ে সূক্ষ্ম হেসে বলল, ‘ তোমাদের আমি আছি।’

মাধুর্যের নয়নে পানি টলমল করলেও অধরে কিয়ৎ হাসির রেখা। সে আজ সফল সাইকোলিজস্ট। মেহরীন এইবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিবে। আর ইরা ফয়েজ সদূর অস্ট্রেলিয়াতে পারি জমিয়েছে আরো বছর পাঁচেক পূর্বে।
নাজিফা হায়ার স্টাডি করার জন্য কানাডা গিয়ে আর ফেরত আসে নি। সবার সাথে সমস্ত অভিযোগ যেন তার। সে কখনো মানতে পারে না তার বাবা এতো জঘন্য কাজ করতে পারে।
রাব্বীও যেন কোথায় হাসিয়ে গেছে। সময়ের পাতা উল্টালে হাজারো হাসি মুখ ভেঁসে উঠে। যাদের ভেতর বাহির সমস্ত ধোঁয়াটে ছিলো।
কে বলবে তার ভেতরে তো রয়েছে কতোকিছু। আজকে শেষ আরেকটা খুন হবে। আর সেটা মাহফুজা বেগমের। দুনিয়ার সবাই না জানুক সে জানে,মাহফুজা সমস্ত কিছুর পেছনে ছিলো।
মাধুর্যের ভেতর দহনে পুড়ছে আর বাইরে সুমিষ্ট হাসি। ওইতো সামনেই মাহফুজা এহসান বাড়ির সদরে দাঁড়িয়ে আছে।
মাধুর্য আবেশের হাতের উপর হাত রেখে বলল,’আপনার ভেতরে বাহিরে সবটা জুড়ে আমি আছি তাই না আবেশ?’

আবেশ গাড়ি থামিয়ে প্রথমে নিয়ানার কঁপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে মাধুর্যের কঁপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,

‘ সব সময়। আমার সবটা জুড়ে তোমরা আছো।’

মাধুর্য হাসলো। তবে তার ভেতর এমন প্রতিহিংসার আগুন কেন জ্বলছে। তার ভেতর বাহির কেন অন্যরুপ নিচ্ছে। কোনো ব্যাখ্যা নেই তার কাছে। শুধু সে জানে পাপীদের দুনিয়ায় থাকতে নেই।

সমাপ্ত